ঋত্বিক - বাংলা সাহিত্য পত্রিকা

 


   || সূচিপত্র ||


💖কমিকস - অম্বুচরিত - রাহুল ঘোষ

💖শিশুসাহিত্য - কিরকেল - ভাস্কর শীল




                               
 

  

রাঙিয়ে দিয়ে যাও - ঐষিক_মজুমদার



রাঙিয়ে দিয়ে যাও

ঐষিক মজুমদার


    দেরী হয়ে গেল! বড় দেরী হয়ে গেল! - ক্লান্ত, অশক্ত হাতে যন্ত্রের সার্কিট শেষবারের মত ঠিকঠাক করে নিতে-নিতে ভাবলেন অশীতিপর বিজ্ঞানী বাসব রায়। এতদিন পরে সম্ভব হবে কি তাঁর স্বপ্নের সেই রঙীন জগতে ফিরে যাওয়া?
নিজের আবাস এই ধাতব গোলকের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালেন বিজ্ঞানী। সেই একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন ধূসরতা। রুক্ষ, প্রাণহীন প্রান্তরে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে আরো কিছু ধাতব গোলক। ক্ষীয়মান জীবনের একমাত্র চিহ্ন। শুধু এই শহর বলে নয়। ভূপৃষ্ঠের সর্বত্রই একই চালচিত্র।

    অথচ একদিন এমন ছিল না। বর্ণময় ছিল আজকের এই মৃতবৎসা পৃথিবী। ছিল উদ্ভিদের সবুজ, পরিণত শস্যের সোনালী, জলাশয়ের নীল, ফুল-পাখি-প্রজাপতির বহুবর্ণ কোলাজ। আর এত রঙের মধ্যেই তাঁর জীবনে এসেছিল আরো রঙীন সেই দিন....

নাঃ, এখন নয়! একটি নিঃশ্বাস ফেলে সবলে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন বিজ্ঞানী। দেখবেন, তিনি দেখবেন। নিজের জীবনের শেষ রঙীন দিনটির যে স্বপ্ন শয়নে-জাগরণে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের দোসর হয়ে আছে, না দেখে পারেন কি তা? সেই স্বপ্নকে ঘিরেই তো তাঁর এত আয়োজন!
দেখবেন তিনি অবশ্যই! তবে তার আগে শেষ কাজটুকু সেরে নেওয়া দরকার। অন্যান্য আবিষ্কারের অন্তরালে সারা জীবন ধরে যে সাধনা তিনি করে এসেছেন, এই তার অন্তিম পর্যায়। এতে সফল হলে ওই স্বপ্ন আর থমকে যাবে না মাঝপথে, শূন্যে মিলিয়ে যাবে না অলীক মরীচিকার মত!
মাঝপথে? হ্যাঁ , মাঝপথেই থেমে যায় ওই স্বপ্ন, ঘোর ভেঙে যায় সেই রঙীন, কিন্তু ভয়ঙ্কর মুহূর্তটিতে এসে পৌঁছলেই!
ছোট্ট বাড়িটার সামনে উচ্ছল একঝাঁক তরুণ-তরুণীর ভিড়। তার মধ্য থেকে বেরিয়ে এল অহনা। হাসিমুখে ছুটে আসছে তাঁর দিকে। হাতের মুঠিতে আবীর। উদ্বেল আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বাসব।
হঠাৎ কেঁপে উঠল পায়ের নীচের মাটি। ছুটতে-ছুটতেই থমকে দাঁড়াল অহনা। রঙে-রঙে রঙীন তার শরীর সহসা আরো রঞ্জিত হয়ে উঠল উৎকট গাঢ় লাল রঙে। তারপর সব অন্ধকার।
আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাসব। অহনা তাঁর কলেজের বান্ধবী। প্রায় এক বছর ধরে গাঢ় হয়ে উঠেছিল দু'জনের পরিচয়। তার আমন্ত্রণে হোলির দিন তার বাড়িতে গেছিলেন তিনি।
ষাট বছর আগে সেই অভিশপ্ত হোলির দিনেই এই শহরে আছড়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ। বিপক্ষ বায়ুসেনার অতর্কিত বোমাবর্ষণে মৃত্যু হয় অহনা-সহ আরো অনেকের। যারা বেঁচে গেল, তাদের স্থায়ী ঠিকানা হল এই মৃত্যু আর ধ্বংসের সাম্রাজ্য।

     তিন বছর। তিন বছর ধরে চলেছিল সেই যুদ্ধ। মাত্র তিনটি বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ, আর তার সাথে মানুষের তিলে-তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার অর্ধেক। যে অর্ধেক পড়ে রইল, তাদের জীবন অবরুদ্ধ হল দুঃস্বপ্নের কারায়। বাসব তাদের একজন।
যুদ্ধে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছিল পরমাণু-অস্ত্র। ফলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে আক্রান্ত হল অনেকে। উপার্জনহীন, ব্যাধি-জর্জর জীবন নিয়ে আহত কীটের মত বেঁচে রইল তারা। ক্ষতিগ্রস্ত হল পৃথিবীর রক্ষাকবচ ওজোন স্তর। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগল। পরবর্তী কয়েক দশকে আন্টার্কটিকার বরফ গলে জলমগ্ন হল বহু দেশ। অবশিষ্ট অংশে প্রথমে উদ্ভিদ, পরে প্রাণীরা লুপ্ত হতে থাকল। যুদ্ধোত্তর পঞ্চাশ বছরে ধীরে-ধীরে পৃথিবী পরিণত হল এই বিবর্ণ, ধূসর গোলকে।
এরই মধ্যে অতি কষ্টে পড়াশোনা এবং তারপর বিজ্ঞানসাধনা চালিয়ে গেছেন বাসব। চোখের সামনে অহনার বীভৎস মৃত্যু দেখার পর তিনি আর সংসারী হন নি। আজ প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বিজ্ঞানী বাসব রায়। আজকের উদ্ভিদহীন পৃথিবীতে বায়ু সংশোধন ও খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি, বসবাসের অযোগ্য পরিবেশে ধাতব গোলকের এই কৃত্রিম উপনিবেশ, বাইরে চলাচলের বিশেষ পোশাক - এর প্রায় সব কিছুর পেছনেই তাঁর অবদান রয়েছে।

    তবুও, হারছেন তিনি। হারছেন তাঁরা। হারছে সমগ্র মানবজাতি। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সমস্ত ভাণ্ডার। কমছে বিশ্বের জনসংখ্যা। তেজস্ক্রিয়তার বিষে প্রজনন-ক্ষমতা হারিয়েছে অনেকে। যারা সক্ষম, তারা সন্তানধারণে নারাজ। আরেকটি প্রাণকে নিজেদের দুর্ভাগ্যের অংশীদার করতে চায় না তারা।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কেউই জেতে নি - মাঝে-মাঝে ভাবেন বিষণ্ণ বাসব। আরেক মরণপণ লড়াইয়ে তাঁরা এক অবশ্যম্ভাবী এবং চূড়ান্ত পরাজয়কে সামান্য বিলম্বিত করছেন মাত্র।

    তবুও, ফিরে-ফিরে আসে ওই স্বপ্ন। বর্তমানের এই ধূসর বিবর্ণতার তীব্র বৈপরীত্যে বর্ণময় অতীতের সেই আভাস বারে-বারেই উঁকি দিয়ে যায় তাঁর চেতনায়। সেই অধরাকে ধরতেই তাঁর এই উদ্ভাবন, তাঁর গণনাতীত দিনের সাধনার ফল - স্বপ্নসম্ভব!

     হ্যাঁ, তিনি এই যন্ত্রের নাম রেখেছেন স্বপ্নসম্ভব। কৈশোর ও যৌবনে বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যকেও ভালোবেসেছিলেন বাসব। এই নাম তারই প্রতিফলন। তাঁর ভাণ্ডারে আজও মাইক্রোফিল্ম আকারে রক্ষিত আছে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সব মণিমুক্তো। তাঁর মৃত্যুর সাথে-সাথেই যাবে সব। আজকের নির্মম, নিষ্করুণ জগতে সাহিত্য ও সুকুমার কলার চর্চা অবলুপ্ত। একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে বহ্ন্যুৎসবের মধ্য দিয়ে যার সূচনা, সেই বর্বরতার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে এসে।

     শেষ সার্কিটটি যথাস্থানে বসিয়ে জেনারেটরের সুইচ অন করলেন বাসব। মৃদু গুঞ্জনে চালু হয়ে গেল যন্ত্র। সেটিকে পাশে টেনে এনে ইজিচেয়ারে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি।

     স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের যে সূক্ষ্ম বিচলন হয়, এই যন্ত্র তা অনুভব ও বিশ্লেষণে সক্ষম। সেই ক্ষমতার বলে তাঁর স্বপ্নকেও বিশ্লেষণ করবে এই যন্ত্র। তারপর নির্ধারণ করবে তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি। সবশেষে তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী ওই অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নকে পূর্ণতা দেবে সে। নিজের স্বপ্নের ঈপ্সিত পরিণতিটি প্রত্যক্ষ করবেন তিনি। তারপর....না, তারপর কি হবে, তা তাঁরও জানা নেই।

     উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে চেয়ে রইলেন বাসব। ক্লান্তিতে তাঁর চোখের পাতা ঢলে পড়ছে। বাইরে ধাতব গোলকগুলির মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে রুক্ষ পথ। অহনার বাড়ির পথটিও ছিল কিছুটা এমনই। তফাত একটাই। সে পথের দু'পাশে ছিল গাছ, ছিল সবুজ মাঠ। আর এই পথের ধারে আছে প্রাণহীন, বর্ণহীন প্রান্তর...
বর্ণহীন? না, একটু ভুল হল বোধহয়! দূরে দেখা যাচ্ছে না সামান্য সবুজের আভাস? কৌতূহলী বাসব সেদিকে পা বাড়ালেন।
হ্যাঁ, এবারে আর সন্দেহ নেই! ওখানে মাঠ আবার সবুজ ঘাসে ঢেকে গেছে। উত্তেজনায় তাঁর চলার গতি বেড়ে গেল।
এখন বাসবের দু'পাশে গাছের সারি। তাদের সবুজ পত্ররাজির ফাঁকে-ফাঁকে লাল ফুলে আগুনের আভাস। আজ হোলি যে! প্রকৃতিও বুঝি তাই সেজেছে রঙীন সাজে! কি যেন নাম এসব গাছের? হ্যাঁ, মনে পড়ছে! পলাশ, কৃষ্ণচূড়া....
দ্রুত পায়ে, প্রায় দৌড়ের গতিতে চলেছেন তিনি। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে সব। আরেকটু এগোলেই অহনার বাড়ি। আর....
আর ওই যে অহনা!

     থমকে দাঁড়িয়েছেন বাসব। নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন তিনি নিজে। ওদিকে রাস্তার ওই প্রান্ত থেকে খিলখিল হেসে যেন পরীর মতই উড়ে আসছে অহনা! তার হাতের মুঠিতে আবীর।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছেন বাসব। আসছে অহনা, আসছে.....এসে পড়ল! না, থমকে যায় নি স্বপ্ন!
প্রেয়সীর দামাল আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। হাসতে-হাসতে অত্যাচারী দস্যুর মত সে হাতের আবীর মাখিয়ে দিল তাঁর মুখে-গলায়-ঘাড়ে।
"কি হচ্ছেটা কি?" - কপট ক্রোধে তাকে সামান্য ঠেলা দিলেন তরুণ বাসব। পরক্ষণেই আবদ্ধ করলেন তৃষিত দুই বাহুর নিবিড় আলিঙ্গনে....

                                            ***

        হ-৪২ কৃত্রিম উপনিবেশের ক-১ অঞ্চলে বিখ্যাত বিজ্ঞানী বাসব রায়ের বাস -গোলক থেকে পুরো একদিন কোনোরকম সঙ্কেত না আসায় সেখানে অনুসন্ধানকারী দল পাঠাল উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা। দলের সদস্যরা গোলকের দরজা ভেঙে দেখতে পেল - জানালার সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী। তাঁর মুখে শুধু আনন্দ আর প্রশান্তি। মাথার পাশে রয়েছে এক বিচিত্রদর্শন যন্ত্র, যার গঠন বা উদ্দেশ্য অনুধাবনের কোনো উপায় এখন আর নেই। স্তব্ধ হয়েছে জেনারেটর, গলে লয় হয়ে গেছে তার সমস্ত সার্কিট।

        পৃথিবীর শোকস্তব্ধ মানুষ জানল - হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের অস্তিত্ব-সংগ্রামের চিরস্মরণীয় সেনাপতি মহান বিজ্ঞানী বাসব রায়। শুধু একটি রহস্যের সমাধান কেন্দ্রীয় সংস্থা করতে পারে নি। প্রয়াত বিজ্ঞানীর মুখে, গলায়, পরিধেয় বস্ত্রে লেগে ছিল এক ধরণের সূক্ষ্ম রঞ্জক-চূর্ণ। অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যরা প্রথমে বুঝতে পারে নি তা কি।

     তাদের সংগৃহীত নমুনার বিশ্লেষণ এবং কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার অন্বেষণের পর জানা যায়, বস্তুটির নাম আবীর। পুরাকালে হোলি নামে এক অধুনা-বিলুপ্ত উৎসবে তার ব্যবহার ছিল। কিন্তু বিস্মৃত অতীতের সেই রঙ এই বর্ণহীন জগতে কি করে এল - সেই রহস্যের কোনো মীমাংসা এখনও হয় নি।

Oeeshik Majumdar









কাম সারছে- শৌভিক ঘোষ


কাম সারছে
শৌভিক ঘোষ



    কাল দুপুরবেলা গান্ডেপিন্ডে গিলে ভাবলাম বিছানায় একটু প্রেমিকাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করি! এই তো খারাপ ভাবছেন শুরুতেই,প্রেমিকা মানে আমার এই মুহুর্তের সুখদুঃখের সঙ্গী ...আমার জানু..আমার গুলুগুলু মোবাইলটা!! তা মেঘলা মেঘলা ওয়েদারে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,চোখ খুলতেই দেখি মেয়ে আর বৌ পাশটিতে ভসভস করে ঘুমোচ্ছে! জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম সবে ভোর ভোর..বাব্বা!! কতদিন পর এত্তো ভোরে উঠলাম!! তা যাই একটু ছাদে পায়চারি করে আসি...

     ছাদে উঠে দেখি পাশের বাড়ির দাদা আর বৌদি পায়চারি করছে!! এ তো দেখছি আমার থেকেও সকালে ওঠে!! হেঁ হেঁ করে একগাল হেসে বললাম,গুড মর্নিং ..এই যে সকাল সকাল শরীরচর্চা করছেন,এটা কিন্তু বেশ ভালো!! আমার বৌকে বললেও শোনে না,কত বেলা করে ওঠে!!
দাদা বৌদি দেখলাম কোনো উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে তাকালো! ও ঠিক আছে, সকাল সকাল প্রেমে বাঁধা দিতে নেই..

     ছাদের এ পাশটিতে এসে দেখি পাশের বাড়ির কাকু বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে কাকিমার সাথে চা খাচ্ছেন ..আবার একগাল হেসে বললাম,গুড মর্নিং কাকু কাকিমা।এতো সক্কাল সক্কাল চা খাচ্ছেন!! আমার তো ব্রাশ ই করা হয়নি,পটি ফটি করে আজ একটু বাজার যাবো,তারপর চা খাবো!!ওনারাও দেখি অবাক হয়ে তাকালেন!! আসলে এতো সকালে তো আমাকে কোনোদিন দেখেন না তাই ঘাবড়ে গেছেন বোধহয়!!

     ভাবলাম এতো সকালে উঠলাম ই যখন একটু রামদেবকে স্মরণ করি..প্রাণায়াম যদিও করছি সকাল বিকেল..তবে শবাসন ছাড়াও এই শ্বাস ছাড়া,শ্বাস নেওয়া এটাও একটু প্র্যাকটিস করা যেতে পারে!এক পায়ে খাড়া হয়ে হুঁক হুঁ .... হুঁক হুঁ করছি ,দেখলাম পাশের বাড়ির পোংটা পাকা মেয়েটা উঁকি দিয়ে দেখেই জানালাটা ধপাস করে বন্ধ করে দিল!! ব্যাপারটা তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না!!

     খানিকক্ষণ ছাদে এদিক ওদিক করছি,দেখলাম নিচ থেকে সঙ্গীর গগণভদী চিৎকার..ফটাফট তুমি নিচে এসো!! ধুড়মুড় করে নিচে নেমে বললাম,দেখলে তো কত্তো সকাল সকাল উঠেছি আজ!!
মেয়ে টিভিতে ইদানিং খুব মহাকালী সিরিয়াল দেখছে,বৌ এর লুকস যেন সাক্ষাৎ মা কালী.. শুধু দ্রামা দ্রিমি দ্রিমি,তা দুন দুন মিউজিক দিলেই আমার কাটামুন্ডু ওর হাতে ঝুলবে!!
হুংকার দিয়ে বললো,পাশের বাড়ির বৌদিকে কি বলেছো?
কি বলেছো মানে!! চরিত্র চারবার পাঁচবার করে এখন স্যানিটাইজ করছি,কি বলবো!!

গুড মর্নিং ,এখন গুড মর্নিং?
তা না তো কি? মর্ণিংকে আফটারননুন বললে আফটারশক কি হবে বোঝো?
আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন,এখন ভর সন্ধ্যে,আর তুমি গুড মর্নিং বলে এসেছো!!দাদা বলছে, শৌভিক কে অ্যান্টাসিড দাও,মনে হয় বায়ু কুপিত হয়েছে!!
যাঃ কেলো!!সরি সরি,তুমি কুপিত হয়ো না প্লিজ,আমার বায়ুপ্রবাহ,বায়ুচাপ কিচ্ছু কুপিত হয়নি!!

     মা ফোন করলো এইমাত্র,দত্ত কাকু ফোন করে মা কে কিসব বলেছেন,তুমি নাকি উল্টোপাল্টা বকছো!! নেশার জিনিস না পেয়ে নাকি সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার!! কি করে মুখ দেখাবো বলোতো!!
আরে বাপরে! জীবনে তোমার চুমু ছাড়া আর কিছু নেশা করলাম না,এখন না হয় ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং মেইনটেইন করছি.. কিন্তু সেটা তো কাকুর জানার কথা না!! উনি এসব কি লাগানি ভাঙানি করছেন বলোতো!!
ভরসন্ধ্যেবেলা কাউকে মর্ণিং বললে তিনি কি তোমায় সুস্থ ভাববে?আরো শোনো ,থানা থেকে ও ফোন এসেছিল,তোমার নাকি শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল খানিকক্ষণ আগে? হেবি জোরদার শ্বাস নিচ্ছিলে?যাই যাই অবস্থা!!
সে কি!!আমি তো প্রাণায়াম করছিলাম!!

     পাড়ার কেউ ফোন করেছে পুলিশকে ,আমাদের ফোন নম্বর ও দিয়েছে,থানা থেকে বললো,আপাতত ১৪ দিন তুমি যেন বাড়ির বাইরে পা না দাও,আর বেশি টান উঠলে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে....
এরপর আর শুনতে পারিনি!! নিজেকে দাদার কীর্তি র তাপস পাল মনে হচ্ছিল ..শাআআলা এতদিন ঘর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছিলাম,মোবাইলে ডালগোনা কফি খাচ্ছিলাম,এই একটা মেঘলা ওয়েদার শেষে কিনা ...😭😭😭




Souvik Ghosh

                          
                               
                                      

খেজুরতলার ইতিকথা -অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


খেজুরতলার ইতিকথা

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


        তেমন গরম পড়েনি এখনও। সন্ধের ঝটকা হাওয়ায় ধুলো উড়ছে এলোমেলো। পার্বতী মেঠো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে সনিষ্ঠ যত্নে।বসে থাকলে চলে না। সে বসে গেলে পরিবারও বসে যাবে।আরো তিনটে ছেলেমেয়ে আছে। কাঁচা বয়েস, কাঁচা মন। তবে পেকে যাচ্ছে অকালের বাতাসে।ঘরের পুরুষটার তেমন নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। পুরুষটা তার শ্বশুরমশাই। প্রায় সর্বক্ষণ শুয়ে থাকে। কি হয়েছে কে জানে। ডাক্তার বদ্যি করার পয়সা কোথায়। দু মাইল দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গুলি এনে খাওয়ায় মাঝেমধ্যে। কাজের কাজ কিছুই হয় না তেমন। হাত পা ফুলে উঠছে কেমন। অসাড়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে যখন তখন। কে সামলাবে এত ঝক্কি। মাটির মেঝেয় খড় পেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে লোকটাকে। বুদ্ধিসুদ্ধিও লোপ পেয়েছে মনে হয়। প্রায় সারাক্ষণই নিজের মনে বিড় বিড় করে কি সব বকে নিজের মনে। মাঝে মাঝে নিকুঞ্জ... নিকুঞ্জ করে ডাকে । নিকুঞ্জের কোন সাড়া পায় না। তবু অবুঝের মতো ডাকে। নিকুঞ্জ হল বুড়োর ছেলে । আজ বারো বছর ধরে সদরের জেলখানায় জীবন কাটাচ্ছে। কি অপরাধ পরিষ্কার কেউ জানে না। রেল কোয়ার্টারের পেছনে নাকি ফেলে দেওয়া কয়লা কুড়োচ্ছিল। ফেলে দেওয়া কয়লা— জোড়া তাপ্পি দেওয়া সংসারে যদি এট্টু কাজে আসে। পুলিশে ধরেছিল। তারপর থেকে সদরের জেলখানায়। বারো বছর কেটে গেল এইভাবে। জোয়ান নিকুঞ্জ বুড়িয়ে যেতে চলল। তার অপরাধটা কি আজও তার হদিশ পায়নি সে। উকিল লাগাবার পয়সা কোথায়। সরকার উকিল দিয়েছিল একটা। কিন্তু তাকে ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। বছরের পর বছর কেস ওঠে না কোর্টে। নিকুঞ্জ অনেক ভেবে ভেবে এখন ভাবনার ঘরে তালা চাবি মেরে দিয়েছে। তিনটে বাচ্চার কথা ভেবে খুব কান্না পেত প্রথম প্রথম। এখন মরে গেছে সে জলের সোঁতা। এখন শুধু অ্যাঁকাব্যাঁকা হিসেব করে দিনভর, আর কতদিন সে বাঁচবে। তার বুড়ো বাপটা কি বেঁচে আছে এখনও ? পার্বতী কিভাবে ঘর ছেলেপুলে সামলাচ্ছে , কে জানে । মদন এলে এবার জিজ্ঞেস করতে হবে সবকিছু। মদন বড় ভাল ছেলে। আর ক’বছরই বা সে বাঁচবে। মরার আগে তার দোষটা জানতে পারলে বড় ভাল হত।

  

   তিনটে বৌ কোমরে ঘড়া ভরা ।জল নিয়ে মন্ডলপাড়ার দিকে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে।

 বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধে ঝুঁকে আসছে। ঝাঁট দেওয়া শেষ করে ঝাঁটাটা দাওয়ার একধারে রেখে মুখ তুলতেই দেখতে পেল মাথা নীচু করে আনমনে কি ভাবতে ভাবতে মদন আসছে।মদন দাস। পার্বতীর বোনপো। দিদির ছেলে।বড় উপকারি ছেলে।প্রায় পাঁচবছর ধরে আগাগোড়া পাশে আছে জানমান দিয়ে। তার আগে ও বড্ড ছোট ছিল।

 মদন কাছে এসে দাঁড়াতে পার্বতী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।মদন কিন্তু চোখ তুলল না। মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইল।

— ‘ কিছু হল না, না ? ‘ পার্বতী উদাস এবং প্রত্যাশাহীন স্বরে প্রশ্ন করে, যে প্রশ্ন সে বারো বছর ধরে করে আসছে।

— ‘ না, মানে .... আজ কোর্টে খুব গন্ডগোল । জজ আসেনি... ‘ মদন অপরাধী গলায় জবাব দেয়।

 নতুন কোন কথোপকথন নয়।বছরের পর বছর চলছে একই ধারায়। দিন চলে যায়, শরীর বদলে যায়, পৃথিবী আরও বুড়ো হয়। কিন্তু এ দুনিয়ার বহু মানুষের জীবনের রঙ কখনও বদলায় না।হেমন্তের ধূসর মাঠ পড়ে থাকে অগোচরে, অনাদরে ।

       মদন কাটোয়ার একটা হোটেলে কাজ করে। ভাতের হোটেল। এবেলা ওবেলা মিলে প্রায় তিনশো লোক খায় । মালিক সনৎ বরাট খুব ভাল লোক। অনেক চেষ্টা করেছে নিকুঞ্জর জন্য একটা ভাল উকিল যোগাড় করে দেবার । কিন্তু এত বছরেও সেটা হয়ে উঠল না। এটা হয় তো, ওটা হয় না। ওটা হয় তো এটা হয় না। ‘অন্তত জামিনের ব্যবস্থাটা যদি হয়ে যেত.... তারপর মামলা গড়ায় গড়াক। আমি শীল বাবুকে বলে রেখেছি। মদন দেখিস তুই এবার মামলা উঠবেই।’ এই করে করে বারো বছর গেল। মদন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।তার আর কোন তাপ উত্তাপ হয় না এসব শুনে। এত বছর ধরে এত শুনেছে এসব কথা। সনৎ বরাটের মন খারাপ হয়ে যায় মদনের নির্বাক হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে। বলে, ‘ আমার কি আর খারাপ লাগে না ! খুব খারাপ লাগে, বুঝলি মদন, খুব খারাপ লাগে । এতগুলো বছর গেল কিছুই করতে পারলাম না নিকুঞ্জর জন্য .... তবু হাল ছাড়িস না, বুঝলি মদন, হাল কখনও ছাড়তে নেই। ব্যবস্থা একটা হবেই।’

       সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মদন দেখল স্টেশনের বাইরের দোকানে গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে। যেমন মুচমুচে লালচে বরণ তেমনি রসে চুপচুপে।মদনের জিভে জল এসে গেল। পকেটে মোট পঁয়ত্রিশ টাকা আছে। তাছাড়া কিছু খুচরো পয়সা আছে। তিনটে জিলিপি কিনল।পনের টাকা লাগল। মদন দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসল শালপাতার ওপর রস গড়িয়ে পড়া তিনটে গরম জিলিপি নিয়ে।গরম জিলিপি একটা ছোট কামড়ে মুখের ভেতরে নিল সে। পরম আবেশে মদনের চোখ বুজে এল। সংসারের সব যন্ত্রনা যেন কর্পূরের মতো উবে গেল । আ: কি সুখ !


       মদনের বাবা তারকনাথ মারা গেছে বারো বছর আগে, সাপের কামড়ে। চক্রবর্তীদের জমিতে কাজ করে মাঠের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করছিল বাড়ির দিকে। ভর সন্ধেবেলা। সূয্যি পাটে গেছে। ভাল করে দেখা যায় না কিছু । অসাবধানে গায়ে পা পড়ে গিয়েছিল । জাত কালসাপ। নিমেষে ছোবল মারল। চিৎকার শুনে বিধু মন্ডল ছুটে এল কাছের কুঁড়ে থেকে।দুচারটে লোকজনও জড়ো করল। কিন্তু বিশেষ কিছু করা গেল না। কর্ত্তব্য ঠি ক করতে করতেই সরসর করে বিষ উঠে গেল মাথায়। সদরের হাসপাতাল ওখান থেকে দশ মাইল দূরে। ওরা তৈরি হয়েছিল যাবার জন্য। কিন্তু তারকনাথের ভবিতব্য তাদের সে সময় দিল না। চলে গেল অকালে।মদনের বয়েস তখন মোটে তেরো।


       মদনের মা শেফালি গরু চরানোর কাজ করে চার বাড়ি। ঢেঁকিতে পাড়ও দেয় ঘোষাল বাড়ি। মদন ক্লাস এইট অব্দি পড়েছিল অচিন্ত্যমোহন  বিদ্যাভবনে। তার পর আর সম্ভব হল না। কাটোয়া স্টেশনের ধারে সনৎ বরাটের ভাতের হোটেলে কাজে লেগে গেল। এখন তার চব্বিশ/ পঁচিশ বছর বয়েস। তার খুব ইচ্ছে সেও একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিক হবে। সনৎ বরাটও তাকে খুব উৎসাহ দেয়। বলে, ‘ লেগে থাক মদন, তোরও একদিন হবে , ঠি ক হবে। এখন এই নিকুঞ্জটার জন্যই বড় চিন্তা।যদি একটা জুতসই উকিল পাওয়া যেত ..... ।’ সনতের মতো লোক হয় না। বারো বছর ধরে নিকুঞ্জর দু:খ বহন করে চলেছে। এর মধ্যে দুনিয়ার কত কিছু বদলে গেল। কত লোক এল, কত লোক গেল। নিকুঞ্জটা জেলে পচে মরছে বিনা দোষে। কবে যে কি হবে.... । বড় নরম সরম মানুষ সনৎ বরাট। কি করে যে কারবার চালায় কে জানে। ধড়িবাজ লোকের তো অভাব নেই। ওপরওয়ালা বোধহয় নরম মানুষের মাথায় খানিক স্নেহের হাত রাখেন কখনও সখনও।

 

      তার মা আর তার মাসী পার্বতীর খুব মিলমিশ। জেলখানায় তার মা আর মাসী অনেকবার গেছে মেশোমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে।মদনও গেছে বেশ কয়েকবার। দেখা করা সহজে হয় না। তার জন্যও জেলের গেটে গিয়ে ধরা করা করতে হয়। ঘুষ দিতে হয়। অন্তত বিড়ি সিগারেট। তাদের মতো গরীব মানুষ এর বেশি আর কিই বা দেবে। তারা আশাও করে না এর বেশি । এখন আর জেলখানায় যায় না অনেকদিন হল। মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। মেশোর খুব কষ্ট। প্রথমদিকে কান্নাকাটি করত। এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে।মদন ভাবে এ বছর পুজোর মধ্যে যে করে হোক উকিলের ব্যবস্থা করবেই। জামিনটা একবার হলে হয়। তারপর নয় লড়াই করা যাবে। সনৎ বরাটও চেষ্টায় আছে । দেখা যাক কি হয়। মাসী খুব যুদ্ধ করছে। কত ঝড় জল সয়ে তিনটে বাচ্চাকে বড় করে তুলছে। গ্রামের ইস্কুলেও ভর্তি করেছে। পড়াশোনায় অবশ্য মন নেই কোনটার। শুধু মিড ডে মিল খাওয়ার জন্য ইস্কুলে যায়।

 

   বর্ষাকাল এসে গেল ।ঘরের চালে খড় দেওয়ার দরকার। জীবন জীবনের মতো চলে।পেছনে তাকায় না। পুজোর আর মাস তিনেক বাকি। তার আগে কি উকিল যোগাড় হবে ? তাদের তো টাকা পয়সা নেই। উকিলবাবুরা বিনি পয়সায় খাটবেই বা কেন। তাদের কত কাজ। নিশ্বেস ফেলার ফুরসত নেই। সনৎ বরাট একবার একজনের সঙ্গে কথা বলেছিল। সে কোর্টে উকিলদের বসার জায়গায় তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। কিন্তু পরপর পাঁচদিন বিভিন্ন সময়ে গিয়েও তার দেখা পায়নি মদন। তারপর হাল ছেড়ে দেয়। অবশ্য হাল ঠি ক ছাড়েনি।বলা যায়, দাঁত কামড়ে পড়ে আছে লড়াইয়ের মাঠে আরও কড়া লড়াই দেবার জন্য।

 

       শিবব্রত সান্যালের তিন পুরুষের পেষা ওকালতি। ভবানীপুরে পেল্লায় বাড়ি। রাজপ্রাসাদ বলা যায়। তিনি নিজেও বাগুইহাটিতে আড়াই  হাজার স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বছরখানেক আগে। এখন সেখানেই থাকেন। বাড়ির কাজের লোকের উপস্থিতি বাদ দিলে বাড়ির সদস্য সংখ্যা চার। স্বামী স্ত্রী এবং দুটি সন্তান। দুটিই ছেলে। বড়টির বয়স বারো। ছোট ছেলের বয়স দশ। সমস্যা বড় সন্তানটিকে নিয়ে। এ এস ডি অর্থাৎ অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার  আক্রান্ত। প্রকৃতি বা নিয়তি জীবন ঢাকবার জন্য গোটা চাদর কাউকে দেয় না। একটা দিক ঢাকতে গেলে আর একটা দিক উদোম হয়ে যায়। জীবনের একদিকে সতেজ সজীব বৃষ্টি অরণ্য থাকলেও আর একদিকে ধু ধু মরুভূমি জেগে থাকে, ঠি ক পৃথিবীপৃষ্ঠের মতো।সব মিলিয়েই প্রকৃতি এবং পৃথিবী।মরু এবং অরণ্য একে অপরের পরিপূরক। মানুষের জীবনও ঠি ক তাই।একদিক ভরা, একদিক খালি। না হলে বহমানতা বজায় থাকে না। পূর্ণ এবং শূন্য , এই দুই প্রান্তের প্রবহমান চলাচলে গতিষ্মান থাকে জীবন। সেই কারণেই হয়ত শিবব্রত সান্যালের এক দিক ধূসর যন্ত্রণাময়। সেই যন্ত্রনার রূপ হল তার বড় ছেলে শুদ্ধসত্ত্ব বা বাবিন।কোটি কোটি টাকার সুখময়তায় চাপা দেওয়া যায় না কোন কোন ব্যথার কাঁটা। থেকে থেকে ছোবল মারে কষ্টের কালসাপ।

      ছোট ছেলে অতলান্ত একবারেই স্বাভাবিক। চনমনে এবং বুদ্ধিদীপ্ত। দশ বছর বয়েস। আপনমনে খেলে বেড়ায়। আপনমনে হোমওয়ার্ক করে, নিজে নিজেই তৈরি হয়ে স্কুলে যায়, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসে। তার মা বাবার সময় নেই তার দিকে নজর দেবার। তা নিয়ে তার কোন অনুযোগ নেই। বাবা তার পেশাগত কাজে চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত। তার ছেলেরা কোন ক্লাসে পড়ে সে খবরই তিনি রাখেন কিনা সন্দেহ।বাবিন এখন আর স্কুলে যেতে পারে না। তার মা সবসময়েই তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজে মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বাবিনের দেখভাল করার জন্য। সন্তান বড় মায়ার জিনিস। গর্ভের নাড়ি ছেঁড়া ধন। শিবব্রতবাবুরও বুকে হাহাকার আছে। তিনি হাহাকারের শূন্য গহ্বর চাপা দিয়ে রাখেন ভারি ভারি কাজের পাথর দিয়ে।

    শিবব্রতবাবু ভাবলেন, কাজের থেকে ছুটি চাই একটু। পরিবারের সকলেরই ছুটি চাই, ভরাট প্রবল কর্মের ফাঁস আলগা হওয়ার দরকার। স্ত্রী স্বাতীলেখারও দরকার, দুই ছেলেরও দরকার।স্বাতীলেখার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন উত্তরাখন্ডের দিকে যাবেন। প্রথমে যাবেন হরিদ্বার আর মুসৌরি তারপর রানীক্ষেত, আলামোড়া, কৌসানি।

 

       সনৎ বরাট বলল, ‘ কাল সকালে তোকে নিয়ে একবার কলকাতায় যাব শিবব্রত উকিলের বাড়ি , বুঝলি মদন। মস্ত উকিল। আমার ভায়রা ভায়ের খুব চেনা।ওকে দিয়েই যোগাযোগ করিয়েছি, অনেক বলে কয়ে। তা, উকিলবাবু কাল সকাল এগারোটায় টাইম দিয়েছে। কলকাতায় ভবানীপুরে বাড়ি, বুঝলি মদন। কাল সকালে ছটা বত্রিশের ট্রেন ধরব। কাগজপত্র যা আছে সঙ্গে নিয়ে আসিস।’

  মদন কৃতজ্ঞতা মাখা চোখে সনতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

মদন ভাবল মাসীর বাড়ি একবার যেতে হবে ।কাগজ বলতে থানা থেকে দেওয়া বর্ধমান কোর্টের স্ট্যাম্প মারা কি একটা পড়চা আছে। আর জেল থেকে দেওয়া কোর্ট অর্ডারের একটা কপি আছে।ওইটা খুঁজে বার করতে হবে।

  

   বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ ভবানীপুরে শিবব্রত সান্যালের প্রায় একশো বছরের পুরনো বাড়ির বিশাল দরজার পাশে  কলিং বেলে দুরুদুরু বুকে চাপ দিল সনৎ বরাট। পাশে দাঁড়িয়ে মদন। একজন টাকমাথা রোগামতো লোক দরজা খুলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

 — ‘ আজ্ঞে আমাদের আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল স্যারের সঙ্গে। ওই মহেন্দ্র .... মানে, মহেন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়েছিল ....’

   টাকমাথা লোকটি একেবারেই কথা বাড়াল না। বলল, ‘ আসুন, ওপরে আসুন । স্যার আসছেন এক্ষুণি ।’ লোকটি তাদের দোতলায় নিয়ে গেল। সনৎ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবল, যাক এক গাঁট পেরনো গেল।

  লোকটি আবার বলল, ‘ এই যে, এইদিকে আসুন।এই বারান্দা দিয়ে সোজা গিয়ে ওই ডানপাশের ঘরটায় বসুন।স্যার আসছেন।’

   সনৎ আর মদন ওই ঘরে গিয়ে ঢুকল।ঘরে বনবন করে পাখা ঘুরছে। মাঝারি সাইজের ঘর। উকিল বাবুর বসার চেয়ার টেবিল রয়েছে। টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার এবং তার পেছন দিকে জনা চারেক লোক বসার মতো একটা সোফা রয়েছে। দরজার পাশেও দুটো ফাইবারের চেয়ার রয়েছে। বিরাট উঁচু সিলিং। দেয়ালে কোন ক্যালেন্ডার নেই। উকিলবাবুর চেয়ারের পেছনে শুধু  বিবেকানন্দের একটা বাঁধানো ছবি টানানো আছে।

   ফুল স্পীডে ঘোরা পাখার হাওয়ায় টেবিলের কাগজপত্র ফরফর করে কাঁপছে। টেবিলের একপাশে ডাঁই করে রাখা প্রচুর ফিতে বাঁধা ফাইল। সনৎ আর মদন পেছনের সোফায় গিয়ে বসল। নীচে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড থেকে অবিশ্রান্ত গাড়ি চলাচলের আওয়াজ আসছে।

  

    তারা দুজন চুপচাপ বসে শিবব্রত সান্যালের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। সনৎ একবার বলল, ‘ আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে।কেমন গুমোট পড়েছে।’ মদন বলল, ‘ হ্যাঁ তা হতে পারে।’ সনৎ আবার বলে, ‘ দুটো তেইশে কাটোয়া লোক্যাল আছে.... যদি কাজ হয়ে যায়.... কোথাও চাট্টি খেয়ে নিয়ে ... ওই গাড়িটা....’

এইসময়ে কে একটা ঘরে এসে ঢুকল।সনৎরা শিবব্রতবাবু এলেন ভেবে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। ও হরি ! এ যে একটা বাচ্চা ছেলে।

   ছেলেটা একটা ফুলপ্যান্ট আর ফুলশার্ট পরা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাদের দেখতে লাগল।এগারো বারো বছর বয়স হবে ছেলেটার। রঙ খুব ফর্সা। সনৎ একটু হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ছেলেটার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ওইভাবে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।ভাবলেশহীন দৃষ্টি। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মদন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।কে জানে কি কারণে ছেলেটার মুখে হাল্কা হাসি ফুটে উঠল। একটা চার বছরের ছেলের মতো হঠাৎ হুড়মুড় করে মদনের দিকে ছুটে এল। যেন অনেক দিনের চেনা লোক। ছুটে এসে মদনের পাশে বসল। বসে বুকের কাছে হাত দিল।বুকে নাক লাগিয়ে কিসের যেন গন্ধ শুঁকল।তারপর মদনের পাশে সোফায় হেলান দিয়ে বসল।

   এইসময়ে শিবব্রত সান্যাল ঘরে ঢুকলেন। ক্লায়েন্টের পাশে বাবিনকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তার চেম্বারে এত ক্লায়েন্টের আনাগোনা। কিন্তু এহেন দৃশ্য তিনি কখনও দেখেননি। যাই হোক, পরম স্নেহভরে তিনি বাবিনকে বললেন, ‘ তুমি ভেতরে যাও বাবা.... এখানে থাকে না... ‘

বাবিনের কিন্তু বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না বাবার কথায়।সে হেলান দিয়ে বসেই রইল মদনের বাহুতে হাত দিয়ে।ডাকসাইটে আইনজীবী শিবব্রতবাবু তার চেয়ারে এসে বসলেন এবং তার হৃদয়ের অতি কোমল জায়গা শুদ্ধসত্ত্ব বা বাবিনের দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

 — ‘ আসুন ...’  শিবব্রতবাবু মদনদের দিকে নজর ঘোরান। সনৎ আর মদন উঠে গিয়ে উকিলবাবুর উল্টোদিকের চেয়ার দুটোয় বসল। বাবিনও উঠে গিয়ে মদনের পাশে দাঁড়াল। শিবব্রতবাবুর বেশ অবাক লাগছে। নিজের মা বাবা ছাড়া আর কারো সঙ্গে বাবিনের এমন প্রতিক্রিয়া কখনও দেখেননি। তিনি মামলাটার কথা ভুলে গিয়ে বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

   ‘ আজ্ঞে , মহেন্দ্র বিশ্বাস আমার ভায়রা হয়।আপনার ভরসাতেই আমরা..... ‘ সনৎ সময় নষ্ট না করে আসল কথাটা পাড়ে ।

— ‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ ... বলুন, বলুন ...’ শিবব্রত সান্যালের সম্বিৎ ফেরে। তিনি নিজের জগতে ফিরে আসেন।

       তিনি সনৎ বরাটের কাছ থেকে নিকুঞ্জর ব্যাপারে খুব মন দিয়ে সব কিছু শুনলেন। মামলার ধরণ অবশ্য তার কাছে খুবই পরিচিত।এরকম পেটি কেসে মুরুব্বির জোর নেই বলে কোর্টে কেস উঠছে না বছরের পর বছর এবং জেলে অকারণে পচে মরছে, এ সব ব্যাপার তার মতো আইন কানুনের মাঠে পোড় খাওয়া খেলোয়াড়ের অজানা থাকার কথা নয়। কাজেই মামলার সারাৎসার তিনি সহজেই বুঝে নিলেন। এই সময়ে তার আবার চোখ গেল বাবিনের দিকে। বাবিন মদনের চেয়ারে একটু জায়গা করে নিয়ে একেবারে তার কাছ ঘেঁসে বসে আছে।যারা ওকে চেনে সবাই বুঝবে যে, বাবিনের বিহেভিয়ারাল প্যাটার্নে এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।মদন স্বাভাবিক বাৎসল্যস্নেহবশত: তার একহাত বাবিনের কাঁধে রাখল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। বাবিনও একগাল হেসে মদনকে ডানহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং সবাইকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার উচ্চারনে ( যা এখন পর্যন্ত বাবিনের মুখে কেউ শোনেনি )বলল, ‘ মদন... বাবা....’। মদন অবাক হয়ে বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবিনের বিচক্ষণ এবং বিদগ্ধ আইনজীবী পিতা প্রবল বিস্ময়ে প্রস্তরীভূত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন।

   এইসময়ে সেই রোগামতো টাকমাথা লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকল। ‘ এ: হে ... এই যে বাবুসোনা ..... তুমি এখানে! আমি এদিকে সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।কিছু হয়ে গেলে বৌদিদিমনি কি ভাববে ! ইশশ্ ....‘  মদনের চেয়ার থেকে  বাবিনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করতে লাগল। বাবিন এদিকে মদনের সঙ্গে এঁটে বসে আছে। টানাটানিতে বিশেষ ফল হল না। লোকটা আবার বলতে লাগল, ‘ ... এ: হে এমন করে না বাবুসোনা ... মা ডাকছেন.... চল ...চল ... বাপিকে কাজ করতে দাও ‘। কে জানে কোন অজ্ঞাত কারণে বাবিনকে একচুলও টলানো গেল না। শিবব্রতবাবুর বিস্ময়ের মাত্রা এতক্ষণে আকাশ ছুঁয়েছে। বাবিনের মধ্যে যে এমন নিজস্ব ইচ্ছা প্রকাশ করার জেদের অস্তিত্ব আছে তা বারো বছরের মধ্যে তিনি এই প্রথম জানলেন।তিনি ধীর স্বরে লোকটিকে বললেন, ‘ ওকে ছেড়ে দাও ভবানী.... তুমি যাও... ‘। টাকমাথা লোকটির নাম বোধহয় ভবানী।

 

   শিবব্রত কাজে ফিরে এলেন।বললেন, ‘ দিন , কাগজগুলো দিন। ‘

 বহু বছর ধরে সযত্নে গুছিয়ে রাখা দুটো কাগজ বার করে শিবব্রত সান্যালের দিকে বাড়িয়ে ধরে সনৎ বলল, ‘ এই দুখানাই আছে। একটা থানার কাগজ, আর একটা কোর্টের.......’

— ‘ ঠিক আছে , যা আছে তাই দিন।অরিজিনালগুলো দেবেন।চিন্তা নেই আমি জেরক্স করিয়ে নিয়ে এগুলো পরে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব ’ , শিবব্রতবাবু বললেন। তিনি আরও বললেন—‘প্রথম কাজ হল কেসটা কলকাতার কোন কোর্টে ট্রান্সফার করা, নাহলে আমি পার্সোনালি অ্যাপিয়ার হতে পারব না।তারপর হিয়ারিং-এর ডেটের জন্য একটা পিটিশান ইনভোক করতে হবে।হিয়ারিং-এর ডেটটা পেয়ে গেলে কেসটা আমার আওতায় আসবে। সেটা করে ফেলতে পারব আশা করি।এখন দেখতে হবে আই পি সি কত নম্বরে ফেলেছে কেসটা।এসব কেস সাধারণত: দুশো পাঁচ বা দুশো ছয়ে ফেলে।ঠিক আছে কোন চিন্তা করবেন না।এটা কোন কগনিজেবল অফেন্স নয়। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। আমি কাজ শুরু করছি । সামনের মঙ্গলবার আমাকে একটা কল দেবেন দুপুর একটা নাগাদ।’

   শিবব্রতবাবু একটানা বলে থেমে গেলেন এবং সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলেন, বাবিন মদনের কাঁধের কাছে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে নীচের দিকে তাকিয়ে।

      সনৎ বলল, ‘ আজ আমরা তালে উঠি স্যার....’ , তারপর মদনের সঙ্গে চোখ চাওয়া চাউয়ি করে বলল, ‘ ..... স্যার আজ আপনাকে .....মানে...কত....’

       শিবব্রত সান্যাল সনতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যে কথাটা আগে কখনও বলেননি,সেই কথাটা বললেন, ‘ কিছু দিতে হবে না। আগে কাজটা করি তারপর ওসব ভাবা যাবে । আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। চিন্তাটা আমাকে ট্রান্সফার করে দিন। মহেন্দ্র আমার অনেকদিনের পরিচিত ....। ‘

     যখন তিনজনেই ভাবছে কি করে মদনকে আঁকড়ে থাকা বাবিনকে আলাদা করা যায় ঠিক সেই সময়ে বাবিন কি জানি কি কারণে মদনের কাঁধের ওপর ঘুমে ঢলে পড়ল।শিবব্রতবাবু দাঁড়িয়ে উঠে উৎকন্ঠা ভরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন— ‘ ভবানী...... ভবানী..... ।’ ছুটে এল রোগাসোগা টাকমাথা ভবানীচরণ।

 

  নীচে নেমে মদন আর সনৎ পেট ভরে ভাত খেল একটা পাইস  হোটেলে।’কাটোয়ায় আমরা এর চেয়ে অনেক ভাল চালের ভাত খাওয়াই খদ্দেরকে।’ সনৎ বলে।

‘ কিন্তু ছেলেটার ব্যাপার কিছু বুঝতে পারলি ? হঠাৎ তোকে কেন....’  মদন বলে , ‘ কি জানি, বুদ্ধিতে কিছু আসছে না...’

 

      মদন পরের দিন পার্বতী মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছল প্রায় সন্ধেবেলা। পার্বতী বাড়ির পেছনের মাঠ থেকে একটা গরুর দড়ি ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে।গরুটা দুধ টুধ কিছু দেয় না। শখে পোষা, স্নেহবশত:। কলকাতার উকিলের বৃত্তান্ত শুনে পার্বতীর  বিশেষ ভাবান্তর হল না। বারো বচ্ছর ধরে এমন অনেক কিস্যা সে শুনে আসছে।কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কুঁড়ের বাঁ পাশে আমগাছগুলোর ওপরে সাঁঝের আঁধার ঘন হয়ে নেমে আসছে। মদনের মুখে সব শুনে টুনে ‘ অ , তা ভাল....’ বলে গোয়ালে গরুটা বেঁধে রেখে ঘরের ভেতরে গেল। ঘরে শুয়ে থাকা লোকটা দুপুরে আবার বিছানা ভিজিয়েছে। দুর্গন্ধে টেক্কা যায় না।সারাদিনে নিশ্বাস ফেলার ফুরসৎ নেই। এখন পোস্কের টোস্কের করতে হবে যেভাবে হোক।নাজেহাল অবস্থা একেবারে।ছেলেমেয়েগুলো দাওয়ায় পড়তে বসবে একটু পরে।

 

      পরের মঙ্গলবার দুপুর ঠিক একটার সময়ে সনৎ শিবব্রত সান্যালের মোবাইলে কল দিল তার হোটেলে বসে। সনতের মনে হল শিবব্রতবাবু যেন তার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ওদিক আওয়াজ এল, ‘ হ্যাঁ, হ্যালো .... কাজ এগিয়েছে .... হিয়ারিং-এর ডেট বার করেছি... অনেক কষ্টে কেসটা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ট্র্যানজিটও করা গেছে।’ উকিলবাবুর গলায় প্রবল উচ্ছ্বাস, যা শুনে , যারা তাকে চেনে তারা বেশ অবাক হবে। এমন দ্রুতগতির প্রচেষ্টা তার পেশাগত জীবনে বিরল বলা যায়।

     সে যাই হোক, সনৎ আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘ ধন্যবাদ স্যার, অনেক ধন্যবাদ.... মানে কি বলব স্যার....আপনি যা করলেন আমাদের জন্য.... কি বলব .... ‘

    ওদিক থেকে শিবব্রতবাবু আবার বললেন, ‘ ..... হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ..... ওসব পরে হবে’খন ....আপনারা কুড়ি তারিখ, মানে এই সোমবারের পরের সোমবার সকাল দশটা নাগাদ ডালহৌসির ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পৌঁছে যাবেন।আমি ওখানে থাকব। চেষ্টা করব যাতে সিঙ্গল হিয়ারিং-এ ভারডিক্ট হয়ে যায়।আর হ্যাঁ, মদনবাবু যেন অবশ্যই থাকে। ওর সঙ্গে অনেক দরকার আছে।’

 

   ধুরন্ধর আইনজীবী শিবব্রত সান্যালের কেরামতিতে সত্যিই  বারো বছর ধরে আটকে থাকা  নিকুঞ্জ দাসের জামিনের রায় মাত্র দু ঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে গেল। এখন কোর্টের বর্ধমান সংশোধনাগারে পৌঁছন পর্যন্ত অপেক্ষা । তারপর নিকুঞ্জ তার গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। শিবব্রতবাবু বললেন, এর পরের কাজ হল কেসটা ডিসমিস করানো। সেটাও নাকি খুব শীঘ্র হবে।

  কোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির পার্কিং স্লটের দিকে হাত দেখিয়ে শিবব্রতবাবু বললেন, ‘ আসুন...’

— ‘ আজ্ঞে কোথায় ? ‘ সনৎ বলে।

—- ‘ এ..ই আমার বাড়িতে একটু যেতে হবে। একটু দরকার ছিল...আমার ড্রাইভার আপনাদের ঠিক সময়ে হাওড়া স্টেশনে ফেরবার গাড়ি ধরিয়ে দেবে। .... না না ওসব ব্যাপার নয়। কিছু দিতে হবে না । সামান্য ব্যাপার.... আসুন আসুন....’

মদন আর সনৎ অবাক হয়ে মুখ চাওয়া চাউয়ি করে।

 

    গাড়িতে শিবব্রতবাবু সনৎ আর মদনের সঙ্গে পিছনের সিটে বসলেন। মদন মাঝখানে , বাকি দুজন দুপাশে।গাড়ি রেড রোড দিয়ে মেয়ে রোডে গিয়ে পড়ল। এরপর পার্ক স্ট্রীট ফ্লাই ওভার ধরবে।শিবব্রতবাবুকে একেবারেই তার পরিচিত ধরণে দেখা যাচ্ছে না। তিনি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন।এবার বললেন, ‘ সেদিন আপনারা যাওয়ার পর থেকে আমার বড় ছেলে বাবিনের একটা আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হয়েছে। সব কথা মোটামুটি পরিষ্কার বলতে পারছে , যেটা সে এতদিন পারত না।এতদিন আমরা অনেক ট্রি টমেন্ট   করেছি, কিন্তু সেরকম ইমপ্রুভমেন্ট কিছু হয়নি।সেদিন মদনবাবুর টাচে এসে কি ব্যাপার ঘটল কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রায়ই বলছে মদন আমার ছেলে.... কত বড় হয়ে গেছে । সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল সে আপনাদের গ্রামের নামও বলছে। বলছে খেজুরতলায়  যাব। আজই যাব। মদন তোমার গ্রামের নাম কি খেজুরতলা  ?’

মদন বলল, ‘ আজ্ঞে হ্যাঁ ‘

 

    শিবব্রতবাবু বাড়িতে পৌঁছে ওদের দুজনকে নিয়ে ওপরে গেলেন এবং অফিস রুমে বসালেন।নিজেও বসলেন। তিনি মদনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ আচ্ছা মদন , তোমার বাড়িতে কে কে আছেন ? নিকুঞ্জ দাস তো তোমার মেশোমশাই হন ?’

— ‘বাড়িতে শুধু আমার মা আছে,আর কেউ নেই। হ্যাঁ উনি আমার মেসো।’ মদন উত্তর দেয়।

— ‘ আর তোমার বাবা ?’

— ‘ বাবা মারা গেছে অনেকদিন আগে।আমার তখন বারো তেরো বছর বয়স।’ মদন জানায়।

— ‘ তা মোটামুটি কতদিন আগে হবে ?’

— ‘ তা ধরুন বারো বছর হবে ।’

— ‘ বারো বছর ! একদম ঠি ক তো ? শিবব্রতবাবুর কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে। রুমাল বার করে তিনি মুখের ঘাম মোছেন ।’ তারপর আবার বলেন ‘ আচ্ছা তারকনাথ কার নাম ? ‘

— ‘ আজ্ঞে আমার বাবার নাম।’ মদন জবাব দিতে না দিতে কোথা থেকে হঠাৎ হুড়মুড় করে বাবিন এসে ঢুকল।পেছনে ছুটতে ছুটতে আসলেন তার মা স্বাতীলেখা।বাবিন সকলকে বিস্ময়ে বোবা বানিয়ে বলতে লাগল — ‘ আমি তারক ... তারক .... মদন কোথায় গেলি .... বাবা মদন .... ‘ , বলতে বলতে মদনের দিকে ছুটে এল আগের দিনের মতো। শিবব্রতবাবুর মুখের পেশীগুলো কুঁচকে গেল। ডান হাতের তেলোয় মুখ রেখে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজের চেয়ারে বসে রইলেন।মদন ও সনৎ বিষ্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল।স্বাতীলেখা ছুটে বাবিনের কাছে গেলেন মদনের চেয়ারের পাশে । বাবিনকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

 

    নিকুঞ্জর জামিনের অর্ডার হয়ে গেছে। জেল প্রশাসনের হাতে কাগজ পৌঁছল পরদিন সকালে।শিবব্রতবাবু নিজে জেলের অফিসে গিয়ে তদারকি করে নিকুঞ্জকে রিলিজ করালেন বেলা বারোটা নাগাদ। সে যে কোনদিন মুক্তি পেতে পারে নিকুঞ্জ সে  বিশ্বাস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। যে সব অবিশ্বাস্য ঘটনা কদিন ধরে ঘটছে, তার ওপর তার জন্য তদ্বির করতে স্বয়ং উকিলবাবুর জেলের ভেতর আবির্ভাব, তার মনে হতে লাগল সে স্বপ্ন দেখছে কিনা।নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে।চিমটিতে লাগল বেশ।

       জেল থেকে বেরিয়ে সে সনৎ বরাট আর মদনের সঙ্গে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল।সঙ্গে তাদের আইনজীবী শিবব্রত সান্যাল।তার গাড়ির ড্রাইভারকে হাত নেড়ে গাড়িটা চায়ের দোকানের উল্টোদিকে রাখতে বললেন। তিনিও ওদের সঙ্গে কাঁচের গ্লাসে চা খেতে লাগলেন।মদনরা বেশ সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শিবব্রতবাবু নির্বিকারভাবে চায়ে চুমুক দিলেন।দুটো চুমুক মেরে তিনি বললেন, ‘আমাদের উত্তরাখন্ড ট্যুর প্রোগ্রাম ক্যানসেল করেছি । নিকুঞ্জ তো তার বাড়ি পাটলিপাড়া গ্রামে ফিরে যাবে। সপ্তাহে একদিন করে লোক্যাল ফাঁড়িতে মুখ দেখিয়ে আসবে যতদিন না কেসটা খারিজ হয়।ফাঁড়িতে কাগজ চলে যাবে শিগ্গীর। আর আমি যাব মদনের গ্রাম খেজুরতলায়..... উইথ হোল ফ্যামিলি। আমি পুরো রহস্যটাই জানতে চাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না । মদনরা তিনজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল দুঁদে উকিল শিবব্রত সান্যালের মুখের দিকে। ইতিমধ্যে গাড়ির ড্রাইভার এসে এক গ্লাস চা নিয়ে বসেছে।

 

    তিনদিন পরে মদন, সনৎ আর নিকুঞ্জর সঙ্গে শিবব্রতবাবুর পরিবার খেজুরতলা গাঁয়ে মদনদের বাড়ি গেলেন।মদনের মা শেফালি কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। শিবব্রতবাবু তাকে বললেন , ‘ব্যস্ত হবেন না, ব্যস্ত হবেন না। আমরা একটা কাজে এসেছি।’

     বেলা দশটা বেজেছে। চড়চড় করে রোদ উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলে মদনদের কুঁড়ে থেকে একটু দূরে গাছপালা ঘেরা একটা মেঠো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবিন তার মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে পড়ল  বাবিন অস্থিরভাবে চারদিকে দেখছে।তারমধ্যে অটিজমের সব লক্ষ্মণ যেন ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে গেছে। কোন এক গন্ধে যেন সে ছটফটিয়ে উঠছে। আচমকা তার মার হাত ছাড়িয়ে সে মদনদের কুঁড়ের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। তার পিছন পিছন ওরাও ছুটতে লাগল। সবাই শুনতে পেল বাবিন শেফালি শেফালি বলে ডাকতে ডাকতে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে বাবিন এক জায়গায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।পড়ে গিয়ে বাঁ পাটা চেপে ধরে একটা ঘসঘসে গলায় চেঁচাতে লাগল ‘ ওরে বাবারে.... মরে গেলাম.... মরে গেলাম .... জ্বলে যাচ্ছে রে..... ও: ...মদন কোথায় গেলি রে..... ও মদন শিগ্গীর আয়.... শিগ্গীর আয়.....

       ততক্ষণে মদনরা সকলে সেখানে এসে পৌঁছে গেছে। অটিস্টিক পেশেন্ট তার বড় ছেলে শুদ্ধসত্ত্বকে এমন ছুটতে দেখে তার বাবা মা বাকরুদ্ধ  হয়ে গেছেন।

মদনকে দেখে বাবিন বলল, ‘ মদন .... মদন ... ধর আমাকে ... শিগ্গীর বাঁধ এইখানটা... জ্বলে যাচ্ছে... জ্বলে যাচ্ছে ...

    মদন ওখানে উবু হয়ে বসল।বাবিন মদনকে জড়িয়ে ধরল। মদন তাকে কোলে শুইয়ে নিয়ে মাটির ওপর বসল।

    নিকুঞ্জ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, ‘ ঠিক এই জায়গাটায় মদনের বাবাকে সাপে কেটেছিল বারো বচ্ছর আগে।


Anjan Bandopadhyay



 

                         


                              


দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এবং সেই ফুচকাওয়ালা - অঙ্কুর চক্রবর্তী


  ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এবং সেই ফুচকাওয়ালা

অঙ্কুর চক্রবর্তী


        ২০০১ সালের গ্রীষ্মকালটা আমার কেটেছিল হাওড়ার একটা মেস বাড়ির তিনতলার ঘুপচি ঘরে। দশ বাই দশ ফুটের এই এক চিলতে ঘরটায় আমার তক্তপোষ এবং ইজেল ও রং তুলি রাখার পর আর বিশেষ জায়গা ছিল না। কিন্তু আমার ঘরটা অপছন্দ ছিল না তার কারণ ঘরের একমাত্র জানলাটা খুলে দিলে গঙ্গা এবং তার তটের দৃশ্য চোখে পড়ত। চোখে পড়ত নদীর ওপারের চটের কলগুলোর সারি সারি চিমনি আর অসংখ্য ছোট ছোট আলো যাদের প্রতিটির নিশ্চয়ই নিজস্ব কোনো গল্প ছিল। একজন শিল্পীর জন্য আদর্শ দৃশ্য সন্দেহ নেই। গঙ্গার ধারে ঘিঞ্জি বস্তি সংলগ্ন এলাকায় মেস বাড়িটার অবস্থানের জন্য এই ঘরটার ভাড়াও ছিল কম। যদিও এখন বলতে বাধা নেই যে, মাঝে মাঝেই সেই ভাড়া গুনতেও আমাকে নাজেহাল হতে হতো এবং মেসের ম্যানেজার হৃষিকেশ বাবু অত্যন্ত সজ্জন ভদ্রলোক হওয়ার কারণেই আমাকে নিতান্ত উৎখাত হতে হয়নি।

        আমার এই অর্থকষ্টের মূল কারণ হলো আমার ছবির বিক্রি নেই। আজকাল ছবি এঁকে পেট চালানো যায় না বললেই চলে। তবুও পোট্রেট হলে কথা ছিল, খেয়ালি বড়োলোকের কিছু ছবির বরাত জুটে যেত ঠিকই। কিন্তু আমার পছন্দ ল্যান্ডস্কেপ। মডার্ন আর্টের এই যুগে ল্যান্ডস্কেপ ছবির প্রদর্শনী হয় কম, বিক্রি আরো কম। তবুও সুযোগ একটা এসেছে দিন কয়েক হলো। মিত্র গ্যালারির উদ্যোগে টলিগঞ্জে একটা প্রদর্শনী হচ্ছে শুধুমাত্র ল্যান্ডস্কেপ ছবির ওপর। ছবির বিষয় - কলকাতার রাত। আমি ঠিক করেছি গঙ্গার ওপরে নেমে আসা রাত হবে আমার ছবির বিষয়বস্তু। আমি আমার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে চাই রাতের আবছা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা এক অব্যক্ত হতাশার কথা। ছবিটার একটা যুতসই নামও ঠিক করে ফেলেছি ইতিমধ্যে - দ্য স্ট্রাগলিং নাইট বাই দি গ্যাঞ্জেস। স্টুডিও পাড়ার কাছেই যেহেতু গ্যালারি, কপাল জোরে কোনো ফিল্মস্টার হয়ত পছন্দ করে ফেলল ছবিটা, কিংবা কোনো প্রোডিউসার কলমের এক আঁচড়ে আমার জন্য লিখে দিলেন মোটা অঙ্কের চেক আর তাতে সমাধান হয়ে গেল আমার জীবনের না মেলা সব অঙ্কগুলো? এমন হতে পারে না কি কখনো? দিবাস্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে, আমারও লাগে।

        অনেক রাত অবধি কাজ করা আমার অভ্যেস। সকালবেলায় মুটে মজুরদের হাঁক ডাকে এপাড়ায় কাজের সুবিধে হয় না। তাছাড়া দিনের বেলা হৃষিকেশবাবু মাঝে মাঝে এসে উপস্থিত হন ভাড়ার তাগাদা দিতে। তাই দিনের বেলাটা আমি ঘরে থাকা এড়িয়ে চলি। হয় ইতস্ততঃ ঘুড়ে বেরাই না হয় গ্যালারির কিউরেটরদের সাথে আলাপ জমাই কাজের খোঁজে কিংবা নিতান্ত অনন্যোপায় হলে নেশন্যাল লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দেই ছবির ব্যাপারে পড়াশুনো করে। পাশ্চাত্য শিল্পে রাতের ছবি বিষয়টা নতুন কিছু নয়। রেনেসাঁর সময় থেকেই বারবার রাত ফুটে উঠেছে শিল্পীদের রং তুলিতে। কখনও সেই চিত্রের বিষয়বস্তু ধর্মীয়, কখনও যুদ্ধ কিংবা মহাকাব্যের কোনো ঘটনা। এই ছবিগুলোর মধ্যে নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে বিখ্যাত ভ্যান গগের আঁকা " স্টারি নাইট"। রাতের শেষে ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার ঠিক আগের সেই অপার্থিব ছবিটি মানুষের আশা নিরাশায় দোলা জীবনের কথা বলে। এ পিকচার স্পিকস এ থাউজ্যান্ড ওয়ার্ডস- শতাব্দী পেরিয়েও এই ছবিটি তাবৎ বিশ্বের মানুষের সাথে ফিসফিসিয়ে কত কথা বলতে চায়।

        জানলা খুলে রোজ রাতে আমি বাইরের দৃশ্য স্টাডি করি। দীর্ঘক্ষণ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে যাই ক্যানভাসে। কিছুদিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ছে আমার। রাত একটু গভীর হলেই একটা ফুচকাওলা এসে বসে গঙ্গার ধারের একটা ল্যাম্প পোস্টের নীচে। কাঁচের বয়াম ভর্তি করা ফুচকা। এত রাতে কে ফুচকা খেতে আসবে কে জানে, তবু লোকটা আসে রোজ। ভোর হয়ে আসার ঠিক আগে, লোকটা গিয়ে বসে গঙ্গার ঘাটে। সারা রাতে একটাও ফুচকা বিক্রি হয় না তার। দিনের বেলা কিন্তু আর দেখা যায় না তাকে।

                                            - ২-


        আজকাল অয়েল পেইন্টিং আঁকার খরচ কিছু কম নয়। বেশ কিছু রঙের টিউব কেনার দরকার ছিল। কলেজ স্ট্রিটের চেনা দোকানে ধার হয়ে গেছে অনেক, সহজে দিতে চাইছিল না এবার; শেষ পর্যন্ত দিয়ে বলেছে যে এই শেষবার। আমি খুব বুঝতে পারছি, এভাবে আর বেশিদিন চলবে না।
কলেজ স্ট্রিট থেকে হাওড়া ফিরব বাসে, দুপুরের বাসে বিশেষ লোক থাকে না। কন্ডাক্টর টিকেট কাটতে এলে ওর হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, টিকিটের দরকার নেই। সে কথা না বাড়িয়ে অন্য যাত্রীদের টিকিট করতে লাগলো, আমার নগদ তিনটে টাকা বেঁচে গেলো।

        বিকেলের দিকে গঙ্গার ঘাটে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে লাগলাম নিছক সময় কাটানোর জন্য। এসময় হৃষিকেশ বাবু মেসে থাকেন, ওনার সামনে পড়লে আবার ভাড়ার কথা তুলবেন। এই ছবিটি এক্সিবিশন এ জমা নিলে মিত্র গ্যালারির থেকে সাম্মানিক হিসেবে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে, সেটা না পেলে আমার একেবারেই চলবে না। সন্ধ্যে নামার অনেকক্ষণ পর অবধিও গঙ্গার ঘাটে ঘুরে সেই রাতের ফুচকাওয়ালার কোনো সন্ধান আমি পেলাম না। আচ্ছা বোকা লোক তো, গঙ্গার ঘাট এই সময় লোকে গমগম করছে, কপোত কপোতী আইসক্রিম আর চিনেবাদাম শেষ করে ফেলছে মুহূর্তে। এমনকি দুটো ফুচকাওয়ালাও দেখতে পেলাম, তাদের বিক্রি বাট্টাও নেহাত মন্দ নয়। এই সময় না এসে সেই লোকটা আসবে গভীর রাতে। কি ব্যাপার কে জানে, লোকটা কি ব্যবসার কাজ কিছুই জানে না?

          রাত নটার দিকে চোরের মত চুপিচুপি মেসে ঢুকলাম। সবার নজর এড়িয়ে তেতলায় নিজের ঘরে ঢুকে নতুন কেনা রঙগুলো রাখলাম বিছানার ওপর। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে মগ্ন হয়ে গেলাম আমার ছবিটার মধ্যে। রাত তখন একটা প্রায়, খুব গুমোট লাগছে বলে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। গঙ্গার স্নিগ্ধ হাওয়া শরীরটাকে জুড়িয়ে দিল, নদীর ওপর নিশুতি রাত নামছে। চাঁদ উঠেছে মধ্য গগনে, মাঝ গঙ্গায় একখানি ছোট নৌকা ভেসে রয়েছে। নদীর পাড়ের কোনো কোনো চটের কলের আলো দেখা যাচ্ছে, কোনটার আলো জ্বলছে না, হয়ত লক আউট চলছে। সেসব কারখানার শ্রমিক, নৌকার মাঝির অশ্রু আর ঘামে ভারী হয়ে আছে কলকাতার গ্রীষ্মের রাতের বাতাস। ঠিক এই ছবিটাই তো আঁকতে চাইছি আমি আমার ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এর ক্যানভাসে। জানলার বাইরে দৃশ্যে খাপ খাচ্ছে না শুধু মাত্র একটি ব্যাপার। রাতের সেই ফুচকাওয়ালা আবার হাজির আজ তার কাঁচের বয়াম ভর্তি ফুচকা নিয়ে। আজও তার একটিও খদ্দের নেই। একবার ওর কাছে যাব নাকি? একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছি আমি, আর সেটা ঠিক মাঝরাতে ফুচকা খাওয়ার লোভ নয়। নিজেকে বোঝালাম সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমি একরকম জোর করেই আবার মন বসালাম আমার কাজে, আজই শেষ করে আনতে পারব বলে মনে হচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ টা।

                                            -৩-

        মিত্র গ্যালারিতে ঢুকলেই দেখা যাবে, শ্রী অম্বরেন্দু মিত্র মহাশয়ের একটা অয়েল পোট্রেট। সেকালে ডাকসাইটে বিত্তশালী লোক ছিলেন অম্বরেন্দু মিত্র, সাবানের ব্যবসা করে পয়সা করেছিলেন বিস্তর। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তারই সংগৃহীত দেশি বিদেশি ছবি নিয়ে আজকের এই ' মিত্র গ্যালারি ' । এই গ্যালারির কিউরেটর এখন পার্থসারথি সাহা। আমি তার সামনেই বসে ছিলাম ছবিটি দেখানোর জন্য। একটা ঢাউস অ্যালবামের পাতা উল্টে কিছু একটা দেখে চলেছেন বিশালবপু পার্থসারথি বাবু। এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া সত্বেও জুন মাসের এই দুপুরে ঘেমে উঠছে তার কপাল; আমার উপস্থিতি যেন গ্রাহ্যই করছেন না ভদ্রলোক। শেষে না থাকতে পেরে বললাম
- স্যার..
- হুম্ করে একটা ছোটো শব্দ করলেন পার্থসারথি বাবু। তার মনোযোগ এখনও অ্যালবামে।
আমি একটা ছোট্ট কাশির শব্দ করলাম।
- হ্যাঁ? এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পান ভদ্রলোক। ও তোমার ছবিটা না? এই চা খাওনি? ছি ছি!
ফোন তুলে বেয়ারাকে দুটো চা এর অর্ডার দেন পার্থসারথি সাহা।
-কই দেখাও দেখি ছবিটা..
আমি ফোল্ডার থেকে বার করে যত্ন করে মেলে ধরি তার সামনে। খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন ভদ্রলোক ল্যান্ডস্কেপ টা। বেয়ারা এসে চা দিয়ে যায়, আমি উদগ্রীব হয়ে আছি পার্থসারথি বাবুর প্রতিক্রিয়ার জন্য।
কিছুক্ষণ বাদে চোখ থেকে চশমা নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক
- দেখো, তোমার ছবিটা ভালো। কিন্তু কিছু একটা মিসিং।
- কি মিসিং স্যার?
- একটা হিউম্যান টাচ্! মানুষের কথা কোথায় বলছে ছবিটা?
- স্যার মানে রাতের কথা, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা গুলো দেখুন, তাদের শ্রমিকের কথা, নৌকার মাঝিদের কথা। এমনকি গঙ্গার নিজের কথা, সারা ভারতের সমস্ত আবর্জনা বয়ে নিয়ে চলার কথা, এগুলোই তো বলছে ছবিটা।
- না হে না! বড্ড ভেগ , বড্ড অস্পষ্ট সেসব। এরম অবস্থায় ছবিটাকে এক্সিবিশন এ নিতে পারব না। আরো চেষ্টা করো।

আর কি চেষ্টা করবো, আগামীকাল ছবি জমা করার শেষ দিন, আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম। পার্থসারথি বাবুর গলা শুনতে পেলাম আবছা
- আরে, চললে নাকি? চা টা খেয়ে গেলে না। যাক গে মাথায় রেখো হিউম্যান টাচ্ চাই..

আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, একটা যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেবো সে শক্তিটুকু যেন নেই। এবারেও হলো না? পকেটে পয়সা একেবারে শেষ, একটা সিগারেট কেনাও বিলাসিতা। তবুও গতকালের টিকিট বাঁচানোর টাকা দিয়ে একটা চা আর একটা ফ্লেক নিলাম। পায়ে পায়ে কখন মেট্রোরেলের স্টেশনে এসে বসেছি আমার নিজেরও খেয়াল নেই। একটার পর একটা পর একটা মেট্রো চলে যাচ্ছে, ওঠানামা করছে কর্মব্যস্ত মানুষের দল। ঠিকমতো কলেজ শেষ করে কি একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া যেত না ওদের মতই? এখন চোখের সামনে শুধু নিরেট অন্ধকার।
একবার উঠে মেট্রোরেলের লাইনটা দেখে এলাম, ট্রেন আসার আগে কেমন একটা সর সর করে আওয়াজ হতে থাকে। ইচ্ছে করছে কান পেতে শুনতে সেই আওয়াজ। ওই লোহার পাতগুলোর ও কি মাঝে মাঝে পেতে ইচ্ছে করে না মানুষের ছোঁয়া, মানে পার্থসারথি বাবুর ভাষায় যাকে বলে হিউম্যান টাচ্? আবার ঝিক ঝিক শব্দ শুরু হয়েছে; টানেলের ভেতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে মেট্রোরেলের, আর আমার জীবনের এই সুরঙ্গের শেষে আলো কোথায়? মেট্রোটা আরো কাছে চলে এসেছে এখন , খুব টানছে আমাকে ইস্পাতের লাইনটা।
নাহ! কি সব ছাইপাশ ভাবছি, নিজেকে জোর করে সরিয়ে আনলাম সেখান থেকে।

                                            -৪-

        সন্ধ্যের বাসে অফিসের ভিড়। কোনোমতে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছি মাত্র। কন্ডাক্টর আসাতে আমি হাতে একটা টাকা দিলাম রোজের মতোই।
- দাদা, ভাড়া পাঁচ টাকা।
আমি চোখের ইশারায় বললাম টাকাটা রেখে দিতে নিজের কাছে। কিন্তু ভিড় বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, আজ সে নাছোড়বান্দা
- বাসে উঠলে পুরো ভাড়াই দিতে হবে দাদা। না থাকলে নেমে যান। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাটা বলল কন্ডাক্টর। আমার পকেটে সত্যি আর একটা পয়সাও নেই, তাই মাথা নিচু করে অপমানটা হজম করলাম আমি। পরের স্টপেজ আসতে নেমে পড়লাম বাস থেকে।

        বাকি পথটা হেঁটে যখন মেসের ঘরে পৌঁছলাম তখন রাত দশটা হবে। শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। গামছা হাতে বাথরুমে ঢুকলাম মুখে চোখে জল দেওয়ার জন্য। সারাদিন না খাওয়ার জন্যই হোক কিংবা এই জৈষ্ঠের গরম মাথায় করে এতটা হাঁটার জন্যই হোক টালমাটাল লাগছে খুব। বাথরুমে ঢুকে সিলিং এর দিকে তাকালাম, শক্ত পোক্ত একটা হুক থেকে জ্বলছে বাল্বটা, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মাথার মধ্যে একটা চিন্তা পোকা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠলো - ঠিক ঠিক। গত ছয় মাসে আমার একটাও ছবি বিক্রি হয়নি, তিনমাসের মেস ভাড়া বাকি হৃষিকেশ বাবুর কাছে, আজকের বাসের সমস্ত যাত্রীদের দৃষ্টি আমাকে নিরীক্ষণ করে চলেছে বন্ধ বাথরুমের ভেতরেও। এরপর আমার মাথাটা যেন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল।

        তারপর কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। হয়ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সম্বিৎ যখন ফিরল, তখন আমি খোলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি, ফুরফুর করে গঙ্গার হাওয়া আসছে, ক্যানভাসে টাঙানো আমার ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' । এখনও আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব আমার চারিদিকে, নিজেকে আশ্চর্যরকম হালকা অনুভব করছি। ল্যাম্পপোস্টের নীচে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই ফুচকাওয়ালা। কিন্তু আজ একটা পরিবর্তন হয়েছে, তার কাছে ফুচকা খাচ্ছে এক জোড়া তরুণ তরুণী। সারাদিন কিছুই খাইনি, খিদে বোধ হচ্ছে না যদিও তবু একটু ফুচকা খেলে মন্দ হয় না। সারাদিনের অনাহারের জন্যই আমার পায়ে কোনো সাড় নেই বোধহয়, যেন সেগুলো শূন্যে ভাসছে। তবুও কিভাবে যেন হাঁটতে হাঁটতে কিংবা হয়ত ভাসতে ভাসতেই একরকম পৌঁছে গেলাম ফুচকাওয়ালার কাছে।

        আমাকে দেখে একগাল হেসে শালপাতা ধরিয়ে দিল সে। মাথায় ছোট করে ছাটা কাঁচা পাকা চুল, চোখগুলো কেমন গর্তে বসা, মুখে একটা ক্ষ্যাপাটে ভাব। শীর্ণ আঙ্গুলগুলো দিয়ে আলু মটর মাখতে শুরু করেছে সে। মাখতে মাখতেই সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় নিজের মনেই বলে চলেছে,
- ছোটেলালের ফুচকা, প্রতিটা পিস মাস্টারপিস। একবার খেলে বার বার খাবেন।
প্রথম ফুচকাটা মুখে তুলেই বুঝলাম, লোকটা ভুল কিছু বলেনি, দিব্যি স্বাদ ফুচকার।
- তা ছোটেলাল। তুমি সন্ধ্যেবেলা না বসে এই রাতদুপুরে বসো কেন?
ফিক করে হেসে লোকটা বলে ওঠে
- আমার খদ্দেরদের যে এটাই সময়।
- মানে?
- মানে আপনি যা ভাবছেন তাই! ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর এলো।
- কি বলতে চাও হে, ভূতেদের খদ্দের করেছ নাকি তুমি? হালকা মেজাজে কথাটা বললাম আমি।
- বলতে চাই না বলছি। একটু আগেই যে একজোড়া এসছিল, বাড়িতে মেনে নেয়নি বলে ওরা তো এই ঘাটেই ঝাঁপ দিয়েছিল হেঁ হেঁ। আর আমিও তো, বেঁচে থাকতে ফুচকা বিক্রিই হত না। অন্যরা নিজেদের ফুচকা বিক্রি শেষ করে চলে যেত, আমি বসে থাকতাম ঘাটে। চার বছর আগে একদিন দিলাম সব শেষ করে!
- কি আবোল তাবোল বকছ তুমি বলত? আমার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে এবার।
- " আবোল তাবোল নয় বাবু" । কান এঁটো করা হাসি হেসে বলে চলে ছোটেলাল। " আমার পেছনে বোস বাবু আসছেন। ইন্সুরেন্স এজেন্ট। লাইফ ইন্সুরেন্স বিক্রি না করতে পেরে একদিন নিজের লাইফটা শেষ করে দিলেন। ওনার নিজের কোনো ইন্সুরেন্স ছিল না হেঁ হেঁ।"
বলতে বলতে ছোটেলাল নিজের মুন্ডুটা পুতুলের মত ঘাড়ের ওপর একশো আশি ডিগ্রী ঘুড়িয়ে দেয়। এই পৈশাচিক আতঙ্কের মধ্যেও আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লক্ষ্য করলাম, একজন গোবেচারা গোছের লোক কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এগিয়ে আসছে। ল্যাম্প পোস্টের আলো লোকটার ভারী চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে। আশ্চর্য এই ছোটেলালের ঘোরানো মাথা তাকে একটুও অবাক করল না।

        আমি আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে, নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমার মেসের দরজায়। আমি বুঝতে পারছি, এত ভয়ের মধ্যেও একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে আমার মনের মধ্যে।

        দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই ইজেলে টাঙানো ছবিটায় চোখ পড়ল। মন্ত্রমুগ্ধের মত রং তুলি তুলে নিলাম হাতে, ফুটিয়ে তুললাম আমার দেখা ফুচকাওয়ালার সেই ভর্তি বয়ামটা আর টিমটিম করে জ্বলতে থাকা পিদিম। সারাদিনের বিক্রি না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে সাদা ধুতি আর বাংলা শার্ট পড়া ফুচকাওয়ালা বসে আছে গঙ্গার ধারে। এবার আমার ছবিতে এসেছে কি পার্থসারথি বাবুর চাওয়া সেই " হিউম্যান টাচ"?
ছবিটা রোল করে ফোল্ডারে ঢুকিয়ে, মিত্র গ্যালারির ঠিকানা সেটে দিলাম তাতে, এবার কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে যাবে সেটা। তারপর তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে, সেটার জায়গা হবে হয়ত মিত্র গ্যালারির মাস্টারপিস সেকশানে কিংবা হয়ত আস্তাকুড়ে।

        ক্লান্ত মস্তিষ্কে রং মাখা হাত বাথরুমে ধুতে ঢুকতেই যে দৃশ্যটা চোখে পড়লো তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাথরুমের ছাদের আংটার সঙ্গে বাঁধা গামছা থেকে ঝুলে আছে একটা দেহ। তার গালের দু সপ্তাহের না কাটা দাঁড়ি, হাতা গোটানো ঘামের দাগ বসা সবুজ শার্ট - এগুলো আমার খুব চেনা কারণ সেগুলো আমি বহুবার দেখেছি। হ্যাঁ, মৃতদেহের হাঁ করা চোখ ঠিকরে যাওয়া যে মুখটা এখন বিভৎস হয়ে গেছে সেটাও আমি অজস্র বার দেখেছি - আয়নায়। আমি এটাও বুঝলাম আমার মনের মধ্যে লেগে থাকা প্রশ্নটার উত্তর আমি পেয়ে গেছি এবার। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেন চার বছর আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া লোকটার হাতের ফুচকা আমি খেতে পারলাম আজ। কারণ আজ থেকে আমিও যে সেই ব্যর্থ মানুষগুলোর দলে যারা জীবনের ক্যানভাস থেকে নিজেদের মুছে ফেলেছে চিরকালের মতো। আর সেই না-মানুষ আমিই আমার শেষ আঁকা ছবিতে এনে দিয়েছি হিউম্যান টাচ - মনুষ্যত্বের স্পর্শ।

        আমার অন্তিম ল্যান্ডস্কেপ এর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, জানলার গরাদ গলে বাইরে বেরিয়ে এলাম, কোনো অসুবিধে হলো না। গঙ্গাবক্ষের অপার্থিব জোৎস্নার সেই জগৎ আমার ইজেলের নীল কালো আর সাদা রঙের মতোই অবসাদ আচ্ছন্ন অথচ সুন্দর। এই পৃথিবীতে ভাড়ার তাগাদা নেই, আমার ছবি বিক্রির চিন্তা নেই, ছোটেলালের ফুচকা বিক্রির দায় নেই, বোস বাবুর ইন্সুরেন্স নেওয়ার ক্লায়েন্ট নেই। আছে শুধু কালচে নীল রঙের অনন্ত অন্ধকার। রাতের অন্ধকারের সেই নেশাতুর রঙের সাথেই আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে আমার আঠাশ বছরের জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা আর সমস্ত স্ট্রাগল। সব শিল্পীর সেরা শিল্পীর আঁকা শেষ রাতের সেই ক্যানভাসে আমি নিজেকে বিলীন করে দিলাম।

(সমাপ্ত)

 Ankur Chakraborty