যা ছোঁয়া যায় না - রুমেলা দাস


যা ছোঁয়া যায় না

রুমেলা দাস





    ‘উফঃ কী দারুণ! আমি তো জাস্ট ভাবতে পারছি না। ছাদে উঠলেই পাহাড় দেখতে পাওয়া যায়? কোনটা মুসৌরির আর কোনটা ধনৌলটির আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না; ওয়াও কী কালার। হাল্কা সবুজ, গাঢ় বাদামি, স্যাপ গ্রীন, কচি পাতার মেশামেশি। আর ওই যে পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘগুলো আটকে ওগুলো কি সত্যিই মেঘ? নাকি কুয়াশা? এই বলো না, বলো না ওই পাহাড়ে কবে যাচ্ছি আমরা?’
‘এই তো আজই, এক্ষুণি।‘

    দু’হাতে বেড় দিয়ে তিস্তার পাতলা কোমরটা ধরে হ্যাঁচকা টানে কাছে নিয়ে নেয় ঋক। ছাদের দেওয়ালে ঠেসে ধরে ঝুঁকে পড়ে তিস্তার ঠোঁটের কাছাকছি।
‘ইশ অসভ্য ছাড়ো। কী যে করো না। ছাদে দাঁড়িয়ে এইসব? কেউ দেখে নেয় যদি?’
‘নিলে নিক মেরি জান। বাড়ি থেকে এত দূরে। এখন আর তোমার নাখরা শুনব কেন?’
‘না ঋক। আজ আমি ভীষণ টায়ার্ড। বুঝতেই পারছ সারারাত জার্নি করেছি এতটা পথ। দিল্লি থেকে দেরাদুন। কম নাকি পথ? টানা ৫-৬ঘন্টা। তারপর বাসে একটা যা গামবাট বসেছিল পাশে। সারাক্ষণ নাক ডেকে গেছে। একটুও ঘুমাতে পারিনি জানো। মাথাটাও ধরে আছে। এখন খুব ঘুম পাচ্ছে।‘ ঋককে সরিয়ে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোয় তিস্তা।
‘বাহ, এইতো পাহাড় দেখেই বুক চলকে উঠেছিল। পাগল পাগল হচ্ছিলে। আমি ভাবলাম বুঝি...
‘হুম পাগল তো হয়েই আছি। কিন্তু সবুরে মেওয়া ফলে এটাও তো জানো। আর আমাদের এখনও স্ট্যাম্প লাগেনি সে খেয়াল আছে?’
‘বকবাস বন্ধ করো। তুমি সেই বুড়ি পিসি-ই রয়ে গেলে।‘
    
    ঋক আরও একবার ঘন হয়ে আসে। চুল সরিয়ে তিস্তার কাঁধে ঠোঁট ডোবায়। একটা অচেনা গরম নিঃশ্বাস তিস্তার গোটা শরীরের রোমকূপে রোমকূপে সাপের মত কিলবিলিয়ে ওঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। ঋক পেছনদিক থেকে ডানহাত দিয়ে খামচে ধরার চেষ্টা করে তিস্তার নাভির নিচের অংশ।
    
    অস্বস্তি লাগে তিস্তা-র। শরীরের চাহিদা ঋকের বরাবরই বেশি। সম্পর্কটা দশ বছরের। প্রথমদিকে কলকাতা থাকাকালীন অনেকবারই ঋক কাছে আসার চেষ্টা করেছে। তিস্তা বারবার আটকেছে। মনে হত এসব টিনএজের নাদানি। ওরকম একটু আধটু হয়েই থাকে। বাড়িতে যতক্ষণ না জানছে ততদিন। ভয় ভয় ভাবটা এখনও যে ওর পিছু ছাড়েনি। আর তাছাড়া... নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে তিস্তা বলে,
‘ঋক তুমি না; একটুও বুঝতে চাও না। আমি তো সাতদিন আছি। এখনই...

    তরতরিয়ে একতলায় নেমে আসে তিস্তা। নামতে নামতে একবার পেছনের দিকে তাকায়। সকালের লাল আলো মাখা সূর্যটা এক আঁচলা তিরছি রোদ ফেলেছিল হাফ ল্যান্ডিংটায়। সেই হলদেটে আলোতেই দেখেছিল, ঋক একদৃষ্টে ওরই দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টিটা একদম আলাদা। এই ঋককে ও চেনে না। 
‘ক্যায়া হুয়া? আতে হি দোস্ত কে সাথ ঝগড়া হুয়া ক্যায়া?’
এইরে তিস্তা একেবারে পড়বি তো পড় ঋকের ল্যান্ডলর্ডের মুখোমুখি। বাড়িতে ঢুকতেই যদিও আলাপ পরিচয়ের পর্বটা সেরে নিয়েছিল। তিস্তা খুব তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তাই বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করেছেন। মুখে বেশ একটা খুশি খুশি ভাব এনে ও বলে,
‘নেহি নেহি..।‘
‘ক্যায়া সোচা। মেরে বাল ব্যায়সেহি সফেদ হো গ্যায়া? ইধার আও।‘

    বৃদ্ধা হাতের ইশারায় তিস্তা’কে ডাকেন। বয়স আন্দাজ সত্তরের কাছাকাছি। বাড়ি সমেত বাউন্ডারি বিশাল। দশ কাঠা তো হবেই কম সে কম। কলকাতায় এমন জায়গা পেলে তো বড়মাপের মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হয়ে যায়। দেরাদুনের ঘণ্টাঘর পেরিয়ে প্রায় ২-৩কিলোমিটার পর থেকেই সহস্রধারার এই মেন রোডে ঘনবসতি অতটা নেই। তাই ফাঁকা ফাঁকা। সে কারণেই জায়গাটা আরও বেশি মনে ধরেছে তিস্তার। কথায় কথায় জানতে পেরেছে ইনি ফ্যামিলি ছাড়া ভাড়া দেন না। নেহাৎ ঋক ভাল কথা ফাঁদতে পারে। বুড়িকে কিভাবে যেন রাজি করিয়ে ছাদের একটা ঘর ঠিক বাগিয়ে নিয়েছে। আবার তিস্তাকেও এই সাতদিনের জন্য হোটেল নয়, বুড়ির-ই একতলার একটা ঘরে ম্যানেজ করে দিয়েছে। অবশ্য ম্যানেজ করেছে বললে ভুল হবে। ঋক চাইছিলই তিস্তা ওর ঘরেই থাকুক। ল্যান্ডলেডি-ই তিস্তাকে নিজের ঘরের পাশে নিয়ে আসেন। 
‘ইয়ে লো বেটি, তুমহারা ঘার।‘ বৃদ্ধা বেশ বড়সড় একটা ঘরের দরজা খোলেন।
‘ওয়াও। থ্যাঙ্কু আন্টি।‘ চারদিকে চোখ বুলিয়ে হেসে মাথা নাড়ে তিস্তা।
‘ম্যায় তুমহারা আন্টি নেহি, দাদি কি এজ কি ।‘ 
আরও দু’একটা এদিক ওদিকের কথাবার্তা বলে বৃদ্ধা নিজের কাজে চলে যান।

    বাব্বা! ঘরখানা যা বিশাল। আর সামনে পাহাড় মেঘের যা কম্বিনেশন তাতে সাতদিন কেন? সতেরোদিন পেরিয়ে গেলেও মন আদৌ ফিরতে চাইবে কিনা সন্দেহ; ঋক যেন কী? এমন একটা অ্যাটমোস্ফিয়ারে মেজাজ খাট্টা করছে। আরে তাইতো? তিস্তা সেই কখন নিচে চলে এসেছে! ঋক এখনও নিচে নামল নাতো? তিস্তা কোন ঘরে আছে একবার দেখেও গেল না? বাবুর এত রাগ? মনে মনে নিজেকেই নিজে দোষে তিস্তা। সত্যি এতটা রুড বিহেভ করা উচিৎ হয়নি। এতদিন পর দেখা; একটু কাছাকাছি তো আসাই যায়। এই আটকে থাকার স্বভাবটা তিস্তার জিনগত। মা বাবা ছোট থেকে পাখি পড়ানোর মত করে বুঝিয়ে এসেছেন মেয়েদের চিরকাল সংযম থাকতে হয়। নাহলেই মেয়েরা লক্ষ্মীছাড়া। কত কষ্ট করে যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সে শুধু তিস্তাই জানে। অবশ্য দিল্লির কন্টেন্ট রাইটারের কাজটা ঋক-ই কলকাতা ছেড়ে দেরাদুনে আসার সময় ওর এক বন্ধুকে দিয়ে অফার করিয়েছিল। তারপর অনেক ভুজুং ভাজুং। তিস্তার নিজের দাদার ব্যাঙ্গালোরে চাকরির অজুহাত দেখিয়ে দিল্লি আসা। বাবা একটাই কথা এখনও বলে,
‘ছেলেদের যেটা মানায়। মেয়েদের সেটা মানায় না।‘
বোকা বোকা একটা কথা। তাহলে ঋকের বাবা-মা এতটা ফ্র্যাঙ্ক হয় কিকরে? তিস্তা জানে ঋকের বাড়িতে ওর কোনও বান্ধবী আসারও বাধা নেই। যত বাধা তিস্তার।
নাহ এভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট করা যাবে না। একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই কাল থেকে কোথায় কোথায় ঘুরবে একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলতেই হবে। আর আজ বিকেলে যদি টুকটাক একটু ঘুরে আসা যায়। তাহলেও মন্দ হয় না। ঋক স্টেশন থেকে আসবার সময় বলছিল। ছুটির অ্যাপ্লাই করে দিয়েছে অলরেডি। ঋক এখানে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সিনিয়র গ্রাফিক্স ডিজাইনারের পদে আছে। মাইনে মন্দ নয়। কাজের চাপ কম। আর দু’তিনটে বছর। তারপরেই মোটামুটি সেটল হয়ে বাড়িতে জানাবে। 

    ট্রলিটা ঘরের একপাশে রেখে তিস্তা বাইরে বেরিয়ে আসে। শীত শীত করছে। বৃদ্ধা বলেছিলেন, সবে জুলাই। কিন্তু এই পাহাড়ে বর্ষা থেকেই ঠান্ডার রেশ শুরু হয়ে যায়। আহ এখানকার স্থানীয় মানুষজন কী লাকি। তবে প্রাইভেট কোম্পানি বিশেষ নেই। নাহলে দেরাদুন নাম শুনে কবেই ঋক-কে বলেছিল তিস্তা যদি এখানেই একটা কিছু...
ফিনফিনে একটা হাওয়া চোখ মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে তিস্তার। বৃষ্টি নামবে নাকি? এইতো রোদ দেখল?

    একতলার ঘর ঘেঁষে একটা বটলব্রাশ গাছ দাঁড়িয়ে। লাল লাল খেকরাকাঠীর মত ফুলগুলো মেঘ মেঘ হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। রাতের ক্লান্তিটা একটু একটু করে চলে যাচ্ছে। সূঁচের মত জলের ফোটাগুলো একটার পর একটা হাত পায়ের খালি জায়গাগুলোয় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। তিস্তা হাতটাকে ছাতার মত করে ঘরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই বড় মাপের একটা কাক তীব্রস্বরে ডাকতে ডাকতে ডানা ঝাপটে চোখের নিমেষে এসে পায়ের নখ দিয়ে তিস্তার মাথার এক খাবলা চুল ছিঁড়ে নেয়। ঠোঁট দিয়েও হয়ত বা একবার ঠোক্কর দেয়।
‘আহঃ...

    চিৎকার করে ওঠে তিস্তা। মাথার তালু থেকে সারা শরীর আতঙ্কে কুঁকড়ে যায়। তুমুল জোরে নামে বৃষ্টিটা। প্রচন্ড শব্দ আর বৃষ্টির দাপটে তিস্তার গলার আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। আধভেজা হয়ে তিস্তা কোনওমতে ঘরে ঢোকে। মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। 
ঋক কোথায়? পাশের ঘরের দাদীজিই বা কোথায় গেল?
মন এত ‘কু’ ডাকছে কেন?
মা বারবার বলে,
‘কাকে ঠোক্কর দিলে অশুভ হয়।‘
কিন্তু...

    ‘বেব। খামোকা ঢিলে হয়ে বসে আছো। এরকম করে থাকলে যে রাস্তার মধ্যেই আমার ইঞ্জিনে ফুয়েল ফুরিয়ে যাবে।‘ কথাগুলো বলে হে হে করে দাঁত বের করছিল ঋক। বাইকে ব্রেক দিচ্ছিল বারবার। এইরকম স্মুদ ঢালু পাহাড়ি পথে যেগুলো একেবারেই বেমানান। তিস্তা যতই ভাবছিল ঋকের সঙ্গে নর্মাল বিহেভ করবে। ছেলেটা ততই যেন অসহ্য হয়ে উঠছিল। কি মনে করে দেরাদুন ঘুরতে এসেছিল আর এখন কি হচ্ছে?
দেরাদুন সাইড সিন করা নিয়েও একচোট মন কষাকষি হয়ে গেছে। মনটা ভালোলাগছিল না। কলকাতায় মা-কে ফোন করে ফেলেছিল রাতেই। মা তো কিছু একটা আন্দাজ করে বলে,
‘তিস্তা তোর বাবা অনেক ভরসা করে তোর জেদে বাইরে কাজ করতে পাঠিয়েছে। নিজের খেয়াল রাখিস। আর আমাদেরও। মন এলোমেলো হলেই তাঁকে স্মরণ করিস।‘
আলাদা করে আর কাকের কথাটা বলতে পারেনি তিস্তা। মায়ের প্রেশার। শুধুমুধু চিন্তা বাড়বে। সবকিছু মাথা থেকে হটিয়ে সকালে বৃষ্টি থামলেই ঋকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল। ঠিক কোথায় যাওয়া যায় এই ওয়েদারে। যা ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝেই।
শরীরটায় আরেকটু জুত করে তারপর মুসৌরি যাবে ঠিক করে। মাঝের এক দু’দিনে কাছাকাছি ঘুরলেও মন্দ হয় না। দাদীজি বলছিল, দেরাদুন শহর থেকে ৫কিমি দূরে মনোরম পরিবেশে তপকেশ্বর মহাদেবের মন্দির। একবার এখানে আসার সুযোগ হয়েছে যেকালে সেটা মিস করা উচিত হবে না। স্কন্দপুরাণে মেলে আচার্য দ্রোণ দ্বাপর যুগে এখানেই দ্রোনা গুম্ফাতে বাস করতেন। অজানা ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছেয় তিস্তার ভেতরটা শিশুর মত ছটফটিয়ে উঠেছিল। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে কখন যে ওর এই সুপ্ত আগ্রহটা চাপা পড়ে গেছে নিজেই জানে না। যা ঘটে যায়, তার নিচে যে কত রহস্য কত ছায়া মেঘের লুকোচুরি তা আধুনিক পৃথিবী কতটাই বা জানে? সেই ইতিহাস প্রেম তিস্তার বরাবরই। কলেজেও হিস্ট্রি পাস সাবজেক্টে রেখেছিল। কিন্তু ওই যে ছোট্ট থেকে বাবা-মায়ের নিষেধাজ্ঞা। 
‘মেয়েকে একা কোনও ট্যুরে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়ে সুন্দর। লোকের নজর লাগবে। একটা ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে?’
তাই ইতিহাস বিষয়টা নিয়েও তেমনভাবে হায়ার স্টাডি করা হয়নি।

    ঋক-কে আর চটিয়ে লাভ নেই। তিস্তা ওর পিঠে লেপ্টে দেয় নিজের শরীর। বুঝতে পারে ঋক পালসারের স্পিড করে দিয়েছে দ্বিগুণ। যাক ঋক যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাক ওকে।
    
    স্বাভাবিকভাবেই ঋক তিস্তার ধম্ম কম্মের ইচ্ছেকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। ওদের গন্তব্য শহর থেকে ৮কিমি দূরে টনস নদীর ধারে রবার্স কেভ। ঋক বলেছে এই সময়টায় নাকি ওখানে ফাটাফাটি মস্তি করা যাবে। ঋককে জড়িয়ে থাকলেও প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা কি এতই সহজ? 
তিস্তার বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল পথের দু’ধারে। পথের দু’ধারেই ল্যানটানা গাছের ঝোপ। বাংলায় আমরা একে পুটুশ ফুল বলি। আদরযত্নের তোয়াক্কা না করা এই বহুবর্ণের ফুলগুলো সারা ভারতেই দেখা যায়।
আরও কিছুটা এগোতেই বাঁয়ে পড়ে রবার্স কেভের রাস্তা। ‘রবার্স কেভ’ বা ‘গুচ্ছপানি’ একটা গুহা। একসময় কুখ্যাত ডাকাত সুলতান নাকি তাঁর দলবল নিয়ে এখানে লুকিয়ে থাকত তাই এই নাম। বেশ একটা রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ ফিল হয় নামটাতেই।

    তিরিশ মিনিট মতন চলার পর আচমকা ভয়ানক একটা ব্রেক কষে বাইক থামায় ঋক। উফঃ বুকের ভেতরটা আরেকটু হলেই হিম হয়ে যাচ্ছিল। পাজি ছেলে একটা! ঋকের পিঠে হালকা চাপড় মারে তিস্তা। 
‘জানেমন এবার তো একটু হাঁটি হাঁটি পা পা করতে হবে। এখানে পার্কিং।‘
এক নম্বরের ফাজিল ঋক। কথাগুলো এমন জোরে বলে পাশে চার-পাঁচটা ছেলের দল ওদের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে থাকে।
তিস্তা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ওকে চোখ দেখায়। 

    বাইক পার্কিং করতে করতেই একটা মিঠে হাওয়া দিতে শুরু করে। ওয়েদারটা ফাটাফাটি সন্দেহ নেই। কিন্তু মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাতেই তিস্তার মনটা কেমন করে ওঠে। সারাটা সকাল বেশ রোদ ছিল। এখন পশ্চিমের আকাশে একগোছা ধূসর মেঘ এসে জমা হচ্ছে। আর তার সঙ্গে হাওয়াটাও ওর ফিনফিনে রেশ কাটিয়ে বেশ জোরালো হয়ে উঠছে। বৃষ্টি তো এক আধঘন্টার মধ্যে নামবেই। ঝড়ও কি?
এতক্ষণে খেয়াল হল সন্ধে নামতেও আর বিশেষ দেরি নেই। অলরেডি বিকেল চারটে বেজে গেছে। আর বড় জোর একঘণ্টা...
‘উফঃ ডার্লিং আবার কি ভাবছ? আজ তোমাকে যা লাগছে না। পুরো মন্দাকিনি।’
ঋক আবারও বিশ্রীভাবে হাসছিল। কাছাকাছি এসে তিস্তার কোমরের কাছে যেখানে ক্যাপরীটা চাপ হয়ে আটকেছে সেখানে আঙুল দিয়ে খোঁচাচ্ছিল। 

    ‘অ্যাই ঋক। কি হচ্ছে... বলে তিস্তা চারপাশটা ঘাড় ঘোরাতেই দেখে হাত দশেক দূরে ওই ছেলেগুলো পেছন পেছন আসছে। কিন্তু এই ছাইলেপা আলোহীন পরিবেশেও তিস্তা স্পষ্ট দেখতে পায়; ওদের প্রত্যেকের চোখ যেন ধিকধিকিয়ে জ্বলছে। 

    কয়েক সেকেন্ড। আকাশ আরও ঘন কালো হয়ে আসে। গুরগুড়িয়ে মেঘ ডেকে উঠেই ঝমঝমিয়ে চারপাশ সাদা করে বৃষ্টি নামে। চোখ মেলে তাকানোরও উপায় নেই। ঋক তিস্তার হাতটা ধরে একটা বড় মাপের পাথরের আড়ালে দাঁড়ায়। আকাশ থেকে তো বৃষ্টি হচ্ছেই। কিন্তু তিস্তার পায়ের তলা যেন জমে যাচ্ছে। মাঝে ঝর্ণার পাগলপারা জলের স্রোত আর দুপাশে লাইমস্টোন ক্ষয়ে প্রায় ৬০০মিটার লম্বা গুহা তৈরি হয়েছে। কী ভয়ঙ্কর সুন্দর। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরা ছাড়া তিস্তার আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। প্রথমত বৃষ্টি, দ্বিতীয়ত রবার্স কেভের পাথরগুলো দেওয়ালের মত দুদিকে গজিয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু মাঝের অংশটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। খোলা আকাশের যাবতীয় বিপর্যয় অক্লেশে গুহায় প্রবেশ করতে পারে। আর ক্ষয়ে যাওয়া দেওয়াল পাথরে কোনও বিদ্যুতের যোগাযোগ নেই। সন্ধে হলেই নিয়মমত বন্ধ হয় কেভ। কেন যে এল এখানে? জুতো, চটি খুলে খালি পায়ে কেভে ঢুকতে হয়। কারণ জলের স্রোতে পায়ে জুতো রাখা বেজায় মুশকিল। সেসবের আর সুযোগ পেল কই? তার আগেই তো...
ঋক খুব কাছে থাকায় ওকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে তিস্তা। কিন্তু বাদবাকি সব নিকষ কালো। ঋক যেন ঠোঁট নেড়ে কি বলছে?

    জলের শব্দ তো বিপুল। কিছুই শুনতে পাচ্ছে না তিস্তা। এর মধ্যেই ভিজে কাক হয়ে গেছে। ঋক হয়ত আন্দাজ করেছিল। তিস্তার কানের কাছে মুখটা এনে চিল চিৎকার করে ওঠে,
‘কই জলদি করো, কুইক।‘ তিস্তা অবাক হয়ে তাকানোর আগেই ঋকের হাত তিস্তার ভেজা কুর্তির ওপর দিয়ে ক্রমশঃ পিষতে থাকে। তিস্তা ঠেলে ঋককে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। ঋক আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে একে একে কামড়ে ধরে তিস্তার গলা, বুকের নরম মাংসল।
বৃষ্টি তার দাপট বাড়িয়েছে আরও কয়েক দাগ। মনে হচ্ছে আরও কেউ যেন ওর চারপাশে। অনেক খুঁজেও অন্ধকার আর প্রচন্ড বৃষ্টিতে কিছু বোঝার উপায় নেই। ঋককে জোর করে সরিয়ে বোঝার চেষ্টা করার আগেই অন্ধকারের মধ্যেই ঋক অসম্ভব আর্তনাদ করে জলের মধ্যে ছপাৎ শব্দ করে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে আরও কতগুলো শরীর যেন তিস্তাকে ধরে টানা হ্যাঁচড়া করতে শুরু করে। 

    তিস্তা চিৎকার করতে থাকে। কাঁদতে থাকে। কিন্তু উন্মাদ প্রকৃতির খেয়ালিপনায় সবটাই চাপা পড়ে যায়। শরীর অবশ হয়ে পড়ে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসে স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধি। তবু মানুষগুলোর নিজেদের মধ্যে সামান্য কথাবার্তায় তিস্তা বুঝতে পারে,
‘ওরা একটু আগে দেখা ছেলের দলটা...
ঋক কোথায়?... ওর গলার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
তবে কি ও অজ্ঞান ...
কি করবে তিস্তা?
ভীষণ ভীষণ বাড়ির কথা মনে পড়ছে।
ও কি আর কোনওদিন বাড়ি ফিরতে পারবে?
ছেলেগুলো তিস্তাকে টানতে টানতে কোথায় একটা নিয়ে যাচ্ছে। আর পারছে না তিস্তা। গোটা শরীরটা ভিজে দুমড়ে মুচড়ে কাগজের মত দলা পাকিয়ে গেছে। তাও ওরা ছাড়ছে না। আরও আরও অন্ধকার চারদিক থেকে মৌমাছির মত ছেঁকে ধরছে। ওরা কি কেভের মধ্যে ঢুকছে। জানে না তিস্তা কিচ্ছু জানে না।
বিশ্রী উগ্র একটা গন্ধ যেন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে।

    সজোরে কঠিন কিছু একটার ওপর তিস্তাকে আছড়ে ফেলে লাফিয়ে উঠে আসে একটা শরীর। চারপাশের ছেলেগুলো চিৎকার করতে শুরু করে আর ঠিক তারপরই একটা পুরুষালি গলা গোটা কেভের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ইকোর মত কানের পর্দা প্রায় ফাটিয়ে দেওয়ার মত চিৎকার করে ওঠে। 
‘নিকলো... নিকলো কামিনো...
গমগমে আওয়াজটায় হাত পা সিঁটিয়ে এলেও তিস্তা খানিক বুকে বল পায়।
নিশ্চয়ই পুলিশ বা কেভের গার্ড...।

    তিস্তার ওপর উঠে আসা শরীরটা তখনও কোনও কিছু তোয়াক্কা না করেই তিস্তার জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করে দিয়েছে। আর তারপরেই প্রবল একটা ধাক্কা তিস্তার ওপর থেকে প্রায় হাওয়ার বেগে উপড়ে নিয়ে গিয়ে দূরে কোথায় ফেলে শরীরটাকে। বিশ্রী একটা গালাগাল দিয়ে ছেলেটা স্রোতের জলে শব্দ করে পড়ে যায়। বাকিদের মধ্যেও কেমন যেন ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এসবের মাঝেও যে তিস্তা নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এগোবে শরীরের সে ক্ষমতা কখন ফুরিয়ে গেছে। শুধু নাক জুড়ে লেগে রয়েছে বিকট এক গা গুলানো গন্ধ।

    হিসেবমত তিস্তা চোখ মেলেছিল পরেরদিন সকালে ম্যাক্স হসপিটালের বেডে। পায়ের গোড়ালিতে সামান্য ক্র্যাক আর চূড়ান্তভাবে মন থেকে ভেঙে পড়া তিস্তার কাছে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ছিল কালো দাগের মত।
কারা কিভাবে কিকরে ওকে কেভ থেকে উদ্ধার করে হসপিটালে ভর্তি করেছিল ও জানে না। নিজে থেকে জানতে চাওয়ার সব ইচ্ছেই যে মরে গেছিল ততক্ষণে। ইচ্ছে হয়নি ঋকের কথা জানারও। কিন্তু না জানতে চাওয়ার মধ্যেই এমন কিছু থেকে যায় যা মানুষকে আপনা আপনিই এসে ধরা দেয়। কথাগুলো বলেছিল হাসপাতালেরই এক স্টাফ।
‘... সুলতান। মোঘল আমলের কুখ্যাত ডাকাত। যে তার দলবল নিয়ে ডেরা করেছিল উত্তরের ওই অংশে। দলেরই এক শাকরেদ কোনও এক সময়ে আশেপাশের গ্রাম থেকে মেয়ে তুলে এনে গুহার মধ্যে লুকিয়ে ধর্ষণ করত। তাকে সাথ দিত বাকিরাও। কিন্তু একদিন কোনওভাবে এই কুকর্মের কথা জানতে পারে সুলতান স্বয়ং। হ্যাঁ লুঠ সে করত বটে। কিন্তু কেন জানে না সঙ্গীদের এই অন্যায় সে মেনে নিতে পারেনি। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত সবকটাকে দল থেকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অন্যায় কি এত সহজে হেরে যায়? প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে দলের সর্দারকে বহিষ্কৃত সঙ্গীরা হত্যা করে। সুলতানের দল ভেঙে যায়। কিন্তু গুহা রয়ে যায়। আর রয়ে যায়... সুলতান...
নারীর অসম্মান সে সইতে পারে না আজও।
এর আগেও নাকি দু’চারবার ছেলেরা ওই নির্জন গুহায় কুকর্ম করতে গিয়ে সুলতানকে অনুভব করেছে।‘
একথা স্থানীয় অনেকেই বিশ্বাস করে। আর এই বিশ্বাস থেকেই কেভের মধ্যে বাইরের দুনিয়ার ঝাঁ চকচকে আলো বা বাণিজ্যিক কোনও কাঠামো গড়ে তোলেনি আজ পর্যন্ত কেউই। 
এসব কি সত্যি?
বিশ্বাস করতে কোথাও যেন বাধে তিস্তার। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় যে মানুষটাকে ভালবেসে ভরসা করে জীবনের এতটা পথ ভুল কদম নিয়েছে। একটা অচেনা... আনদেখা ইতিহাসকে ছুঁয়ে যে তার চেয়ে অনেক বেশি পথ পাড়ি দেওয়া যায়...
ক্ষতি কি?
গাল ছাপিয়ে বৃষ্টি নামে তিস্তার।
পাহাড়ি ঝর্ণার মত শহুরে মেয়েটার বুকে বহু যুগ আগে কোনও এক সুলতানের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে।
চোখ বুজিয়ে সেসব মনে করলেই তিস্তা বেশ বুঝতে পারে একটা উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধ ওর চারপাশ ঘিরে ধরছে।
নাঃ তিস্তা এর কারণ খুঁজতে যাবে না।
কিছু কিছু ইতিহাস আধুনিকতার কাছে আড়াল থাকাই শ্রেয়। কিছু ইতিহাস বইয়ের সিলেবাসের না-হয় বাইরে থাক। 
(সমাপ্ত)

Rumela Das