শ্যামাপ্রাসাদ সরকার লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শ্যামাপ্রাসাদ সরকার লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মজলো আমার মন ভ্রমরা - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

 

মজলো আমার মন ভ্রমরা

শ্যামাপ্রসাদ সরকার
 
 

 

আশ্বিনমাস শেষ হয়ে গেছে পক্ষকাল পূর্বেই।  হিমভেজা কূয়াশার মিহি আবরণ একটু একটু করে গঙ্গার ওপরে জড়ো হয়ে এক ভাব তন্ময়তার সৃষ্টি করেছে। পূর্বাকাশের রক্তিমাভায় একটি দিবসের নবোদয় মুহূর্তটি যেন উন্মুখ হয়ে আছে।

মধ্যমাকৃতির সুগৌর এক যুবাপুরুষ আপাতত গঙ্গার ঘাটের অভিমুখী। বেশ কিছুদিন হল নিশাকালের সুষুপ্তিতে তিনি আগ্রহ হারিয়েছেন। আজকাল প্রায়সই তাঁর মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হয় স্বহস্তে রচিত পঞ্চমুন্ডির আসনে বিল্বতলায়। 
বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে তিনি সাধক যেমন, তেমন পদগীতিকারও। ব্রহ্মময়ীর এই সন্তানটির স্বকন্ঠে মাতৃনামের গীতিসুষমায় বঙ্গদেশ সুরভিত। এব্যাপারে তাঁর একটি সঙ্গীও আছে তার নাম আজু গোঁসাই। গানের সঙ্গে সঙ্গে সে তার শ্রীখোলটিকেও যোগ্য সঙ্গত করে। মাতৃনামের সুরধ্বনী যখন তাঁর কন্ঠে আসে তখন সেই সুধায় মাতোয়ারা হয়ে যান স্বয়ং তিনিও। 

সন্ন্যাস তিনি গ্রহণ করেননি বটে তবু কাষায় বস্ত্র ও একটি বহির্বাস কেবল তাঁর অনুষঙ্গ। এঁর জায়াটির এই মহেশ্বরপ্রতীম আপনভোলা মানুষটিকে নিয়ে  অনুযোগহীন সপ্রেম গৃহস্থালি। তিনটি কন্যাসন্তানের সর্বকনিষ্ঠটির নাম ব্রহ্মময়ী।সাধকের সিদ্ধিলাভ আর সন্তানটির জন্মের সমাপতনই এর কারণ বলা যেতে পারে।

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে প্রসাদ জলে নামেন পূর্বাস্য হয়ে,

" ডুব দে রে মন কালী ব’লে।
হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে,
ডুব দে রে মন কালী ব’লে..."

ধীরে ধীরে অরুণরাগে সূর্যোদয় ঘটে। 
আহা! মন ভ্রমরা শ্যামাপদে যদি মজে থাকে তবে কেমন সদারঙ্গে বিভোর থেকেই মহামায়ার পদধ্বনি হৃদিকন্দরে শ্রবণ করা যায়! তিনি ও তাঁর মাতৃকা ব্রহ্মময়ী যেন অভিন্ন। বাল্যের পাঠশালায় শেখা অন্যসকল বর্ণমালা বিস্মৃত হয়ে শুধু 'কালী' শব্দের 'ক' বর্ণটিতেই আজীবন বিভোর তিনি। পরিহাসপ্রিয় প্রসাদ নিজেকে বলেন 'কালীর বেটা' !

আর কয়েকদিন পরই দীপাণ্বিতা অমানিশা। মাতৃআরাধনার জোগাড় করতে পত্নী সর্বাণীর সাহায্য প্রয়োজন। মাতৃমূর্তিটির নির্মাণে তিনি স্বয়ং আর কুম্ভকার পল্লীর হরিরামকে সংবাদ দিলেই বাকি কাজ হয়ে যাবে। সর্বাণী অন্নভোগ প্রস্তুতিতে স্বয়ং অন্নপূর্ণা। ইদানীং  অন্নভোগ সামান্য হলেও আয়োজন করা এখন আর কঠিন নয়।  রাজানুগ্রহে কয়েকবিঘা দেবত্র ধানজমিতেই এই খাস চালের কৃষিকর্ম হয়ে থাকে। 

হরিরাম বেলায় এসে দন্ডবৎ করে। কবিপত্নী তৎক্ষণাৎ  অতিথি সেবায় বাতাসা আর জলের ঘটিটি এগিয়ে দেন।
এই গৃহে সবার অবারিত দ্বার। হরিরাম জানায় যে আজ-কালের মধ্যেই মূর্তির কাঠামোটি বেঁধে একমেটে প্রলেপটি সমাপ্ত করে দেবে বিনামূল্যেই। তারপর সেই অর্ধসমাপ্ত দেবীমূর্তি সাধক-কবির হাতে চিন্ময়ী হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে। প্রসাদ শুনে প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন। 

কাচকী মাছ, তিন্তিরির টক আর শালীধানের সামান্য অন্নপাক দিয়ে দ্বিপ্রাহিক আহার সারেন প্রসাদ। আহারান্তে গৃহের অন্যান্য সব কাজ সেরে, সন্তানগুলিকে দিবানিদ্রায় রেখে, কবিগৃহিণী অবশেষে আসেন পতি সন্নিকটে। সর্বাণী শ্যামলবরণী। মাথায় মেঘবরণ একঢাল চুল। আভরণহীন হলেও একটি শান্ত মুখশ্রী তার, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুগভীর আয়ত চক্ষুদ্বয়। প্রসাদের হাতে স্বহস্তে রচিত তাম্বুলগুলি নিবেদন করতে যেতেই সবেগে প্রসাদ তাকে নিজ বক্ষে চেপে ধরেন। এই নারীটি তার সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করে না দিলে কুন্ডলিনীর পরম জাগৃতি ও আসঙ্গ ব্রহ্মস্বাদ অধরাই রয়ে যেত। বিপরীতবিহারে প্রসাদ গ্রহণ করতে থাকেন সহস্রার কমলের পরম উন্মেষের ঐশী আনন্দ। 

মূর্তি নির্মাণ প্রায় পরিশেষের পথে। ধনত্রয়োদশী তিথিতে প্রসাদ মূর্তির চক্ষুদান অঙ্কন করলেন। কি জীবন্ত দেখাচ্ছে তাঁর ব্রহ্মময়ীকে এবার। সন্তানদের ক্রোড়ে বসিয়ে তিনি উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠেন,

"আমি তাই কালোরূপ ভালোবাসি,
জগ-মন মজিলি এলোকেশী।
শ্যামা মন মজিলি এলোকেশী, ভালোবাসি"

সর্বাণী জানেন আগামী তিনটি দিবস ও রজনী পতিদেবটিকে চোখের নাগালে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। মাতৃনামের জোয়ারে তিনি নিজে ভাসবেন আবার ভাসাবেনও। 

মহাপূজার রাত্রিটি অবশেষে আগত। প্রসাদের পূজায় গীতগুলিই মন্ত্রের মত। তবুও তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে করন্যাস,অঙ্গন্যাস প্রভৃতি উপাচার মান্য করে তিনি বীজমন্ত্র জপ করেন। দেবীঘট স্হাপনের পূর্বে শুদ্ধির মন্ত্র উচ্চারিত হয় সাধক -কবির মন্দ্র স্বরে,

"গঙ্গাদ্যাঃ সরিতঃ সর্ব্বাঃ সরাংসি জলদা নদাঃ। হ্রদাঃ প্রস্রবণাঃ পুণ্যাঃ স্বর্গপাতালভুগতাঃ। সর্ব্বতীর্থানি পুণ্যানি ঘটে কুর্ব্বন্তু সন্নিধিম্॥"

 জবাপুষ্প আর বিল্বপত্রের অপরূপ সাজে মাতৃমূর্তি যেন প্রকৃতই চিন্ময়ীস্বরূপীনী। প্রসাদ সন্ধ্যাকাল থেকেই  কিঞ্চিৎ কারণ পানে ঢলোঢলো। মাতৃআরাধনার 
জন্য নির্বাচিত সর্বশ্রেষ্ঠ গীতগুলি আজ তাঁর কন্ঠে উচ্চকিত। আজু গোঁসাইএর হাতেও আজ কালের মন্দিরার মত তার শ্রীখোলটি সঙ্গতে রত। কবি আর সাধকের মিলনে রচনা হয়েছে যুগান্তকারী ভাবাবেশের। 

" দেহের মধ্যে সুজন যে জন
তার ঘরেতে ঘর করেছি,
দেহের মধ্যে সুজন যে জন
তার ঘরেতে ঘর করেছি,
এবার শমন এলে হৃদয় খুলে
দেখাব ভেবে রেখেছি,
অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি.."

সর্বাণীর সর্বদেহ রোমাঞ্চিত হয়। প্রসাদ যেন একটু অধিক ভাববিহ্বল আজ, সেকি শুধুই কারণানন্দের জন্য? মৃৎপাত্র করে সে অন্নভোগ অার পাঁচ রকম ভাজা সাজিয়ে আনে সঙ্গে পরমান্ন। প্রসাদ টের পান কুন্ডলিনীর জাগৃতি, ক্রমশ ব্রহ্মসারাৎসার জগতের দ্বার সুষুম্নাপথে উন্মোচিত হতে থাকে। 

পূজা সমাপন হয়  মধ্যরাত্রি পার করেই। তারপর সপরিবারে দেবীমূর্তিকে প্রণাম করে উঠোনে আসন বিছিয়ে  অন্নভোগ সেবায় বসেন সাধক-কবি। সঙ্গে আজু আর চর্মকার বলরাম এরা প্রসাদের নন্দী ভৃঙ্গী স্বরূপ। ভোজনান্তে একটি ভান্ডে সামান্য কিছু ভোগ সংগ্রহ করে তিনি গৃহের পিছনে বাঁশবনের দিকে অগ্রসর হন। শিস্ দিয়ে বিশেষ কাউকে যেন আহ্বান করেন প্রসাদ। মুহূর্তে দুটি শৃগাল অন্ধকারে প্রোজ্জল দুটি চক্ষু মেলে সম্মুখে গোচর হয়। এদের নাম 'জয়া' আর 'বিজয়া'। প্রসাদ শিবাভোগ শেষে গৃহে ফেরেন রাত্রির শেষভাগে।

এরপর প্রসাদ যেন একটু আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন । সুষুম্নাপথে সহস্রার পদ্মের দলগুলি এখন পূর্ণবিকশিত। এই অবস্হায় বেশীক্ষণ স্হিতিতে অবস্হান করা যায়না।কুটিরাভ্যন্তরে সর্বাণী ক্লান্ত দেহে সন্তানসহ ততোক্ষণে নিদ্রামগ্ন। প্রসাদ তাঁর কুটিরটি বড় মমতায় প্রদক্ষিণ করেন একবার। তাঁর গৃহের আঙিনায় সর্বদীপ্তিতে আজ ব্রহ্মময়ী বিরাজ করছেন। সে দিকে বেশীক্ষণ চেয়ে থাকলে মন উন্মার্গগামী অবস্হা থেকে স্বাভাবিকভূমিতে অবতরণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এরপর বিল্বতলায় পঞ্চমুন্ডের আসনটিকে প্রণাম করলেন আভূমি নত হয়ে। কালী কল্পতরুমূলে আজ তিনি ভ্রমণের জন্য ক্রমশ প্রস্তুত করছেন দেবতনুটিকে।

সূর্যোদয়ের মুহূর্তে দর্পণে বিসর্জন করে মঙ্গলকলসের সূত্রটি ছিন্ন করে অঝোর ধারায় প্লাবিত হন তিনি। ভববন্ধনটিও কি তবে ছিন্ন হবে এবার? 

উলুধ্বনিতে মাতৃমূর্তি বরণ করে সর্বাণী। শিশুগুলি ফেনী বাতাসা আর চিনির মঠ মুখে করে এই কৃত্য দেখে বিস্ময়ের চোখে। 

মাতৃকামূর্তি শিরোপরে স্হাপন করে প্রসাদ অগ্রবর্তী হন গঙ্গার তীরের অভিমুখে। সদ্যরচিত গীতটি এবার কন্ঠে ফেরে তাঁর,

" এমন দিন কি হবে মা তারা।
যবে তারা তারা তারা বলে তারা বেয়ে ধরবে ধারা।।" 

সর্বাণী দূয়ারপ্রান্ত থেকে অপসৃয়মান আলোকদ্যূতিটিকে মাতৃনামের ধারায় ভাসতে ভাসতে অভীষ্টপথে চলে যেতে দেখেন। তার চোখের কোণে দুটি অশ্রুকণা সদ্য ঊষার শিশিরবিন্দুর মতই।

গঙ্গাবক্ষে তখন পূর্ণ জোয়ার। কুমারহট্টের এই ঘাটটি সাবর্ণগোত্রীয় রায়চৌধুরিদের নির্মিত। একটি একটি করে সিঁড়ি পার হয়ে এক্ষণে ভরা গঙ্গায় নামেন সাধক -কবি। 
জলের মধ্যে স্রোতের টানটি আজ প্রবল। প্রসাদ নিশ্চিন্ত মনে ব্রহ্মময়ীর মূর্তিটি বিসর্জন দিতে চলেছেন জলের মধ্যভাগে। গঙ্গোদকের পূণ্য স্পর্শে ক্রমেই ব্রহ্মলীন হয়ে যাচ্ছেন তিনি। প্রথম দুটি ডুব দিয়ে সবে উঠলেন। সমগ্র কৃষ্ণকায় শ্মশ্রুগুম্ফ ও বৃষস্কন্ধ স্পর্শকরা দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশরাজি সিক্ত এখন। তাঁর চক্ষুদুটিতে পরমপ্রশান্তির ছোঁয়া। তাঁর সাধের ব্রহ্মময়ীর মূর্তিটি ভাসতে ভাসতে এবারে জলের গভীরে নিমজ্জিত হতে চলেছে। সহাস্য প্রসাদ তপোভূমির উচ্চমার্গে আগেই প্রবেশ করেছেন রাত্রিযামে। ভববন্ধন খন্ডন করে ভাবজগতে চিরবিলীন হবার পূর্বে তিনি শেষবার গেয়ে ওঠেন,

" তিলেক দাঁড়া ওরে শমন,
বদন ভ’রে মাকে ডাকি,
আমার বিপদকালে ব্রহ্মময়ী,
আসেন কি না আসেন দেখি "

অন্তিমডুবটির পর কালাকালের জলতরঙ্গে প্রসাদের জীবন ভেসে যায় মাতৃনামের বৈতরণীতে। 

ধন্য কবি ! ধন্য তোমার ঐশী সাধনা।
..............................................
 

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি
 

 
 
 

কবিতা -আজ অসময়ে, রাই - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

  আজ অসময়ে, রাই

শ্যামাপ্রসাদ সরকার
 
 

তর্জনী দেখিয়ে কতবার বলেছ
আমায় অযথা চলে যেতে...
গেট ছাড়িয়ে কৃষ্ণচূড়ার ডালপালায়
কেন এত মায়া তবে রেখে দিতে গেলে....

অসমাপ্ত কাহিনীর পাতাগুলো ছিঁড়ে
কেন বারবার চলে যেতে যেতে
বিষণ্ণ গ্রীবায় মেখেছ সেই গৈরিক রোদের আদর!

যতবার চৌকাঠ পার করে,
যেতে গেছি! অপার্থিব ডাকে
সাড়া দেব বলে সেই ক্ষণিকের চাহনিটুকুই 
ফেরার হয়েছে নিয়তির মত।

সকালের রাধাচূড়ায় যে পথ 
ঢেকে দিতে কখনো অঙ্গরাগের বাহানায়....
সে পথের প্রতিটা বাঁকেই আছে অর্গলহীন বন্ধন।
সেখানে  প্রিয় নামটিতে শুধু আটকে গিয়েছি
একই দিনে জন্মের মতন যদি মৃত‍্যুও এসে আসঙ্গ চায়?

তখনো কি ফেরাবে বল রাই, 
তখনো কি ফেরাবে আমায়?
.............................
 

 

নৈঃশব্দের চূড়ায় - শ্যামাপ্রাসাদ সরকার

 

নৈঃশব্দের চূড়ায়
শ্যামাপ্রাসাদ সরকার 
 

        বিরাট একটা পাঁচিল। দূর থেকে দেখলে জেলখানারর কথা মনে পড়ে যাবে। তারপর একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা আজও শহরের সমস্ত কোলাহলের সীমানা পেরিয়ে চুপ করে টিকে আছে। আসলে চারপাশটাই বদলে গিয়েছে অনেকটা। এখন শহরের আশেপাশে তেমন চিল-শকুনের দেখা মেলে না।
কিন্তু একটা সময় তারাও এখানে অপেক্ষা করে থাকত। কখন একটি মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির লোকেরা পল-বিয়ারারের দলের হাতে সেটিকে নীরবে তুলে দেবে সেই মিনারের চূড়ায়। আর তারপর সেই মৃতদেহের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসবে মাংসাশী পাখিরা। তাদেরডানার ঝাপটে আর ক্ষুধার চিৎকারে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এখনতো আর চিল-শকুনেরা আর অপেক্ষা করে থাকে না। মৃতদেহও আসে না বললেই চলে। নওরোজজী দুকানওয়ালাদের মত শ' তিনেক পার্সী পরিবার টিকে আছে এই কলকাতায়। হ্যাঁ, বললে কি কেউ মানবে এই সেদিন পর্যন্ত কলকাতা শহরেই এক লক্ষ পার্সি নাগরিক বাস করত। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির বদান্যতায় কলকাতা তখন সদ্যযৌবনা। কত জাতের বর্ণময় লোকের সমাহার তখন আর ততই বিচিত্র তাদের ব্যবসা। সেই সময় অগ্নি-দেব আহুর মাজ্দা র উপাসক পার্সিরাও এল কলকাতায়। বোম্বাই, সুরাটের পর জাঁকিয়ে বসল তিলোত্তমায়। আগে থেকেই ধনে-বিদ্যায়-ঐশ্বর্যে এগিয়ে ছিল সকলের থেকে। পসার জমিয়ে আরওবড়লোক হয়ে উঠল তারা।
পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি সুরাট থেকে কলকাতা এসেছিলেন ১৭৬৭ সালে। কলকাতায় তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল একাধিক এন্টারপ্রাইজ। তবে বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে তাঁদের বেশি সময় লাগেনি। অনেকের তো পদবীর শেষে ‘বেঙ্গলি’ শব্দটাও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেমন করে পেশা বা ব্যবসাভিত্তিক ভাবে
' বাটলিওয়ালা', 'দারুওয়ালা', 'মিস্ত্রী এসব পদবী গুলো এসেছে।
*********
নওরোজজী দুকানওয়ালার বয়স এখন আশি ছুঁই ছুঁই। একা নির্জন একটা কামরায় সিনাগগ্ স্ট্রীটের ভেতরে তার পঞ্চাশ বছরের ভাড়া করা ফ্ল্যাট। তখন ভাড়া ছিল মাসে একশো দশ টাকা এতদিনে বেড়ে বারশো পঞ্চাশ। মালিক টালিক কেউ নেই। ফ্ল্যাটটা আদালতের রেজিস্টারের হাতে চলে গেছে তাও নয় নয় করে বছর দশেক হল। যে কোন দিন শমন পাঠিয়ে উঠিয়ে দিতে পারে। তাও নিজে নিয়ম করে রেন্ট কন্ট্রোলের অফিসে গিয়ে ভাড়া দিয়ে বেরোবার সময় রেভিনিউ স্ট্যাম্ন লাগানো রসিদটা পকেটে পুরতে পুরতে প্রতিবার একবার করে ভাবেন,
'যাঃ! এই শেষবার! সামনের মাসে বোধহয় আর আসতে হবেনা! '
নওরোজজীর জীবনেও যেমন ছুটির নোটিস আসতে দেরী করছে , তেমনি আদালতের ঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার শমনটাও আসব আসব করে এখনো আসেনি।
 
************
 
একা থাকাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে বলে হলদেটে দেওয়ালে বাল্বের আলোয় নিজের কাঁপাকাঁপা ছায়াটাকেও আজকাল পছন্দ হয়না যেন! এতরকমের মৃত্যু দেখেছেন যে, সে আজ সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
 
      নওরোজজীর একমাত্র ছেলে সোরাবজী গেল এয়ারফোর্সে চাকরী করতে । সেই তরতাজা তিরিশ বছরের ছেলে যখন প্লেন ক্র্যাশে মারা গেল তখন থেকেই আবার নতুন করে শূন্যতার সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বসা। ওই একবারই যা নওরোজজীর টাওয়ারে আসা হয়নি। নইলে তার আগে অবধি বাবা, মা, কাকা, ভাই, সোফিয়া...প্রতিটা প্রিয়জনকেই শেষবার নিয়ে এসে নিজের হাতে পল-বিয়ারারের হাতে জমা করে গেছেন। মাংসলোভী গৃধিণীদের ভুক্তাবশেষ হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে তারা। স্ত্রী সোফিয়া তো আগেই গেছিল। সোরাব তখন স্কুলে পড়ত। কাপড়ের ব্যবসায়ী রনি বিলিমোরিয়ার মেয়ে সোফিয়া যে কি করে নওরোজজীর প্রেমে পড়েছিল তা এক রহস্য বটে। অবশ্য তখন নওরোজজীও সুপুরুষ ছিল। পাক্কা ছ'ফুট লম্বা, হকি খেলা চেহারা আর টকটকে গায়ের রঙ। ওদের ছিল পোর্সেলিনের বাসন আর ফুলদানী তৈরীর একটা ছোট কারখানা। ট্যাংরা ছাড়িয়ে সে সব জায়গা তখন ধূ ধূ প্রান্তর একেবারে। বেশ ছিল কিন্তু দিনগুলো তখন। 
 
*********
 
      এরপর ছেলের বউ আফরিন একদিন সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দুবছরের ফুটফুটে নাতনি শিরিনকে নিয়ে। সে আবার সংসার পাততে চায়! নাঃ, নওরোজজীর এ বিয়েতে কোনরকম আপত্তি ছিল না ঠিকই তবে নাতনীটাকে দেখতে না পাওয়া আর সিনাগগ স্ট্রীটের চারটে দেওয়ালের চাপা একাকীত্বটাই যা শুধু গিলে খেতে আসত। নাতনীটার ফেলে যাওয়া ফিডিং বোতলটায় দুধের গন্ধও শুকিয়ে চড়া পরে গেছে কবেই।
এরমধ্যে তো একবার তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যাও করার কথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু না, ওষুধের স্ট্রীপটা খালি করতে আর শেষ অবধি সাহসে কুলোয়নি।
*********
শীতকালে হাঁপানির কষ্টটা বাড়ে। বুড়ো হওয়াটায় এটাই একটা অসুবিধা। বড্ড নড়বড়ে হয়ে যেতে হয়। বন্ধুবান্ধবের অধিকাংশই এখন সাদা কালো এ্যালবামের পাতা থেকে হাতছানি দেয়। সোফিয়াও ওকে ডাকে শুনতে পান! সোরাব ও যেন 'পাপা! পাপা! ' বলে সেইদিনগুলোর মত ট্রাইসাইকেলে চক্কর দেয়। এগুলোর কোনটাই যদিও চোখে দেখা যায়না। মনে হয় চারদিকের অনন্ত শূন্যতার মধ্যে এই ফিসফিসানিগুলোই বোধহয় বেঁচে আছে।
 
**********
 
     রোববার সকালবেলায় হাঁটতে হাঁটতে একবার টাওয়ারের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক অনেক বছর আগে, যখন বেলেঘাটার খালটাও ছিল না, তখনকার সেই নিদ্রিত নীরবতার চেহারাটা যেন টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে আজও থমকে আছে। আজকাল বোধহয় আর কেউ আসেনা এখানে। বিরাট পাঁচিলটা দূর থেকে দেখলে জেলখানার মত মনে হয়। তারপর সেটা পেরিয়ে একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা বৃদ্ধ নওরোজজীর মতই উদাস, একা, শূন্য আর নিশ্চুপ হয়ে আছে বহুদিনই।
পা টিপে টিপে ওপরটায় উঠে আসলেন নিজেই। কিছু সামান্য শুকনো হাড়গোড় পড়ে আছে বলেই হয়তো মৃত্যুর গন্ধটা কিন্তু এখনো বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
কতজনের অশ্রু আর স্মৃতির অবশেষ এখানে!
নিজের আসার সময় হলে তো আর টের পাবেননা মৃত্যুর সেই নিরবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা কেমন করে চিল শকুনের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়।
পল-বিয়ারার দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখন। আচ্ছা যদি সোফিয়া, পল, সবার সাথে এখানে একবার দেখা হয়ে গেলে প্রথমে কি বলে ডাকবেন নওরোজজী? তারা যদি আজ সামনে এসে দাঁড়ায় ওঁকে চিনতে পারবে আগের মতোই? সোরাবের দেহের কয়লা হয়ে যাওয়া টুকরোগুলোই মিলেছিল আর্মির কফিনের ম্যে। নয়তো সোরাবকেও তো যদি এখানে আনতে হত.....
আর এসব ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে বৃদ্ধ বসে থাকেন খানিক্ষণ। দুচোখের পাতায় যেন অন্ধকারের ডাক আসছে ধীর পায়ে।
সূর্যের আলো ঢেকে ততোক্ষণে লম্বা লম্বা ডানা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে অসংখ্য শকুন আর মাংসভোজী পাখির দল নেমে আসছে....
আরো নীচে....আরো নীচে......
আর তাদের ডানার ঝটপট শব্দে একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে নৈঃশব্দের চূড়োয়। 
......................
 
Shyama Prasad Sarkar 



অনুসন্ধান পর্ব - শ্যামাপ্রসাদ সরকার


অনুসন্ধান পর্ব

শ্যামাপ্রসাদ সরকার 


    কুমার শিলাদিত্য যখন দুইজন অমাত্য  লইয়া অরণ্যভূমির প্রান্তে আসিয়া পৌছাইলেন তখন সূর্য অস্তগামী প্রায়। এই অঞ্চলটি  স্থানেশ্বর হইতে প্রায়  সহস‍্র ক্রোশ দক্ষিণে এবং শ্বাপদসঙ্কুল বলিয়া দুর্নাম  আছে। যদিও সঙ্গের অমাত্য  দুইজন অতি বিশ্বস্ত, তবুও এই অসময়ে,  নিবিড়় অরণ্যপ্রান্তে কিছু দুশ্চিন্তার অবকাশ থাকিয়াই যায়। সামনে কুলুকুলু শব্দে বহিয়া চলেছে রঙ্গিলা নামের একটি স্থানীয় পূর্ববাহিনী নদী। এটি শেষ পর্যন্ত শোণ নদীতে গিয়া মিশিয়াছে। । ক্রমাগত দুইশত ক্রোশ পথ অশ্বচালনার পর  অধিক পথশ্রমে ও ক্ষুধায় তাঁরা কাতর হইয়া  সূর্যাস্তের পর থামিয়াছেন।

    বহুকাল পূর্বে সম্রাট অশোক একটি সুবিশাল রাজপথ রচনা করিয়াছিলেন। তাহার অধিকাংশই  আর্যাবর্তের বিভিন্ন নগরীর মধ‍‍্যে দিয়া প্রবাহিত হইলেও দীর্ঘদিন  এই অংশে লোকচলাচলের অভাব হেতু  তাহা অরণ‍্যের গ্রাসে পড়িয়া  লুক্কায়িত হইয়া গেছে। অরণ‍্যটির মাটীকে বর্তমানে সূর্যালোক  স্পর্শ করে না। 

    এই অরণ‍্যভূমিটি  বিপদসংকুল বলিয়া রাত্রিযাপনের জন‍্য তাঁহারা একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজিতেছিলেন। সহসা শুষ্ক পত্রের উপর দিয়া একটি প্রাণীর ধীর পদচারণার শব্দ শ্রুত হইল। কুমার তরবারিটি কোষমুক্ত করিলেন। তাঁহার অঙ্গরক্ষকদ্বয়  বসুদত্ত ও  শান্তশীল  একটি করে বাণ ধনুকে যোজনা করিয়া এদিকওদিক ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল।  ঘনসন্নিবিষ্ট বনচ্ছায়াটিতে  কোনও হিংস্র প্রাণীর গমনাগমনের শব্দ বলিয়াই বোধ হইতেছে।

    কিছুক্ষণ পর শব্দের উৎসটি ক্রমে নিকটে আসিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে জনহীন বনাঞ্চলে বন‍্যপশুর পরিবর্তে  চীরবস্ত্র পরিহিত এক বৌদ্ধ শ্রমণ ক্রমে গোচর হইলেন। শিলাদিত‍্য তাহা দেখিয়া তরবারি কোষবদ্ধ করিয়া ধীর পায়ে আগন্তুকের  দিকে করজোড়ে অগ্রসর হইলেন। বৃদ্ধ এই  শ্রমণের নাম ভদন্ত কারুণিক। সম্প্রতি বিক্রমশীলা মহাবিহার হইতে পূর্বদেশে আসিয়াছেন। গৌড়দেশে এখন ভয়ানক মাৎস‍্যন‍্যায় চলিতেছে। গৌড়েশ্বর  শশাঙ্ক ভয়ানক বৌদ্ধ বিরোধী হইয়া উঠিয়াছেন। তাই একের পর এক সঙ্ঘারামকে ধ্বংস করিয়া ধূলায় পরিণত করিতেছেন। ভদন্ত ও তাঁহার সঙ্গে আগত কিছু ভিক্ষু শিষ‍্য মিলিতভাবে  অতি গোপনে বৌদ্ধশাস্ত্রগুলির মধ‍্যে প্রধান  বোধিসত্ত্বাবদান ও মূলকল্পাবদানের দুটি প্রাচীন পুস্তিকাকে কোনওমতে রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছেন। এই  অরণ‍্যে পূর্বের সঙ্ঘাধ‍্যক্ষ দেবভূতির একটি ভগ্নপ্রায় বিহার এখনো টিকিয়া আছে। তাঁহারা গোপনে সেই বিহারেই অবস্থান করিতেছেন।
কুমারের পরিচয় পাইয়া ভদন্ত সঙ্ঘারামেই  তাঁহাদের রাত্রিযাপনের জন‍্য  অনুরোধ করিলেন। বলিলেন - " ভগবন্ বুদ্ধ  যেস্থানে অবস্থান করিতেছেন সেই স্থানে ব‍্যাঘ্রাদি পশুও সাধারণতঃ  মিত্রবৎ অহিংস আচরণই করিয়া থাকে!"


    শিলাদিত‍্য মনে মনে উৎফুল্ল হইয়া ভাবিলেন ভগ্নপ্রায় হইলেও বিহারটিতে এখনো যখন মনুষ‍্য বসবাস  করিয়া থাকে তখন সেই স্থলে সঙ্গীসহ রাত্রিযাপনের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ব‍্যবস্থা আর কিই বা হইতে পারে। অঙ্গরক্ষকদ্বয়কে তাঁহাদের  ঘোড়াগুলিকে লইয়া কুমার  তখন শ্রমণের অনুবর্তী হইলেন।

    বর্তমানে মালবরাজ দেবগুপ্ত ও গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক রাজনৈতিক মিত্রতায় আবদ্ধ। একদিকে গৌড়ের রাজধানী  কর্ণসূবর্ণ হইতে শশাঙ্ক যুদ্ধ জয়ের  নিশান উড্ডীন করিয়া উত্তরপথস্বামী হইবার উদ্দেশ‍্যে বাহির হইয়াছেন। অপরদিকে হুণ জাতীয় বর্বর দস‍্যুর দল দেশের পশ্চিম সীমান্ত হইতে পুনরায় আক্রমণ করিয়া দেশের শান্তি ভঙ্গ করিয়া এক ভয়ংকর অরাজকতার জন্ম দিয়াছে। স্থানেশ্বরের নরপতি মহামহিম রাজ‍্যবর্ধন বেশ কয়েকবার তাহাদের প্রতিহত করিলেও সম্প্রতি এক অন‍্যায় যুদ্ধে নিহত হইয়াছেন। কুমার শিলাদিত‍্য তাঁহারই কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তাঁহার অপর নাম হর্ষবর্ধন। তাহাদের একটি ভগিনীও আছে। সে তাহার ভ্রাতাদের বড় প্রিয়। হর্ষ তাহাকে রাজ‍্যশ্রী বলিয়া ডাকিয়া থাকে। বৎসরকাল পূর্বে মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার সহিত সাড়ম্বরে রাজ‍্যশ্রীর বিবাহ হইয়াছিল। কিন্তু হুণদের সহিত যুদ্ধে রাজ‍্যবর্ধনের সহিত সেও নিহত হইয়াছে। শোনা যায়  মালবরাজ রাজ‍্যশ্রীকে বন্দি করিয়া বলপূর্বক কারাগারে নিক্ষেপ করিবার সময় এক চতুর পরিকারিণীর সাহায‍্যে সে একাকী পলায়ন করিয়াছে। 
তাহার পর হইতে রাজ‍্যশ্রীর কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নাই।

    হর্ষ ছদ্মবেশে ভগিনীর সন্ধানে বহু স্থান ঘুরিয়া শেষে বিন্ধ‍্যাচলের এই অরণ‍্যে আসিয়া উপনীত হইয়াছেন।  পথিমধ‍্যে তাহাদের সহিত এক নিষাদের  সাক্ষাৎ হইয়াছিল। সপ্তাহপূর্বে এক ভদ্রবেশী সুন্দরী  রাজকন‍্যাকে সে এই পথে ভীতা ও উদভ্রান্তের ন‍্যায় ছুটিয়া যাইতে দেখিয়াছিল। তাহা শুনিয়া  হর্ষের অনুমান হইয়াছে যে  ওই পলায়নকারিণীই আসলে রাজ‍্যশ্রী।

    ভদন্ত কারুণিক ও তাঁহার সঙ্গীগণ এই ঘন বনাঞ্চলেও গোধূম চূর্ণ ও ঘৃত ব‍্যবহার করিয়া একপ্রকার গোলাকৃতি খাদ‍্যবস্তু কুমার ও তাঁহার সঙ্গীদের জন‍্য পরিবেশন করিলেন আর  পানীয় হিসাবে তাহার  সহিত একটু ঘন ছাগদুগ্ধ। শশাঙ্কের অত‍্যাচারে মাসাধিককাল তাঁহারা অতি স্বল্পাহারে তাঁহাদের  রসদটি বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। এর অধিক সঙ্ঘারামটিতে  রাত্রিকালে অপর  কোনও খাদ‍্যবস্তুর আয়োজন করা বর্তমানে সম্ভবপর নহে। 

    কুমার শিলাদিত‍্য তাঁহাদের আতিথেয়তায়  কৃতজ্ঞতা জানাইয়া অবশেষে  রাজ‍্যশ্রীর প্রসঙ্গটি উত্থাপন করিলেন। ভদন্ত শ্রমণ বৃদ্ধ হইয়াছেন  ও সদাই তদ্ভাবে থাকেন। এরূপ কোনও রমণীকে তিনি এ অরণ‍্যে প্রবিষ্ট হতে অথবা নিষ্ক্রান্ত হইতে দেখেন নি। কিন্তু একজন ভিক্ষু, তাহার  নাম সম্বুদ্ধ সে কহিল যে এক সুন্দরী রমণীকে গতকল‍্যই সে অরণ‍্যের ভিতর কাষ্ঠ আহরণের সময় দেখিয়াছিল বটে। বনের পথে এইরূপ সুকন‍্যাটিকে দেখিবামাত্র সে আশ্চর্য হইয়াছিল। ভিক্ষু অভয়বাক‍্যের সহিত  তাহাকে ডাকিলেও রমণীটি তাহার কোনও উত্তর না দিয়াই ছুটিয়া অন‍্যত্র চলিয়া যায়। 

    কুমার তাহা শুনিয়া আশাহত হইয়া  বিমর্ষ চিত্তে আহার করিতে লাগিলেন। বসুদত্ত তাঁহাকে নিশ্চিন্ত করিবার জন‍্য বলিল কাল প্রাতেই অরণ‍্যের প্রতিটি কোণ তাহারা সকলে মিলিয়া খুঁজিয়া দেখিবে। রাজ‍্যশ্রীকে উদ্ধার না করিয়া তাহারা স্বভূমিতে ফিরিবে না। 

***********
    ভগ্নপ্রায় সঙ্ঘারামটির তোরণদ্বারে ভগবন্ বোধিসত্ত্বের একটি বিশালাকার একটি শায়িত মূর্তি রক্ষিত আছে। কুমার সেই মূর্তিটিকে দীপ হস্তে তিনবার প্রদক্ষিণ করিয়া তাঁহার  প্রার্থনা জানাইলেন। কনিষ্ঠা ভগিনীর কোনও অনিষ্ট হইলে তিনি নিজেকেও ক্ষমা করিতে পারিবেন না। কুমার  নিজেও একজন বৌদ্ধধর্মানুরাগী। স্থানেশ্বরের প্রাসাদে বৌদ্ধ শাস্ত্র মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের একটি হস্ত লিখিত প্রাচীন পুস্তিকা তাঁহার সংগ্রহে আছে। সম্প্রতি মহাচীন থেকে এক পরিব্রাজক বুদ্ধের জন্মভূমি দেখিতে আসিয়াছেন। তাহার নাম ' য়ুয়াং ছাং'। কুমারের অতিথিশালায় তিনি কয়েকমাস অতিবাহিত করিয়া বুদ্ধভূমির বিবরণ লিখিতেছেন। তিনি ভাবিলেন রাজ‍্যশ্রীর সন্ধান পাইবার পর  ভদন্ত কারুণিক ও তাঁহার সঙ্গীসাথীদের স্বভূমিতে লইয়া যাইবেন। ভগবন্ তথাগতের প্রেম ও মৈত্রীর পরম বাণীর প্রচারক হইয়া  ও তাঁহার  রক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতা করিতে পারিলে তিনি নিজেও ধন‍্য বোধ করিবেন।

    পরদিন সূর্যোদয়ের পর বেশ বেলা করিয়া কুমারের নিদ্রাভঙ্গ হইল। পক্ষকালের পথশ্রম ও মানসিক অবসন্নতা তাঁকে ক্লান্ত করিয়া দিয়াছে। এমন সময় ভিক্ষু সম্বুদ্ধ আসিয়া সংবাদ দিল যে অরণ‍্যের পূর্বদিকে এক রমণী চিতা সাজাইয়া অগ্নি প্রস্তুতি করিতেছে। সকলের শীঘ্রই সেইস্থলে এই মুহূর্তে গমন করিবার  প্রয়োজন।  আর দ্বিরুক্তি না করিয়া কুমার  শিলাদিত্য বসুদত্ত ও শান্তশীলের সহিত ভিক্ষু সম্বুদ্ধকে সঙ্গে করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে দ্রুত অরণ‍্যভূমির পূর্বপ্রান্তের উদ্দেশ‍্যে  নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

    স্বামীর মৃত‍্যুর পর রাজ‍্যশ্রী অত‍্যন্ত অসহায় বোধ করিতেছিল। জ‍্যেষ্ঠভ্রাতা ও পতির যুগপৎ নিধন তাহাকে জীবনের প্রতি বীতরাগ করিয়া তুলিয়াছে। সে স্থির করিয়াছে প্রায়োপবেশনের পথে প্রাণ ত‍্যাগ করিবে। রাজ‍্যশ্রী যৌবনবতী। মালবের কারাগারে তাহার কোনও অনিষ্ট না হইলেও অরণ‍্যে দস‍্যু আর তস্করের অভাব নাই। তাহাদের হাতে ভ্রষ্টা হইবার চেয়ে মৃত‍্যুই শ্রেয়। তাই সে  অরণ‍্য হইতে  কাষ্ঠ ও শুষ্ক পত্রাদি সংগ্রহ করিয়া চকমকি প্রস্তরখন্ড দিয়া সবেমাত্র অগ্নি জ্বালাইতে যাইবে এমন সময় সে অশ্বক্ষুরধ্বনির সাথে কুমারের কন্ঠস্বর শুনিয়া সহসা চমকিয়া উঠিল। তাহার হস্তধৃত প্রস্তরখন্ডদুটি মাটিতে পড়িয়া গেল। কুমার অশ্বপৃষ্ঠ হইতে নামিয়া দ্রুতবেগে ভগিনীর নিকট ছুটিয়া যাইলেন। কিছুক্ষণ অপলকে দুইজনে একে অপরকে দেখিতে লাগিলেন। তাঁহাদের দুইচক্ষু দিয়া অশ্রুর বন‍্যা বহিতে লাগিল। রাজ‍্যশ্রী হর্ষকে দেখিয়া আশ্চর্য হইল। সানন্দে ভ্রাতা ও ভগিনীর এই  মিলনদৃশ‍্য দেখিয়া বসুমিত্র ও শান্তশীল নেপ‍থ‍্যে জয়স্তুতি দিয়া উঠিল।

    স্থানেশ্বরের প্রজারা দীর্ঘদিন অভিবাবকহীন হইয়া থাকায় তাহারা কুমার শিলাদিত‍্যকে সিংহাসনে আসীন হইতে দেখিতে চাইল। কিন্তু হর্ষ এখনো ভ্রাতৃশোক ভুলিতে পারেন নাই। রাজ‍্যশ্রীকে যদিবা ফিরিয়া পাইলেন তবুও সে কৃচ্ছসাধনে জীবন অতিবাহিত করিতেছে। সে গৈরিক চীরবস্ত্র পরিধান করে ভিক্ষুণীর ন‍্যায় তথাগতের স্মরণাগতা। বর্তমানে সে স্বহস্তে ছাগচর্মের উপর  শতসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতার একটি অতিপ্রাচীন ও প্রায়বিলুপ্ত পুস্তিকার  নকল করিতেছে ও তাহার টীকাভাষ‍্য লিখিতেছে। ভদন্ত কারুণিক ও ভিক্ষু সম্বুদ্ধ  কুমার হর্ষের নিকটে আজকাল সুরক্ষিত হইয়া  স্থানেশ্বরেই অবস্থান করিতেছেন।
 গৌড়েশ শশাঙ্ক গুপ্তঘাতকের হাতে সদ‍্য নিহত হইয়াছেন। এই মুহূর্তে দেশের বাতাবরণ কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হইয়া উঠিতেছে। রাজ‍্যশ্রীও  প্রত‍্যহ চৈনিক পরিব্রাজক ' য়ুয়াং ছাং' এর সহিত তাঁহাদের বৌদ্ধশাস্ত্রালোচনায় অংশ গ্রহণ করিতেছেন। ভদন্ত কারুণিকের সহায়তায় 
'য়ুয়াং ছাং' চীনাভাষায় একটি বুদ্ধভূমির  বিবরণী লিখিতেছেন।  তিনি অঙ্গীকার করিয়াছেন যে সেই বিবরণীতে তাঁহার দৃষ্ট সকল অভিজ্ঞতার ঘটনাই বিবৃত থাকিবে। 
একদা 'য়ুয়াং ছাং' রাজগৃহে একদল দস‍্যূর হস্তে ধৃত হইয়াছিলেন। তাহারা তাঁকে নরবলি দিবার জন‍্য যূপকাষ্ঠেও আরোহণ করিয়াছিল। হঠাৎ একজন দস‍্যু দেখিতে পায় যে  তাঁহার বাম  হস্তের কনিষ্ঠা অঙ্গুলিটির উপরিভাগটি খন্ডিত। উৎসর্গীকৃত বলিটির খুঁত থাকিলে তাহা দেবকার্যে গৃহীত হয়না। তাহারা তখন পরিব্রাজকের পেটিকা হইতে স্বর্ণ ও রৌপ‍্যমুদ্রাগুলি কাড়িয়া লইয়া তাঁহাকে শেষঅবধি নিষ্কৃতি প্রদান করে। 
আজ সন্ধ‍্যায় তাহাই বিস্ফারিত মুখে উপবিষ্ট শ্রোতৃমন্ডলকে তিনি সেই কাহিনী শুনাইতেছিলেন। 
হর্ষ শুনিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন -  
" এই অরাজকতার হেতু আসলে দারিদ্র। গৌড় ও মগধের ইন্দ্রিয়প্রবণ রাজন‍্যগণ প্রজাদিগকে বিবিধ করভারে জর্জরিত করিয়া রাখিয়াছে। তাই অন্ত‍্যজ শ্রেণীর মানুষগুলির কেহ দস‍্যূতা বা অন‍্য কুপ্রবৃত্তির বলে জীবনধারণ করিতে বাধ‍্য হয়। ইহার আশু প্রতিকার  করিতে হলে সমগ্র আর্যাবর্তকে পুনরায় একটি চন্দ্রাতপের নীচে আনিয়া  সুশাসনের প্রচলন ভিন্ন আর উপায় নাই।" 

    দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হইবার পর আজ মহামহিম রাজাধিরাজ শ্রী হর্ষবর্ধন শিলাদিত‍্য সমগ্র আর্যাবর্ত অধিকার করিয়া মাতৃভূমিতে প্রত‍্যাবর্তন করিয়াছেন। অমাত‍্য নাগানন্দ তাঁহাকে 'সকলোত্তপথনাথ' বলিয়া সর্বসমক্ষে ঘোষণা করিয়া জনমানসে তাঁহার  বীরগাথা প্রচার করিতে উদ‍্যত। হর্ষ স্বয়ং আজ বড় প্রসন্ন। বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশেষে ভ্রাতৃহত‍্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়া তিনি সিংহাসনে আরোহণের পরই বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ করিবেন বলিয়া মনস্থির করিয়াছেন। সম্প্রতি নালন্দা মহাবিহারের উন্নতিকল্পে তিনি একলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা সহ ভদন্ত কারুণিককে সেখানে প্রেরণ করিয়াছেন। এইবার  নালন্দাকে জ্ঞান ও সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসাবে তিনি গড়িয়া তুলিবেন। তাঁহার ভগিনী রাজ‍্যশ্রীও এই কর্মযজ্ঞে যোগদান করিতে ইচ্ছুক। তাহার অবশিষ্ট জীবন সে তথাগতের চরণে সমর্পণ করিয়াছে। 

    হর্ষ প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে এক মহাদানেসম্মেলনের  আয়োজন করিলেন। এই স্থলটি অতি প্রাচীন ও মাহাত্ম‍্যপূর্ণ। অবলোকিতেশ্বরের প্রকান্ড মূর্তিটির সামনে আজ তিনি নতজানু হইয়া বসিয়াছেন। তাঁহার কোনরূপ ভেদবুদ্ধি নাই। চতুবর্ণের কেহই অপাঙক্তেয় নন এমনকি বহু জৈন ও নাথযোগী সন্ন‍্যাসীগণও তাঁর নিকট হইতে স্বর্ণ, বস্ত্র ও তন্ডুল লাভ করিতেছে। প্রসন্ন বদনে হর্ষ ও রাজ‍্যশ্রী দানসামগ্রী লইয়া প্রতীক্ষারত। প্রাগজ‍্যোতিষরাজ ভাস্করবর্মার সহিত হর্ষবর্ধন  মিত্রতা স্থাপনের পর তাঁহাদের  সৈন‍্যজোট বৃদ্ধি পাইয়াছে।  বন্ধুত্বের প্রীতি স্বরূপ একশত রণনিপুণ রাজহস্তী ও স্বর্ণাদি তিনি মিত্রবরকেও উপহার হিসাবে  প‍্রেরণ করিয়াছেন। পক্ষকালের অনুষ্ঠান এখন সমাপ্তির পথে। দানকর্ম সমাধা হলে এইবার রাজাধিরাজ শ্রী হর্ষবর্ধন শিলাদিত‍্য একটি বৌদ্ধ ধর্মমহাসম্মেলন আয়োজন করিবেন।ভাস্করবর্মাকে তখন নিমন্ত্রণ করিতে হইবে। আগামী দিনে ভগবন্ বুদ্ধের ঐশী মাহাত্ম‍্যকে প্রচার করিতে হর্ষ আগ্রহী। এক্ষেত্রে পূর্বজ সম্রাট প্রিয়দর্শী তাঁহার আদর্শস্বরূপ। 

    দানমঞ্চ হইতে দান সমাপন করিয়া নামিয়া আসিবার সময় হঠাৎ  এক গলিতদেহ কুষ্ঠরোগী তাঁর সম্মুখে আসিয়া ভিক্ষা যাচনা করিল। এক্ষণে সকল সামগ্রী অপ্রতুল হইয়া যাওয়ায় তিনি স্বয়ং লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। পরক্ষণে কি ভাবিয়া  ভগিনীর নিকট হইতে একটি চীবর চাহিয়া লইয়া পরিধান করিয়া তাঁহার বহুমূল‍্যবান রত্নখচিত রাজপোষাকটি তাকে দান করিয়া দিলেন। তাহা দেখিয়া সমবেত জনতা ধন‍্য ধন‍্য করিয়া উঠিল। 

    প্রত‍্যাবর্তনের সময় হর্ষ রথে আরোহণ করিতে যাইবেন  সময়  দূর হইতে একজন পরিচিত মানুষ দৃষ্ট হইল। ইনি হর্ষের অন‍্যতম মিত্র বাণভট্ট। হর্ষ বাণকে  দেখিতে পাইয়া অত‍্যন্ত প্রীত হইলেন। বাণভট্ট কহিল সে  হর্ষবর্ধনের সকল কীর্তির কথা অবগত।একটি বিশেষ কার্যে কয়দিন ব‍্যস্ত থাকায় দানসম্মেলনে সে আসিতে পারে নাই।  দুই মিত্র পরস্পরকে আলিঙ্গন করিলেন। হর্ষবর্ধনের জন‍্য সে একটি উপহার আনিয়াছিল। বহুযত্নে মলমলের বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া তাহা বুকে করিয়া সে এতকাল রক্ষা করিয়াছে। আজ বিজয়ী ও দানবীর বন্ধুবরকে স্বহস্তে তাহা উপহার প্রদান করিয়া  সে যুগপৎ আনন্দিত ও উত্তেজিত। পেটিকাটি খুলিয়া রাজাধিরাজ শ্রী হর্ষবর্ধন শিলাদিত‍্য সেই পরম উপহারটি দেখিয়া অত‍্যন্ত আশ্চর্য হইলেন।  বাণভট্ট 'হর্ষচরিত' নামে একখানি সংস্কৃতে কাব‍্যরচনা করিয়া আনিয়াছে। আজ উপযুক্ত দিবসে তাহা হস্তান্তর করিয়া সে তাহাদের মিত্রতাকে সম্মানীত করিল।

    রপর প্রয়াগের তটরেখা ধরিয়া হর্ষবর্ধনের রথের ঘর্ঘর শব্দ ক্রমশ দূর হতে দূরে মিলিয়া যাইতে যাইতে একসময়  মহাকালের চরণধ্বনির সাথে লয় হইয়া গেল। 

    রক্তমাংসের মানুষ তাহার নশ্বর দেহ ত‍্যাগ করিয়া একদা চলিয়া যায় ঠিকই কিন্তু কীর্তিমানের কীর্তি কালের মন্দিরায় সর্বদাই অনন্তকাল ধরিয়া বাজিতেই থাকে ।

সমাপ্ত


SHYAMAPRASAD SARKAR