কৈতব - সৌমী আচার্য্য

কৈতব
সৌমী আচার্য্য

 


 


ঘাড় গুঁজে পড়ে রয়েছি নীল সন্ধ‍্যের ভেতর।কিছুতেই দিশা পাই না আমি ঠিক কোন অক্ষরের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বসেছি।দোরে দোরে শঙ্খ বাজে টিমটিম করে।আলো জ্বলে প্রদীপের। আমি কেবল জড়োসড়ো হয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকি।কোন দিক যাব দিশা পাই না।ধোঁয়া ওঠা পথ একা বোকার মতো শুয়ে থাকে।ওর গা থেকে মন খারাপের হাবিজাবি গন্ধ উঠে আমায় আরো বেকুব করে দেয়।নিশানাথ যেদিন আমার সব পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে গেল,বলেছিলো,চুকলিবাজি করে কার কার জীবনের গোপন কথা লিখেছিস পড়ে দেখি।তবে তো ছাপার প্রশ্ন।আমি পাণ্ডুলিপি চেপে ধরি।আমার গল্প ফেরৎ দে।ছাপতে হবে না।জোর করে কেড়ে নিয়ে খ‍্যাঁখ‍্যাঁ করে হাসলো।

-আমার থেকে কেড়ে নিবি?কি করে?মনে রাখিস অনন্ত এই পাশা খেলায় আমিই শকুনি আমিই যুধিষ্ঠির।জিতবো আমি হারাবো আমি আবার শেষেও জিতবো আমি।

সেই থেকে ভয় পেয়ে কুঁকড়ে আছি।আমার বৌ লতিকা ভারি মিষ্টি মেয়ে।ওর বুকের খাঁজে মৌরিফুল গন্ধ কিন্তু আমায় দেখলেই চটে যায়।আর বড্ড মাতব্বরী করে এই যা দোষ।

-এমন ভিজে ন‍্যাতানো লোক কেন তুমি?তোমার গল্প ছেপে কোন লোকে টাকা কামায়?তার নাম তো বলো?তুমি ভিখারীর মতো ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা কুড়িয়ে নিয়ে কবরে আলো জ্বালবে আর কতদিন?তাহলে লিখো না অনন্ত,লিখো না।এই করে ব‍্যবসাটা পর্যন্ত লাটে উঠতে বসেছে।তোমার এই উত্তর না দেওয়াটা সহ‍্য হয় না।

ওর কথায় উত্তর দিতে পারিনা।কোনদিন পারিনি।কি করে বোঝাবো আমি সত‍্যি জানিনা নিশানাথ কোথায় থাকে।কাগজে গল্প বেরোলে বুঝি আমার পাণ্ডুলিপি বেচে দিয়েছে।আমাকে হতাশ দেখে প্রথম প্রথম লতিকা কষ্ট পেত।এখন রাগে গরগর করে।পালিয়ে যাই বাড়ি থেকে।বাসস্ট‍্যাণ্ডে গিয়ে বসি।হুশহুশ করে সময় বয়ে নিয়ে যায় ব‍্যস্ত অফিস ফেরৎ ক্লান্ত মানুষ,গায়ে গায়ে লেগে থাকা জড়িবুটি যুবক যুবতী,লোকের বাড়ি কাজ সেরে ফেরা অতসীর মা সবাইকে।অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎ লিকলিকে ছোড়া এগিয়ে আসে,কি কাকু এমন অন্ধকার নিয়ে বসে আছেন কেন?কোথায় যাবেন?ওর বলার ধরণে তীব্র গন্ধ।চারিদিক কালো করে আসে।যত বলি আআআআআমায় ছাড়োওওও।তত কনুই চেপে বলে,কি নেশা করো বাপ এমন ডুবে রয়েছো?আমি কোনদিন কোন নেশা করিনি এই তীব্র হাহাকার নিয়ে নিজেকে গুঁজে দিই চলন্ত বাসে।হৈহৈ কনডাক্টারের কর্কশ স্বরের পেছন পেছন কে যেন বলে,বুড়ো কালে যত হিরোগিরি।সব উৎকট মন্তব‍্যের অশ্লীলতা নিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়ি অন্ধকারে।বাসের লাল চোখ অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই ঝিঁঝিঁ ডাকে বেধড়ক।এটা বোধহয় পৃথিবীর শেষ প্রান্ত।আর একটু এগোলেই মুক্তি।নিশানাথ আর আমার শব্দ অপহরণ করতে পারবে না।আমি যেভাবেই হোক একটা শক্ত খুঁটি পেলেই উঠে দাঁড়াব আবার।লতিকা বিয়ের রাতে শক্ত খুঁটি হতে চেয়েছিল।চোখ বড় করে বলেছিল,তুমি লেখক?তুমি লেখ?এই  লোহা লস্করের মধ‍্যে থেকে লেখার সময় পাও?আমায় পড়িও পড়বো।কিন্তু কোনদিন শোনেনি কেবল রাগ আর শাসন।

অন্ধকার চলে আমার আগে আমি ঘাড় গুঁজে তার পিছনে,অন্ধকার চলে আমার পিছনে আমি ভয়ে ঘাড় গুঁজে তার আগে।ট্রুইইই ট্রুট্রু জানান দেয় পাখি।মৌবনী পাখির নাম জানতো।মামাবাড়ি গেলেই ওর সাথে ঘুরতাম।সব পাখি চেনাত আর আমি ভুলে যেতাম।রেগে উঠতো,অনন্ত তুই একটা ম‍্যাদামারা ছেলে।চোখ মরা,বুদ্ধি মরা।তুই থেকেও নেই।এক মেঘলা দিনে মামা বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি যাবো বলে বেরিয়েছি,মৌবনী রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে গেল ওর সাথে।ওর জোরের কাছে আমি সব সময় অসহায়।মরালীর তীর ঘেঁষে জঙ্গলে টানটান শুয়ে ফিসফিস করে বললো,ঐটা শামুকখোল আর ঐ যে মোটাহাঁটু।

-ধুর মোটাহাঁটু কোন পাখির নাম হয়?

ঠোঁটের উপর আঙুল এসে পড়লো সাথে মৃদু শাসন,চুপ!কথা বললে উড়ে যায়।ঐ দেখ মাণিকজোড়,সরালি।

মৌবনীর গলা পিছলে আমার চোখ ভরাট বুকে স্হির।বুকের ভেতর ঝড়।বাইরে দিনের আলোতে কালি ঢেলে দিল মেঘ।ঠোঁটের নরম হাতছানি বিভ্রমে ফেলেছিল আমার গোপন লজ্জাকে।হঠাৎ কাদায় পা ধরে টেনে নিল মৌবনীকে।ছেলেগুলো আমার গলায় দা রেখে এক হ‍্যাঁচকায় প‍্যান্ট খুলে গাছে ঝুলিয়ে দিল। আমার বাড়ি ফেরার ব‍্যাগটাকেও গাছের নীচে ছুঁড়ে দিল।আর মৌবনীকে উপড়ে নিল জামা কাপড়ের ভেতর থেকে।আমার চোখের সামনে উফ্!তুলতুলে কাদামাটিতে কি অপূর্ব দক্ষতায় বীজ বুনছিল ওরা।চিৎকার করে মৌবনী আমায় গাল দিতে শুরু করলো,থুথু ছিটিয়ে দিল মুখে।আমি ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকলাম কাপুরুষের মতো।কি উপভোগ‍্য সেই মৈথুন দৃশ‍্য।ইচ্ছাই জাগেনি ওকে বাঁচাই।ছেলেগুলো ওকে কাদায় অজ্ঞান করে ফেলে রেখে আমায় শাসিয়ে তাড়িয়ে দিল।ভয়ে ঘাড় গুঁজে ট্রেন ধরে পালিয়ে এলাম সোজা বাড়ি।মনে মনে দৃশ‍্যটা বারবার দেখেছি সারাজীবন।কতবার লতিকাকে তেমন ভাবেই... কিন্তু প্রতিবার হেরে গিয়েছি।হয়তো উন্মুক্ত প্রকৃতিতে কাছে এলে তেমন আশ্চর্য কিছু হতো।লতিকা আমায় দেখলে রেগে ওঠে,কাপুরুষ,ইতর বলে দুচ্ছাই করে।আচ্ছা ছেলেগুলো যদি লতিকাকে ভোগ করে মৌবনীর মতো ও কি খুব খুশি হবে।ছেলেগুলো কোথায় থাকে জানলে নিমন্ত্রণ পাঠাতাম।আমি দূর থেকে আবার নয় দেখতাম।

রাস্তাটা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে ঝোপ জঙ্গলে।বর্ষার সোহাগের চিহ্নসর্বত্র।ভিজে মাটি আর মন খারাপ করা ভয় আমার শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে।চোর বলে পিটিয়ে মেরে ফেললে নিজেকে বড় বেকুব মনে হবে।সামনের বাড়িটায় ঢুকবো কি ঢুকবো না ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসি আরো অনেক পথ।একটা বাওড় চোখে আসে।বড় করে আগুন জ্বলছে।মন বলে এমন কটূ গন্ধ নিয়ে চড়বড় করে নিজেকে জানান দেয় যে সে কেবল শ্মশান।বড় বড় কথা বলতো জ‍্যেঠা।এইখানেই নাকি শান্তি।শান্তি!কিসের শান্তি?মরলে আবার শান্তি কি?আর মরলেই যদি শান্তি তবে আমার বিধবা মাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে নকল দলিল বানিয়েছিল কেন?

পুরো দুনিয়াটাই জোচ্চোর।আমার হাবাগোবা মা ঐ স‍্যাঁতস‍্যাঁতে বাড়ির রান্নাঘরে চিরকাল নির্বাসিত ছিল।কতবার দেখেছি সকলের পাতে মাছ। আমার আর মায়ের পাতে কেবল ডালের জল পেঁপে সিদ্ধ।ডালের জল আলগোছে জ‍্যেঠিমা আগেই আলাদা করে তুলে রাখতো।মা আর আমি রান্নাঘরে খেতাম ওরা বারান্দায়।এই দুখি দুখি চিত্র আমি ঘষে ঘষে তুলে দিয়েছিলাম।যেদিন জ‍্যেঠু গলায় দড়ি দিয়ে মরলো তারপর থেকে শুধু ঘষে গেছি।নিরাপদ মামা অবশ‍্য ভরসা দিয়েছিলেন কোর্টে কেস করার জন‍্য কিন্তু দরকার হয়নি।জ‍্যেঠিমার মাথার অসুখ বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে নিতেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেল মায়ের সব কান্না।জ‍্যেঠু বেশি বয়েসে বিয়ে করেছিলো তাই ছোট ভাই বোন গুলোকে মা পরম যত্নে আঁচলে তুলে নিল।আমি সবার জন‍্য মাছ আনতাম।জ‍্যেঠিমাকে পাগল গারদে দেবার মতো শয়তানি আমার মাথায় কোনদিন আসেনি।তবে জ‍্যেঠিমা যেখানে সেখানে চলে যেত।হাওয়ায় ঢিল ছুঁড়তো আর চিৎকার করতো,খা খা আমাকে খা।শেষে বাধ‍্য হয়ে ঘরে বাঁধলাম।ওষুধ খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিলে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকাতো।কৃতজ্ঞতা না বিস্ময় কে জানে?মুখ নামিয়ে উঠে আসলেই মুক্তি।বড় শান্তি যুতসই সংসারের ওমে।শ্মশানে কিসের শান্তি?সব পোড়া,সব।দাউদাউ আগুণ জ্বলছে।জ্বলছে জীবন,জ্বলছে সাধ,স্বপ্ন,আশা আকাঙ্খা।আহ্!এখানে গুটিয়ে থাকি বরং।আশেপাশে ছায়া ভীড় করে আসে।যতবার যতদূরে চলে যাই স্মৃতি পেরিয়ে।ছায়া আসে ভীড় করে।হাত বাড়িয়ে ডাকে প্রেতের মতো।আমি অক্ষর লিখি জীবন জুড়ে।

মৌবনী আমার দিকে আঙুল দেখায়,ও করেছে সব,ওর গুটিয়ে যাওয়া মুখ দেখে করুণা করবেন না।ও শয়তান,জীবন্ত শয়তান।আমি ঘাড় গুঁজে বলে গেছি আমিইইইই কিছু করিনি সত‍্যি বলছি।বলতে পারিনি আমি শুধু দুচোখ ভরে দেখেছি।লাজুক,সরল,বোকা ঘাড় গোঁজা অনন্ত সরকারকে মেয়েটা কেন দোষারোপ করছে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।মাটি দাপিয়ে মাথা খুঁড়েছে মেয়েটা আমি মামাদের হাত চেপে ধরে থরথর কেঁপেছি।জন্মে ইস্তক করুণা প্রার্থী আমি।এমন ভয় পেয়ে ছিলাম বলার নয়।ঘটনার দিন আমি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম আর উড়নচণ্ডী মৌবনীর ধর্ষণ কাণ্ডে একাধিক প্রেমিকের উপস্থিতি বড় হয়ে উঠেছিল।একথা প্রমাণ হতে দেরি হয়নি।মৌবনী আর কোনদিন পাখি চেনায়নি আমায়।

মাঝেমাঝে জ‍্যেঠু একই ভাবে সরে আসে পাশে।কানের লতিতে শ্বাস ফেলে,আমি তো তোদের মেরে ফেলিনি,তুই আমায় মারলি কেন?ধুতরার বিজ খাইয়ে আমার বৌটাকে পাগল করে দিলি?অনাথ করে দিলি ছেলেমেয়ে গুলো কে।থতমত খেয়ে যাই।এরা আমায় দোষ দেয় কেন?আমি তো ঘাড় গুঁজে চলা সরীসৃপ।কেবল মাথার ভিতর লকলক করে আগুন খাণ্ডব পেলেই পোড়ানোর ছুঁতে খোঁজে।কাছে ঘেঁষে আসে লতিকা।

-কি দেখতে চেয়েছিলে অনন্ত!জীবন্ত শরীর পুড়লে কেমন গন্ধ ভাসে?আমার শুধু এটুকুই দোষ যে আমি তোমায় ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম।তুমি কোনদিন এক অক্ষর লেখোনি অথচ কাগজের অফিসে গিয়ে রোজ রোজ ঝামেলা করেছো যে তোমার পাণ্ডুলিপি চুরি করে লেখকরা গল্প লেখেন।কাদের কল্পনা করে নাও তোমার আশেপাশে?যারা কেউ নেই বাস্তবে।আমি তো ছিলাম অনন্ত।তোমার সব পাগলামো মেনে নিয়ে।কতবার,কতবার আমায় জন্তুর মতো ভোগ করেছো যেন  তুমি একাই চার পাঁচজনের প্রতিচ্ছবি।বারবার বার বার।তবু ধুয়ে মুছে যত্নে নিয়েছি বুকে।কি হত ডাক্তার দেখালে?আর কি হতো আমায় বাঁচতে দিলে?

-তুমিই তো একমাত্র সব জানতে।তাই তো কৌশল‍্যা মাসী এসে ভ‍্যানভ‍্যান করতে শুরু করলো,ওকে মেরে ফেল অনন্ত,এতদিনের লোকানো পাপ সবাইকে জানিয়ে দেবে।মনের ডাক্তার তোর সব পাপ জেনে যাবে।মেরে ফেল মেরে ফেল।আমিও অধৈর্য হয়ে আগুন জ্বেলে দিলাম।মায়া হচ্ছিল খুব মায়া কিন্তু পারলাম না।

লতিকা বোকা,বোকার হদ্দ আমি নাকি কিছু লিখিনি।কিচ্ছু লিখিনি আমি?সেই ছোট থেকে একের পর এক লিখেই চলেছি,তবু বলে আমি লিখিনি?আজ আবার একটা উপন‍্যাস শুরু হবে হয়তো এইখানে।যত্ন করে লিখতে হবে এটাও।চুল দাড়ি কামিয়ে সন্ন‍্যাসের পাঠ শুরু করেই এসেছি।সাথে যা আছে তাই দিয়ে নিপূণ ভাবে লেখা যাবে নতুন কাহিনী।শ্মশানের পাশে কালী মন্দিরে কয়েকজন ছেলে ছোকড়া দেশী নেশা করছে।ম্লান মুখে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই খিস্তি করলো,কেডায় রে শালা!এহানে কি চাই?ভাগ?আমি নরম হয়ে প্রার্থনা করলাম,বাবা এই চাতালে একটু শোব?রাতটুকু কাটাবো।কিছু চাইনা বাবা।পরমেশ্বরের দরবারে ফকিরের চাহিদা শূন‍্যের জন‍্যেই।দেখ লতিকা ওদের গদগদ মুখে কৃপা প্রার্থনা করার ভঙ্গীতে নান্দীমুখ হয়েই গেল।তবে ঘাড়গুঁজে চলার অভ‍্যেস আমি ছাড়তে পারবো না।ভদ্রতার উৎকৃষ্ট নমুনা ত‍্যাগ ক‍রতে নেই।সব শয়তানি অক্ষর মুছে ফেলা যায় ঘাড় গুঁজলে।রাতটা আর ভয় দেখাতে পারছে না বরং শক্তি হারিয়ে ফ‍্যাকাশে হয়ে গেছে।অক্ষর গুলো যুতসই করে নিই।ছায়াগুলো আবার আসবে জানি কিন্তু আমার এখনো অনেক লেখা বাকি।আবার নতুন গল্প নতুন প্লট।
......................

অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার