অস্ফুট মঞ্জরী - বিদিশা মুখার্জি

 

অস্ফুট মঞ্জরী

বিদিশা মুখার্জি



  (১)

আজ ৩৫তম দিন,আমি মায়ের গর্ভে বাসা বেঁধেছি। এখনও মা আমার আগমনবার্তা সুনিশ্চিতভাবে জানেন না। তবে সকালে উঠে গা-গুলানো ভাব,সবসময় খাবার খেতে অনীহা দেখে আঁচ করেছেন শরীরের বেগতিক অবস্থা। আমি কিন্তু এই অন্ধকার গহ্বরেও বেশ নিশ্চিন্তবোধ করছি,মাতৃজঠর তো সবথেকে নিরাপদস্থান। দুনিয়ার আর কোথাও এমন সুন্দর নয় এই ঘন আঁধার। আজ মা যেন কাকে বললেন

 ''শুভ,মে বি সামথিং রঙ উইথ মি।"

 আমি এখনও জানিনা কে এই শুভ,তবে নিশ্চয় মায়ের খুব আপনজন কেউ হবে,তা না হলে মা নিজের শরীরের খবর ওনাকেই  বা কেন দিচ্ছেন? মনে হচ্ছে উনিই আমার বাবা। আমার এখন খুব ইচ্ছে করছে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে।

 (২)

আজ এই ফ্ল‍্যাটের বউটি আমাকে নার্সারি থেকে এনে ওদের ব‍্যালকনিতে রাখা টবে বসিয়েছে। খুব মিষ্টি দেখতে বউটি,সবথেকে যা ওর বেশি আকর্ষণীয় তা হলো ওর গঠনসৌষ্ঠব,দেখলেই মায়ের প্রতিমূর্তি মনে হয়। আমাকে টবের মাটিতে রোপন করে যখন শিকড়ের গোঁড়ায় জল দিচ্ছিলো তার চোখে মুখে এক অপূর্ব স্নেহমাখা আলো খেলা করছিল ,এই আলো সন্তানকে প্রথম কোলে নেওয়ার পর মায়ের চোখেমুখে ফুটে ওঠে। আমি এই টবে আশ্রয় পেয়ে আর মেয়েটির সযত্নস্পর্শ পেয়ে বেশ নিশ্চিন্তবোধ করছি।আমার বুকে লুকিয়ে থাকা কুঁড়ি এবার তার পাপড়ি মেলতে পারবে বউটির সযত্ন লালনে। 

 

 (৩)

আজ মা জানতে পেরেছেন তাঁর শরীরে আমার আবির্ভাব। জানার পরেই আনন্দঘন সুরে সেই নামের ব‍্যক্তিকে ফোন করে বললেন,

 

"শুভ,আমাদের প্রথম সন্তান আসছে জানো!"

আমি এখন নিশ্চিত ওপারের ব‍্যক্তি আমার বাবা, কিন্তু মায়ের উদ্বিগ্ন গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে বাবা হয়তো আমার আসাটা পছন্দ করেননি। মাকে বলতে শুনলাম-

   "শুভ,আমাদের বিয়ে একবছর হয়ে গেছে। এখন তোমার উন্নতিও তো ভালোই হয়েছে । জীবনে এগিয়ে চলার শেষ নেই, তা'বলে প্রথম সন্তানকে বলি দেবো!"

    ওদিকের কথা শুনতে পেলাম না,তবে মায়ের ভাঙাগলায় শুনলাম-

"দিস ইজ নট ফেয়ার,শুভ। ঠিক আছে তুমি বাড়ি এসো,তারপর কথা হবে।"

তারপর দীর্ঘক্ষণ মায়ের কান্নার শব্দ পেলাম, মন খারাপ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম না ,আমার এই আসাটা বাবার কেনো যে এত অপছন্দ, আমি নিজের ইচ্ছেয় তো আসিনি।

 (৪)

 

এই ক'দিনে এই ব‍্যালকনির টবে থেকেই এদের সংসারটা আমি মোটামুটি বুঝতে পারছি। যে মেয়েটি আমাকে এখানে এনেছে সে এবাড়ির বউ। মেয়েটি সংসারকে খুব ভালোবাসে,  তার সংসার যেন ভালোবাসায় মোড়া থাকে এই প্রচেষ্টা থাকে তার। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী আর চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক নিয়েই তার ঘরকন্না। প্রত‍্যেকের প্রতি এতটাই নজর তার যে কাজের মেয়েটিকেও দেখি তার প্রতি অনুরক্ত। ব‍্যালকনিতে রাখা প্রতিটি গাছকে সন্তান স্নেহে যেমন যত্ন করে ,তেমনই ব‍্যালকনিতে উড়ে এসে বসা পাখিদের জন্য জল বা খাবার ও সে তার বাঁধাধরা রুটিন করেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে বউটির চলাফেরায় যেন কেমন শ্লথ-ক্লান্তভাব। মনে হয় ওর মধ‍্যেও আমারই মত আগামীর কুঁড়ি বাসা বেঁধেছে। আমার কুঁড়ির মত সেই কুঁড়িও নিশ্চয় প্রস্ফুটিত হওয়ার আশায় উন্মুখ।

  (৫)

 আজ বাবা-মায়ের প্রচন্ড ঝগড়া শুনে ভয় পাচ্ছি। কাল বাবা ,মা'কে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চান। মা কান্নাকাটি করে শুধু ই অনুনয় করে বলছেন, তার জীবনের প্রথম কলিকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না তিনি। হঠাৎ আমার প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগলো,টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছি,আমার সমস্ত বাতাস কে যেন কেড়ে নিলো,আমি প্রবল জলের তোড়ে কোনো দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবল চেষ্টা করছি। মায়ের গোঙানি শোনার ক্ষমতা হারালাম আমি।

(৬)

 

কাল রাতের প্রবল ঝড়ে আমার ডালপালা ভেঙে আমাকে নিঃস্ব করেছে, আমার ছোট্ট কলিকে বুক থেকে ছিঁড়ে ঐ টবের নীচে ছুঁড়ে ফেলেছে। সকালের এই রৌদ্রকিরণে রাতের ঝড়ের তান্ডবকে দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।  আমার মতই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে এদের বউটিকে, সবাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। পাশের বাড়ির মহিলাকে কাজের মেয়েটি দুঃখ করে বলছিলো শুনলাম-

 "বড়লোকদের ঘরের ব‍্যাপার গো,নইলে নিজের পোয়াতি বউকে ঠেলে ফেলে নিজের সন্তানকে নিজে মেরে ফেলে একথা কেউ শুনেছে কখনও!"

 কথাগুলো শুনে মনে হলো, শুধু প্রকৃতির বুকেই ঝড়ের তান্ডব হয় না,বন্ধ দরজার ভিতরেও ঝড়ের প্রতাপ প্রবল"।

 ...............................................

 

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি 


 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by