জয়তী রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জয়তী রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুদ্ধিং যস্য - জয়তী রায় মুনিয়া

 

বুদ্ধিং যস্য
জয়তী রায় মুনিয়া 
 

 

 
      নাইজেরিয়ার লেগস বন্দর। দাঁড়িয়ে আছে চৌষট্টি হাজারটনের কার্গো জাহাজ,  এম ভি কনক -নারী।  তার পেটের মধ্যে থেকে খালাস হল পোষা প্রাণীদের জন্য খাবার। খাবার গুলো আনা হয়েছে আর্জেন্টিনা থেকে। একমাস ধরে নোঙর ফেলে আছে এখানে। কাজ চলছে।

        লেগস বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়বে আগামীকাল। লক্ষ্য হিউস্টন। মুম্বাই থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল।  শেষ মুহূর্তে ব্যস্ততা তুঙ্গে। ক্যাপ্টেন স্বামীনাথন , চিফ ইঞ্জিনিয়ার রণজিৎ সাহা , বাকি লোকজন সহ জাহাজে লোক প্রায় চল্লিশজন। মাল খালাস করছে দশাসই চেহারার নাইজেরিয়ান কুলিরা। দারিদ্রতা এদের বানিয়ে দিয়েছে রুক্ষ্ম। নৃশংস। 

   আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে , আমেরিকার হিউস্টন বন্দরে যাবে, জাহাজ কনক-নারী, তুলবে রাশিকৃত গম। 

 ফিস ফিস করে ক্যাপ্টেন বলে:

 :হে চিফ! রাস্তা    নিরাপদ নয়। প্রচুর আফ্রিকান জলদস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার তো নতুন বিয়ে। সোনা দানা আছে না কি? 

  বিরক্ত গলায় উত্তর দেয় চিফ রণজিৎ--সে আর বলতে স্যার! এত করে বারণ করলাম। কিন্তু নতুন বউ। রোজ সাজবে গুজবে। রোজ একটা করে গয়না পরবে। 

---দেখবে কে? তুমি?

---স্যার। সমুদ্রের লোনা জল। আর আকাশের পাখি। ওরাই দেখবে। সামনের পনেরোদিন তো ওরাই সঙ্গী আমাদের। 

  গলা খুলে হেসে উঠল দুই নাবিক। দুই পুরুষ। কিছুক্ষণ পরেই তারা পাড়ি দেবে , অতল গভীর রহস্যময় সাগর। পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি।  আধুনিকতম যন্ত্র হার মেনে যায় প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার কথা আগাম জানান দিতে। আর সেই সঙ্গে সাগরদস্যুর দল। এরা বেশিরভাগ দরিদ্র আফ্রিকান। যেমন দুরন্ত গতির, তেমনি নিষ্ঠুর। ভয়ঙ্কর চেহারা। কালো, তালগাছের মত লম্বা, ক্রুর চাউনি। হাতের থাবা এমন যে, তার মধ্যে ঢুকে যাবে মানুষের মাথা। খুব দ্রুত কাজ করে এরা। কথা না শুনলে , নিমেষের মধ্যে গুলি চালিয়ে দেয়। অকারণ হত্যাও করে কখনো কখনো। 

  **********

    পিছনে সাদা ফেনা উড়িয়ে নীল সাগরের বুক চিরে মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এম ভি কনকনারী। সকাল নয়টা বেজে চার মিনিট ।  গন্তব্যর দিকে এগোতে আরো পনেরোদিন বাকি...মানুষের হিসেবমতো। প্রকৃতির ক্ষমতা রাখে হিসেব উল্টে দেওয়ার।  জাহাজ যখন জলে, তখনো কাজ চলে। পেটের ভিতর পুরো কারখানা। মেশিনপত্র।  ইঞ্জিনরুম। উপরে ক্যাপ্টেন , অফিসারদের ঘর। খাবার মেস। ডেকের উপর পাতা চেয়ার। পাশে বার। চেয়ারে পা তুলে অলস ভঙ্গিতে বসে ছিল রুণা। রণজিৎ পই পই করে বলেছিল--তুমি চাইলে থেকে যেতে পারো। এই ট্রিপে জাহাজে কোনো মহিলা থাকছে না। তুমি একলা হয়ে যাবে।

  রুণা শোনেনি। এটা ওর হানিমুন ট্রিপ।  কেউ না থাক --সেটাই তো ভালো। নির্জনতার সঙ্গে ভাগ করে নেবে ভালোবাসা। ইঞ্জিনরুমে ডিউটি শেষ করেই , দুজনে একসঙ্গে হয়।  এই আর্জেন্টিনা থেকে ওরা ফিরে যাবে ভারতের দিকে। সেটা অনেক লম্বা সফর। 

 সমুদ্র দেখে দেখে আশ মেটেনা । জলের রঙ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে জলের চরিত্র। কখনো রেগে যাচ্ছে, কখনো উতলা বাতাস আর লোনা জলের ঝাপটায় আদুরে, কখনো দার্শনিকের মত নির্লিপ্ত। রুণা বক বক করে সাগরের জলের সঙ্গে, ডেকের রেলিংয়ে চিবুক ঠেকিয়ে--গলা ছেড়ে গান শোনায়। মাঝসমুদ্রের জল শান্ত হয়ে তার সব আবেগ ধারণ করে। মুগ্ধ রুনা ভাবে--সমুদ্রের মত প্রেমিক বাস্তবে কেন হয় না? 
************
    
 রণজিৎ ভীষণ খুঁত খুঁতে। সব কিছুতেই চিমটি কাটা মন্তব্য। জাহাজে ওঠার আগে, গয়না দিল মা । তাতে এমন বলার কি দরকার ছিল যে--জাহাজে তোমায় কে দেখবে? এমন কেউ বলে? গভীর অভিমান নিয়ে সাগরের দিকে তাকায় রুনা। প্রত্যেক সম্পর্কের ভিতর ছোট্ট করে লুকিয়ে থাকে পরকীয়ার বীজ। রুণার  মনে হয়, সাগর যদি প্রেমিক হত তার? সে যাই বলুক, যত তুচ্ছ আবেগ, অভিমান--সাগর চুপ করে শোনে। নিজের ভাষায় উত্তর দেয়। সব পুরুষের এই বোধ নেই। তাদের পুরুষালী দুনিয়ায় মেয়েলী অভিমান ঠাঁই পায় না। 

    মনে পড়ে পার্থর কথা।  আবোল তাবোল যাই বলত রুণা, পার্থ মন দিয়ে শুনত। কিন্তু বিয়ের বাজারে ধনী রঞ্জিতের কাছে হেরে গেল পার্থ। কবি পাত্র কখনো দাঁড়াতে পারে ইঞ্জিনয়রের কাছে? আজ মনে হয়, দিনের শেষে যদি অতৃপ্ত মন নিয়ে সোনার পালঙ্কে শুতে হয়--তবে সেই সম্পর্ক, ব্যাংকের ভল্টে তুলে রাখা গয়নার মত। নিরাপদ কিন্তু আটপৌরে জীবন থেকে অনেক দূরের। 
**************

      জাহাজে ডিনার সারা হয়ে যায়, সন্ধ্যে ছটার মধ্যে। তবে ইঞ্জিনরুম খোলা সারারাত। শিফট ডিউটি চলে। আজ রাত নয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত ইঞ্জিনরুমে থাকবে রণজিৎ। তাছাড়া , চিফ ইঞ্জিনয়রের ফোন খোলা থাকে সারারাত । স্ত্রীকে সতর্ক করে এবং আদর করে রণজিৎ পা বাড়াল ইঞ্জিনরুমের দিকে। যা থাকে সমুদ্রের জলের তলায়। জাহাজ শিল্পটাই অদ্ভুত। তার পেটের মধ্যে থাকে আমদানী রপ্তানীর জিনিস। যার জন্য তাকে মনে করা হয় নারী। ship is she। আর sea is he। 
**************

  দরজায় প্রবল ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল রুণার।  তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই দেখে রণজিৎ --

   :জাহাজ আক্রমণ করতে আসছে জলদস্যুর দল। তোমার যা কিছু আছে নিয়ে চলো ক্যাপ্টেনের ঘরে। 

 রুণা হতবাক। জলদস্যু? ---ফাস্ট--রণজিৎ তীব্র স্বরে বলল। হাউসকোট গায়ে চাপিয়ে , গয়নার পাউচ বগলদাবা করে ছুটে চলল, করিডরের শেষ মাথায় ক্যাপ্টেনের ঘরে। স্বামীনাথন আর দুজন সিকিউরিটি গার্ড বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

   ---ভল্ট আমার ঘরে। ওরা এখানেই আসবে। রণজিৎ , তুমি বাকিদের দেখো। একটি প্রাণ ও যেন না যায়। রুণা এখানে রইল। গো। যাও। আদেশ করল ক্যাপ্টেন।

     বন্ধ দরজা। রণজিৎ কোথায় গেল কে জানে? 

ক্যাপ্টেন বললেন--ওটা তোমার জুয়েলারি প্যাক? ভল্টে রাখো। 

---আমার কাছেই থাক। 

 বলে হাত তুলে, মখমলের পাউচ দেখাল রুণা--এটা গায়ের চাদরের ফাঁকে ঢুকে যাবে। 

---কি আছে? হিরে? ডায়মন্ড?

ম্লান মুখে মাথা নাড়ল রুণা। হিরের ছোট ছোট গয়না। দেখতে বড় না। কিন্তু প্রচুর দাম।

---are you sure? ওরা কিন্তু জানে, মহিলারা শরীরে গয়না লুকিয়ে রাখে। কিছুই বাঁচবে না। শুধু প্রাণ থাকলেই হল। 

   রুণা বিবর্ণ মুখে ঘাড় হেলায়। ক্যাপ্টেনের ঘরে সোফার কোনায় চুপ করে বসে থাকে। মিনিট পাঁচেক ও কাটেনা। দমদম ঘা পড়তে থাকে দরজায়:

    :হে ক্যাপ্টেন । ওপেন দি ডোর। ক্যাপ্টেন--- গম্ভীর কর্কশ গলায় কেউ বলে।

        সেই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন স্বামীনাথন যেন এক পাহাড় হয়ে যান। একাই এগিয়ে এসে দরজা খোলেন। হুড়মুড় করে ঢোকে তিনজন অতিকায় কালো মানুষ। প্রত্যেকের হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। মুখ ভাবলেশহীন। চোখ গুলো ঘুরছে। রুণার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। ক্যাপ্টেন গম্ভীর স্বরে বলল--

  :হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? উত্তরে একটা লোক স্টেনগান সোজা ধরল তাক করে। মাতালের গলায় বলল:

   :ওপেন ওপেন। ফাস্ট ফাস্ট। অন্য দুজন ভয়াল দৃষ্টিতে তাকাল রুণার দিকে। দেরি করে লাভ নেই দেখে, ক্যাপ্টেন খুলে দিলেন , ভল্ট। ভিতরে ডলারের তাড়া দেখে খুশিতে শিশ দিয়ে উঠল তারা। কোমর দুলিয়ে নেচে  নিল একটু। তারপর ফিরল রুণার দিকে---হে লেডি? ওপেন ব্রেসলেট। 

এভরিথিং। 

 রুণা তাড়াতাড়ি লোহা বাঁধানো আর কানের যে সামান্য সোনা খুলে দিল। তারা সন্তুষ্ট হলো না। খুব চালাক এরা। বলল:

  :নো। ইটস নট এনাফ!  হু ইস শি?

    চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওয়াইফ- শুনে কর্কশ রাগী গলায় বলল:

  :লেটস গো টু ইয়োর রুম। ফাস্ট ফাস্ট। 

একরকম ঠেলতে ঠেলতে তাকে নিয়ে এল নিজের ঘরে। ক্যাপটেন দৌড়ে এলেন সঙ্গে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে বিশেষ কিছু পেল না। তবে, খুব একটা অ-খুশিও মনে হল না তাদের । এমনিতেই অনেক কিছু পেয়েছে। প্রচুর ডলার, শুকনো খাবার, দামী হুইস্কি --সব নিয়ে--হে ক্যাপ্টেন। স্লিপ ওয়েল...বলে শিষ দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে রাত আর কুয়াশায় হারিয়ে গেল ওদের স্পিড বোট। যে হুকওয়ালা দড়ির মই ঝুলিয়ে, জাহাজের রেলিং বেয়ে টপাটপ উঠে পড়েছিল, সেটাও সঙ্গে নিতে ভুলল না। 
********

   একটা প্রবল ঝড় যেন তছনছ করে দিল সকলকে। প্রাণের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। প্রাণ বেঁচে গেছে, এতেই খুশি সবাই।  আফ্রিকান জলদস্যু এখন পৃথিবীর প্রায় সব সাগর জুড়ে তান্ডব করে বেড়ায়। জাহাজে রক্ষী থাকে। কিন্তু দস্যুদের হিংস্রতার কাছে তারা সব নস্যি। আক্রমণ হবে কি না হবে, পুরোটাই  জাহাজের ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।

  সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সবাই রুণাকে নিয়ে পড়ল। গয়না কোথায় তোমার? হাতেই তো ছিল। কোথায় গেল? 

রুণা ধীর পায়ে উঠে, সামনেই রাখা ক্যাপ্টেনের মস্ত বড় গামবুট তুলে নিয়ে এল। সবার অলক্ষ্যে ওটার মধ্যেই গয়নার মখমলের পাউচ ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে। রাখে বুদ্ধি মারে কে?
.................................
 অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার

 

মাতৃদোষে - জয়তী রায়

 

মাতৃদোষে
জয়তী রায়
 

 

  আরে, ভয় কিসের? চুক চুক চুক চুক। পুরুষ তো তুমি। টিপে ধরো আমাকে। কামড়ে দাও। উপরে ওঠো। ওঠো। ওঠোওঠোওঠো। 

নীল আলোয় ভেসে যাওয়া শোবার ঘরে রাত এখন বারোটা। বিশাল খাটের উপর হামাগুড়ি দিচ্ছে উলঙ্গ নারী। সরে সরে যাবার চেষ্টা করছে। তাকে ধরতে হাত বাড়াচ্ছে লোমশ পুরুষ। খল খল করে হাসছে। পুরুষটির গলায় হার। ঠোঁটে লিপস্টিক। হাতে চুড়ি। সে এবার চিৎ হয়ে শুয়ে এক ঝটকায় নারীকে উপরে শুইয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল," এমন করে না কি? ছি। আদর করো আমাকে। আদর করো। চুমু দাও। 
নারী ঘামছে। চুল খুলে গেছে। চোখ দুটো আশ্রয় খুঁজছে। হঠাৎ গলা দিয়ে বমি উঠে ভাসিয়ে দিল পুরুষের মুখ বুক শরীর। অজ্ঞান নারী গড়িয়ে পড়ে গেল পুরুষের উপর থেকে। 

-2-

বসুবাড়ির রবিবারের সকাল। জল খাবারের বিশাল আয়োজন। লুচি আছে। সেইসঙ্গে সাদা আলুর তরকারি। মোহন ভোগ। ক্ষীর। জমিয়ে বসেছেন বড় কর্তা রমেন্দ্রনারায়ণ বসু আর তার দুই ভাই, যথাক্রমে মেজো ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আর ছোট দীপ্তেন্দ্রনারায়ণ। শ্বশুর শাশুড়ি অবর্তমানে বড় বউ দীপ্তিময়ী বাড়ির গিন্নি। নির্দিষ্ট চেয়ার থেকে তিনি গম্ভীর স্বরে ছোট দুই জা র উদ্দেশ্যে বললেন," তোদের ফিসফিস গুজগুজ শেষ হলে ছেলেদের একটু মোহন ভোগ দে। 
মেজগিন্নি অলকা তাড়াতাড়ি মোহনভোগ এনে নিজের ছেলের পাতে দিতে গেল। দীপ্তিময়ী বেঁকা হেসে বললেন," স্বভাব আর যাবে না। বলি, আর কত? তবু যদি মোহনভোগের ঘিটুকু নিজের গ্যাঁট থেকে যেত। ঠাকুরপো, নিজের ছেলে পরের ছেলের ভাগাভাগি এবার কমাও। 
কথা তো নয়। যেন তপ্ত তেলে শুকনো লঙ্কা। সদাশয় রমেন্দ্রনারায়ণ বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু , দীপ্তিময়ী তোয়াক্কা করেন না। বিয়ে হয়ে যখন এলেন , তার স্বামী একমাত্র রোজগেরে। আর আজ দুই ভাই দাঁড়িয়ে গেছে। তবু একটা পয়সা উপুড় হাত করবে না। সবেতেই বড়দা। এরকম করে চলে? স্বামীর বয়স হচ্ছে। পুত্র সন্তান নেই যে রোজগার করে খাওয়াবে। বাকি দুই ভাইয়ের একটি করে ছেলে। দুদিন পরে লায়েক হলে বাবার পাশে দাঁড়াবে। তার আগে যত পারো চুষে নাও দাদাকে। রাগে কস কস করতে থাকে মনের ভিতর। ওদিক থেকে ছোট জা ভালোমানুষ গলায় বলে, শ্রী অনেকদিন আসেনি। এবার এসে থাকুক দিন কতক। 
দীপ্তিময়ী চেহারার গনগন আগুন কেমন নিভে গেল হঠাৎ। তবু জোরালো গলায় বলে উঠলেন," নিজের চরকায় তেল দাও রমলা। আমার মেয়ে কবে আসবে বাপের বাড়ি, সে আমি বুঝে নেব। ওতো বড়ো বনেদি পরিবারে বিয়ে হয়ছে। ঝপ বললে খপ করে তো আসতে পারবে না। তত্ব তলাশ করে দিয়ে থুয়ে আনতে হবে। 
মেজো ভাই লুচি ছেঁড়া বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বলে উঠল," আমাকে বলো বড় বৌদি। কি করতে হবে। 
-- থাক। তোমার এখন ছেলে ভর্তির সময়। তুমি বরং সেটাই মন দিয়ে করো। 
এইসব সময় বড়কর্তা কথা কন না। বলে তেমন কোনো লাভ হয় না, তিনি দেখেছেন। দীপ্তিময়ীর প্রতাপ এমন যে, তার সামনে নিজের গলা অত্যন্ত ক্ষীণ শোনায়। সমস্ত সংসারের দন্ড মুণ্ডের কর্তা হল বড় গিন্নী। শুধু কর্তা হলেও বলার কিছু ছিল না, আজকের এই আধুনিক যুগে, কলকাতা শহরে বসেও, বড় গিন্নীর মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক শাসন করার প্রবণতা দেখা যায়। সেটা ওই ছোট দুই ভাইয়ের কম রোজগারের জন্য আরো সুবিধা হয়। রমেন্দ্রনারায়ণ লক্ষ্য করেছেন, অসহায় পরিবার দুটিকে হাতের মুঠোয় রেখে শোষণ করার সময় দীপময়ীর মুখ চোখ জ্বল জ্বল করে। বিকৃত আনন্দ পান মনে হয়। যাক, এসব না ভেবে বরং ক্ষীর খাওয়াই ভালো। 

-3-

ডিমের ওমলেটের গন্ধ খুব বিচ্ছিরি। ইস। খুব যত্ন করে ভেজে দিয়েছে রান্নার মাসী। সঙ্গে টোষ্ট। মাখন। কফি। পরিপাটি। ঝকঝক ডাইনিং টেবিল। শুধু এক জায়গায় কেন, গোটা বাড়িটা দেখার মতন। দক্ষিণ কলকাতার চারহাজার স্কোয়ার ফিটের বিশাল ফ্ল্যাটে শুধু তিনটি প্রাণী। শ্রী , শাশুড়ি আর স্বামী অনির্বাণ। ছিমছাম পরিবার। ছিমছাম কথা। ঢিমে তালে। নিচু স্বরে। কাজের দুটো লোক। কাজ করে বাতাসে ভেসে। কখন আসে কখন বাড়ি যায় কেউ টের পায়না। মাধুরী অর্থাৎ শাশুড়ি প্রশ্ন করলেন," ভালো লাগছে না শ্রী? ওহহ। মনে হচ্ছে, ভেজে ফেলেছে বেশি। সরিয়ে রেখে দাও ওটা। 
শ্রী সতর্ক গলায় বলে," না না। ঠিক আছে। 
মায়ের থেকে আরো এক কাঠি নরম সুরে বলে অনির্বাণ," একদম খেতে হবে না। আমি নিজে কিচেনে যাচ্ছি। রবিবার ওদের বাড়ি লুচি খাওয়া হয়? তাই না? 
শ্রী আবার মরমে মরে গেল। তাদের বাড়ির এমন কোনো ডাইনিং হল নেই। পুরোটাই রান্নাঘর। সেখানে সব কিছু বড় বড়। ভারি ভারি। গোবদা একটা টেবিল ঘিরে কিছু চেয়ার। বসে পড়লেই কাঁসার থালা দুম , জলের গ্লাস ঠকাস। বাইরের লোকজন এলে কাঁচের গ্লাস বার করা হয়। অনির্বাণ আবার মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল," প্লিজ ফিল ফ্রী। তুমি লুচি আর সাদা আলুর তরকারি খাবে? আমারও ফেভারিট। মাসী , আলু কেটে জলে ভিজিয়ে দাও। আমি যাচ্ছি। 
বলতে বলতে অনির্বাণ কিচেনের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল। ফর্সা ধপধপ চেহারা। ব্ল্যাক টিশার্ট আর বারমুডা। পায়ে স্লিপার। প্রায়ই নানা রকম রান্না করে। শিল্পীর মত সরু সরু আঙ্গুল নাচিয়ে সে বলে," ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে, মায়ের সঙ্গী তো আমি। তাই না মম? 
মাধুরী ফিনফিন করে হাসেন। রঙিন কাফতান, সুন্দরী এই মহিলার সঙ্গে মা দীপময়ীর মিল কেবল একটি মাত্র জায়গায়, সেটা হল, কর্তৃত্ব  হাতের মুঠোয় রাখা। 
অনির্বাণ পাকা হাতে লুচি তৈরি করে। নির্বাক শ্রী পুতুলের মত টেবিলে বসে থাকে। মাধুরী বলেন," ছোট বেলার অনিকে দেখতে ছিল একদম একটা পুতুলের মত। সবাই ভাবত মেয়ে। বড় হতে হতে ওই হল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সাজ পোশাক লিপস্টিক সব ওর পছন্দেই কেনাকাটা করা হত। 
" সে ভারি মজার দিন ছিল জানো শ্রী। 
দ্রুত হাতে প্লেটে লুচি গোছাতে গোছাতে বলে অনির্বাণ," মা আর আমি মিলে ঘর সাজাতাম। নাড়ু বানাতাম। পাস্তা পিজা। তারপর রাত জেগে সিনেমা... এখন এত ব্যস্ত! দিন গুলো বদলে গেল। 
শ্রীর সামনে লুচির প্লেট এগিয়ে দিয়ে মা কে জড়িয়ে শব্দ করে চুমু খায় অনির্বাণ। লুচির টুকরো ভেঙ্গে মায়ের ঠোঁটের কাছে ধরে। আর শ্রী দেখতে পায় সাদা লুচির শরীর জুড়ে লাল লাল রক্তের ছোপ। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এসব কি হচ্ছে? এসব কি ভাবছে? এসব কেন দেখছে? মা দীপময়ীর মুখ মনে পড়ে। গম্ভীর থমথম। অহঙ্কারী। মায়ের উঁচু মাথা লুটিয়ে দিতে পারবে না সে। চোখ বন্ধ করে রক্ত মাখা লুচি খেতে থাকে। টেবিলের দুই প্রান্ত থেকে মা - ছেলে তাকে দেখতে থাকে। যেমন করে শিকার ফাঁদে পড়লে দেখে শিকারি। 

-4-
 
             " অতি দর্পে হত লঙ্কা বুঝলি ছোটো । দ্যাখ বাপু,  আমি যা বলি মুখের ওপর বলি, সেই জন্য মেজোগিন্নি খারাপ। বলি সুন্দরী মেয়ে, বিদুষী মেয়ে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা! লাভ হলো কিছু?"

 : বিয়ের সময় এতো খরচ দেখে তো চোখ কপালে উঠে গেলো গো। ভীতু ছোটবৌ চিমটি কেটে বললো।

 শ্ৰী  আমাদেরও মেয়ে। আমাদের  দুটো করে ছেলে।  মেয়ে বলতে তো ঐ একমাত্তর। কিন্তু  বড়োগিন্নী সে কথা বুঝলে তো?
 খরখর করে ওঠে মেজোগিন্নী।

:মেজদি গো। নামেই বসুপরিবার যৌথ পরিবার । আসলে  দীপময়ীর হিটলাররাজ চলে এখানে। 
কাউকে তোয়াক্বা করেন না উনি। এখন? । হলো তো? হলো? ঐ মুখ আর কাউকে দেখাতে হবে না!

 আহা! শ্রী আমাদের বড়ো ভালো মেয়ে গো মেজদি। কোনোদিন উঁচু গলায় কথা বলেনি । রূপে লক্ষী গুণে সরস্বতী। মা বাবার পছন্দ করা পাত্রকে এক কথায় বিয়ে করে নিলো। তার কপালে এমন ছিল! আহা।
**

ননদ কথাটা বলতে আঁতকে উঠলেন দীপময়ী," এ কি বলছ দিদি? পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব? শ্রী পাগল না কি! 
ননদ বিরক্ত। 
" কোন যুগে পড়ে আছো বৌদি? সারাক্ষণ ঠাকুর আর রান্নাঘর করে করে তোমার এই দশা। মনের ডাক্তারের কথা বলছি। 
" ওই একই হল। 
" নাহ্। মোটেই এক না। আর ইনি শুনেছি, পাশ করা ডাক্তার নন। ইনি কথা বলেন। ওষুধ লাগলে অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে বলেন। 
" কথা বলে বলে শ্রীকে ভালো করবেন? মাথায় আর চাপ সহ্য হয় না। 
ননদ হাত রাখল বৌদির কাঁধে। 
" বুঝতে পারছি মনের অবস্থা। চলো না একবার। ওষুধ দেন না। চিকিৎসা পদ্ধতি অন্য রকম। 
শেষদিকে বুজে আসে ননদের গলা," শ্রী আমাদের এত ভালো মেয়ে। কি যে হল! কেন কথা বলে না! 
দাপুটে দিপময়ী যেন ঝড়ে ভাঙ্গা গাছ। এই ননদ তার খুব কাছের মানুষ। এর কাছেই একটু নরম তিনি। এ যখন জোর করছে, যাওয়া যাক ডাক্তারের কাছে। 

-5-

আজ তিনদিন হল। পর পর আসছেন দীপঙ্কর বিশ্বাসের চেম্বারে। যিনি নিজেকে বলেন মনের বন্ধু। এই তিনদিন শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। লোকটাকে অসহ্য লাগছে। রোগ তো তার মেয়ের। তাকে কেন এমন প্রশ্ন করা? তবে এটা ঠিক, সব বলতে বলতে কেমন হাল্কা বোধ হয়। প্রশ্নগুলো ধারাল ছুরি। যেন অতীত ছিঁড়ে ফেলে।
দমচাপা নিষ্ঠুর অতীত। অবাক হয়ে অনুভব করেন, তিনি এখনো ওই অতীতে বাস করছিলেন। অন্ধকার সময়টাই তাকে চালাচ্ছিল? 

    : দেখুন মিসেস বসু। আপনার মেয়ে চুপ করে গেছে। খাচ্ছে না। বমি করছে। শুন্য চোখে তাকিয়ে আছে। এটা এক ধরণের অসুখ। আপনারা যদি এমন অস্থির হয়ে যান তবে তো মুশকিল!
" অস্থির হব না? 
" নাহ্। 
পেন ঘোরাতে ঘোরাতে হাসি মুখে উত্তর ডাক্তারের। 
    
" আপনি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন? ওর বাবা আর হাসে না। আত্মীয় স্বজন আড়ালে গুজগুজ করছে। ওর শাশুড়ি যেদিন ডেকে বলল যে, মেয়েকে নিয়ে যান। ও কথা বলছে না। সেদিন... সেদিন...!
" শান্ত। শান্ত। কি বলেছি এই দুদিন ধরে? আপনি শান্ত তো দুনিয়া শান্ত। 

" শাশুড়ি খুব ভালো। কি মিষ্টি ব্যাবহার। কিছুদিন আমার কাছে রাখতে বললেন। যদি আস্তে আস্তে ঠিক হয়। আবার ফিরিয়ে নেবেন । এটাই ভরসা।

মনেরবন্ধু তাকাল সামনের মহিলার দিকে। অসহায় প্রাণ। অন্ধকারে রাস্তা খুঁজে চলেছে। বাইরে দাপট। ভিতরে ভিখারী। বাইরে ভিতরে সমান ধনী হলে, তবেই সে পূর্ণ। 
 
 -মেয়ের একবছর বিয়ে হয়েছে তাই তো! 
-- একবছর দশ দিন।'

- খোঁজ নিয়েছিলেন সব কিছু?
 খোঁজ নেবেন না দীপময়ী? তার একমাত্র মেয়ে। সুন্দরী। মিষ্টি নরম স্বভাব। ইতিহাস অনার্স। ঘরোয়া।  মোটে বাইশ বছর বয়স। খোঁজ কেন নেবেন না? অনির্বাণ গর্ব করে বলার মতো জামাই। আইআইটি খড়গপুর। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। । এক মাত্র ছেলে । বাবা নেই। মা আছেন।  লোক লাগিয়েছিলেন। পাড়ায় ভীষণ সুনাম।

-- এখনো ওরা খুব ভালো ব্যবহার করছে। ওরা তো বুঝতেই পারছে না, কেন ওদের বউ মাত্র একবছরে এমন পাল্টে গেল? 
--- হম। বুঝবে বুঝবে। স অ ব বুঝবে। আপনি ওদের জানিয়েছেন আমার কথা? 
" জানিয়েছি। দরকার যদি মনে করেন, ওরা আসবে।
" দরকার হলে মানে? শ্রীর এই অবস্থার জন্য সক্কলে দায়ী। তাদের আসতে তো হবেই। 
" ডাক্তার বাবু, দোষ আমার মেয়ের। ও বরাবর কুনো। চাপা। হয় কে নয় করে। কিচ্ছু বোঝে না। একলা একলা ছাদের ঘরে বসে থাকবে। আপনি ওকে জেরা করুন। ওষুধ দিন। ওর সংসার বাঁচান। 
" ওষুধ আমি দি ই না মিসেস বসু। আপনাকে আমি আগেই বলেছি। বিশ্বাস যদি না করেন, ওষুধ দিতে চাইলে অন্য জায়গায় যেতে পারেন স্বচ্ছন্দে। 
" গোড়া ছেড়ে আগা ধরছেন। ডাক্তার আপনি। আমরা কি করলাম? পুলিশের মত জেরা করেই চলেছেন তিনদিন ধরে। 
" দেবীর এক রূপ হল মা। মাতৃরূপে ন সংস্থিতা। মায়ের খবর জানলেই ছা য়ের খবর জানতে পারব। তারপর ঘাড় মটকে ধরব সমস্যার। 

-
--ডাক্তার বাবু। 
দীপময়ী স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় বলেন," আমি মা। রাক্ষসী নই। 
" গাছ সুন্দর হলে ফল সুন্দর হতে বাধ্য। কিন্তু , গাছ নিজেই যদি ভিতরে ভিতরে হতাশায় ভোগে, তবে , ফলের পুষ্ট হতে সমস্যা তো হবেই। 
" কি বলছেন আপনি? আমি সমস্ত সংসার চালাই। আমি এক হাতে ধরে রেখেছি সব। আমি ভুগব হতাশায়? এই আপনি ডাক্তার? 
ছিটকে ওঠে দীপময়ী।
" আর এক মুহূর্ত থাকব না এখানে। যত সব ভুলভাল। 
" এক মিনিট। চুপ করুন বলছি। এক মিনিট শুনুন। এত কিসের অহঙ্কার আপনার? স্বৈরাচারী শাসক নাকি? সবাইকে দমিয়ে রাখতে চান। কেন শুনি? 
" আমি না হলে, এই সংসার কোথায় ভেসে যেত আপনার কোনো ধারণা আছে? হতাশা নেই আমার। আমি আত্মবিশ্বাসী। 
" শুনুন। আপনার হতাশার কারণ একটা না। অনেক গুলো। আপনার স্বামী। তিনি উপরে স্ত্রৈনরূপ দেখান বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভাইদের দুই হাতে সাহায্য করেন। সেটা আটকানোর ক্ষমতা আপনার নেই। 
" আপনি...
" আপনার বাপের বাড়ি দরিদ্র। তাদের সাহায্য করতে হয় নিয়মিত।এই নিয়ে চাপা হীনমন্যতা আছে। কারণ , আপনার দ্যাওর সাধারণ চাকরি করলেও, জা দুজনের বাপের বাড়ির পরিবার অবস্থাপন্ন। 
দীপময়ী ধপ করে বসে পড়লেন। সামনে এ কে? ডাক্তার না জাদুকর? দীপঙ্কর ধীর স্বরে বলে," কিশোরী বেলায় যৌন  লাঞ্ছনার শিকার ছিলেন। কে সে? বলুন। বলে ফেলুন। মনের গোপন দরজা বন্ধ করে রাখলে সেখানে দুর্গন্ধ জন্মায়। বিষাক্ত দুর্গন্ধ। যা নষ্ট করে দিতে পারে সন্তানের সবুজ প্রাণ। মেয়ের ভালো চাইলে সব বলুন।
" নিজের মামা। মা সেলাই করে সংসার চালাত। মামা আসত প্রায়ই। মুদিখানার দোকান। আটা চাল নুডলস নিয়ে আসত। আমারও অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। কেমন মনে হত, বুকে হাত দিতে বাধা দিলে যদি মামা আর চাল না আনে? 
" বিয়েটা ভালো হল আপনার। 
" হ্যাঁ। এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে শাশুড়ি এক দেখাতেই পছন্দ করে বিনে পয়সায় নিয়ে আসেন। আমার ননদ চিনত আমাকে। মায়ের কাছে ব্লাউস তৈরি করত। ও আমাকে পছন্দ করত। তাছাড়া, গুরুজী...। 
একটানা বলে হাঁফ ধরে যায়। ভারি শরীর। সুগার প্রেশার সব আছে। ঘর থেকে বেরুনোর অভ্যাস নেই। হাত বাড়িয়ে জল খান। 
" গুরুজী? তিনি কি বললেন? 
" তিনি বলেছিলেন এ মেয়ে ভারি ভাগ্যবতী। আর...আর...
" আপনার কাছে টাকা চাইতেন? 
" হ্যাঁ। নিয়মিত আশ্রমে মোটা টাকা দিতে হবে, এই বিয়ের বিনিময়ে। 
" এখনো দ্যান? 
" উনি মারা গেছেন।
" আর মামা? 
" পাগলের মত আচরণ করত। কিন্তু ততদিনে আমি জমি শক্ত করে নিয়েছি। মায়ের কোনো অভাব রাখিনি। মামাকে জুতো পেটা করে তারিয়েছি।
ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে দীপময়ীর। ঠাণ্ডা ঘরেও কুল কুল ঘামছেন। হাত বাড়িয়ে জল খেলেন আবার। 
দীপঙ্কর পিছনে হেলান দিয়ে বসা। চোখ দুটি বোজা। 
সন্তান ধারণ করতে হলে মায়ের মন স্থির থাকা খুব জরুরি। সহবাসের সময় থেকেই মন সুন্দর রাখতে হয়। মনের মধ্যে ভিলেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, আক্রমণ করছে, রক্তাক্ত মা জন্ম দিচ্ছে সন্তান... 
ডাক্তার নরম স্বরে বললেন," সহজ হতে পারেন নি মেয়ের সঙ্গে কোনোদিন। তাই সে আপনাকে ভয় পায়। কোনো কথা বলতে চায় না। আপনাকে বন্ধু হতে হবে মিসেস বসু। আপনি ওকে জড়িয়ে ধরবেন রোজ একবার করে। 
" কিন্তু ও যে পাথর! 
" মায়ের চাইতে বড় শক্তি আর কার আছে? পাথর গলে বেরিয়ে আসবে অমৃত ধারা। 
" অনেক ভুল করেছি। 
" জীবন মাত্রেই তাই। ভুল থেকেই শেখে মানুষ। 
" শ্রী ভালো হবে ডাক্তার বাবু? 
" চারিদিক ভালো হবে। ফুল ফুটবে। পাখি গান গাইবে। শ্রী আবার হেসে উঠবে। প্রকৃতির নয়ম তাই। আমরাও যে প্রকৃতির জীব। ব্যতিক্রম নই। 
আপনি শ্রী র শাশুড়ি কে বলবেন আসতে। প্রয়োজন আছে।
" আর শ্রী? 
" সে সবার শেষে। তার মনে কোনো রোগ বাসা বাঁধে নি। শুধু , জোরে আঘাত লেগেছে। ওখানে মলম দেবেন আপনি। দুজনে মিলে গল্প করবেন। মামার কথা বলবেন। ছাদে যাবেন। আমিও থাকব। এখন আসুন। ভালো থাকুন। 

-6-

দীপঙ্কর দেখছিল। সামনে বসে আছে শ্রী। এক বিষন্ন জুঁই লতা। 

- আমাকে আয়না ভাবতে পারো অথবা বাথরুম। খুলে ফেলো নিজেকে। বলো শ্রী। সুন্দর নাম। ঠিক তোমার মতো।   আয়না অথবা বাথরুম? সেখানেও কি সবকথা বলা যায়? মায়ের কাছে বসেও কোনোদিন কিছুই বলতে পারেনি। এই ডাক্তার না কি মনের বন্ধু! এনার কথা এখন খুব বলছে মা। মায়ের ভুরু দুটো সমান থাকে। মুখে হাসি। কাকিমাদের সঙ্গে ডেকে ডেকে গল্প। সেদিন কি একটা ব্যাপারে ছোট কাকাকে একলাখ টাকা দিল মা। কাকা ঢিপ করে প্রণাম করতে মা কেঁদে ফেলে ক্ষমা চাইল। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। শুনেছে, শাশুড়ি মাধুরী না কি এসেছিল এই চেম্বারে। এবার তার পালা। 

--- বলো শ্রী। তোমাকে আদর করতো অনির্বাণ?
 কেঁপে উঠলো শ্ৰী। এ কেমন প্রশ্ন? সে আধুনিক নয় মোটেও। বিয়ের আগে কোনো পুরুষ ছোঁয়নি তাকে। কেবল একবার এক দুপুরে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে মাসীর ছেলে মুগ্ধ চোখে তার গালে হাত ঠেকিয়েছিলো। সেটা কেন জানি না পাপ জেনেও আজন্ম লালন করে চলেছে বুকের ভেতর।

--- আদর করতো? ডাক্তার না আয়না প্রশ্ন করলো আবার। 
_ভালো লাগতো আদর? তোমার অর্গাজম হতো? 
এত কঠোর কেন এই ডাক্তার? ইনি না কি মনের বন্ধু! নাহ। কিছু বলবে না। কেন বলবে? বরফ চাউনি মেলে চুপ করে থাকে সে।  কি হতো সেই সময়? পুরুষের দুটো জ্বলন্ত চোখের সামনে শরীর উন্মোচন হত তার। ঘরে কটকট আলো জ্বলত। অনুনয় করত আলো নিভিয়ে দেবার। অনির্বাণ শুনত না। 

 ডাক্তারের ঠোঁট নড়ছে। শ্রী কিছু শুনবে না। কিছু না। 

-7-

       শ্ৰী। তুমি চিংড়ি পটল খাবে? আমি রান্না করবো? আরে রান্না করতে আমার দারুণ লাগে।

-- শ্ৰী, শাড়ি পরো । শাড়িতে তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। এই শাড়ি ? না না তুমি এই হলুদ রং টা পরো । আরে আরে শ্ৰী। দাঁড়াও দাঁড়াও। আমি পরিয়ে দিচ্ছি তোমাকে শাড়ি। তোমার ব্লাউজের মাপ কতো ?

  স্বামীর দখল ভাবতো শ্রী । তখন কিছুই বোঝেনি। তাকে রোজ ভোগ করতো জন্তুর মতো। আবার তার  প্রত্যেকটি ব্যাপারে খেয়াল রাখতো। যত্ন করে নেলপলিশ পরিয়ে দিতো। চুল আঁচড়ে দিতো।  শ্রীর সারা শরীরে ক্রীম মাখিয়ে দিতো। তখন যেন স্বামী নয়। পুরুষ নয়। মেয়েলী সখী।

      দীপংকর ঝুঁকে এলো। দশ দিন পার হয়ে গেছে। তেমন কিছু কাজ এগোয় নি। তবে, কেস তার কাছে পরিস্কার। মাতৃদোষে রাবণ রাক্ষস। সম্পর্কের গিঁট গুলো খুলেছে। শ্রী এখন বুঝবে। ধীরে ধীরে বুঝবে, অনির্বাণ ক্রিমিন্যাল না। পরিস্থিতির শিকার।

     রাত যেন দাঁত বার করে এসে দাঁড়াতো রোজ। শ্ৰী ভয় পেত রাতকে। মনে হতো ছুটে পালিয়ে যায় মায়ের নিশ্চিন্ত কোলে। ঘুম হতো না। অনির্বাণ অফিস থেকে এসে চা খেত। রোজ হয় ফুল নয় আইসক্রিম চকলেট। শাশুড়ী মা , মাধুরীলতা,  স্নেহের চোখে তাকাতেন। কেউ নেই সংসারে। মা ছেলে আর অপর্যাপ্ত অর্থ। মাধুরী বলতেন -- আমার একটা নাতনী চাই শ্ৰী। নাতি নয়। নাতনী। মেয়ের বড়ো শখ শাশুড়ির।


       চেম্বারের জানলা গুলো এমন বন্ধ কেন? এসি চলছে তবু গরম ?

-- বলো শ্ৰী । তুমি কিছু বলতে চাইছো। বলো। যা তুমি মা কে বলোনি। কাউকে বলো নি। আমাকে আয়না ভেবে বলো।

 কোন দূর গ্রহ থেকে ভেসে আসে ডাক্তারের গলা। ওনার নাম দীপঙ্কর। সুন্দর চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। কত কি জানতে চান। বলতে গেলে কথা বলতে হবে। কথা বলতে ভীষন কষ্ট। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। প্রথমে সে ভেবেছিল, অনির্বাণ গে। পরে বুঝল, সেটা নয়। তবে এমন কেন করে?  কোথা থেকে শুরু করবে? সেই রাত থেকে?
 
-8-

   প্রথম প্রথম কোনো অসুবিধা হয় নি। স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতই ছিল তারা। হঠাৎ এক রাতে অনির্বাণ  অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। সুন্দর সাজানো শোবার ঘর। পর্দা থেকে শুরু করে খাট মেঝের কার্পেট সব নিখুঁত। খেয়ে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, হাতে হাত ঘষতে থাকে। ঠোঁট চেটে চেটে পায়চারী করতে করতে অদ্ভুত হাসি  হেসে বলে-- আজ পটলের তরকারী কেমন বানালাম বললে না তো?

-- তুমি  ভালোই রান্না করো সব কিছু।

-- রান্না করতে আমার দারুণ লাগে শ্রী। জানো তো আমি কিন্তু ম্যাজিক জানি। 

--ম্যাজিক? অবোধের মতো সরল চোখ তুলে প্রশ্ন করলো শ্রী। এমনিতেই রাত হলে তার ভয় বাড়ে। কি সব নতুন নতুন খেলা খেলে তার শরীর নিয়ে অনির্বাণ । তার একদম ভালো লাগেনা। ঘেন্না করে।  এরপরে আবার ম্যাজিক? 

খিক খিক করে হাসতে হাসতে অনির্বাণ শুরু করে ম্যাজিক। ধীরে ধীরে পোশাক মুক্ত করে নিজেকে। তারপর সাজতে থাকে। ব্লাউজ, ব্রা,পেটিকোট  শাড়ী গয়না, কাজল টিপ মায় আলমারির গোপন জায়গা থেকে নকল চুল পর্যন্ত। 
সুন্দর করে সাজে। গায়ে আঁচল ফেলে আয়নায় দেখে নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। পায়ে নুপুর পরে নেল পালিশ লাগায়। হাত পায়ে লোম নেই। তুলে ফেলেছে।লিপস্টিক লাগানো বীভৎস ঠোঁট নিয়ে শ্রীর একেবারে কাছে এসে অদ্ভুত ন্যাকা সুরে অনির্বাণ বললো---" আমি কিন্তু নারী নই মোটেও। আমি পুরুষ। কিন্তু আমার মা, ছোটবেলা থেকে আমাকে মেয়ে সাজাতে ভালোবাসতো। মেয়ের মতো করে সব বোঝাতো। মেয়েলী গল্প করতো। এখন আমারো ভালো লাগে। শ্রী শোনো, মাঝে মাঝে আমি এরকম মেয়ে সাজবো তুমি সাজবে পুরুষ। আমারা প্রেম করবো। মজা হবে খুব বলো খুব মজা। খুব মজা। কদাকার হাসি ভেসে বেড়াতে লাগলো ঘরটায়। মাথা ঘুরে গেছিলো তার। কিছু মনে নেই। প্রায় দশদিন এই নারী ভাব ছিল অনির্বানের। একদিন ঘুঙুর পায়ে নেচেও উঠেছিল।অনেকদিন চুপ করে সহ্য করতে করতে এখন ভাষা আসে না মুখে।

ডাক্তার চুপ । শ্রীও চুপ। ঘর গুমোট। আসলে শ্রী আরো বলতে চাইছিলো। চাইছিলো যে মা কিন্তু তাকে আনতে চায়নি। খুব অহংকারী তার মা দীপময়ী। তিনি কিছুতেই বুঝতে চাইছিলেন না। নিজের সম্মান নষ্ট হবে, এই ভাবনাতে অস্থির ছিলেন তিনি। পিসী পাশে না দাঁড়ালে এই ডাক্তারের কাছে আসা হতো না আজ। মার আচরণে আঘাত আরো তীব্র হয়ে বেজেছিল। আরো চুপ করে গেছিলো সে। আজ কেমন করে ইনি আগল খুলে দিলেন। কেমন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কতদিন ঘুমোয় নি শ্ৰী। চোখ বন্ধ হলেই লিপস্টিক লাগানো  ঘুঙুর পায়ের পুরুষ সামনে ঘুরে ঘুরে নেচে উঠতো। অথচ আজ চোখ ভারী হয়ে আসছে। সে ঘুমোতে চায়।

  গ্রহান্তর থেকে ভেসে আসে ডাক্তারের গলা----" অনির্বাণ পুরুষ। স্বাভাবিক পুরুষ। । তাকে নারী বানিয়ে খেলতো তার মা, মাধুরী। সে স্বীকার করে গেছে, এই চেম্বারে বসে। নিজের ছেলেকে মেয়ে বানিয়ে খেলা খেলত সে। অনির্বাণ মজা পেত। তারপর কেমন করে অভ্যাস হয়ে গেল। 
অনির্বাণের দোষ নেই। নিজের মায়ের অবুঝ মনের শিকার ও। মনের অতৃপ্ত চাহিদা দিয়ে একটা পুতুল তৈরি করেছিল মাধুরী। 
শ্রী, বুঝতে পারছ? অনির্বাণ দূরে চলে যাবে। তোমারও আবার বিয়ে হবে। কিন্তু, একটা নির্দোষ প্রাণ নষ্ট হয়ে যাবে চিরকালের মত। 
পারব না আমরা? আমি তুমি তোমার মা, মাধুরী সকলে মিলে অনির্বাণকে রক্ষা করতে পারব না? 
কোথা থেকে মিষ্টি বাতাস ভেসে আসছে। বৃষ্টি নামল না কি? মরুভূমি মন ভিজে উঠছে ক্রমশঃ। তবে সেখানে ফসল ফলবে কি না জানে না শ্রী। সে তাকাল দীপঙ্করের দিকে। অস্ফুট উচ্চারণে বলল, "চেষ্টা করব।"
.....................
Jayati Roy
 
অলঙ্করণ :-  দেবাদৃতা দাস