উত্তর জানা নেই
অদিতি ঘোষদস্তিদার
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে সবে ওপরে ওঠার সুইচটা টিপেছি, হৈ হৈ করে ছুটে এসে ঘিরে দাঁড়াল একরাশ কচিকাঁচা। ছয় থেকে দশের মধ্যে বয়েস। মুখ চেনা সবগুলোরই। আমাদের হাউজিং কমপ্লেক্সেরই বাচ্চারা।
একটি তুলনামূলকভাবে লম্বা মেয়ে এগিয়ে এল।
"আন্টি, তোমার মেয়ে আজ আরুশীকে খুব দুঃখ দিয়েছে, বেচারা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেছে।" তীব্র অভিযোগের তীর।
"খুব খারাপ কথা বলেছে গডকে নিয়ে!" আর এক কচি রিনরিনে গলা।
বুঝলাম আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল এই বাহিনী। রোজ এই সময় আমার সঙ্গেই মুন্নি, মানে আমার মেয়ে খেলে বাড়ি ফেরে। একসঙ্গেই থাকে সবকটা। আজ নেই। মনে হয় আগেই ফিরে গেছে ফ্ল্যাটে। তার মানে ব্যাপার গুরুতর। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছি আরো তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের, এমন সময় ঘড়াং করে লিফটটা এসে আমাকে বাঁচাল। দরজা খুলে টুক করে ঢুকতে ঢুকতে ওদের হাত তুলে আশ্বস্ত করলাম যে ব্যাপারটা আমি দেখছি।
মুখে ওদের কিছু না বললেও মাথা গরম হয়েছে নালিশ শুনেই। সারাদিন খাটুনির পর বাড়ি ঢোকার মুখেই ঝামেলা - কার ভালো লাগে?
পইপই করে মেয়েটাকে বলি কথা কম বলতে। সাত বছর বয়েস। কথাবার্তা যেন সত্তরের বুড়ি। সব ব্যাপারেই তার বিরাট মতামত আর যুক্তি। দেবদেবীদের ভুল ত্রুটিও সে হামেশাই ধরে থাকে, এ অভিজ্ঞতা আমার যথেষ্ট। তাই একটু আগে শোনা কথাগুলো নিয়ে মনে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই।
কদিন আগের ঘটনা।
আমাদের কমপ্লেক্সের ভেতরই একটা মন্দির আছে। সেখানে সন্ধ্যেবেলা পাঠ হয়, রামায়ণ মহাভারত ছাড়াও পুরাণের নানান গল্প খুব সুন্দর করে বলেন কথকঠাকুর।
মুন্নি খুব ভালোবাসে সেই সব গল্প শুনতে। তাই তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক সেরে ঠাকুমার সঙ্গে প্রায়ই যায় সেখানে।
কদিন আগে এক শনিবার সকালে আমার শাশুড়ি বোধহয় কয়েকজন সখীর সঙ্গে কালীঘাট বা অন্য কোন মন্দিরে যাচ্ছিলেন। মুন্নির শনিবার স্কুল থাকে না। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। সেদিন সকাল থেকে দেখি ঠাকুমার পেছন পেছন ঘুরছে আর ঘ্যানঘ্যান করছে।
"আমায় নিয়ে চলো ঠাম্মি!"
ঠাকুমা কোনমতেই রাজি হচ্ছেন না।
"বড্ড ভিড় সেখানে। তোমার কষ্ট হবে দিদি!"
"আমি যাবই, আমার খুব দরকার!"
"কেন দিদিভাই?" খুব অবাক ঠাকুমা।
কী সেই প্রয়োজন সেটা জানার তীব্র কৌতূহল আমারও। একটু এগিয়ে আসতেই শুনতে পেলাম, "কবে থেকে বলছি সব গডকে আমাকে একটা বোনু দাও। বাড়িতে বললাম, আমাদের মন্দিরে বললাম, কোন গডই শুনছে না, কেউ ভালো নয়। দেখি ওই ঠাকুর যদি কথা শোনে!"
শাশুড়ি আর বৌমা, দুজনেরই হাসি চাপা বেজায় দায় হয়েছিল সেদিন।
আরুশী আমাদের পাশের বিল্ডিঙে থাকে। মুন্নির প্রাণের বন্ধু। একই স্কুলে পড়ে, একই ক্লাসে। শুধু সেকশনটা আলাদা। স্কুল যায় একই পুলকারে। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও মোটামুটি ভাব। তবে বেশ কিছুদিন হল আরুশীর বাবা আর মায়ের সম্পর্কের মধ্যে কিছু গোলমাল চলছে একথা কানে এসেছে। আমি ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে কাউকে বিব্রত করতে চাইনি।
বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম মুন্নির চোখ ভিজে, মুখ শুকনো। এমনিতে খুব সহজে কাঁদে না মেয়েটা। আমি কিছু তলিয়ে না ভেবেই চেঁচালাম, "তোর জ্বালায় তো আর পারা যাবে না দেখছি, কেন কষ্ট দিয়েছিস আরুশীকে?"
চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শাশুড়ি আমার পিঠে হাত রাখলেন। চোখে নীরব ভর্ৎসনা। ততক্ষণে মুন্নি কেঁদে ভাসাচ্ছে।
আমি মাটিতে উবু হয়ে বসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুন্নি জানাল যে আরুশীর বাবা এখন আর ওদের সঙ্গে থাকছেন না।
“তুই কী করে জানলি?”
দুহাতে চোখের জল মুছে আমার দিকে তাকাল মুন্নি।
“বা রে? আরুশীই তো বলল আমাদের।”
“কদিন তো ও স্কুল যায়নি তাই না?”
মুন্নি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
আমিই পুলকারে তুলতে যাই। কয়েকদিন দেখতে পাইনি আরুশীকে। অসুখ বিসুখ হল কিনা সে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল। ফোন করেছিলাম ওর মাকে।
“আরুশীর মা বলেছিল ও তো মামারবাড়িতে। আজ স্কুলে এসেছিল?”
“হ্যাঁ, তারপর আমাদের সঙ্গেই বাড়ি ফিরেছে। পুলকারেই তো বলল আমাকে। বিকেলে খেলতে গিয়ে সব বন্ধুদেরও বলেছে। খুব কাঁদছিল ও জানো মা?”
আমি এবার সংশয়ে।
“তাহলে যে বাচ্ছাগুলো বলল তুই ওকে কাঁদিয়েছিস?”
“আমি ওকে দুঃখ দিতে চাইনি মা। কিন্তু মিকি, রাই, মৌ, শুভ ওরাই তো গণ্ডগোল করে ফেলল।”
“মানে?”
মুন্নি কান্নাভেজা গলায় এলোমেলো একগাদা কথা বকে গেল। আমি যা বুঝলাম তা হল, আরুশী বাবার জন্যে খুব মন কেমন করে - একথা বন্ধুদের বলতে বলতে খুব কাঁদছিল। তখন বন্ধুরা ওকে শান্ত করতে সবাই মিলে একসঙ্গে বুদ্ধি দিয়েছে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে। মন দিয়ে ভগবানকে ডাকলে নিশ্চয়ই আরুশীর মনে ইচ্ছে পূরণ হবে, একথা সবাই জোর গলায় বার বার জানিয়েছে। কিন্তু তখনই একমাত্র মুন্নি রেগে গিয়ে ভীষণভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
"ভালোই তো বলেছে বন্ধুরা, তুই তাতে রেগে গেলি কেন?"
মুন্নি এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকাল।
“আমি আরুশীকে কত ভালোবাসি মা, তুমি তো জানো!”
“জানি তো, তাই তো ভাবছি, আরুশীকে কাঁদালি কেন? সেজন্যেই তো বন্ধুরাও রেগে গেছে।”
"আরুশী বাবার কোলে বসতে চায়...সেই জন্যেই গডকে ডাকবে, আর সেটাই তো মুশকিল…" জোরে জোরে নাক টানতে টানতে জানায় মুন্নি।
"সে তো চাইতেই পারে, তাতে সমস্যা কোথায়?" হতভম্ব আমি।
"তুমি জানো না ধ্রুবের গল্প?"
এবার আমার পুরো মাথা শূন্য।
"কে ধ্রুব? এর মধ্যে সে আসছে কোত্থেকে?"
শাশুড়ি এগিয়ে আসেন। বুঝলাম আমার আসার আগেই নাতনির কাছ থেকে জেনেছেন সবকিছু।
"দোষটা আমারই রে! আমিই ওকে ধ্রুবের গল্প বলেছিলাম, ওই যে যার নামে ধ্রুবতারা!"
মনে পড়ল এবার। উত্থানপাদ রাজার ছেলে ধ্রুব। সৎ ভাইকে বাবার কোলে বসতে দেখে বায়না করেছিল সেও বসবে কোলে। কিন্তু তার আবদারে রাজি হননি বাবা। তাই তখন তপস্যা করেছিল ধ্রুব।
গল্প মনে পড়লেও মনের ধাঁধা কাটছিল না।
"দোষের কী আছে? পুরাণকথা তো ভাল!"
মুন্নি এবার আবার সরব।
"তুমি জানো কী হয়েছিল ধ্রুবর?"
মনে পড়ল না ঠিক পুরোটা, তাই ঘাড় নাড়লাম।
"ধ্রুব খুব মন দিয়ে ডেকেছিল গডকে, কী যেন করেছিল… ও ঠাম্মি বলো না গো?”
“কঠিন তপস্যা!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তখন খুব খুশি হয়ে ভগবান ধ্রুবকে নিজের কোলে বসিয়েছিলেন, আর ওকে ষ্টার বানিয়ে দিয়েছিলেন। আরুশীও যদি বাবার কোলে বসতে চেয়ে গডকে ডাকে কী হবে তাহলে?”
“কেন, কী হবে? গড খুশি হয়ে ওর মনের ইচ্ছে পূরণও তো করতে পারেন!”
“না গো না!” মুন্নির গলা এবার যেন আর্তনাদ!
“দেখলে না ধ্রুবর কী হল? বাবার কোলে কি বসতে পেলো? হয়ে গেল স্টার। এবার গড যদি খুশি হয়ে আরুশীকেও নিজের কোলে বসিয়ে নেন, আর তারা বানিয়ে দেন, আমি তো আর কোনদিন ওকে দেখতে পাব না মা!”
আমি হাঁ করে মুন্নির দিকে তাকিয়ে আছি। ও তখনও কাতর স্বরে বলে চলেছে, “এটা ভালো করে বোঝাতেই পারলাম না ওকে। তার আগেই কেঁদেকেটে বাড়ি চলে গেল। ওমা তুমি ফোন করে আন্টিকে একটু বুঝিয়ে বলো না, ও যেন গডকে না ডাকে! প্লিজ মা,প্লিজ… "
হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল এবার আমার মেয়েটা।