আজব কথা - তপাশ্রী (তপা ব্যানার্জী)

 


আজব কথা 
তপাশ্রী (তপা ব্যানার্জী)
 

 



বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা | ক্লাস নাইনে উঠে বেশ কটা টিউশন নিয়েছে রিয়া | অঙ্কের টিউশনটা স্কুলের কাছে সপ্তাহে দুদিন | বান্ধবীদের সাথে স্কুল ফেরার সময় হাঁটাপথে চলে যায় | যাবার সময় বাড়ির লোক না গেলেও ফেরার সময় অবশ্যই বাবা নয় মা নিতে আসে, একা ফিরতে হয় না রিয়াকে | তখন একটু সন্ধ্যে হয়ে যায় - চারিদিক ফাঁকা - লোকালয় কম | গলিপথে পোষ্টের আলোগুলি তেমন স্পষ্ট নয় |

.......আগেরদিন থেকেই স্যার এর শরীরটা খারাপ করেছে | সেদিন ডাক্তারের কাছে যাবে বলে একটু তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে ছুটি দিয়েছিল |এদিকে বর্ষাকাল ; কখন বৃষ্টি আসবে কেউ বলতে পারে না | আজ সবাই আসে নি, বান্ধবী বলতে পিংকি স্যারের বাড়ির পাশেই থাকে একাই চলে গেল | পাপড়ি বলল, "ওর ভাই সাইকেল নিয়ে আসবে ওকে নিয়ে যাবে |" রিয়া একা বসে থেকে কি করবে ! একাই রওনা দিল | ভাবলো মাঝপথে বাড়ির কেউ নিশ্চয় নিতে আসবে; দেখা হয়ে যাবে |

.........স্যারকে এই কথা বলেই রিয়া রওনা দিল | কিছুটা পথ যাবার পর গলিটা শেষ হলেই বড় রাস্তা পড়বে, ততক্ষণে বাড়ির কেউ এসে যাবে | এমনটা ভেবে হাঁটতে শুরু করলো | বড় গাছের ছায়ার সঙ্গে মেঘলা দিনের আলো-আঁধারের খেলায় হঠাৎ বেশ অন্ধকার হয়ে গেল, সন্ধ্যে তেমন হয় নি | গলির পথ যেন শেষ হয় না, এদিকে গাছের ছায়ার ফাঁকে রিয়া আবছা একটা মানুষের ছায়া লক্ষ্য করলো | মনে হলো কেউ ফলো করছে | পেছনে ফিরে বেশ কয়েকবার দেখলেও তেমন কিছুই চোখে পড়লো না, ভাবল ও কিছু না | আবার হাঁটতে শুরু করলো | ছায়াটা যেন এখন বেশ স্পষ্ট হতে লেগেছে | এবার একটু ভয় লাগছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না | একলা জনমানব শূন্য পথ | মাঝে মাঝে বড় বড় গাছগুলি আপাতদৃষ্টিতে রাস্তার ধারে রক্ষী সেজে সতর্ক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও তখন ভয়ে যেন গিলে খেতে চাইছে |

....... রিয়া জানে না সত্যিকারের প্রহরী থাকলে কি করতো ! ভয়ে ওর হাত-পা যেন সিটিয়ে আসছে | এখন ফিরতেও পারবে না অগত্যা এগোতে হবে জেনে নিজেকে বড় অসহায় ঠেকছে | কটা বাজে কে জানে, ঘড়িটা দেখে এলে ভালো হতো ! বাড়ির কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন কে জানে ! তাহলে কি অন্য রাস্তা ধরেছে রিয়া ! এমন অনেক প্রশ্ন রিয়ার মনে ঘোরাফেরা করতে লাগল ।

........ "গাছগুলো দেখে তো ঠিক পথেই আসছি মনে হচ্ছে ! হ্যাঁ; এই পথ দিয়েই মায়ের হাত ধরে ফিরি বলে মনে হচ্ছে ! এ কী ! আবার একটা সরু পথ, কোনদিকে গেলে বাড়ি ফেরার সঠিক পথটা পাবো তাও বুঝতে পারছি না | এখানে কোন লোকালয় নেই যে কাউকে পাবো |" আসলে মাঝখানে একটি মাঠ তারপর চারিদিক থেকে এক একটা সরু গলি দেখে রিয়ার সব গোল পাকিয়ে গেছে | এসব ভেবে একবার পেছন ফিরতেই দেখতে পেল একটা লম্বা টুপি পরা লোক এই পথেই হেঁটে আসছে | দেখে মনে একটু সাহস এলো |

একটু উঁচু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা ! বাগদি পাড়ায় যাবো ! কোনদিকে পরবে বলতে পারেন ?"

লোকটি হাতটা নেড়ে ইশারা করলো ডানদিকে |

.......... আবছা আলোতে যা বোঝা গেল,
সেইদিকে এগোতে লাগল নিশ্চিন্তে রিয়া | খানিক গিয়ে থমকে দাঁড়ালো ! একটা চারিদিক গাছে ঘেরা ফাঁকা মাঠ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না | লোকটি ঠিক বলল ! ..... ভেবে ঘুরতেই দেখে কেউ কোথাও নেই | এবার বুঝতে পারলো ও আবার আগের পথে ফিরে এসেছে | একটা বিপদের আশঙ্কা বুঝলো, বাঁচাবার মতো এখন কাউকে পাবেও না ! ঝির ঝির করে আবার বৃষ্টি শুরু হল, কি করবে ! বেশি বৃষ্টিতে জল জমে সঙ্গে মাঠের কাদা তথৈচব অবস্থা হবে | নিজে একা স্কুল ছাড়া পথে বের হয় না বলে অন্য পথের ভরসা পাচ্ছে না, যেন গোলক ধাঁধায় পড়েছে, অগত্যা কি আর করবে ! কিছু বুঝতে না পেরে কান্না পাচ্ছে | কেঁদে কোন লাভ নেই, কে দেখবে ওর চোখের জল ! ভেবে মন শক্ত করে আবার এগোতে শুরু করলো |

........ভাবলো সোজা মাঠ পেরিয়ে ঠিক কোনো বড় রাস্তা পাবে | তখন কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবে । এই ভেবে খুব জোরে হাঁটতে লাগল | খানিক যেতেই দেখছে আবার সেই ছায়া যেন ওর পিছু নিয়েছে ! অথচ তাকে চোখে দেখতে পাচ্ছে না ! ভীষণ ভয় পেয়ে ভীমরি খাবার জোগাড় ! এমন সময় বেশ কিছুটা আগে একটি লোক যাচ্ছে দেখতে পেল | রাস্তার আলোটা এখানে বেশ স্পষ্ট বলে তাকে দেখে মনে একটু বল আর ধড়ে প্রাণটা ফিরে এল রিয়ার ঐ জনশূন্য স্থানে |

গলা চড়িয়ে রিয়া জিজ্ঞাসা করলো ,"শুনছেন ?"

লোকটি পেছন ফিরে একটু অবাক হয়ে খানিক থেমে জিজ্ঞাসা করলো ,"কোথায় যাবে তুমি ? বাড়ির ঠিকানাই বা কি, একা এই পথে কেন ?"

রিয়ার বাড়ি বাগদি পাড়া বলতেই লোকটি খুব চমকে উঠলো !

সে বলল, "তোমার বাবার নাম কি ?"

রিয়া উওর দিল ।

উওর শুনে লোকটি বলল, "বিশ্বনাথদার মেয়ে তুমি ! আমার পাশের পাড়ায় তাহলে আর চিন্তা কি চলো আমার সাথে |"

....... লোকটির কথা শুনে রিয়ার বেশ সাহস আর ভরসা হলো | একরাশ অন্ধকারে যেন একটু আলোর দিশা | সেই পরিস্থিতিতে মেনে নিতে কষ্ট হলেও বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই ।

......কোন উপায়ান্তর না পেয়ে রিয়া এগিয়ে চলল, পথ শেষ হলে কখন বাড়িতে ফিরবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত হলো | পথ যে আর শেষ হয় না, আবছা আলোয় তার ওপর ছায়া পড়ে অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও পেছনে যে একটা লোক হাঁটছে সেটা ভালোই বোঝা গেল | এইভাবে অনেকক্ষণ হেঁটে মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে এসে পড়লো ওরা | উল্টো দিকে রাস্তার ধারে লাইট পোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখলো রিয়ার বাবা বিশ্বনাথ বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন | তাকে দেখে রিয়া পড়ি কি মরি করে এক ছুট দিয়ে বাবার কাছে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এ যাত্রায় |

"এ কী অমন করে দৌড়ে এলি কেন ? বৃষ্টির জন্য লাইট চলে গেছে বলে আমি ঘড়িটার সময় ঠিক ঠাওর করতে পারি নি |"

বৃষ্টি থামতেই তোর মা তাড়াতাড়ি বেরোতে বলল তোকে নিয়ে যাবার জন্য |

"তুই একা কোন পথে এলি আর কার সঙ্গে এলি বলতো ?"

.......তখনও মেয়ে বেশ জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে দেখে বাবার মনে একটা আশঙ্কা হল | উৎকন্ঠা থেকে বাবার মাথায় হাজার প্রশ্ন ভীড় করতে লাগল !

........বিশ্বনাথ বাবু মেয়ের কথায় জড়তা দেখে ভাবলেন ওকে আগে বাড়ি নিয়ে গিয়ে যা জিজ্ঞাসা করার করবো | পথে আর কোন কথা বললেন না | বাড়ি পৌঁছাতেই মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না, দেখে মনে হবে কেউ খুব বকাবকি করেছে |

...... কিছু বুঝতে না পেরে মা সরাসরি রিয়ার বাবার দিকে তীরটা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ গো মেয়েকে কি খুব বকেছো ? নাকি স্কুলে কিছু হয়েছে ?"

......কিছুই বললেন না বিশ্বনাথবাবু ।
বাধ্য হয়ে মেয়েকে এবার একটু বকুনির সুরে মা বললেন, "কি হয়েছে পরিষ্কার করে বলবি তো !"

......রিয়ার মুখে সব শুনলেন তারা | ঐ ছায়ার মতো মানুষটার কথা শুনে বাবা-মা দুজনেই হেসে উঠলেন | শেষের লোকটি তাদের পরিচিত সেটা দেখেছেন বিশ্বনাথবাবু |

.......পরে টুপি পরা লোকটি পথ দেখিয়েছে শুনে দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন |রিয়া অতটা পথ একা এসেছে শুনে মা তো ভীষণ রেগে গেলেন | অবশ্য সবটা শুনে রাগ প্রশমিত করে মেয়েকে বকতে ছাড়েন নি | বড় কোন বিপদ ঘটলে তারা নিজেদের ক্ষমা করতে পারতেন না |

বারবার বারণ করা সত্বেও কেন একা ফিরতে গেল অপেক্ষা না করে | ভবিষ্যতে যেন এমন না করে সেটা বলে রাখলেন মেয়েকে |

.......অনিতাদি বললেন, "অনেকেই ঐ মাঠের পথ ধরে সকালে গেলেও সন্ধ্যার পর থেকে কেউ যায় না | তুই একা ঐ পথ ধরে এসে ভুল করেছিস বটে ! কিছু যে হয় নি এই বেশি !"

...... রিয়া মায়ের কথায় কিছু একটা ইঙ্গিত লুকানো আছে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো, "কেন মা বলো না ?"

....."না ও সব আমরা বিশ্বাস করি না, তবে এর আগেও অনেকেই এমন সব ঘটনা দেখেছে বলে শুনেছি | তুমি কেন যে ঐ মাঠের ভেতরের বড় বড় গাছের ছায়া ঘেরা পথ দিয়ে ফিরতে গেলে কে জানে !"

রিয়ার কৌতুহল ভীষণ বেড়ে গেল মায়ের কথাগুলি শুনে !

......অনিতাদি বলতে লাগলেন, "ঘটনাটা হল অনেক বছর আগে ওখানে একটা বড় বাগান ছিল | তাতে বড় বড় আম জাম কাঁঠাল ছাড়াও অনেক গাছ ছিল | মাঠের ধারে নিম, তেঁতুল, বট, অশ্বত্থ আরও কি সব গাছ ছিল | তখন কারা যেন সেই ফলের গাছগুলি কেটে দেয় জমিটা বিক্রি করবে বলে | যার জমি সে পরে জানতে পেরে মামলা - মোকদ্দমা করে, জমিটা বিক্রির হাত থেকে বাঁচে | এসব শুনেছি তোমার দাদু-ঠাম্মার কাছে |"

.......সেই থেকেই জমিটা ফাঁকা পড়ে আছে | মাঝে চারপাশের ছেলেরা জমিটায় খেলাধূলা করেছে বলে মাঠ নাম হয়েছে | আমাদের পাড়ার দুজন পর পর ঐ তেঁতুল না নিম গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে ভয়ে ও পথে কেউ যায় না | অনেকেই বলে এখনও তাদের প্রেতাত্মা নাকি ঘোরাফেরা করে | এসব শুনে জমির মালিক তাদের বাড়িতে অনেক পূজাপাঠ - যজ্ঞ করেছে, তবু মানুষের মনে সেই ভয়টা রয়েই গেছে |

.......কথাগুলি বলতেই মাকে ধরে রিয়া বলে উঠলো, "আমি তাহলে যাকে দেখলাম সেটা কে ? সেই ভূত না প্রেআত্মা বলে - তাই ?" বলেই মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো | বাবা-মা তখন মেয়ের চোখেমুখে জলের ছাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরায় আর বুঝিয়ে বলে ওসব কিছু না, ছায়াকে ভয়ে তুই অমন দেখেছিস | সেদিন মেয়েকে সাত্ত্বণা দিলেও পরেরদিন সকালবেলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারা ।

.......ডাক্তার দেখে বললেন, "খুব ভয় পেয়েছে সেই আতঙ্ক থেকে একটা ট্রমা কাজ করছে | কিছুদিন বিশ্রাম আর একটু পথ্য খেলে ঠিক হয়ে যাবে | ততদিন একা বেরোতে দেবেন না |"

" যারা এই গল্পটি পড়ে ভূতে বিশ্বাস করলেন না, তারা যেন এমন জনশূন্য পথে একলা কখনও পেছনে ফিরে দেখবেন না | "

         .................................
 
অলঙ্করণ :-  পায়েল খান