অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বডি - অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

বডি
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়





ছড়ানো ঝিল ভর ভরন্ত । ওপারে ঝোপঝাড় জঙ্গল। এপারে কাঁচা রাস্তা আবলা খাবলা । শুক্লা রাতে চাঁদের আলো খেলা করে ঝিলের জলে।ওপারের জঙ্গল থেকে শেয়ালের দল ডাকতে শুরু করে আচমকা।এপারে শিবমন্দিরের বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছটা মাখা আঁধারে বসে রাত বারোটা অব্দি চার পাঁচজনে মিলে এন্তার মদ খায়। মদ গিলতে গিলতেই যে যার ঘর সংসারের জমিয়ে রাখা বিষ বাষ্প উগরে দেয়। নেশা চড়ে গেলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে। সুহাস আর তারক অশ্রাব্য গালাগালি করতে থাকে। বোধহয় ভগবান বা ভাগ্যের উদ্দেশ্যে।
বাইপাস এখান থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার ফারাকে। লোকাল পুলিশ ফাঁড়ি মুকুন্দপুরে। ওখান থেকে রাতের ঝিঁঝি ডাকা আঁধারে
মাঝে মাঝে কড় কড় কড় কড় করতে করতে পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায় জলার ধারে।
বাইপাসের দিকে মুখ করে পাশাপাশি তিনটে বিশাল বিল্ডিং উঠছে।জমির পিছন দিকে পলিথিন ঘেরা টিনের শেডের নীচে সিমেন্ট বালি স্টোন চিপসের অস্থায়ী স্টোর রুম। বৃষ্টি হলে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে টি নের চালে। রকমারি মাপের জি অাই স্টীলের পাঁজা পাঁজা রড এনে ফেলে রেখে গেছে সাপ্লায়াররা। পেঙ্গুইন বিল্ডার তিন তিনটে কন্স্ট্রাকশানের কাজ চালাচ্ছে একসঙ্গে। এই সব জলা আগাছায় ভরা প্লটে ফ্ল্যাটগুলো জলের দরে ছাড়া হবে ফিলহাল। সামনের দিকে একটু দোকান বাজার মল টল বসে গেলে ব্যস্ ..... দাম চলে যাবে ছাপোষা লোকের আওতার বাইরে।
শিখর পাঁজি যতটা সম্ভব ঘরের বাইরেই থাকে। গলা পর্যন্ত চুল্লু খেয়ে রাত দুটো নাগাদ ঘরে ঢোকে। সকালে যখনই ঘুম ভাঙে তখনই বেরিয়ে যায়। ঘরে থাকতে পারে না। তার পরিবার যন্ত্রণার লৌহকপাটের ভিতরে বাস করে।
বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে এক ঠিকাদারের অধীনে। মা ক্যানসার রুগী। অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রনায় দুমড়ে যেতে যেতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে প্রায় বিনা চিকিৎসায়। কিন্তু মরণ কি অত সহজে আসে ! একটা বিনাপয়সার হাসপাতালে ছিল কিছুদিন । কিন্তু সেখানে ছুটি করে দিল। বলল, ‘ এখানে আর রেখে কি করবেন..... এ পেশেন্টের তো আর কিছু হওয়ার নেই.... আর যে কটা দিন থাকে বাড়িতেই রাখুন.... কত পেশেন্ট লাইনে রয়েছে, মিছিমিছি একটা বেড আটকে রাখা .....।’
না: ... বেড আটকে রাখা গেল না।
একটা ভাই কেরালা না কর্নাটক কোথায় যেন চলে গেছে। আর একটা ভাই কেপমারি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বেদম মার খেয়ে আপাতত: জেলে আছে। কতদিন থাকতে হবে কেউ জানে না। উকিল দেবার পয়সা নেই, লোকও নেই। কোর্টে কেস ওঠেনা। ওটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কেউ নেই।
শিখর একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করে। বাজার খারাপ । বছরে দশ মাস ফাঁকা যায়। খদ্দের নেই। তিনমাস পরে পরে মাইনে পায়। চুল্লুর টাকা তারকরা জোগায়। তারক আর সুহাস মিনি বাসের কন্ডাক্টর। চুল্লুর সঙ্গে মাঝে মাঝে পিঁয়াজি কিংবা চর্বির বড়াও হয়। তারকের দিল আছে বলতে হবে। জমানো পয়সা খরচ করছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মাস দুই হল মিনি বাস বসে আছে। তেলের যা দাম মালিকের পোষাচ্ছে না। বাস বার করছে না। সুতরাং সুহাস বা তারক কারোরই আমদানি নেই। তবু শিখরকে , দিশি হলেও মাল তো খাওয়াচ্ছে।দিল আছে বলতে হবে।
শিখরের মাঝে মাঝে মনে হয়
মা- টাকে যদি একটু করে খাওয়ানো যেত বোধহয় যন্তন্নাটা একটু চাপা পড়ত। কি জানি কতদিনে এ কষ্টের তারকাঁটা থেকে ছাড়ান পাবে বেচারি মা-টা। ‘মরে গেলে’ আর কোন কষ্ট নেই বোধহয়।
অন্ধকার বেশ ঝামরে ধরেছে। ওদিকের ল্যাম্পপোস্টে আলো বিগড়ে গেছে। কবে মেরামত হবে কে জানে । জলার ওপাশে ঝুঁঝকো ঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ একপাল শেয়াল উঁচু পর্দার কোরাসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে লাগল। একটা জিপ কড় কড় কড় কড় করে ওই কাঁচা রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়াল। একজন জিপে বসে বসেই টর্চ ফেলল জি আই স্টীলের পাঁজার ওপর । পরষ্পরে জড়িত আবদ্ধ শীতঘুমে আচ্ছন্ন সরীসৃপপুঞ্জের মতো পড়ে থাকা ‘বিল্ডিং মেটিরিয়াল’-এর শরীর ঝিকমিক করতে লাগল।
একটা গলা শোনা গেল জিপের মধ্য থেকে- ‘ একটা কথা মনে রেখ বিপ্লব ....কেস দিতে না পারলে এখানে পোস্টিং ধরে রাখা মুশ্কিল হয়ে যাবে। চাপ শুধু ডিপার্টমেন্টের নয়, পেঙ্গুইন কোম্পানিরও আছে। তাদেরও তো খসছে নাকি ?’
বিপ্লববাবু বললেন, ‘ সে তো বটেই
..... ‘

শিখরের বাবা কার্ত্তিক কাল কাজ করতে করতে ভারা থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট খেয়েছে। কপাল ভাল তেমন গুরুতর চোট লাগেনি। বাড়ির মালিক সজ্জন ব্যক্তি । তিনিই সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। না, ভাঙেনি। তবে ভালোরকম মচকেছে হাঁটু আর পায়ের গোছ। ঠিকে দার নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল কার্ত্তিককে। এসব সমস্যা তেমন হয়নি। তবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হল যে, মাস দুই বসে থাকতে হবে এখন । পায়ের চোট না সারলে কাজে যাওয়া মুশ্কিল।
যাও বা গাড়ি চলছিল টাল খেতে খেতে, গাড্ডায় পড়ে থেমে গেল হ্যাঁচকা টানে।

সকাল দশটার সময় বাস রাস্তার মুখে তারকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শিখরের।তারক বলল, ‘রাতে আসিস কিন্তু । আজ দারুন চাট আনাব। বহুৎ মজা পাবি। তাছাড়া কিছু প্ল্যান প্রোগ্রামের কথাও আছে। আসিস কিন্তু। ‘
— ‘ কিরকম প্ল্যান ? ‘
— ‘ আয় না .... বলব অখন .... ‘

পেঙ্গুইন কন্স্ট্রাকশানের বোর্ড মিটিং চলছে । ডালহৌসি, নেতাজি সুভাষ রোডে সেঞ্চুরি প্লাজার আটতলায়।
পীযূষ কেডিয়া সাহেব বললেন, ‘ লাইসেন্স তো আমরা পেয়ে গেছি। সো উই শুড গেট দি ওয়ার্ক আন্ডার ওয়ে ইমিডিয়েটলি। মেটিরিয়াল পড়ে আছে আনগার্ডেড অবস্থায়। লোক্যাল পুলিশ স্টেশনে অবশ্য ইনফর্ম করা আছে। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং , আনঅফিসিয়ালি পে-ও করতে হচ্ছে টু টেক কেয়ার অফ।
স্টি ল উই শুড নট মেক এনি ফারদার ডিলে।নন পারফর্মিং অ্যাসেট মিনিমাইজ করতে হবে আমাদের। আদারওয়াইজ ইট ইজ ডিফিকাল্ট টু সারভাইভ। কম্পিটিশান ইজ সো স্কেদিং।’

মিটিং-এর পর কফি সেশান হল। স্ন্যাক্সের ভূরিভোজ আয়োজন। প্রদীপ্ত মিত্র সিভিল ইঞ্জীনিয়ার। তাকেও ডাকা হয়েছিল। কন্স্ট্রাকশানের ব্লু প্রিন্ট তার তৈরি। কোম্পানির দুই বড় কর্ত্তা আর একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এই সাইটে মোট
পনের কোটি টাকার টার্ন ওভার। রাফ অ্যাসেমেন্ট অনুযায়ী আট কোটি টাকা প্রফিট আসা উচিৎ। ইনপুট মোটেই নন পারফর্মিং লে অফ- এ রাখা উচিৎ নয় , পীযূষ কেডিয়া এ কথা বারবার স্মরণ করান তার এক্সিকিউটিভদের। কেডিয়ার মূল ব্যবসা অবশ্য আয়রণ অ্যান্ড স্টীলের। বিল্ডিং ডেভেলপমেন্টে নেমেছেন অতি সম্প্রতি। অতটা মেটিরিয়াল পড়ে আছে সাইটে। যদিও স্থানীয় থানায় জানানো আছে, তবু চিন্তা একটা আছেই। পীযুষ কেডিয়াকে একেবারেই হৃদয়হীন ব্যবসায়ীর স্তরে ফেলা যায় না। গরীব মানুষের জন্য তিনি অনেক করেন। কারো দুর্দশার খবর পেলে নিজেই পৌঁছে যান সেখানে এবং তাদের সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য উদ্যোগী হন। ওই বাইপাসের লাগোয়া সাইট ঘেঁসা এলাকাতেও, তিনি খবর পেয়েছেন দুরবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বেশ ক ঘর মানুষ। তার মধ্যে একজনের অবস্থা খুব ঘোরাল। পীযুষ কেডিয়া ঠি ক করেছেন পরশুদিন তিনি ওই এলাকায় যাবেন।

তারকের কোথা থেকে কিছু আমদানি হয়েছে। আজ রাতে চিলি চিকেন আনিয়েছে। বাংলার সঙ্গে জমবে ভাল। দু চার ঢোক মারবার পর ‘স্কিম’ টা বলে শিখরকে। নেশা চড়ার আগেই কথাবার্তা বলে নেওয়া ভাল। নক্শাটা অবশ্য সুহাসের।
সে বলে, ‘ এখানে দশ লাখ টাকার রড পড়ে আছে। চারটে সরে গেলে কোন শালা হিসেব পাবে না। খুব কমসম করে চারটে বেচতে পারলেও কমসে কম দু হাজার টাকা আসবে। মুকুন্দপুরে পার্টি আছে। মাল আমাদের ক্যারি করতে হবে । ওখানে তারিখ আলির লোক থাকবে, নামিয়ে নেবে। এটার সাকসেস হলে পরের বারের প্ল্যান ছকা যাবে। ‘
শিখর আর এক ঢোক মারে । জুলজুল করে সুহাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিলি চিকেনের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে থাকে। টক ঝাল সস মেশানো নরম মাংসের স্বাদে গন্ধে মৌজে চোখ বুজে আসে শিখরের।
তার আচমকা মনে পড়ে যায় চাপচাপ যন্ত্রণার তলায় অসহায়ভাবে পড়ে থাকা তার মায়ের কথা।চোখ বুজে প্রবলভাবে চিলি চিকেন চিবোতে থাকে শিখর। আর এক ঢোক বাংলা মারে । জঙ্গলের ওদিক থেকে জমাট আঁধার ফালা ফালা করে একটা পেঁচা ডেকে উঠল হঠাৎ।
তারক বলল, ‘ আজ আর টানিস না শিখর। ধুমকি এসে গেলে কাজটা করতে পারবি না। একটা ঠেলাগাড়ি রেডি আছে। মাল তুলে বেরিয়ে পড়তে হবে। দুজন যাবে তোর সঙ্গে । তারাই ঠেলায় রড তুলে নেবে । তুই শুধু ওদের সঙ্গে যাবি। তারিখ আলি স্পটে থাকবে। মাল নামিয়ে নিয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেবে তোর হাতে। এই খেপের পুরোটাই তোর । আমাদের কিছু দিতে হবে না। আমরা বুঝি .....
ওই যে দুজন .... ওখানে বসে আছে .... টাকা পাবার পর শুধু দুশো টাকা ওদের হাতে দিয়ে দিস।’
শিখরের কিছু বলার ছিল না। কি বলা উচিৎ তার মাথায় আসছিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল ওদিকে অন্ধকারে একটা ভাঙা সিমেন্টের বেঞ্চে দুজন মানুষ বসে আছে। এখান থেকে যেটুকু ঠাওর করা যাচ্ছে .... দুটো সতের আঠেরো বছরের ছেলে। আগুনের দুটো ফুলকি দেখা যাচ্ছে। বিড়ি টানছে বোধহয়।

ঠেলায় চারটে টাটার জি আই রড তুলে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কাঁচা রাস্তা ঠেলে বড় রাস্তায় এসে উঠল।ছেলে দুটোই ঠেলা টানতে লাগল। রাস্তাঘাট ল্যাম্পপোস্টের ঝলমলে আলো মেখে ঘুমোচ্ছে। চারপাশ শুনশান । হুস হাস করে মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে বাইপাস ধরে। রাত প্রায় দেড়টা বাজে।

ছেলে দুটোর নাম হিল্টন আর পদা । পদা বলল, ‘ ওই সামনের গলতায় তো ? ‘
— ‘ কি জানি ঠিক বুঝতে পারছি না .... দাঁড়া তারিখকে ফোন করছি ..... ‘ , শিখর মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্ট গড়াতে থাকে আঙুল দিয়ে।
— ‘ পরেরটা হলে কিন্তু আড়াইশো টাকা লাগবে .... ‘ , হিল্টন আর একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে।
শিখর ফোনে তারিখকে পেয়ে যায়। জানা গেল, পরেরটা না ওই সামনের মোড়টাই। ওখানে তারিখের লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারাই মাল নামিয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেবে।
— ‘ না: ... নে টান টান .... সামনেরটাই ..... তোরা চোষবার জন্য বসে আছিস শালারা.... নে চল চল ......’ শিখর ফুরফুরে মেজাজে বলল।

‘ .... আরে দাঁড়া দাঁড়া ..... অত তাড়াহুড়ো কিসের ! মালেরা মুখটা একটু দেখা ..... ‘
গলাটা কানে আসা মাত্র হিল্টন আর পদা ঠেলাটা ছেড়ে দিয়ে পলকের মধ্যে রাস্তার পাশের অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে ।
থানার দুজন স্টাফ অপ্রস্তুত হতচকিত শিখরের গায়ের কাছে এসে পড়ল।
— ‘ এই যে চাঁদু .... চ্যাম্পিয়ান লোক একেবারে .... ও: , এতদিনে জালে একটা মাছ পড়ল। তা মাল কোথায় খালাস করতে যাচ্ছিলি ?’ একজন বলল। আর একজন শিখরের কলারটা চেপে ধরল । ‘এরপর কি হবে জানিস ? ‘
আতঙ্কে দিশাহারা শিখরের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। ঘেমে নেয়ে তোতলাতে তোতলাতে শুধু বলতে পারল, ‘ আমি তো ... আমি তো ....’।
— ‘ তুই তো .... কি ? কোন শাহেনশা তুই ? চল চল .... থানায় গিয়ে জামাই আদর খেতে খেতে যা বলবার বলবি ....’
কড় কড় কড় কড় করতে করতে থানার জিপ এসে থামল।যে লোকটা শিখরের কলার ধরে ছিল
সে জোরালো এক গুঁতো মেরে বলল, ‘ চল ওঠ ওঠ .... হাতে টাইম নেই .... ‘ বলে ঠেলা মেরে শিখরকে জিপে তুলল।
জিপের সামনের সিটে বোধহয় বড়বাবু বা মেজবাবু বসেছিলেন। তিনি মোবাইল কানে লাগিয়ে কাকে যেন বলছেন, ‘ মালটা ষষ্ঠীতলায় রাস্তার ধারে পড়ে আছে। কেডিয়ার কোম্পানিতে খবর দিয়ে মালটা তুলিয়ে নাও। আমরা একটাকে তুলেছি। এটার যা ব্যবস্থা করার করব ....’

পেঙ্গুইন কন্স্ট্রাকশানের পীযূষ কেডিয়া কথার নড়চড় করার লোক নন। ব্যবসায়ী মাত্রেই শোষক এবং হৃদয়হীন মুনাফাখোর এই ধারণার যারা বশবর্তী শ্রী কেডিয়া তাদের বিরুদ্ধে মূর্তিমান প্রতিবাদ ।
বেলা এগারোটা নাগাদ জোরালো রোদ্দুরে ঝলমল করছে ঝিলের জল। তিনজন সহচর নিয়ে কেডিয়াজি এসে দাঁড়ালেন কার্ত্তিক পাঁজির ইঁটের হাড় পাঁজরা সার ঘরখানার সামনে। সঙ্গের একজন শিখরের নাম ধরে ডাকতে লাগল। ভেতর থেকে অবসন্ন ক্ষীণ কন্ঠে জবাব এল, ‘ যাই ..... এই যাই .... ‘
ভাঙ্গা পায়ে শরীরটাকে কোনমতে ঠেলেঠুলে বার করে আনল কার্ত্তিক। চোখে একরাশ ভয়। চোখদুটো কেমন যেন ভিজে টইটুম্বুর।
বলল, ‘ বাবুরা .... থানা থেকে ? ‘
— ‘ আরে না না ..... থানা থেকে আসব কেন ? পীযূষ স্যার এসেছেন এই এরিয়া কভার করতে। আপনাদের কি দরকার স্যারকে বলুন । ‘
শ্রী কেডিয়া প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘ তোমার পা ভেঙেছে খবর পেয়েছি। তোমার ছেলেকে পেলে সুবিধা হত। এখন কি নেই ? ‘
কার্ত্তিক খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে জলকাটা কাকুতি ভরা চোখে কেডিয়াজির মুখের তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ না .... বডিটা এখনও পাইনি । যদি বডিটা পাবার একটু ব্যবস্থা করে দেন স্যার ..... আর বিরক্ত করব না .... দয়া করুন স্যার ..... ‘
ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে পীযূষ কেডিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল — ‘ মানে ! ‘
‘ আমার ছেলে তো কাল রাতে ধরা পড়েছিল স্যার। ও নাকি আপনাদের ওই রড নিয়ে ভাগছিল..... বডিটা পাওয়া গেছে ওই ষষ্ঠীতলার জলার ধারে। এখন মর্গে । সবাই বলল ও নাকি পালাতে যাচ্ছিল তাই .... থানার বন্ধ হাজত থেকে কি করে যে পালাল ......’
পীযূষ কেডিয়া এবং তার সঙ্গের তিনজন হিমশীতল নৈশব্দ্যে বাকরুদ্ধ, স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল কার্ত্তিক মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে ।

সিভিল ইঞ্জীনিয়ার প্রদীপ্ত মিত্র প্লিন্থ-এর ডেপথ্ অঙ্ক কষে বার করে ফেলেছেন , যাতে চোদ্দ তলা বিল্ডিং-এর ‘বডি’ নির্ভুল খাপ খেয়ে যায়। আপডেটটা দিয়ে রাখার জন্য তিনি মিস্টার পীযূষ কেডিয়াকে ডায়াল করলেন।

কেডিয়াজির বুক পকেটে মোবাইল একটানা বেজে যেতে লাগল নীরব অবহেলায়।প্রথম মধ্যাহ্নের প্রখর আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ।


*****************************

 


 

ছাতিমতলা - অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 ছাতিমতলা

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়



    বসন্তের সকাল। শীতের গাড়ি স্টেশান ছেড়ে চলে গেছে । আর্সিয়ানাদের গাড়ি এসে থামল এক নির্জন পাথুরে জায়গায়। রোদ্দুরে উজ্জ্বল প্রচুর ছোটবড় গাছে ভরা । জায়গাটা শিমূলতলা... ও..ই লাট্টু পাহাড়ের কাছাকাছি। বালি কাঁকড়ে ভরা পথ আর একটুখানি হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি আর যাবে না। আর্সিয়ানা , সৌমিনি আর বজ্র টাটা সুমো থেকে নেমে স্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। চিরচিরে সব পাখির ডাকে ঝিরঝিরে হাওয়া কুটিপাটি হচ্ছে। শৌভিক, মানে শৌভিক চ্যাটার্জী খুব বড় সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত আছে। তুখোড় ছেলে। তরতর করে ওপরে উঠছে। শৌভিক কিন্তু আর্সিয়ানার গুনমুগ্ধ। শিমূলতলায় ছাতিমতলা বাংলা সেই ঠি ক করে দিয়েছে। ওখানকার পুলিশ স্টেশনের ও সি-র মোবাইল নাম্বারও মেসেজ করে পাঠিয়েছিল আর্সিয়ানাকে।
যে ছেলেটা গাড়ি চালাচ্ছিল সে বেশ স্মার্ট গোছের । পরনে নীল জিনস আর লাল টি শার্ট। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গাঁয়ের রঙ। মুখের গড়ন অনেকটা আমির খানের মতো।কথা বলে খুব। বলল, ‘ এখানে এসেছেন খুব ভাল করেছেন। জায়গাটা খুব সুন্দর। আমাদের অমিত স্যারও খুব শরীফ আদমি। মগর একটু সামহালকে থাকবেন। বদমাশ লোক ভি বহুৎ আছে এখানে।’
—-‘ তাই নাকি ? ‘
আর্সিয়ানা নির্বিকারভাবে জিজ্ঞাসা করে।
—- ‘ হ্যাঁ ম্যাডাম। খুন খারাবা ভি আখছার হয় ।আমি অবশ্য বেশিদিন আসিনি এখানে। এই এক সালের মতো হবে।আগে দেওঘরে থাকতাম। এখানে শীতকালটা খুব ভাল লাগে আমার। এই গরম আসছে... বহুৎ পরেশান হবে এবার।যাই হোক আপনারা ভাল সিজনেই এসেছেন। এনজয় করতে পারবেন.... ।’ অনর্গল বকবক করতে লাগল ও। বাংলা বেশ পরিষ্কার, তবে দেহাতি টান আছে।সৌমিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমির খান মার্কা যুবকের দিকে।
আর্সিয়ানা ভোলাভালা সৌমিনির উরুতে একটা চিমটি কাটল।
সৌমিনি চমকে ওঠে....’আ...হ ! ‘
আর্সিয়ানার দিকে তাকায় ঝট করে। আর্সিয়ানা ঠোঁটে গূঢ় হাসি ঝুলিয়ে এক চোখ টেপে।
সৌমিনি অপ্রস্তুত স্বরে অস্ফুটে বলে , ‘ ধ্যাৎ ! ‘ হেসে গড়িয়ে পড়ে গাড়ির সিটে। বজ্র, মানে টাটা সুমোর ড্রাইভার কিন্তু একবারও মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল না।
এখানে শশীভূষণ মিত্রের এক পেল্লায় বাগানবাড়ি আছে এক বিশাল পাথুরে প্রান্তরে। ওখান থেকে দূরে দূরে আবছা ছবির মতো ঝাড়খন্ড অঞ্চলের পাহাড়ের সারি দেখা যায়। শশীভূষণ তো আর এখন বেঁচে নেই। তার ছেলে মেয়েরাও সকলেই পরলোকগত। আছে দুই নাতি আর এক নাতনি। সকলেই ছেলের দিকের। তাদের বয়েস পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। এদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে বড় অমিতাংশু। তারপর সুপ্রভা।
 

    সবার ছোট অজিতাভ। তার পঞ্চান্ন হল। এদের মধ্যে শুধু অমিতাংশুবাবু শিমূলতলার এই খামারবাড়িতে থাকেন। তিনি অবিবাহিত। সঙ্গে থাকত মালি ঝগরু আর তার পরিবার। পরিবার মানে, ঝগরু আর তার বৌ। বৌ কমলার বয়েস তিরিশের বেশি নয়। ঝগরু বেঁচে নেই। মারা যাবার সময় ঝগরুর বয়েস ছিল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা বলা যায়। ওদের কোন ছেলেপুলে নেই। ঝগরু খুন হয়েছিল বছর দেড়েক আগে।
বাড়ির নাম ছাতিমছায়া। লোকে বলে ছাতিমতলা।বাড়িটা প্রায় দেড়শো বছরের পুরণো। চারদিক ঘেরা দেড় মানুষ সমান পাঁচিলে। পাঁচিল অবশ্য বারংবার মেরামত হয়েছে। তবু পাঁচিলের একপাশে বেশ বড়সড় ক্ষত। সেখান দিয়ে সেঁধিয়ে আসে শেয়াল, বুনো ভাম কিংবা বনবিড়াল ।আর বেজির আনাগোনার তো শেষ নেই।একসময়ে এখানে প্রচুর ছাতিম গাছ ছিল । এখনও বেশ কিছু আছে। সেজন্য ভিলার নাম ছাতিমতলা। বাড়ির চারপাশে জঙ্গুলে আবহ।অার ভেতরে তো নাম জানা ও নাম না জানা গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই।
বজ্র আর কমলা হাতে হাতে মহাদেবদের মালপত্র বয়ে এনে ছাতিমতলার একতলার বারান্দায় এনে রাখল। বাড়িটা দোতলা । একতলায় আটখানা ঘর আছে ।দোতলাতে ছ খানা । অমিতাংশুবাবু দোতলার একটা ঘরে থাকেন। অমিতাংশুবাবুর ঘরের পাশের দুটো ঘরে
আর্সিয়ানা এবং সৌমিনির থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। আর্সিয়ানারা দুজনে অবশ্য একই ঘরে ঢুকল।পুরণো দিনের বাগানবাড়ি ।কোন ঘরের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট গোসলখানা নেই। এয়ার কন্ডিশনারও নেই। বাথরুম ওপাশে একটু তফাতে । অমিতাংশুবাবুও অ্যাটাচড্ বাথ নির্মাণের আগ্রহ দেখাননি। কমলার থাকার ঘর মূল বাড়ির পেছন দিকে প্রায় পনের মিটার দূরে।ঢালাই ছাদের পাকা ঘর। টালি বা অ্যাসবেসটসের ছাদ নয়।
ঝগরুর বিধবা ঘরনি কমলা
আর্সিয়ানাকে সিগারেট টানতে দেখে বেশ মজা পেল। হাসিমাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কৌতুকি দৃষ্টিতে অার্সিয়ানা আর সৌমিনিকে  দেখতে লাগল।
বাড়ির হাতায় গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই। আম লিচু সবেদা জাম আর অনেক কাঁঠাল গাছ আছে।পাঁচিল ঘেঁসে গোটা তিনেক বেশ ফলন্ত সজনে গাছও আছে।
সেই ভোর থেকে গাছের ডালে ডালে পাতার আড়ালে শ’য়ে শ’য়ে পাখির কলকাকলি। সারা দিনভর চঞ্চল চপল আনাগোনা। ওদের পারিবারিক ব্যস্ততার শেষ নেই।
 

    এখানে বিদ্যুতের আগমন বেশিদিন হয়নি। এই বছর পাঁচেক হবে। তার আগে সন্ধের পর হত ঘুরঘুট্টি অাঁধার। দেহাতিদের ঘরে জ্বলত ঢিমে আলো। ঝোপঝাড় থেকে শেয়ালের পাল তুলত এককাট্টা একটানা ডাক। জোনাকির আলো চুমকি ছড়াত রাতের শরীরে। এখন নরম সরম হলেও রাতের গায়ে পড়ে মৃদু ভোল্টের আভা ।
রাত্রে কমলার পাকানো দেশি মুরগির ঝোল, ফুলকপির তরকারি আর গরম ভাত
আর্সিয়ানা সৌমিনির যেন অমৃত মনে হল। অমিতাংশুবাবুও একসঙ্গে খেতে বসলেন। খাওয়াদাওয়া চলাকালীন কমলা সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকল। ঘরে দুটো সিঙ্গল খাট আছে। দুটো চেয়ারও আছে । একটা বড় টেবিল আছে দেয়াল ঘেঁসে এবং টেবিলের ওপর একটা বড় আয়না দাঁড় করানো আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে। প্রায় পনের ফুট উঁচু সিলিং। ঘরের আকার কমপক্ষে পনের ফুট বাই বারো ফুট। কমলা নৈশভোজ তত্ত্বাবধানের ফাঁকে কৌতুকভরা চোখে শার্ট প্যান্ট পরা আর্সিয়ানা সৌমিনিকে দেখে চলেছে। খাওয়া শেষ হলে কমলা এঁটো বাসনপত্র তুলে নিয়ে চলে গেল।
এসব জায়গায় সকালবেলাটা যেন স্বর্গীয় সুষমা মাখান। একটা মোরগ ডাক ছাড়ল সনাতন ভৈরবী মায়ায়।অমল উদার আলোয় মাখামাখি শিথিল অলস হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল সে তান। গাছের পাতায় নরম লাবন্যময় আলো পড়ে চিকচিক করতে লাগল একটু পরে। কমলা একটা বড় ঝুড়ি মাথায় চাপিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেল হন্তদন্ত হয়ে। বোধহয় স্টেশনের পাশে হাটে বসে মুরগির ডিম বিক্রি করে। বাড়ির পুব দিকে একটা ছোটখাটো দেশি মুরগির খামার আছে। সকালবেলায় দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। রঙ বেরঙের মুরগির দল বাড়ির সামনে নিশ্চিন্তে ঘুরঘুর করছে। খুঁটে খুঁটে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে মাটিতে ঘাসে।
আর্সিয়ানার সকালবেলায় এক কাপ কফি খাওয়ার অভ্যেস। কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে না। অগত্যা কমলার এনে দেওয়া এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসল।সৌমিনি এখনও ঘুমোচ্ছে বিছানা আঁকড়ে। সৌমিনিকে আর্সিয়ানার বন্ধুও বলা যায়, ভক্তও বলা যায়। আর্সিয়ানার হাত পাকড়ে এখানে চলে এসেছে শুধুমাত্র ভ্রমণবিলাসে। আর্সিয়ানার ডাকাবুকো জীবন ও ক্ষুরধার মানসিকতার সঙ্গে তার কোন দিক দিয়েই কোন মিল নেই। কিন্তু বিপরীত মেরুদ্বয়ই তো একে অপরকে টানে। আর্সিয়ানা সৌমিনির জোড় লাগা বোধহয় সেইভাবেই।দুজনেরই বয়েস সাতাশ অতিক্রান্ত।
একতলার বারান্দায় খান চারেক প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা আছে। একটা ছোট টেবিলও আছে।
আর্সিয়ানা একটা চেয়ারে বসে চা খেতে লাগল। বারান্দাটা একটু উঁচু। উঠোনে পা দিতে গেলে তিনধাপ আধচাঁদা সিঁড়ি নামতে হবে। তিননম্বর সিঁড়িটার নীচে বসে আছে একটা কুকুর।চেহারা দেখে মনে হয় অ্যালসেসিয়ান আর দেশি কুকুরের সংকরজাতীয়। দু’পা সামনে রেখে বসে জিভ বার করে শ্বাস ফেলছে। সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে যেন কিসের প্রতীক্ষায়।মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে আর্সিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকছে কয়েক সেকেন্ড। কয়েকবার এরকম তাকাবার পর কুকুরটার চোখে চোখ পড়ল আর্সিয়ানার।
দূর দিগন্তে দেখা যাচ্ছে নীলাভ পাহাড়ের সারি। নি:শব্দ চারিধার।
সৌমিনির ঘুম ভেঙে গেছে। দেখল
আর্সিয়ানার বিছানা ফাঁকা। আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে বারান্দায় এল। এসে দেখল ও অলস ভঙ্গীতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
— ‘ হাই লিখা... গুড মর্নিং...’
— ‘ হাই ডার্লিং... গুড মর্নিং... ঘুম ভাঙল ? ‘
সৌমিনি
আর্সিয়ানার পাশে এসে বসল। সামনের আবছা নীল পাহাড়ের দিকে উদাস চোখ মেলে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ।
— ‘ হোয়াট আ বিউটিফুল ল্যান্ডস্কেপ .... না লিখা ? ‘
— ‘ ইয়েস, রিয়েলি ...’
দুজনে আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ।
কুকুরটা বারান্দার নীচে ঠায় বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকাল আবার। কেমন যেন আবেদনের বার্তা মাখা দৃষ্টি।
আর্সিয়ানা তাকিয়ে রইল নির্লিপ্তভাবে।
— ‘ আচ্ছা অমিতাংশুবাবুর সমস্যাটা কি সেটা তো বললি না !
কি জন্য তোকে ডেকেছেন এখানে ?’ সৌমিনি জিজ্ঞাসা করে।
— ‘ মূল সমস্যাটা হল কমলাকে নিয়ে। পরে বলব সব কথা।’ অার্সিয়ানা সংক্ষেপে জবাব দেয়।
খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজনে। একটা বছর পঁচিশের সুঠাম চেহারার ছেলে সামনের টেবিলে আর এক কাপ চা এনে রাখল। সেই নীল রঙা জিন্স এবং লাল রঙের টিশার্ট পরা আমির খান মার্কা ড্রাইভার ছেলেটা। বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গীতে সৌমিনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ম্যাডাম চা ... ‘। আদিবাসিসুলভ শক্তপোক্ত শরীরি কাঠামো, কিন্তু রঙ কালো নয়। বরং বেশ ফর্সা।
আর্সিয়ানা জিজ্ঞাসা করল ,
‘ তোমার নাম কি ?’
ছেলেটা বলল, ‘ বজ্র । আমি অমিতাংশু স্যারের গাড়ি চালাই।’
— ‘ ও আচ্ছা , ঠিক আছে । তুমিই তো কাল আমাদের গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে এলে। ঠি ক আছে, দরকার হলে ডাকব....’
ছেলেটা চলে গেল।
দুপুর একটা নাগাদ কমলা হাট থেকে ফিরল। তারপর চটপট দুপুরের খাবার লাগিয়ে দিল ভেতরের তিন নম্বর ঘরে পাতা টেবিলে। মটর ডাল, পোস্ত মাখানো আলু ভাজা আর দেশি চিকেনের কারি। আর শেষে সাদা মিষ্টি দই। অপূর্ব স্বাদ ।

অমিতাংশুবাবু বললেন, ‘এই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে পারলে সব দিক দিয়েই ভাল হয়। কিন্তু মন সাড়া দেয় না। কি মায়ায় যে জড়িয়ে আছি এই খামারবাড়িটার সঙ্গে। কমলা আর বজ্রই এ বাড়ির সব কিছু সামলায়। বজ্র অবশ্য বছর দেড়েক হল এখানে এসেছে।তার আগে কমলা একাই সব সামলাত।
অমিতাংশুবাবু
আর্সিয়ানাকে বললেন , ‘ কে বা কারা যেন ঝগরুকে মেরে ফেলেছিল। মার্ডার করেছিল। তারপর ওই দক্ষিনদিকে পাঁচিলের ধারে যে আমগাছটা রয়েছে তার ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। খুন করার কারণটা আজও পরিষ্কার হয়নি।পুলিশি তদন্ত এখনও চলছে। ঝগরুর বউ কমলার ছেলেপুলে হয়নি। প্রথমদিকে খুব কান্নাকাটি করত। তারপর সামলে নিল।ওর তো নিজের লোক বলতে তেমন কেউ নেই। মা বাবা দুজনেই মরে গেছে। কমলা আবার তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গেল। শুধু স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে গেল না। অসম্ভব প্রগলভ হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন।কেমন একটা ব্যধি ওর ওপর চেপে বসল। একটু আকর্ষণীয় মহিলা দেখলেই তাকে পাবার জন্য ও ক্ষেপে ওঠে। ‘
অার্সিয়ানাকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অমিতাংশুবাবু বলে উঠলেন, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম ঠিকই শুনছেন.... পুরুষে নয়, নারীতে তীব্র আকর্ষণ। অথচ ও একেবারেই এরকম ছিল না। একেবারেই সহজ সরল একটা দেহাতি মেয়ে..... ‘
একটু চুপ করলেন অমিতাংশু।
আর্সিয়ানাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘ জানি কি ভাবছেন।আমি কমলাকে টলারেট করছি কেন।ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। হ্যাঁ তা দিতেই পারতাম। মুশ্কিল হল, আমি ওকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসি। আমার তো পুত্র কন্যা কেউ নেই। তাই.... । কিন্তু ব্যাপারটা দিন দিন ইনটলারেবল হয়ে উঠছে।....এই যে আপনারা দুজন মেয়ে এখানে এসেছেন আমি শিওর ও সুযোগ খুঁজছে আপনাদের ঘনিষ্ঠ হবার জন্য।আর একটা ব্যপার হল ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ। সেটা মাঝে মাঝে কি করে বেড়ে যায় কে জানে।আবার অন্য সময়ে একদম নর্মাল। ভারি ওজন একদম বইতে পারে না। সেদিন ষাট কেজির একটা সিমেন্টের বস্তা অনায়াসে তুলে নিয়ে গোডাউনে ঢোকাল। .... আপনার কি মনে হয় এটা কোন সাডেন হর্মোনাল বা ক্রমোজোমিক মেটামরফোসিস ?
আমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।’
— ‘ আমি তো এ ব্যাপারে এক্সপার্ট নই ....’ ,
আর্সিয়ানা বলে। ‘....তবে সো ফার অ্যাজ আই নো এরকম সাডেন মেটামরফোসিস ইজ কোয়াইট আনলাইকলি । দেয়ার মাস্ট বি সামথিং আনক্যানি বিহাইন্ড দা অকারেন্স ।
যাই হোক, আমি চেষ্টা করব টু দা বেস্ট অফ মাই ক্যাপাসিটি টু আনভেল দা মিস্ট্রি।’ তারপর ট্রেডমার্ক গোয়েন্দাসুলভ লব্জে জিজ্ঞাসা করল, ‘ এ ব্যাপারে আপনার কাউকে সন্দেহ হয় ? ‘
—- ‘ না: , কাকে সন্দেহ করব বলুন তো । সন্দেহ করার মধ্যে তো এক ওই বজ্র। কিন্তু কমলার কান্ডকারখানার জন্য তো সে রেসপনসিবল হতে পারে না। তাছাড়া ঝগরু যখন মার্ডারড হয় সে তো এখানে আসেইনি।’
— ‘হুমম্ ... আচ্ছা কুকুরটা কতদিন ধরে এখানে আছে ? ‘ অার্সিয়ানা আচমকা প্রশ্ন করে।
— ‘ কোন কুকুরটা বলুন তো ?’
— ‘ ওই যে অ্যালসেসিয়ানের মতো দেখতে ‘
— ‘ ও আচ্ছা ....টমি... ‘ একটু ভাবতে লাগলেন। ‘ ওটা .... ওটা যদ্দুর মনে পড়ছে এখানে এসেছে ঝগরু মারা যাবার মাসখানেক পর । এক শীতের রাতে হঠাৎ এল গেট দিয়ে ঢুকে। তারপর থেকে গেল এখানে। কমলাই খেতে দেয়। আমি আর তাড়াইনি ওটাকে।’
— ‘ও আচ্ছা । আচ্ছা ঠিক আছে । দেখা যাক হাউ ইট প্যানস্ আউট।’
—- ‘ হ্যাঁ থ্যাঙ্ক ইউ। দেখুন কি করতে পারেন। .... আর হ্যাঁ , একটা কথা । আপনারা কিন্তু রাত্রে দরজা জানলা ভাল করে আটকে শোবেন।’
— ‘ ওক্কে ‘

নিশুতি রাত। ফাঁকা জায়গা । নিস্তব্ধ পরিবেশ। বেশ বড় মাপের ঘরের দুপাশে দুটো সিঙ্গল বেড। প্রায় পনের ফুট উঁচুতে সিলিং।ঘরে ঢিমে বালব্ জ্বলছে।সাতফুট উচ্চতার সেগুন কাঠের দরজার ছিটকিনি এবং খিল বন্ধ।অমিতাংশুবাবুর কথামতো
আর্সিয়ানা যেদিকে শুয়েছে সেদিকের বড় বড় দুটো জানলা বন্ধ করা আছে। তেমন গরম এখনও পড়েনি এখানে।মাঝরাতের পর গায়ে কিছু টেনে নিতে হয়।নি:শব্দ তল্লাটে হঠাৎ একপাল শেয়াল সমবেত স্বরে ডাকতে আরম্ভ করল। আর্সিয়ানার চোখে ঘুম নেই।মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।ওদিকের খাটে সৌমিনি বেশ খানিকক্ষণ আবোলতাবোল বকবক করার পর এখন ঘুমিয়ে কাদা।হাল্কা নাকও ডাকছে।অার্সিয়ানা ভাবে, সত্যি... সৌমিটা ছেলেমানুষই থেকে গেল।
মোবাইল খুলে সময় দেখল
আর্সিয়ানা । একটা বাহান্ন । এরপর আরও মিনিট পাঁচেক কাটল। চোখের পাতা একটু জুড়ে আসছে যেন।
একটা চাপা গোঙানিতে ঘুম ছুটে গেল তার। ধড়মড় করে উঠে বসল অার্সিয়ানা। তার বালিশের তলায় রিভলভার আছে। পাশে টর্চ। অবশ্য মৃদু বাতিতে সবই দেখা যাচ্ছে। চিৎ হয়ে শোয়া সৌমিনির দেহে উপুড় হয়ে দখল নিতে চাইছে কে একজন। আর সৌমিনি ছটফট করছে নিজেকে ছাড়াবার জন্য।দরজা জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ। ভয়ে বিষ্ময়ে কন্ঠরোধ হয়ে গেল তার।কিন্তু অার্সিয়ানার স্নায়ু অন্য ধাতুতে গড়া । কয়েক সেকেন্ড লাগল বুকের চাপটা কাটাতে। ঝট করে টর্চের আলো ফেলল সৌমিনির বিছানায়। সৌমিনির শরীরে ওপর অস্থির আকুলিবিকুলিরত এক নগ্ন নারীদেহ। দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল
আর্সিয়ানা যে, নগ্ন নারীটি কমলা। আর্সিয়ানা তার আঠাশ বছরের বৈচিত্রময় এবং দু:সাহসী জীবনে এ ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি কখনও। কিন্তু সে অন্য ধাতুতে তৈরি। এর মধ্যেই ভাবনা চিন্তা করে ফেলল। সে সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে এটা একটা অ্যাকিউট কেস অফ পেরিফেরাল হ্যালুসিনেশান। সে তাড়াতাড়ি সুইচ বোর্ডের কাছে গেল এবং সুইচে চাপ দিল। আলোয় ভরা ঘরে অার্সিয়ানা কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। সৌমিনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তড়িতাহত এবং বিদ্ধস্ত ভঙ্গীতে। উদভ্রান্ত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিছানার পাশে দাঁড়ানো আর্সিয়ানার দিকে। আর্সিয়ানা কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় না হয়ে ঢাকা গ্লাস থেকে জল নিয়ে সৌমিনির চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে লাগল। তারপর ওই রাতদুপুরেই মোবাইল কল দিল অমিতাংশুবাবুকে। দরজা বা জানলা কিছুই খুলল না।
মোবাইলে রিং হয়ে যেতে লাগল। কেউ ফোন ধরল না। স্লিপিং পিল খেয়ে বিছানায় যাওয়া অমিতাংশুবাবুর বোধহয় ঘুম ছুটল না।
পুব আকাশে সূর্য উঠে যথারীতি ভোর হল। অার্সিয়ানা দরজা খুলে বারান্দায় এল। দেখল, গাছকোমর করে শাড়ি বেঁধে নীচে চাতালে শুকনো পাতা ঝাঁট দিচ্ছে কমলা।
আর্সিয়ানার সব কিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।সৌমিনি এখনও ট্রমায় আচ্ছন্ন।ঘরে শুয়ে আছে।
সকাল প্রায় নটা নাগাদ একজন ডাক্তারবাবু এলেন। কমলাই ডেকে নিয়ে এল। অার্সিয়ানার অবাক হওয়ার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । ডাক্তারবাবুর ঝাঁঝায় বাড়ি। শিমূলতলায় প্র্যাকটিস করেন।তিনি অবশ্য বিশেষ কিছু বুঝতে পারলেন না।একটা ট্র্যাঙ্কুইলাইজার প্রেসক্রাইব করে গেলেন। ডাক্তারবাবু যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন অ্যালসিসিয়ান মার্কা কুকুরটা ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি শুরু করল কমলার আশেপাশে।শান্তশিষ্ট কুকুরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
আর্সিয়ানা দোতলার বারান্দায় বসে রইল দূরে আবছা নীল পাহাড়ের সারির দিকে চেয়ে। ভাবল, সৌমিনিকে কি আজ রাতে এখানে রাখা ঠি ক হবে ! বেচারা এমনিতেই ট্রমাটাইজড হয়ে আছে।সে কিন্তু আজ রাতে কি ঘটে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কাল রাতের ঘটনাটা সত্যিই কি হ্যালুসিনেশান ছিল ? নানা চিন্তা ঘোরে আর্সিয়ানার মাথায়। একবার ভাবল, স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবে কিনা । ফাঁড়ির ফোন নম্বর আর্সিয়ানা যোগাড় করেই রেখেছে। তারপরই মনে হল, এরকম একটা ঘটনায় পুলিশের কি করার আছে। অনেকক্ষণ ধরে সাতপাঁচ ভাবার পর আর্সিয়ানা থানার বড়বাবুকে একটা কল দিল। ওদিকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ হয়ে ফোন কেটে গেল। তারপর বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর হাল ছেড়ে দিল আর্সিয়ানা । প্রত্যেকবারই ঘুরে আসে একই কথা— ডায়াল করা নম্বর নাকি উপলব্ধ নেই ,পরিষেবা সীমার বাইরে। ও: ডিজগাস্টিং.... আর্সিয়ানা বিরক্তিতে খানখান হয়।বড়বাবু কি জবাব দিচ্ছেন
কিছু শোনা যাচ্ছে না। ঘড়ঘড় করে আওয়াজ হয়ে লাইন কেটে যাচ্ছে । ওফ্ , এই নেটওয়ার্কের সমস্যায় জীবন ঝালাপালা হয়ে গেল। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে
আর্সিয়ানার চোখেমুখে।
কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। কাকে একটা দেখা গেল ওই দূরে একটা আমগাছের তলায় ঠি ক যেন আমগাছটার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাল্কা ধোঁয়া উড়ছে মনে হচ্ছে এখান থেকে। কোন ব্যাটা বোধহয় ওখানে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে।
টমিকে দেখা যাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরে। বিদ্যুৎতরঙ্গের মতো
আর্সিয়ানার মাথায় একটা চিন্তা ছিটকে উঠল। সে তাড়াতাড়ি দোতলা থেকে নীচে নেমে এল। কুঠির চারদিকের বিশাল কম্পাউন্ড ঘুরে কুকুরটাকে খুঁজতে লাগল। না:, কোথ্থাও নেই। আর্সিয়ানা আপনমনে বোকার মতো হাসে। তাই তো ! সে কুকুরটাকে খুঁজে মরছে কেন। দক্ষিনদিকের ওই আমগাছটার দিকে হাঁটতে লাগল শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে যেখানে কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে । মশ্ মশ্ করে আওয়াজ হতে লাগল।নীরব আবহে ওইটুকু আওয়াজই বাতাসে ছলকে ছলকে উঠছে।আমগাছটার তলায় পৌঁছল আর্সিয়ানা ।কেমন নির্জন সিরসিরে পরিবেশ।কোন গাছের পাতার আড়ালে বসে একটা  পাখি ডাকছে । বাতাস কেটে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে কুঁড়ুর কুঁড়...... কুঁড়ুর কুঁড় ..... অসীম নীরবতায় রহস্যময় শব্দের মতো।
অবাক কান্ড। ওখানে কাউকে দেখতে পেল না
আর্সিয়ানা । কেউ নেই ধারে কাছে। এ জায়গাটায় আম জাম কাঁঠাল লিচু গাছ যেমন আছে, তেমনি শাল গাছও আছে বেশ কিছু। বেশ ঘন জঙ্গল মতো হয়ে আছে এক জায়গায়। কেমন যেন ঝুঁঝকো অাঁধার ওখানে। অার্সিয়ানা ওই দিকেই তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দেখে ওই শাল গাছগুলোর আড়াল থেকে অ্যালসেসিয়ানের মতো দেখতে টমি বেরিয়ে এল। ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ধীরে সুস্থে হেঁটে আর্সিয়ানার সামনে এসে দাঁড়াল। মুখটা তুলে ঠি ক কালকের মতো করুণ আবেদনময় চোখে আর্সিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অদ্ভুত একটা আবেশ জড়িয়ে ধরছে যেন তাকে । অার্সিয়ানার হঠাৎ সৌমিনির কথা মনে পড়ল। সে জোর পায়ে হাঁটা দিল ছাতিমতলা কুঠির দিকে। কুকুরটাও তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তার নিজের ওপর খুব রাগ হল। মনে হল, যদিও কমলাকে বলে এসেছে সৌমিনিকে দেখার জন্য, তবু একটা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেয়েকে একা ফেলে আসা উচিৎ হয়নি। আর কমলা তো.... কাল রাত্রের কথা মনে করে শিউরে উঠল সে। তার কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল নাকি। অন্তত আজ রাতটা কাটাতে হবে এখানে। হাঁটতে হাঁটতেই ফাঁড়ির ও সি-র মোবাইল নম্বর ডায়াল করল। এটা মনে হচ্ছে একেবারেই পুলিশ টুলিশের মামলা নয়। তবু, আর্সিয়ানা পুলিশ ছাড়া আর কার সাহায্যই বা নিতে পারে এখানে।
তরতর করে দোতলায় উঠে ঘরে ঢুকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল
আর্সিয়ানা । বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে বসে সৌমিনি কমলার সঙ্গে কি সব গল্প করছে। অবশ্য কমলাকে দেখে সৌমিনির কোন প্রতিক্রিয়া হবার কথা নয়।সে তো কাল রাতে কমলাকে দেখতেই পায়নি। যা দেখেছে, তা শুধু অার্সিয়ানা । মাথার দিকে জানলার বিশাল পাল্লা দুটো খোলা। হু হু করে হাওয়া বইছে শালবনের মধ্যে দিয়ে।
দুপুরবেলায় দুজন দেহাতি মহিলা মাদুর বিক্রি করতে এল। এখানে গরমকালে এগুলোর খুব চাহিদা। দামও কম। রকমারি সব সেলাই ও বুনন। কমলা, বজ্র আর অমিতাংশুবাবু একতলার সামনের বারান্দায় বসে মাদুর পছন্দ করছে। অার্সিয়ানা সৌমিনিকে নিয়ে নীচে নেমে এল। হাওয়ায় কেমন যেন আতরের গন্ধ নাকে লাগল
আর্সিয়ানার।
সৌমিনি এখন অনেক স্বাভাবিক।কিন্তু আজ রাতে আবার কি ঘটে সেটা চিন্তা ক’রে
আর্সিয়ানার মতো মেয়েরও গা সিরসির করে উঠল। মোবাইলে তো এখনও থানার অফিসারের সঙ্গে একবারও কথা বলা গেল না। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাদুর কেনা বেচা দেখতে দেখতে থানার ও সি-কে একটা টেক্সট মেসেজ করল — আজ রাতে তার সাহায্যের দরকার হতে পারে। দু মিনিটের মধ্যে উত্তর এল— ওকে, জাস্ট গিভ মি আ মিস কল। টেক কেয়ার। এক চান্সেই কানেকশান হল। অথচ ভয়েস কানেকশান কিছুতেই হচ্ছিল না। নেটওয়ার্কের এত প্রবলেম যে বলার নয়। কিন্তু আর্সিয়ানার অনুসন্ধিৎসু মনে সবসময়ে সন্দেহের কাঁটা লটকেই থাকে। তার মনে হতে লাগল, কে যেন মোবাইল যোগাযোগে বাধা দিচ্ছিল। আর ওই ঘর্ঘর আওয়াজ .... ওটা কি যান্ত্রিক গন্ডগোল , নাকি .....! আবোলতাবোল চিন্তা আসছে আর্সিয়ানার মাথায়। সে ঠি ক করে ফেলে অাজ রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে কালকেই সৌমিনিকে নিয়ে কলকাতায় রওয়ানা দেবে। তারপর দরকার হলে সে আবার একা ফিরে আসবে এখানে। রহস্যটা তো উন্মোচন করতেই হবে। কাল রাতের সেই সাঙ্ঘাতিক দৃশ্যটা মনে করে অার্সিয়ানার মতো ডাকাবুকো মেয়েও মনে মনে একটু যেন কেঁপে গেল। পেরিফেরাল হ্যালুসিনেশান ? কে জানে, হবে হয়তো । কিন্তু সৌমিনি তাহলে ট্রমাটাইজড হল কেন ? বড্ড ধাঁধার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে গোটা ব্যাপারটা।
মাদুর বাছাবাছি চলছে বারান্দায়।টমি বারান্দায় উঠে এল। কমলার একদম কাছ ঘেঁসে বসল।বসেই রইল। সেই একইরকম জিভ হ্যালহ্যাল করছে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে কমলার দিকে তাকাচ্ছে।
আর্সিয়ানার মনে হল, কেমন যেন আসঙ্গলিপ্সু ধরণ। কমলার অবশ্য কোন হেলদোল নেই। সে মাদুরওয়ালিদের সঙ্গে দেহাতি ভাষায় নানা গল্পগাছায় ব্যস্ত।
অমিতাংশুবাবু
আর্সিয়ানাকে বললেন, ‘ বিকেলে আপনারা লাট্টু পাহাড়ে ঘুরে আসতে পারেন। ভাল লাগবে। সঙ্গে কমলা আর বজ্রও যাবে। আরও দুএকদিন থাকলে হলদি ঝর্ণা দেখে আসতে পারতেন। খুব ভাল পিকনিক স্পট।যাক, পরে আবার কখনও এলে..... ‘
কমলাও বলল, ‘ হাঁ দিদি চলেন, বিকেল বেলা ওখান থেকে সানসেট দেখবেন ....খুব সুন্দর ।’
সকাল গড়িয়ে চলল দুপুরবেলার দিকে। মাদুরওয়ালিরা গা তুলল। কমলাও কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। এখানে রান্নাঘরগুলো খানিক তফাতে। ওই কুয়োতলার পাশে। টমিও একেবারে কমলার গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটতে লাগল রান্নাঘরের দিকে। কমলাকে যেন কাছছাড়া করতেই চাইছে না। আর হ্যাঁ, বজ্রকে ধারে কাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ওই যে আমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিল। ধোঁয়া বেরোতে দেখল।ওটা কি বজ্র তবে ? সেটাও কি তবে ভিসানারি অ্যাবারেশান !
আর্সিয়ানার মাথায় বিদ্যুতের মতো চিড়িক দিয়ে উঠল একটা ভাবনা। তবে কি ......
কিন্তু টমি তার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকে কেন ? ওর কি কিছু বক্তব্য আছে
আর্সিয়ানার কাছে ?
আর্সিয়ানা ঠিক করে নেয়, আজ রাত্রেই ফয়সালা করতে হবে।
বিকেলবেলা মনোরম বাসন্তী আবহে ভরে আছে।
আর্সিয়ানা আর সৌমিনি কমলাকে সঙ্গে নিয়ে লাট্টু পাহাড়ের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। এটা কিছুই না, একটা ছোট টি লা। শীতকালে অনেক টুরিস্ট আসে শিমূলতলায়। এখন একদম ফাঁকা। নির্জন বিকেলে পড়ে আছে আশপাশ। তিনজনে মিলে উঠতে লাগল টি লার ওপর দিকে। অার্সিয়ানা দেখল বজ্রও যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে।কমলা ঘুরে নীচের দিকে তাকিয়ে কি দেখছে। আর্সিয়ানা দেখল নীচের থেকে তীরবেগে ওপরে দৌড়ে আসছে টমি। এসে কমলার চারপাশে একবার ঘুরপাক খেয়ে নিল। তারপর তাদের সঙ্গে
টি লার ওপরে উঠতে লাগল।
আর্সিয়ানা ভাবল, কুকুররা খুব ফেথফুল হয়।কমলা টমিকে খেতে দেয়। তাই বোধহয় কমলার সঙ্গে এত দোস্তি। বজ্র তাদের সঙ্গেই হাঁটছিল। টমি আসার পর অনেকটা তফাৎ হয়ে গেল। ও নিশ্চয়ই কুকুরটাকে তেমন পছন্দ করে না।
এখন অফ সিজন। লাট্টু পাহাড়ে একটাও টুরিস্ট নেই। টিলার ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।ঝোপঝাড়, পাথুরে মালভূমি, আবছা জনপদ নীরব ক্যানভাসের মতো এলিয়ে আছে। সন্ধে নেমে আসছে। পড়ন্ত আলোয় শত শত নীড়ে ফেরা পাখির কাকলিতে মুখর হতে লাগল চারপাশ। বজ্র বলল, ‘ ওই দেখুন ম্যাডাম .... ওইদিকে স্টেশান আছে।’ তারপর উল্টোদিকে ঘুরে বলল, ‘ ....আর ও..ই দিকে হলদি ঝর্ণা .... এখান থেকে খরিফ ছ কিলোমিটার হবে। ওই যে.... অনেক পেড় দেখা যাচ্ছে। ওটা একটা টুরিস্ট স্পট। কুছ দিন পহলে ওখানে নাকি অচানক শের দেখা গিয়েছিল।’
— সৌমিনি প্রবল উৎসাহে বলে, ‘ তাই নাকি ! ইশশ্ হাতে টাইম থাকলে যাওয়া যেত .....’
আর্সিয়ানা সৌমিনির পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয় , ‘ কাম অন ডিয়ার, ডোন্ট ওয়ারি...... আবার আসব , চিন্তা নেই...’
বজ্রও সায় দেয়, ‘ হাঁ ম্যাডাম, জরুর আসবেন।’
এই সময়ে টমি বজ্রের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রচন্ড গর্জন করতে লাগল। কমলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । মোটেই থামাবার চেষ্টা করছে না কুকুরটাকে। বজ্র আবার তফাতে সরে গেল। পুঁচকে পাহাড়টার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। আলো আরও মরে এসেছে। বিহঙ্গের কলকাকলিতে তিরতির করছে গোধূলি । কমলা একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ ওই ওদিকে, অনেক দূরে যেখানে ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে ওইখানে আমাদের গাঁও ছিল।’
আর্সিয়ানা কমলার দিকে তাকিয়ে থাকে । বলে, ‘ কেন, এখন আর নেই ? আর যাও না ওখানে ?’ কমলা তার গাঁওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বলল, ‘ হাঁ, গাঁও তো জরুর আছে, মগর আমি তো আর নেই .....’ কমলা আনমনে উদাস দৃষ্টি মেলে ওই দূর গাঁওয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর্সিয়ানার মাথায় চিড়িক দিয়ে উঠল একটা ভাবনা। সে কমলার দিকে ঘুরে বলল, ‘ তার মানে ?’ টমি দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটানা লেজ নাড়াতে নাড়াতে একবার এর মুখের দিকে আর একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।যেন সব কথাই বুঝতে পারছে। কমলা কোন উত্তর দিল না। অানমনে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নীচের ওই দূর গাঁয়ের দিকে।কোন ঘোরে যেন ডুবে আছে।এ জগতে নেই। আর্সিয়ানার চোখে পড়ল টমিও কমলার পাশে দাঁড়িয়ে ওই দূরের ঘরবাড়ি ক্ষেতখামারের দিকে তাকিয়ে আছে উন্মুখ হয়ে।ওই গাঁ যেন ওরও খুব চেনা।
পকেট থেকে মোবাইল বার করে ফের একটা টেক্সট করে ফাঁড়ির
ও সি-কে — ‘ প্লিজ মেক শিওর টু স্টে ক্লোজ বাই আফটার ইভনিং ....’। জবাব এল তক্ষুণি , ‘ ওকে ....ডোন্ট ওয়রি । জাস্ট গিভ আ মিস কল। স্টে সেফ।’
একসময়ে সন্ধে নেমে আসে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অার্সিয়ানা আর সৌমিনি দূর পাহাড়ের আড়ালে লাল আবির ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাওয়ার ছবি দেখছিল। একদম ছবির মতো দৃশ্য। কমলাকে দেখা গেল একটা ঝাঁটা আর ঝুড়ি নিয়ে বাড়ির সামনের শুকনো পাতা পরিষ্কার করছে। মেয়েটা সবসময়ে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। অমিতাংশুবাবু কোথায় বেরিয়ে গেলেন। বোধহয় এখান থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে এক উকিল বন্ধুর বাড়ি গেলেন আড্ডা মারতে। অার্সিয়ানার মনে হল, এই অমিতাংশুবাবু মানুষটিও বেশ সন্দেহজনক চরিত্র। বেশ দুর্বোধ্য ধরণের। সারাদিন কোথায় যে থাকেন বোঝা গেল না। কাল রাতে ওরকম অদ্ভুত ঘটনার পর ফোন করে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবাক কান্ড।
এখানে বিদ্যুতের ভোল্টেজ খুব কম। জোলো পানসে আলো।
আর্সিয়ানাদের ঘরের দরজার পাশের দেওয়ালে একটা অংশে প্লাস্টার খসে গিয়ে ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে পড়ে দেয়ালের ওপর নগ্ন মানুষের আকার তৈরি হয়েছে। দরজার পাশে যেন দাঁড়িয়ে আছে কার প্রতীক্ষায়। ভর সন্ধেবেলায় চোখে পড়লে গা ছমছম করে।
এর ঠিক পাশেই অমিতাংশুবাবুর ঘর। দরজা আধখোলা।
আর্সিয়ানা বারান্দার এদিক থেকে ওদিক ধীর পায়ে পায়চারি শুরু করল। পায়চারি করতে করতেই অমিতাংশুবাবুর ঘরের ভেতর উঁকি দিল। ভেতরে অন্ধকার। যেটুকু দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে ঘরে আসবাবপত্র খুব কম। সৌমিনির মোবাইলে থানার ও সি-র নম্বরটা সেভ করে দিয়ে বলল, ‘ শোন তুই এখানে দাঁড়া।কোন ভয় নেই। আমি একটু এ ঘরটায় ঢুকছি। যদি সাত মিনিটের ভেতর না বেরিয়ে আসি এই নাম্বারে একটা মিসকল দিবি শুধু। এখানে দাঁড়া। কোন ভয় নেই। কিচ্ছু হবে না।’ মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আর্সিয়ানা অমিতাংশুর ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। দুদিকে দুটো বড় বড় জানলা। জানলার পর্দাগুলো হাওয়ায় নাচানাচি করছে।একটা ঢাউস সাইজের ড্রেসিং টেবিল রয়েছে একপাশে। আর একটা দুজন শোবার মতো খাট। খাটে একটা মশারি টানানো রয়েছে। চারপাশ ওপর দিকে গোটানো। একটা টেবিলও রয়েছে মনে হচ্ছে খাটের মাথার দিকে। আর্সিয়ানা ঘরের চারদিকে আলো ফেলতে লাগল। একটা দেয়াল আলমারি রয়েছে দক্ষিণদিকের জানলার পাশে। জানলার একটা পাল্লা খোলা ।
আর্সিয়ানা ঘরের চারদিকে মোবাইলের আলো ঘোরাতে লাগল। ঘরের সিলিং-এ একটা পুরনো ঝুলমাখা পাখা ঝুলছে। অার্সিয়ানা দেখতে পেল সিলিং ফ্যান থেকে একটা মোটা নাইলনের দড়ি ঝুলছে। ঘরে কোন জামাকাপড়, তোয়ালে, চিরুনি বা অন্য কোন সরঞ্জাম দেখা গেল না। আর্সিয়ানা দেয়াল আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। পাল্লাটা খুলে ফেলল। ভেতরটা একদম ফাঁকা।পাল্লা খুলতেই ভেতর থেকে যেন একটা মিস্টি আতরের গন্ধ মাখা দমকা হাওয়া এক ঝটকায় বেরিয়ে এসে আর্সিয়ানাকে ঝাপটা মারল।
সাত মিনিট পুরো হবার আগেই অার্সিয়ানা বেরিয়ে এল। সৌমিনি যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল ।

আর্সিয়ানা সৌমিনিকে বলল, ‘চল ঘরে যাই। প্যাক আপ করে রাখতে হবে । আজ রাতেই হয়ত এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। হ্যাঁ, আজ রাতে আর ঘরে শোব না কিন্তু। বারান্দাতেই বসব।’
— ‘ কেন ? ঘরে কোন ডেঞ্জার আছে ?’ খুব স্বাভাবিকভাবে সৌমিনি জিজ্ঞেস করে।যেন আগে থেকেই জানা ছিল কথাটা ।
— ‘ কিছু জানি না। তবে সাবধানের মার নেই। তাছাড়া তোকে এখানে নিয়ে এসেছি।আমার একটা দায়িত্ব তো আছে...’
— ‘ কেন আমি কি ভয় পেয়েছি ? আমি কি একবারও কিছু বলেছি ?
আমি চাই মিস্ট্রিটা আনভেইলড হোক।’ সৌমিনি একটু যেন অভিমানী।
আর্সিয়ানা অবশ্য ড্যামেজ কন্ট্রোল করে নেয়— ‘ ও... কাম অন মাই চাম .... আমি কি একবারও সে কথা বলেছি ? আমি কি জানিনা তুই কি .... কাম অন।’ আর্সিয়ানা সৌমিনির অভিমান ভাঙাতে থাকে।
এইসময়ে দেখা গেল অমিতাংশু তার সান্ধ্যভ্রমণ সেরে গেট খুলে ভেতরে ঢুকছেন। অালো আরো ধূসর হয়ে গেছে এতক্ষণে। নীরব পরিবেশ।
খাবার টেবিলে
আর্সিয়ানাদের সঙ্গে অমিতাংশুবাবুও খেতে বসলেন।বজ্রও একপাশে এসে খেতে বসল। কমলা যথারীতি পরিবেশন করছে। টমি নাছোড়বান্দার মতো কমলার সঙ্গে লেগে আছে। এক মুহুর্ত কমলাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না। আর্সিয়ানা খুব মন দিয়ে ঘরের সবাইকে লক্ষ্য করতে লাগল। মাঝে মাঝে একবার অমিতাংশুর দিকে, একবার বজ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে । চোখে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি। ওদের যেন সামনাসামনি লড়াইয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। কেমন যেন জিঘাংসাভরা চাউনি। আর্সিয়ানার দিকে মেলে ধরা সেই প্রার্থনার দৃষ্টি আদৌ নয়।

    পরিবেশন করা হয়েছে রুটি আর মুরগীর মাংস কষা।
আর্সিয়ানার খাওয়ায় মন নেই। সে একবার বজ্রের দিকে, একবার অমিতাংশুবাবুর দিকে গভীর মনোযোগে দেখতে লাগল। দেখল দুজন দুজনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খাবার পড়ে আছে সামনে। কেউ ছুঁয়েও দেখছে না। দুজনের চোখের তারায় যেন আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি একজন আর একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুজনকেই সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক লাগছে । কমলা এখানে নেই। বোধহয় রান্নাঘরে কিছু করছে । টমি হঠাৎ প্রচন্ড আওয়াজে ডাকতে আরম্ভ করল। তার শান্ত চোখ থেকেও যেন আগুন ছিটকোচ্ছে। সৌমিনি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে আর্সিয়ানার হাতটা জড়িয়ে ধরল। আর্সিয়ানা কোনদিন এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। তার সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে । তবে সে একেবারে ভিন্ন উপাদানে গড়া বলেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারল। টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইলে ঝট করে ও সি-র নম্বরটা ছুঁয়ে দিল। চারপাশে এখন ছেয়ে আছে আমাবস্যার নিকষ কালো আঁধার। মুহুর্তের মধ্যে ছাতিমতলার সব আলো ঝপ করে নিভে গেল। কেন কে জানে !
টমি উন্মত্তের মতো চেঁচাতে লাগল। একটা ছায়া অমিতাংশুর টেবিল থেকে উঠে এসে
আর্সিয়ানাকে জড়িয়ে ধরল। তীব্র আতরের গন্ধে ভরে গেল জায়গাটা । রিভলবারটা আর্সিয়ানার পকেটের মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে ।

দুমিনিটের মধ্যে অন্ধকার ভাঙা হেডলাইটের আলো জ্বলা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল ছাতিমতলার ভাঙাচোরা লোহার গেটের সামনে।

থানার ও সি সুদীপ্ত সেন প্রবাসী বাঙালী। জোরালো টর্চ জ্বেলে পাঁচজন কনস্টেবলসহ ছাতিমতলা বাংলোর রান্নাঘর থেকে অার্সিয়ানা আর সৌমিনির অচেতন দেহ যখন উদ্ধার করলেন ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা বাজে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে দু একটা নিভন্ত অাঁচের আলো জ্বলছে। ছড়ানো খামারে থেকে থেকে দমকা হাওয়া বইছে গাছগুলোর ডালপালার মধ্যে দিয়ে।
********* ******* *********

    
আর্সিয়ানার যখন ঘুম ভাঙল, পুলিশ গেস্টহাউসের দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে আসছে বসন্তের হাওয়া মাখানো রোদ্দুর। এক ডাক্তারবাবু আর্সিয়ানার বিছানার পাশে বসে তার হাতে ব্লাডপ্রেসার মেশিনের প্যাড বাঁধছেন। সৌমিনির এখনও ঘুম ভাঙেনি।
সুদীপ্ত সেনের বছর বত্রিশ বয়েস। সুঠাম দীর্ঘ শরীর। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ হাই, গুড মর্নিং ম্যাডাম।’
আর্সিয়ানা ধড়মড় করে উঠে বসে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টিতে সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকে, যার মানে হল— এটা কি হল !! তারপর রিভলবারের খোঁজে পকেটে হাত দেয় অভ্যাসবশত: । সুদীপ্ত উত্তমকুমারি স্টাইলে হেসে বলে, ‘ ওটা আপাতত: আমার জিম্মায় আছে।একটু পরেই ফেরত পাবেন। আর এই নিন আপনার মোবাইল। আর এটা বোধহয় ওই ম্যাডামের।
সৌমিনির এতক্ষণে ঘোর কেটেছে। পিটপিট করে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে তার পরম ভরসা
আর্সিয়ানার দিকে। ডাক্তারবাবু তার যন্ত্রপাতি গোটাতে গোটাতে বললেন বি পি বিলকুল নর্মাল, একশো চল্লিশ বাই আশি। কোন মেডিসিন প্রেসক্রাইব করলাম না।বলে, তিনি সৌমিনির বিছানার দিকে এগোলেন।
     

    প্রায় ঘন্টা দুই বাদে সুদীপ্ত সেন বলল, ‘ শৌভিক আমার স্কুল লাইফের বন্ধু ছিল। খুব ক্লোজ। ও আমাকে ফোন করে আপনার এখানে আসার কথা বলেছিল।আপনার ফোন নাম্বারও আমাকে দিয়েছিল। কিন্তু আপনি যে ছাতিমতলা বাংলোয় উঠেছেন সেটা আমি একদমই জানতাম না। জানলে , আমি প্রথমেই আপনাকে অ্যালার্ট করতাম।’
— ‘কেন তার কারনটা কি ?’
— ‘ কারণ আপনি দেহধারি মানুষের সঙ্গে হয়ত টক্কর নিতে সক্ষম। অশরীরিদের সঙ্গে তো নয়......’
— ‘ তার মানে ? 
আর্সিয়ানার ভুরু কুঁচকে যায়। তারপর বলে ,’ হ্যাঁ, ওই টমি বলে কুকুরটা.....আই ওয়াজ হ্যাভিং আ স্ট্রঙ্গ হানচ অ্যাবাউট ইট...... বাট....
— ‘ না না বাট টাট কিছু নেই। ওখানে কারোরই শরীর নেই। অর্থাৎ বেশ কিছুকাল আগেই সকলে পরলোকগত।’
শুনে সৌমিনির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।সে একদৃষ্টে কোন কথা না বলে সুদীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর্সিয়ানার ভুরু আবার একবার কুঁচকে ওঠে।
— ‘ আমার কাছে ছাতিমতলার পুরো কেস হিস্ট্রি আছে।এটা আসলে দুই সেক্স ম্যানিয়াকের গল্প। দুজনেরই সেক্সুয়াল টার্গেট ছিল কমলা। অবশ্য কমলাও কিছু কম যায়না। সে দুজনেরই তৃপ্তি মিটিয়ে চলছিল। অমিতাংশুবাবুকে শরীর দিচ্ছিল টাকার ধান্দায় আর বজ্রের কাছে যেত নিজেরও ক্ষুধা মেটানোর জন্য। অমিতাংশুবাবু আর বজ্র। ভূত হয়েও এরা নারী শরীরের নেশা ছাড়তে পারেনি । অদ্ভুত ব্যাপার হল, যৌনতা মেটাবার জন্য এরা কমলার শরীরে ঢোকে।ইরোটিক অ্যাবারেশান যে কত রকমের হয় ! অশরীরিদেরও অতৃপ্ত কামনা বাসনা থাকে। তারই পরিণতি হল পরশু রাত্রে সৌমিনি ম্যাডামের ওপর অ্যাটাক। এই দুই করাতের মাঝে পড়ে বেচারা ঝগরুকে জান দিতে হল। কে বা কারা গলার নলি কেটে মার্ডার করে, তারপর বাগানের আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কে মেরেছিল সেই ইনভেস্টিগেশান এখনও চলছে। আপনার ওই টমি কুকুরটা হল ঝগরু। এখনও কমলাকে আগলে চলেছে দুই কামুকের গ্রাস থেকে। বেচারা কমলাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভাল বাসত। একফুল দো মালির গল্পে প্রায়ই এক মালিকে প্রাণ দিতে হয়। কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা ছোট্ট ডোবা মত আছে, তার জলে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল বজ্র । অমিতাংশুবাবু স্লিপিং পিল খেয়ে আর কমলা অমিতাংশুর ঘরেই সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পৃথিবী থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। কারণ, আমি যা বুঝেছি দুজনেই প্রচন্ড মেন্টাল স্ট্রেস অ্যান্ড গিল্ট কনসেন্সের শিকার হয়ে পড়েছিল।ওই যে কথায় বলে না পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অবশ্য মৃত্যুর কারণগুলো আমার ব্যক্তিগত ধারণা এবং অনুমান। জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশান ইজ স্টীল অন। ব্যাস ম্যাডাম, আমার কথাটি ফুরলো......এবার একটু ফ্রেশ হয়ে নিন।তারপর ব্রেকফাস্ট করবেন। এ দুদিন তো ভূতের হাতে দিব্যি খাওয়াদাওয়া করে এলেন।’
—-‘ আরে ... দাঁড়ান দাঁড়ান, কি সব বলছেন..... এই তো কাল দুপুরে দুজন মহিলা মাদুর বিক্রি করতে এসেছিল......’
— ‘ ইয়েস ইয়েস... বুঝতে পেরেছি.... ‘
আর্সিয়ানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে সুদীপ্ত , ‘ ওরা যে রক্তমাংসের মানুষ সে কথা কে বলল আপনাকে ?’
— ‘ তার মানে ! ! ‘
— ‘ মানেটা নিজেই বুঝে নিন ....’
অার্সিয়ানার ভুরু আবার কুঁচকে উঠল। সৌমিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। দুজনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে কোন হিমশীতল সরীসৃপ সিরসির করে নামতে লাগল পরশু রাতের কথা মনে করে। কপালে ঘাম দেখা দিল দুজনেরই।
সুদীপ্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ না:, আপনারা রেস্ট করুন। আধঘন্টা পরে ব্রেকফাস্ট লাগাচ্ছি। আর হ্যাঁ , আপনাদের ট্রেন পাঁচটা তেত্রিশে।আমি গিয়ে আপনাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব।ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যান বাবা । আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আর হ্যাঁ, আপনারা নিশ্চই ভাবছেন, আমি ছাতিমতলার এত কিস্যা জানলাম কি করে । এসব কথা তো পুলিশ ফাইলের কেস হিস্ট্রিতে থাকার কথা নয়।’
আর্সিয়ানার কানে কিছুই ঢুকছিল না। মাথায় নানা চিন্তা ভোঁ ভোঁ করছে। সৌমিনি পাশ বালিশ আঁকড়ে আবার শরীর ফেলে দিয়েছে বিছানায়। আর্সিয়ানা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুদীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুদীপ্ত উত্তমকুমারি হাসি হেসে আবার বলে, ‘ সেকথা এখন থাক ম্যাডাম। ক্রমশ: প্রকাশ্য ... ‘

পরদিন ভোরে বাড়ি পৌঁছল অার্সিয়ানারা। সকাল এগারোটা নাগাদ শৌভিক চ্যাটার্জীকে একটা কল দিল। শৌভিককে একবার ডায়ালেই পাওয়া গেল। হাই হ্যালোর পর শিমূলতলা বৃত্তান্ত আগাগোড়া বর্ণনা করে। অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা পুরোটা রুদ্ধশ্বাসে শোনার পর বলে ওঠে, ‘ দাঁড়াও দাঁড়াও ....কি বললে ? অামার বন্ধু পুলিশ অফিসার সুদীপ্ত সেন ! ‘
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সুদীপ্ত সেন... রিয়েলি এ গ্রেট গায় । হি ওয়াজ, ইন ফ্যাক্ট, আওয়ার সেভিয়ার দেয়ার । ও না থাকলে উই উড হ্যাভ বিন...... ‘ অার্সিয়ানা মুখর হয়।
— ‘ আরে দু..ৎ , কি সব গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছ ! সুদীপ্ত তো এক্সপায়ার করে গেছে মাস ছয়েক আগে কোন এক টেররিস্ট এনকাউন্টারে ওখানে কাছাকাছি কোন এলাকায় ..... ‘
— ‘ সেকি ! ....’ অার্সিয়ানা আকাশ থেকে পড়ে । ‘ ও তো বলল, তুমি ওকে কল করে আমাদের টেক কেয়ার করার কথা বলেছিলে..... আর ওর মোবাইল নাম্বারটা তো তুমিই আমাকে পাঠিয়েছিলে ......’
— ‘তাই নাকি ?’ শৌভিক সরস হয়। ‘ অার্সিয়ানা, এর থেকে প্রমাণ হল ভূতেরাও শিভালরাস হয় .... হা: হা: হা: .... আমি সুদীপ্তর মোবাইল নাম্বার কোথায় পাব ! পাগল নাকি ! আর অমিতাংশুবাবুই তো আমাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর অ্যারেঞ্জ করার জন্য। ওহ্ মাই গুডনেস.....কিছু ভূতের , তার মানে , স্বভাব যায় না ম’লেও.....’

ফোন নামিয়ে রেখে
আর্সিয়ানা সিদ্ধান্ত নিল ছাতিমতলায় তাকে আর একবার যেতেই হবে । টমি কাম ঝগরুর প্রতি নিশ্চিতভাবেই তার একটা কর্ত্তব্য রয়ে গেছে।

( সমাপ্ত )

 Anjan Banerjee
 

 


 

 

খেজুরতলার ইতিকথা -অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


খেজুরতলার ইতিকথা

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


        তেমন গরম পড়েনি এখনও। সন্ধের ঝটকা হাওয়ায় ধুলো উড়ছে এলোমেলো। পার্বতী মেঠো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে সনিষ্ঠ যত্নে।বসে থাকলে চলে না। সে বসে গেলে পরিবারও বসে যাবে।আরো তিনটে ছেলেমেয়ে আছে। কাঁচা বয়েস, কাঁচা মন। তবে পেকে যাচ্ছে অকালের বাতাসে।ঘরের পুরুষটার তেমন নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। পুরুষটা তার শ্বশুরমশাই। প্রায় সর্বক্ষণ শুয়ে থাকে। কি হয়েছে কে জানে। ডাক্তার বদ্যি করার পয়সা কোথায়। দু মাইল দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গুলি এনে খাওয়ায় মাঝেমধ্যে। কাজের কাজ কিছুই হয় না তেমন। হাত পা ফুলে উঠছে কেমন। অসাড়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে যখন তখন। কে সামলাবে এত ঝক্কি। মাটির মেঝেয় খড় পেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে লোকটাকে। বুদ্ধিসুদ্ধিও লোপ পেয়েছে মনে হয়। প্রায় সারাক্ষণই নিজের মনে বিড় বিড় করে কি সব বকে নিজের মনে। মাঝে মাঝে নিকুঞ্জ... নিকুঞ্জ করে ডাকে । নিকুঞ্জের কোন সাড়া পায় না। তবু অবুঝের মতো ডাকে। নিকুঞ্জ হল বুড়োর ছেলে । আজ বারো বছর ধরে সদরের জেলখানায় জীবন কাটাচ্ছে। কি অপরাধ পরিষ্কার কেউ জানে না। রেল কোয়ার্টারের পেছনে নাকি ফেলে দেওয়া কয়লা কুড়োচ্ছিল। ফেলে দেওয়া কয়লা— জোড়া তাপ্পি দেওয়া সংসারে যদি এট্টু কাজে আসে। পুলিশে ধরেছিল। তারপর থেকে সদরের জেলখানায়। বারো বছর কেটে গেল এইভাবে। জোয়ান নিকুঞ্জ বুড়িয়ে যেতে চলল। তার অপরাধটা কি আজও তার হদিশ পায়নি সে। উকিল লাগাবার পয়সা কোথায়। সরকার উকিল দিয়েছিল একটা। কিন্তু তাকে ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। বছরের পর বছর কেস ওঠে না কোর্টে। নিকুঞ্জ অনেক ভেবে ভেবে এখন ভাবনার ঘরে তালা চাবি মেরে দিয়েছে। তিনটে বাচ্চার কথা ভেবে খুব কান্না পেত প্রথম প্রথম। এখন মরে গেছে সে জলের সোঁতা। এখন শুধু অ্যাঁকাব্যাঁকা হিসেব করে দিনভর, আর কতদিন সে বাঁচবে। তার বুড়ো বাপটা কি বেঁচে আছে এখনও ? পার্বতী কিভাবে ঘর ছেলেপুলে সামলাচ্ছে , কে জানে । মদন এলে এবার জিজ্ঞেস করতে হবে সবকিছু। মদন বড় ভাল ছেলে। আর ক’বছরই বা সে বাঁচবে। মরার আগে তার দোষটা জানতে পারলে বড় ভাল হত।

  

   তিনটে বৌ কোমরে ঘড়া ভরা ।জল নিয়ে মন্ডলপাড়ার দিকে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে।

 বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধে ঝুঁকে আসছে। ঝাঁট দেওয়া শেষ করে ঝাঁটাটা দাওয়ার একধারে রেখে মুখ তুলতেই দেখতে পেল মাথা নীচু করে আনমনে কি ভাবতে ভাবতে মদন আসছে।মদন দাস। পার্বতীর বোনপো। দিদির ছেলে।বড় উপকারি ছেলে।প্রায় পাঁচবছর ধরে আগাগোড়া পাশে আছে জানমান দিয়ে। তার আগে ও বড্ড ছোট ছিল।

 মদন কাছে এসে দাঁড়াতে পার্বতী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।মদন কিন্তু চোখ তুলল না। মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইল।

— ‘ কিছু হল না, না ? ‘ পার্বতী উদাস এবং প্রত্যাশাহীন স্বরে প্রশ্ন করে, যে প্রশ্ন সে বারো বছর ধরে করে আসছে।

— ‘ না, মানে .... আজ কোর্টে খুব গন্ডগোল । জজ আসেনি... ‘ মদন অপরাধী গলায় জবাব দেয়।

 নতুন কোন কথোপকথন নয়।বছরের পর বছর চলছে একই ধারায়। দিন চলে যায়, শরীর বদলে যায়, পৃথিবী আরও বুড়ো হয়। কিন্তু এ দুনিয়ার বহু মানুষের জীবনের রঙ কখনও বদলায় না।হেমন্তের ধূসর মাঠ পড়ে থাকে অগোচরে, অনাদরে ।

       মদন কাটোয়ার একটা হোটেলে কাজ করে। ভাতের হোটেল। এবেলা ওবেলা মিলে প্রায় তিনশো লোক খায় । মালিক সনৎ বরাট খুব ভাল লোক। অনেক চেষ্টা করেছে নিকুঞ্জর জন্য একটা ভাল উকিল যোগাড় করে দেবার । কিন্তু এত বছরেও সেটা হয়ে উঠল না। এটা হয় তো, ওটা হয় না। ওটা হয় তো এটা হয় না। ‘অন্তত জামিনের ব্যবস্থাটা যদি হয়ে যেত.... তারপর মামলা গড়ায় গড়াক। আমি শীল বাবুকে বলে রেখেছি। মদন দেখিস তুই এবার মামলা উঠবেই।’ এই করে করে বারো বছর গেল। মদন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।তার আর কোন তাপ উত্তাপ হয় না এসব শুনে। এত বছর ধরে এত শুনেছে এসব কথা। সনৎ বরাটের মন খারাপ হয়ে যায় মদনের নির্বাক হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে। বলে, ‘ আমার কি আর খারাপ লাগে না ! খুব খারাপ লাগে, বুঝলি মদন, খুব খারাপ লাগে । এতগুলো বছর গেল কিছুই করতে পারলাম না নিকুঞ্জর জন্য .... তবু হাল ছাড়িস না, বুঝলি মদন, হাল কখনও ছাড়তে নেই। ব্যবস্থা একটা হবেই।’

       সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মদন দেখল স্টেশনের বাইরের দোকানে গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে। যেমন মুচমুচে লালচে বরণ তেমনি রসে চুপচুপে।মদনের জিভে জল এসে গেল। পকেটে মোট পঁয়ত্রিশ টাকা আছে। তাছাড়া কিছু খুচরো পয়সা আছে। তিনটে জিলিপি কিনল।পনের টাকা লাগল। মদন দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসল শালপাতার ওপর রস গড়িয়ে পড়া তিনটে গরম জিলিপি নিয়ে।গরম জিলিপি একটা ছোট কামড়ে মুখের ভেতরে নিল সে। পরম আবেশে মদনের চোখ বুজে এল। সংসারের সব যন্ত্রনা যেন কর্পূরের মতো উবে গেল । আ: কি সুখ !


       মদনের বাবা তারকনাথ মারা গেছে বারো বছর আগে, সাপের কামড়ে। চক্রবর্তীদের জমিতে কাজ করে মাঠের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করছিল বাড়ির দিকে। ভর সন্ধেবেলা। সূয্যি পাটে গেছে। ভাল করে দেখা যায় না কিছু । অসাবধানে গায়ে পা পড়ে গিয়েছিল । জাত কালসাপ। নিমেষে ছোবল মারল। চিৎকার শুনে বিধু মন্ডল ছুটে এল কাছের কুঁড়ে থেকে।দুচারটে লোকজনও জড়ো করল। কিন্তু বিশেষ কিছু করা গেল না। কর্ত্তব্য ঠি ক করতে করতেই সরসর করে বিষ উঠে গেল মাথায়। সদরের হাসপাতাল ওখান থেকে দশ মাইল দূরে। ওরা তৈরি হয়েছিল যাবার জন্য। কিন্তু তারকনাথের ভবিতব্য তাদের সে সময় দিল না। চলে গেল অকালে।মদনের বয়েস তখন মোটে তেরো।


       মদনের মা শেফালি গরু চরানোর কাজ করে চার বাড়ি। ঢেঁকিতে পাড়ও দেয় ঘোষাল বাড়ি। মদন ক্লাস এইট অব্দি পড়েছিল অচিন্ত্যমোহন  বিদ্যাভবনে। তার পর আর সম্ভব হল না। কাটোয়া স্টেশনের ধারে সনৎ বরাটের ভাতের হোটেলে কাজে লেগে গেল। এখন তার চব্বিশ/ পঁচিশ বছর বয়েস। তার খুব ইচ্ছে সেও একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিক হবে। সনৎ বরাটও তাকে খুব উৎসাহ দেয়। বলে, ‘ লেগে থাক মদন, তোরও একদিন হবে , ঠি ক হবে। এখন এই নিকুঞ্জটার জন্যই বড় চিন্তা।যদি একটা জুতসই উকিল পাওয়া যেত ..... ।’ সনতের মতো লোক হয় না। বারো বছর ধরে নিকুঞ্জর দু:খ বহন করে চলেছে। এর মধ্যে দুনিয়ার কত কিছু বদলে গেল। কত লোক এল, কত লোক গেল। নিকুঞ্জটা জেলে পচে মরছে বিনা দোষে। কবে যে কি হবে.... । বড় নরম সরম মানুষ সনৎ বরাট। কি করে যে কারবার চালায় কে জানে। ধড়িবাজ লোকের তো অভাব নেই। ওপরওয়ালা বোধহয় নরম মানুষের মাথায় খানিক স্নেহের হাত রাখেন কখনও সখনও।

 

      তার মা আর তার মাসী পার্বতীর খুব মিলমিশ। জেলখানায় তার মা আর মাসী অনেকবার গেছে মেশোমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে।মদনও গেছে বেশ কয়েকবার। দেখা করা সহজে হয় না। তার জন্যও জেলের গেটে গিয়ে ধরা করা করতে হয়। ঘুষ দিতে হয়। অন্তত বিড়ি সিগারেট। তাদের মতো গরীব মানুষ এর বেশি আর কিই বা দেবে। তারা আশাও করে না এর বেশি । এখন আর জেলখানায় যায় না অনেকদিন হল। মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। মেশোর খুব কষ্ট। প্রথমদিকে কান্নাকাটি করত। এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে।মদন ভাবে এ বছর পুজোর মধ্যে যে করে হোক উকিলের ব্যবস্থা করবেই। জামিনটা একবার হলে হয়। তারপর নয় লড়াই করা যাবে। সনৎ বরাটও চেষ্টায় আছে । দেখা যাক কি হয়। মাসী খুব যুদ্ধ করছে। কত ঝড় জল সয়ে তিনটে বাচ্চাকে বড় করে তুলছে। গ্রামের ইস্কুলেও ভর্তি করেছে। পড়াশোনায় অবশ্য মন নেই কোনটার। শুধু মিড ডে মিল খাওয়ার জন্য ইস্কুলে যায়।

 

   বর্ষাকাল এসে গেল ।ঘরের চালে খড় দেওয়ার দরকার। জীবন জীবনের মতো চলে।পেছনে তাকায় না। পুজোর আর মাস তিনেক বাকি। তার আগে কি উকিল যোগাড় হবে ? তাদের তো টাকা পয়সা নেই। উকিলবাবুরা বিনি পয়সায় খাটবেই বা কেন। তাদের কত কাজ। নিশ্বেস ফেলার ফুরসত নেই। সনৎ বরাট একবার একজনের সঙ্গে কথা বলেছিল। সে কোর্টে উকিলদের বসার জায়গায় তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। কিন্তু পরপর পাঁচদিন বিভিন্ন সময়ে গিয়েও তার দেখা পায়নি মদন। তারপর হাল ছেড়ে দেয়। অবশ্য হাল ঠি ক ছাড়েনি।বলা যায়, দাঁত কামড়ে পড়ে আছে লড়াইয়ের মাঠে আরও কড়া লড়াই দেবার জন্য।

 

       শিবব্রত সান্যালের তিন পুরুষের পেষা ওকালতি। ভবানীপুরে পেল্লায় বাড়ি। রাজপ্রাসাদ বলা যায়। তিনি নিজেও বাগুইহাটিতে আড়াই  হাজার স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বছরখানেক আগে। এখন সেখানেই থাকেন। বাড়ির কাজের লোকের উপস্থিতি বাদ দিলে বাড়ির সদস্য সংখ্যা চার। স্বামী স্ত্রী এবং দুটি সন্তান। দুটিই ছেলে। বড়টির বয়স বারো। ছোট ছেলের বয়স দশ। সমস্যা বড় সন্তানটিকে নিয়ে। এ এস ডি অর্থাৎ অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার  আক্রান্ত। প্রকৃতি বা নিয়তি জীবন ঢাকবার জন্য গোটা চাদর কাউকে দেয় না। একটা দিক ঢাকতে গেলে আর একটা দিক উদোম হয়ে যায়। জীবনের একদিকে সতেজ সজীব বৃষ্টি অরণ্য থাকলেও আর একদিকে ধু ধু মরুভূমি জেগে থাকে, ঠি ক পৃথিবীপৃষ্ঠের মতো।সব মিলিয়েই প্রকৃতি এবং পৃথিবী।মরু এবং অরণ্য একে অপরের পরিপূরক। মানুষের জীবনও ঠি ক তাই।একদিক ভরা, একদিক খালি। না হলে বহমানতা বজায় থাকে না। পূর্ণ এবং শূন্য , এই দুই প্রান্তের প্রবহমান চলাচলে গতিষ্মান থাকে জীবন। সেই কারণেই হয়ত শিবব্রত সান্যালের এক দিক ধূসর যন্ত্রণাময়। সেই যন্ত্রনার রূপ হল তার বড় ছেলে শুদ্ধসত্ত্ব বা বাবিন।কোটি কোটি টাকার সুখময়তায় চাপা দেওয়া যায় না কোন কোন ব্যথার কাঁটা। থেকে থেকে ছোবল মারে কষ্টের কালসাপ।

      ছোট ছেলে অতলান্ত একবারেই স্বাভাবিক। চনমনে এবং বুদ্ধিদীপ্ত। দশ বছর বয়েস। আপনমনে খেলে বেড়ায়। আপনমনে হোমওয়ার্ক করে, নিজে নিজেই তৈরি হয়ে স্কুলে যায়, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসে। তার মা বাবার সময় নেই তার দিকে নজর দেবার। তা নিয়ে তার কোন অনুযোগ নেই। বাবা তার পেশাগত কাজে চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত। তার ছেলেরা কোন ক্লাসে পড়ে সে খবরই তিনি রাখেন কিনা সন্দেহ।বাবিন এখন আর স্কুলে যেতে পারে না। তার মা সবসময়েই তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজে মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বাবিনের দেখভাল করার জন্য। সন্তান বড় মায়ার জিনিস। গর্ভের নাড়ি ছেঁড়া ধন। শিবব্রতবাবুরও বুকে হাহাকার আছে। তিনি হাহাকারের শূন্য গহ্বর চাপা দিয়ে রাখেন ভারি ভারি কাজের পাথর দিয়ে।

    শিবব্রতবাবু ভাবলেন, কাজের থেকে ছুটি চাই একটু। পরিবারের সকলেরই ছুটি চাই, ভরাট প্রবল কর্মের ফাঁস আলগা হওয়ার দরকার। স্ত্রী স্বাতীলেখারও দরকার, দুই ছেলেরও দরকার।স্বাতীলেখার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন উত্তরাখন্ডের দিকে যাবেন। প্রথমে যাবেন হরিদ্বার আর মুসৌরি তারপর রানীক্ষেত, আলামোড়া, কৌসানি।

 

       সনৎ বরাট বলল, ‘ কাল সকালে তোকে নিয়ে একবার কলকাতায় যাব শিবব্রত উকিলের বাড়ি , বুঝলি মদন। মস্ত উকিল। আমার ভায়রা ভায়ের খুব চেনা।ওকে দিয়েই যোগাযোগ করিয়েছি, অনেক বলে কয়ে। তা, উকিলবাবু কাল সকাল এগারোটায় টাইম দিয়েছে। কলকাতায় ভবানীপুরে বাড়ি, বুঝলি মদন। কাল সকালে ছটা বত্রিশের ট্রেন ধরব। কাগজপত্র যা আছে সঙ্গে নিয়ে আসিস।’

  মদন কৃতজ্ঞতা মাখা চোখে সনতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

মদন ভাবল মাসীর বাড়ি একবার যেতে হবে ।কাগজ বলতে থানা থেকে দেওয়া বর্ধমান কোর্টের স্ট্যাম্প মারা কি একটা পড়চা আছে। আর জেল থেকে দেওয়া কোর্ট অর্ডারের একটা কপি আছে।ওইটা খুঁজে বার করতে হবে।

  

   বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ ভবানীপুরে শিবব্রত সান্যালের প্রায় একশো বছরের পুরনো বাড়ির বিশাল দরজার পাশে  কলিং বেলে দুরুদুরু বুকে চাপ দিল সনৎ বরাট। পাশে দাঁড়িয়ে মদন। একজন টাকমাথা রোগামতো লোক দরজা খুলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

 — ‘ আজ্ঞে আমাদের আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল স্যারের সঙ্গে। ওই মহেন্দ্র .... মানে, মহেন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়েছিল ....’

   টাকমাথা লোকটি একেবারেই কথা বাড়াল না। বলল, ‘ আসুন, ওপরে আসুন । স্যার আসছেন এক্ষুণি ।’ লোকটি তাদের দোতলায় নিয়ে গেল। সনৎ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবল, যাক এক গাঁট পেরনো গেল।

  লোকটি আবার বলল, ‘ এই যে, এইদিকে আসুন।এই বারান্দা দিয়ে সোজা গিয়ে ওই ডানপাশের ঘরটায় বসুন।স্যার আসছেন।’

   সনৎ আর মদন ওই ঘরে গিয়ে ঢুকল।ঘরে বনবন করে পাখা ঘুরছে। মাঝারি সাইজের ঘর। উকিল বাবুর বসার চেয়ার টেবিল রয়েছে। টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার এবং তার পেছন দিকে জনা চারেক লোক বসার মতো একটা সোফা রয়েছে। দরজার পাশেও দুটো ফাইবারের চেয়ার রয়েছে। বিরাট উঁচু সিলিং। দেয়ালে কোন ক্যালেন্ডার নেই। উকিলবাবুর চেয়ারের পেছনে শুধু  বিবেকানন্দের একটা বাঁধানো ছবি টানানো আছে।

   ফুল স্পীডে ঘোরা পাখার হাওয়ায় টেবিলের কাগজপত্র ফরফর করে কাঁপছে। টেবিলের একপাশে ডাঁই করে রাখা প্রচুর ফিতে বাঁধা ফাইল। সনৎ আর মদন পেছনের সোফায় গিয়ে বসল। নীচে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড থেকে অবিশ্রান্ত গাড়ি চলাচলের আওয়াজ আসছে।

  

    তারা দুজন চুপচাপ বসে শিবব্রত সান্যালের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। সনৎ একবার বলল, ‘ আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে।কেমন গুমোট পড়েছে।’ মদন বলল, ‘ হ্যাঁ তা হতে পারে।’ সনৎ আবার বলে, ‘ দুটো তেইশে কাটোয়া লোক্যাল আছে.... যদি কাজ হয়ে যায়.... কোথাও চাট্টি খেয়ে নিয়ে ... ওই গাড়িটা....’

এইসময়ে কে একটা ঘরে এসে ঢুকল।সনৎরা শিবব্রতবাবু এলেন ভেবে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। ও হরি ! এ যে একটা বাচ্চা ছেলে।

   ছেলেটা একটা ফুলপ্যান্ট আর ফুলশার্ট পরা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাদের দেখতে লাগল।এগারো বারো বছর বয়স হবে ছেলেটার। রঙ খুব ফর্সা। সনৎ একটু হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ছেলেটার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ওইভাবে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।ভাবলেশহীন দৃষ্টি। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মদন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।কে জানে কি কারণে ছেলেটার মুখে হাল্কা হাসি ফুটে উঠল। একটা চার বছরের ছেলের মতো হঠাৎ হুড়মুড় করে মদনের দিকে ছুটে এল। যেন অনেক দিনের চেনা লোক। ছুটে এসে মদনের পাশে বসল। বসে বুকের কাছে হাত দিল।বুকে নাক লাগিয়ে কিসের যেন গন্ধ শুঁকল।তারপর মদনের পাশে সোফায় হেলান দিয়ে বসল।

   এইসময়ে শিবব্রত সান্যাল ঘরে ঢুকলেন। ক্লায়েন্টের পাশে বাবিনকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তার চেম্বারে এত ক্লায়েন্টের আনাগোনা। কিন্তু এহেন দৃশ্য তিনি কখনও দেখেননি। যাই হোক, পরম স্নেহভরে তিনি বাবিনকে বললেন, ‘ তুমি ভেতরে যাও বাবা.... এখানে থাকে না... ‘

বাবিনের কিন্তু বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না বাবার কথায়।সে হেলান দিয়ে বসেই রইল মদনের বাহুতে হাত দিয়ে।ডাকসাইটে আইনজীবী শিবব্রতবাবু তার চেয়ারে এসে বসলেন এবং তার হৃদয়ের অতি কোমল জায়গা শুদ্ধসত্ত্ব বা বাবিনের দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

 — ‘ আসুন ...’  শিবব্রতবাবু মদনদের দিকে নজর ঘোরান। সনৎ আর মদন উঠে গিয়ে উকিলবাবুর উল্টোদিকের চেয়ার দুটোয় বসল। বাবিনও উঠে গিয়ে মদনের পাশে দাঁড়াল। শিবব্রতবাবুর বেশ অবাক লাগছে। নিজের মা বাবা ছাড়া আর কারো সঙ্গে বাবিনের এমন প্রতিক্রিয়া কখনও দেখেননি। তিনি মামলাটার কথা ভুলে গিয়ে বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

   ‘ আজ্ঞে , মহেন্দ্র বিশ্বাস আমার ভায়রা হয়।আপনার ভরসাতেই আমরা..... ‘ সনৎ সময় নষ্ট না করে আসল কথাটা পাড়ে ।

— ‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ ... বলুন, বলুন ...’ শিবব্রত সান্যালের সম্বিৎ ফেরে। তিনি নিজের জগতে ফিরে আসেন।

       তিনি সনৎ বরাটের কাছ থেকে নিকুঞ্জর ব্যাপারে খুব মন দিয়ে সব কিছু শুনলেন। মামলার ধরণ অবশ্য তার কাছে খুবই পরিচিত।এরকম পেটি কেসে মুরুব্বির জোর নেই বলে কোর্টে কেস উঠছে না বছরের পর বছর এবং জেলে অকারণে পচে মরছে, এ সব ব্যাপার তার মতো আইন কানুনের মাঠে পোড় খাওয়া খেলোয়াড়ের অজানা থাকার কথা নয়। কাজেই মামলার সারাৎসার তিনি সহজেই বুঝে নিলেন। এই সময়ে তার আবার চোখ গেল বাবিনের দিকে। বাবিন মদনের চেয়ারে একটু জায়গা করে নিয়ে একেবারে তার কাছ ঘেঁসে বসে আছে।যারা ওকে চেনে সবাই বুঝবে যে, বাবিনের বিহেভিয়ারাল প্যাটার্নে এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।মদন স্বাভাবিক বাৎসল্যস্নেহবশত: তার একহাত বাবিনের কাঁধে রাখল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। বাবিনও একগাল হেসে মদনকে ডানহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং সবাইকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার উচ্চারনে ( যা এখন পর্যন্ত বাবিনের মুখে কেউ শোনেনি )বলল, ‘ মদন... বাবা....’। মদন অবাক হয়ে বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবিনের বিচক্ষণ এবং বিদগ্ধ আইনজীবী পিতা প্রবল বিস্ময়ে প্রস্তরীভূত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন।

   এইসময়ে সেই রোগামতো টাকমাথা লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকল। ‘ এ: হে ... এই যে বাবুসোনা ..... তুমি এখানে! আমি এদিকে সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।কিছু হয়ে গেলে বৌদিদিমনি কি ভাববে ! ইশশ্ ....‘  মদনের চেয়ার থেকে  বাবিনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করতে লাগল। বাবিন এদিকে মদনের সঙ্গে এঁটে বসে আছে। টানাটানিতে বিশেষ ফল হল না। লোকটা আবার বলতে লাগল, ‘ ... এ: হে এমন করে না বাবুসোনা ... মা ডাকছেন.... চল ...চল ... বাপিকে কাজ করতে দাও ‘। কে জানে কোন অজ্ঞাত কারণে বাবিনকে একচুলও টলানো গেল না। শিবব্রতবাবুর বিস্ময়ের মাত্রা এতক্ষণে আকাশ ছুঁয়েছে। বাবিনের মধ্যে যে এমন নিজস্ব ইচ্ছা প্রকাশ করার জেদের অস্তিত্ব আছে তা বারো বছরের মধ্যে তিনি এই প্রথম জানলেন।তিনি ধীর স্বরে লোকটিকে বললেন, ‘ ওকে ছেড়ে দাও ভবানী.... তুমি যাও... ‘। টাকমাথা লোকটির নাম বোধহয় ভবানী।

 

   শিবব্রত কাজে ফিরে এলেন।বললেন, ‘ দিন , কাগজগুলো দিন। ‘

 বহু বছর ধরে সযত্নে গুছিয়ে রাখা দুটো কাগজ বার করে শিবব্রত সান্যালের দিকে বাড়িয়ে ধরে সনৎ বলল, ‘ এই দুখানাই আছে। একটা থানার কাগজ, আর একটা কোর্টের.......’

— ‘ ঠিক আছে , যা আছে তাই দিন।অরিজিনালগুলো দেবেন।চিন্তা নেই আমি জেরক্স করিয়ে নিয়ে এগুলো পরে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব ’ , শিবব্রতবাবু বললেন। তিনি আরও বললেন—‘প্রথম কাজ হল কেসটা কলকাতার কোন কোর্টে ট্রান্সফার করা, নাহলে আমি পার্সোনালি অ্যাপিয়ার হতে পারব না।তারপর হিয়ারিং-এর ডেটের জন্য একটা পিটিশান ইনভোক করতে হবে।হিয়ারিং-এর ডেটটা পেয়ে গেলে কেসটা আমার আওতায় আসবে। সেটা করে ফেলতে পারব আশা করি।এখন দেখতে হবে আই পি সি কত নম্বরে ফেলেছে কেসটা।এসব কেস সাধারণত: দুশো পাঁচ বা দুশো ছয়ে ফেলে।ঠিক আছে কোন চিন্তা করবেন না।এটা কোন কগনিজেবল অফেন্স নয়। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। আমি কাজ শুরু করছি । সামনের মঙ্গলবার আমাকে একটা কল দেবেন দুপুর একটা নাগাদ।’

   শিবব্রতবাবু একটানা বলে থেমে গেলেন এবং সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলেন, বাবিন মদনের কাঁধের কাছে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে নীচের দিকে তাকিয়ে।

      সনৎ বলল, ‘ আজ আমরা তালে উঠি স্যার....’ , তারপর মদনের সঙ্গে চোখ চাওয়া চাউয়ি করে বলল, ‘ ..... স্যার আজ আপনাকে .....মানে...কত....’

       শিবব্রত সান্যাল সনতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যে কথাটা আগে কখনও বলেননি,সেই কথাটা বললেন, ‘ কিছু দিতে হবে না। আগে কাজটা করি তারপর ওসব ভাবা যাবে । আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। চিন্তাটা আমাকে ট্রান্সফার করে দিন। মহেন্দ্র আমার অনেকদিনের পরিচিত ....। ‘

     যখন তিনজনেই ভাবছে কি করে মদনকে আঁকড়ে থাকা বাবিনকে আলাদা করা যায় ঠিক সেই সময়ে বাবিন কি জানি কি কারণে মদনের কাঁধের ওপর ঘুমে ঢলে পড়ল।শিবব্রতবাবু দাঁড়িয়ে উঠে উৎকন্ঠা ভরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন— ‘ ভবানী...... ভবানী..... ।’ ছুটে এল রোগাসোগা টাকমাথা ভবানীচরণ।

 

  নীচে নেমে মদন আর সনৎ পেট ভরে ভাত খেল একটা পাইস  হোটেলে।’কাটোয়ায় আমরা এর চেয়ে অনেক ভাল চালের ভাত খাওয়াই খদ্দেরকে।’ সনৎ বলে।

‘ কিন্তু ছেলেটার ব্যাপার কিছু বুঝতে পারলি ? হঠাৎ তোকে কেন....’  মদন বলে , ‘ কি জানি, বুদ্ধিতে কিছু আসছে না...’

 

      মদন পরের দিন পার্বতী মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছল প্রায় সন্ধেবেলা। পার্বতী বাড়ির পেছনের মাঠ থেকে একটা গরুর দড়ি ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে।গরুটা দুধ টুধ কিছু দেয় না। শখে পোষা, স্নেহবশত:। কলকাতার উকিলের বৃত্তান্ত শুনে পার্বতীর  বিশেষ ভাবান্তর হল না। বারো বচ্ছর ধরে এমন অনেক কিস্যা সে শুনে আসছে।কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কুঁড়ের বাঁ পাশে আমগাছগুলোর ওপরে সাঁঝের আঁধার ঘন হয়ে নেমে আসছে। মদনের মুখে সব শুনে টুনে ‘ অ , তা ভাল....’ বলে গোয়ালে গরুটা বেঁধে রেখে ঘরের ভেতরে গেল। ঘরে শুয়ে থাকা লোকটা দুপুরে আবার বিছানা ভিজিয়েছে। দুর্গন্ধে টেক্কা যায় না।সারাদিনে নিশ্বাস ফেলার ফুরসৎ নেই। এখন পোস্কের টোস্কের করতে হবে যেভাবে হোক।নাজেহাল অবস্থা একেবারে।ছেলেমেয়েগুলো দাওয়ায় পড়তে বসবে একটু পরে।

 

      পরের মঙ্গলবার দুপুর ঠিক একটার সময়ে সনৎ শিবব্রত সান্যালের মোবাইলে কল দিল তার হোটেলে বসে। সনতের মনে হল শিবব্রতবাবু যেন তার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ওদিক আওয়াজ এল, ‘ হ্যাঁ, হ্যালো .... কাজ এগিয়েছে .... হিয়ারিং-এর ডেট বার করেছি... অনেক কষ্টে কেসটা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ট্র্যানজিটও করা গেছে।’ উকিলবাবুর গলায় প্রবল উচ্ছ্বাস, যা শুনে , যারা তাকে চেনে তারা বেশ অবাক হবে। এমন দ্রুতগতির প্রচেষ্টা তার পেশাগত জীবনে বিরল বলা যায়।

     সে যাই হোক, সনৎ আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘ ধন্যবাদ স্যার, অনেক ধন্যবাদ.... মানে কি বলব স্যার....আপনি যা করলেন আমাদের জন্য.... কি বলব .... ‘

    ওদিক থেকে শিবব্রতবাবু আবার বললেন, ‘ ..... হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ..... ওসব পরে হবে’খন ....আপনারা কুড়ি তারিখ, মানে এই সোমবারের পরের সোমবার সকাল দশটা নাগাদ ডালহৌসির ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পৌঁছে যাবেন।আমি ওখানে থাকব। চেষ্টা করব যাতে সিঙ্গল হিয়ারিং-এ ভারডিক্ট হয়ে যায়।আর হ্যাঁ, মদনবাবু যেন অবশ্যই থাকে। ওর সঙ্গে অনেক দরকার আছে।’

 

   ধুরন্ধর আইনজীবী শিবব্রত সান্যালের কেরামতিতে সত্যিই  বারো বছর ধরে আটকে থাকা  নিকুঞ্জ দাসের জামিনের রায় মাত্র দু ঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে গেল। এখন কোর্টের বর্ধমান সংশোধনাগারে পৌঁছন পর্যন্ত অপেক্ষা । তারপর নিকুঞ্জ তার গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। শিবব্রতবাবু বললেন, এর পরের কাজ হল কেসটা ডিসমিস করানো। সেটাও নাকি খুব শীঘ্র হবে।

  কোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির পার্কিং স্লটের দিকে হাত দেখিয়ে শিবব্রতবাবু বললেন, ‘ আসুন...’

— ‘ আজ্ঞে কোথায় ? ‘ সনৎ বলে।

—- ‘ এ..ই আমার বাড়িতে একটু যেতে হবে। একটু দরকার ছিল...আমার ড্রাইভার আপনাদের ঠিক সময়ে হাওড়া স্টেশনে ফেরবার গাড়ি ধরিয়ে দেবে। .... না না ওসব ব্যাপার নয়। কিছু দিতে হবে না । সামান্য ব্যাপার.... আসুন আসুন....’

মদন আর সনৎ অবাক হয়ে মুখ চাওয়া চাউয়ি করে।

 

    গাড়িতে শিবব্রতবাবু সনৎ আর মদনের সঙ্গে পিছনের সিটে বসলেন। মদন মাঝখানে , বাকি দুজন দুপাশে।গাড়ি রেড রোড দিয়ে মেয়ে রোডে গিয়ে পড়ল। এরপর পার্ক স্ট্রীট ফ্লাই ওভার ধরবে।শিবব্রতবাবুকে একেবারেই তার পরিচিত ধরণে দেখা যাচ্ছে না। তিনি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন।এবার বললেন, ‘ সেদিন আপনারা যাওয়ার পর থেকে আমার বড় ছেলে বাবিনের একটা আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হয়েছে। সব কথা মোটামুটি পরিষ্কার বলতে পারছে , যেটা সে এতদিন পারত না।এতদিন আমরা অনেক ট্রি টমেন্ট   করেছি, কিন্তু সেরকম ইমপ্রুভমেন্ট কিছু হয়নি।সেদিন মদনবাবুর টাচে এসে কি ব্যাপার ঘটল কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রায়ই বলছে মদন আমার ছেলে.... কত বড় হয়ে গেছে । সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল সে আপনাদের গ্রামের নামও বলছে। বলছে খেজুরতলায়  যাব। আজই যাব। মদন তোমার গ্রামের নাম কি খেজুরতলা  ?’

মদন বলল, ‘ আজ্ঞে হ্যাঁ ‘

 

    শিবব্রতবাবু বাড়িতে পৌঁছে ওদের দুজনকে নিয়ে ওপরে গেলেন এবং অফিস রুমে বসালেন।নিজেও বসলেন। তিনি মদনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ আচ্ছা মদন , তোমার বাড়িতে কে কে আছেন ? নিকুঞ্জ দাস তো তোমার মেশোমশাই হন ?’

— ‘বাড়িতে শুধু আমার মা আছে,আর কেউ নেই। হ্যাঁ উনি আমার মেসো।’ মদন উত্তর দেয়।

— ‘ আর তোমার বাবা ?’

— ‘ বাবা মারা গেছে অনেকদিন আগে।আমার তখন বারো তেরো বছর বয়স।’ মদন জানায়।

— ‘ তা মোটামুটি কতদিন আগে হবে ?’

— ‘ তা ধরুন বারো বছর হবে ।’

— ‘ বারো বছর ! একদম ঠি ক তো ? শিবব্রতবাবুর কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে। রুমাল বার করে তিনি মুখের ঘাম মোছেন ।’ তারপর আবার বলেন ‘ আচ্ছা তারকনাথ কার নাম ? ‘

— ‘ আজ্ঞে আমার বাবার নাম।’ মদন জবাব দিতে না দিতে কোথা থেকে হঠাৎ হুড়মুড় করে বাবিন এসে ঢুকল।পেছনে ছুটতে ছুটতে আসলেন তার মা স্বাতীলেখা।বাবিন সকলকে বিস্ময়ে বোবা বানিয়ে বলতে লাগল — ‘ আমি তারক ... তারক .... মদন কোথায় গেলি .... বাবা মদন .... ‘ , বলতে বলতে মদনের দিকে ছুটে এল আগের দিনের মতো। শিবব্রতবাবুর মুখের পেশীগুলো কুঁচকে গেল। ডান হাতের তেলোয় মুখ রেখে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজের চেয়ারে বসে রইলেন।মদন ও সনৎ বিষ্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল।স্বাতীলেখা ছুটে বাবিনের কাছে গেলেন মদনের চেয়ারের পাশে । বাবিনকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

 

    নিকুঞ্জর জামিনের অর্ডার হয়ে গেছে। জেল প্রশাসনের হাতে কাগজ পৌঁছল পরদিন সকালে।শিবব্রতবাবু নিজে জেলের অফিসে গিয়ে তদারকি করে নিকুঞ্জকে রিলিজ করালেন বেলা বারোটা নাগাদ। সে যে কোনদিন মুক্তি পেতে পারে নিকুঞ্জ সে  বিশ্বাস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। যে সব অবিশ্বাস্য ঘটনা কদিন ধরে ঘটছে, তার ওপর তার জন্য তদ্বির করতে স্বয়ং উকিলবাবুর জেলের ভেতর আবির্ভাব, তার মনে হতে লাগল সে স্বপ্ন দেখছে কিনা।নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে।চিমটিতে লাগল বেশ।

       জেল থেকে বেরিয়ে সে সনৎ বরাট আর মদনের সঙ্গে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল।সঙ্গে তাদের আইনজীবী শিবব্রত সান্যাল।তার গাড়ির ড্রাইভারকে হাত নেড়ে গাড়িটা চায়ের দোকানের উল্টোদিকে রাখতে বললেন। তিনিও ওদের সঙ্গে কাঁচের গ্লাসে চা খেতে লাগলেন।মদনরা বেশ সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শিবব্রতবাবু নির্বিকারভাবে চায়ে চুমুক দিলেন।দুটো চুমুক মেরে তিনি বললেন, ‘আমাদের উত্তরাখন্ড ট্যুর প্রোগ্রাম ক্যানসেল করেছি । নিকুঞ্জ তো তার বাড়ি পাটলিপাড়া গ্রামে ফিরে যাবে। সপ্তাহে একদিন করে লোক্যাল ফাঁড়িতে মুখ দেখিয়ে আসবে যতদিন না কেসটা খারিজ হয়।ফাঁড়িতে কাগজ চলে যাবে শিগ্গীর। আর আমি যাব মদনের গ্রাম খেজুরতলায়..... উইথ হোল ফ্যামিলি। আমি পুরো রহস্যটাই জানতে চাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না । মদনরা তিনজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল দুঁদে উকিল শিবব্রত সান্যালের মুখের দিকে। ইতিমধ্যে গাড়ির ড্রাইভার এসে এক গ্লাস চা নিয়ে বসেছে।

 

    তিনদিন পরে মদন, সনৎ আর নিকুঞ্জর সঙ্গে শিবব্রতবাবুর পরিবার খেজুরতলা গাঁয়ে মদনদের বাড়ি গেলেন।মদনের মা শেফালি কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। শিবব্রতবাবু তাকে বললেন , ‘ব্যস্ত হবেন না, ব্যস্ত হবেন না। আমরা একটা কাজে এসেছি।’

     বেলা দশটা বেজেছে। চড়চড় করে রোদ উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলে মদনদের কুঁড়ে থেকে একটু দূরে গাছপালা ঘেরা একটা মেঠো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবিন তার মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে পড়ল  বাবিন অস্থিরভাবে চারদিকে দেখছে।তারমধ্যে অটিজমের সব লক্ষ্মণ যেন ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে গেছে। কোন এক গন্ধে যেন সে ছটফটিয়ে উঠছে। আচমকা তার মার হাত ছাড়িয়ে সে মদনদের কুঁড়ের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। তার পিছন পিছন ওরাও ছুটতে লাগল। সবাই শুনতে পেল বাবিন শেফালি শেফালি বলে ডাকতে ডাকতে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে বাবিন এক জায়গায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।পড়ে গিয়ে বাঁ পাটা চেপে ধরে একটা ঘসঘসে গলায় চেঁচাতে লাগল ‘ ওরে বাবারে.... মরে গেলাম.... মরে গেলাম .... জ্বলে যাচ্ছে রে..... ও: ...মদন কোথায় গেলি রে..... ও মদন শিগ্গীর আয়.... শিগ্গীর আয়.....

       ততক্ষণে মদনরা সকলে সেখানে এসে পৌঁছে গেছে। অটিস্টিক পেশেন্ট তার বড় ছেলে শুদ্ধসত্ত্বকে এমন ছুটতে দেখে তার বাবা মা বাকরুদ্ধ  হয়ে গেছেন।

মদনকে দেখে বাবিন বলল, ‘ মদন .... মদন ... ধর আমাকে ... শিগ্গীর বাঁধ এইখানটা... জ্বলে যাচ্ছে... জ্বলে যাচ্ছে ...

    মদন ওখানে উবু হয়ে বসল।বাবিন মদনকে জড়িয়ে ধরল। মদন তাকে কোলে শুইয়ে নিয়ে মাটির ওপর বসল।

    নিকুঞ্জ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, ‘ ঠিক এই জায়গাটায় মদনের বাবাকে সাপে কেটেছিল বারো বচ্ছর আগে।


Anjan Bandopadhyay