আশীর্বাদ
উত্তম চক্রবর্তী
খুব আস্তে আস্তে ছুরিটা দিয়ে ভিতরের কাঠের খিলটা খুলে ফেলল রোহিত। একটু শুধু খচ করে শব্দ হল। রোহিত ঐ ছুরির সাহায্যেই ভৌমিক বাড়ির রান্না ঘরের পিছনের দরজাটা খুলে ফেলল। এটাই একমাত্র পথ বাড়িতে ঢুকবার রোহিত আগের দিনই দুপুরে ভিখারির বেশে বাড়ির আশেপাশে কয়েকবার ঘুরে দেখে রেখেছিল। খিড়কির দরজাটা খুলে রোহিত খুব সন্তর্পণে পা ফেলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে আবার আস্তে করে দরজাটা আটকে দেয়। রাত এখন প্রায় দুটো বাজে। অন্ধকারে পকেট থেকে ছোট পেন্সিল টর্চটা বের করে রোহিত রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের বসবার ঘরে ঢুকে যায়।
ভৌমিক বাড়ির একতলায় দুটো শোবার ঘর আর দোতলায় দুটো। এছাড়া আছে ড্রয়িং রুম কাম ডাইনিং রুম এবং একটা রান্না ঘর। টর্চের আলোয় রোহিত দেখল বসবার ঘরে তেমন কিছুই নেই চুরি করবার। দুখানা শোবার ঘরে উঁকি মেরে দেখল দুটোই খালি, বিছানা পাতা আছে কিন্তু কেউই নেই ঘরে। রোহিত একটু অবাক হয়েই বসবার ঘরে পাস দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পণে দোতলায় উঠে গেল। একটা ঘরে দুটো স্টিলের আলমারি, একটা আলনা আর একদিকে টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা। কিন্তু ঘর খালি, কেউই নেই। আরেকটা ঘরে খাটে বিছানা পাতা, মনে হয় কেউ মশারি টানিয়ে ঘুমোচ্ছে। রোহিত হাতের টর্চ বন্ধ করে শান্ত পায়ে ঘরে ঢুকে বুঝবার চেষ্টা করে মশারির নিচে শোয়া লোকটা জাগা না ঘুমিয়ে আছে।
মেঝেতে একটা প্লাস্টিকের জলের ঢাকনা পড়ে ছিল। রোহিতের পায়ে লেগে খুট করে একটা শব্দ হতেই মশারির নিচ থেকে একটা বৃদ্ধ মানুষের মিহি আওয়াজ ভেসে এলো,’কে, কে এসেছ ? আমাকে একটু তুলে বসাবে, একটা ওষুধ খেতে হবে। ভীষণ বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। কে ওখানে ?’
রোহিত ভদ্রলোকের আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারে যে মানুষটা ভীষণ অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। বাড়িতে কেউই নেই তাই উঠে ওষুধটাও খেতে পাড়ছেন না বোধ হয়। অবস্থার চাপে পড়ে রোহিত একটা ছিঁচকে চোর হলেও আর পাঁচজনের মতই চোর রোহিতের মধ্যে একটা মন কাজ করে। লোকটার জন্য মায়া হল রোহিতের। বলল,’ আপনার ওষুধ কোথায় রাখা আছে বলুন, আমি এনে দিচ্ছি।‘ লোকটা অন্ধকারে রোহিত কোন দিকে আছে না বুঝেই বললেন,’ এই যে আমার মাথার পাশের টেবিলে রাখা। একটা ট্যাবলেটের শিট রাখা আছে। সেখান থেকে একটা ট্যাবলেট ও একটু জল দাও তো বাবা। কে তুমি এতো রাতে এখানে ?’
রোহিত প্রথমে কিছু না বলে টর্চের আলো ফেলে খাটের উল্টো দিকে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা ট্যাবলেট ও জলের গ্লাস তুলে মশারির ভিতর টর্চের আলো ফেলে দেখে একজন প্রায় পঁয়ষট্টি ছেষট্টি বছর বয়সের বৃদ্ধ মানুষ বিছানায় উঠে বসে একটা হাত বারিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। রোহিত মশারি তুলে ওঁকে ওষুধ এগিয়ে দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল মানুষটা অন্ধ, কারণ রোহিতের হাত ঠাহর করতে পাড়ছেন না। অথচ চোখ খুলে কিন্তু তাকিয়ে আছেন রোহিতের দিকে। এবার রোহিত ওঁর কথার জবাব দিতে দিতে লোকটার হাত ধরে একটা ট্যাবলেট দিয়ে জলের গ্লাসটা ধরিয়ে দেয়। রোহিত বলল,’ আমি একজন চোর, চুরি করতে এসেছি। কিন্তু আপনাকে একা রেখে সবাই গেল কোথায় ?’
ভদ্রলোককে ওষুধ খাইয়ে রোহিত ঘরের লাইট জ্বেলে দেয়। দেখে মানুষটা সত্যিই অন্ধ, কিছুই দেখতে পান না। ওষুধ খেয়ে ভদ্রলোক মশারির একদিক তুলে ধরে পুরো শরীরটা বের করে পা ঝুলিয়ে বসে বললেন,’ তা তুমি বাবা আর কোন বাড়ি খুঁজে পেলে না, শেষে এই বাড়িতে এলে চুরি করতে ! হা কপাল, এখানে তুমি কী পাবে বাবা ? আমি একটা বুড়ো অসুস্থ মানুষ একা আছি বাড়িতে। আমার মেয়ে আর ওর মা গেছে বেহালায় আমার ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী আজ সকালে মেরে গেছে, সেখানে। ওরা ফিরবে কাল সকালে। মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু গয়না বানিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলি তো ব্যাঙ্কের লকারে আছে বাবা। বাড়িতে খুচরো কিছু টাকা পয়সা ছাড়া তো আর কিছুই পাবে না। তোমার পরিশ্রমটাই বোধ হয়ে জলে যাবে।‘
রোহিত একটা টুল সামনে এগিয়ে নিয়ে বসে বলল,’ তা আপনাকে একা বাড়িতে রেখে যে ওনারা সবাই চলে গেলেন, রাত বিড়েতে আপনার শরীর যদি আরও খারাপ হয় তার চিন্তা নেই কারো ! আজ আমি না এলে আপনাকে এখন ওষুধ এগিয়ে দেওয়ার জন্যও তো কেউ ছিল না। অন্তত আসে পাশের বাড়ির একজনকে বা আপনাদের কাজের লোককে আজ এক রাতের জন্য আপনার দেখাশুনার জন্য রেখে দেওয়া উচিত ছিল। কিছু মনে করবেন না আপনার স্ত্রী বা মেয়ে কেউই এটা ঠিক কাজ করেননি জেঠু।‘ রোহিত চুরি করবার কথা ভুলে গিয়ে বৃদ্ধ লোকটার সাথে গল্প করতে বসে পড়ল।
ভৌমিক বাড়ির বৃদ্ধ ভদ্রলোক বোধ হয় একটু সুস্থ বোধ করছিলেন। এবার জিজ্ঞাসা করলেন,’ তোমার বাড়ি কোথায় ? এই চুরির কাজ ধরেছ কতদিন ? পড়াশুনা কতদূর করেছে বাবা।‘
রোহিত জবাব দেয়,’ আমার বাড়ি কাছেই, রাজা বাজারে। আমি এম কম পাশ করে অনেক চেষ্টা করেও একটা চাকরীর যোগার করতে পারিনি। বাবা মারা গেছেন ছোট বেলায়। মা আমাদের দুই ভাইকে ঝিয়ের কাজ করে পড়াশুনা করিয়ে বড় করে তুলেছেন। আমার ছোট ভাই গত বছর ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির ঘায়ে ভীষণভাবে আহত হয়ে চারদিন বাদে হাসপাতালে মারা যায়। ও একটা রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিল। তাদের এক নেতা শুধু একবার ক্যামেরা ও সাংবাদিকদের সাথে করে নিয়ে আমার মার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। সরকার ডিক্লেয়ার করেছিল মৃত চারজনের পরিবারের লোককে একটা চাকরী দেবে ও এককালীন তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু কেউ কিছু দেয়নি। আর ঐ নেতেরা আর কোনদিন আসেননি আমাদের পাড়াতে। শেষে বাধ্য হয়ে পেটের জ্বালায় আমাকে এই পথে নাবতে হয়।‘
বৃদ্ধ ভৌমিক বাবু হতাশার সুরে বললেন,’ এটাই হচ্ছে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। সবাই তাদের নিজেদের স্বার্থে কাজ করে চলেছে, সে সরকার যারা চালায় তারা বা বিরোধী দলে যারা আছে তারা। মানুষের মধ্যে সেই মানবিকতা জিনসটা আর এখন নেই। তা তুমি চুরি করা না ধরে একটা ছোট খাটো ব্যবসা শুরু করতে পারতে। চুরি করে তোমার জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে ছাড়া কমবে না। পুলিশের হাতে পরলে জেলের ঘানি টানতে হবে সাড়া জীবন, তখন তোমার মাকে দেখা শোনা কে করবেন ভেবেছ একবার ?’
রোহিত একটু চুপ করে থেকে বলে,’আমার কোন টাকা পয়সা নেই। ব্যবসা করব কি দিয়ে, পুঁজি কই ?’
ভৌমিক বাবু রোহিতের অবস্থান বুঝে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ শোন বাবা, ব্যবসা করতে টাকা লাগে না। এটাই তোমাদের আজকালকার ছেলেদের ভুল ধারনা। তুমি কি জানো এই কলকাতায় এক সময় ঠ্যালা গাড়িতে করে উনুনের ছাই বিক্রি করত মানুষ। পাড়ার মহিলার এক টাকা বা দু টাকা কেজি দড়ে সেই ছাই কিনে ঘরে রাখত বাসন মাজবার জন্য ? কারণ তখন এসব বাসন মাজবার পাউডার ছিলনা। তুমি কি জানো, স্রেফ এক গ্লাস জল বিক্রি করে বিভিন্ন রেল স্টেশনে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা বা মহিলারা পঞ্চাশ পয়সা থেকে এক টাকা পর্যন্ত রোজগার করে ? তুমি কি জানো গঙ্গার জল বোতলে ভরে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক লোক দুই থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে। এরা কেউই তো চুরি করতে নামে নি।‘
রোহিতের কথা বন্ধ হয়ে গেছে তখন। মুখটা হাঁ হয়ে সামনের দিকে ঝুলে গেছে। ভৌমিক বাবু আবার শুরু করলেন,’ তুমি একজন শিক্ষিত ছেলে। তোমার তো এসব ভাবা উচিত ছিল বাবা। তোমার চেয়েও কম বয়সী ছেলেরা ট্রেনে ট্রেনে ধুপ কাঠি, চিরুনি, মাথার ক্লিপ, টিপ গা ঘষার প্লাস্টিকের জালি এসব বেচে তাদের সংসার চালায়। তাদের এই ব্যবসায় নামতে কত পুঁজি লেগেছে বলে তোমার মনে হয় ? আমি একজনকে দেখেছিলাম সে বলেছিল শিয়ালদার বৈঠকখানা থেকে গোল গোল ধুপ কাঠির মোটা মোটা প্যাকেট আর কাগজের প্যাকেট হোল সেলে কিনে নিয়ে বাড়িতে বসে এক ডজন বা বা দুই ডজনের ধুপ কাঠির প্যাকেট বানিয়ে পাঁচ টাকা বা দশ টাকায় দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিত। ছেলেটা বি এ পাস করে তোমার মতই কোন চাকরী না পেয়ে খুব অল্প পুঁজি নিয়ে এই ব্যবসায় নেমে তখন মাস গেলে সাত আট হাজার টাকা রোজগার করত। আজকের দিনে তার মূল্য হবে পনের ষোল হাজার টাকা। কোথায় সে তো তোমার মত হতাশ হয়ে চুরি করতে বের হয়নি। তোমার বলতেও লজ্জা লাগল না বাবা যে তুমি চোর ?’
ভৌমিক বাবু একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন,’তুমি শুনছ তো আমার কথা গুলি ?’ রোহিত অনেকক্ষণ যাবত কোন কথা না বলে ওঁর কথাই শুনছিল। এবার চমকে উঠে বলল,’ হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনছি। আপনি বলে যান জেঠু।‘
ভৌমিক বাবু একটু হেসে বললেন,’ আসলে কি জানো বাবা, ব্যবসা করতে তিনটে জিনিষ দরকার হয়। এক হল বুদ্ধি, দুই হল পরিশ্রম ও তিন হল সততা। দেখ যেই লোকটা এসব ছোট খাট জিনিষের ব্যবসা করছে সে কিন্তু এই তিনটে জিনিষেরই সদ্ব্যবহার করেছে। সে না কাউকে ঠকাচ্ছে, অসম্ভব পরিশ্রম করছে আর মাথার বুদ্ধি খাটিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। যেই ছেলেটা বা মহিলারা স্টেশনে দাঁড়িয়ে জলের গ্লাস বিক্রি করছে সে ভেবেছে অনেক মানুষ জলের বোতল না নিয়েই ট্রেনে চড়ে, তাদের তেষ্টা পাবেই ; আর স্টেশনে পরিষ্কার খাবার জল বিক্রি হচ্ছে দেখেই কিনবে। আবার দেখ মন্দির থেকে বেরিয়ে বাড়ির পূজার জন্য অনেকেই একটু গঙ্গার জল নিয়ে যেতে চায়। একজন আবার সেটার ব্যবসা করে তার সংসার চালাচ্ছে। সব কটা মানুষই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে সততার সাথে অল্প পুঁজির ব্যবসা করছে, তাই না ?’
রোহিত অবাক হয়ে আনমনে বলে উঠল,’ হুম, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি এসব কিছুই ভাবিনি।‘
ভৌমিক বাবু এবার জিজ্ঞাসা করলেন,’ তুমি এই পথে নেবেছ কতদিন হল ?’
রোহিত বলল,’ এই তো মাস খানেক আগে।‘
‘ আজ অবধি ক’টা বাড়িতে চুরি করেছ বাবা ?’ ভৌমিক বাবু রোহিতকে বুঝবার চেষ্টা করেন।
রোহিত বলল,’ মোট দশটা বাড়িতে ঢুকেছিলাম। তার মধ্য দুটো বাড়িতে ঢুকবার সময় কুকুরের চিৎকারে পালিয়ে যাই। তিনটে বাড়িতে বাড়ির লোক জেগে গিয়ে চেঁচাতে থাকে। আর পাঁচটা বাড়িতে ঢুকে টুকি টাকি জিনিষ যেমন ধরুন টেবিলে পড়ে থাকা হাত ঘড়ি, মোবাইল ফোন বা মানি ব্যাগ এসব চুরি করেছি।‘
‘এবার আমাকে বল এই এতো রিস্কের কাজ করে এক মাসে তুমি কত টাকা কামিয়েছ ? তাও আমি বলব তোমার ভাগ্য ভালো আর মায়ের আশীর্বাদে তুমি পুলিশের হাতে পরনি বা বলতে পার পুলিশের খাতায় তোমার নাম ওঠেনি এখনো। একবার সেটা উঠে গেলে জীবনে আর সরকারী চাকরী পেতেনা তুমি।‘ কথাগুলি একসাথে বলে থামলেন বৃদ্ধ মানুষটা। শেষে জিজ্ঞাসা করলেন,’ তোমার নামটা কি বাবা ?’
রোহিত এতক্ষণে ভুলেই গেছে যে রাত ভোর হয়ে আসছে আর ওকে এই বাড়ি থেকে চুরি করে পালাতে হবে। মুখ নিচু করে বলল,’ আমার নাম রোহিত জেঠু। আমি কিন্তু ভদ্র ঘরের ছেলে। আমার বাবা একজন মিউনিসিপালিটির ক্লার্ক ছিলেন। কিন্তু উনি মারা যাবার পরই আমাদের সংসারটা একদম ভেসে যায়।‘
ভৌমিক বাবুর রোহিতের জন্য বোধ হয় মায়া পড়ে গেছিল। বললেন,’ আমার ভীষণ চা তেষ্টা পাচ্ছে। আচ্ছা রোহিত তুমি চা বানাতে পারো ? তাহলে নিচে আমাদের রান্না ঘরে গিয়ে একটু দু কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে একটু বাথরুম করে আসছি।‘ রোহিত বৃদ্ধ মানুষটাকে মুখের উপর না করতে পারল না। উঠে এসে ওঁকে ধরে লাগোয়া বাথরুমের দিকে নিয়ে যেতে উদ্যোগ নিতেই ভৌমিক বাবু বললেন, ‘আমাকে তোমার ধরতে হবেনা বাবা। এটুকু আমি একাই পারব। তুমি নিচে যাও, একটু চা করে আনো।‘
রোহিত সত্যি সত্যি নিচে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে রান্না ঘরে গ্যাস স্টোভ জ্বালিয়ে দুই কাপ চা করে আবার ওপরের ঘরে এসে দেখে ওর পাতানো জেঠু ততক্ষণে মশারি খুলে ফেলে গুটিয়ে পায়ের কাছে রেখে বিছানায় পা তুলে বালিশ কোলে চায়ের অপেক্ষায় বসে আছেন। দরজায় রোহিতের পায়ের আওয়াজ পেয়ে বলে উঠলেন,’কে রোহিত ? এসো বাবা, এক কাপ চা না খেলে আর চলছে না। আমার মেয়ে প্রিয়া রোজ ভোরবেলায় উঠে সাড়ে পাঁচটায় আমাকে চা করে খাওয়ায়। আমাদের রান্নার মহিলা আসতে দেড়ি আছে। কটা বাজে দেখো তো রোহিত।‘ বলে ভৌমিক বাবু চায়ের কাপে চুমুক দেন। রোহিত অবাক হয়ে দেখে ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা বেজে গেছে। বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে একটু আগেই।
রোহিত মনে মনে ভাবল যাক গিয়ে, আজ না হয়ে আর চুরি করবোনা। লোকটা বেশ ভালো ভালো বুদ্ধি দিচ্ছে যখন তখন এই খালি বাড়িতে ওঁর সাথেই বসে একটু চা খেতে খেতে আড্ডা মারা যাক আজ। রোহিত চায়ের কাপ নামিয়ে বলল,’ এখন ভোর পাঁচটা বাজে জেঠু। আপনি কোথায় চাকরী করতেন ? রিটায়ার তো অনেকদিন আগেই করেছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন কি ভাবে ? কোন এক্সিডেন্টে না কঠিন রোগে জেঠু ?’
ভৌমিক বাবু জানালেন,’ আমি জীবনে কোনদিন চাকরী করিনি রোহিত। আমার বাবা আমার জন্য বৌ বাজারের এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পাড়েন নি। উনি চাকরী করতেন। আমি যখন কলজে পড়ি তখন বাবা মারা যান। আমার দিদির তার আগেই বিয়ে হয়ে গেছিল। বাবা মারা যাবার পর আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করে প্রথমেই চাকরীর চেষ্টা না করে আমার এক বন্ধুর লেদ মেশিনের ব্যবসার ওয়ার্কিং পার্টনার হিসাবে যোগ দেই। কোন টাকা পয়সা না দিয়ে কমিশনে ওর ব্যবসা বৃদ্ধির সাহায্য করতে থাকি। এক বছরের মধ্যেই আমি স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসাটা বুঝে যাই। এবার বন্ধুর লেদ কারখানার মাল বেচার সময় মার্কেটে আমি অন্য কোম্পানির মালও বেচতে থাকি আর আমার পুঁজি বানাতে থাকি। এই ভাবে আরও একবছর চলে যায়। শেষে আমি নিজের টাকায় বেলগাছিয়াতে আমার লেদ ফ্যাক্টরি বসাই।‘
চা খেতে খেতে একটা মানুষের জীবনের কাহিনী হাঁ করে গিলছিল রোহিত। জিজ্ঞাসা করল,’ তারপর ?’
ভৌমিক বাবু বলতে থাকেন,’ আমার সেই কারখানা পরে অনেক বড় হয়েছে আর এখন সেখানে মোট পাঁচশ মানুষ চাকরী করছে। আমার কারখানাতেই লেদ মেশিনের সামনে ঝুঁকে পড়ে একটা ঝালাই দেখতে গিয়ে আমার চোখে জ্বলন্ত লোহার গুড়ো ছিটকে এসে লাগে আর আমার দৃষ্টি শক্তি চলে যায় সেই এক্সিডেন্টে। ভুল করে তখন আমার গগলস পরা ছিলনা চোখে। তখন আমার বয়স ধরো ষাট একষট্টি হবে। সেই থেকেই এই গত পাঁচ বছর আমি ঘরে বসা। ছেলে থাকে কানাডায়, ওর বৌ বাচ্চাকে নিয়ে। এখন আমার মেয়ে প্রিয়াই আমাদের সমস্ত ব্যবসা একা দেখা শোনা করছে। আমি পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় ওকে বিয়ের কথা বললেই রেগে যায়। বলে কী জানো, তোমাকে দেখবে কে তাহলে ? আমি যতই বলে তোর মা তো আছেন কিন্তু মেয়ে আমাদের কারো কথাই শোনেনা।‘
রোহিত এই ব্যাপারে কী আর বলবে ? চুপ করে ভাবতে থাকে একটা লোক সামান্য লেদ মেশিনের কাজ শিখে এতো বড় একটা ব্যবসা শুরু করে দাঁড় করিয়ে দিল আর ও নিজে এম কম করে শিক্ষাগত ভাবে তৈরি হয়ে জীবনে কিছুই করতে পারল না। রোহিতের নিজের উপর তখন ঘেন্না হচ্ছিল। সত্যিই তো, জেঠু তো ঠিকই বলেছেন, নিজেকে চোর বলতে তো লজ্জা হওয়াই উচিত। কিন্তু রোহিত কী করবে ? আজ একবছর যাবত বাড়িতে মা শয্যাশায়ী। এতদিন যাবত ঝি গিরি করে শরীরে আর কিছু নেই। পরিশ্রমে আর অপুষ্টিতে ভুগে মা বিছানা নিয়েছেন। রোহিত কিছুদিন টিউশনি করে চাকরীর চেষ্টা করেছে। তারপর আজ এখানে। ওর নিজের উপর ভরসাটাই চলে গেছে। রোহিত হটাত জিজ্ঞাসা করল,’ আপনার মেয়ের বয়স কত ?’
ভৌমিক বাবু বললেন,’ আমাদের ঐ দুটোই সন্তান, ছেলের বয়স এখন ধর বত্রিশ আর প্রিয়ার বয়স এখন পঁচিশ চলছে। বি কম পাশ করে চাকরী করবার ইচ্ছা ছিল ওর। আমার ব্যবসায় যোগ দিতে বলেছিলাম আমি। কিন্তু তখন ও রাজি হয়নি। অথচ আজ দেখ ভাগ্যের এমনি খেল সেই লেদের কারখানায় আমার প্রিয়াই এখন সর্বে সরবা। রোজ ঠিক সকাল নটায় গাড়ি নিয়ে চলে যায় বেলগাছিয়া ফ্যাক্টরিতে। বাড়ি থেকে ওর মা টিফিন দিয়ে দেয়। অফিসে বসে লাঞ্চ করে কাজ কর্ম সেরে মেয়ে বাড়িতে ফেরে সন্ধ্যার পরে। আমাকে এসে সারাদিন কী কী হয়েছে তার রিপোর্ট করে। কিন্তু দিন দিন আমারও শরীরটা এতো ভেঙে পড়ছে যে আমি খুব চিন্তায় আছি যে আমার অবর্তমানে এদেরকে কে দেখবে ?’
ঠিক এই সময় বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াবার আওয়াজ হল। তারপরেই লোহার গেট খুলবার শব্দ পেয়েই ভৌমিক বাবু বলে উঠলেন,’ ঐ তো। ওরা এসে পড়েছে। দেখো বাবা তুমি আবার পালিয়ে যেওনা যেন। আর এক কাপ চা খেয়ে তারপর যেও ‘খন। কি আর করবে, আজ তোমার চুরিটা আর হলনা। এমন বাড়িতেই আজ তুমি ঢুকলে যেখানে কিছুই পাবার ছিল না।‘ বলেই ভৌমিক বাবু হাসতে থাকেন।
একটু বাদেই চাবি দিয়ে দরজা খোলার আওয়াজ হয়। রোহিত ভিতরে ভিতরে ঘামাতে থাকে। কি বিচ্ছিরি কাণ্ড হতে চলেছে ভেবেই ও লজ্জায় মুখ নিচু করে বসে থাকে। ভৌমিক বাবু মুচকি মুচকি হাসছেন তখন।
‘একি, আপনি এখানে রোহিতদা ?’ ঘরে ঢুকেই বাবার বিছানার সামনে একটা চেয়ারে ওদের কলেজের এক বছরের সিনিয়র রোহিতদাকে দেখে অবাক হয়ে যায় প্রিয়া ভৌমিক। এই রোহিতদা ছিল কলেজের এক বছর আগের বেস্ট স্টুডেন্ট। প্রিয়া আর ওর বন্ধুরা কয়েকজন রোহিতের পিছন পিছন ঘুরত শুধু ওর নোট পাবার আশায়। কোনদিন কোন মেয়ের সাথে কোন নোংরামি করেনি রোহিতদা, আর সেই কারণেই এই সরল সোজা মানুষটা সবার মন জয় করে নিয়েছিল সেই সময়। আর আজ সেই রোহিত পাল ওদের বাড়িতে ওর বাবার সামনে বসে দেখেই প্রিয়া অবাক হয়ে গেছিল।
রোহিত প্রিয়ার মুখে ওর নাম শুনে মুখ তুলে তাকায়। ভূত দেখার মত চমকে ওঠে রোহিত। ও ভাবতেই পারেনি যে ওদের কলেজের এক বছরের জুনিয়র সেই সুন্দরী মেয়ে প্রিয়াদের বাড়ি এটা। প্রিয়াকে তখন ওর বন্ধুরা অনেকেই লাইন মারবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রিয়া আর তিনজন বন্ধু উল্টো রোহিতের পিছনে লেগে থাকত ওর নোট পাবার জন্য। রোহিত অনেক বার ওদের নোট এবং সাজেশন দিয়ে সাহায্য করেছে শুধু মাত্র প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে। কারণ রোহিত ওকে খুবই পছন্দ করতে মনে মনে। কিন্তু গরীব রোহিতের কোনদিনই সেই কথাটা আর মুখে আনার সাহস হয়নি। এরপর ইউনিভার্সিটি শেষ করে সংসারের চক্রে গা ভাসিয়ে দিয়ে ওর সেই সোনার দিনগুলি হারিয়ে গেছিল বাস্তবের কঠিন গহ্বরে।
আজ এতদিন বাদে প্রিয়াকে যেন আরও বেশি স্মার্ট আর সুন্দর লাগল রোহিতের। প্রিয়াকে দেখেই ওর মনটা এই ভোরবেলায় খুশির হাওয়ায় ভরে গেল। প্রিয়া যেন হটাত এই ভোরের আকাশে এক ঝলক রৌদ্র নিয়ে এলো এই ঘরে। কিন্তু রোহিত আবেগে কিছু বলবার আগেই ভৌমিক বাবু কথা বললেন। মেয়ের দিকে মুখ করে বললেন,’ তোরা কি একে অপরকে চিনিস নাকি ? কি রোহিত, তুমি কি প্রিয়াকে চেন নাকি ?’ ভৌমিক বাবু মেয়ে রোহিতকে দেখে যেভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে কথাটা বলেছে তাতে বেশ অবাক হয়ে গেছিলেন। রোহিত মুখ নিচু করে জবাব দেয়,’ হ্যাঁ, প্রিয়া আমাদের কলেজেই আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ত।‘ এদিকে প্রিয়ার পিছনে তখন ওর মা মানে মিসেস ভৌমিক এসে দাঁড়িয়েছেন।
ভৌমিক বাবু অন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওঁর সিক্সথ সেন্স বেড়ে গেছে। স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে দুজনের উদ্দেশ্যেই বলে ফেললেন,’ রোহিত একটা ভীষণ ভালো ছেলে বুঝলে। কিন্তু অবস্থার চাপে পরে আজ রাতে আমার বাড়িতে এসেছিল চুরি করতে। ও এই ঘরে ঢুকবার সময় আমার ভীষণ বুক ব্যথা করছিল আর এই রোহিতই আমাকে ট্যাবলেট আর ওষুধ এগিয়ে দিয়েছে। আজ রোহিত তখন না থাকলে আমার বোধ হয় আরেকটা স্ট্রোক হয়ে যেতরে প্রিয়া। ভগবান ওকে একদম ঠিক সময়ে এই বাসায় ঢুকিয়েছেন।‘
প্রিয়া বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করে,’ যা: কি বলছ তুমি। রোহিতদা এখানে চুরি করতে আসবে কেন ? কি রোহিতদা, বাবা যেটা বলছেন সেটা সত্যি নাকি বাবা মজা করার জন্য বলছেন ?’ প্রিয়ার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ওদের সবার প্রিয় সেই রোহিতদা আজ ওদের বাড়িতে, এই ভৌমিক বাড়িতে চুরি করতে এসেছে। প্রিয়া আবার এটাও ভাবতে থাকে যে এই এতো ভোরে রোহিতদা এখানে এলোই বা কিভাবে। চাবি তো ওর কাছে আর বাবার ড্রয়ারে একটা। বাবা তো আর নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেননি নিশ্চয়ই।
রোহিত এবার কথা বলল,’ হ্যাঁ প্রিয়া। তোমার বাবা একদম সত্যি কথা বলেছেন। আমি এই বাড়িতে রান্না ঘরের দরজা বাইরে থেকে কায়দা করে খুলে ভিতরে ঢুকেছিলাম চুরি করতে। তবে তোমার বাবাকে ওষুধ খাইয়ে কথা বলতে বলতে আবার চা বানিয়ে খাইয়ে বাকি রাত টুকু আমাদের গল্পে গল্পেই কেটে যায়। তাই আমিও এই বাড়িতে চুরির প্ল্যান বাদ দিয়ে জেঠুর সাথে আড্ডা মারতে থাকি। আজ উনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন প্রিয়া। আমি সত্যিই বিপথে চলে যাচ্ছিলাম। দুই বছর যাবত চাকরীর চেষ্টা করে করে এতোটাই ভাঙ্গে পড়েছিলাম যে শেষে বাধ্য হয়ে চুরি করতে নেমে যাই। তবে আজ জেঠুর কথা শুনে আমি ঠিক করেছি আর নয়, এবার আমিও ব্যবসা শুরু করব প্রিয়া।‘
প্রিয়া আর ওর মা ততোক্ষণে এসে ভৌমিক বাবুর বিছানার এক ধারে বসে অবাক হয়ে রোহিতের দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিল। এই প্রথম মিসেস ভৌমিক কথা বললেন,’ তা তুমি চুরি করছ কতদিন যাবত ?’ সাথে সাথে ভৌমিক বাবু বলে ওঠেন,’ আরে ওসব কথা পরে সব শুনবে। আগে দু কাপ চা করতো আমাদের জন্য। সেই কখন রোহিত আমাকে চা করে খাইয়েছে। আহা, কি দারুণ চা করেছিল তুই জানিস না প্রিয়া। যা মা, গিয়ে একটু চা করে আনতো। আজ তোর রোহিতদাকে আমরা ছাড়ছি না। ওকে দুপুরে লাঞ্চ খাইয়ে তুই গিয়ে ড্রপ করে দিয়ে আসবি। কাছেই বাড়ি ওর, এই তো রাজাবাজারে। যা মা চা করে আনগে যা।‘
রোহিতের মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’ তুই এখানে বোস প্রিয়া। আমি যাচ্ছি চা করতে।‘ বলে প্রিয়ার মা ঘর থেকে চলে যেতেই প্রিয়া সোজাসুজি তাকাল রোহিতের দিকে। ওর চোখের দৃষ্টিতে তখন অনেক অভিমান, অনেক প্রশ্ন দেখা গেল। রোহিতকে চোখের ভাষায় আর হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেলল এসব কী শুনছি রোহিত দা ? প্রিয়া জানে বাবা নিশ্চয়ই কোন কারণে রোহিতদাকে আটকে রাখতে চাইছেন। কিন্তু পুলিশে খবর দেবার বদলে দুপুরে লাঞ্চ করিয়ে ছাড়বেন কেন বললেন বাবা সেটা ওর মাথায় ঢুকছিল না। ভৌমিক বাবু ওদের দুজনকেই চুপ করে থাকতে দেখে বললেন,’ কিরে তোরা কথা বলছিস না কেন ? একই কলেজে পড়তিস মানে তো তোরা বন্ধুই হলি তাই না ? তা প্রিয়া, আজ তো রবিবার তোর ছুটি, চা খেয়ে রোহিতকে তোর পাশে দাদার ঘরে নিয়ে যাস। ওকে বাথরুম দেখিয়ে টাওয়েল সাবান শ্যাম্পু সব দিয়ে দিস মা।‘
প্রিয়া বাবার পাশে বসেছিল। বাবার গলা পেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল,’তোমরা সেই মাঝ রাত থেকে এতক্ষণ কী এতো গল্প করছিলে গো বাবা ? রোহিতদা তো বেশি কথাই বলে না জানি।‘
‘আরে রোহিত তো শুধু শুনছিল। আমি সুযোগ পেয়ে ওকে অনেকক্ষণ ধরে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনালাম। জীবনে সবারই একজন পথ প্রদর্শক লাগে। রোহিতের বাবা মারা যাবার পর ছেলেটা একদম একা হয়ে পড়েছিল আর অবস্থার চাপে বাজে পথে চলে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস কেউ ওকে চিনতে বা ধরতে পারেনি। নাহলে তো ওর জীবনটাই বরবাদ হয়ে যেতরে মা। আমি চাই রোহিত আমার ফ্যাক্টরিতে কাল থেকে ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করুক। ওর শিক্ষা দীক্ষা ও একটা ভালো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। তুই কী বলিস মা ? আমি ঠিক বলেছি কিনা বল ? তাতে তোর কাজের চাপটাও কমবে তাই না ? আমাদের এখনকার ম্যানেজার বোস বাবু সামনের মাসেই রিটায়ার করছেন, সেই জায়গায় রোহিতকে রিপ্লেস কর প্রিয়া। আমার ধারনা ও আমাদের ব্যবসাটা ভালই চালাতে পারবে। ও খুব সৎ ছেলেরে মা।’
বাবার মনের বাকি কথাটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলনা তার আদুরে সুন্দরী মেয়ে প্রিয়ার। মুচকি হেসে রোহিতের দিকে তাকিয়ে দেখে বেচারা কেমন যেন অসহায়ের মত ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রোহিত বোধ হয় ভাবতেও পারেনি যে এই বাড়িতে চুরি করতে ঢুকে ও এরকম এক অদ্ভুত টারনিং পয়েন্টের সামনে এসে পড়বে। এদিকে চুরি ছেড়ে চাকরী করাটা অনেক বেশি সম্মান জনক। আবার যাদের ফ্যাক্টরিতে চাকরী নেবে তারা ইতিমধ্যে জেনে গেছে রোহিতের বর্তমান পেশা চুরি করা। তারাই বা ওকে কতটা ভসরা করতে পারবে সেটাই দেখার। ওদিকে ভৌমিক বাবু ভাবছেন কোন সাহিত্যিক যেন লিখেছিলেন যে একটা ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেকে মনিটরের পদে বসিয়ে দিলে তার মধ্য দায়িত্ব বোধ আসতে বাধ্য। উনি ঠিক সেটাই করতে চান রোহিতকে নিয়ে।
প্রিয়ার মা চা নিয়ে এসে সবাইকে দেবার পর ভৌমিক বাবু বললেন,’ রোহিত কিন্তু আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যাবে। আর হ্যাঁ, ভাল কথা, ও কাল থেকে আমাদের ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজারের চাকরীতে জয়েন করবে। সুতরাং ওকে এখন আমাদের ম্যানেজার হিসাবে সম্মান দেবে তোমরা সবাই।‘ প্রিয়া আর রোহিত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামায়। মিসেস ভৌমিক একটু অবাক হয়ে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কিরে প্রিয়া, তোরও কি সেই একই মত এই ব্যাপারে ?’ মিসেস ভৌমিক ভাল করে জানেন প্রিয়াই এখন এই কোম্পানিটা চালায়। সুতরাং ওর মত না থাকলে এই ম্যানেজারের পদে একজন চোরের নিয়োগ আটকে যাবে। মিসেস ভৌমিক ভাবতেই পারছিলেন না যে তার স্বামী রোহিতকে এতো তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করে একদম ঘরের ছেলের মত ব্যবহার শুরু করে দেবেন।
এদিকে প্রিয়া মনে মনে ভীষণ খুশি। রোহিতকে প্রিয়ার ভীষণ ভালো লাগত। কিন্তু কলেজে ও এবং ওর বন্ধুরা শুধু পড়াশুনার জন্যই রোহিতের পিছনে পড়ে থাকতো, তার বেশি কোনদিন ভাবেনি প্রিয়া। এই পঁচিশ বছরের জীবনে প্রিয়ার সেরকম কোন ছেলে বন্ধুও হয়নি। প্রিয়ার কাছে সব সময় বাবা মা এবং ওর পারিবারিক ব্যবসাটা আগে গুরুত্ব পেয়েছে। ওর বড়দা অনেকদিন আগেই বিয়ে করে বৌ আর ওদের ছেলেকে নিয়ে কানাডায় গিয়ে সেটেল হয়েছে, আর কোনদিন দেশে ফিরবে না। এখন বাবা শুধু মেয়ের ওপরেই ভরসা করে আছেন। এই অবস্থায় রোহিতকে পাশে পেলে প্রিয়া ওর জীবনটাকে সম্পূর্ণ ভাবে এক অন্য রকম দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করবে ভাবছিল। মায়ের কথার জবাবে বলে,’আমার আপত্তি নেই মা।‘
কথাটা বলে প্রিয়া রোহিতের দিকে আবেগ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কারণ ওর চিন্তা হচ্ছে এখন পর্যন্ত রোহিত এই ব্যাপারে কোন হু হা কিছুই বলেনি। রোহিত যদি এখন না করে দেয় তাহলে ওদের এই পরিকল্পনা একদম ভেস্তে যাবে। দেখে বাবার মুখও গম্ভীর, মাও তাকিয়ে আছেন রোহিতের দিকে। অবশেষে ওদের সবাইকে চমকে দিয়ে প্রিয়াই বলেই ফেলল,’ কিন্তু বাবা, আমার একটা শর্ত আছে। সেটা হল তুমি কিন্তু রোহিতকে আর চোর বলে পরিচয় দিতে পারবে না। ও মোটেই পেশাদার চোর নয়, হ্যাঁ, হয়ত ভুল করে অবস্থার চাপে কিছুদিন এই ভুল কাজটা করেছে, কিন্তু তাই বলে একটা মানুষ জন্ম থেকেই চোর হয় না।‘
রোহিতের মনের সংশয় এবার অনেকটা কেটে গেল। হাসি মুখে বলল,’ আমার আপনাদের সাথে কাজ করতে কোন অসুবিধা নেই জেঠু। কিন্তু আমিও ভাবছিলাম যে একজন চোরকে আপনারা বিশ্বাস করছেন কি ভাবে ? আমি তো ইতিমধ্যেই একটা পরিচয়ে পরিচিতি পেয়ে গেছি।‘ কথাটা বলে রোহিত ভৌমিক বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওঁর এইভাবে স্ত্রী ও মেয়ের সামনে পরিচয় দেওয়াটা রোহিতের ভাল লাগেনি। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা মিথ্যাও নয় তাই কিছুই বলবার ছিলনা ওর। এখন সুযোগ পেয়ে বলেই দিল।
ভৌমিক বাবু বুঝতে পারলেন কথাটা ওঁকেই বলল রোহিত। জবাবে বললেন,’ দেখ রোহিত, নিজেকে কখনো ছোট ভাবতে নেই। মনে রেখ বাল্মিকি মুনি, যিনি রামায়ণ রচনা করেছেন, তিনিও আগে ডাকাত ছিলেন। পরে উনি তপস্যা করে বাল্মিকি মুনি হন এবং রামায়ণের মত মহাকাব্য রচনে করেন। আমার বিশ্বাস তুমি তোমার এই সাপের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে আর খুব তাড়াতাড়ি তোমার পুঁথিগত ও বংশগত শিক্ষার মর্যাদা দিতে পারবে। তুমি আর প্রিয়া দুজনে মিলে আমাদের এই ব্যবসাটাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। আমি কখনো লোক চিনতে ভুল করিনা রোহিত। তুমি মন খারাপ করো না বাবা।‘
নিচে রান্নার লোকের কলিং বেল শুনে মিসেস ভৌমিক চলে গেলেন দরজা খুলতে। প্রিয়া উঠে গিয়ে রোহিতের হাত ধরে টান মেরে বলল, ‘বাবা, আমি রোহিতদাকে নিচে দাদার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি ফ্রেস হবার জন্য। তুমি চিন্তা করো না, ওর বাকি সব আমি ম্যানেজ করে নেব।‘ রোহিত হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায়। ভৌমিক বাবু দুই হাত তুলে বলেন,’ তোমরা খুব সুখী হও বাবা, আমি আশীর্বাদ করছি তোমাদের।‘