অঙ্কুর চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অঙ্কুর চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সেকেন্ড ইনিংস - অঙ্কুর চক্রবর্তী

 

সেকেন্ড ইনিংস

 অঙ্কুর চক্রবর্তী

 
-১-

    দাদা খুব ভুল করেছে। অনিকে নিয়ে মুম্বই কিংবা দিল্লিতে চেষ্টা করা উচিত ছিল। ছেলেটার পোটেনশিয়াল যে আছে সুকুমার বুঝেছিল অনেক আগেই। বছর পাঁচ বয়েস থেকেই টেনিস বল জোরে ছুড়তে ভালবাসত অনিকেত। সুকুমারই তারপর ওকে হাতে ধরে অ্যাকশন ঠিক করিয়েছে। সাত বছরের জন্মদিনে এনে দিয়েছে এস . জি-র ক্রিকেট কিট, বলে দিয়েছে ইন্সুইং আউট সুইং-এ গ্রিপ কিভাবে বদল করতে হয়। এখন সে সম্ভাবনাময় তরুণ পেসার। কিন্তু বাংলায় খেলে কি আর ইন্ডিয়া কল আপ পাবে এত সহজে? বিশেষ করে যখন বাংলা এবছর রঞ্জি খেলছে প্লেট গ্রুপে।

    দাড়ি কামাতে কামাতে এসব কথাই ভাবছিল আটত্রিশ বছরের সুকুমার। সদ্য কাটা গালে আফটার শেভ লাগালে যেরকম শিরশির করে, সেরকম শিরশিরে একটা ব্যথা সে অনুভব করে মনের কোণে। ইন্ডিয়া খেলা হয়নি তার নিজের, আর হবেও না। অজস্র ঘরোয়া ক্রিকেটার যারা আশা জাগিয়েও বিস্মৃতির অতলে চলে চায় সুকুমার তাদেরই একজন। 

    বিবেকানন্দ পার্কে সকালের জগিং করার সময়ও সাত বছর আগের মাঝরাতের একটা ঝগড়ার কথোপকথন তার স্মৃতিতে উঁকি দিতে থাকে।  মেলবোর্নের ফ্লাইট থেকে নেমে ট্যাক্সি ধরে বাড়িতে এসেই জবাবদিহি চেয়েছে সে দাদার কাছে, " মা চলে গেলেন আর তুমি আমাকে বলার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলে না! অ্যাসিস্ট্যান্ট টিম ম্যানেজার মুখ ফস্কে কথাটা বলে না ফেললে আমি জানতে পর্যন্ত পারতাম না! "

    দাদা সুকোমল কৌপিন পরে সোফার ওপর বসেছিল। উস্কো খুস্কো চুলে হাত চালিয়ে বলেছিল, " ইডিয়েট! এই সুযোগ তুই আর পাবি না সুকুমার!"

" মা - কে দেখার শেষ সুযোগও তো আর পাবো না দাদা! শুধু তোমার জন্য" 

" তুই কি এখনও বুঝতে পারছিস না সুকুমার। এভাবে বিদেশ সফর ছেড়ে ব্যাক আপ উইকেট কিপার বাড়িতে চলে এসেছে কেউ শুনেছে কস্মিনকালে? ইন্ডিয়া টিমে ডাক পাওয়া কী ছেলের হাতের মোয়া? তোদের পেট পাতলা টীম ম্যানেজারকে কথাটা জানানোই ভুল হয়েছিল"

" সে সব আমি বুঝে ..."

" ইউসলেস ইউসলেস! ননসেন্স ! বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে", সুকুমারকে কথাটা শেষ না করতে দিয়েই গর্জন করে উঠেছিলেন সুকোমল মুখার্জী।

    বেরিয়েই গেছিলো বরাবরের সেন্টিমেন্টাল সুকুমার, আর ওই বাড়ি মুখো হয়নি। ভাইপো অনিকেতের করুণ মুখটা অনেকবার মনে পড়েছিল , কিন্তু  দাদার " ইউসলেস!" কথাটা এখনও কানে বাজে সুকুমারের। আর দাদার কথা সত্যি করেই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান সুকুমার মুখার্জির আর জাতীয় দলে ডাক আসেনি, স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। দাদা অনেকবার তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। পারিবারিক বিচ্ছেদ বা অন্য যে কারণেই হোক পরপর দুটি রঞ্জি সিজনে রান পায়নি সুকুমার, তখন তার বয়েস বত্রিশ ছুঁয়েছিল । এরপর ভালো খেললেও বয়েসের কারণে তাকে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় সামিল করতে চাননি নির্বাচকমণ্ডলী। 

    এমনকি গত রঞ্জি সিজনে প্রায় একশো ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলা সুকুমারকে বাংলা দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কোনরকম সৌজন্য না দেখিয়ে। শেষ পর্যন্ত কিছু পরিচিত সূত্রে কথা বার্তা বলে সে এই সিজন খেলেছে সিকিমের রাজ্য দলের হয়ে, সে ঠিক করেছে এটিই তার শেষ সিজন; এরপর অবসর। 

    রঞ্জি ট্রফি খেলা হয় দুটি ডিভিশনে - এলিট এবং প্লেট। প্লেট ডিভিশন থেকে চারটি দল সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়। তাদের মধ্যে থেকে বিজয়ী দুটি দল এলিট দলগুলোর সাথে মূল রঞ্জি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। সিকিম, ত্রিপুরার মত ছোট দলগুলো থাকে প্লেট ডিভিশন এ। মজার ব্যাপার হলো যে গত বার বাংলা রঞ্জি ট্রফি শেষ করে লীগ টেবিলের একদম শেষে। তাই তাদের অবনমন হয়ে গেছে প্লেট গ্রুপে। সিকিম, ত্রিপুরা, জম্মু কাশ্মীরের মত টিমগুলোর সাথে খেলে জিতলেই তবে মূল টুর্নামেন্টে এবার অংশগ্রহণ করতে পারবে বাংলা। 

    বাংলা আর সিকিম দুটি টীমের পারফরমেন্স এবার যথেষ্ট ভালো, তারাই এখন মুখোমুখি হবে প্লেট গ্রুপের সেমিফাইনালে। উনিশ বছরের তরুণ পেসার অনিকেত মুখার্জির গতিতে ভর করে বাংলাকে ইতিমধ্যেই অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে। তিনটি ম্যাচ খেলে ইতিমধ্যে তার ঝুলিতে সতেরোটি উইকেট। নিজের শেষ মরশুমে সিকিমের অভিজ্ঞ উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান সুকুমারকে যথেষ্ট দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখিয়েছে। ৭৪, ৩৬, ৩৪*, ৫৮ এবং ১৭* (নট আউট) এর ইনিংসে সে বোলারদের সুযোগ দিয়েছে খুব কম।

    সিকিম বনাম বাংলার এই ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনার পারদ চড়ছে বাংলার ক্রিকেট মহলে, এলিট গ্রুপে যাওয়ার পথে এখন বাধা শুধু সিকিম। বাংলার পেসারদের সুবিধের জন্য ইডেনের উইকেটে ঘাস রেখেছেন কিউরেটর। কাকা ভাইপোর মুখোমুখি ম্যাচ নিয়েও গুঞ্জন উঠেছে ক্রিকেটীয় অলিন্দে। বাংলা নিজের খেলা ধরে রাখলে এটিই হতে চলেছে সুকুমার মুখার্জির ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। জগিং শেষ করে ফিরে এসে আজ ম্যাচের আগের শেষ নেট সেশনের জন্য তৈরি হয়ে যায় সুকুমার।

-২-

    প্রথম দিন, সকাল সাড়ে নটা। শীতের সকালে জনা পঞ্চাশেক দর্শক ইডেনের বিশাল গ্যালারির শূন্যতাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।  টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছে বাংলা। প্যাড, উইকেটকিপিং গ্লাভস নিয়ে ড্রেসিং রুম থেকে বেরোনোর সময় সুকুমারের দেখা হয়ে গেল অনিকেতের সঙ্গে
" কাকু.." অনি তখনও প্র্যাক্টিস কিটে, কারণ তার ব্যাটিং সবার শেষে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হালকা না হেসে পারে না সুকুমার। অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে অনিকেত, ছিপ ছিপে চেহারা, এক মাথা ঝাঁকরা চুল।
"বেস্ট অফ লাক অনি", পেশাদারী ভঙ্গিতে কথাটা বলে সুকুমার।

" গুড লাক টু ইউ টু অন ইওর লাস্ট ম্যাচ"

" লাস্ট ম্যাচ কিনা সেটা সময় বলবে অনি"
কথাটা বলে তর তর করে সিড়ি বেয়ে নেমে আসে সুকুমার। বাংলা কি ধরেই নিয়েছে ম্যাচটা তারা জিতে গেছে? অনিশ্চয়তার অপর নাম ক্রিকেট! চোয়াল শক্ত করে সুকুমার।

    স্টাম্পের পেছনে জায়গা নেওয়ার আগে পিচের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় সুকুমার। হালকা ঘাস, সকালের আদ্রতা শুরুর একঘন্টা ব্যাটসম্যানকে সংযত হতে বাধ্য করবে। বাংলার হয়ে ওপেন করতে নেমেছে অতনু মিত্র এবং কল্লোল সেন। দুজনেই পোড়খাওয়া ক্রিকেটার। কল্লোলের বয়েস চব্বিশ, ইতিমধ্যেই গোটা দশেক ওয়ান ডে খেলে ফেলেছে জাতীয় দলের হয়ে। টেস্ট ম্যাচে সুযোগ পাওয়ার জন্য রঞ্জির এই মরশুম তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।  হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে নতুন বল হাতে সিকিমের হয়ে শুরু করবে গুরুং।

    প্রথম ওভার, মেডেন। মাঝারি গতির পেসার গুরুং ছয়টি বলই রেখেছে অফ স্টাম্পের বাইরে। উইকেটের পেছনে সুকুমার অনুভব করে বাতাসে বল হালকা কাটছে। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সুইং থেকে নিজের ব্যাট বাঁচিয়ে সাবধানে ইনিংস শুরু করেছে অতনু। 

    শীতের সকালের আমেজের সঙ্গে মানিয়ে টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে ধীর গতিতে। কিন্তু অভিজ্ঞ সুকুমার বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে সেট হচ্ছে বাংলার দুই ওপেনার। প্রথম দশ ওভার শেষে বাংলা কোনো উইকেট না হারিয়ে  ২৭ রানে পৌঁছে গেছে।

    ফার্স্ট চেঞ্জ হিসেবে এখন বল হাতে তুলে নিয়েছে তামাং। তামাংকে পুরোপুরি পেসার বলা যায় কিনা তা সুকুমার জানে না, বোলিং অ্যাকশন কিছুটা সৌরভ গাঙ্গুলির মত, গতিও সেরকমই। সর্ব্বোচ ১১০-১২০ কিমি বেগে বল করে সে। তার প্রধান অস্ত্র, অফ কাটার এবং লেগ কাটার। প্রথম ওভারেই কল্লোল তাকে দুটো বাউন্ডারি হাঁকালো। অপর প্রান্ত থেকে বল করতে আসা লেগ স্পিনারের বিরুদ্ধেও স্বচ্ছন্দ বাংলার দুই ওপেনার। আঠারো অভার শেষে বাংলার রান এখন ৬৮/০। 

    সিকিমের ক্যাপ্টেন থন্দুপ ভুটিয়া আবার বল তুলে দিয়েছেন তামাং এর হাতেই। সকালের রোদ যত বাড়ছে পিচ ব্যাটসম্যানের জন্য তত সহায়ক হচ্ছে। আর সেটা প্রমাণ হলো যখন ওভারের তৃতীয় ও চতুর্থ বলে স্টেপ আউট করে পরপর দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে নিজের হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করলো কল্লোল। বাংলার ড্রেসিং রুমের বাইরে তখন হাততালি। সুকুমার এগিয়ে আসে ক্যাপ্টেন ভুটিয়ার কাছে, সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর সে উইকেট থেকে দূরে না দাঁড়িয়ে কাছে এসে দাঁড়ায়। বল হাতে ছুটে আসছে তামাং, হাতের গ্রিপ দেখে সুকুমারের অভিজ্ঞ চোখ বলে দিচ্ছে বল টা লেগ কাটার। আবার স্টেপ আউট করতে ক্রিজের বাইরে বেরিয়ে আসে কল্লোল। এবার কিন্তু বল কেটে বাইরে বেরিয়ে আসে, ব্যাটে বলে সংযোগ হয় না। চোখের পলকে অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে বল সংগ্রহ করে উইকেট ভেঙে দেয় সুকুমার। আউট! স্টাম্পড! হতভম্ব কল্লোল উইকেটের দিকে একবার তাকিয়ে প্যাভিলিয়ন মুখো হয় । বাংলার স্কোর ৮২/১।

    লাঞ্চের পরের সেশনে কিন্তু বাংলার মিডল অর্ডারে র ওপর চেপে বসে সিকিমের লেগ স্পিনার আবদুল্লাহ এবং পার্ট টাইম অফ স্পিনার ছেত্রী। মূলতঃ তাদের অবদানে চা বিরতির সময় বাংলার ৬ ব্যাটসম্যান ফিরে গেছে প্যাভিলিয়ন এ। দলীয় স্কোর তখন ২০৪। নিজের ব্যক্তিগত ৫৬ রানে অপরাজিত আছেন বাংলার অধিনায়ক প্রশান্ত দাশগুপ্ত।

    চা বিরতির পর প্রথম ওভারেই গুরুঙ্গের বলে খোঁচা দেয় বাংলার অলরাউন্ডার শ্রীকান্ত। নিজের ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটির থেকে এক ইঞ্চি ওপরে ক্যাচটি সহজাত ক্ষিপ্রতায় নিজের গ্লাভসবন্দী করে সুকুমার। টেল এন্ডার রা ক্রিজে আসার সাথে সাথে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শুরু করেন অধিনায়ক প্রশান্ত। শীতকালের দিন ছোট, ব্যাড লাইটে খেলা শেষের দু ওভার আগে নিজের শতরান পূর্ণ করে সে। কিছুক্ষণ আগে তাকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে এসেছে বাংলার শেষ ব্যাটসম্যান অনিকেত মুখার্জি। তিনবার খোঁচা দিতে দিতে বেঁচে গেছে সে। বোলার হিসেবে যতই প্রতিভাবান হোক, ব্যাটসম্যান হিসেবে সে একেবারেই কাঁচা। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ভাইপোর  ব্যাটিং টেকনিক দেখে মনে মনে না হেসে পারেনি সুকুমার। কিন্তু তবু দিনের শেষে অপরাজিত থেকেছে সে ৭ রানে। বাংলার স্কোর ৯ উইকেটের বিনিময়ে ২৮১। শীতের পরন্ত বিকেলে কাকা ভাইপো টুক টাক কথা বলতে বলতে যখন ড্রেসিং রুমে ফিরছিল, তখন একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ক্লাব হাউস থেকে বলে উঠলো, " ওয়েল প্লেড! ব্রাভো!" সেদিকে তাকিয়ে সুকুমার দেখলো উপস্থিত হয়েছেন দাদা সুকুমার মুখার্জি। কথা না বাড়িয়ে গ্লাভস খুলতে খুলতে সিকিমের ড্রেসিং রুমের দিকে পা বাড়ায় সুকুমার।  

- ৩ -

    দ্বিতীয় দিন আকাশ মেঘলা, কনকনে উত্তুরে হাওয়া। সুইং বলিংয়ের জন্য আদর্শ পরিবেশ। বাংলার শেষ উইকেটের জন্য সিকিমকে অপেক্ষা করতে হল মাত্র দু ওভার। গুরুঙ্গের ইয়র্কার বল সামলাতে না পারায় নিজের ১০ রানের মাথায় ক্লিন বোল্ড হয়ে যায় অনিকেত। বাংলা প্রথম ইনিংসে ২৯১, ইডেনের স্কোর বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে প্রশান্তের অধিনায়কোচিত ১১৩ নট আউট।

    শীতের সকালের আদ্রতা আর গঙ্গার হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে শুরুতেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে অনিকেত। ১২ ওভার শেষ হতে না হতেই মাত্র ৩৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে সিকিম যখন ধুঁকছে তখন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান লেপচাকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে আসে সুকুমার। আর প্রথম বলে কাকাকে বাউন্সার দিয়ে স্বাগত জানায় অনিকেত।  সুকুমার বুঝতে পারে, অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে অনি। বলের গতি ১৪০ এর বেশ ওপরে। কখনও কখনও লাইন লেংথ হয়ত কিছুটা ভুল করে, তবুও শতকরা ৬০ ভাগ বল সঠিক জায়গায়। তখন অনিকেত নিজের লাগাতার সপ্তম ওভারে, অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের একটি বল দেখে চোখ জ্বলে ওঠে সুকুমারের। সপাটে কাট করে সেটাকে বাউন্ডারিতে পাঠায় সে।

    প্রথমদিনের মত দ্বিতীয় দিনও রোদ ওঠার সাথে ব্যাটিং সহজ হয়। মধ্যাহ্ন বিরতির আগে পর্যন্ত আর কোনো উইকেট না হারিয়ে সিকিম পোঁছে যায় ৯০/৩ রানের স্কোরে। স্কোরবোর্ড বলছে লেপচা ৫৪*, মুখার্জি ২৮*। বোলিং কার্ডে অনিকেত মুখার্জির নামের  পাশে ১২ ওভারে ২১ রানে ২ উইকেট।

    বিশেষজ্ঞরা বলেন দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের পর ইডেন গার্ডেন্সে ব্যাট করার জন্য সেরা সময়। বাংলা স্পিনারদের সহজেই কাবু করে ফেলে সুকুমার ও লেপচার জুটি। দলীয় ১৪২ রানের মাথায় নিজের অর্ধশত রান পূর্ণ করে সুকুমার। বাংলা দলের পুরোনো সতীর্থদের মধ্যে কেউ কেউ এসে অভিনন্দন বলে যায়। কিন্তু এর তিন ওভার এর মধ্যেই খেলার গতির সম্পূর্ণ বিপরীতে অফস্পিনার কল্যাণের বলে এলবিডব্লিউ আউট হয়ে যায় সে নিজে ৬২ রানের মাথায়।

    দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এসে অনিকেত বোলিং শুরু করে নিজের চেনা ছন্দে। বাংলার পেসাররা দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার ঠিক আগে সিকিমকে অল আউট করে দেয় ২৭৩ রানে, প্রথম ইনিংসে বাংলার লিড ১৮ রান। তখনও অনিকেত কিংবা সুকুমার কেউই জানত না এই সামান্য ব্যবধান কত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। সেদিন ইনিংস বিরতির সময় থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। আম্পায়াররা অগত্যা নিরুপায় হয়েই সেদিনের জন্য খেলা শেষ করে। 

-৪-

    তৃতীয় দিন প্রথমে বৃষ্টি এবং ভেজা আউটফিল্ডের কারণে বেলা দুটোর আগে খেলা কিছুতেই শুরু করা গেল না। ভেজা সবুজ পিচ, মেঘলা আকাশ, বোলারদের জন্য আদর্শ পরিবেশই বটে। বল যে মারাত্মক সুইং করছে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে তা অনুভব করে সুকুমার। বাংলার ব্যাটসম্যানরা একেবারেই সুবিধা করে উঠতে পারেনি দ্বিতীয় ইনিংসে, দলীয় ১৬২ রানের মাথায় তারা অল ডাউন হয়ে যায় । সিকিমের দ্বিতীয় ইনিংসে জয়ের জন্য চাই ১৮১ রান। ১৮১ এমন কিছু বড় লক্ষ্য  নয় কিন্তু চতুর্থ ইনিংসে এরকম বোলিং সহায়ক পরিবেশে এই রান তাড়া করাও যে কঠিন হবে তারা যারা বিন্দুমাত্র ক্রিকেট খেলেছেন তারা জানেন।

    আর সিকিমের ড্রেসিংরুম যেই জিনিসটা আশঙ্কা করছিল ঠিক সেটাই হল; বল হাতে অনিকেত এবং বাংলার পেসাররা অদম্য হয়ে উঠল। সিকিম দ্বিতীয় ইনিংসে তাদের তিন উইকেট হারিয়েছে ১২ রানে। ব্যাট হাতে যখন সুকুমার ড্রেসিং রুমের সিড়ি দিয়ে নেমে আসছে , ক্লাব হাউসে বাংলা ও সিকিমের কর্মকর্তারা মুখে দাড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন সিকিম ম্যাচটা হেরে যাচ্ছে অতএব সুকুমারের এই শেষবার ব্যাট হাতে মাঠে নামা। ক্লাব হাউসে সুকোমল মুখার্জির মুখটাও চোখ এড়ালো না সুকুমারের। ক্রিকেট দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়ার নাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ বল হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে এই আজীবন জেনে এসেছে সুকুমার। হোক না গ্যালারি ফাঁকা, হোক না শেষ ইনিংস, মনোসংযোগ করতে হবে বাধ্য ছাত্রের মত। 

    এরপর ইডেন গার্ডেনে গুটি কয়েক দর্শক আর কর্মকর্তারা দেখলেন ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সূর্যাস্তে পৌঁছানো এক ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং প্রদর্শনী। ভালো বল সে ছাড়লো, ফুল লেন্থ বলে ড্রাইভ, শর্ট বলে পুল। অনিকেত এবং বাংলার রঞ্জি স্বপ্নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সুকুমার মুখার্জি। অপরপ্রান্ত থেকে উইকেট পড়ে গেছে অবশ্য লাগাতার। সিকিম যখন তাদের নবম উইকেট হারালো তখনো জেতার জন্য চাই আট রান। ব্যক্তিগত ৯৩ রানে ব্যাট করছে সুকুমার। 

    হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে বাংলার সেরা পেসার ম্যাচে ইতিমধ্যে নয় উইকেট নেওয়া অনিকেত। শর্ট বল, নিজের ওজন পেছনের পায়ে নিল সুকুমার। চোখের ঠিক নীচে ব্যাটে বলে সংযোগ হল। খট করে একটা শব্দ। হুক শট, দ্রুত পিচে এই শর্ট খেলা প্রচন্ড কঠিন। বল উড়ে চলেছে। অনিকেত আর বাংলা ক্যাপ্টেন প্রশান্ত সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, " ক্যাচ..."। ঘাড় ঘুরিয়ে  সুকুমার দেখল ডিপফাইন লীগের মাথার ওপর দিয়ে বলটি উড়ে গিয়ে আছরে পড়লে ফাঁকা গ্যালারিতে। ছয় রান। ভাইপোর দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল সিকিমের বর্ষিয়ান উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। জেতার জন্য আর দুই রান,তার নিজের রান ৯৯। ইতিহাস দেখতে পাচ্ছে সে, প্রথমবার রঞ্জির এলিট গ্রুপে সে দেখতে পাচ্ছে সিকিমকে। "ইউজলেস" নয় সুকুমার মুখার্জি, বাংলার বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ আর মাত্র দু রান দূরে। ওভারের শেষ বল, সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রাখতে হবে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা রেখেছে অনিকেত। থার্ড ম্যান অঞ্চলে একরান নেওয়ার জন্য ব্যাটটা পেতে দিল সুকুমার। একটু রিভার্স সুইং করলো কি বলটা?  উইকেট কিপার এর তালুবন্দি হতেই সারা বাংলা টিম  সমস্বরে আপিল করে উঠলো কট বিহাইন্ডের জন্য।

    আম্পায়ারের দিকে তাকালো সুকুমার.. না আম্পায়ার মাথা নাড়িয়ে জানালেন নট আউট। কিন্তু সুকুমার জানে তার ব্যাটের কিনারা হালকাভাবে হলেও সংস্পর্শ করেছে বলের সাথে; আর কেউ জানুক বা না জানুক ব্যাটসম্যান সব সময় জানে। ইডেন গার্ডেনে তখন শেষ বিকেলের লম্বা ছায়া পড়েছে। ব্যাট বগলে নিয়ে গ্লাভস খুলতে খুলতে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা লাগালো সুকুমার।

    বাংলা দল হতবাক, সমস্ত ইডেন হতবাক এবং ক্রিকেট ঈশ্বরও বোধ হয় এক মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গেলেন। ওয়াকওভার। ব্যাটসম্যানকে আম্পায়ার আউট না দেওয়া সত্ত্বেও, নিজে থেকে হার স্বীকার করে নেওয়া, একমাত্র জেন্টেলম্যানস গেম ক্রিকেটেই সম্ভব। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাংলা দল সোল্লাসে ফেটে পরলো। কিন্তু তার মধ্যে থেকেই অধিনায়ক প্রশান্ত এসে করমর্দন করে গেলেন সুকুমার-এর সঙ্গে, বললেন, " হোয়াট এ লাস্ট ইনিংস!"।  

    ড্রেসিংরুমে সিড়ি দিয়ে ওঠার মুখে দেখা হয়ে গেল দুই ভাইয়ের।সুকুমার অবাক হয়ে দেখল সুকোমল-এর চোখে তখন জল চিক চিক করছে। ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভাঙ্গা গলায় সে বলল, " এটা কী করলি ইডিয়েট? সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে এলি?"

" সেঞ্চুরিটা মাঠে ফেলা থাক দাদা, সম্মানটা সাথে আছে।"

" আমার দেখা ঘরোয়া ক্রিকেটে সেরা সেকেন্ড ইনিংস ব্যাটিং এটা!", বিহ্বল স্বরে বলে ওঠে সুকোমল।

" সেকেন্ড ইনিংস তো সবে শুরু দাদা"

    ভ্রু দুটো ওপরে তুলে অবাক চোখে তাকালেন সুকোমল মুখার্জী। মৃদু হেসে মাঠে উৎসবরত বাংলার ক্রিকেটারদের দিকে দেখিয়ে সুকুমার বললো, " অনির গতি আছে, কিন্তু লাইন লেংথ নিয়ে বিস্তর খাটতে হবে। ওকে ঠিক দেখিয়ে দিতে হবে না?"
    কলকাতার শীতের সেই শেষ বিকেলে নিজের ভাইকে একদিনের মধ্যে দ্বিতীয় বারের জন্য জড়িয়ে ধরলেন সুকোমল।

(সমাপ্ত)
 
Ankur Chakraborty 



দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এবং সেই ফুচকাওয়ালা - অঙ্কুর চক্রবর্তী


  ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এবং সেই ফুচকাওয়ালা

অঙ্কুর চক্রবর্তী


        ২০০১ সালের গ্রীষ্মকালটা আমার কেটেছিল হাওড়ার একটা মেস বাড়ির তিনতলার ঘুপচি ঘরে। দশ বাই দশ ফুটের এই এক চিলতে ঘরটায় আমার তক্তপোষ এবং ইজেল ও রং তুলি রাখার পর আর বিশেষ জায়গা ছিল না। কিন্তু আমার ঘরটা অপছন্দ ছিল না তার কারণ ঘরের একমাত্র জানলাটা খুলে দিলে গঙ্গা এবং তার তটের দৃশ্য চোখে পড়ত। চোখে পড়ত নদীর ওপারের চটের কলগুলোর সারি সারি চিমনি আর অসংখ্য ছোট ছোট আলো যাদের প্রতিটির নিশ্চয়ই নিজস্ব কোনো গল্প ছিল। একজন শিল্পীর জন্য আদর্শ দৃশ্য সন্দেহ নেই। গঙ্গার ধারে ঘিঞ্জি বস্তি সংলগ্ন এলাকায় মেস বাড়িটার অবস্থানের জন্য এই ঘরটার ভাড়াও ছিল কম। যদিও এখন বলতে বাধা নেই যে, মাঝে মাঝেই সেই ভাড়া গুনতেও আমাকে নাজেহাল হতে হতো এবং মেসের ম্যানেজার হৃষিকেশ বাবু অত্যন্ত সজ্জন ভদ্রলোক হওয়ার কারণেই আমাকে নিতান্ত উৎখাত হতে হয়নি।

        আমার এই অর্থকষ্টের মূল কারণ হলো আমার ছবির বিক্রি নেই। আজকাল ছবি এঁকে পেট চালানো যায় না বললেই চলে। তবুও পোট্রেট হলে কথা ছিল, খেয়ালি বড়োলোকের কিছু ছবির বরাত জুটে যেত ঠিকই। কিন্তু আমার পছন্দ ল্যান্ডস্কেপ। মডার্ন আর্টের এই যুগে ল্যান্ডস্কেপ ছবির প্রদর্শনী হয় কম, বিক্রি আরো কম। তবুও সুযোগ একটা এসেছে দিন কয়েক হলো। মিত্র গ্যালারির উদ্যোগে টলিগঞ্জে একটা প্রদর্শনী হচ্ছে শুধুমাত্র ল্যান্ডস্কেপ ছবির ওপর। ছবির বিষয় - কলকাতার রাত। আমি ঠিক করেছি গঙ্গার ওপরে নেমে আসা রাত হবে আমার ছবির বিষয়বস্তু। আমি আমার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে চাই রাতের আবছা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা এক অব্যক্ত হতাশার কথা। ছবিটার একটা যুতসই নামও ঠিক করে ফেলেছি ইতিমধ্যে - দ্য স্ট্রাগলিং নাইট বাই দি গ্যাঞ্জেস। স্টুডিও পাড়ার কাছেই যেহেতু গ্যালারি, কপাল জোরে কোনো ফিল্মস্টার হয়ত পছন্দ করে ফেলল ছবিটা, কিংবা কোনো প্রোডিউসার কলমের এক আঁচড়ে আমার জন্য লিখে দিলেন মোটা অঙ্কের চেক আর তাতে সমাধান হয়ে গেল আমার জীবনের না মেলা সব অঙ্কগুলো? এমন হতে পারে না কি কখনো? দিবাস্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে, আমারও লাগে।

        অনেক রাত অবধি কাজ করা আমার অভ্যেস। সকালবেলায় মুটে মজুরদের হাঁক ডাকে এপাড়ায় কাজের সুবিধে হয় না। তাছাড়া দিনের বেলা হৃষিকেশবাবু মাঝে মাঝে এসে উপস্থিত হন ভাড়ার তাগাদা দিতে। তাই দিনের বেলাটা আমি ঘরে থাকা এড়িয়ে চলি। হয় ইতস্ততঃ ঘুড়ে বেরাই না হয় গ্যালারির কিউরেটরদের সাথে আলাপ জমাই কাজের খোঁজে কিংবা নিতান্ত অনন্যোপায় হলে নেশন্যাল লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দেই ছবির ব্যাপারে পড়াশুনো করে। পাশ্চাত্য শিল্পে রাতের ছবি বিষয়টা নতুন কিছু নয়। রেনেসাঁর সময় থেকেই বারবার রাত ফুটে উঠেছে শিল্পীদের রং তুলিতে। কখনও সেই চিত্রের বিষয়বস্তু ধর্মীয়, কখনও যুদ্ধ কিংবা মহাকাব্যের কোনো ঘটনা। এই ছবিগুলোর মধ্যে নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে বিখ্যাত ভ্যান গগের আঁকা " স্টারি নাইট"। রাতের শেষে ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার ঠিক আগের সেই অপার্থিব ছবিটি মানুষের আশা নিরাশায় দোলা জীবনের কথা বলে। এ পিকচার স্পিকস এ থাউজ্যান্ড ওয়ার্ডস- শতাব্দী পেরিয়েও এই ছবিটি তাবৎ বিশ্বের মানুষের সাথে ফিসফিসিয়ে কত কথা বলতে চায়।

        জানলা খুলে রোজ রাতে আমি বাইরের দৃশ্য স্টাডি করি। দীর্ঘক্ষণ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে যাই ক্যানভাসে। কিছুদিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ছে আমার। রাত একটু গভীর হলেই একটা ফুচকাওলা এসে বসে গঙ্গার ধারের একটা ল্যাম্প পোস্টের নীচে। কাঁচের বয়াম ভর্তি করা ফুচকা। এত রাতে কে ফুচকা খেতে আসবে কে জানে, তবু লোকটা আসে রোজ। ভোর হয়ে আসার ঠিক আগে, লোকটা গিয়ে বসে গঙ্গার ঘাটে। সারা রাতে একটাও ফুচকা বিক্রি হয় না তার। দিনের বেলা কিন্তু আর দেখা যায় না তাকে।

                                            - ২-


        আজকাল অয়েল পেইন্টিং আঁকার খরচ কিছু কম নয়। বেশ কিছু রঙের টিউব কেনার দরকার ছিল। কলেজ স্ট্রিটের চেনা দোকানে ধার হয়ে গেছে অনেক, সহজে দিতে চাইছিল না এবার; শেষ পর্যন্ত দিয়ে বলেছে যে এই শেষবার। আমি খুব বুঝতে পারছি, এভাবে আর বেশিদিন চলবে না।
কলেজ স্ট্রিট থেকে হাওড়া ফিরব বাসে, দুপুরের বাসে বিশেষ লোক থাকে না। কন্ডাক্টর টিকেট কাটতে এলে ওর হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, টিকিটের দরকার নেই। সে কথা না বাড়িয়ে অন্য যাত্রীদের টিকিট করতে লাগলো, আমার নগদ তিনটে টাকা বেঁচে গেলো।

        বিকেলের দিকে গঙ্গার ঘাটে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে লাগলাম নিছক সময় কাটানোর জন্য। এসময় হৃষিকেশ বাবু মেসে থাকেন, ওনার সামনে পড়লে আবার ভাড়ার কথা তুলবেন। এই ছবিটি এক্সিবিশন এ জমা নিলে মিত্র গ্যালারির থেকে সাম্মানিক হিসেবে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে, সেটা না পেলে আমার একেবারেই চলবে না। সন্ধ্যে নামার অনেকক্ষণ পর অবধিও গঙ্গার ঘাটে ঘুরে সেই রাতের ফুচকাওয়ালার কোনো সন্ধান আমি পেলাম না। আচ্ছা বোকা লোক তো, গঙ্গার ঘাট এই সময় লোকে গমগম করছে, কপোত কপোতী আইসক্রিম আর চিনেবাদাম শেষ করে ফেলছে মুহূর্তে। এমনকি দুটো ফুচকাওয়ালাও দেখতে পেলাম, তাদের বিক্রি বাট্টাও নেহাত মন্দ নয়। এই সময় না এসে সেই লোকটা আসবে গভীর রাতে। কি ব্যাপার কে জানে, লোকটা কি ব্যবসার কাজ কিছুই জানে না?

          রাত নটার দিকে চোরের মত চুপিচুপি মেসে ঢুকলাম। সবার নজর এড়িয়ে তেতলায় নিজের ঘরে ঢুকে নতুন কেনা রঙগুলো রাখলাম বিছানার ওপর। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে মগ্ন হয়ে গেলাম আমার ছবিটার মধ্যে। রাত তখন একটা প্রায়, খুব গুমোট লাগছে বলে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। গঙ্গার স্নিগ্ধ হাওয়া শরীরটাকে জুড়িয়ে দিল, নদীর ওপর নিশুতি রাত নামছে। চাঁদ উঠেছে মধ্য গগনে, মাঝ গঙ্গায় একখানি ছোট নৌকা ভেসে রয়েছে। নদীর পাড়ের কোনো কোনো চটের কলের আলো দেখা যাচ্ছে, কোনটার আলো জ্বলছে না, হয়ত লক আউট চলছে। সেসব কারখানার শ্রমিক, নৌকার মাঝির অশ্রু আর ঘামে ভারী হয়ে আছে কলকাতার গ্রীষ্মের রাতের বাতাস। ঠিক এই ছবিটাই তো আঁকতে চাইছি আমি আমার ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এর ক্যানভাসে। জানলার বাইরে দৃশ্যে খাপ খাচ্ছে না শুধু মাত্র একটি ব্যাপার। রাতের সেই ফুচকাওয়ালা আবার হাজির আজ তার কাঁচের বয়াম ভর্তি ফুচকা নিয়ে। আজও তার একটিও খদ্দের নেই। একবার ওর কাছে যাব নাকি? একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছি আমি, আর সেটা ঠিক মাঝরাতে ফুচকা খাওয়ার লোভ নয়। নিজেকে বোঝালাম সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমি একরকম জোর করেই আবার মন বসালাম আমার কাজে, আজই শেষ করে আনতে পারব বলে মনে হচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ টা।

                                            -৩-

        মিত্র গ্যালারিতে ঢুকলেই দেখা যাবে, শ্রী অম্বরেন্দু মিত্র মহাশয়ের একটা অয়েল পোট্রেট। সেকালে ডাকসাইটে বিত্তশালী লোক ছিলেন অম্বরেন্দু মিত্র, সাবানের ব্যবসা করে পয়সা করেছিলেন বিস্তর। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তারই সংগৃহীত দেশি বিদেশি ছবি নিয়ে আজকের এই ' মিত্র গ্যালারি ' । এই গ্যালারির কিউরেটর এখন পার্থসারথি সাহা। আমি তার সামনেই বসে ছিলাম ছবিটি দেখানোর জন্য। একটা ঢাউস অ্যালবামের পাতা উল্টে কিছু একটা দেখে চলেছেন বিশালবপু পার্থসারথি বাবু। এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া সত্বেও জুন মাসের এই দুপুরে ঘেমে উঠছে তার কপাল; আমার উপস্থিতি যেন গ্রাহ্যই করছেন না ভদ্রলোক। শেষে না থাকতে পেরে বললাম
- স্যার..
- হুম্ করে একটা ছোটো শব্দ করলেন পার্থসারথি বাবু। তার মনোযোগ এখনও অ্যালবামে।
আমি একটা ছোট্ট কাশির শব্দ করলাম।
- হ্যাঁ? এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পান ভদ্রলোক। ও তোমার ছবিটা না? এই চা খাওনি? ছি ছি!
ফোন তুলে বেয়ারাকে দুটো চা এর অর্ডার দেন পার্থসারথি সাহা।
-কই দেখাও দেখি ছবিটা..
আমি ফোল্ডার থেকে বার করে যত্ন করে মেলে ধরি তার সামনে। খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন ভদ্রলোক ল্যান্ডস্কেপ টা। বেয়ারা এসে চা দিয়ে যায়, আমি উদগ্রীব হয়ে আছি পার্থসারথি বাবুর প্রতিক্রিয়ার জন্য।
কিছুক্ষণ বাদে চোখ থেকে চশমা নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক
- দেখো, তোমার ছবিটা ভালো। কিন্তু কিছু একটা মিসিং।
- কি মিসিং স্যার?
- একটা হিউম্যান টাচ্! মানুষের কথা কোথায় বলছে ছবিটা?
- স্যার মানে রাতের কথা, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা গুলো দেখুন, তাদের শ্রমিকের কথা, নৌকার মাঝিদের কথা। এমনকি গঙ্গার নিজের কথা, সারা ভারতের সমস্ত আবর্জনা বয়ে নিয়ে চলার কথা, এগুলোই তো বলছে ছবিটা।
- না হে না! বড্ড ভেগ , বড্ড অস্পষ্ট সেসব। এরম অবস্থায় ছবিটাকে এক্সিবিশন এ নিতে পারব না। আরো চেষ্টা করো।

আর কি চেষ্টা করবো, আগামীকাল ছবি জমা করার শেষ দিন, আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম। পার্থসারথি বাবুর গলা শুনতে পেলাম আবছা
- আরে, চললে নাকি? চা টা খেয়ে গেলে না। যাক গে মাথায় রেখো হিউম্যান টাচ্ চাই..

আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, একটা যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেবো সে শক্তিটুকু যেন নেই। এবারেও হলো না? পকেটে পয়সা একেবারে শেষ, একটা সিগারেট কেনাও বিলাসিতা। তবুও গতকালের টিকিট বাঁচানোর টাকা দিয়ে একটা চা আর একটা ফ্লেক নিলাম। পায়ে পায়ে কখন মেট্রোরেলের স্টেশনে এসে বসেছি আমার নিজেরও খেয়াল নেই। একটার পর একটা পর একটা মেট্রো চলে যাচ্ছে, ওঠানামা করছে কর্মব্যস্ত মানুষের দল। ঠিকমতো কলেজ শেষ করে কি একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া যেত না ওদের মতই? এখন চোখের সামনে শুধু নিরেট অন্ধকার।
একবার উঠে মেট্রোরেলের লাইনটা দেখে এলাম, ট্রেন আসার আগে কেমন একটা সর সর করে আওয়াজ হতে থাকে। ইচ্ছে করছে কান পেতে শুনতে সেই আওয়াজ। ওই লোহার পাতগুলোর ও কি মাঝে মাঝে পেতে ইচ্ছে করে না মানুষের ছোঁয়া, মানে পার্থসারথি বাবুর ভাষায় যাকে বলে হিউম্যান টাচ্? আবার ঝিক ঝিক শব্দ শুরু হয়েছে; টানেলের ভেতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে মেট্রোরেলের, আর আমার জীবনের এই সুরঙ্গের শেষে আলো কোথায়? মেট্রোটা আরো কাছে চলে এসেছে এখন , খুব টানছে আমাকে ইস্পাতের লাইনটা।
নাহ! কি সব ছাইপাশ ভাবছি, নিজেকে জোর করে সরিয়ে আনলাম সেখান থেকে।

                                            -৪-

        সন্ধ্যের বাসে অফিসের ভিড়। কোনোমতে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছি মাত্র। কন্ডাক্টর আসাতে আমি হাতে একটা টাকা দিলাম রোজের মতোই।
- দাদা, ভাড়া পাঁচ টাকা।
আমি চোখের ইশারায় বললাম টাকাটা রেখে দিতে নিজের কাছে। কিন্তু ভিড় বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, আজ সে নাছোড়বান্দা
- বাসে উঠলে পুরো ভাড়াই দিতে হবে দাদা। না থাকলে নেমে যান। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাটা বলল কন্ডাক্টর। আমার পকেটে সত্যি আর একটা পয়সাও নেই, তাই মাথা নিচু করে অপমানটা হজম করলাম আমি। পরের স্টপেজ আসতে নেমে পড়লাম বাস থেকে।

        বাকি পথটা হেঁটে যখন মেসের ঘরে পৌঁছলাম তখন রাত দশটা হবে। শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। গামছা হাতে বাথরুমে ঢুকলাম মুখে চোখে জল দেওয়ার জন্য। সারাদিন না খাওয়ার জন্যই হোক কিংবা এই জৈষ্ঠের গরম মাথায় করে এতটা হাঁটার জন্যই হোক টালমাটাল লাগছে খুব। বাথরুমে ঢুকে সিলিং এর দিকে তাকালাম, শক্ত পোক্ত একটা হুক থেকে জ্বলছে বাল্বটা, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মাথার মধ্যে একটা চিন্তা পোকা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠলো - ঠিক ঠিক। গত ছয় মাসে আমার একটাও ছবি বিক্রি হয়নি, তিনমাসের মেস ভাড়া বাকি হৃষিকেশ বাবুর কাছে, আজকের বাসের সমস্ত যাত্রীদের দৃষ্টি আমাকে নিরীক্ষণ করে চলেছে বন্ধ বাথরুমের ভেতরেও। এরপর আমার মাথাটা যেন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল।

        তারপর কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। হয়ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সম্বিৎ যখন ফিরল, তখন আমি খোলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি, ফুরফুর করে গঙ্গার হাওয়া আসছে, ক্যানভাসে টাঙানো আমার ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' । এখনও আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব আমার চারিদিকে, নিজেকে আশ্চর্যরকম হালকা অনুভব করছি। ল্যাম্পপোস্টের নীচে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই ফুচকাওয়ালা। কিন্তু আজ একটা পরিবর্তন হয়েছে, তার কাছে ফুচকা খাচ্ছে এক জোড়া তরুণ তরুণী। সারাদিন কিছুই খাইনি, খিদে বোধ হচ্ছে না যদিও তবু একটু ফুচকা খেলে মন্দ হয় না। সারাদিনের অনাহারের জন্যই আমার পায়ে কোনো সাড় নেই বোধহয়, যেন সেগুলো শূন্যে ভাসছে। তবুও কিভাবে যেন হাঁটতে হাঁটতে কিংবা হয়ত ভাসতে ভাসতেই একরকম পৌঁছে গেলাম ফুচকাওয়ালার কাছে।

        আমাকে দেখে একগাল হেসে শালপাতা ধরিয়ে দিল সে। মাথায় ছোট করে ছাটা কাঁচা পাকা চুল, চোখগুলো কেমন গর্তে বসা, মুখে একটা ক্ষ্যাপাটে ভাব। শীর্ণ আঙ্গুলগুলো দিয়ে আলু মটর মাখতে শুরু করেছে সে। মাখতে মাখতেই সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় নিজের মনেই বলে চলেছে,
- ছোটেলালের ফুচকা, প্রতিটা পিস মাস্টারপিস। একবার খেলে বার বার খাবেন।
প্রথম ফুচকাটা মুখে তুলেই বুঝলাম, লোকটা ভুল কিছু বলেনি, দিব্যি স্বাদ ফুচকার।
- তা ছোটেলাল। তুমি সন্ধ্যেবেলা না বসে এই রাতদুপুরে বসো কেন?
ফিক করে হেসে লোকটা বলে ওঠে
- আমার খদ্দেরদের যে এটাই সময়।
- মানে?
- মানে আপনি যা ভাবছেন তাই! ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর এলো।
- কি বলতে চাও হে, ভূতেদের খদ্দের করেছ নাকি তুমি? হালকা মেজাজে কথাটা বললাম আমি।
- বলতে চাই না বলছি। একটু আগেই যে একজোড়া এসছিল, বাড়িতে মেনে নেয়নি বলে ওরা তো এই ঘাটেই ঝাঁপ দিয়েছিল হেঁ হেঁ। আর আমিও তো, বেঁচে থাকতে ফুচকা বিক্রিই হত না। অন্যরা নিজেদের ফুচকা বিক্রি শেষ করে চলে যেত, আমি বসে থাকতাম ঘাটে। চার বছর আগে একদিন দিলাম সব শেষ করে!
- কি আবোল তাবোল বকছ তুমি বলত? আমার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে এবার।
- " আবোল তাবোল নয় বাবু" । কান এঁটো করা হাসি হেসে বলে চলে ছোটেলাল। " আমার পেছনে বোস বাবু আসছেন। ইন্সুরেন্স এজেন্ট। লাইফ ইন্সুরেন্স বিক্রি না করতে পেরে একদিন নিজের লাইফটা শেষ করে দিলেন। ওনার নিজের কোনো ইন্সুরেন্স ছিল না হেঁ হেঁ।"
বলতে বলতে ছোটেলাল নিজের মুন্ডুটা পুতুলের মত ঘাড়ের ওপর একশো আশি ডিগ্রী ঘুড়িয়ে দেয়। এই পৈশাচিক আতঙ্কের মধ্যেও আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লক্ষ্য করলাম, একজন গোবেচারা গোছের লোক কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এগিয়ে আসছে। ল্যাম্প পোস্টের আলো লোকটার ভারী চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে। আশ্চর্য এই ছোটেলালের ঘোরানো মাথা তাকে একটুও অবাক করল না।

        আমি আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে, নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমার মেসের দরজায়। আমি বুঝতে পারছি, এত ভয়ের মধ্যেও একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে আমার মনের মধ্যে।

        দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই ইজেলে টাঙানো ছবিটায় চোখ পড়ল। মন্ত্রমুগ্ধের মত রং তুলি তুলে নিলাম হাতে, ফুটিয়ে তুললাম আমার দেখা ফুচকাওয়ালার সেই ভর্তি বয়ামটা আর টিমটিম করে জ্বলতে থাকা পিদিম। সারাদিনের বিক্রি না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে সাদা ধুতি আর বাংলা শার্ট পড়া ফুচকাওয়ালা বসে আছে গঙ্গার ধারে। এবার আমার ছবিতে এসেছে কি পার্থসারথি বাবুর চাওয়া সেই " হিউম্যান টাচ"?
ছবিটা রোল করে ফোল্ডারে ঢুকিয়ে, মিত্র গ্যালারির ঠিকানা সেটে দিলাম তাতে, এবার কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে যাবে সেটা। তারপর তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে, সেটার জায়গা হবে হয়ত মিত্র গ্যালারির মাস্টারপিস সেকশানে কিংবা হয়ত আস্তাকুড়ে।

        ক্লান্ত মস্তিষ্কে রং মাখা হাত বাথরুমে ধুতে ঢুকতেই যে দৃশ্যটা চোখে পড়লো তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাথরুমের ছাদের আংটার সঙ্গে বাঁধা গামছা থেকে ঝুলে আছে একটা দেহ। তার গালের দু সপ্তাহের না কাটা দাঁড়ি, হাতা গোটানো ঘামের দাগ বসা সবুজ শার্ট - এগুলো আমার খুব চেনা কারণ সেগুলো আমি বহুবার দেখেছি। হ্যাঁ, মৃতদেহের হাঁ করা চোখ ঠিকরে যাওয়া যে মুখটা এখন বিভৎস হয়ে গেছে সেটাও আমি অজস্র বার দেখেছি - আয়নায়। আমি এটাও বুঝলাম আমার মনের মধ্যে লেগে থাকা প্রশ্নটার উত্তর আমি পেয়ে গেছি এবার। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেন চার বছর আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া লোকটার হাতের ফুচকা আমি খেতে পারলাম আজ। কারণ আজ থেকে আমিও যে সেই ব্যর্থ মানুষগুলোর দলে যারা জীবনের ক্যানভাস থেকে নিজেদের মুছে ফেলেছে চিরকালের মতো। আর সেই না-মানুষ আমিই আমার শেষ আঁকা ছবিতে এনে দিয়েছি হিউম্যান টাচ - মনুষ্যত্বের স্পর্শ।

        আমার অন্তিম ল্যান্ডস্কেপ এর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, জানলার গরাদ গলে বাইরে বেরিয়ে এলাম, কোনো অসুবিধে হলো না। গঙ্গাবক্ষের অপার্থিব জোৎস্নার সেই জগৎ আমার ইজেলের নীল কালো আর সাদা রঙের মতোই অবসাদ আচ্ছন্ন অথচ সুন্দর। এই পৃথিবীতে ভাড়ার তাগাদা নেই, আমার ছবি বিক্রির চিন্তা নেই, ছোটেলালের ফুচকা বিক্রির দায় নেই, বোস বাবুর ইন্সুরেন্স নেওয়ার ক্লায়েন্ট নেই। আছে শুধু কালচে নীল রঙের অনন্ত অন্ধকার। রাতের অন্ধকারের সেই নেশাতুর রঙের সাথেই আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে আমার আঠাশ বছরের জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা আর সমস্ত স্ট্রাগল। সব শিল্পীর সেরা শিল্পীর আঁকা শেষ রাতের সেই ক্যানভাসে আমি নিজেকে বিলীন করে দিলাম।

(সমাপ্ত)

 Ankur Chakraborty