রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

গলা তুলতে লাই - ময়না মুখোপাধ্যায়

গলা তুলতে লাই

ময়না মুখোপাধ্যায়

 



- ধর্মাবতার এই যে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত তরিনি সোরেন ওকে ওপর থেকে দেখতে যতই শান্ত সহজ লাগুক আসলে ও একটা নৃশংস মনের খুনী। ওর এই চুপ করে থাকা, কিছু বুঝতে না পারা সব একটা নাটক, একটা চিত্রনাট্য, যেটা ওরই উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। এভাবে শাস্তি এড়াতে চাইছে ও ধর্মাবতার।

সরকারি উকিলের একটানা বলে যাওয়া কথাগুলো টুসুর কানে আর অর্থবহ হয়ে উঠছিল না। শব্দগুলো কেমন দলা পাকিয়ে একটা জড়ানো ঝিঁঝিঁর গুঞ্জনের মত তার কানের পাশে ঘোরাফেরা করছিল শুধু। টুসুর মাথাটা টলছিল, পা ভেঙে আসছিল তবু সে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যেতে লাগল। কতক্ষণ ধরে কত কথা চলল, কেউ হাসল, কেউ টিটকিরি দিল কিন্তু তার একবর্ণও টুসুর কানে ঢুকল না। বোধ ফিরল তখন যখন একটা মেয়ে পুলিশ তার হাত ধরে টান দিয়ে কাঠগড়া থেকে তাকে নামাল। টুসু এলোমেলো দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার তাকাল তারপর পা ঘষে ঘষে মেয়ে পুলিশটার সাথে ভ্যানে গিয়ে উঠল। এরকম কতদিন ধরে চলছে আরো কতদিন চলবে সেসব হিসেব টুসুর মনে থই পায় না। সে শুধু জানে তার একদিন শাস্তি হবে। প্রথমবার যেদিন তাকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে বিচারক জিজ্ঞাসা করেছিল,
- তরিনি সোরেন তোমার বিরুদ্ধে যে সুনীল মরান্ডিকে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে তা কি তুমি মেনে নিচ্ছ ? 
টুসু নির্বাক হয়ে চারিদিকে তরিনি সোরেনকে খুঁজে বেরাচ্ছিল। সে ভুলেই গেছিল তরিনি বলে তার একটা নাম ছিল যেটা পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার সময় বড় দিদিমণি দিয়েছিল। দিদিমণি বলেছিল,
- টুসু তো ঘরের নাম। বাইরের একটা নাম লাগে। 
টুসুর বাপ হাঁ করে চেয়ে বলেছিল, 
-বাইরের নামটা আবার কি বট্যে। 
দিদিমণি হেসে বলেছিল, 
-ও তোমার বুঝতে হবে না আমি টুসুর নাম দিলাম তরিনি। 
টুসু বিচারকের কথার জবাব না দিয়ে ভাবতে থাকে একটা মানুষের কতগুলো মন, কতগুলো রূপ আর তার মাত্র দুটো নাম তাও সে ভুলে গেল। ভালো হত যদি নানা রূপের নানা নাম থাকত তবে বলা যেত এটা তরিনি করেনি গো, এটা টুসু করেছে। তরিনি তো পড়ালেখা জানা মেয়ে হত। তার কি এমন করতে হত। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে যায় উকিলের গর্জন শুনে, 
- হুজুর কি বলছেন শুনতে পাচ্ছ না ? উত্তর দাও।
টুসু ভিড়ের মধ্যে হুজুরকে খুঁজতে খুঁজতে বলে,
- আমি কিছু জানিনে কো হুজুর।
উকিল তরবরিয়ে ওঠে,
- দেখেছেন হুজুর বলেছিলাম না এ মেয়ে ছেনাল আছে। 
বিচারক বলে,
- ভাষায় সংযম রাখুন।
টুসুর মনে পড়ে কে যেন বলেছিল, শালী সংযম দিখাচ্ছে। টুসু কি জানে সংযম কি, কিভাবে দেখাতে হয়। অত কি লেখাপড়া করেছে সে। দু কেলাস পড়েই তো তার ছুটি হয়ে গেল। মায়ের আবার বেটা হল। তাকে মানুষ করবে কে। সরকারি দিদি আসলে তাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিল,
- সংযম কি লা দিদি ? 
ভেবেছিল খারাপ কথা হবে। সরকারি দিদি বলল, 
- ওই কেউ খারাপ কথা বললে তাকে খারাপ কথা না বলা। 
টুসু জেনে খুশি হয়েছিল। বলেছিল,
- ও তাই বল। ই তো আমরা সব্বসময় দিখাই।  আমার মা বলেছিল যে, টুসু ম্যেইয়াদের গলা তুলতে লাই, জিগাস করতে লাই, নিতি মরদের হাতে দু ঘা খ্যেইয়ে লিতে হয়। তবে লা ঘরকে শান্তিটো থাইক্যে। 
তা টুসু মারঝাপটা কতোই না খেয়েছে সংযম দেখিয়ে। তা শান্তিটা তার জীবনে থাকল কই। 

কদিন না কমাস যেন থানা আদালত ঘুরপাক খেয়ে শাস্তিটা হয়েই গেল টুসুর। সরকারি উকিল শেষটা যেদিন বলছিল সেদিন টুসু একটুও উদাস হয়নি, টালমাটালও করেনি, সব শক্তি দিয়ে কান মাথা খুলে সব শুনেছিল। উকিল বলেছিল,

- হুজুর এই তরিনি যখন পাঁচ বছর আগে বিধবা হয়ে ঘরে ফিরেছিল তখন তার বাপ মরেছে, মা মরোমরো। দুবছর পরে মা মরলে ভাইরা তাকে আর ঘরে রাখতে চায়নি। ওর দিদি সুবু মরান্ডির বর সুনীল মরান্ডি তখন ওকে আশ্রয় দেয়। দুই বছর সে সেখানে আদর যত্নেই ছিল। নইলে কখনো কি কারোকে তরিনি খারাপ থাকার কথা জানাতো না। তরিনির দিদি সুবু বিছানায় শয্যাশায়ী ছিল বহুদিন আর সেই সুবাদে তরিনি সংসারের কর্ত্রী হয়ে ওঠে। বছর খানেক আগে সুবু মারা গেলে সুনীলের বাড়িতে অশান্তি শুরু হয়। সুনীল মারা যাবার আগে বয়ান দিয়ে গেছে তরিনি দুশ্চরিত্রা ছিল, নানা ছেলেকে ঘরে ঢোকাতো। ঘটনার দিন সুনীল ঘরের থেকে অন্য ছেলেকে বেরোতে দেখে তরিনিকে মারতে গেলে তরিনি খড় কাটার বটি দিয়ে নৃশংস ভাবে সুনীলের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়। সুনীলের চিৎকারে সবাই ছুটে যায়, পুলিশ ডাকে। পুলিশ আসলে সুনীল এই বয়ান দিয়ে মারা যায়। আর দেখুন হুজুর এই মেয়ে যদি নিরপরাধ হত তবে কি একবারও বলত না ও খুন করেনি। একটুও কি কান্নাকাটি করত না, আপনার দয়া ভিক্ষা করত না। আমার ওকালতির জীবনে এমন শক্ত মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। এ পাক্কা খুনি হুজুর। একে কঠোর শাস্তি দিন।

তরিনি অলস চোখে কাঠগড়ার কাঠ দেখতে দেখতে মনকে বলে সংযম টুসু, সংযম, গলা তুলতে লাই। বিচারক রায় দেন।
- যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। 
রায় শেষে মেয়ে পুলিশ যখন তাকে ভ্যানে তুলছে তখন চারিদিকে থইথই ভিড়। আওয়াজ উঠছে খুনি, ছেনাল মেয়েছেলে। এমন শক্ত খুনি মেয়ে আবার কবে দেখা যাবে কে জানে তাই ভিড় উপচে পড়ছে। 

টুসু আজ খুব নিশ্চিন্ত। তার যা হওয়ার হয়ে গেছে তা নিয়ে সে ভাবিত নয়। কিন্তু মার কথা সে রেখেছে সে কথা বলেনি। তবে তার যা করার ছিল তা সে করে দিয়েছে। এ কটা রাত সে ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমাবে। কত কথা ভিড় করে আসে টুসুর মনে। যেদিন তার বরটা মদ খেয়ে লিভার পচে মরে গেল তখন সে মাত্র সাতমাসের নতুন বৌ। শ্বশুর ঘরে ঠাঁই হল না ভাতারখাকি মেয়েমানুষের। বাপের ঘরে মা'টা ছিল তাই উঠতে পেরেছিল। যে ভাইদুটোকে হাতে করে বড় করেছিল তারাই বলল যে কদিন মা সে কদিন তুই। দুবছর যেতে না যেতে মা'টাও মরে গেল। তখন অকূল পাথারে পড়েছিল টুসু। আঠেরো বছরের ডবকা ছুড়িকে কে ঘরে নেবে।ওই সুনীল মরান্ডি তাকে সেধে নিয়ে গেল দিদি সুবুর ঘরে। সুবুর তখন একটা দশ বছরের মেয়ে আর একটা সাত বছরের ছেলে। সুবুর কি অসুখ কেউ জানে না কিন্তু বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা তার ছিল না। টুসু গিয়ে হাল ধরল সংসারের। দিদির ছেলে শিবু আর মেয়ে পাকুকে নিজের সন্তানের মত পালত সে। দিদি বিছানায়, তার শরীর কথা বলে না তাই শরীরের ক্ষিদে মেটাতে একদিন সুনীলের চোখ পড়ল টুসুর ওপরে। টুসু ভেবেছিল পালিয়ে যাবে। সুবু হাতযোড় করল তার সামনে। জলভরা চোখে বলেছিল,
-  আমি বাঁচব লাই টুসু। তবে মরার আগে তোর সাথে উয়ার বিয়্যাটা দিয়া যাব। 
টুসু বুঝেছিল গলা তুলতে লাই। মনকে বুঝিয়ে ছিল ঘর পাব, মরদ পাব, সন্তান পাব আর কি চাই। সুনীল যখন তার শরীরের ওপর চাপতো তার গা ঘিনঘিন করত বমি আসতো তবু সে গলা তোলেনি। একদিন সুবু মরে গেল। পাকু আর শিবুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে ছিল টুসু। ওরা মানুষ হোক। বছর খানেক কাটল। টুসুর যত্নে বার বছরের পাকুকে তখন চোদ্দ পনের বছরের ডবকা লাগে। ছেলে মেয়ের সামনে টুসুর লজ্জা লাগে শরীর দিতে। একদিন সুনীলকে সেকথা বলায় সে টুসুকে সপাটে চড় মেরে বলে ওঠে,
- মাগী সংযম দিখাচ্ছে আমায়।
সেও সহ্য হয়েছিল কিন্তু যেদিন নেশা করে সুনীল পাকুর ওপর চড়াও হল সেদিন আর টুসুর সহ্য হয়নি। সেদিনও সে গলা তোলেনি তবে হাত তুলেছিল। খড় কাটার বটিটা সোজা বসিয়ে দিয়েছিল উদোম লোকটার অহংকারে। ভেবেছিল যদি মরে যায় ভালো আর বেঁচে গেলে যেন কেন্নোর মত গুটিয়ে থাকে সারাজীবন। সে আদালতে প্রাণ ভিক্ষা চায়নি। শুধু চেয়েছিল পাকুর নাম যেন একবারের তরেও না ওঠে। সত্যি ঘটনাটা জানলে হয়তো হুজুর তাকে মাপ করে দিত কিন্তু পাকু, তার গায়ে যে দাগ লেগে যেত। পাকুকে দিব্যি দিয়ে এসেছিল যাতে সে মুখ না খোলে। শুধু সরকারি দিদিকে বলে এসেছিল পাকু আর শিবুকে যেন একটা অনাথ আশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করে দেয়। 
 
টুসু আজ জেলে যাবে। সরকারি দিদি এসেছে পাকু আর শিবুকে নিয়ে। একবার দেখা করতে।  ওরা এখান থেকে অনাথ আশ্রমে চলে যাবে। দিদি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যতদিন টুসু ছাড়া না পাবে ততদিন ওরা সেখানেই থাকবে। টুসু পাকুর মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
- গলা তুলতে হয় পাকু, দরকার হলে গলা তুলবি।
                            

................................

অলঙ্করণ :-  পায়েল খান

 



 

সাক্ষী ছিল না - দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

সাক্ষী ছিল না
দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
 
 

 


                টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই ওরা শিলিগুড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল। শুকনা পার হতেই বৃষ্টির তেজ বেশ বেড়েছিল। আরিয়ান একবার বলেছিল এই বৃষ্টিতে আর এগিয়ে কাজ নেই, কিন্তু ময়ঙ্ক হেসে বলেছিল -''তুই এই ডুয়ার্সের ছেলে হয়ে বৃষ্টিকে ভয় পাচ্ছিস?''

-''আমার ঐ ইকো রিসর্টে যাওয়ার ইচ্ছাই ছিল না। তোরা রাজি হলি বলে যাচ্ছি।''

-''ধুর, যাবো না কেন? এই ফাঁকে দুদিন ঘোরাও হবে।''

সাহিল কানে হেড ফোন গুঁজে বসেছিল প্রথম থেকেই। ওদের কথা হয়তো কানে গেছিল। তাই আদেশকে বলেছিল -''বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় একটু সাবধানে চালাস ভাই। এত তাড়াতাড়ি দেওয়ালে ছবি হতে চাই না।''

দুধিয়া পার করে ওদের গাড়ি তখন পাকদণ্ডি পথে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু আরও কিছুটা ওপরে ওঠার পর ওদের ঘিরে ধরেছিল এক রাশ জল ভরা মেঘ। আগে পিছে কিছুই আর দৃষ্টি গোচর হয় না। ফগ লাইট জ্বালিয়েও গাড়ি নিয়ে এগোতে ভয় পাচ্ছিল আদেশ।

শেষে ময়ঙ্ক ওকে সরিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। বলল -''নবনীতটা আর বিয়ে করার দিন পেল না!''

ওরা চার বন্ধু চলেছে মিরিকের পথে, একটা ছোট্ট গ্ৰামে। ওদের বন্ধু নবনীতের একটা ইকো রিসর্ট রয়েছে ওখানে। এর আগেও বহুবার নবনীত ওদের ডেকেছে। কিন্তু একসঙ্গে চারজনের যাওয়া হয়েই ওঠে না। গত সপ্তাহে নবনীত হঠাৎ ফোন করেছিল ওদের যে ও বিয়ে করছে। স্বাধীনতা দিবসে ওর বিয়ে, করোনার জন্য কোনও অনুষ্ঠান করছে না। তবে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে উইক এন্ডটা ও এনজয় করতে চায় ইকো অরেঞ্জ রিসর্টে। বিগত পাঁচ মাস এই অতিমারিতে জনজীবন প্রায় স্তব্ধ। তাই ও এভাবে বিয়েটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সাহিল হঠাৎ বলে -''আচ্ছা নবনীত ঠিক কাকে বিয়ে করল তোরা কিছু জানিস!ও তো ভালবাসত...” কথাটা শেষ করে না ও আর।

সবাই চুপ।

কয়েক সেকেন্ড পর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আদেশ বলে -''একটা মেয়েকেই বিয়ে করবে নিশ্চই। ওর গিফটটা এনেছিস তো ময়ঙ্ক।''

হঠাৎ করে বন্ধুর বিয়ের খবর পেয়েছিল ওরা গত সপ্তাহে। ময়ঙ্কের পৈতৃক সোনার দোকান। এখন তো অতিমারিতে দোকানপাট ঠিকমত খোলে না। তাই ওরা সবাই মিলে ময়ঙ্ককেই উপহার কিনতে বলেছিল।

ময়ঙ্ক গাড়ি চালাতে চালাতে মাথা নাড়ে।


শনিবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সবার ছুটি। করোনার জন্য এসময় ব‍্যবসা সে ভাবে চলছে না। রাস্তাঘাট শুনশান। কিন্তু এই বৃষ্টিতে যে পরিস্থিতি এমন ভয়ানক হয়ে উঠবে ওরা বুঝতে পারেনি।

সামনের বাঁকটা বিপদজনক ভাবে পেরিয়ে ময়ঙ্ক গাড়িটা পাহাড়ের ঢালে দাঁড় করায়। আর মাত্র কয়েক কিমি পথ বাকি। কিন্তু পুরোটাই হেয়ার পিন বাঁক। এপথে একটু ভুল করলেই বিপদ।

সিটের নিচ থেকে একটা বিয়ারের ক্যান বের করে একাই চিয়ার্স করে আদেশ বলে -''বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। লেটস এনজয় দা রেইন।''

আরিয়ান আরেকটা ক্যান তুলে বলে -''তবে তাই হোক। নবনীতের বিয়ে উপলক্ষে আমরা এখানেই আসর জমাই।''

সাহিল ময়ঙ্ককে বলে -''আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেই ভালো হত। অন্ধকার হয়ে আসছে। কোনও বড় গাড়ি উপর থেকে নামার সময় আমাদের দেখতে না পেলে... নিউজ হয়ে যাবো ভাই। এমন কিন্তু হয় পাহাড়ে।''

ময়ঙ্ক দাঁতে দাঁত চেপে আবার গাড়ি স্টার্ট করে। আধঘণ্টার পথ দেড় ঘণ্টায় পার করে ওরা যখন ইকো অরেঞ্জ রিসর্টে পৌঁছয় তখনো বৃষ্টি পড়েই চলেছে। কিন্তু তেমন কোনও লোকজন ওদের চোখে পড়ল না। দারোয়ান বলল ছয় নম্বর কটেজে রয়েছে নবনীত। কটেজটা একটা ছোট টিলার উপর। একদিকে গভীর খাদের উপর ঝুলন্ত বারান্দা। বৃষ্টির জন্য অন্ধকার আজ আরও বেশি ঘন।

আপাতত ব‍্যবসা নেই বলে সব স্টাফকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল নবনীত। ওরা ছ’নম্বর কটেজে পৌছতেই খিলখিল করে মেয়েলী হাসির আওয়াজ ভেসে এল।

আদেশ আর ময়ঙ্ক নবনীতের নাম ধরে ডাকতেই ও বেরিয়ে আসে। হলুদ পাঞ্জাবিতে ওকে বেশ অন্যরকম লাগছে।


-''চলে এলাম, এবার বল কী প্ল্যান? আর তোর বৌ কই? আলাপ করা।'' আরিয়ান বলে।

ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে নবনীত বলে -''দাঁড়া, এত তাড়া কিসের। অনেকটা পথ পার করে এলি তোরা। বস, রেস্ট কর। মংলুকে বলি ড্রিঙ্কস দিতে। বৌ তো পালিয়ে যাচ্ছে না আমার।''

ওদের কটেজের প্রথম ঘরটায় বসায় নবনীত। বাইরে একঘেয়ে বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ।

-''তোরা কি ফ্রেশ হবি? তবে পাঁচ নম্বর ঘরটা খুলে দেবে মংলু।'' নবনীত বলে।

-''আগে বৌ দেখি, আলাপ হোক।'' সাহিল বলে।

-''ও একটু তৈরি হচ্ছে। তোরা বস। আমি মংলুকে বলে দেই।'' পাশের ইন্টার কম ফোনটা তুলে নেয় নবনীত।

-''আর লোকজন... মানে তোর স্টাফেরা...?'' আদেশ বলে।

-''সবাইকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। ব‍্যবসাই তো বন্ধ। শুধু মংলু রয়েছে পরিবার নিয়ে। ও এই রিসর্টের কেয়ারটেকার।''

ওরা গুছিয়ে বসতেই মংলু ড্রিঙ্কস আর পকোরা নিয়ে হাজির হয়। ময়ঙ্কের এখানে আসার পর থেকেই মাথাটা কেমন ধরে ছিল। মেজাজটাও কেমন তাল কেটে গেছে। ও একটা হুইস্কির বোতল টেনে নেয়।

-''সবে বিয়ারটা খেলি, এখনি ওটা খাস না।'' সাহিল বলে। কিন্তু ময়ঙ্ক ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে গ্লাসে ভরে নেয় সোনালী তরল। বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ঝমঝম করে বৃষ্টিটা হয়েই চলেছে।

আদেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে -''আমার এখানে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না! তোদের জন্য এলাম।''

-''বোকার মত কথা বলিস না। এই রুটে আমি বহুবার এসেছি।''

-''কিন্তু...!'' কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় আদেশ। দূরের পাঁচ নম্বর কটেজের বারান্দায় একটা সাদা কুর্তি পরা মহিলার অবয়ব যেন ওদের দিকেই চেয়ে রয়েছে।

-''কিরে, তোরা এই ঝোড়ো হাওয়ায় বাইরেই থাকবি নাকি। করোনা না হলেও নিউমোনিয়া হয়ে যাবে কিন্তু তোদের।'' আরিয়ান ওদের ডাকে ভেতর থেকে।

-''তোর পাঁচ নম্বর কটেজে কি গেস্ট আছে নবনীত!!" ঘরে ঢুকে কাঁপা গলায় বলে আদেশ।

-''এই অতিমারিতে ট্যুরিজম লাটে উঠেছে। গেস্ট আসবে কোথা থেকে?'' বলে ওঠে নবনীত।

খিলখিল করে কে যেন হেসে ওঠে ওদের কথায়। আদেশ চমকে ওঠে। কিন্তু বাকিরা শান্ত। তবে কি নবনীতের স্ত্রী!

আরিয়ন ভেতরে ডাকে ময়ঙ্ককে -''মশা মাছি তো কম নেই বাইরে। ভেতরে চলে আয়।''

ও ভেতরে এসে বসে।

একটু পরেই মংলু গরম গরম নাগেটস আর পেয়াজি নিয়ে আসে। আদেশ ওকে বলে -''আমরা ছাড়া আর কেউ আছে নাকি এই রিসর্টে?''

-''নেহি সাব। কিউ?''

উত্তর দেয় না আদেশ। মনে মনে ভাবে তবে ওটা মংলুর বৌ হবে।

একটা নাগেটসে কামড় দিয়ে সাহিল নবনীতকে বলে -''কি রে তোর বৌ আর কত সাজবে? ডাক এবার।''

নবনীত একবার ভেতরের ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসে। ও গায়ে একটা হাল্কা শাল জড়িয়েছে।

এবার সবার হাতেই শোভা পাচ্ছে পানীয়র পাত্র। আদেশ নবনীতের দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিতেই ও বলে-''তোরা নে, আমি ভাই ছেড়ে দিয়েছি ও সব। আর আজ তো একদম নয়।''

-''কেন? তোর বৌয়ের বারণ বুঝি! বিয়ে হতে না হতেই তুই শালা স্ত্রৈণ হয়ে গেলি! জরু কা গোলাম!'' ময়ঙ্ক হাসতে থাকে। ওর রসিকতায় সবাই হেসে ওঠে।

-''ছাড় আমার কথা। তোরা এনজয় কর। রাতে বিরিয়ানি আর কাবাব বলেছি। মংলু যা বানায় না! ফাটাফাটি! আমি একবার দেখে আসি ওদিকটা।''

একটা ছাতা নিয়ে ও এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। একঘেয়ে বৃষ্টিটা হয়েই চলেছে।

ময়ঙ্ক এবার উঠে দুই ঘরের মাঝের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে বলে -''আরে নতুন বৌদি, এ ঘরে আসুন। আর সাজতে হবে না। ''

সাহিল আর আরিয়ান বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ঘরটা সিগারেটের ধোয়ায় ভারি হয়ে উঠেছে। খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকায় আকাশে। আর দিনের আলোর মত চারদিক সাদা হয়ে ওঠে। সেই আলোয় পাঁচ নম্বর কটেজের দিকে চোখ পড়তেই কেমন সাদা হয়ে যায় ওর চেহারা। কে ওটা? ও কি কিছু ভুল দেখল!

-''তুই কি কাউকে দেখতে পেলি ওধারে?'' কয়েক সেকেন্ড পর সাহিল বলে। আরিয়ান উত্তর দিতে ভুলে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মনে হয় একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে এদিকে।


-''কিরে, এমন ভাবে কী দেখছিস?" ছাতাটা বন্ধ করতে করতে বলে নবনীত।

-''তুই... তুই ঐ পাশের কটেজটার বারান্দায় ছিলি?''

-''আমি তো কিচেনে সব দেখে আসলাম। রুমি বের হয়নি এখনো?'' নবনীত ভেতরের ঘরে দিকে তাকায়!

-''রুমি... এখানে!'' সাহিল বলে।

-''ও হো, সারপ্রাইজ ফ্রেন্ডস! আমি রুমিকেই বিয়ে করেছি। এই রুমি, এবার বাইরে এসো।'' নবনীতের ডাকাডাকিতে ভেতরের দরজা খুলে যায়। আর চার জোড়া চোখ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে হাল্কা গোলাপি শিফন পরা যে রুমি ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

ময়ঙ্ক হিসহিস করে বলে -''এসব কি নবনীত? রুমি এখানে কোথা থেকে...!''

-''কেন? রুমিকে তো তোরা সবাই চিনতিস। সাহিল তো জানতিস আমাদের ব‍্যপারটা। আর ময়ঙ্ক তুই তো শুনেছিলি গতবছর যে রুমি আমাকে বিয়ে করবে!'' নবনীত রুমিকে নিয়ে এগিয়ে আসে।

বাইরে বৃষ্টির তেজ বেড়েছে।

রুমি খিলখিল করে হেসে ওঠে, বলে -''আমায় দেখে তোমার বন্ধুরা কেমন ভয় পেয়েছে দেখো!''

-''সরি রুমি, আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইছি।'' আরিয়ান হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।

-''এনাফ ইজ এনাফ। এটা রুমি নয়।হতে পারে না।নবনীত, দা গেম ইজ ওভার।'' ময়ঙ্ক চিৎকার করে ওঠে।

-''ও যদি রুমি হয় ও গত এক বছর কোথায় ছিল?'' আদেশ বলে।

-''আরে, এক বছর কোথায় ছিলাম তোমরা জানো না?'' আবার হেসে ওঠে রুমি।

-''নবনীত কাজটা ভাল করলি না। এভাবে আমাদের ডেকে এনে... !'' ময়ঙ্ক বলে। ওর চোখ দুটো টকটকে জবা ফুলের মত লাল।

-''রুমি যা হয়েছে ভুলে যা। আমরা ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা চলে যাচ্ছি।'' আরিয়ন বলে।

-''দাঁড়াও, এই বৃষ্টিতে কোথায় যাবে?'' রুমি বলে।

-''আরিয়ান, সাহিল চলে আয়। ইটস আ ট্র্যাপ। ময়ঙ্ক...!'' আদেশ বেরিয়ে যেতে চায়।

-''ওয়েট ওয়েট, কী হয়েছে তোদের? কেন এমন করছিস?'' নবনীত প্রশ্ন করে।

-''শোন নবনীত। রুমি কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। ও তো বেঁচেই আছে দেখছি...!" ময়ঙ্ক বলে।

-''হ্যাঁ, বেঁচে আছি। কিন্তু আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল...'' রুমির চোখ দুটো জ্বলে ওঠে।

-''এবারের মত ক্ষমা কর আমাদের। আমরা চলে যাচ্ছি। ভুলে যা যা ঘটেছে...'' আরিয়ান আর্তনাদের স্বরে বলে ওঠে।

-''নিজেকে বড্ড চালাক ভাবিস তুই! এবার দেখ।'' আদেশের হাতে উঠে এসেছে একটা 4.25 mm লিলিপুট। হিসহিসে গলায় আদেশ বলে -''সেদিন তুই কি করে বেঁচে গেছিলি জানি না, আজ তুই আর নবনীত দুজনের একটাকেও ছাড়ব না।''

-''কী করছিস আদেশ?'' নবনীত দু পা পিছিয়ে যায়।

-''গত বছর এই পাহাড়ে এসেই রুমির শরীরটা আমরা ভোগ করে একটা পাহাড়ের খাদে ছুড়ে ফেলেছিলাম। ও যে বেঁচে যাবে ভাবিনি। বড় অহংকার ছিল ওর..., কিন্তু আজ আর সেই ভুল করবো না।''

ফায়ারিং এর আওয়াজে সবাই চমকে ওঠে। আদেশের রিভলভার ছিটকে পড়েছে, হাত চেপে বসে পড়েছে আদেশ। তিনজন লোক ওদের ঘিরে ধরেছে।

সাদা চুড়িদার পরা এক মহিলা এগিয়ে আসেন। বলেন -''ওয়েল ডান সুমি, ওয়েল ডান নবনীত। ইনস্পেক্টর ভুজেল, রুমেলা থাপাকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে এদের চারজনকে এরেস্ট করো।''

শালের নিচ থেকে একটা ছোট ক্যামেরা বার করে দেয় নবনীত। সেটা হাতে নিয়ে মহিলা বলেন – “সবটা রেকর্ড করেছ তো?”

মাথা নাড়ে নবনীত।

একজন ওদের হাতকরা পরাতে এগিয়ে যায়। আদেশ সহ বাকি তিনজনের চোয়াল ঝুলে পড়েছে তখন।


*****

-''ওয়েল ডান অফিসার দময়ন্তী। এবার বলুন কী ভাবে এই আনসলভ মিষ্ট্রিটা সলভ করলেন?'' এসিপি সিনহা প্রশ্ন করেন। ওরা সবাই বসেছিল দার্জিলিং কমিশনারেটে। এক বছর আগে হারিয়ে গেছিল রোমিলা থাপা। ওর বোন সুমেধা থাপা বার বার থানায় জানিয়েছিল রোমিলা শিলিগুড়িতে পড়াশোনা করত, গত বছর স্বাধীনতা দিবসে চার বন্ধুর সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরতে গেছিল। অথচ ওর এই বন্ধুরা বলেছিল রুমি আসেনি ওদের সঙ্গে। আমরা রুমির ফোনের টাওয়ার চেক করে দেখেছিলাম সে মিরিকের দিকেই ছিল সেদিন সারাদিন। বিকেল থেকে তার ফোন বন্ধ ছিল। গত তিনমাস আগে পাহাড়ে মধু সংগ্ৰহ করতে গিয়ে এক গিরিখাতের ভেতর একটা পচা গলা কঙ্কাল দেখতে পেয়ে আমাদের জানিয়েছিল। কঙ্কালের ডিএনএ টেস্ট করে আমরা জানতে পারি ওটাই রুমেলা অর্থাৎ রুমি। সুমি ওর এক বছরের ছোট বোন প্রায় এক রকম দেখতে, ও থাকত সিকিমে দাদুর বাড়ি। সুমি আর রুমির বন্ধু নবনীত বারবার বলেছিল ওরা চারজন রুমির অন্তর্ধানের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু প্রমাণ ছিল না। বাধ্য হয়ে সুমিদের সাহায্য নিয়ে এই ছোট্ট নাটকটা করতে হয়েছিল। সুমিকে রুমির মতো সাজিয়ে প্লেস করার প্ল্যানটা নবনীতের। বাকিটা তো দেখতেই পেলেন।''

-''অপরাধ সাক্ষী রেখে না গেলেও তোমরা অসাধ্য সাধন করেছো। আই রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ।'' এসিপি সাহেব বলেন।

সুমি ও নবনীত বেরিয়ে আসে থানার বাইরে। আজ রুমির আত্মা অবশেষে শান্তি পাবে।
..................................
 
Debdutta Banerjee
 

 অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি

 
 

 


অন্ধকারে খুনের খেলা -কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 



অন্ধকারে খুনের খেলা
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
 
 
বিল্ডিংটার গা ঘেঁষে বডিটা পড়ে আছে । স্থির, নিথর একটা দেহ । দেখে অ্যাপারেন্টলি মনে হয়, প্রায় থেঁৎলেই গেছে মাথাটা । একটা হাত গুঁজড়ে আছে শরীরের তলায় । ডান পা-টা ভাঁজ হয়ে গেছে, আর বাঁ পায়ের চটিটা খুলে গিয়ে পড়ে আছে একটু দূরে । তবে শরীরের কোথাও কোনও রক্তের দাগ নেই, শুধু মাথাটা কেৎরে আছে বাঁ দিকে, আর সেই মাথার তলার দিক থেকে শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া রক্তের ধারা খানিকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে ।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে সুতীর্থ সান্যাল উঠে দাঁড়াল বডির পাশ থেকে । এস-আই দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম ভদ্রলোকের ?”
“সেটা তো এখনও জানা যায়নি । এই বিল্ডিং-এর কেউই এঁকে চেনে না বলছে । অথচ এই বাড়িটার ওপর থেকেই যে পড়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ।” সাব ইন্সপেক্টর মলয় দত্ত পাঁচতলা বিল্ডিংটার ওপরদিকে তাকাল ।
সুতীর্থও একবার বিল্ডিংটার ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল । তারপর ধীরে ধীরে দৃষ্টি নামিয়ে আনল একটু একটু করে । গোটা বাড়িটার সবগুলো তলা জরিপ করে নিচ্ছিল ওর দৃষ্টি । ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন কনস্টেবল । আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল বিল্ডিংটার দু-চারজন লোক আর একজন দারোয়ান । চোখে কৌতূহল, কিন্তু পাশাপাশি মনের মধ্যে ধুকপুকুনি । পুলিশ ওদের এই মুহূর্তে এলাকা ছাড়তে বারণ করেছে । তার মানেই জেরা আর টানাহেঁচড়া চলবে । আর যদি জানা যায় যে এটা মার্ডার, তাহলে তো আর দেখতে নেই ।
সেইসময় দত্ত বলল, “কী বুঝলেন ? সুইসাইড না খুন ?”
সুতীর্থ সোজাসুজি দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা বাইরের লোক আত্মহত্যা করার জন্যে অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকে একেবারে ছাদে চলে যাবে, কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য ?”
“রাইট । আমিও সেটাই ভাবছিলাম মিঃ সান্যাল । তার মানে এই বাড়িরই কেউ একে সঙ্গে করে এনেছে, তারপর ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে খুন করেছে, তাই না ?”
সুতীর্থ অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “হতেও পারে, নাও হতে পারে । কেউ একে নিয়ে এলে দারোয়ান দেখতে পেত না ?”
দত্ত একটু বিব্রত হয়ে বলল, “সেটাই তো সমস্যা । দারোয়ানের ঘরটা থেকে যদিও সিঁড়ি আর লিফটের জায়গাটা দেখা যায়, কিন্তু দারোয়ান তো একে কখনও দেখেইনি বলছে ।” কথাটা বলে দত্ত দূরে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকাল । সিড়িঙ্গে চেহারা লোকটার । বয়েস পঞ্চাশের ওপরে । ড্রেস পরা না থাকলে একে দারোয়ান বলে ভাবাই যেত না ।
সুতীর্থও গম্ভীরভাবে লোকটার দিকে দেখছিল । গম্ভীর স্বরেই বলল, “হুম, আরেকবার নেড়েচেড়ে দেখতে হবে । এখানকার লোকগুলোকেও একটু বাজিয়ে দেখা দরকার । তবে তার আগে ভিক্টিমের পরিচয়টা …”
“সে কাজ শুরু হয়ে গেছে মিঃ সান্যাল,” দত্ত বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলে উঠল, “মুখের একটা ক্লোজ আপ ছবি তুলে আমি অলরেডি থার্ড অফিসার চৌধুরীকে হোয়াট্‌স-অ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছি । সেটা সমস্ত থানায় পাঠিয়ে লোকটাকে ট্রেস করার চেষ্টা করা হবে ।”
“গুড । আর ডাক্তার কখন আসছেন ?”
“এই তো, এবার এসে যাবেন । উনি দেখে নিলেই বডি পোস্টমর্টেমে পাঠাব । গাড়ি তো রেডি ।”
সুতীর্থ চোখ তুলে গেটের বাইরে দাঁড়ানো কালো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,“বেশ । তাহলে বডিটা চলে যাওয়ার পরই আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব ।” বলতে বলতে বডিটাকে পাশ কাটিয়ে সুতীর্থ বিল্ডিংটার পেছনের দিকে হাঁটা দেয় । গোটা বাড়িটা আগে একবার ঘুরেফিরে দেখে নেওয়া দরকার ।
 
# # # # #
 
সাতসকালেই খবরটা এসেছিল সুতীর্থর কাছে । কলকাতার একেবারে উত্তরপ্রান্তে সদ্য গড়ে ওঠা একটা বিল্ডিং কমপ্লেক্সে একটা লোকের বডি পাওয়া গেছে । সুইসাইড না খুন বোঝা যাচ্ছে না । লোকটার পরিচয়ও জানা যায়নি । নিউটাউন থানার ওসি দীপঙ্কর বোস খবরটা দিয়ে বলেছিলেন, “কাইন্ডলি আপনি একবার ওখানে যান মিঃ সান্যাল । দত্ত অলরেডি চলে গেছে ওখানে । কিন্তু কোনও থই পাচ্ছে না । প্লিজ আপনি যদি একটু হেল্প করতে পারেন ।”
বছর তিনেক আগে থেকে ওসি দীপঙ্কর বোসের সঙ্গে পরিচয় সুতীর্থর । তখন উনি এই নিউটাউন থানার দায়িত্বে ছিলেন না । ছিলেন বেহালা থানায় । ওখানেই একটা কেসে জব্বর ফেঁসে যাওয়া অবস্থা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে সুতীর্থ । তারপর থেকেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে সময় লাগেনি । এমনকি এর পরেও নানা কেসে সুতীর্থ তাঁকে টুকটাক সাহায্য করেছে বিভিন্নভাবে । কাজেই এবারেও তাঁর এই অনুরোধ ও ফেলতে পারেনি । ঠিকানা জেনে নিয়ে হাজির হয়েছে এখানে ।
বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় বিল্ডিংটা । আশেপাশে যদিও আর কোনও বাড়ি এখনও নেই, কিংবা সীমানা নির্দিষ্ট করে কোনও পাঁচিল দেওয়া হয়নি এখনও, তবে চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হয়, এদিকে ওদিকে আরও কিছু বিল্ডিং তৈরী হবে । কারণ জায়গায় জায়গায় বালি, সিমেন্ট আর ইঁটের স্তূপ রাখা । সম্ভবত একটা গোটা কমপ্লেক্সই হয়তো গড়ে উঠবে জায়গাটা ঘিরে, আর তার প্রথম বিল্ডিং এটাই । যদি খুনই হয়ে থাকে, তাহলে খুনী খুব ভালো জায়গাই বেছে নিয়েছে বলতে হয় । নিশ্চিন্ত নিরূপদ্রব একটা জায়গা । কারও চোখে পড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই ।
ঘুরতে ঘুরতে বাড়িটার পেছনদিকে চলে গিয়েছিল সুতীর্থ । এদিকটাও একদম ফাঁকা, আর বেশ নোংরা । প্রচুর রাবিশ পড়ে আছে কিছুটা জায়গা জুড়ে । আশ্চর্য ব্যাপার ! এটা যদি খুনই হয়ে থাকে, তাহলে খুনী তো ভিক্টিমকে ধাক্কা মেরে এইদিকে ফেলতে পারত । তাতে তো রিস্ক আরও কম হত ! তা না করে বিল্ডিং-এর পাশের দিকে ফেলল কেন ? তার মানে কি খুনী একেবারেই নিশ্চিন্ত ছিল যে কেউই দেখতে পাবে না ? নাকি ঠিকমতো পজিশন পায়নি ? যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই ধাক্কাটা দিয়েছে ?
আর যদি এটা সুইসাইড হয় ? তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে, লোকটা অগ্রপশ্চাৎ কিছু বিবেচনা না করেই ঝাঁপ দিয়েছে । এরকম মানসিক অবস্থায় যেটা খুবই সম্ভব । কিন্তু আত্মহত্যা কিংবা খুন, যেটাই হোক, মূল সমস্যা হল লোকটা বাইরের লোক । এরকম বাইরের একটা লোক কীভাবে বাড়িতে ঢুকল, সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জট খুলবে না । আর তার জন্য এ বাড়ির যে-কটা লোক আছে, তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করাটা খুব দরকার । ভাবতে ভাবতে বিল্ডিংটা ঘুরে সামনের দিকে চলে এল সুতীর্থ । আর তখনই তার চোখে পড়ল, ডাক্তার এসে গেছেন । মৃতদেহটা টেনে চিৎ করে শুইয়ে পরীক্ষা করছেন । তার মানে আর খুব একটা দেরি হবে না । ডাক্তারের প্রাথমিক পরীক্ষা হয়ে গেলেই বডি চলে যাবে পোস্টমর্টেমে । তারপর সুতীর্থ তার জেরা করার কাজ শুরু করে দিতে পারবে । একবার কব্জি উল্টে হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সুতীর্থ । তারপর একবার ছাদটা ঘুরে আসার জন্য পা বাড়াল । সকালের আবহাওয়াটা বেশ ভালো । সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে । অথচ এর মধ্যেই একটা লোকের অপঘাত মৃত্যু । জীবন কী আশ্চর্য !
 
# # # # #
 
আধঘন্টার মধ্যেই সব প্রসিডিওর শেষ করে বডি নিয়ে চলে গেল পুলিশ । একজন কনস্টেবল শুধু রয়ে গেল দত্তর সঙ্গে । বিল্ডিং-এর যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে এবার দত্ত ঘোষণা করল, “আপনারা শুনুন । এই বাড়ির সমস্ত ফ্ল্যাটের যারা যারা আছেন, তাদের প্রত্যেককে একে একে আমরা ডাকব । যা জিজ্ঞাসা করা হবে, তার উত্তর দেবেন । কোনকিছু লুকোবার চেষ্টা করবেন না, যা জানেন তাই বলবেন । ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সত্যি কথা বললে আপনাদের কোনও ক্ষতি হবে না । কিন্তু কিছু লুকোবার চেষ্টা করলে আমরা ছেড়ে দেব না । মনে থাকে যেন ।”
কথাটা বলার পর দত্ত একবার সুতীর্থর দিকে তাকাল, ওর সমর্থন পাবার আশায় । সুতীর্থ মৃদু হেসে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, সব ঠিক আছে । তারপর চিন্তিতমুখে দত্তর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কিন্তু আমরা বসব কোথায় ?”
দত্ত মিনিটখানেক চুপ করে কী যেন ভাবল । তারপর বলল, “গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা হলঘর আছে, মোটামুটি বড়ই । বিল্ডিং সংক্রান্ত মীটিং-ফিটিং ওই ঘরেই অ্যারেঞ্জ করা হয় । আপাতত এই দারোয়ান ভদ্রলোকওই ঘরেই আছেন । ওখানেই ব্যবস্থা করি ?”
সুতীর্থ মাথা নেড়ে সায় দিতে দত্ত কনস্টেবলকে ইশারা করে এগিয়ে গেল দাঁড়িয়ে থাকা দলটার দিকে । তারপর দারোয়ানের সঙ্গে দু-একটা কথাবার্তার পর তারা ঢুকে গেল বিল্ডিংয়ের সামনের গেটটা দিয়ে । সুতীর্থ পিছন ফিরল । সবকিছু রেডি হলে দত্ত ওকে ডেকে নেবে । ততক্ষণ আরেকটু খুঁটিয়ে এখানটা দেখে নেওয়া যাক, যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায় ।
বিল্ডিংয়ের ঠিক নিচেটায় খানিকটা খোলা উঠোন । শান বাঁধানো । প্রায় গোটা বাড়িটাই চারপাশে এই উঠোন দিয়ে ঘেরা । চওড়া উঠোনটার সীমানা ঘিরে বেশ কিছু গাছ লাগানো । ফুলের গাছ আর বাহারি গাছ । আর গাছগুলো শুধু এই সামনের দিকে আর পাশের দিকেই লাগানো হয়েছে । বিল্ডিংটার পেছনদিকে কোনও গাছপালা নেই । তবে গাছগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অনেকদিন আগে গাছগুলো কোনক্রমে লাগানো হয়েছিল, তার পর থেকে সেরকম যত্ন নেওয়া হয়নি । তাই এর মধ্যে বেশ কিছু আগাছাও জন্মে গেছে ।
অবস্থা দেখে আপনমনে মাথা নাড়ল সুতীর্থ, তারপর উঠোনের যেখানে বডিটা পড়ে ছিল, সেখানটায় এল । বডির চারপাশ ঘিরে একটা দাগ টেনেছিল পুলিশ । এখন সেই দাগটা আর শুকনো রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে । এপাশে ওপাশে নজর করে দেখতে দেখতে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হল । কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না । ইতিমধ্যে বেশ চড়া রোদও উঠে গেছে । অগত্যা গাছের ছায়ার দিকে এগিয়ে গেল সুতীর্থ ।
আর ঠিক তখনই এক ঝলকের জন্য তার চোখে পড়ল, ঘাস আর আগাছার মধ্যে কী যেন একটা চকচক করে উঠল । নেহাৎ কৌতূহলের বশে পায়ে করে আগাছা সরিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল, একটা মোবাইল ফোন পড়ে আছে । কার ফোন ? নিশ্চয়ই ওই লোকটার ! ওপর থেকে পড়ার সময় বুকপকেট থেকে ছিটকে এসে পড়েছে এই আগাছার মধ্যে ! তাই পুলিশ এর খোঁজ পায়নি । চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল সুতীর্থর । যাক, এখানে আসার পর থেকে কেসটা নিয়ে যেভাবে হতাশ হয়ে পড়ছিল, ভেবেই পাচ্ছিল না কোনদিক থেকে শুরু করবে, এবার তা থেকে মুক্তি । এই মোবাইল থেকেই অজানা কোনও সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে । আজই দত্তকে দিয়ে এই ফোনের ডেটা চেক করাতে হবে, বিশেষ করে কল লিস্ট । রুমালে জড়িয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকাল সুতীর্থ ।
 
# # # # #
 
পাঁচতলা বিল্ডিং । প্রত্যেক তলায় এদিকে ওদিকে দুটো করে মোট দশটা ফ্ল্যাট । তার মধ্যে মাত্র চারটে ফ্ল্যাটে এখন পর্যন্ত লোক এসেছে । দোতলায় একটা অবাঙালি ফ্যামিলি, পাঁচতলায় নিয়োগী দম্পতি, আর তিনতলার দুটো ফ্ল্যাটই বুক্‌ড । একদিকে ফ্যামিলি নিয়ে আছেন মিঃ অরূপ বিশ্বাস, আর অন্যটায় পজেশন নিয়েছেন মলি মিত্র বলে এক ভদ্রমহিলা । যদিও তিনি নিয়মিত এখানে বাস করেন না, মাঝে মাঝে আসেন । গত সপ্তাহের মাঝামাঝি তিনি শেষবার এখানে এসেছিলেন ।
অগত্যা সুতীর্থ বাকি তিনটে ফ্ল্যাটের লোকজনকেই এক এক করে ডেকে পাঠাল । প্রথমে দোতলার মিঃ অরোরার ফ্যামিলি । ভদ্রলোক সোনার কারবারী, বউবাজারে তাঁর নিজস্ব গয়নার দোকান । আর তাঁর স্ত্রী নিতান্তই গৃহবধূ, সাতেপাঁচে থাকেন না । আট বছরের একটা বাচ্চাকে সামলাতেই ব্যস্ত থাকেন । কাজেই তাঁদের কাছ থেকে কোনও খবরই উদ্ধার করা গেল না । শুধু জানা গেল, গতকাল মিঃ অরোরা দোকান থেকে ফিরে আসেন রাত আটটার সময় । তাঁর নিজের একটি গাড়ি আছে, নিজেই চালান । একতলার গ্যারেজেই সেই গাড়ি রাখা থাকে । রোজকার মতো গতকালও মিঃ অরোরা দোকান থেকে ফিরে এসে গাড়ি গ্যারেজ করে সরাসরি দোতলায় উঠে যান । তারপর আর বেরোননি । তাঁর স্ত্রী আর ছেলেও ঘরেই ছিল । না, রাতে কোন অস্বাভাবিক কিছু তাঁরা দেখেননি বা শোনেননি । আর এই মৃত ভদ্রলোককেও তাঁরা কোনদিন দেখেননি । কাজেই চেনার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।
এরপর তিনতলার অরূপবাবুর ফ্যামিলি । অরূপ বিশ্বাস সরকারী চাকুরে । তাঁর স্ত্রী ও একটি ছেলেকে নিয়ে থাকেন । ছেলের বয়েস চব্বিশ কি পঁচিশ বছর । সে-ও চাকরি করে, তবে তার চাকরি একটা প্রাইভেট ফার্মে । গতকাল অরূপবাবু ও তাঁর স্ত্রী সন্ধে থেকে ঘরেই ছিলেন, টিভি দেখছিলেন । আর ছেলে রোজকার মতো অফিসফেরত ক্লাবে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরেছে রাত দশটায় । তারাও কেউ অস্বাভাবিক কিছু দেখতে বা শুনতে পাননি । আর ভিক্টিমকে তাঁরাও চেনেন না ।
দেখেশুনে ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিল সুতীর্থ । কোথাও কোনও ক্লু-ই কি পাওয়া যাবে না ? দুটো ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলার পরও এখন পর্যন্ত প্রায় কিছুই জানা যায়নি । শুধু একটু সন্দেহের আভাষ পাওয়া গেছে অরূপবাবুর ছেলে অভিলাষের আচরণে । সে বড্ডো তাড়াহুড়ো করছিল অফিস যাবে বলে । কোনরকমে প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে চলে যেতে পারলেই যেন বাঁচে । কিন্তু কেন ? এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরঘুর করছিল সুতীর্থর ।
তবে একটু পরেই পাঁচতলার নিয়োগী দম্পতির সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য একটা খবরে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠল সে । রিটায়ার্ড ব্যারিস্টার মিঃ নিয়োগী আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই নিপাট ভালো মানুষ । নিঃসন্তান দম্পতি তাঁরা, কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি । বহুদিন ধরে ভবানীপুরে ভাড়া থাকার পর এখানে ফ্ল্যাট কিনে উঠে এসেছেন মাস দুয়েক হল । তাঁরা থাকেন পাঁচতলায় । রোজ রাত্রে নটার মধ্যে ডিনার সেরে নিয়ে তাঁরা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখেন । কালও তাই দেখছিলেন । তার মধ্যেই কোনও একটা সময়ে নাকি তাঁরা একটা আওয়াজ শুনেছিলেন । সম্ভবত কেউ বা কারা ছাদের দরজাটা খুলেছিল । ছাদটা কমন, তাই যে কোনও ফ্ল্যাটের বাসিন্দাই যে-কোন সময় ছাদে উঠতে পারেন । আর পাঁচতলার ঠিক ওপরেই সেটা থাকায় ছাদের দরজা খোলা বা বন্ধের শব্দ নিয়োগীদের ফ্ল্যাট থেকে ভালভাবেই শোনা যায় । তবে শব্দটা শুনলেও ওঁরা খুব একটা গুরুত্ব দেননি, কারণ বাইরের ব্যাপারে ওঁরা খুব একটা মাথা গলান না ।
কিন্তু এই খবরটা সুতীর্থকে বেশ চাঙ্গা করে তুলল । কারণ এতক্ষণে ঘটনার সময়টা মোটামুটি আন্দাজ করা গেল । এবার দেখতে হবে ওই রাত নটার আশেপাশে দারোয়ান কোথায় ছিল । সুতীর্থ নিয়োগী দম্পতিকে বিদায় দিয়ে দারোয়ানকে ডেকে পাঠাল ।
 
# # # # #
 
সন্ধের একটু পরে নিউটাউন থানায় বসে ছিল সুতীর্থ । বিকেলের মধ্যেই অনেকগুলো খবর এসে গেছে ওসি দীপঙ্কর বোসের হাতে । সেগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্যেই সুতীর্থকে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি ।
ওসির মুখে খবরগুলো শুনতে শুনতে সুতীর্থ বুঝতে পারছিল, সবকটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর । প্রথমত, বডির সঙ্গে থাকা জিনিষপত্রের মধ্যে কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি । কাজেই সম্ভবত এটা খুনই । খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে খুন ।
দ্বিতীয়ত, বালিগঞ্জ থানার সোর্স থেকে পাওয়া গেছে ভিক্টিমের পরিচয় । ভদ্রলোক ওই এলাকাতেই থাকতেন, নাম নীলাভ সরকার । একজন পার্টনারের সঙ্গে ইলেক্ট্রিক্যাল গুডসের ব্যবসা ছিল তাঁর । বেশ ভালোই পসার ছিল ব্যবসার । তবে ইদানীং নাকি পার্টনারের সঙ্গে খুব বেশি বনিবনা হচ্ছিল না । যাঁর সঙ্গে ব্যবসার শেয়ার ছিল নীলাভর, সেই বন্ধুর নাম পরিতোষ দাস । ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে খোঁজখবরও নিয়ে নিয়েছে পুলিশ । তাতে জানা গেছে যে, গতকাল সন্ধে সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পরিতোষ কাটিয়েছেন কলকাতার একটা ক্লাবে । এই অকাট্য অ্যালিবাই থাকার ফলে এই খুনের ব্যাপারে তাঁকে জড়ানো যাচ্ছে না ।
আর তৃতীয় সংবাদ, ওই মোবাইলের ডেটা থেকে যা উদ্ধার করা গেছে, তাতে নিউটাউনের ওই বাসিন্দাদের কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগের কথা আবিষ্কার করা যায়নি । বিল্ডিংয়ের সবার ফোন নম্বরই নিয়ে রেখেছিল পুলিশ । চেক করে দেখা গেছে, তাদের কারও নম্বরই নীলাভ সরকারের ফোনে সেভ করা নেই বা সেইসব ফোন থেকে কোনও ফোন আসেওনি, যায়ওনি । তবে একটা রহস্যময় নাম্বার পুলিশ পেয়েছে, যেটি নীলাভর ফোনে সেভ করা ছিল ; এমনকি গতকালও সেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে এই ফোনে । কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এখন সেই নাম্বারটির নাকি আর কোনও অস্তিত্ব দেখাচ্ছে না ।
এই শেষের খবরটাই সুতীর্থর কাছে সবচেয়ে রহস্যময় বলে মনে হল । গতকালও সেই নম্বর থেকে ফোন এসেছে ভিক্টিমের কাছে, অথচ আজ আর নম্বরটার কোনও অস্তিত্ব নেই !
তাহলে কি এই ফোনের মালিকই সেই অজানা খুনী ? কাজ মিটে যাওয়ার পর সিমটা নষ্ট করে ফেলেছে ? কিন্তু সে কে ? আর নীলাভকে খুন করার কারণ কী তার ?
প্রশ্নটা মনে আসতেই সুতীর্থ নিজের মনেই হেসে ফেলল । কী ছেলেমানুষের মত কথা ভাবছে সে । খুনের কারণ জানলে কি আর খুনীকে ধরতে এত মাথা ঘামাতে হত ? আসলে এটা একটা বেসিক থিওরি । শতকরা নিরানব্বই ভাগ কেসেই খুনের মোটিভটা জানলেই খুনীর আন্দাজ পাওয়া সহজ হয়ে যায় । কাজেই এখানেও খুনী কে সেটা জানার আগে খুনের কারণটা জানতে হবে ।
দীপঙ্কর বোস ওকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার ? আপনি হাসছেন যে ?”
সুতীর্থ একটু বিব্রত হয়ে বলল, “স্যরি মিঃ বোস । আসলে হঠাৎ ছেলেমানুষের মত একটা কথা মনে এল, তাই হেসে ফেললাম ।” এই বলে হাসার কারণটা বলল । তারপর দুহাত তুলে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, “ওক্কে মিঃ বোস । আজ তাহলে ওঠা যাক । কাল পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা এলে আমাকে ফোন করবেন ।”
মিঃ বোস অবাক হয়ে বললেন, “সেকি ? উঠবেন মানে ? বললাম যে আজ আমার সঙ্গে ডিনার করে বাড়ি ফিরবেন !”
সুতীর্থ বলল, “ডিনার ? এখানে ? কে রাঁধবে দাদা ?”
“ধুর মশাই । আজকাল আবার কোনও কাজের জন্য সমস্যা হয় নাকি ? আপনার পকেটে যদি টাকা থাকে, আর হাতে থাকে একটা স্মার্ট ফোন, তাহলে আপনি দুনিয়ার সবকিছু করে ফেলতে পারেন ঘরে বসেই । এই তো, এখানে বসেই সুইগিতে অর্ডার করে দিলাম । নটা বাজলেই চলে আসবে মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন কষা । কী বলেন, চলবে তো ?”
কথাটা বলে দীপঙ্কর বোস সুতীর্থর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার ধারালো চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে । মাথার মধ্যে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে একটা জটিল চিন্তা । ভাবতে ভাবতেই সুতীর্থ বলে উঠল, “আচ্ছা মিঃ বোস, এই যে আপনি বললেন, এখন টাকা আর ফোন থাকলে ঘরে বসেই সব কাজ সেরে ফেলা যায় । সেটা তো এ ক্ষেত্রেও হতে পারে, তাই না ? এইভাবেই তো মার্ডারও করে ফেলা যায় !”
“অবশ্যই যায়,” মাথা নেড়ে সায় দেন ওসি, “লোকে তো সুপারি দিয়ে আজকাল খুন করাচ্ছে । নিজের হাতে কালি না মেখে প্রফেশনাল কিলারকে দিয়ে …”
“আর তার ফলে অনেক সময় আসল অপরাধী ধরাও পড়ছে না, তাই না মিঃ বোস ?”
দীপঙ্কর বোস থমকে গিয়ে গভীর চোখে তাকিয়ে বললেন, “কী বলতে চান আপনি ?”
“মিঃ বোস, ওই যে আননোন নাম্বারটা, যেটা থেকে ভিক্টিমের কাছে ফোন এসেছিল, তার পুরো কললিস্ট চেক করিয়েছেন ? মানে ভিক্টিমের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এমন কারও সঙ্গে ওই নাম্বার থেকে কোনও যোগাযোগ হয়েছিল কিনা ?”
“মাই গুডনেস ! সেটা তো করা হয়নি !” বলেই টেবিলে রাখা কলিংবেল টিপলেন দীপঙ্কর বোস । তারপর সুতীর্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার সন্দেহটা কী মিঃ সান্যাল ? তাহলে কি …”
সুতীর্থ মৃদু হেসে বলল, “আশা করি বুঝতেই পারছেন আমি কার কথা ভাবছি । দেখা যাক আমার অনুমান মেলে কিনা ।”
ইতিমধ্যে সেকেন্ড অফিসার দত্ত ঘরে ঢুকেছিল । দীপঙ্কর বললেন, “দত্ত, ওই আননোন নাম্বারটার কললিস্ট চেক করাতে কতক্ষণ লাগবে ?”
দত্ত একটু ইতস্তত করে বলল, “তা … কয়েক ঘন্টা তো লাগবেই স্যার । এমনিতেই রাত হয়ে গেছে, তারপর এমন হঠাৎ করে …”
“বেশ । যা সময় লাগে লাগুক, তুমি এখনই বলে দাও যেন ইমিডিয়েটলি শুরু করে । আর হ্যাঁ, ভিক্টিমের সঙ্গে রিলেটেড যতজনের নাম্বার পেয়েছ, সকলের নাম্বারের সঙ্গে চেক করতে বোলো ।”
দত্ত মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলে দীপঙ্কর বোস চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন । সুতীর্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার ?”
সুতীর্থ অল্প হেসে বলল, “এবার খাবারের প্রতীক্ষা ।”
# # # # #
ভোর সোয়া ছটায় মোবাইলের রিংটোনে ঘুম ভাঙল সুতীর্থর । ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখল, ওসি দীপঙ্কর বোস । সুইচ টিপে সাড়া দিতেই তাঁর উত্তেজিত গলা, “মিঃ সান্যাল, সাংঘাতিক ব্যাপার । ভাবতেও পারবেন না কী খবর পেয়েছি ।”
সুতীর্থ বলল, “কী খবর ? আমরা যা ভাবছিলাম তাই তো ? মানে ওই আননোন নাম্বার থেকে পরিতোষের ফোনে কল হয়েছে তো ?”
“ইয়েস ইয়েস । সেটা তো আমরা আন্দাজ করেইছিলাম, কিন্তু আর একটা খবর যেটা পেয়েছি, সেটা শুনলে অনুসন্ধানী সুতীর্থ সান্যালও রীতিমতো শক্‌ড হবেন । সেটা কী জানেন ? শুধু পরিতোষই নয়, ওই ফোন থেকে নীলাভ সরকারের স্ত্রীয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে কয়েকবার ।”
“তার মানে ?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সুতীর্থ ।
“সেটাই তো ধাঁধার মতো লাগছে মিঃ সান্যাল । শুনুন, পরিতোষকে তুলে আনা হচ্ছে থানায় । আপনি কি আসবেন ?”
সুতীর্থ একটু চিন্তা করে বলল, “নাঃ । আমি আর যাচ্ছি না । আপনারা আপনাদের কায়দায় পরিতোষের থেকে কথা আদায় করুন । আমি বেলার দিকে ফোন করছি আপনাকে ।”
ফোন রেখে দিয়ে একঝাঁক দুশ্চিন্তা নিয়ে হাবুডুবু খেতে লাগল সুতীর্থ । অনেকগুলো প্রশ্ন এখন পরপর জমা হচ্ছে ওর মনে । গতকাল পর্যন্ত নীলাভর বিজনেস পার্টনার পরিতোষ দাসই ছিল ওদের টার্গেট । কারণ নীলাভকে খুনের পেছনে এরই মোটিভ ছিল সবচেয়ে জোরালো । কিন্তু যেহেতু খুনটা হয়েছে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে, আর সেইসময় পরিতোষ ছিল স্পট থেকে অনেক দূরে, তাই তার ওপর সন্দেহ হবার কোনও কারণ নেই ।
কিন্তু সত্যিই কি তাই ? যদি এরকম হয় যে সে নিজে দূরে বসে থেকে কাউকে দিয়ে খুনটা করাতে চাইল ? ওসির ঘরে বসে এমনই একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এসেছিল সুতীর্থর । আর তাই সে ওই আননোন নাম্বারের কললিস্ট চেক করাতে চেয়েছিল ।
এখন দেখা যাচ্ছে ওর অনুমান নির্ভুল । তার মানে ওই নাম্বারের মালিককে পরিতোষ চেনে । আর সে যে নিউটাউনের ওই বিল্ডিংয়েরই কেউ, এ ব্যাপারেও কোনও সন্দেহ নেই । কে জানে, হয়তো তিনতলার অরূপবাবুর ছেলে অভিলাষই সেই অজানা খুনী !
যদিও দারোয়ান নীলাভকে ওখানে কারও সঙ্গে ঢুকতে দেখেনি, কারণ গতকাল দারোয়ানের কথা থেকে জানা গেছে যে, সাড়ে আটটার পর দারোয়ান বাইরে রুটি কিনতে গিয়েছিল, আর ভিড় ছিল বলে বেশ দেরি হয়েছে তার ফিরতে । আর ঠিক ওই সময়ের মধ্যেই খুনটা ঘটেছে । কাজেই দারোয়ানের তা জানার কথাও নয় । তবে দারোয়ান দেখুক বা না দেখুক, অনুমানের ভিত্তিতে যতদূর এগোনো গেছে, তার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনও ফাঁক ছিল না ।
কিন্তু এই নতুন খবরটা ! ওই নাম্বার থেকে নাকি নীলাভর স্ত্রীকেও ফোন করা হয়েছিল ! এটাই তো সমস্ত যুক্তিবুদ্ধিকে ওলটপালট করে দিচ্ছে । যদি অভিলাষ সেই খুনী হয়, অর্থাৎ পরিতোষের কথায় বা তার থেকে সুপারি নিয়ে সে খুন করে থাকে, সেই খুনের সঙ্গে নীলাভর স্ত্রীর সম্পর্ক কী ? তবে কি নীলাভর স্ত্রীর সঙ্গে অভিলাষের গোপন অবৈধ সম্পর্ক ছিল ? নাকি আসলে নীলাভর স্ত্রীই সেই মেঘনাদ, যে মেঘের আড়াল থেকে খুনটা করাতে চেয়েছে ? সে ক্ষেত্রে পরিতোষের ওপর ওদের সন্দেহ কি ভুল ?
সুতীর্থ আবার মোবাইলটা তুলে নিল হাতে । ওসি দীপঙ্কর বোসকে ধরল । তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে শলা পরামর্শ হতে থাকল তাদের মধ্যে ।
 
# # # # #
 
পরের দিন সন্ধে সাতটা । উল্টোডাঙার মুচিবাজারে রাস্তার ওপর একটা জীপ এসে থামল । ওসি দীপঙ্কর বোস জীপ থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে সামনের দোতলা বাড়িটার সদর দরজার কড়া নাড়লেন । তাঁর পেছনে সুতীর্থ আর দুজন কনস্টেবল ।
দরজা খুলে দাঁড়ালেন একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক । পুলিশ দেখেই হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “কী ? কী ব্যাপার ? আপনারা … ?”
দীপঙ্কর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে প্রশ্ন করলেন, “এখানে মিস মলি মিত্র থাকেন ?”
“হ্যাঁ … কিন্তু …”
“তিনি আছেন বাড়িতে ?”
ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ আছে । ওই তো, একতলার ওদিকে …” আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন । ওরা এগিয়ে গেল ।
মলি মিত্রর ঘরের দরজা বন্ধ । ধাক্কা দিতে দরজা খুলল, আর খোলামাত্রই স্পষ্ট ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর মুখ । দীপঙ্কর বোস একটু হেসে বললেন, “কী মিস মিত্র ? আমাদের আশা করেননি, তাই না ?”
জোর করে হাসার চেষ্টা করে মলি বললেন, “না, মানে পুলিশ কেন …”
সুতীর্থ এবার সামনে এগিয়ে এসে বলল, “ঘরে চলুন, বলছি ।”
সবাই একে একে ঘরে এসে ঢুকল । প্রথম প্রশ্ন সুতীর্থই করল, “মিস মিত্র, আপনি নীলাভ সরকার নামে কাউকে চেনেন নাকি ?”
মলি মিত্র ততক্ষণে নার্ভাস ভাবটা প্রায় কাটিয়ে ফেলেছে । কোনরকমে উচ্চারণ করল, “নীলাভ … সরকার …”
এবার কড়া গলায় দীপঙ্কর বললেন, “দেখুন মিস মিত্র, নাটক করবেন না । আজ থেকে তিনদিন আগে আপনার নিউটাউনের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে নীলাভ সরকারকে আপনি ছাদ থেকে ফেলে খুন করেছেন । বলুন ঠিক কিনা ?”
এরকম জোরালো আক্রমণে কী বলবেন তা প্রথমে ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না মলি মিত্র । তারপরেই তাঁর চোখদুটো জ্বলে উঠল । প্রায় মরিয়ার মতো বলে উঠলেন, “তার মানে ? কী বলছেন কী আপনারা ? খুন !! কেন ? আমি খুন করব কেন ? আর এসব ফালতু অভিযোগ আপনারা …”
“একদমই ফালতু অভিযোগ নয় মিস মিত্র,” সুতীর্থ কঠিন স্বরে বলে ওঠে, “যথেষ্ট প্রমাণ নিয়েই আমরা আপনার কাছে এসেছি । যার সুপারি নিয়ে আপনি কাজটা করেছেন, সেই পরিতোষ দাসই সবকিছু স্বীকার করেছেন ।”
এবার সমস্ত প্রতিরোধ এক নিমেষে শেষ হয়ে যায় মলি মিত্রের । হিসহিসিয়ে বলে, “পরিতোষ দাস ?”
“হ্যাঁ মিস মিত্র । তবে শুধু এই তো প্রথম নয়, এর আগেও আপনি বাবলু হাজরা বলে আর একজনের কাছ থেকে সুপারি নিয়ে বড়বাজারের এক ব্যবসায়ীকে খুন করেছিলেন, তাই না ?”
“ক্কে ? কে বলল ?” তোতলায় মলি মিত্র ।
দীপঙ্কর বোস বলেন, “আমাদের হাতটা অনেক বড় মিস মিত্র । কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কীভাবে কেউটে পাকড়ে ফেলি, তা আমরা নিজেই বুঝে উঠতে পারি না । এই যেমন আমরা জেনে গেছি যে ওই বাবলু হাজরার কাছ থেকেই পরিতোষবাবু আপনার ফোন নাম্বার পেয়েছিলেন । তারপর আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে এই মার্ডারের কন্ট্র্যাক্ট করেন । আর আপনি শুধু এই কাজটা করার জন্য কিছুদিনের জন্য একটা ফোন নাম্বার ব্যবহার করেছিলেন । তারপর কাজ মিটে যেতে সেদিন রাতেই সেটা নষ্ট করে ফেলেন । ঠিক কিনা ?”
কথাটা বলে দীপঙ্কর বোস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান মলির দিকে । তার তখন কথা বলার অবস্থা নেই ।
আবার কথা শুরু করেন দীপঙ্কর, “আর একটা কথা কী জানেন মিস মিত্র, ঠিকমতো একটা সূত্র পেলে প্রমাণ যোগাড় করার জন্য আমরা অনেক কিছুই করে ফেলতে পারি । যেমন ধরুন আপনার কেসটাতেই । খবর পাবার পর আপনার অজান্তেই আপনার নিউটাউনের ফ্ল্যাটের চাবি খুলিয়ে নিয়ে আমরা আপনার ফ্ল্যাট সার্চ করেছি । আর সেখানেই বেসিন থেকে আপনার নষ্ট করে দেওয়া ফোন আর সিমের পোড়া অংশ উদ্ধার করেছি আমরা । সেইসঙ্গে ওই ঘরের সেন্টার টেবিলের একটা অংশ থেকে পাওয়া গেছে নীলাভর আঙুলের ছাপ । এর পরেও কি আর কোনও প্রমাণ চাই মিস মিত্র ?”
মলি মিত্র এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলেন । এবার ধপ করে বসে পড়েন বিছানায় ।
মুখ খোলে সুতীর্থ, “কিন্তু শুধু এটাই কারণ নয় মিস মিত্র । নীলাভকে খুন করার পেছনে আর একটা কারণ ছিল আপনার, তাই না ? আর সেই কারণটা হলেন মিসেস অঞ্জনা সরকার, নীলাভর স্ত্রী । আসলে আপনার সঙ্গে মিসেস অঞ্জনার এক গোপন সম্পর্ক ছিল । আপনারা ছোট থেকে এক পাড়ায় থাকতেন, হয়তো তখন থেকেই এই সম্পর্ক, যেটা এখনও বজায় আছে । এমনকি মাঝেমাঝেই দুপুরের দিকে আপনি তাঁর বাড়ি যেতেন, এ খবরও আমরা পেয়েছি । এখন নীলাভকে মার্ডার করার সুপারি পেয়ে যেতে আপনি আর অঞ্জনা, দুজনেই হাতে চাঁদ পেলেন । নীলাভর সম্পত্তি এসে যাবে অঞ্জনার হাতের মুঠোয়, আর সেইসঙ্গে আপনাদের অবাধ মেলামেশারও আর কোনও অসুবিধে থাকবে না । ফলে আপনি এক ঢিলে দু পাখি মারার প্ল্যান করলেন । কিন্তু অপরাধ করা যে অত সহজ নয় মিস মিত্র । যেভাবেই হোক, কিছু না কিছু চিহ্ন তার রয়েই যায় । যেমন আপনার ওই নষ্ট করে দেওয়া ফোন । যদি শুধুমাত্র নীলাভর সঙ্গেই আপনি ওই ফোন থেকে কথা বলতেন, তাহলে হয়তো আপনি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যেতেন । কিন্তু তা থেকে আপনি পরিতোষ আর অঞ্জনা দেবীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন, আর সেটাই আপনাকে ধরিয়ে দিল । তবে চিন্তা করবেন না, আপনার সঙ্গে পরিতোষ দাস আর অঞ্জনা সরকারকেও লক-আপে পোরার ব্যবস্থা আমরা করেছি । কাস্টডিতে আপনার সঙ্গীর অভাব হবে না ।”
সুতীর্থ চুপ করে । সুন্দরী মলি মিত্রর চোখেমুখে তখন একরাশ অন্ধকার নেমে এসেছে, রাতের আকাশের মতো ।
---------------------------------------------------------
Krishnendu Bandyopadhyay
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি