ছাতিমতলা
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
বসন্তের সকাল। শীতের গাড়ি স্টেশান ছেড়ে চলে গেছে । আর্সিয়ানাদের গাড়ি
এসে থামল এক নির্জন পাথুরে জায়গায়। রোদ্দুরে উজ্জ্বল প্রচুর ছোটবড় গাছে
ভরা । জায়গাটা শিমূলতলা... ও..ই লাট্টু পাহাড়ের কাছাকাছি। বালি কাঁকড়ে
ভরা পথ আর একটুখানি হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি আর যাবে না। আর্সিয়ানা ,
সৌমিনি আর বজ্র টাটা সুমো থেকে নেমে স্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। চিরচিরে সব
পাখির ডাকে ঝিরঝিরে হাওয়া কুটিপাটি হচ্ছে। শৌভিক, মানে শৌভিক চ্যাটার্জী
খুব বড় সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত আছে। তুখোড় ছেলে। তরতর করে
ওপরে উঠছে। শৌভিক কিন্তু আর্সিয়ানার গুনমুগ্ধ। শিমূলতলায় ছাতিমতলা বাংলা
সেই ঠি ক করে দিয়েছে। ওখানকার পুলিশ স্টেশনের ও সি-র মোবাইল নাম্বারও মেসেজ
করে পাঠিয়েছিল আর্সিয়ানাকে।
যে ছেলেটা গাড়ি চালাচ্ছিল সে বেশ স্মার্ট গোছের । পরনে নীল জিনস আর লাল টি
শার্ট। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গাঁয়ের রঙ। মুখের গড়ন অনেকটা আমির খানের
মতো।কথা বলে খুব। বলল, ‘ এখানে এসেছেন খুব ভাল করেছেন। জায়গাটা খুব সুন্দর।
আমাদের অমিত স্যারও খুব শরীফ আদমি। মগর একটু সামহালকে থাকবেন। বদমাশ লোক
ভি বহুৎ আছে এখানে।’
—-‘ তাই নাকি ? ‘ আর্সিয়ানা নির্বিকারভাবে জিজ্ঞাসা করে।
—- ‘ হ্যাঁ ম্যাডাম। খুন খারাবা ভি আখছার হয় ।আমি অবশ্য বেশিদিন আসিনি
এখানে। এই এক সালের মতো হবে।আগে দেওঘরে থাকতাম। এখানে শীতকালটা খুব ভাল
লাগে আমার। এই গরম আসছে... বহুৎ পরেশান হবে এবার।যাই হোক আপনারা ভাল সিজনেই
এসেছেন। এনজয় করতে পারবেন.... ।’ অনর্গল বকবক করতে লাগল ও। বাংলা বেশ
পরিষ্কার, তবে দেহাতি টান আছে।সৌমিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমির খান মার্কা
যুবকের দিকে। আর্সিয়ানা ভোলাভালা সৌমিনির উরুতে একটা চিমটি কাটল।
সৌমিনি চমকে ওঠে....’আ...হ ! ‘
আর্সিয়ানার দিকে তাকায় ঝট করে। আর্সিয়ানা ঠোঁটে গূঢ় হাসি ঝুলিয়ে এক চোখ টেপে।
সৌমিনি অপ্রস্তুত স্বরে অস্ফুটে বলে , ‘ ধ্যাৎ ! ‘ হেসে গড়িয়ে পড়ে গাড়ির
সিটে। বজ্র, মানে টাটা সুমোর ড্রাইভার কিন্তু একবারও মুখ ঘুরিয়ে পেছনে
তাকাল না।
এখানে শশীভূষণ মিত্রের এক পেল্লায় বাগানবাড়ি আছে এক বিশাল পাথুরে
প্রান্তরে। ওখান থেকে দূরে দূরে আবছা ছবির মতো ঝাড়খন্ড অঞ্চলের পাহাড়ের
সারি দেখা যায়। শশীভূষণ তো আর এখন বেঁচে নেই। তার ছেলে মেয়েরাও সকলেই
পরলোকগত। আছে দুই নাতি আর এক নাতনি। সকলেই ছেলের দিকের। তাদের বয়েস
পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। এদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে বড় অমিতাংশু। তারপর
সুপ্রভা।
সবার ছোট অজিতাভ। তার পঞ্চান্ন হল। এদের মধ্যে শুধু অমিতাংশুবাবু শিমূলতলার
এই খামারবাড়িতে থাকেন। তিনি অবিবাহিত। সঙ্গে থাকত মালি ঝগরু আর তার
পরিবার। পরিবার মানে, ঝগরু আর তার বৌ। বৌ কমলার বয়েস তিরিশের বেশি নয়। ঝগরু
বেঁচে নেই। মারা যাবার সময় ঝগরুর বয়েস ছিল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বৃদ্ধস্য
তরুণী ভার্যা বলা যায়। ওদের কোন ছেলেপুলে নেই। ঝগরু খুন হয়েছিল বছর দেড়েক
আগে।
বাড়ির নাম ছাতিমছায়া। লোকে বলে ছাতিমতলা।বাড়িটা প্রায় দেড়শো বছরের
পুরণো। চারদিক ঘেরা দেড় মানুষ সমান পাঁচিলে। পাঁচিল অবশ্য বারংবার মেরামত
হয়েছে। তবু পাঁচিলের একপাশে বেশ বড়সড় ক্ষত। সেখান দিয়ে সেঁধিয়ে আসে
শেয়াল, বুনো ভাম কিংবা বনবিড়াল ।আর বেজির আনাগোনার তো শেষ নেই।একসময়ে
এখানে প্রচুর ছাতিম গাছ ছিল । এখনও বেশ কিছু আছে। সেজন্য ভিলার নাম
ছাতিমতলা। বাড়ির চারপাশে জঙ্গুলে আবহ।অার ভেতরে তো নাম জানা ও নাম না জানা
গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই।
বজ্র আর কমলা হাতে হাতে মহাদেবদের মালপত্র বয়ে এনে ছাতিমতলার একতলার
বারান্দায় এনে রাখল। বাড়িটা দোতলা । একতলায় আটখানা ঘর আছে ।দোতলাতে ছ খানা
। অমিতাংশুবাবু দোতলার একটা ঘরে থাকেন। অমিতাংশুবাবুর ঘরের পাশের দুটো ঘরে আর্সিয়ানা এবং সৌমিনির থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। আর্সিয়ানারা দুজনে অবশ্য
একই ঘরে ঢুকল।পুরণো দিনের বাগানবাড়ি ।কোন ঘরের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট গোসলখানা
নেই। এয়ার কন্ডিশনারও নেই। বাথরুম ওপাশে একটু তফাতে । অমিতাংশুবাবুও
অ্যাটাচড্ বাথ নির্মাণের আগ্রহ দেখাননি। কমলার থাকার ঘর মূল বাড়ির পেছন
দিকে প্রায় পনের মিটার দূরে।ঢালাই ছাদের পাকা ঘর। টালি বা অ্যাসবেসটসের ছাদ
নয়।
ঝগরুর বিধবা ঘরনি কমলা আর্সিয়ানাকে সিগারেট টানতে দেখে বেশ মজা পেল।
হাসিমাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কৌতুকি দৃষ্টিতে অার্সিয়ানা আর সৌমিনিকে
দেখতে লাগল।
বাড়ির হাতায় গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই। আম লিচু সবেদা জাম আর অনেক কাঁঠাল গাছ আছে।পাঁচিল ঘেঁসে গোটা তিনেক বেশ ফলন্ত সজনে গাছও আছে।
সেই ভোর থেকে গাছের ডালে ডালে পাতার আড়ালে শ’য়ে শ’য়ে পাখির কলকাকলি। সারা
দিনভর চঞ্চল চপল আনাগোনা। ওদের পারিবারিক ব্যস্ততার শেষ নেই।
এখানে বিদ্যুতের আগমন বেশিদিন হয়নি। এই বছর পাঁচেক হবে। তার আগে সন্ধের পর
হত ঘুরঘুট্টি অাঁধার। দেহাতিদের ঘরে জ্বলত ঢিমে আলো। ঝোপঝাড় থেকে শেয়ালের
পাল তুলত এককাট্টা একটানা ডাক। জোনাকির আলো চুমকি ছড়াত রাতের শরীরে। এখন
নরম সরম হলেও রাতের গায়ে পড়ে মৃদু ভোল্টের আভা ।
রাত্রে কমলার পাকানো দেশি মুরগির ঝোল, ফুলকপির তরকারি আর গরম ভাত আর্সিয়ানা সৌমিনির যেন অমৃত মনে হল। অমিতাংশুবাবুও একসঙ্গে খেতে বসলেন।
খাওয়াদাওয়া চলাকালীন কমলা সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকল।
ঘরে দুটো সিঙ্গল খাট আছে। দুটো চেয়ারও আছে । একটা বড় টেবিল আছে দেয়াল
ঘেঁসে এবং টেবিলের ওপর একটা বড় আয়না দাঁড় করানো আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে।
প্রায় পনের ফুট উঁচু সিলিং। ঘরের আকার কমপক্ষে পনের ফুট বাই বারো ফুট। কমলা
নৈশভোজ তত্ত্বাবধানের ফাঁকে কৌতুকভরা চোখে শার্ট প্যান্ট পরা আর্সিয়ানা
সৌমিনিকে দেখে চলেছে। খাওয়া শেষ হলে কমলা এঁটো বাসনপত্র তুলে নিয়ে চলে গেল।
এসব জায়গায় সকালবেলাটা যেন স্বর্গীয় সুষমা মাখান। একটা মোরগ ডাক ছাড়ল
সনাতন ভৈরবী মায়ায়।অমল উদার আলোয় মাখামাখি শিথিল অলস হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল সে
তান। গাছের পাতায় নরম লাবন্যময় আলো পড়ে চিকচিক করতে লাগল একটু পরে। কমলা
একটা বড় ঝুড়ি মাথায় চাপিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেল হন্তদন্ত হয়ে। বোধহয়
স্টেশনের পাশে হাটে বসে মুরগির ডিম বিক্রি করে। বাড়ির পুব দিকে একটা
ছোটখাটো দেশি মুরগির খামার আছে। সকালবেলায় দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। রঙ
বেরঙের মুরগির দল বাড়ির সামনে নিশ্চিন্তে ঘুরঘুর করছে। খুঁটে খুঁটে কি যেন
খুঁজে বেড়াচ্ছে মাটিতে ঘাসে।
আর্সিয়ানার সকালবেলায় এক কাপ কফি খাওয়ার অভ্যেস। কিন্তু এখানে তা পাওয়া
যাবে না। অগত্যা কমলার এনে দেওয়া এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসল।সৌমিনি এখনও
ঘুমোচ্ছে বিছানা আঁকড়ে। সৌমিনিকে আর্সিয়ানার বন্ধুও বলা যায়, ভক্তও বলা
যায়। আর্সিয়ানার হাত পাকড়ে এখানে চলে এসেছে শুধুমাত্র ভ্রমণবিলাসে। আর্সিয়ানার ডাকাবুকো জীবন ও ক্ষুরধার মানসিকতার সঙ্গে তার কোন দিক দিয়েই
কোন মিল নেই। কিন্তু বিপরীত মেরুদ্বয়ই তো একে অপরকে টানে। আর্সিয়ানা
সৌমিনির জোড় লাগা বোধহয় সেইভাবেই।দুজনেরই বয়েস সাতাশ অতিক্রান্ত।
একতলার বারান্দায় খান চারেক প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা আছে। একটা ছোট টেবিলও
আছে। আর্সিয়ানা একটা চেয়ারে বসে চা খেতে লাগল। বারান্দাটা একটু উঁচু।
উঠোনে পা দিতে গেলে তিনধাপ আধচাঁদা সিঁড়ি নামতে হবে। তিননম্বর সিঁড়িটার
নীচে বসে আছে একটা কুকুর।চেহারা দেখে মনে হয় অ্যালসেসিয়ান আর দেশি কুকুরের
সংকরজাতীয়। দু’পা সামনে রেখে বসে জিভ বার করে শ্বাস ফেলছে। সামনের দিকে
চেয়ে বসে আছে যেন কিসের প্রতীক্ষায়।মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে আর্সিয়ানার দিকে
তাকিয়ে থাকছে কয়েক সেকেন্ড। কয়েকবার এরকম তাকাবার পর কুকুরটার চোখে চোখ
পড়ল আর্সিয়ানার।
দূর দিগন্তে দেখা যাচ্ছে নীলাভ পাহাড়ের সারি। নি:শব্দ চারিধার।
সৌমিনির ঘুম ভেঙে গেছে। দেখল আর্সিয়ানার বিছানা ফাঁকা। আড়ামোড়া ভাঙতে
ভাঙতে বারান্দায় এল। এসে দেখল ও অলস ভঙ্গীতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
— ‘ হাই লিখা... গুড মর্নিং...’
— ‘ হাই ডার্লিং... গুড মর্নিং... ঘুম ভাঙল ? ‘
সৌমিনি আর্সিয়ানার পাশে এসে বসল। সামনের আবছা নীল পাহাড়ের দিকে উদাস চোখ মেলে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ।
— ‘ হোয়াট আ বিউটিফুল ল্যান্ডস্কেপ .... না লিখা ? ‘
— ‘ ইয়েস, রিয়েলি ...’
দুজনে আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ।
কুকুরটা বারান্দার নীচে ঠায় বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকাল
আবার। কেমন যেন আবেদনের বার্তা মাখা দৃষ্টি।আর্সিয়ানা তাকিয়ে রইল
নির্লিপ্তভাবে।
— ‘ আচ্ছা অমিতাংশুবাবুর সমস্যাটা কি সেটা তো বললি না !
কি জন্য তোকে ডেকেছেন এখানে ?’ সৌমিনি জিজ্ঞাসা করে।
— ‘ মূল সমস্যাটা হল কমলাকে নিয়ে। পরে বলব সব কথা।’ অার্সিয়ানা সংক্ষেপে জবাব দেয়।
খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজনে। একটা বছর পঁচিশের সুঠাম চেহারার ছেলে
সামনের টেবিলে আর এক কাপ চা এনে রাখল। সেই নীল রঙা জিন্স এবং লাল রঙের
টিশার্ট পরা আমির খান মার্কা ড্রাইভার ছেলেটা। বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গীতে সৌমিনির
দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ম্যাডাম চা ... ‘। আদিবাসিসুলভ শক্তপোক্ত শরীরি
কাঠামো, কিন্তু রঙ কালো নয়। বরং বেশ ফর্সা।
আর্সিয়ানা জিজ্ঞাসা করল ,
‘ তোমার নাম কি ?’
ছেলেটা বলল, ‘ বজ্র । আমি অমিতাংশু স্যারের গাড়ি চালাই।’
— ‘ ও আচ্ছা , ঠিক আছে । তুমিই তো কাল আমাদের গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে এলে। ঠি ক আছে, দরকার হলে ডাকব....’
ছেলেটা চলে গেল।
দুপুর একটা নাগাদ কমলা হাট থেকে ফিরল। তারপর চটপট দুপুরের খাবার লাগিয়ে দিল
ভেতরের তিন নম্বর ঘরে পাতা টেবিলে। মটর ডাল, পোস্ত মাখানো আলু ভাজা আর
দেশি চিকেনের কারি। আর শেষে সাদা মিষ্টি দই। অপূর্ব স্বাদ ।
অমিতাংশুবাবু বললেন, ‘এই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে পারলে সব দিক দিয়েই ভাল
হয়। কিন্তু মন সাড়া দেয় না। কি মায়ায় যে জড়িয়ে আছি এই খামারবাড়িটার
সঙ্গে। কমলা আর বজ্রই এ বাড়ির সব কিছু সামলায়। বজ্র অবশ্য বছর দেড়েক হল
এখানে এসেছে।তার আগে কমলা একাই সব সামলাত।
অমিতাংশুবাবু আর্সিয়ানাকে বললেন , ‘ কে বা কারা যেন ঝগরুকে মেরে ফেলেছিল।
মার্ডার করেছিল। তারপর ওই দক্ষিনদিকে পাঁচিলের ধারে যে আমগাছটা রয়েছে তার
ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। খুন করার কারণটা আজও পরিষ্কার হয়নি।পুলিশি তদন্ত এখনও
চলছে। ঝগরুর বউ কমলার ছেলেপুলে হয়নি। প্রথমদিকে খুব কান্নাকাটি করত। তারপর
সামলে নিল।ওর তো নিজের লোক বলতে তেমন কেউ নেই। মা বাবা দুজনেই মরে গেছে।
কমলা আবার তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গেল। শুধু স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে
গেল না। অসম্ভব প্রগলভ হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন।কেমন একটা ব্যধি ওর ওপর
চেপে বসল। একটু আকর্ষণীয় মহিলা দেখলেই তাকে পাবার জন্য ও ক্ষেপে ওঠে। ‘
অার্সিয়ানাকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অমিতাংশুবাবু বলে উঠলেন, ‘
হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম ঠিকই শুনছেন.... পুরুষে নয়, নারীতে তীব্র আকর্ষণ। অথচ ও
একেবারেই এরকম ছিল না। একেবারেই সহজ সরল একটা দেহাতি মেয়ে..... ‘
একটু চুপ করলেন অমিতাংশু। আর্সিয়ানাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে
বললেন, ‘ জানি কি ভাবছেন।আমি কমলাকে টলারেট করছি কেন।ওকে এখান থেকে
তাড়িয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। হ্যাঁ তা দিতেই পারতাম। মুশ্কিল হল, আমি
ওকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসি। আমার তো পুত্র কন্যা কেউ নেই। তাই.... ।
কিন্তু ব্যাপারটা দিন দিন ইনটলারেবল হয়ে উঠছে।....এই যে আপনারা দুজন মেয়ে
এখানে এসেছেন আমি শিওর ও সুযোগ খুঁজছে আপনাদের ঘনিষ্ঠ হবার জন্য।আর একটা
ব্যপার হল ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ। সেটা মাঝে মাঝে কি করে বেড়ে যায় কে
জানে।আবার অন্য সময়ে একদম নর্মাল। ভারি ওজন একদম বইতে পারে না। সেদিন ষাট
কেজির একটা সিমেন্টের বস্তা অনায়াসে তুলে নিয়ে গোডাউনে ঢোকাল। .... আপনার
কি মনে হয় এটা কোন সাডেন হর্মোনাল বা ক্রমোজোমিক মেটামরফোসিস ?
আমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।’
— ‘ আমি তো এ ব্যাপারে এক্সপার্ট নই ....’ , আর্সিয়ানা বলে। ‘....তবে সো
ফার অ্যাজ আই নো এরকম সাডেন মেটামরফোসিস ইজ কোয়াইট আনলাইকলি । দেয়ার মাস্ট
বি সামথিং আনক্যানি বিহাইন্ড দা অকারেন্স ।
যাই হোক, আমি চেষ্টা করব টু দা বেস্ট অফ মাই ক্যাপাসিটি টু আনভেল দা
মিস্ট্রি।’ তারপর ট্রেডমার্ক গোয়েন্দাসুলভ লব্জে জিজ্ঞাসা করল, ‘ এ
ব্যাপারে আপনার কাউকে সন্দেহ হয় ? ‘
—- ‘ না: , কাকে সন্দেহ করব বলুন তো । সন্দেহ করার মধ্যে তো এক ওই বজ্র।
কিন্তু কমলার কান্ডকারখানার জন্য তো সে রেসপনসিবল হতে পারে না। তাছাড়া
ঝগরু যখন মার্ডারড হয় সে তো এখানে আসেইনি।’
— ‘হুমম্ ... আচ্ছা কুকুরটা কতদিন ধরে এখানে আছে ? ‘ অার্সিয়ানা আচমকা প্রশ্ন করে।
— ‘ কোন কুকুরটা বলুন তো ?’
— ‘ ওই যে অ্যালসেসিয়ানের মতো দেখতে ‘
— ‘ ও আচ্ছা ....টমি... ‘ একটু ভাবতে লাগলেন। ‘ ওটা .... ওটা যদ্দুর মনে
পড়ছে এখানে এসেছে ঝগরু মারা যাবার মাসখানেক পর । এক শীতের রাতে হঠাৎ এল
গেট দিয়ে ঢুকে। তারপর থেকে গেল এখানে। কমলাই খেতে দেয়। আমি আর তাড়াইনি
ওটাকে।’
— ‘ও আচ্ছা । আচ্ছা ঠিক আছে । দেখা যাক হাউ ইট প্যানস্ আউট।’
—- ‘ হ্যাঁ থ্যাঙ্ক ইউ। দেখুন কি করতে পারেন। .... আর হ্যাঁ , একটা কথা । আপনারা কিন্তু রাত্রে দরজা জানলা ভাল করে আটকে শোবেন।’
— ‘ ওক্কে ‘
নিশুতি রাত। ফাঁকা জায়গা । নিস্তব্ধ পরিবেশ। বেশ বড় মাপের ঘরের দুপাশে
দুটো সিঙ্গল বেড। প্রায় পনের ফুট উঁচুতে সিলিং।ঘরে ঢিমে বালব্
জ্বলছে।সাতফুট উচ্চতার সেগুন কাঠের দরজার ছিটকিনি এবং খিল
বন্ধ।অমিতাংশুবাবুর কথামতো আর্সিয়ানা যেদিকে শুয়েছে সেদিকের বড় বড় দুটো
জানলা বন্ধ করা আছে। তেমন গরম এখনও পড়েনি এখানে।মাঝরাতের পর গায়ে কিছু
টেনে নিতে হয়।নি:শব্দ তল্লাটে হঠাৎ একপাল শেয়াল সমবেত স্বরে ডাকতে আরম্ভ
করল। আর্সিয়ানার চোখে ঘুম নেই।মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।ওদিকের
খাটে সৌমিনি বেশ খানিকক্ষণ আবোলতাবোল বকবক করার পর এখন ঘুমিয়ে কাদা।হাল্কা
নাকও ডাকছে।অার্সিয়ানা ভাবে, সত্যি... সৌমিটা ছেলেমানুষই থেকে গেল।
মোবাইল খুলে সময় দেখল আর্সিয়ানা । একটা বাহান্ন । এরপর আরও মিনিট পাঁচেক কাটল। চোখের পাতা একটু জুড়ে আসছে যেন।
একটা চাপা গোঙানিতে ঘুম ছুটে গেল তার। ধড়মড় করে উঠে বসল অার্সিয়ানা। তার
বালিশের তলায় রিভলভার আছে। পাশে টর্চ। অবশ্য মৃদু বাতিতে সবই দেখা যাচ্ছে।
চিৎ হয়ে শোয়া সৌমিনির দেহে উপুড় হয়ে দখল নিতে চাইছে কে একজন। আর সৌমিনি
ছটফট করছে নিজেকে ছাড়াবার জন্য।দরজা জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ। ভয়ে বিষ্ময়ে
কন্ঠরোধ হয়ে গেল তার।কিন্তু অার্সিয়ানার স্নায়ু অন্য ধাতুতে গড়া । কয়েক
সেকেন্ড লাগল বুকের চাপটা কাটাতে। ঝট করে টর্চের আলো ফেলল সৌমিনির বিছানায়।
সৌমিনির শরীরে ওপর অস্থির আকুলিবিকুলিরত এক নগ্ন নারীদেহ। দেখে বিস্ময়ে
স্তব্ধ হয়ে গেল আর্সিয়ানা যে, নগ্ন নারীটি কমলা। আর্সিয়ানা তার আঠাশ
বছরের বৈচিত্রময় এবং দু:সাহসী জীবনে এ ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি
কখনও। কিন্তু সে অন্য ধাতুতে তৈরি। এর মধ্যেই ভাবনা চিন্তা করে ফেলল। সে
সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে এটা একটা অ্যাকিউট কেস অফ পেরিফেরাল হ্যালুসিনেশান। সে
তাড়াতাড়ি সুইচ বোর্ডের কাছে গেল এবং সুইচে চাপ দিল। আলোয় ভরা ঘরে
অার্সিয়ানা কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। সৌমিনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তড়িতাহত
এবং বিদ্ধস্ত ভঙ্গীতে। উদভ্রান্ত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিছানার পাশে
দাঁড়ানো আর্সিয়ানার দিকে। আর্সিয়ানা কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় না হয়ে ঢাকা
গ্লাস থেকে জল নিয়ে সৌমিনির চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে লাগল। তারপর ওই
রাতদুপুরেই মোবাইল কল দিল অমিতাংশুবাবুকে। দরজা বা জানলা কিছুই খুলল না।
মোবাইলে রিং হয়ে যেতে লাগল। কেউ ফোন ধরল না। স্লিপিং পিল খেয়ে বিছানায় যাওয়া অমিতাংশুবাবুর বোধহয় ঘুম ছুটল না।
পুব আকাশে সূর্য উঠে যথারীতি ভোর হল। অার্সিয়ানা দরজা খুলে বারান্দায় এল।
দেখল, গাছকোমর করে শাড়ি বেঁধে নীচে চাতালে শুকনো পাতা ঝাঁট দিচ্ছে কমলা। আর্সিয়ানার সব কিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।সৌমিনি এখনও ট্রমায় আচ্ছন্ন।ঘরে
শুয়ে আছে।
সকাল প্রায় নটা নাগাদ একজন ডাক্তারবাবু এলেন। কমলাই ডেকে নিয়ে এল।
অার্সিয়ানার অবাক হওয়ার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । ডাক্তারবাবুর ঝাঁঝায়
বাড়ি। শিমূলতলায় প্র্যাকটিস করেন।তিনি অবশ্য বিশেষ কিছু বুঝতে পারলেন
না।একটা ট্র্যাঙ্কুইলাইজার প্রেসক্রাইব করে গেলেন। ডাক্তারবাবু যখন বেরিয়ে
যাচ্ছেন অ্যালসিসিয়ান মার্কা কুকুরটা ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি শুরু করল কমলার
আশেপাশে।শান্তশিষ্ট কুকুরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
আর্সিয়ানা দোতলার বারান্দায় বসে রইল দূরে আবছা নীল পাহাড়ের সারির দিকে
চেয়ে। ভাবল, সৌমিনিকে কি আজ রাতে এখানে রাখা ঠি ক হবে ! বেচারা এমনিতেই
ট্রমাটাইজড হয়ে আছে।সে কিন্তু আজ রাতে কি ঘটে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
কাল রাতের ঘটনাটা সত্যিই কি হ্যালুসিনেশান ছিল ? নানা চিন্তা ঘোরে আর্সিয়ানার মাথায়। একবার ভাবল, স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে ব্যাপারটা জানিয়ে
রাখবে কিনা । ফাঁড়ির ফোন নম্বর আর্সিয়ানা যোগাড় করেই রেখেছে। তারপরই মনে
হল, এরকম একটা ঘটনায় পুলিশের কি করার আছে। অনেকক্ষণ ধরে সাতপাঁচ ভাবার পর আর্সিয়ানা থানার বড়বাবুকে একটা কল দিল। ওদিকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ হয়ে ফোন
কেটে গেল। তারপর বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর হাল ছেড়ে দিল আর্সিয়ানা ।
প্রত্যেকবারই ঘুরে আসে একই কথা— ডায়াল করা নম্বর নাকি উপলব্ধ নেই ,পরিষেবা
সীমার বাইরে। ও: ডিজগাস্টিং.... আর্সিয়ানা বিরক্তিতে খানখান হয়।বড়বাবু কি
জবাব দিচ্ছেন
কিছু শোনা যাচ্ছে না। ঘড়ঘড় করে আওয়াজ হয়ে লাইন কেটে যাচ্ছে । ওফ্ , এই
নেটওয়ার্কের সমস্যায় জীবন ঝালাপালা হয়ে গেল। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে আর্সিয়ানার চোখেমুখে।
কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। কাকে একটা
দেখা গেল ওই দূরে একটা আমগাছের তলায় ঠি ক যেন আমগাছটার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। হাল্কা ধোঁয়া উড়ছে মনে হচ্ছে এখান থেকে। কোন ব্যাটা বোধহয় ওখানে
দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে।
টমিকে দেখা যাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরে। বিদ্যুৎতরঙ্গের মতো আর্সিয়ানার মাথায়
একটা চিন্তা ছিটকে উঠল। সে তাড়াতাড়ি দোতলা থেকে নীচে নেমে এল। কুঠির
চারদিকের বিশাল কম্পাউন্ড ঘুরে কুকুরটাকে খুঁজতে লাগল। না:, কোথ্থাও নেই। আর্সিয়ানা আপনমনে বোকার মতো হাসে। তাই তো ! সে কুকুরটাকে খুঁজে মরছে কেন।
দক্ষিনদিকের ওই আমগাছটার দিকে হাঁটতে লাগল শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে
যেখানে কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে । মশ্ মশ্ করে আওয়াজ হতে
লাগল।নীরব আবহে ওইটুকু আওয়াজই বাতাসে ছলকে ছলকে উঠছে।আমগাছটার তলায় পৌঁছল আর্সিয়ানা ।কেমন নির্জন সিরসিরে পরিবেশ।কোন গাছের পাতার আড়ালে বসে একটা
পাখি ডাকছে । বাতাস কেটে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে কুঁড়ুর কুঁড়...... কুঁড়ুর
কুঁড় ..... অসীম নীরবতায় রহস্যময় শব্দের মতো।
অবাক কান্ড। ওখানে কাউকে দেখতে পেল না আর্সিয়ানা । কেউ নেই ধারে কাছে। এ
জায়গাটায় আম জাম কাঁঠাল লিচু গাছ যেমন আছে, তেমনি শাল গাছও আছে বেশ কিছু।
বেশ ঘন জঙ্গল মতো হয়ে আছে এক জায়গায়। কেমন যেন ঝুঁঝকো অাঁধার ওখানে।
অার্সিয়ানা ওই দিকেই তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দেখে ওই শাল গাছগুলোর আড়াল থেকে
অ্যালসেসিয়ানের মতো দেখতে টমি বেরিয়ে এল। ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ধীরে সুস্থে
হেঁটে আর্সিয়ানার সামনে এসে দাঁড়াল। মুখটা তুলে ঠি ক কালকের মতো করুণ
আবেদনময় চোখে আর্সিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে
থাকতে অদ্ভুত একটা আবেশ জড়িয়ে ধরছে যেন তাকে । অার্সিয়ানার হঠাৎ সৌমিনির
কথা মনে পড়ল। সে জোর পায়ে হাঁটা দিল ছাতিমতলা কুঠির দিকে। কুকুরটাও তার
সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তার নিজের ওপর খুব রাগ হল। মনে হল, যদিও কমলাকে
বলে এসেছে সৌমিনিকে দেখার জন্য, তবু একটা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেয়েকে একা
ফেলে আসা উচিৎ হয়নি। আর কমলা তো.... কাল রাত্রের কথা মনে করে শিউরে উঠল সে।
তার কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল নাকি। অন্তত আজ রাতটা কাটাতে হবে এখানে।
হাঁটতে হাঁটতেই ফাঁড়ির ও সি-র মোবাইল নম্বর ডায়াল করল। এটা মনে হচ্ছে
একেবারেই পুলিশ টুলিশের মামলা নয়। তবু, আর্সিয়ানা পুলিশ ছাড়া আর কার
সাহায্যই বা নিতে পারে এখানে।
তরতর করে দোতলায় উঠে ঘরে ঢুকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আর্সিয়ানা । বিছানায়
বালিশে ঠেস দিয়ে বসে সৌমিনি কমলার সঙ্গে কি সব গল্প করছে। অবশ্য কমলাকে
দেখে সৌমিনির কোন প্রতিক্রিয়া হবার কথা নয়।সে তো কাল রাতে কমলাকে দেখতেই
পায়নি। যা দেখেছে, তা শুধু অার্সিয়ানা । মাথার দিকে জানলার বিশাল পাল্লা
দুটো খোলা। হু হু করে হাওয়া বইছে শালবনের মধ্যে দিয়ে।
দুপুরবেলায় দুজন দেহাতি মহিলা মাদুর বিক্রি করতে এল। এখানে গরমকালে এগুলোর
খুব চাহিদা। দামও কম। রকমারি সব সেলাই ও বুনন। কমলা, বজ্র আর অমিতাংশুবাবু
একতলার সামনের বারান্দায় বসে মাদুর পছন্দ করছে। অার্সিয়ানা সৌমিনিকে নিয়ে
নীচে নেমে এল। হাওয়ায় কেমন যেন আতরের গন্ধ নাকে লাগল আর্সিয়ানার।
সৌমিনি এখন অনেক স্বাভাবিক।কিন্তু আজ রাতে আবার কি ঘটে সেটা চিন্তা ক’রে আর্সিয়ানার মতো মেয়েরও গা সিরসির করে উঠল। মোবাইলে তো এখনও থানার অফিসারের
সঙ্গে একবারও কথা বলা গেল না। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাদুর কেনা বেচা
দেখতে দেখতে থানার ও সি-কে একটা টেক্সট মেসেজ করল — আজ রাতে তার সাহায্যের
দরকার হতে পারে। দু মিনিটের মধ্যে উত্তর এল— ওকে, জাস্ট গিভ মি আ মিস কল।
টেক কেয়ার। এক চান্সেই কানেকশান হল। অথচ ভয়েস কানেকশান কিছুতেই হচ্ছিল না।
নেটওয়ার্কের এত প্রবলেম যে বলার নয়। কিন্তু আর্সিয়ানার অনুসন্ধিৎসু মনে
সবসময়ে সন্দেহের কাঁটা লটকেই থাকে। তার মনে হতে লাগল, কে যেন মোবাইল
যোগাযোগে বাধা দিচ্ছিল। আর ওই ঘর্ঘর আওয়াজ .... ওটা কি যান্ত্রিক গন্ডগোল ,
নাকি .....! আবোলতাবোল চিন্তা আসছে আর্সিয়ানার মাথায়। সে ঠি ক করে ফেলে
অাজ রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে কালকেই সৌমিনিকে নিয়ে কলকাতায় রওয়ানা দেবে। তারপর
দরকার হলে সে আবার একা ফিরে আসবে এখানে। রহস্যটা তো উন্মোচন করতেই হবে।
কাল রাতের সেই সাঙ্ঘাতিক দৃশ্যটা মনে করে অার্সিয়ানার মতো ডাকাবুকো মেয়েও
মনে মনে একটু যেন কেঁপে গেল। পেরিফেরাল হ্যালুসিনেশান ? কে জানে, হবে হয়তো ।
কিন্তু সৌমিনি তাহলে ট্রমাটাইজড হল কেন ? বড্ড ধাঁধার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে
গোটা ব্যাপারটা।
মাদুর বাছাবাছি চলছে বারান্দায়।টমি বারান্দায় উঠে এল। কমলার একদম কাছ ঘেঁসে
বসল।বসেই রইল। সেই একইরকম জিভ হ্যালহ্যাল করছে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে কমলার
দিকে তাকাচ্ছে। আর্সিয়ানার মনে হল, কেমন যেন আসঙ্গলিপ্সু ধরণ। কমলার অবশ্য
কোন হেলদোল নেই। সে মাদুরওয়ালিদের সঙ্গে দেহাতি ভাষায় নানা গল্পগাছায়
ব্যস্ত।
অমিতাংশুবাবু আর্সিয়ানাকে বললেন, ‘ বিকেলে আপনারা লাট্টু পাহাড়ে ঘুরে
আসতে পারেন। ভাল লাগবে। সঙ্গে কমলা আর বজ্রও যাবে। আরও দুএকদিন থাকলে হলদি
ঝর্ণা দেখে আসতে পারতেন। খুব ভাল পিকনিক স্পট।যাক, পরে আবার কখনও এলে..... ‘
কমলাও বলল, ‘ হাঁ দিদি চলেন, বিকেল বেলা ওখান থেকে সানসেট দেখবেন ....খুব সুন্দর ।’
সকাল গড়িয়ে চলল দুপুরবেলার দিকে। মাদুরওয়ালিরা গা তুলল। কমলাও কোমরে আঁচল
জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। এখানে রান্নাঘরগুলো খানিক তফাতে। ওই কুয়োতলার
পাশে। টমিও একেবারে কমলার গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটতে লাগল রান্নাঘরের দিকে।
কমলাকে যেন কাছছাড়া করতেই চাইছে না। আর হ্যাঁ, বজ্রকে ধারে কাছে কোথাও
দেখা যাচ্ছে না। ওই যে আমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিল। ধোঁয়া বেরোতে
দেখল।ওটা কি বজ্র তবে ? সেটাও কি তবে ভিসানারি অ্যাবারেশান ! আর্সিয়ানার
মাথায় বিদ্যুতের মতো চিড়িক দিয়ে উঠল একটা ভাবনা। তবে কি ......
কিন্তু টমি তার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকে কেন ? ওর কি কিছু বক্তব্য আছে আর্সিয়ানার কাছে ?
আর্সিয়ানা ঠিক করে নেয়, আজ রাত্রেই ফয়সালা করতে হবে।
বিকেলবেলা মনোরম বাসন্তী আবহে ভরে আছে। আর্সিয়ানা আর সৌমিনি কমলাকে সঙ্গে
নিয়ে লাট্টু পাহাড়ের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। এটা কিছুই না, একটা ছোট টি লা।
শীতকালে অনেক টুরিস্ট আসে শিমূলতলায়। এখন একদম ফাঁকা। নির্জন বিকেলে পড়ে
আছে আশপাশ। তিনজনে মিলে উঠতে লাগল টি লার ওপর দিকে। অার্সিয়ানা দেখল বজ্রও
যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে।কমলা ঘুরে নীচের দিকে তাকিয়ে কি দেখছে। আর্সিয়ানা
দেখল নীচের থেকে তীরবেগে ওপরে দৌড়ে আসছে টমি। এসে কমলার চারপাশে একবার
ঘুরপাক খেয়ে নিল। তারপর তাদের সঙ্গে
টি লার ওপরে উঠতে লাগল। আর্সিয়ানা ভাবল, কুকুররা খুব ফেথফুল হয়।কমলা টমিকে
খেতে দেয়। তাই বোধহয় কমলার সঙ্গে এত দোস্তি। বজ্র তাদের সঙ্গেই হাঁটছিল।
টমি আসার পর অনেকটা তফাৎ হয়ে গেল। ও নিশ্চয়ই কুকুরটাকে তেমন পছন্দ করে না।
এখন অফ সিজন। লাট্টু পাহাড়ে একটাও টুরিস্ট নেই। টিলার ওপর থেকে অনেক দূর
পর্যন্ত দেখা যায়।ঝোপঝাড়, পাথুরে মালভূমি, আবছা জনপদ নীরব ক্যানভাসের মতো
এলিয়ে আছে। সন্ধে নেমে আসছে। পড়ন্ত আলোয় শত শত নীড়ে ফেরা পাখির কাকলিতে
মুখর হতে লাগল চারপাশ। বজ্র বলল, ‘ ওই দেখুন ম্যাডাম .... ওইদিকে স্টেশান
আছে।’ তারপর উল্টোদিকে ঘুরে বলল, ‘ ....আর ও..ই দিকে হলদি ঝর্ণা .... এখান
থেকে খরিফ ছ কিলোমিটার হবে। ওই যে.... অনেক পেড় দেখা যাচ্ছে। ওটা একটা
টুরিস্ট স্পট। কুছ দিন পহলে ওখানে নাকি অচানক শের দেখা গিয়েছিল।’
— সৌমিনি প্রবল উৎসাহে বলে, ‘ তাই নাকি ! ইশশ্ হাতে টাইম থাকলে যাওয়া যেত .....’
আর্সিয়ানা সৌমিনির পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয় , ‘ কাম অন ডিয়ার, ডোন্ট ওয়ারি...... আবার আসব , চিন্তা নেই...’
বজ্রও সায় দেয়, ‘ হাঁ ম্যাডাম, জরুর আসবেন।’
এই সময়ে টমি বজ্রের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রচন্ড গর্জন করতে লাগল। কমলা চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে । মোটেই থামাবার চেষ্টা করছে না কুকুরটাকে। বজ্র আবার তফাতে
সরে গেল। পুঁচকে পাহাড়টার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। আলো আরও মরে এসেছে। বিহঙ্গের
কলকাকলিতে তিরতির করছে গোধূলি । কমলা একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ ওই ওদিকে,
অনেক দূরে যেখানে ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে ওইখানে আমাদের গাঁও ছিল।’
আর্সিয়ানা কমলার দিকে তাকিয়ে থাকে । বলে, ‘ কেন, এখন আর নেই ? আর যাও না
ওখানে ?’ কমলা তার গাঁওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বলল, ‘ হাঁ, গাঁও
তো জরুর আছে, মগর আমি তো আর নেই .....’ কমলা আনমনে উদাস দৃষ্টি মেলে ওই
দূর গাঁওয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর্সিয়ানার মাথায় চিড়িক দিয়ে উঠল একটা
ভাবনা। সে কমলার দিকে ঘুরে বলল, ‘ তার মানে ?’ টমি দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
আছে। একটানা লেজ নাড়াতে নাড়াতে একবার এর মুখের দিকে আর একবার ওর মুখের
দিকে তাকাচ্ছে।যেন সব কথাই বুঝতে পারছে। কমলা কোন উত্তর দিল না। অানমনে
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নীচের ওই দূর গাঁয়ের দিকে।কোন ঘোরে যেন ডুবে আছে।এ
জগতে নেই। আর্সিয়ানার চোখে পড়ল টমিও কমলার পাশে দাঁড়িয়ে ওই দূরের ঘরবাড়ি
ক্ষেতখামারের দিকে তাকিয়ে আছে উন্মুখ হয়ে।ওই গাঁ যেন ওরও খুব চেনা।
পকেট থেকে মোবাইল বার করে ফের একটা টেক্সট করে ফাঁড়ির
ও সি-কে — ‘ প্লিজ মেক শিওর টু স্টে ক্লোজ বাই আফটার ইভনিং ....’। জবাব এল
তক্ষুণি , ‘ ওকে ....ডোন্ট ওয়রি । জাস্ট গিভ আ মিস কল। স্টে সেফ।’
একসময়ে সন্ধে নেমে আসে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অার্সিয়ানা আর সৌমিনি
দূর পাহাড়ের আড়ালে লাল আবির ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাওয়ার ছবি দেখছিল। একদম
ছবির মতো দৃশ্য। কমলাকে দেখা গেল একটা ঝাঁটা আর ঝুড়ি নিয়ে বাড়ির সামনের
শুকনো পাতা পরিষ্কার করছে। মেয়েটা সবসময়ে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত।
অমিতাংশুবাবু কোথায় বেরিয়ে গেলেন। বোধহয় এখান থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে এক
উকিল বন্ধুর বাড়ি গেলেন আড্ডা মারতে। অার্সিয়ানার মনে হল, এই অমিতাংশুবাবু
মানুষটিও বেশ সন্দেহজনক চরিত্র। বেশ দুর্বোধ্য ধরণের। সারাদিন কোথায় যে
থাকেন বোঝা গেল না। কাল রাতে ওরকম অদ্ভুত ঘটনার পর ফোন করে কোন সাড়া পাওয়া
গেল না। অবাক কান্ড।
এখানে বিদ্যুতের ভোল্টেজ খুব কম। জোলো পানসে আলো।আর্সিয়ানাদের ঘরের দরজার
পাশের দেওয়ালে একটা অংশে প্লাস্টার খসে গিয়ে ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে পড়ে
দেয়ালের ওপর নগ্ন মানুষের আকার তৈরি হয়েছে। দরজার পাশে যেন দাঁড়িয়ে আছে
কার প্রতীক্ষায়। ভর সন্ধেবেলায় চোখে পড়লে গা ছমছম করে।
এর ঠিক পাশেই অমিতাংশুবাবুর ঘর। দরজা আধখোলা।আর্সিয়ানা বারান্দার এদিক
থেকে ওদিক ধীর পায়ে পায়চারি শুরু করল। পায়চারি করতে করতেই অমিতাংশুবাবুর
ঘরের ভেতর উঁকি দিল। ভেতরে অন্ধকার। যেটুকু দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে ঘরে
আসবাবপত্র খুব কম। সৌমিনির মোবাইলে থানার ও সি-র নম্বরটা সেভ করে দিয়ে বলল,
‘ শোন তুই এখানে দাঁড়া।কোন ভয় নেই। আমি একটু এ ঘরটায় ঢুকছি। যদি সাত
মিনিটের ভেতর না বেরিয়ে আসি এই নাম্বারে একটা মিসকল দিবি শুধু। এখানে
দাঁড়া। কোন ভয় নেই। কিচ্ছু হবে না।’ মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আর্সিয়ানা
অমিতাংশুর ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। দুদিকে দুটো বড় বড় জানলা। জানলার
পর্দাগুলো হাওয়ায় নাচানাচি করছে।একটা ঢাউস সাইজের ড্রেসিং টেবিল রয়েছে
একপাশে। আর একটা দুজন শোবার মতো খাট। খাটে একটা মশারি টানানো রয়েছে। চারপাশ
ওপর দিকে গোটানো। একটা টেবিলও রয়েছে মনে হচ্ছে খাটের মাথার দিকে। আর্সিয়ানা ঘরের চারদিকে আলো ফেলতে লাগল। একটা দেয়াল আলমারি রয়েছে
দক্ষিণদিকের জানলার পাশে। জানলার একটা পাল্লা খোলা ।
আর্সিয়ানা ঘরের চারদিকে মোবাইলের আলো ঘোরাতে লাগল। ঘরের সিলিং-এ একটা
পুরনো ঝুলমাখা পাখা ঝুলছে। অার্সিয়ানা দেখতে পেল সিলিং ফ্যান থেকে একটা
মোটা নাইলনের দড়ি ঝুলছে। ঘরে কোন জামাকাপড়, তোয়ালে, চিরুনি বা অন্য কোন
সরঞ্জাম দেখা গেল না। আর্সিয়ানা দেয়াল আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। পাল্লাটা
খুলে ফেলল। ভেতরটা একদম ফাঁকা।পাল্লা খুলতেই ভেতর থেকে যেন একটা মিস্টি
আতরের গন্ধ মাখা দমকা হাওয়া এক ঝটকায় বেরিয়ে এসে আর্সিয়ানাকে ঝাপটা মারল।
সাত মিনিট পুরো হবার আগেই অার্সিয়ানা বেরিয়ে এল। সৌমিনি যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল ।
আর্সিয়ানা সৌমিনিকে বলল, ‘চল ঘরে যাই। প্যাক আপ করে রাখতে হবে । আজ রাতেই
হয়ত এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। হ্যাঁ, আজ রাতে আর ঘরে শোব না কিন্তু।
বারান্দাতেই বসব।’
— ‘ কেন ? ঘরে কোন ডেঞ্জার আছে ?’ খুব স্বাভাবিকভাবে সৌমিনি জিজ্ঞেস করে।যেন আগে থেকেই জানা ছিল কথাটা ।
— ‘ কিছু জানি না। তবে সাবধানের মার নেই। তাছাড়া তোকে এখানে নিয়ে এসেছি।আমার একটা দায়িত্ব তো আছে...’
— ‘ কেন আমি কি ভয় পেয়েছি ? আমি কি একবারও কিছু বলেছি ?
আমি চাই মিস্ট্রিটা আনভেইলড হোক।’ সৌমিনি একটু যেন অভিমানী।
আর্সিয়ানা অবশ্য ড্যামেজ কন্ট্রোল করে নেয়— ‘ ও... কাম অন মাই চাম ....
আমি কি একবারও সে কথা বলেছি ? আমি কি জানিনা তুই কি .... কাম অন।’ আর্সিয়ানা সৌমিনির অভিমান ভাঙাতে থাকে।
এইসময়ে দেখা গেল অমিতাংশু তার সান্ধ্যভ্রমণ সেরে গেট খুলে ভেতরে ঢুকছেন। অালো আরো ধূসর হয়ে গেছে এতক্ষণে। নীরব পরিবেশ।
খাবার টেবিলে আর্সিয়ানাদের সঙ্গে অমিতাংশুবাবুও খেতে বসলেন।বজ্রও একপাশে
এসে খেতে বসল। কমলা যথারীতি পরিবেশন করছে। টমি নাছোড়বান্দার মতো কমলার
সঙ্গে লেগে আছে। এক মুহুর্ত কমলাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না। আর্সিয়ানা খুব
মন দিয়ে ঘরের সবাইকে লক্ষ্য করতে লাগল। মাঝে মাঝে একবার অমিতাংশুর দিকে,
একবার বজ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে । চোখে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি। ওদের যেন
সামনাসামনি লড়াইয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। কেমন যেন জিঘাংসাভরা চাউনি। আর্সিয়ানার দিকে মেলে ধরা সেই প্রার্থনার দৃষ্টি আদৌ নয়।
পরিবেশন করা হয়েছে রুটি আর মুরগীর মাংস কষা। আর্সিয়ানার খাওয়ায় মন নেই। সে
একবার বজ্রের দিকে, একবার অমিতাংশুবাবুর দিকে গভীর মনোযোগে দেখতে লাগল।
দেখল দুজন দুজনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খাবার পড়ে আছে সামনে।
কেউ ছুঁয়েও দেখছে না। দুজনের চোখের তারায় যেন আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে
এক্ষুণি একজন আর একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুজনকেই সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক
লাগছে । কমলা এখানে নেই। বোধহয় রান্নাঘরে কিছু করছে । টমি হঠাৎ প্রচন্ড
আওয়াজে ডাকতে আরম্ভ করল। তার শান্ত চোখ থেকেও যেন আগুন ছিটকোচ্ছে। সৌমিনি
ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে আর্সিয়ানার হাতটা জড়িয়ে ধরল। আর্সিয়ানা কোনদিন এমন
সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। তার সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে । তবে সে একেবারে ভিন্ন
উপাদানে গড়া বলেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারল। টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইলে ঝট
করে ও সি-র নম্বরটা ছুঁয়ে দিল। চারপাশে এখন ছেয়ে আছে আমাবস্যার নিকষ কালো
আঁধার। মুহুর্তের মধ্যে ছাতিমতলার সব আলো ঝপ করে নিভে গেল। কেন কে জানে !
টমি উন্মত্তের মতো চেঁচাতে লাগল। একটা ছায়া অমিতাংশুর টেবিল থেকে উঠে এসে আর্সিয়ানাকে জড়িয়ে ধরল। তীব্র আতরের গন্ধে ভরে গেল জায়গাটা । রিভলবারটা আর্সিয়ানার পকেটের মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে ।
দুমিনিটের মধ্যে অন্ধকার ভাঙা হেডলাইটের আলো জ্বলা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল ছাতিমতলার ভাঙাচোরা লোহার গেটের সামনে।
থানার ও সি সুদীপ্ত সেন প্রবাসী বাঙালী। জোরালো টর্চ জ্বেলে পাঁচজন
কনস্টেবলসহ ছাতিমতলা বাংলোর রান্নাঘর থেকে অার্সিয়ানা আর সৌমিনির অচেতন দেহ
যখন উদ্ধার করলেন ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা বাজে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে দু
একটা নিভন্ত অাঁচের আলো জ্বলছে। ছড়ানো খামারে থেকে থেকে দমকা হাওয়া বইছে
গাছগুলোর ডালপালার মধ্যে দিয়ে।
********* ******* *********
আর্সিয়ানার যখন ঘুম ভাঙল, পুলিশ গেস্টহাউসের দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকে
আসছে আসছে বসন্তের হাওয়া মাখানো রোদ্দুর। এক ডাক্তারবাবু আর্সিয়ানার
বিছানার পাশে বসে তার হাতে ব্লাডপ্রেসার মেশিনের প্যাড বাঁধছেন। সৌমিনির
এখনও ঘুম ভাঙেনি।
সুদীপ্ত সেনের বছর বত্রিশ বয়েস। সুঠাম দীর্ঘ শরীর। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ হাই, গুড মর্নিং ম্যাডাম।’
আর্সিয়ানা ধড়মড় করে উঠে বসে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টিতে সুদীপ্তর দিকে
তাকিয়ে থাকে, যার মানে হল— এটা কি হল !! তারপর রিভলবারের খোঁজে পকেটে হাত
দেয় অভ্যাসবশত: । সুদীপ্ত উত্তমকুমারি স্টাইলে হেসে বলে, ‘ ওটা আপাতত: আমার
জিম্মায় আছে।একটু পরেই ফেরত পাবেন। আর এই নিন আপনার মোবাইল। আর এটা বোধহয়
ওই ম্যাডামের।
সৌমিনির এতক্ষণে ঘোর কেটেছে। পিটপিট করে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে তার পরম
ভরসা আর্সিয়ানার দিকে। ডাক্তারবাবু তার যন্ত্রপাতি গোটাতে গোটাতে বললেন বি
পি বিলকুল নর্মাল, একশো চল্লিশ বাই আশি। কোন মেডিসিন প্রেসক্রাইব করলাম
না।বলে, তিনি সৌমিনির বিছানার দিকে এগোলেন।
প্রায় ঘন্টা দুই বাদে সুদীপ্ত সেন বলল, ‘ শৌভিক আমার স্কুল লাইফের বন্ধু
ছিল। খুব ক্লোজ। ও আমাকে ফোন করে আপনার এখানে আসার কথা বলেছিল।আপনার ফোন
নাম্বারও আমাকে দিয়েছিল। কিন্তু আপনি যে ছাতিমতলা বাংলোয় উঠেছেন সেটা আমি
একদমই জানতাম না। জানলে , আমি প্রথমেই আপনাকে অ্যালার্ট করতাম।’
— ‘কেন তার কারনটা কি ?’
— ‘ কারণ আপনি দেহধারি মানুষের সঙ্গে হয়ত টক্কর নিতে সক্ষম। অশরীরিদের সঙ্গে তো নয়......’
— ‘ তার মানে ? আর্সিয়ানার ভুরু কুঁচকে যায়। তারপর বলে ,’ হ্যাঁ, ওই
টমি বলে কুকুরটা.....আই ওয়াজ হ্যাভিং আ স্ট্রঙ্গ হানচ অ্যাবাউট ইট......
বাট....
— ‘ না না বাট টাট কিছু নেই। ওখানে কারোরই শরীর নেই। অর্থাৎ বেশ কিছুকাল আগেই সকলে পরলোকগত।’
শুনে সৌমিনির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।সে একদৃষ্টে কোন কথা না বলে সুদীপ্তর
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর্সিয়ানার ভুরু আবার একবার কুঁচকে ওঠে।
— ‘ আমার কাছে ছাতিমতলার পুরো কেস হিস্ট্রি আছে।এটা আসলে দুই সেক্স
ম্যানিয়াকের গল্প। দুজনেরই সেক্সুয়াল টার্গেট ছিল কমলা। অবশ্য কমলাও কিছু
কম যায়না। সে দুজনেরই তৃপ্তি মিটিয়ে চলছিল। অমিতাংশুবাবুকে শরীর দিচ্ছিল
টাকার ধান্দায় আর বজ্রের কাছে যেত নিজেরও ক্ষুধা মেটানোর জন্য।
অমিতাংশুবাবু আর বজ্র। ভূত হয়েও এরা নারী শরীরের নেশা ছাড়তে পারেনি ।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, যৌনতা মেটাবার জন্য এরা কমলার শরীরে ঢোকে।ইরোটিক
অ্যাবারেশান যে কত রকমের হয় ! অশরীরিদেরও অতৃপ্ত কামনা বাসনা থাকে। তারই
পরিণতি হল পরশু রাত্রে সৌমিনি ম্যাডামের ওপর অ্যাটাক। এই দুই করাতের মাঝে
পড়ে বেচারা ঝগরুকে জান দিতে হল। কে বা কারা গলার নলি কেটে মার্ডার করে,
তারপর বাগানের আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কে মেরেছিল সেই ইনভেস্টিগেশান
এখনও চলছে। আপনার ওই টমি কুকুরটা হল ঝগরু। এখনও কমলাকে আগলে চলেছে দুই
কামুকের গ্রাস থেকে। বেচারা কমলাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভাল বাসত। একফুল দো
মালির গল্পে প্রায়ই এক মালিকে প্রাণ দিতে হয়। কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা ছোট্ট
ডোবা মত আছে, তার জলে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল বজ্র । অমিতাংশুবাবু স্লিপিং
পিল খেয়ে আর কমলা অমিতাংশুর ঘরেই সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে
পৃথিবী থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। কারণ, আমি যা বুঝেছি দুজনেই প্রচন্ড
মেন্টাল স্ট্রেস অ্যান্ড গিল্ট কনসেন্সের শিকার হয়ে পড়েছিল।ওই যে কথায় বলে
না পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অবশ্য মৃত্যুর কারণগুলো আমার ব্যক্তিগত ধারণা এবং
অনুমান। জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশান ইজ স্টীল অন। ব্যাস ম্যাডাম, আমার কথাটি
ফুরলো......এবার একটু ফ্রেশ হয়ে নিন।তারপর ব্রেকফাস্ট করবেন। এ দুদিন তো
ভূতের হাতে দিব্যি খাওয়াদাওয়া করে এলেন।’
—-‘ আরে ... দাঁড়ান দাঁড়ান, কি সব বলছেন..... এই তো কাল দুপুরে দুজন মহিলা মাদুর বিক্রি করতে এসেছিল......’
— ‘ ইয়েস ইয়েস... বুঝতে পেরেছি.... ‘ আর্সিয়ানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে
সুদীপ্ত , ‘ ওরা যে রক্তমাংসের মানুষ সে কথা কে বলল আপনাকে ?’
— ‘ তার মানে ! ! ‘
— ‘ মানেটা নিজেই বুঝে নিন ....’
অার্সিয়ানার ভুরু আবার কুঁচকে উঠল। সৌমিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। দুজনেরই
শিরদাঁড়া বেয়ে কোন হিমশীতল সরীসৃপ সিরসির করে নামতে লাগল পরশু রাতের কথা
মনে করে। কপালে ঘাম দেখা দিল দুজনেরই।
সুদীপ্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ না:, আপনারা রেস্ট করুন। আধঘন্টা পরে
ব্রেকফাস্ট লাগাচ্ছি। আর হ্যাঁ , আপনাদের ট্রেন পাঁচটা তেত্রিশে।আমি গিয়ে
আপনাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব।ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যান বাবা । আমি হাঁফ
ছেড়ে বাঁচি। আর হ্যাঁ, আপনারা নিশ্চই ভাবছেন, আমি ছাতিমতলার এত কিস্যা
জানলাম কি করে । এসব কথা তো পুলিশ ফাইলের কেস হিস্ট্রিতে থাকার কথা নয়।’
আর্সিয়ানার কানে কিছুই ঢুকছিল না। মাথায় নানা চিন্তা ভোঁ ভোঁ করছে। সৌমিনি
পাশ বালিশ আঁকড়ে আবার শরীর ফেলে দিয়েছে বিছানায়। আর্সিয়ানা জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে সুদীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুদীপ্ত উত্তমকুমারি হাসি হেসে আবার বলে, ‘ সেকথা এখন থাক ম্যাডাম। ক্রমশ: প্রকাশ্য ... ‘
পরদিন ভোরে বাড়ি পৌঁছল অার্সিয়ানারা। সকাল এগারোটা নাগাদ শৌভিক
চ্যাটার্জীকে একটা কল দিল। শৌভিককে একবার ডায়ালেই পাওয়া গেল। হাই হ্যালোর
পর শিমূলতলা বৃত্তান্ত আগাগোড়া বর্ণনা করে। অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা পুরোটা
রুদ্ধশ্বাসে শোনার পর বলে ওঠে, ‘ দাঁড়াও দাঁড়াও ....কি বললে ? অামার
বন্ধু পুলিশ অফিসার সুদীপ্ত সেন ! ‘
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সুদীপ্ত সেন... রিয়েলি এ গ্রেট গায় । হি ওয়াজ, ইন ফ্যাক্ট,
আওয়ার সেভিয়ার দেয়ার । ও না থাকলে উই উড হ্যাভ বিন...... ‘ অার্সিয়ানা মুখর
হয়।
— ‘ আরে দু..ৎ , কি সব গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছ ! সুদীপ্ত তো এক্সপায়ার করে
গেছে মাস ছয়েক আগে কোন এক টেররিস্ট এনকাউন্টারে ওখানে কাছাকাছি কোন এলাকায়
..... ‘
— ‘ সেকি ! ....’ অার্সিয়ানা আকাশ থেকে পড়ে । ‘ ও তো বলল, তুমি ওকে কল করে
আমাদের টেক কেয়ার করার কথা বলেছিলে..... আর ওর মোবাইল নাম্বারটা তো তুমিই
আমাকে পাঠিয়েছিলে ......’
— ‘তাই নাকি ?’ শৌভিক সরস হয়। ‘ অার্সিয়ানা, এর থেকে প্রমাণ হল ভূতেরাও
শিভালরাস হয় .... হা: হা: হা: .... আমি সুদীপ্তর মোবাইল নাম্বার কোথায় পাব !
পাগল নাকি ! আর অমিতাংশুবাবুই তো আমাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন একজন
প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর অ্যারেঞ্জ করার জন্য। ওহ্ মাই গুডনেস.....কিছু ভূতের
, তার মানে , স্বভাব যায় না ম’লেও.....’
ফোন নামিয়ে রেখে আর্সিয়ানা সিদ্ধান্ত নিল ছাতিমতলায় তাকে আর একবার যেতেই
হবে । টমি কাম ঝগরুর প্রতি নিশ্চিতভাবেই তার একটা কর্ত্তব্য রয়ে গেছে।
( সমাপ্ত )
Anjan Banerjee