গৌতম সাহা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গৌতম সাহা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

নায়কী কানাড়া - গৌতম সাহা

 


নায়কী কানাড়া  
গৌতম সাহা
 

       বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক চটকলের অফিসে সামান্য চাকুরে সুধীরবাবু। অজাতশত্রু, ভালো মানুষ বলেই চেনে তাকে মানুষজন। আসাধারণ মেধা সম্পন্ন না হলেও পড়াশোনায় আর পাঁচটা ছাত্রদের থেকে খুব একটা পিছিয়েও ছিলেন না তিনি। সেই মাঝারিয়ানার সুবাদেই কলেজের গণ্ডি পেরিয়েই পাড়াতুতো কাকার সামান্য সুপারিশে পাওয়া এই চাকরি। স্ত্রী গৌরী প্রকৃত অর্থেই দেবী দুর্গার মতন। যেমন তার রূপ, তেমনি তার স্বভাব। অসম্ভব সুপুরুষ সুধীরবাবু যখন কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী গৌরীকে নিয়ে যান মানুষজন এই জুটিকে প্রশংসা না করে পারেন না। গৌরীও তার স্বামীকে নিয়ে গর্বিত। সুধীরবাবু যে শিল্পী। ছাত্রাবস্থাতেই কি করে যেন তার মাথায় গানের ভূত চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। অথচ এই বংশে গানের চর্চা যে তেমন ছিল তা নয়। সুধীরবাবু যে কী করে এই পথে চলে এলেন তা সবার কাছেই আশ্চর্যের। শুধু চলে এলেন না, নিজ অধ্যাবসায়ে, একনিষ্ঠ সাধনায় কিভাবে নিজেকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেটা সত্যিই কল্পকাহিনীর মতন।
ফুলশয্যার দিন নতুন বউকে কাছে নিয়ে সুধীরবাবু আর কী কী বলেছিলেন তা মনে করতে না পারলেও একটা কথা কোনদিন ভুলবেন না গৌরী।
-“তোমার এক সতীন আছে জানো তো?’’ অবাক বিস্ময়ে নতুন বউ এর লজ্জা আর দ্বিধা নিয়ে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন গৌরী। সেই সংশয় মাখা অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন সুধীরবাবু। হাত ধরে নববধূকে খাট থেকে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “চল, তোমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।’’ বলে হাত ধরে তাকে নিয়ে এসেছিলেন পাশের ঘরে। ঘরের কোণায় রাখা বিশাল আকৃতির এক তানপুরার সামনে দাঁড় করিয়ে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী কে বলেছিলেন সুধীরবাবু, “এই তোমার সতীন, নাও বন্ধুত্ব করে নাও।’’
 
      এই ব্যাপার! বাপরে বাপ, বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একেবারে! উনি যে শিল্পী, গান যে ওনার প্রাণ, এ তো জানে গৌরী। এলাকার মানুষজন সবাই চেনে ওকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা গায়ক হিসাবে। গৌরী তো বিয়ের সম্বন্ধের সময়েই জানে তা। তাও এমনভাবে ভয় দেখাতে হয়! রাগই হয়ে যায় গৌরীর একটু। কিন্তু নতুন বউ এর কি আর রাগ দেখানো সাজে! মুখে তাই রাগের ভাব না এনে মৃদু স্বরে বলে ওঠেন গৌরী, “আমি জানি, গান আপনার সবকিছু, সবাই আপনাকে আপনার গানের জন্য শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।’’
-“তুমিও নিশ্চয়ই চাইবে যে তোমার স্বামীকে সবাই এইভাবে শ্রদ্ধা করুক, সম্মান করুক।’’
 
      বুঝেছিলেন গৌরী। হাজার হোক, তিনিও অভিজাত পরিবারের কন্যা। কোন কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী তা বোঝার শিক্ষা তার আছে, বোধও। মুখ নিচু করেই আশ্বস্ত করেছিলেন তার স্বামীকে, “আমি আপনার সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। আপনি আগের মতই আপনার সাধনা নিয়ে থাকবেন, আমার জন্য কখনো আপনার এই সাধনায় বিঘ্ন ঘটবে না, আমি কথা দিলাম।’’
সংগীত অন্ত প্রাণ এক শিল্পীর কাছে তার স্ত্রী’র থেকে ফুলশয্যার দিনেই এর থেকে বেশী প্রাপ্তি কী থাকতে পারে! আপ্লুত হয়েছিলেন সুধীরবাবু। প্রথমদিনের সেই প্রাণে মধু ঢেলে দেওয়া আশ্বাস, তার পরে প্রকৃত অর্থেই তার সংসারকে মা দুর্গার মত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার সাধনার উৎকৃষ্ট বাতাবরণ প্রস্তুত করে দেওয়া- ভীষণরকম ভাবে ভালোবেসে ফেললেন তিনি তার স্ত্রী’কে। বছর ঘুরতেই গৌরীদেবীর কোল জুড়ে জন্ম নিল তাদের প্রথম পুত্র সন্তান। ভালোবেসে গৌরী তার নাম রাখলেন রামানুজ।
 
*******
 
       সুধীরবাবুর খ্যাতি তার বিবাহের পরে বেড়েই চলেছে। মফস্বলের একটু নামকরা যে কোন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে সুধীরবাবুর উপস্থিতি, সংগীত পরিবেশনা সেই আসরে অন্য মাত্রা যোগ করে। এই তল্লাটে তার সমকক্ষ শিল্পী খুব কমই আছে, এই নিয়ে শ্রোতৃমহলে কোন দ্বিমত নেই। অথচ কলকাতার শিল্পী মহলে তার বিশেষ কোন নাম নেই, পরিচিতিও। কারণ অবশ্য একটা আছে। সুধীরবাবু মূলত যার কাছে সংগীত শিক্ষা করেছেন সেই পন্ডিত দীনকর রাও এর সঙ্গে কলকাতার নামজাদা সকল শিল্পীরই এক অঘোষিত বৈরীতা আছে। কেন, তা অবশ্য জানেন না সুধীরবাবু। অনেকেই মনে করেন যে দীনকর রাওয়ের সাথে তারই গুরুভাই তথা কলকাতা সংগীত সমাজের পুরোধা শিল্পী কুলদারঞ্জন বাবুর এক ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণই দীনকর রাওকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। জানেন না ঠিক সুধীরবাবু। তবুও দীনকর রাও কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার পর তাঁরই গুরুভাই এর কাছে তালিম পাবার জন্য, তাঁর সান্নিধ্যে আসার জন্য এক বিশিষ্ট শুভানুধ্যায়ীর অনুরোধে তার সঙ্গেই কুলদারঞ্জন বাবুর কাছে গিয়েছিলেন সুধীর।
কলকাতার শিল্পীদের স্বভাবসুলভ তাচ্ছিল্যভরা ভঙ্গীতে করা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন সুধীর।
- “কার কাছে শেখা হয়েছে?’’
-“আজ্ঞে, পন্ডিত দীনকর রাও....।’’
-“ওহ, দীন-কর! তা বেশ। কী গাওয়া হয়? খেয়াল? নাকি দীনকর এর মতন ঠুংরি? হা হা হা হা।’’
 
       তাচ্ছিল্যভরা অট্টহাসিতে ভেসে গিয়েছিল বালিগঞ্জের সুবিশাল সেই বাড়ি। ভালো লাগেনি সুধীরবাবুর। হাজার হোক গুরুনিন্দা শুনে, গুরুর প্রতি অবহেলা দেখে তাঁর কাছে নতুন করে শেখার কিংবা শিক্ষার জন্য তদবির করতে মন সায় দেয়নি আর। আর কারো অনুরোধে তার শিল্পী সত্তাকে পদদলিত করে কখনো কলকাতায় যাননি তিনি। গানের ঘরোয়া আসরে ক্কচিৎ কদাচিৎ আমন্ত্রণ পেয়েছেন, গেছেন, গান গেয়ে মাত করে এসেছেন, কিন্তু অনুষ্ঠানের তদবির করতে কিংবা কারও কৃপা পেতে কলকাতা মুখো হননি তিনি। যা তিনি তার গুণ্মুগ্ধদের থেকে পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট। পাশাপাশি তিনি এটাও জানতেন যে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, আরো শিখতে পারলে ভালো হতো। মনে হতো আরো কোথায় শিখতে পারা যায়! কন্ঠসংগীতের আরো জটিল পথগুলোতে আলোকপাত কে করবে? কে দেখাবে আলো, কে চেনাবে পথ? কলকাতায় তো তার উপায় নেই, তাহলে তো কলকাতা ছাড়তে হয়! কিন্তু তার উপায় কোথায়? স্ত্রী, পুত্র, সংসার, চাকরী ফেলে তো আর অনির্দিষ্টের পথে পা বাড়ানো যায়না। সর্বোপরি, গৌরীকে ছেড়ে থাকবার কথা তিনি যে ভাবতেই পারেন না। তাই মনে ক্ষুধা থাকলেও যা পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন সুধীরবাবু।
 
*******
 
       কিন্তু শোভা কিছুতেই ছাড়বে না। এই আর একজন অদ্ভুত মেয়ে শোভা। টিটাগড় এর কেল্ভিনশন জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজারের স্ত্রী। নিজে ডাকসাইটে গাইয়ে। সবাই বলে তার গান চোখ বুজে শুনলে আখতারী বাঈ গাইছে না শোভা গাইছে এটা আলাদা করা যায়না। টালিগঞ্জের নামকরা ফিল্ম ডিরেকটরেরা অবধি শোভা গাঙ্গুলীকে দিয়ে কোনো গান গাইয়ে নিতে পারলে বর্ত্তে যান। কিন্তু সে গাইবে না। রেডিওর বি হাই আরটিস্ট সে। মুড নেই তো প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেওয়া তার কাছে কোন ব্যাপারই না। নিজে পারিবারিকভাবে রাজবাড়ির মেয়ে হওয়ায় রাজকীয় স্বভাব তার চলনে, বলনে কথাবার্তায়, আচার আচরণে। কাউকে সে পাত্তা দেয়না।
এহেন শোভা কিন্তু সুধীরবাবুর ভীষণ ফ্যান। একদিন তার বাড়ির এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সুধীরবাবু গাইলেন কৌশী কানাড়া। বড় প্রিয় রাগ তার এই কৌশী কানাড়া। বস্তুত যেকোন কানাড়া অঙ্গের রাগই তার প্রিয়। তার গুণমুগ্ধরা বলে, ‘কানাড়ার রূপ আপনার গলায় আরো বেশি খোলে’।
গঙ্গার ধারের সেই বিলাসবহুল বাংলোর প্রতিটা কোণ দিয়ে যেন ঝরে পড়ছিল কৌশী কানাড়ার অপূর্ব সুর।
"রাজন কে শিরতাজ"
প্রেম বিরহের অদ্ভুত মেলবন্ধনে কৌশী কানাড়ার সুর আর গঙ্গার দিক থেকে মৃদু মন্দ ভেসে আসা শীতল বাতাস কী যে স্বর্গীয় বাতাবরণ তৈরী করেছিল তা একমাত্র সংগীতের ঈশ্বরই জানেন। মাঝ খামাজে ঠুংরী গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন সুধীরবাবু।
সবার শেষে গাইবার কথা শোভা দেবীর। তিনিই এই অনুষ্ঠানের আয়োজক, উদ্যোক্তা, তিনিই শেষ শিল্পী। কিন্তু শোভা নিজে বেঁকে বসলেন। বললেন, “সুধীরদা’র এই গানের পরে আজ আমি আর গাইতে পারবো না।’’
শোভার এই রাজরাণীর মতন স্বভাব ও মেজাজ সম্বন্ধে সবাই ওয়াকিবহাল। কারো সাহস হলো না আর কিছু অনুরোধের। সময়ের আগেই এলাহি রাত্রিকালীন ভোজনের সূচনা করা হল। সবাই যখন ওই রাজকীয় ভোজনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত, হাতে পানীয়ের গ্লাস নিয়ে সুধীরকে গঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন শোভা। গঙ্গার দিকে মুখ করে রাখা লোহার বেঞ্চে বসে সুধীরের একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে ঈষৎ জড়ানো গলায় বললেন তিনি, “তোমাকে যদি এই জগতের কাছে বিখ্যাত না করে যাই সুধীর’দা, আমার নাম তবে শোভা গাঙ্গুলী নয়। সারা দেশের মানুষের কাছে তোমার নাম আমি পরিচিত করে যাবো।’’
ভয় পেলেন সুধীর। তিনি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। বড়লোকের মতিগতি তিনি বোঝেন না, তাদের কথার অর্থও। দ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। কী বলবেন এই অপূর্ব মোহময়ী নারীর কথার উত্তরে! বোঝেন না সুধীর, চুপ করে থাকেন।
 
*****
 
       ফ্যাক্টরী থেকে সবে ফিরেছেন সুধীর। গোধূলির আলো মেখে গেটের বাইরে ছাই রঙা বিরাট একটা কন্টেসা এসে দাঁড়ালো। ঊর্দি পরা ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সুধীরের হাতে একটা চিরকূট ধরিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুই বুঝতে পারলেন না সুধীর, শুধু পড়লেন, ‘তানপুরাটা শুধু সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
শোভার হুকুম। ইতস্তত করেন সুধীর। গৌরীর সাথে শোভাকে নিয়ে বহুবার তার কথা হয়েছে। আজ অবধি গৌরী কোনদিনও সুধীরের কোন মহিলা গুণমুগ্ধা, ছাত্রী কিংবা অতি উৎসাহী মহিলা শ্রোতাকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। তবুও কেমন যেন বাধো বাধো লাগে সুধীরের। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসেন গৌরীই। সমস্ত বিষয়টা যেন চোখের পলকে বুঝে ফেলেন তিনি। আলমারি থেকে পাটভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবী স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে চোখের তারার ইশারায় বুঝিয়ে দেন, “যাও।’’ কৃতজ্ঞতায় মনটা আর্দ্র হয়ে যায় সুধীরের। গৌরীকে কি বলবেন ভেবে পাননা তিনি, শুধু এক মুহূর্তের জন্য তার হাতটা আঁকড়ে ধরেন গভীর ভরসায়।
অন্যদিনের মতন নয় আজ এই গঙ্গার ধারের বিশাল বাংলো। কেমন যেন একটু চুপচাপ, বাইরের পোর্টিকোয় দুটো বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। কী গাড়ি কে জানে! কেউ কি এসেছে? শোভার যা পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান তাতে কোন এস্টেটের মহারাজার পরিবারের লোকের আসাটাও আশ্চর্যের নয়। সুধীরকে তলব কি তাহলে তেমন কোন বিশিষ্ট অতিথিকে গান শোনাবার জন্য? বুঝতে পারেন না সুধীর।
 
       সামনের বিশাল সেগুন কাঠের মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে তানপুরা হাতে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে দৌড়ে এল শোভা। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল গঙ্গার দিকের একটা বড় মাপের ঘরে। ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যান সুধীর। ঘর জুড়েই ফরাশ বিছানো, অথচ কোন শ্রোতা নেই। এক প্রান্তে তাকিয়া শোভিত মঞ্চের আদল! অবাক বিস্ময়ে শোভাকে প্রশ্ন করতে যান সুধীর। মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেন শোভা। ফিসফিস করে বলেন, ‘একজনের সামনে তোমাকে গান গাইতে হবে সুধীর’দা, আমার মান রাখতে হবে আজ। আমি তাঁকে বলিনি এখনও যে এমন একজন শিল্পীর গান শোনাবো তাঁকে যে তিনি চমকে যাবেন।’
কেমন যেন সামান্য নার্ভাস হয়ে যান সুধীর। এমনিতে তার এই দোষ নেই, তানপুরা নিয়ে বসলে তিনি খুব তাড়াতাড়িই আত্মস্থ হয়ে যান। কিন্তু আজ কেন জানি একটু সংশয়েই পড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘কে তিনি?’
-‘তুমি তাড়াতাড়ি তানপুরা বেঁধে নিয়ে গান তো শুরু কর। আমি চাই তোমার গান তাঁকে টেনে নিয়ে আসুক এখানে’।
শোভা’র মুখের চাপা উত্তেজনাও নজর এড়ায় না সধীরবাবুর। ইতিমধ্যেই গুটিগুটি পায়ে কয়েকজন সংগীতপীপাসু পরিচিত, অপরিচিত মানুষজন ঘরে প্রবেশ করেছেন, লক্ষ্য করেন সুধীর। তারাশঙ্কর তার সাথে তবলা সঙ্গত করে। অবাক বিস্ময়ে তবলার ব্যাগ হাতে তাকেও ঘরে ঢুকতে দেখেন সুধীর।
একটা ছোটখাট সংগীত সভার আয়োজন করা হয়েছে চুপিচুপি, হয়ত কিছুটা তড়িঘড়ি করেই, অথচ তার কোন আগাম ফরমান নেই। অবাকই হন সুধীর। বেশ কিছু পরিচিত শ্রোতাদের উপস্থিতিতে আর তিনি নতুন করে ভাবেন না কিছু। প্রশ্ন করেন, “কিছুই তো প্রস্তুতি নেই নি, কী গাই বলো তো?”
-“সেদিনের সেই কৌশী কানাড়াই গাও।” আবদার করে শোভা।
মাটিতে শোয়ানো তানপুরা কোলে তুলে নেন সুধীর। খড়জের তারকে সামান্য মোচড়ে সূক্ষ্ম ভাবে ডি শার্পের সা তে মিলিয়ে নিতে নিতে বলেন, “আজ কৌশী না, নায়কী কানাড়া গাইবো।” শিল্পীর চোখের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত শ্রোতারা বুঝতে পারেন, আত্মস্থ হচ্ছেন সুধীর; সুরের রঙে ভাব মিশিয়ে নায়কী কানাড়াকে প্রতিষ্ঠা করা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অনতিদূরে গঙ্গার পাড়ে রাসমণির ঘাটে তখন সন্ধারতি শেষ হয়েছে। কালো চাদরে মুড়ে রাত্রি নেমেছে গঙ্গার উপরে।
"ক্যায়সে সমঝাউ তনরঙ্গওয়া"
 
        সুরের মোচড়ে উথাল পাথাল হয়ে উঠছে এই পুরনো দিনের বাংলো বাড়ি। সুধীরকে যেন আজ কোন এক অতিপ্রাকৃত শক্তি ভর করেছে। সুধীরের গলায় নায়কী কানাড়া আজ অবধি কেউ শোনেন নি তার পরিচিতরা। শুনেছেন আভোগী কানাড়া, কৌশী কানাড়া। দরবারি কানাড়া তো অজস্রবার। কিন্তু নায়কী কানাড়া? জীবনে এই প্রথম। প্রথমবারেই জীবনে প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া নায়কী কানাড়ায় মাতিয়ে দিলেন তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের। সুরের বিস্তারে রাগের রূপকে প্রতিষ্ঠা করে তার সপ্তকের সা তে স্থিত হচ্ছিলেন সুধীর। বিলম্বিতের অন্তরার মুখটাকে ধরার পরিকল্পনা করে এগোচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এই সময় ঘরের বাইরে যেন একটু মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। অন্তরার গানের মুখ ধরতে গিয়েও পিছিয়ে এলেন সুধীর, সামান্য সময়ের জন্য মনোসংযোগ ছিন্ন হল।
-“কৌন গা রাহা হায়, কৌন গা রাহা হায়” বলতে বলতে টলোমলো পায়ে যিনি ঘরে ঢুকলেন তাকে দেখে সুধীর একা নয়, থমকে গেলেন উপস্থিত সক্কলে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কারো, কে ইনি? ঠিক দেখছি তো? মৃদু, অতি মৃদু ফিসফাস এর আওয়াজও থেমে গেল যখন পরিপূর্ণ মদিরার পাত্র হাতে সুধীরের সামনে প্রায় তিন হাত দুরত্বে এসে পা গুটিয়ে বসে পড়লেন ওই বিস্ময় আগন্তুক। মাথা ঝোকানো সেই পরিচিত ভঙ্গীতে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন, “গা বেটা, গা, বহুত আচ্ছা, গা...”।
 
*******  
 
        ঘুম আসছে না আজ সুধীরের কিছুতেই। যেন এখনও ঘোরের মধ্যে আছেন। সামনে বসে আছেন তার অন্যতম সংগীত দেবতা পন্ডিত ভীমরাও যোশী, আর তিনি তার সামনে গাইছেন! আর পন্ডিত যোশী সুরের দ্যোতনায় “ওয়া ওয়া”, সাপাট তানের বিদ্যুৎ গতির ছোবলে “কেয়া বাত কেয়া বাত” করছেন!
তার পরে যা ঘটল তা তো তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। সত্যিই কি এমন ঘটেছিল? কী করে সম্ভব হল এটা! বিলম্বিত শেষ করে তিনি দ্রুতের খেয়াল এ যাবেন ভাবছেন, হাতের পাত্র কে একটু দূরে সরিয়ে রেখে পন্ডিতজি বলে উঠলেন, “ইয়ে তো নায়কী কানাড়া হ্যায়, অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”।
আর এক ধরণের নায়কী কানাড়া শুনালেন পন্ডিতজি। দশ মিনিট। সুরের চলনের পৃথক রাস্তায় হেঁটে আবার ফিরে এলেন সুধীরের গাওয়া নায়কী কানাড়ায়, দুই একটা ছুট তান করে গানের খেই ধরিয়ে দিলেন সুধীরকে। অনির্বচনীয় এক স্বর্গীয় পরিবেশের সাক্ষী হয়ে থাকলেন উপস্থিত গুটিকয়েক শ্রোতা। রাজরাণীর মত যার চালচলন সেই শোভার চোখের কোণেও আনন্দাশ্রু চিকচিক্ করে উঠলো।
*****
খাটের উপরে কি শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে গৌরী! পাশে তার ছেলে । মায়ের বুকের ভিতর মুখ গুঁজে সেও গভীর নিদ্রামগ্ন। ঘুমোতে পারছেন না একমাত্র সুধীর। বাড়ি ফিরে গৌরীকে সবিস্তারে গল্প করেছেন আজকের ঘটনা। গৌরী ভীষণ খুশী হয়েছে, কিন্তু গৌরী জানেননা এই ঘটনার প্রকৃত অনুভূতি কেমন! সারা দেশ যাঁর গানে মোহিত হয়ে থাকে সেই জগতবিখ্যাত পন্ডিত ভীমরাও যোশী তার সাথে নায়কী কানাড়ার সুর মিলাচ্ছেন, গাইছেন একই বন্দিশ! একসাথে! তাকে বলে দিচ্ছেন, “অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”! গৌরী যতই তার গানের সমর্থক হোক, এই অপার্থিব অনুভূতির যে সূক্ষ্মতা তা সে ধরতে পারবে না। সুধীরের গায়ে যে লেগে আছে পন্ডিতজির আলিঙ্গনের স্পর্শ! গান শেষ হতেই নিজে থেকে উঠে এসে সুধীরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। অনেক আশীর্বাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি সুধীরকে বলে উঠলেন, “তু মেরে পাশ চলা আ, পুনে মে। ওয়াহা ম্যায় তুঝকো আউর শিখাউঙ্গা। সারা দেশ তুঝে পহেচানেগা”।
গৌরীর নিদ্রামগ্ন, পবিত্র, দেবীর মতন মুখটাকে আবার দেখেন সুধীর। দেখেন ছেলের কচি কচি হাত দুটিকে। আবার মনে পড়ে সেই জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বরের নির্দেশনা।
“নৌকরী?! মা সরস্বতী কা আশীর্বাদ জিসকে উপর হ্যায়, উনহে নৌকরী কি ফিকর হোনা নেহি চাহিয়ে। নৌকরী ওয়াক্রী ছোড়, পুনা চলা আ, মেরে পাস...”।
বড় দ্বন্দ্বে পড়ে যান শিল্পী। কী করবেন তিনি! কোন পথে হাঁটবেন! উত্তর খুঁজে পান না। নিদ্রামগ্ন মা আর ছেলের ওই পবিত্র দৃশ্য তাকে বিহবল করে তোলে।
না, না, এ মহা পাপ হবে। তার নাম, তার খ্যাতির জন্য এদেরকে ছেড়ে সুদূর পুনা চলে যাওয়া ঘোর অন্যায় হবে। এই অন্যায় করতে পারবেন না সুধীর। নাই বা হল তাতে তার দেশজোড়া নাম!
খাটের পাশ থেকে আস্তে নেমে দাঁড়ান সুধীর। যে পাঞ্জাবী পরে তিনি আজ গাইতে গেছিলেন তা ঝোলানো ছিল দেওয়ালে সাঁটা সাবেকী ডায়মন্ড আকৃতির কাঠের হুকে। সেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে আনলেন সুধীর। দেখলেন ওই রাতের আবছায়াতেও। পন্ডিত ভীমরাও যোশীর নিজের হাতে লিখে দেওয়া তাঁর পুনা’র বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কাগজটা মাথায় ঠেকালেন তিনবার। দেওয়াল আলমারি খুলে ভাতখন্ডেজির বই বের করে নায়কী কানাড়ার পাতা টা খুললেন। কাগজের টুকরোটা সেই পাতায় রেখে বই বন্ধ করে আলমারিতে তুলে রাখলেন সুধীরবাবু।
 
******* শেষ *******
Goutam Saha
 

 

আস্তাকুড় - গৌতম সাহা

আস্তাকুড়

গৌতম সাহা


     ক্লান্ত, কর্মব্যস্ত একটা গোটা দিনের পরে নির্জন, প্রায় জনশূন্য রেল স্টেশনের নিস্প্রভ আলোর নিঝুমভাবে এক অন্য রকম মনখারাপী মিশে থাকে। রাত পৌনে এগারোটায় আপ শান্তিপুর লোকাল একদম ফাঁকা চলে গেল সামনে দিয়ে, একটু আগেই। নৈহাটি স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের উত্তরপ্রান্তের একটা বেঞ্চে বসে এই উদাসী রূপটাই দেখছিলাম দু চোখ ভরে। 

     ডিম, তরকারি, রুটি বেচা পরিচিত লোকটিও তার ডেকচি হাঁড়ি, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গুটিয়ে চলে গেছে । পান-বিড়ির দোকানের গোপাল চুপিচুপি সিগারেটের প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে স্টলের ঝাঁপ ফেলতে ফেলতে বলেছিল, "বড় ঠাণ্ডা পড়েছে গো দাদা, আজ আর গৌড়ের জন্য দাঁড়াব না।"  ভিখারি হারুটাও ছেঁড়া বিছানায় শতছিন্ন কম্বলে মাথা মুড়ে শুয়ে পড়েছে গোপালের দোকানের ওপাশের টিনের শেডের আড়ালে। প্রতিবারের মতো যাবার আগে ওর হাতে কিছু যে দিয়ে যাব তার সুযোগ পেলাম না আজ।

     ঠাণ্ডায় যাত্রীও প্রায় নেই বললেই চলে। চার নম্বর প্লাটফর্মের চায়ের দোকান নিশ্চিতভাবে অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তিন নম্বর প্লাটফর্মের শেডের প্রায় শেষাশেষি উত্তরদিকে ওভারব্রিজের কাছে  বসে আছি। অন্য প্রান্তে ওভারব্রিজের কাছে একটা জলের দোকান এখনও খোলা, কেন কে জানে! ওইদিকেই দুই একজন লোক। হয়ত গৌড় ধরবে। অথবা নেহাতই প্লাটফর্মেই রাত্রি কাটানো ভবঘুরে। এতদূর থেকে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। দিনের বেলায় লোকজন, হকার, যাত্রীদের ভিড়ে যে প্লাটফর্ম চত্বর গমগম করে, শেষ জানুয়ারির হঠাৎ পড়া ঠাণ্ডায় রাত এগারোটাতে সেই প্লাটফর্মকেই কেমন যেন ধূসর আলো আর কুয়াশার চাদরে মোড়া জবুথবু প্রৌঢ়ের মতো লাগে।

     মাসে দু-একবার আসি বাড়িতে। আর প্রায় প্রতিবারই এমন হয়। বালুরঘাট হাসপাতালে আমার নিজস্ব কোয়ার্টার আছে, কিন্তু মা তার শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে ছেলের কাছে কিছুতেই যাবেন না। একা থাকবেন এই এত বড় বাড়িতে, সর্বক্ষণের সঙ্গী রুমার মাকে নিয়ে। আমারও উপায় নেই। সরকারী চাকুরে, তার উপর জনসেবাই আমার পেশা, আমার কাজের জায়গা ছেড়ে থাকার কোনও উপায় নেই। কিন্তু মায়ের জন্য আমাকে আসতে হয়ই। আর এই নিয়মিত আসা যাওয়া করতে করতেই নৈহাটির প্লাটফর্ম, স্টলের দোকানদার, হকার এমনকি স্থায়ী ভিখারিদের অবধি মোটামুটি মুখ চেনা হয়ে গেছে আমার। কয়েক জনকে তো নামেই চিনি।

     প্রতিবারই বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়ে মা বলে, "পৌঁছেই একটা খবর দিস"। হয়ত একই কথা, কিন্তু বুকের মাঝে কোথায় যেন একটা মন খারাপের সুর বয়ে যায়। আর সেই রেশ থাকে যতক্ষণ না আগামীকাল হাসপাতাল পৌঁছে আবার সেই রোগী, ওষুধ, প্রেসক্রিপশন, ওটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, ততক্ষণ। এই ঠান্ডায় বিবশ হওয়া জনশূন্য প্লাটফর্মের আবহও যেন সেই মনখারাপীকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়।

     সেই অবশ, ঝিম ধরা মন নিয়ে বসেছিলাম চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে মুখ করে। গৌড় এক্সপ্রেসের এখনও খবর হয়নি। হঠাৎ একটা চাপা হিসহিসে গলার স্বরে একটু চমকে উঠলাম।

 -"ওইইই, ওটা খোল না তাড়াতাড়ি।"

      নারীকণ্ঠের প্রত্যুত্তর এত মৃদু যে বোঝা গেল না। কিন্তু ঈষৎ চাপা হাসি মিশ্রিত কণ্ঠস্বরে যে প্রশ্রয় আর নারী পুরুষের আদিম ক্রিয়ার আভাস ছিল তা এই জনশূন্যপ্রায় প্লাটফর্মের নিস্তব্ধতার মাঝেও বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। আওয়াজ আসছে উত্তরের ওভারব্রিজের অন্ধকার নিচের দিক থেকে। এমনই অপ্রত্যাশিত এই অনুভব যে কী করা উচিত আমার বুঝে উঠতে পারলাম না। এইটুকু বুঝলাম, জনশূন্য এই  প্লাটফর্মে আদিম ক্রিয়ায় রত কোন নারী পুরুষ তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিকে গ্রাহ্যই করছে  না! হয়ত ভাবতেই পারেনি এই প্রান্তে এত রাতে কেউ বসেও তাকাতে পারে! অথবা তারা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেপরোয়া কিংবা প্রবলভাবে রিপুতাড়িত। 

     উঠে চলে আসব কিনা ভাবছি, হঠাৎই গোপালের দোকানের পাশে কম্বলের তলা থেকে ভিখারি হারু বেশ উঁচু গলায় কিন্তু শ্লেষ্মামিশ্রিত স্বরে বলে উঠল, "মর, মর। মর শালা খানকি মাগি। মরেও না রে শালী।"

     চমকে উঠলাম। কম্বল ঢাকা হারুর অবয়বের দিকে তাকাতেই বুঝলাম, এতক্ষণ ভুল ভাবছিলাম আমি। ঠাণ্ডায় জড়সড় হয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু ঘুমায়নি হারু। অপ্রস্তুত হয়ে উঠতে যাব এমন সময়েই প্লাটফর্মের মাইকে ঘোষণা শুরু হলো, "অনুগ্রহ করে শুনবেন, ওয়ান থ্রি ওয়ান ফাইভ থ্রি আপ শিয়ালদহ মালদা টাউন গৌড় এক্সপ্রেস কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই  নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। ..."

     ট্রেন আসছে আমার। ট্রেনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সামান্য একটু ব্যস্ততা। বেশ কয়েকজন যাত্রী প্লাটফর্মের অন্য প্রান্তে, আমার থেকে বেশ তফাতে স্লিপার ক্লাসে উঠবে বলে কোথাও গুটিসুটি মেরে বসেছিল, হঠাৎ করে তাদের  ত্রস্ত পদচারণা শুরু হলো। যে ঘটনায় আমি কিঞ্চিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলাম তাকে ভুলেই আমিও এগিয়ে গেলাম আমার এসি থ্রি টায়ার বগি যেখানটায় দাঁড়াবে তার দিকে। 

     থ্রি-টায়ার এসিতে কম্বলের উষ্ণতায় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ার আগে অবধি কানে বাজতে থাকল সেই হাসি আর বেপরোয়া শীৎকারের শিনশিনে শব্দ!

 ****** 

     কয়েকটা ট্রেনিং  নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম কয়েক মাস। ভুলেই গেছিলাম সেদিনকার কথা। গরম পড়তেই ডায়রিয়ার প্রকোপ এত বেশি হতে শুরু করল যে আমার নাওয়া খাওয়ার সময় অবধি নেই। ব্যাঙ্গালোর থেকে ছোট মাসি এসে ছিলেন কলকাতায় মাস দুয়েকের জন্য, তাই বাঁচোয়া। মাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয়নি। নাহলে এই কটা মাস কী যে করতাম, ঈশ্বর জানেন। মাঝে এসেছি একবার, আবার দিনের বালুরঘাটের ট্রেন ধরেই ফিরে গেছি। ফলে এই চত্বরে আসা হয়নি। স্বভাবতই ভুলেই গেছিলাম ঘটনাটার কথা। আজ যখন আবার গৌড় ধরব বলে অনেকদিন পরে নৈহাটি স্টেশনে এলাম মনেই পড়ত না সেদিনের কথা যদি না অন্য এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতাম।

     আজকে সেই চেনা প্লাটফর্মের অবস্থা কিন্তু সেদিনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেদিন ছিল শীতে জবুথবু জানুয়ারীর রাত। আর আজ মে মাসের হাসফাঁস করা গরমে সরগরম প্লাটফর্ম চত্বর। গোপালের দোকানে যেতেই একহাল হেসে বলল, “কি গো দাদা, অনেকদিন পর যে? এর মধ্যে আসোনি বাড়িতে?”

 -“আরে না রে, খুব ব্যস্ত ছিলাম, আসতে পারি নি।” কাজের জগতের ব্যস্ততার খতিয়ান গোপালকে দিতে ইচ্ছে করল না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, “তোদের খবর সব ভালো তো?”

 -“হ্যাঁ দাদা, এই চলে যাচ্ছে।”

 -“হ্যাঁ, চলে গেলেই হলো।” বলে অন্য কথার অবতারণা করতে যাব সামনের দিকে চোখ আটকে গেল। যা দেখলাম তাতে আমার তথাকথিত সভ্য চোখের দৃষ্টিও সামান্য কুঁচকে গেল। চোখ এড়াল না গোপালের। অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলল, “ওদিকে তাকিও না দাদা, এসব এখানে জল ভাত। সেই চোদ্দ বছর বয়স থেকে দোকান করছি, এইসব দেখে দেখে চোখ পচে গেছে।”

     গোপালের কথাগুলো কানে গেলেও আমি দেখছিলাম সামনের দৃশ্য, আর সারা শরীরে এক অদ্ভুত অস্বস্তি পাক দিয়ে উঠছিল।

     একজন কমবয়সী নারী। বয়স ঠিক কত হতে পারে তা আন্দাজ করতে পারছিলাম না, চাইছিলামও না। আসলে নারীত্বের কোন চিহ্নই তেমনভাবে প্রকট নয় এর শরীরে। পরিস্কার বোঝা যায় বেশ অপুষ্টির শিকার  এই নারী। তবুও চোখে মুখে বেশ খানিকটা প্রগলভতা মাখা এই শ্যামলা মেয়েটির। একসময় হয়ত বেশ সুশ্রীই ছিল, অপুষ্টি জনিত চিহ্নগুলোকে অগ্রাহ্য করেও নজর পড়ে যায় কথায় ভরা তার মায়াবী চোখদুটো। একটি চোয়ারে টাইপের যুবক বেশ বলপূর্বক মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে প্লাটফর্মের অন্য প্রান্তে। জোরে হাতটা ধরে থাকলেও মুখে কিন্তু ছেলেটির অনুনয়ের ভাষা।

 -“ওই ফুলি চল না, একটা জিনিস দেখাব তোকে।”

 -“ছাড় শালা হারামি, কী দেখাবি জানি আমি, খালি ধান্দাবাজি!”

 -“মায়ের দিব্যি করে বলছি, চল সত্যিই একটা জিনিস দেবো।”

 -“তুকে আমি চিনি না রে খানকির ছেলে, তুর মতো হারামি হা বললেই হাওড়া বুঝি আমি, শুয়ো-রের বাচ্চা।”

 -“চ না ফুলি, কেন ঝাঁট জ্বালাচ্ছিস?”

 -“ওরে আমার সাধের নাগর রে, তুই বললেই যেতে হবে নাকি?”

 -“রুটি আর আলুর দম খাওয়াব।”

     ফুলির সব প্রতিরোধের বেলুন যেন এক নিমেষে চুপসে গেল! সে যে যুবকটির সঙ্গে যেতে অনিচ্ছুক ছিল তা যেন নয়, কিন্তু তবুও ছলাকলার মাধ্যমে প্লাটফর্মে উপস্থিত লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মেয়েটি যেন তার পাওনাটুকু নিশ্চিত করতে চাইছিল। 

     মানুষকে নিয়েই আমার প্রাত্যহিক কারবার। প্রতিদিন হাসপাতালের আউটডোরে জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে হয় আমাকে নানা ভাবে। অদৃশ্য শিল্পীর তুলির টানে সৃষ্ট বিচিত্র জীবনের অদ্ভুত শেডসকে প্রতিদিন সামনা সামনি দেখি  আমি। তবুও এই দৃশ্য যেন সেই সকল চিত্রের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এ যেন আমার সামনে আমার দেশের এক খণ্ডচিত্র উপস্থিত তার কঙ্কালসার চেহারার রিক্ততা নিয়ে। 

     যে শীর্ণ অথচ বলিষ্ঠ হাত ফুলিকে প্রায় জোর করে টেনে নিতে চাইছিল, যুবকের সেই হাতটাকেই প্রায় বুকের সামনে ইচ্ছাকৃত চেপে ধরে গলায় মধু ঢেলে সে আবদারের সুরে বলল, “আজ ডিম খাওয়াবি?”

 -“হ্যাঁ খাওয়াব। চল আগে।”

 -“আগে খাওয়া।” তারপরেই রুটি বিক্রেতার দিকে আদেশের সুরে বলল, “ওই মদনা, ডিম রুটি দে।”

     যুবকটি পাত্তাই দিলো না। সেরকম ভাবেই ফুলিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “ঠিক খাওয়াব। কসম সে।”

     ফুলি যেন জানতই এটিই হবে, যুবটির হাত জড়িয়ে চলে যেতে যেতে তখনও সে বলে যাচ্ছে, “তুই এক নম্বরের কামিনা আছিস, হারামি শালা! একটুও তর সয়না তোর কুত-তা।” সেই কথা হয়ত  অশ্লীলতার, সেই যুবতীর গলার স্বরে কিন্তু আলতো সোহাগের ছোঁওয়া!

     ভরা প্লাটফর্মের মাঝেই ঠিক এইরকম একটা ঘটনা ঘটছে, তা সে যত রাত্রিই হোক, উপস্থিত হকার, দোকানদার, অপেক্ষারত যাত্রী- কারো কোনও হেলদোল নেই! কারো মাথাব্যথা নেই। আর আমি? আমার ট্রেন একটু পরেই, মন বলছে, কী দরকার উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে! আমি ডাক্তার, ওই শ্রেণিটা আমার নয়, এর মধ্যে নাক গলান আমার উচিত নয়। আমরা শুধু পাশ কাটিয়ে যাওয়া রপ্ত করেছি, নিজের মনেই নাক সিঁটকে নিজেকে পৃথক ভাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পুরোপুরি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছি কি? পারিনি তো! অস্বস্তির কাঁটা গলায় বিঁধে থাকে কী করে নাহলে!

     গোপাল হাসল, যেন আমার মনটা পড়তে পারল কিছুটা। নিজেই বলল, “খারাপ পেয়ো না দাদা, কালুটা কিন্তু সত্যিই ফুলিকে ভালবাসে।”

 -“কালু কে রে?” নিজের ঘেঁটে যাওয়া মন থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম।

 -“রেল ইয়ার্ডের পাতি গুন্ডা। ওয়াগন ব্রেক থেকে কাঁচরাপাড়ার ওয়ার্কশপের স্ক্র্যাপ বিক্রি, সবেতেই আছে ও।”

 -“ওহ!” আর খুব একটা উৎসাহ দেখালাম না গোপালের কথাতে। এই তথ্য আমার কাছেও কেমন স্ক্র্যাপের মতোই। কিন্তু চমকে উঠলাম ওর পরের কথায়।

 -“আর ওই মেয়েটা কে জানো?”

 -“কে?” অনিচ্ছুক জানতে চাওয়া আমার।

 -“হারুদার বৌ।”

 ****** 

     এসিটা বেশ জোরালো আজকের কম্পার্টমেন্টে। রাতে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। চোখ বুজলেই যেন সমাজের নিচের স্তরের বাস্তবতা থেকে এক ঝাঁক দৃশ্যাবলি মনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে আমাকে কেমন বেসামাল করে দিচ্ছিল। গোপালের বলা কথাগুলো যেন এখনও কানের মধ্যে বাজছে  আমার। 

     যে হারুকে আমি চিনি, যার থাইয়ের সামান্য নিচ থেকে দুটো পা নেই; যে নৈহাটি স্টেশনের দু নম্বর প্লাটফর্মে এক জায়গায় ঠায় বসে যাত্রীদের দিকে অকপট হাত বাড়িয়ে দেয় কিছু ভিক্ষা পাবার আশায়, সেই চেনা হারুই নাকি একদা ছিল এক দাগি সমাজবিরোধী। ওয়াগন ব্রেকিংয়ে ছিল ও সিদ্ধহস্ত। পাশাপাশি অন্য কী কী গুণাবলী ওর ছিল তা গোপাল না বললেও এটা জানাতে ভোলে নি যে ফুলিকে কোন গ্রাম থেকে জোর করে এখানে তুলে এনেছিল হারু। সে পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার ধরা পড়ে জেলের ঘানি টেনে এলেও, ফিরে এসেই লেগে পড়ত আবার তার পুরনো কাজে। কালু ছিল ওর সাকরেদ, ডান হাত বলা যেতে পারে। একদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে ট্রেনের তলায় পড়ে যায় হারু। প্রাণে বেঁচে গেলেও খোয়া যায় দুটো পা। 

     এই বদলে যাওয়া দিনে কালু কিন্তু তার পুরনো ওস্তাদকে ভোলেনি। হারুর জান বাঁচাতে নিজের সব কিছু উজার করে দিয়েছিল কালু। অথর্ব হয়ে পড়া হারুকে নৈহাটি স্টেশনে বসার ব্যবস্থাও নাকি কালু করে দিয়েছিল। দাদাদের কৃপা ছাড়া এখন ভিখারীরাও নাকি ভিক্ষা করার এলাকা পায় না! 

-"ফুলির সঙ্গে কি কালুর আগে পরিচয় ছিল?" গোপালকে না জিজ্ঞেস করে পারিনি।       

-"কী যে বলো দাদা! ফুলি কোথায় আর কালু কোথায়!"

-"তবে কি ওই হারুকে সুস্থ করে তোলার সময় থেকেই কালুর সঙ্গে ফুলির ঘনিষ্ঠতা?" না জিজ্ঞেস করে পারি না আর!

-"আসলে দাদা, হারুদা টা ছিল একটা বাজে লোক। গুন্ডামি তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল মদ গাঁজার নেশা। নিজের গুন্ডামির জোরে অনাথ ফুলিকে প্রায় জোর করেই তুলে নিয়ে এসেছিল ওর গ্রাম থেকে। শ্যামনগর কালিমন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেছিল নাকি। কিন্তু ভীষণ অত্যাচার করত বৌয়ের উপর। মারধর। খিস্তি! ভগবান শাস্তি দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে গুন্ডা থেকে একেবারে পঙ্গু ভিখারি!"

-"আচ্ছা বুঝলাম। হারুর ওই দুঃসময়েই কালুর সঙ্গে ফুলির আলাপ, ঘনিষ্ঠতা।"

-"একদম ঠিক দাদা।"

-"তা ওরা আলাদা করে সংসার করলেই তো পারত!"

-"ওদের কথা ওরা জানে দাদা। কালুদের দৌরাত্ম্যও যে বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। আগের সেই রমরমা, কথায় কথায় চাকু, বোম, পিস্তল যে নেই আর। পুরনো গুন্ডামির নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছে।"

-"তবুও। সুস্থ ভাবেও তো কিছু করতে পারত? "

-"ছাড়ো তো দাদা, পেটে বোম মারলেও ওদের মুখে খিস্তি ছাড়া কিছু বেরোবে না, ওরা করবে কাজ! "

-"আশ্চর্য কিন্তু! যেখানে হারুকে ছেড়ে কালুকে নিয়ে সংসার করাটাই ছিল স্বাভাবিক সেখানে হারুর সঙ্গেই প্লাটফর্মে এই সংসার সংসার খেলাটা কিন্তু ভীষণ রকমের অবাক করা ঘটনা।"

-"মানুষের মন দাদা! কখন যে কী করে বসে তার কি ঠিক আছে?"

-"সেটা অবশ্য ঠিক বলেছ।"

-"তুমি ফুলিকে খেয়াল করেছ দাদা ভাল করে?"

-"না তেমন করে কিছু দেখিনি তো!"

-"আমরা রোজ দেখি তো দাদা, আমরা জানি। ফুলিও দিনদিন মনে হয় কেমন হয়ে যাচ্ছে, কেমন যেন তারকাটা টাইপ। মাঝে মাঝেই কেমন ভুলভাল বকে"

    খেয়াল আমি করেছি। ভালই খেয়াল করেছি। ডাক্তারী করি, এটুকু বুঝব না? কালুর কাছে ডিম রুটি খেতে চাওয়া থেকে শুরু করে রুটিওয়ালাকে রুটি দিতে বলা, তারপরে কালুর হাত জড়িয়ে অন্তর্হিত হয়ে যাবার মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা অস্বাভাবিকতা মিশে তো ছিলই। মনে মনে যাই ভাবি না কেন, মুখে কিছু বলাটা সমীচীন মনে করিনি। 

 -"কিন্তু যাই বলো দাদা, যতই পাগলামি করুক আর যত নোংরামিই করুক, দু'বেলা নিজে হাতে হারুকে খাওয়ায় কিন্তু ফুলিই। ভিক্ষা করে যাই পাক হারু, দুপুর রাত্রে হারুদার ভাত ডাল তরকারি নিজে জোগাড় করে আনে ফুলি, কখনও যদি বা মাছ টাছ পায় তাও। খেতে খেতে হারুদা খিস্তি করে, আর ফুলি ওর পাশে বসে থাকে যতক্ষণ না ওর খাওয়া শেষ হয়! হারুর অসুখ করলেও ওই কালুকে দিয়েই জোর করে ওষুধ নিয়ে আসে ফুলি।" 

-"কত না আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায় রোজ আমাদের আশেপাশে!  মানুষের বুদ্ধি দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই না।"

-"ঠিকই! একদম ঠিক কথাই বলেছ দাদা।"

     কথাটা গোপালকে বললাম ঠিকই, কিন্তু রাতে ট্রেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তেও ভাবছিলাম- ওই যে গোপালকে বললাম, 'বুদ্ধি দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না', কথাটা কি সত্যি? বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না নাকি আমরা ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখি না? এই প্রশ্নের  উত্তর নেই যদিও। 

 ****** 

     আবার ফুলিকে দেখি মাস পাঁচেক পর। অপুষ্টির চেহারাতে  মাতৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। প্লাটফর্মের মেঝেতে পা ছড়িয়ে কীসব যেন আঁকিবুকি কাটছে। আরও অবিন্নস্ত এবং আরও অবহেলিত শরীর মনে হলো যেন! কথা বলছে না আগের মতো চিৎকার করে, বরং নিজের সঙ্গেই যেন একা একা বকবক করে চলেছে সে। বড্ড চিন্তা হলো ফুলির জন্য। কিন্তু কীই বা করার আছে আমার!

     এরপরে জীবনের নদীতে অনেক সময় বয়ে গিয়েছে। আমি ডাক্তারির এমডি তে সুযোগ পেয়েছি। তিন বছর বালুরঘাটের সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই। নেই নৈহাটি থেকে গৌড় এক্সপ্রেস ধরার অভ্যাসও। স্বভাবতই হারুদা, কালু কিংবা ফুলি ট্রেনের জানলা দিয়ে পিছনে ফেলে আসা দৃশ্যপটের মতো কবে পিছনে রয়ে গেছে তা খেয়ালও করিনি। 

     এমডি পাশ করার পর আমার পোস্টিং হলো কৃষ্ণনগরে। যদিও এখন আর ট্রেনে চাপি কম। গাড়ি নিয়েই যাই। লোকাল ট্রেনের ভিড় তো সহ্যই হয়না। ড্রাইভার আছে। হাসপাতালের ডিউটি, কয়েকটা প্রাইভেট চেম্বার, নাওয়া খাওয়ার সময়টাও পাই না কখনও কখনও। 

     গাড়িটা গ্যারেজে দিয়েছিল ড্রাইভার সুকুমার। সকালেই গ্যারেজ থেকে ফোনে জানাল যে গাড়ির কাজ শেষ হয়নি। একদিন সময় লাগবে আরো। এত কাজ! তার মাঝে গাড়ি নেই। অথচ ডিউটিতে যেতেই হবে। রাগ হলেও কিছু করার নেই। অগত্যা ট্রেনে যাওয়াই ঠিক করলাম। 

     সেই নৈহাটি স্টেশন। সেই প্লাটফর্ম নম্বর তিন। গোপালের দোকানে দেখি অপরিচিত এক যুবক। গোপালের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বলল, "দাদা তো দুপুরের দিকে আসে, আমি সকালটা চালাই।" 

     হারুদার কথা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। ছেলেটি বলল, "হারুদা আছে তো। ওই ওভারব্রিজের দিকে যান, দেখবেন ওভারব্রিজের পাশের ছায়ায় বসে আছে।" 

     ওর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম ওভারব্রিজের দিকে। ঠিক চিনতে পারলাম হারুদাকে। একটা দু তিন বছরের শিশুকে কোমরের কাছে একটা কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছে হারুদা। আর প্লাটফর্মের যাত্রীদের দিকে হাত পেতে বলছে, "বাবারা, মা রা, আমি পঙ্গু, কাজ করতে পারি না, আমার এই দুধের শিশুর জন্য দু টো টাকা দিয়ে যান গো বাবারা।" 

 কেন জানি না, মনটা কেমন করে উঠল। 

     কাছে গিয়ে একটা একশ টাকার নোট এগিয়ে দিলাম। বললাম, "কি গো হারুদা, কেমন আছো? চিনতে পারছ?" 

     হারুদার চোখে সে এক বিহ্বল দৃষ্টি! সে কি আমাকে চিনতে পারার কারণে, নাকি একশ টাকার নোটের কারণে বুঝলাম না। খুব খোলা মনেই জিজ্ঞেস করলাম, "এটা তোমার ছেলে নাকি গো হারুদা?" 

    কেমন যেন থতমত খেল হারুদা। চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল হঠাৎই। পাল্টে গেল গলার স্বরও। স্পষ্ট বিরক্তি চোখে। একটু আগে নেমে আসা মুখের বিহ্বল ভাবটা পাল্টে একটু  যেন কর্কশ স্বরেই বলল, "কেন? আমার ছেলে না তো কার হবে?" 

     সত্যিই তেমন কিছু ভেবে বলিনি কথাটা। খারাপ লাগল। ধাক্কা লাগল সামান্য। ভীষণ  জানতে  ইচ্ছে করছিল ফুলির কথা। করব কি করব না করে তাই প্রশ্নটা করেই ফেললাম। 

 -"আর ছেলের মা? ফুলি। সে কেমন আছে?" 

     এক ঝলক আগুন ছিটকে পড়ল যেন হারুদার গোটা মুখমণ্ডলে, ফুলকির মতো, চকিতে। এক মুহূর্তের জন্য সেই দৃষ্টির আগুন নিয়ে আমার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকল। তারপর তড়িঘড়ি শিশুটিকে দু হাত দিয়ে সামলিয়ে হেঁচড়ে হেঁচড়ে অথর্ব শরীরটাকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমার চোখের আড়ালে চলে গেল হারুদা। 

     ফুলি আর ফুলির খবর? আরো পাঁচটা অনাবশ্যক ঘটনার মতোই অজানা হয়ে পড়ে রইল নৈহাটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। 

 

সমাপ্ত

Goutam Saha