সংগ্রামী লাহিড়ী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সংগ্রামী লাহিড়ী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

হেমন্তের বৃষ্টি - সংগ্রামী লাহিড়ী

 

হেমন্তের বৃষ্টি
সংগ্রামী লাহিড়ী
 

 


ছোট্ট ভক্সওয়াগন গাড়িটা ছুটছে ঘণ্টায় সত্তর মাইল গতিতে, পঁচানব্বই নম্বর হাইওয়ে ধরে, নিউ জার্সির দিকে। রবিবারের বিকেল, রাস্তা ফাঁকা। গ্রীষ্মের দিনে অনেকক্ষণ আলো থাকে। সন্ধে হতে ন'টা বাজবে। ড্রাইভারের সিটে আমি, অর্থাৎ এই নিরীহ সাংবাদিক সোমনাথ। পাশে সুমিতা। নিউ জার্সির নামকরা কবি। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। আজ ছিল ফিলাডেলফিয়ায় সাহিত্যসভা।
সুমিতা আর আমি একসঙ্গে যাদবপুরের ইংরেজি অনার্স। আমার মত গুটিকয়েক ছেলে ছিল ইংরেজি ক্লাসের মাইনরিটি। ঝকঝকে, ফ্যাশনেবল মেয়েরা ওড়না উড়িয়ে, জিন্স-টিশার্টে হিল্লোল তুলে ঘুরে বেড়াত। আমরা ভেবলুর মত দেখতাম। সাহিত্য ভালোবেসে পড়তে আসার হ্যাপা কি কম? বাড়ি থেকে বলেই দিয়েছিল, "পড়াশুনোর শেষে চাকরি যদি জোটাতে না পারো, তাহলে বাড়ির হোটেলের দরজা বন্ধ।"
সেই ভয়ে ভীত আমরা কয়েকজন দিনরাত এক করে পড়াশোনা করি। নেট, স্লেটএর চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যায়।  
অন্যদিকে সুমিতার মত সহপাঠিনীরা দেদার আড্ডা মারে, লেটেস্ট ফ্যাশন ট্রেন্ডের খবরাখবর রাখে, কফিহাউসে গিয়ে খায় ও খাওয়ায়। সেইসঙ্গে দুর্ধর্ষ রেজাল্টও করে। পড়ে কখন, সে এক রহস্য!
একদিন জিজ্ঞেস করতে ঝাড়া দু'মিনিট আমার দিকে চোখ সরু করে চেয়েছিল।
আমি তো ঘাবড়ে টাবড়ে একাকার! কী জানি বাবা, কী ভুল বলে ফেলেছি, খোদায় জানে!
আশ্বস্ত করে আমায় পিঠ চাপড়ে দিল, "ওই কফিহাউসেই তো আদ্ধেক পড়াশোনা হয়ে যায় রে, আসিস একদিন, বসিস আমাদের আড্ডায়।"
চমকে উঠি, "আমি? না না..."
সে আড্ডায় যাদবপুরের উজ্জ্বল সব নক্ষত্ররা আলো ছড়ান।। কেউ ফিল্ম ডিরেক্টর হবেন, গুটিকয়েক ফিল্ম বানিয়ে ইতিমধ্যেই কলেজ ফেস্টে খ্যাতিলাভ করেছেন। কেউ বা বিজ্ঞাপন জগত আলো করবেন বলে এখন থেকেই কপিরাইটিং করেন। কেউ আবার আগুন-ঝরানো বিপ্লবী। কলেজ থেকে একবার বেরোনোর অপেক্ষা, তারপরেই বিপ্লব সংঘটিত হবে।
এঁদের জগতে আমার মত মফস্বলি বাঙাল যে একান্তই বেমানান, সে জ্ঞান আমার আছে। ওসব আড্ডায় ওই সুমিতার মত মেয়েদেরই মানায়।
দূরে দূরেই ছিলাম। এবং কী আশ্চর্য, আমার মত ক্যাবলাকান্তর জন্যে সুমিতার হৃদয়ে কোথাও একটুকু জায়গা ছিল। বন্ধুত্বের জায়গা, সহমর্মিতার জায়গা। ওই সব আলো-জ্বলা টেবিল ছেড়ে মাঝে মাঝেই আমায় টেনে নিয়ে যেত ক্যামপাসের মাঠে। সবুজ ঘাসে বসে চলত সাহিত্যের আলোচনা। দুজনের একটা ব্যাপারে খুব মিল - লেখালেখি। নতুন যা লেখা হল, তা একে অন্যকে শোনানো চাইই চাই। আমার লেখার প্রথম পাঠিকা সুমিতা, সুমিতার প্রথম পাঠক আমি। এ নিয়মের নড়চড় হত না। পড়া এবং কঠোর সমালোচনা। নিজেদের লেখাকে নির্দয় কাটাছেঁড়া না করলে শান্তি নেই।
কবিত্বশক্তি সুমিতারই বেশি। শব্দ নিয়ে অনায়াসে খেলতে পারে, তাকে গেঁথে গেঁথে অনুপম ব্যঞ্জনায় গড়ে তোলে ভাবনার সৌধ। কবিতায় তাকে আমি কোনোদিন এঁটে উঠতে পারিনি। কিন্তু লেখার হাতটি আমারও মন্দ নয়। আমি গোল দিতাম নন-ফিকশন গদ্যে। প্রবন্ধ, প্রতিবেদনে আমি স্বচ্ছন্দ। রম্যরচনাতেও হাত পাকাচ্ছি তখন। কোনো লেখা পড়ে সুমিতা হয়তো বলল, "দিব্যি হয়েছে, দশে দশ।"
আমি সন্দিহান, "কোনো কমেন্ট নেই? যাহ, তুই পড়িসনি ভালো করে।"                    
তেড়েমেড়ে উঠত সুমিতা, "ধুত্তেরি, ভালো হলে ভালো বলতেও পারবো না? কী জ্বালা!!"
তেমনি সুমিতার কবিতার প্রশংসা করলেই খ্যাঁক করে উঠত, "মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবি না তো? পড়ে বল কোথায় খামতি আছে।"  
অন্ত্যমিল না গদ্যকবিতা, সাবলীলতা নাকি চমকে-দেওয়া শব্দবন্ধ - এসব নিয়েই কাটত অনেকটা সময়। এহেন সুমিতা একদিন বেনারসি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ল। আমরা কব্জি ডুবিয়ে নেমন্তন্ন খেলাম।
সুমিতার মনোহরণ করেছিল ঝিলের ওপারে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটি সুপাত্র। আমাদেরই ব্যাচ, আমরা সবাই চিনি তাকে। ভাস্কর অতি ভালোমানুষ। নিজেকে আড়ালে রাখতে পারলেই বাঁচে। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিপার্টমেন্টে বেশ ওপরের দিকেই থাকে তার নাম। ভারি বন্ধুবৎসল। প্রায়ই নিজের গাঁটের পয়সায় আমাদের খাওয়াত। বিয়ের পর ব্যাঙ্গালোরে ভাগলবা হল দুজনেই। ততদিনে আমি খবরের কাগজে চাকরি নিয়েছি, সাংবাদিক। রাতের শিফটে ডিউটি।  দিনে ঘুমোই, রাত জেগে কাজ করি। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। কেই বা আর রাত জেগে জেগে আমার সঙ্গে গল্প করবে?
তারপর ভাগ্যই একদিন আটলান্টিক পার করে দিল। কাগজের করেসপন্ডেন্ট হয়ে নিউ ইয়র্ক অফিসে ট্রান্সফারের কথা জেনে আগেই মনে হয়েছিল সুমিতার কথা। সে যে নিউ জার্সিতে, সেটুকু খবর আমার কাছে ছিল।      
ফোনে ধরলাম একদিন। ওপাশ থেকে লাফিয়ে উঠল, "কী বললি? নিউ ইয়র্ক অফিস? এক্ষুনি আয়, এক্ষুনি আয়! উফ, কত্তোদিন বাদে তোকে দেখব বল তো?"
"কবে আসছিস? কতদিন থাকবি?"  পাশ থেকে পরিচিত খুশি-খুশি গলা। ভাস্কর।        
তারপর এই নিউ জার্সিতে আবার দেখা। সুমিতা প্রতিষ্ঠিত কবি, নিউ জার্সিতে রীতিমতো পরিচিত মুখ। পুরোনো বন্ধুত্ব চাগাড় দিয়ে উঠতে দেরি হল না। বন্ধুবৎসল ভাস্করের কোনোই পরিবর্তন হয়নি, বরং আতিথেয়তার বহর আরো বেড়েছে। বিদেশে বেশ কিছুকাল বসবাসের ফলে রান্নায় তার চমৎকার হাত পেকেছে। কারণে অকারণে ডাক পাঠায়। ফলে তাদের বাড়িতেই আমার সিংহভাগ সময় কাটে। ভাস্করের কিচেনের চা ও সুস্বাদু 'টা' সহযোগে ঘণ্টার পর ঘন্টা কবিতা আর সাহিত্য আলোচনায় অতিবাহিত হয়। সেই যাদবপুরের মাঠে-বসা দিনগুলিই ফিরে এল বুঝি বা।
ভাস্কর নিজের অফিসে তিনখানা মনিটর আর দুটো কিবোর্ড সাজিয়ে ইলেকট্রনের জগতে মশগুল থাকে। মাঝে মাঝে এসে একটু ফোড়ন কেটে যায়। টিপটে চা শেষ হলে ভর্তি করে দেয়। সত্যিই অতিথিবৎসল।      
নিউ জার্সি-নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের বিভিন্ন সাহিত্যবৈঠকে সুমিতার নিয়মিত যাতায়াত। সেসব সভায় আমি খুব আনন্দের সঙ্গেই তার সঙ্গী হলাম। এ ব্যবস্থায় ভাস্কর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাহিত্য বা কবিতা জিনিসগুলো সে তেমন ভালো বোঝে না। নেহাত অনিচ্ছায়ই মাঝে মাঝে সুমিতার সঙ্গী হত। গৃহশান্তি বজায় রাখতে হবে তো? আমায় পেয়ে তার সে যন্ত্রণার অবসান হল।
তবে এত কষ্ট করেও শান্তি বোধহয় আর থাকছে না।
নিত্য যাতায়াতের পথে সুমিতার গজগজানি। শুনে শুনে আমি ক্লান্ত। আজও চলছিল ধারাবিবরণী।
"কিচ্ছু করে না, জানিস? সারাক্ষণ নিজের অফিসঘরটায় তিনখানা মনিটর সাজিয়ে বসে থাকে!"
এতটা অনৃতভাষণ মেনে নিতে সত্যিই কষ্ট হল। "কেন, তোর বাড়িতে গেলে ভাস্করই তো চা খাওয়ায়, স্ন্যাক্স এনে দেয়। কত যত্ন করে! তু্ই তো শুধু সোফায় বসে আড্ডা মারিস!"
তেড়েফুঁড়ে উঠল, "হ্যাঁ, তোদের সামনে তো ঐরকম একটা ইমেজ তৈরী করে রাখে। এদিকে যে বাড়ির উনখুষ্টি কাজ আমি করি?"
"সে না হয় একটু করলিই। ডিভিশন অফ লেবার বলে একটা কথা আছে তো? ভাস্কর যা যা করে তার সব কি তু্ই করিস? তোর বাড়ির নোংরা ফেলে ভাস্কর। গার্বেজ ব্যাগ হাতে তোকে তো একদিনও দেখিনি আমি?"
"ম্যাগো! আমার ঘেন্না করে!"
"তারপর দেখ, তোর পার্সোনাল ব্লগটা তো ভাস্করই বানিয়ে দিল! যেখানে তু্ই কবিতা লিখিস আর লোকে আহা-উহু করে!"      
"হুঁহ, তোর তো চোখে শুধু ওগুলোই পড়ে! জানিস, সেদিন বললাম, বাগানে আগাছাগুলো উপড়ে দিতে। দিলই না!"
সর্বনাশ! সুমিতা এবার খুবই বিপজ্জনক দিকে যাচ্ছে! বাগান তার প্রাণ। এই অভিযোগ থেকে ভাস্করকে রক্ষা করার মত এলেম আমার নেই। ঝটপট কথা ঘোরাই, "তোর ডালিয়াগুলো ফুটল? সেদিন যে দেখলাম কুঁড়ি এসেছে?"
"হ্যাঁ রে, গাছ ঝেঁপে ফুল একেবারে! আর কী রং! একেকটা ফুলে একের বেশি শেড! ভাবতে পারবি না..." মনের মত বিষয় পেয়ে কলকলিয়ে উঠেছে।
রাস্তায় চোখ রেখে আমি ঘাড় নাড়ি। আড়ালে ডেকে ভাস্করকে একটু ধমকে দিতে হবে। এতদিন ঘর করছিস, একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারিস না হাঁদা?
বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। ভাস্কর বেরিয়ে এসেছে, "চা খেয়ে যা। আড়াইঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এলি।"
"খাওয়া।" আরাম করে বসেছি সোফায়।
সুমিতা মনে করাল, "পরের শনিবার কিন্তু নিউ জার্সিতেই। কবিতা ক্লাবের সেশন।"
মাথায় ঝড়াকসে বুদ্ধি খেলে গেল, "পরের শনিবার তো হবে না রে, আমার ডিউটি আছে।"
"তাহলে আর কী, আমি একাই..." সুমিতা নিমেষে নিবে যায়।  
"না না, একা যাবি কেন? ভাস্করটা আছে কি করতে? ভাস্কর, এই ব্যাটা ভাস্কর!" হাঁক পাড়ি আমি।
"ষাঁড়ের মত চেঁচাতে হবে না। সব শুনতে পাচ্ছি আমি।" কাপ-প্লেট-টিপট নিয়ে গুছিয়ে বসল।
"শুনেছিস তো? যাক!" আমি নিশ্চিন্ত।
"কিন্তু আমি তো যাচ্ছি না? আমার অন্য কাজ আছে।"    
সুমিতার মুখ আঁধার।
আমি তাড়াতাড়ি সামাল দিই, "কী এমন তোমার কাজ যে তুমি বৌকে সঙ্গ দিতে পারো না?"
"সঙ্গ দিলেও গালি খাবো, না দিলেও গালি।" ভাস্কর গোঁয়ারের মত বলে।
"কাউক্কে যেতে হবে না। একাই যাবো আমি।" সুমিতা ফেটে পড়ে। "আমি চললাম ওপরে। মাথা ধরেছে।"
সত্যিই গটগটিয়ে চলে গেল নিজের শোবার ঘরে।
"এমন করে কেউ বলে?" আমার খারাপ লাগছে।
"ছাড় তো!" ভাস্কর কেমন নির্বিকার!
আমি একটু ধন্দে পড়ে যাই। উঠে পড়ি। কাল সোমবার। সকাল সকাল কাজে বেরোনো। সারাসপ্তাহ চূড়ান্ত ব্যস্ততা। প্রেশার কুকার জীবন। সপ্তাহান্তে একসঙ্গে সময় কাটানো, গল্প আর আড্ডার মধ্যেই তো বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়ে নেওয়া। সে রসদে কি টান পড়ছে ভাস্কর আর সুমিতার সংসারে? কি জানি!
এমন করেই গড়িয়ে চলে দিন। কাজের চাপ বেড়েছে আমার। সবসময় নিউ জার্সি আসতেও পারি না। সব সাহিত্যসভায় যাওয়াও হয়ে ওঠে না।
সুমিতার কবিখ্যাতি বেড়েছে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন বন্ধু। ভক্তমণ্ডলী ঘিরে থাকে।
একদিন ভাস্করকে ধরে বললাম, "বৌকে একটু মনোযোগ দে। যে রেটে বিখ্যাত হচ্ছে সুমিতা,কেউ যদি ইলোপ করে?"
শুনে সে কী ঘর ফাটিয়ে হাসি! থামতেই চায় না। "ইলোপ? কে করবে?"
"কেন, আমিই যদি করি? তু্ই তোর গুহায় বসে থাকিস। আমিই তো সুমিতার সঙ্গে এখানে ওখানে যাই!"
"আরে কর, কর! ক্ষতি কী? গো অ্যাহেড ম্যান!" আবার সেই গা-জ্বালানো হাসি।
মরুকগে, আমার কী? আমি কি ওদের সম্পর্কের জিম্মেদারি নিয়েছি?          
এই করে করেই কেটে যায় গ্রীষ্মের তিনটে মাস। ফসল উঠে গেছে ক্ষেত থেকে।  হেমন্তের রং ধরেছে পাতায়। ফল কালার। উজ্জ্বল কমলা, হলুদ, লাল রঙের আগুন লেগেছে বনে বনে। ঝরে যাবার আগে রঙের খেলা।
সুমিতাই সেদিন ফোন করল।        
"মেরিল্যান্ডের কবি-সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নেমন্তন্ন করেছেন। আমার কবিতা নিয়ে আলোচনার জন্যে একটা স্পেশ্যাল সেশন রাখতে চান।"
"বলিস কী রে?" আমি উচ্ছ্বসিত। "দারুণ খবর! তোর তো দিকে দিকে জয়জয়কার!"  
"আমি সেই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি। আমার কবিতা নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেব।"
"বাঃ, বাঃ, বিরাট সম্মান। তু্ইই তাহলে সেদিন কবিদের মধ্যমণি" আমি সত্যি খুশি।
মেরিল্যান্ডের কবি-সম্মেলন উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী ও পুরোনো কবিতার আড্ডা। বাছাই করা কবিরা ডাক পান। সামনের মাসেই সেই সভা।  
"ভাস্কর আমার সঙ্গে যাবে না। কবি হিসেবে আমার এতবড় সম্মান, এমন দিনেও ওর নাকি কাজ আছে।   আমায় বলেই দিল, অত কবিতা শুনলে ওর নাকি মাথা ধরবে!" সুমিতার গলা ভেঙে আসে। "আমি তো ওকে সবজায়গায় যেতে বলছি না, বলছি কি? তা বলে এমন একটা বিশেষ দিনেও থাকবে না?"  
আমি কীই বা বলি। খারাপ লাগছে। সুমিতার সেন্টিমেন্টটা অযৌক্তিক নয়।
তবু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি, "ভাস্কর ছেলেটা তো খুবই ভালো, তবে ওয়্যারলেস টেকনোলজি নিয়ে এমনই ডুবে আছে যে সামনাসামনি তারের মধ্যে দিয়ে আসা সিগন্যালগুলো ওর অ্যান্টেনায় আর ধরা পড়ে না।"
"থাম তো তুই, চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!" সুমিতা দাবড়ে দেয়। "ঠিকাছে, আমিও দেখে নেব। মেরিল্যান্ড থেকে ফিরেই ডিভোর্স। এর আর নড়চড় নেই। তুই ল'য়ারের খোঁজ লাগাবি। তোদের মত জার্নালিস্টদের কত চেনাজানা। একটু জিজ্ঞেস করলেই খবর পেয়ে যাবি।"
ফোন নামিয়ে রাখল।  
অবশেষে এল সেই দিন। মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরে সপ্তাহান্তের কবি-সম্মেলনে সুমিতার কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা হল। দেশ বিদেশ থেকে সুখ্যাত কবিরা মঞ্চে এসে তার কবিতার বিশ্লেষণ করলেন। সুমিতার কবিতায় এক অদ্ভুত সাবলীলতা আছে। চরণ থেকে চরণে, পংক্তি থেকে পংক্তিতে অনায়াসে গড়িয়ে চলে কবিতার মূল সুরটি। সবাই প্রশংসা করলেন। সুমিতা লজ্জা লজ্জা মুখে তার কবিতা লেখার গল্প বলল। যাদবপুরের খোলা মাঠে আমাদের দুই বন্ধুর লেখালেখি, প্রথম পড়া আর কাটাছেঁড়ার কথাও বাদ গেল না।
বিকেল নাগাদ ফেরার পথ ধরেছি। মেরিল্যান্ড ছেড়ে পেনসিলভ্যানিয়াতে ঢুকছি, এমন সময় নামল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। কোন এক ঘূর্ণিঝড় তার পথ বদলে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত। সামনেটা বেবাক সাদা। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছি। সামনে, পেছনে, ডাইনে বাঁয়ে - কোনদিকেই দৃষ্টি চলে না। যাকে বলে হোয়াইট আউট কন্ডিশন। খুব বিপজ্জনক।    
খুব সতর্ক হয়ে চালাচ্ছি। পাশে সুমিতা চুপচাপ। আজ মুখে কুলুপ এঁটেছে। কলকলানি নেই। নিয়মমাফিক ভাস্করের নিন্দেমন্দ নেই। বৃষ্টির যা দাপট, নিউ জার্সি পৌঁছতে ঢের সময় লাগবে।
সুমিতাকে বলি, "ভাস্করকে ফোন করে জানিয়ে দে, যেতে দেরি হচ্ছে। নইলে চিন্তা করবে।"  
জবাব দিল না।
আড়চোখে তাকাই।  এ আবার কী ভাববিলাস?        
খানিক পরেই শুনি ফোন করছে।  
"বল, কেমন হল।" ভাস্করের গলা।
"তোর সে খবরে দরকার কী? ফোন করেছিস একবারও?" অভিমান উথলে ওঠে।
"আরে, তুই সভার মুখ্য আকর্ষণ, ভি আই পি, তোকে কি যখন তখন ফোন করে বিরক্ত করা যায়?"
"মিথ্যে কথাগুলো একটু কম বলবি? শোন, আজ 'মাটির কাছাকাছি' কবিতাটা পড়লাম, বুঝলি?"                  
"ও।"
"ও আবার কী?" সুমিতা উত্তেজিত। "সেদিনই তো তোকে বললাম, অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। মনে নেই?"
"ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! সেটাই পড়লি?"
"সবাই ভালো বলল, জানিস? একদম নতুন রকমের কবিতা!"
"আচ্ছা, আচ্ছা, তু্ই বাড়ি আয় আগে। একটা সারপ্রাইজ আছে।“
“কী?"  
"সামনের বসন্তের জন্যে টিউলিপ আর ড্যাফোডিলের বাল্ব কিনে আনলাম। ড্রাইভওয়ের ধারে সার দিয়ে বসিয়ে দেব।"
"সত্যি? টিউলিপ আর ড্যাফোডিল? আমার যে কতদিনের শখ..."
"সে তো জানিই। ভাবলাম তোদের তো ফিরতে দেরি আছে, যাই, কিনে নিয়ে আসি। হেমন্তেই তো ওদের বসাতে হয়, তাই না?"
"হ্যাঁ, এইসময় বসালে বসন্তে চারপাশ আলো করে ফুল ফুটবে।"
“যাক, আর কথা নয়। সাবধানে চালিয়ে আয়। যা বৃষ্টি, রাস্তার নিশ্চয়ই খুব খারাপ অবস্থা।"
"হ্যাঁ রে, ডাইনে বাঁয়ে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না।"
"বাড়ির কাছাকাছি এলে বরং একটা ফোন করিস। চা বসাব। তোর ফেভারিট আদা-এলাচের চা।"
ফোন রেখে দিল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। সুমিতা সিটে মাথা রেখেছে। চোখ বোজা। অবশেষে বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে। আকাশ-ভাঙা থেকে কমে এখন ঝরঝর মুখর বাদর ধারা।  সন্ধে ঘনিয়ে আসছে।                    
"ফোনটা কর।" আমি মনে করালাম।
"আবার কাকে?" খেঁকিয়ে উঠল।
"ওই যে, ভাস্কর চা বসাবে বলেছিল? তোর বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি।"
"ছিঃ সোমনাথ!" সুমিতা এবার সত্যিই আহত হয়েছে। "সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কি আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে? কবিতা সম্মেলনে মন ভরল না তোর? কে কোথায় চা খাওয়াবে বলেছে, সেই আশায় বসে আছিস?" ব্যথিত নয়নে তাকাল আমার পানে।  
আমি চেপে গেলাম। ভাস্করের বুদ্ধিশুদ্ধির ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। আমাদের ফেরার সময়টা ও ঠিকই আন্দাজ করে নেবে। রেডি রাখবে চা এবং অনবদ্য সব 'টা'। মনে মনে সেকথা ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু মুখে বলা চলবে না।
অবশেষে সুমিতার বাড়ি। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকল। বৃষ্টি পড়ছে, জলে থৈথৈ করছে লম্বা ড্রাইভওয়ে।
ছাতাটা এগিয়ে দিই, "এই নে, নাম।"
"তুই থাম!" দাবড়ে দিল আমায়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা।
ফোন লাগিয়েছে, "অ্যাই শুনছিস?"
"হ্যাঁ, বল। চা বসিয়েছি।"
"এসে আমায় নিয়ে যা।"
"তার মানে? কোথায় তোরা?"
"এই তো, ড্রাইভওয়েতে।"
"তাহলে? বাড়ি ঢুকে পড়!"
"না, তুই আয় ছাতা নিয়ে। এত বৃষ্টিতে আমি নিজে নিজে যেতে পারব না।"
"ওহো, দাঁড়া, দাঁড়া, এক্ষুণি যাচ্ছি।"
আমি ছাতা হাতে করে বেকুবের মত গাড়িতে বসে আছি।
বাড়ির দরজা খুলে গেল। ভাস্কর বেরিয়ে এল। মাথায় একখানি ছাতা, হাতেও একখানি। দু'পা এগিয়েছে কী এগোয়নি, পাশ থেকে চেঁচিয়ে সুমিতার সাবধানবাণী, "দাঁড়া, দাঁড়া, আর এগোসনি, পিছল হয়ে আছে সামনেটা। পড়ে যাবি। আমি যাচ্ছি, তুই দাঁড়া ওখানে।"
“দাঁড়াব? তুইই তো এসে নিয়ে যেতে বললি?” ভাস্কর থমকে গেছে।
"আঃ, যা বলছি শোন, ওখানেই দাঁড়া। পা পিছলে পড়বি শেষে, কেলেঙ্কারি হবে একটা।"
আমার হাত থেকে ছাতাটা একটানে নিয়ে নিল সুমিতা, "কী তখন থেকে ধরে আছিস, দে না আমার হাতে।"
ছাতা মাথায় দিয়ে পা টিপেটিপে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে। ভাস্করও অবশ্য থেমে নেই, সেও আসছে সামনে। অবশেষে ড্রাইভওয়ের মাঝামাঝি দুজনের মিলন। বৃষ্টির সুবাসভরা সন্ধ্যায় এক ছাতার তলায় হাঁটছে দু'জন। অভিমান ধুয়ে যাচ্ছে। দুটি হৃদয় কাছাকাছি। হেমন্তের উজ্জ্বল রং ওদের ঘিরে আছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে এগোলাম। ছাতা নেই আমার। তাতে কী? বাড়ি ঢুকলেই গরমাগরম চা অপেক্ষা করে আছে। ভাস্করের নিজের হাতে তৈরি। একটুখানি আদা, কয়েকটি এলাচ আর অনেকখানি ভালোবাসার সুগন্ধে ভরপুর।

সমাপ্ত
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার
 

 

ব্রহ্মদৈত্যের বিপদ - সংগ্রামী লাহিড়ী

 ব্রহ্মদৈত্যের বিপদ
সংগ্রামী লাহিড়ী

 



হরিশঙ্করের বয়স অল্প, তিনকুলে কেহ নাই, গ্রামে দূরসম্পর্কের মামার বাড়ীতে মানুষ। পিতামাতা নাই, বহুকাল হইল গত হইয়াছেন। মামা-মামী তুতো ভাগিনেয়কে আশ্রয় দিয়াছিলেন নিতান্তই লোকলজ্জায়। অনাথ বালকটিকে দূর দূর করিয়া খেদাইলে গ্রামের আর পাঁচটি লোকে যাহা বলিবে তাহা আর যাহাই হউক, শ্রুতিমধুর হইবে না। অতএব তাঁহারা ঢেঁকি গিলিয়াছিলেন, অর্থাৎ হরিশঙ্করের মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেইসঙ্গে গ্রামের বিদ্যালয়টিতে ভর্তিও করিয়া দিয়েছিলেন। হরিশঙ্কর দুই মাইল হাঁটিয়া বিদ্যালয়ে যাইতো। পথে যাহার বাগানের ফলপাকুড় যখন যাহা চোখে পড়িত তাহার সদ্ব্যবহার করিত। বিদ্যালয়ে গিয়া সহপাঠীদের সহিত ফুটবল পিটাইতো। মোটের উপর তাহার সময় মন্দ কাটিত না।
 

সমস্যা দেখা দিলো পড়াশোনা লইয়া। হরিশঙ্কর মধ্যমেধার ছাত্র। বিশেষতঃ গণিতশাস্ত্র লইয়া তাহার ভীতির সীমা পরিসীমা ছিল না। ষান্মাসিক ও বাৎসরিক পরীক্ষাগুলি তাহার রাতের ঘুম কাড়িয়া লইত। শয্যায় ঘনঘন পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া বা মেষসংখ্যা গণনা করিয়াও কোনো উপকার হয় না। গণিতশাস্ত্রের বইয়ের পৃষ্ঠা হইতে সংখ্যাগুলি উঠিয়া আসিয়া নৃত্য শুরু করে।
এমনি এক নিদ্রাহীন রজনীতে হরিশঙ্কর শয্যায় টিঁকিতে না পারিয়া বাহিরের খোলা আকাশের তলে আসিয়া দাঁড়াইল। আকাশ অভিমুখে চাহিয়া জানা-অজানা সর্বপ্রকার দেবতার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা বৈতরণী পার করিয়া দিবার জন্য আকুল প্রার্থনা নিবেদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে সেসময় এক পরোপকারী ব্রহ্মদৈত্য আকাশপথে ভ্রমণ করিতেছিলেন। হরিশঙ্কর তাঁহার নজরে পড়িয়া গেল।
ব্রহ্মদৈত্যটি তাঁহার পূর্বজীবনে গণিতশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। খোদ কে সি নাগের কাছে অঙ্ক শিখিয়াছেন, মনুষ্য-জীবনে ছাত্র ঠেঙ্গাইয়া সুনাম ও দুর্নাম দুইই কুড়াইয়াছেন।   চৌবাচ্চা হইতে নলযোগে জল ঢোকা ও বাহির হইবার হিসাব তাঁহার কাছে জলের মতোই সোজা। এ হেন গণিতজ্ঞ ভূতপ্রবর হরিশঙ্করের বিলাপ শুনিয়া তাহার সামনে আবির্ভূত হইলেন।
হরিশঙ্কর প্রথমটায় ঘাবড়াইয়াছিল। কিন্তু তাহার উপস্থিত বুদ্ধির কোনো অভাব ছিল না। যত গোল বাধিত অঙ্ক কষিতে বসিলে। সে চোখ পিটপিট করিয়া সামনের অপরূপ আবির্ভাবটিকে একটু মাপিয়া লইলো। লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা, গলায় ফুটফুটে সাদা উপবীত, হরিশঙ্কর বুঝিল ইনি ব্রহ্মদৈত্য না হইয়া যান না। হরিশঙ্করের মামার বাড়ী কিঞ্চিৎ সাহিত্যরসিক ছিল। বাড়ীতে খুঁজিলে দুই-একখানা পুরাতন পূজাবার্ষিকী পাওয়া যাইত এবং তাহাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখনীতে ভূতের গল্পও থাকিত। পাঠ্যবইয়ের বাহিরে অপাঠ্য রসদগুলি আমাদের হরিশঙ্করের সর্বদাই প্রিয়। তাই তাহার অজানা ছিল না বুরুন নামে এক অঙ্কে তেরো পাওয়া ছাত্র কী করিয়া ভূতের কৃপায় একশো পাইয়াছিল। সে মনে মনে ভাবিল, ‘একবার পরখ করিয়া দেখিতে হয়।‘
ব্রহ্মদৈত্য খুবই সহানুভূতির সহিত কথা শুরু করিলেন, “কী বাবা, অঙ্ক নিয়ে সমস্যা?”
হরিশঙ্কর পাল্টা প্রশ্ন করিল, “তা তো বটে কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
ব্রহ্মদৈত্য হাসিয়া কহিলেন, “আমাদের Zানতি হয়, আকাশপথে যাচ্ছিলুম, তা দেখলুম তোমার চোখে ঘুম নেই।“
হরিশঙ্কর এবার তেরিয়া জবাব দিল, “তা না থাকলেই বা আপনার কী? আমি তো আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে যাইনি?”
ভূতসমাজে মনুষ্যজাতির প্রতি সহানুভূতির অভাব নাই। ব্রহ্মদৈত্য ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আহা, চটো কেন? চটো কেন? আমি কি তাই বললুম নাকি? আমার ঘুমে তুমি ব্যাঘাত ঘটাবেই বা কেন? আমি বলছি কী, আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।“
হরিশঙ্কর দেখিল, এ তো তাহার পড়া গল্পের সঙ্গে মিলিয়া যাইতেছে! অশরীরীগণ তাহা হইলে প্রায়ই মনুষ্যজাতিকে অংকে সাহায্য করিয়া থাকেন! সে এবার পুরোদস্তুর ইন্টারভিউ লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া কহিল, “তাহলে আগে বলুন দেখি আপনার বিদ্যার দৌড় ঠিক কতটা?”
ব্রহ্মদৈত্য তাঁহার অঙ্ক লইয়া যাবতীয় ডিগ্রী, সার্টিফিকেট ইত্যাদির হিসাব দাখিল করিলেন। হরিশঙ্কর তাহাতে খুব যে সন্তুষ্ট হইলো এমন নহে। সে অতঃপর জানিতে চাহিল ব্রহ্মদৈত্যের স্কুল-ছাত্র পড়াইবার অভিজ্ঞতা আছে কিনা। ব্রহ্মদৈত্য তাঁহার কেশবিরল মস্তক চুলকাইলেন। জীবিতাবস্থায় তিনি কলেজে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন, স্কুলের ছাত্র পড়াইবার সুযোগ কখনো হয় নাই। সে কথা বলিতেই হরিশঙ্কর সজোরে ঘাড় নাড়িল, “নাঃ, আপনাকে দিয়ে হবে না।“
ব্রহ্মদৈত্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, তীরে আসিয়া তরী বুঝি ডুবিয়া যায়, “সে কী বাবা? কেন? হবে না কেন?”
হরিশঙ্কর বলিল, “টিউশন না পড়ালে কেউ কখনো অঙ্ক শেখাতে পারে? এই আমাদের অঙ্ক স্যার  তারাপদবাবুর কথাই ধরুন না কেন। তিনি ব্যাচ কে ব্যাচ অঙ্ক করান, সকাল সাতটা থেকে দশটা, তারপর ইস্কুলটা খানিক জিরোবার জায়গা, আমাদের ক্লাসে এসে একটু ঘুমিয়ে নেন। আমাদের বলা থাকে যেন গোল না করি। তা আমরা লক্ষ্মীছেলে, ঐসময় কাটাকুটি খেলি, গোলমাল করি না। ইস্কুলের পর আবার তো স্যারের অঙ্কর ব্যাচ শুরু হবে, তাই একটু ঘুমোতে না পারলে স্যার বাঁচেন কী করে? পারবেন আপনি দিনে এমন আট-দশটা অঙ্কের ব্যাচ পড়াতে? পড়িয়েছেন তো কলেজে, সে তো শুনেছি দিনে দুটো ক্লাস – হুঁহ!”
ব্রহ্মদৈত্য কাকুতিমিনতি করিয়া বলিলেন, “তুমি আমাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখো, কথা দিচ্ছি - তোমায় অঙ্কে একশো পাওয়াবোই। যদি না পারি তাহলে আমার ব্রহ্মদৈত্য নাম তুমি পাল্টে রেখো।“
হরিশঙ্কর নিমরাজী হইল। দেখাই যাক না ব্রহ্মদৈত্যের এলেম কত দূর। সে বলিল, “ঠিক আছে, তাহলে কাল থেকেই শুরু করুন। এইরকম রাতের বেলায়। আমি বইখাতা নিয়ে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে আসবো'খন, কেউ টেরটি পাবে না।“
ব্রহ্মদৈত্য ভারী খুশি, মানুষের উপকার করিবার সুযোগ মিলিয়াছে।
গোল বাধিল প্রথম রাতেই। পাটিগণিতএর বই খোলা হইয়াছে, তৈলাক্ত বাঁশের উপর বাঁদর উঠানামা করিতেছে। হরিশঙ্কর ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, বাঁশের ওপর তেল ঢালবার কোনো মানে হয়? এই তো, মামা দুবেলা মামীকে বলে, ‘ওগো অতো তেল নষ্ট কোরো না, তেল কি বিনি পয়সায় আসে’?”
ব্রহ্মদৈত্য অনেক কষ্টে তাহাকে বুঝাইলেন, ইহা অঙ্ক মাত্র, বাস্তবে এমন ঘটিবে না।
দ্বিতীয় ধাক্কা আসিল রাম ও শ্যামের অঙ্কে। তাহারা তাহাদের বয়সের সমানুপাতে কয়েকটি মার্বেলের গুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ করিতে চাহে। ব্রহ্মদৈত্য কিছুতেই রামের নাম মুখে আনিতে পারেন না, কেবলই বলেন, “ইয়ে।“ কঠিন অঙ্ক কঠিনতর হইয়া উঠে। ‘ইয়ে’ শুনিয়া শুনিয়া হরিশঙ্করের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল। সে বলিল, “কাল থেকে আর আপনার আসার দরকার নেই।“
ব্রহ্মদৈত্য এইবার সত্যি রাগিলেন। অর্বাচীন বালক বলে কী? ব্রহ্মতেজে মুখমন্ডল রক্তবর্ণ হইলো। রোগা সিড়িঙ্গে চেহারা ফুলিতে লাগিল। দেখিয়া হরিশঙ্করের মতো ডাকাবুকো ছেলেও ভয় পাইল। তবে মুখে প্রকাশ না করিয়া সে উল্টা চাপ দিল, “এহ, নিজে পড়াতে পারেন না আবার রাগ দেখানো হচ্ছে। তবে যে বলেছিলেন আমায় অঙ্কে একশো পাইয়ে দেবেন? আপনার তো দেখছি কথা ও কাজের একেবারেই মিল নেই!”
ব্রহ্মদৈত্য চটিয়া লাল, "সেদিনের ছোকরা, এতবড় তোর সাহস? আমার কথায় কাজে মিল নেই? প্রাণপাত করছি তোকে অঙ্ক শেখাতে, আর সেই তুইই কিনা আমায় গাল দিস? হতভাগা, বিচ্ছু! আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন!"
হরিশঙ্করের দুই কর্ণ লক্ষ্য করিয়া ব্রহ্মদৈত্য দুই হস্ত বাড়াইলেন। ভাঁটার ন্যায় দুই চক্ষু হইতে অগ্নি বর্ষিত হইতেছে। মস্তক তালগাছে ঠেকিয়াছে। ভীত হইয়াও হরিশঙ্কর বুদ্ধি হারায় নাই, শুষ্ককণ্ঠে কোনোমতে বলিল, “রাম-রাম-রাম-রাম।”
ব্রহ্মদৈত্য এইবার মারাত্মক বিষম খাইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গে কেহ যেন বিছুটির পাতা ঘষিয়া দিল। ছোকরা দুষ্টবুদ্ধিতে অতিশয় দড়। গণিতে মাথা না খেলিলেও সঠিক বুঝিয়াছে কোন নাম তাঁহার নিকট বিষবৎ। আর্তনাদ করিলেন, "ওরে থাম, থাম।"
হরিশঙ্কর মওকা পাইয়াছে, ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, "মামা বলেন, বিপদে পড়লে রামনাম করতে। আমি মামার সব কথা শুনে চলি। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি আমায় অঙ্কে একশো পাওয়াতে পারেন, তাহলে আর আমার ওই নাম করার দরকার নেই। নইলে কিন্তু আমি বলতেই থাকবো, রাম-রাম-রাম-রাম, রাম-রাম-রাম-রাম।"
ব্রহ্মদৈত্য চটিয়া লাল হইলেন, ‘রাম-রাম’ ধ্বনি তাঁহার কাছে পরমাণু বিস্ফোরণের শব্দ হইতেও ভয়াবহ। কিন্তু এক্ষণে তিনি নিজের ফাঁদে নিজেই পড়িয়াছেন। অতএব হরিশঙ্করকে “বিচ্ছু, বদমায়েশ, মিচকে শয়তান” ইত্যাদি বাছা বাছা কিছু বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া গালি দিয়া জ্বালা জুড়াইলেন আর বলিলেন, কথার খেলাপ তিনি করিবেন না। হরিশঙ্কর কলম হাতে যখনই কোনো অঙ্ক কষিতে যাইবে, তিনি আসিয়া তাহার কলম চালনা করিয়া অঙ্কটি কষিয়া দিবেন। তাহা হইলেই হরিশঙ্করের অঙ্কে একশোয় একশো বরাবরের মতো নিশ্চিন্ত।
হরিশঙ্কর দেখিল, তাহার কার্যসিদ্ধি হইয়াছে। সে এইবার ঢিপ করিয়া ব্রহ্মদৈত্যকে একটি পেন্নাম ঠুকিল। তবে সেই সঙ্গে বলিতে ছাড়িল না, “দেখবেন কথার খেলাপ যেন না হয়। হলেই কিন্তু আমি আবার মামাভক্ত হনুমান হয়ে গিয়ে রামধুন গাইবো। মনে থাকে যেন - হ্যাঁ।"
ব্রহ্মদৈত্য নাসিকা-কর্ণ মলিয়া বলিলেন, “নিশ্চয় মনে থাকবে বাবা। এ শিক্ষা আমার ভূতজীবনে আর ভুলছি না, মানুষ থেকে দূরে থাকাই ভালো"

..................................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি