জেদ
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
প্রবালের রোগটা সারল না। সে এক অদ্ভুত
রোগ। রোগের নাম ' জেদ '। তিপ্পান্ন বছর বয়েস হল, প্রবালের জীবনের অনেক
কিছুই বদলালো কিন্তু জেদ থেকে গেছে অনড় হয়ে। যেমন ছিল ছ বছর বয়েসে, তেমনই
আছে তিপ্পান্নতে।
প্রবাল আমার ছোট্ট বয়েসের বন্ধু। ক্লাস ওয়ানে
দুজনে একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম সেন্ট সেবাস্টিন স্কুলে। স্কুলের প্রথম দিনেই
আমার ওয়াটার বটল দেখে 'ওটাই চাই' বলে এমন বায়না শুরু করল যে, ওর বাবা
একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। বাকি অভিভাবক যাঁরা ছাড়তে এসেছিলেন
বাচ্চাদের, তারা গা ঠেলাঠেলি করতে লাগলেন। ' কি বাচ্চারে বাবা, বাড়ির
শিক্ষা নেই মনে হয়। ' -- এমন সব কথা ঘুরতে লাগল আশেপাশে।
আমার কী
মনে হয়েছিল জানি না, আমারই মতো একটা ছেলেকে কেঁদে কেটে লালা হয়ে যেতে দেখে
নিজের ওয়াটার বটলটা এগিয়ে দিয়েছিলাম ওর দিকে। তাতে ওর কান্না থেমে গিয়ে
অনাবিল হাসিতে ভরে উঠেছিল মুখ। ওর বাবা প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে গেছিলেন। আমার
বাবাকে বলেছিলেন, ' এতটুকু ছেলের এমন স্যাক্রিফাইস আমি কোনোদিন দেখিনি।
অত্যন্ত ভালো ছেলে আপনার। ' আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, '
তোমার নাম কী?'
' সপ্তক। '
' তুমি খুব ভালো ছেলে। গড ব্লেস ইউ মাই বয়।'
পরের
দিন একদম একরকম দেখতে একটা নতুন ওয়াটার বটল কিনে আমাকে দিয়েছিলেন প্রবালের
বাবা। সেই থেকে আমার আর প্রবালের বন্ধুত্ব। প্রবাল খুব ভালো স্টুডেন্ট
ছিল। পড়াশোনায় ভালো, স্পোর্টসে ভালো, এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতেও
খুব ইন্টারেস্ট ছিল প্রবালের। স্কুল ম্যাগাজিনে নিয়মিত পার্টিসিপেট করত ও।
কেজি লেভেলে ছবি আঁকত, ক্লাস ফোর-ফাইভে ছড়া লিখত। তারপর তো রীতিমতো গল্প
লিখতে শুরু করেছিল। সেটা মনে হয়, ক্লাস নাইন ফাইন হবে। সবাই প্রশংসা করত
কিন্তু শেষ করত ' সবই ভালো কেবল ওই মাথার গোলমালটুকু ছাড়া ' বলে।
প্রবাল
আমাকেও খুব উৎসাহ দিত। ' সপ্তক, এবারের স্কুলের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে তুই
গান করবি। করবিই। বুঝেছিস? কি ভালো কাজী নজরুলের গান গাস তুই। আমি তোর নাম
দিয়ে দেব।'
না বলার উপায় থাকত না। কারণ ওর জেদ। জেদ চাপলে এমন করতে
শুরু করত যে হুলুস্থুল কান্ড বেধে যেত স্কুলে। স্কুলের বেশিরভাগ ছেলেই
ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করত। ইচ্ছে করে ওকে খোঁচাত। উত্তেজিত করার
ফন্দি করত। আমি আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। যখন ওর জেদ চাপত তখন এমন লাল হয়ে
একই কথা বারবার বলত যে, আমার ভয় তো লাগতই আবার মায়াও লাগত।
ছোট
বয়েসে জেদ করাটা তবুও মানায় কিন্তু বড় হয়ে গেলে মনে হয় যেন ইচ্ছে করে এরকম
করছে। বেশির ভাগ মানুষই রেগে যেত প্রবালের কান্ড দেখে কারণ চেহারায় বেড়ে
গেলেও জেদ তার জায়গাতেই থেকে গেছিল।
প্রবালের বাবার ধারণা হয়েছিল,
জেদ ব্যাপারটা ওর একটা অসুখ আর তার ওষুধ এই আমি। তাই, ক্ষণে অক্ষণে আমার
ডাক পড়ত কখনো প্রবালদের বাড়িতে তো কখনো রাস্তাঘাটে।
কতশত যে এমন মাথামুন্ডুহীন জেদের ঘটনা ঘটেছে তার সবকটা এখন আর মনে নেই। দু একটা স্মৃতিতে গেঁথে আছে। যেমন ট্রামে চড়ার একটা ঘটনা।
তখন
আমরা সম্ভবত ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলছে। প্রবালের
খ্যাপামো যদি কোনো কারণে শুরু হয় সেই ভয়ে পরীক্ষার সময়ে ওর বাবা ওকে স্কুলে
দিয়ে এবং নিয়ে যেতেন।
সেদিন পরীক্ষা শেষে বাবার সঙ্গে রাস্তা পার
হবে বলে দাঁড়িয়ে ছিল প্রবাল। একটা ট্রাম আসছে দেখে ওর জেদ চাপল সেটায় উঠবে।
মেসোমশাই বোঝালেন ওটা উল্টোদিকের ট্রাম, ওতে উঠলে বাড়ির বিপরীতে চলে যেতে
হবে। কিন্তু তখন প্রবাল আর নিজের মধ্যে নেই। প্রবল হয়ে উঠেছে ওর জেদ।
মেসোমশাইয়ের হাত ছাড়িয়ে প্রায় ছুটে যায় ট্রামে উঠবে বলে। রাস্তায় দাঁড়ানো
লোকজন হই হই করে ওঠে ' গেলো গেলো ' করে। উপায় না দেখে সেই ট্রামে ওকে নিয়ে
উঠতে বাধ্য হন ওর বাবা।
অফিস ছুটির জ্যামে পড়ে সেদিন বাড়ি ফিরতে বেশ
দেরি হয়েছিল প্রবালদের। পরের দিনের পরীক্ষার রিভিশন ঠিকমতো করে আসতে
পারেনি ও। টেনশন করছিল তাই। আমি বললাম, ' তুই তো জিনিয়াস। রিভাইস না করলেও
তুইই হায়েস্ট পাবি। ' আমার কথা শুনে খুশি হল প্রবাল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, '
তুই আমার একমাত্র ভালো বন্ধু। বেস্ট ফ্রেন্ড! আমরা সারা জীবন বন্ধু থাকব।
থাকবি তো আমার বন্ধু?'
' একদম। ইয়ে দোস্তি হাম নহি তোড়েঙ্গে...। '
হোহো করে হেসে উঠলাম দুজনেই।
অদ্ভুত
ভাবে, একই কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি আমরা। যদিও আমার ইচ্ছে ছিল
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কিন্তু কিছু অসুবিধের কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। চাকরির
ব্যাপারে অবশ্য দুজন দুই কোম্পানিতে কাজ পেলাম। কিন্তু অফিস হল একই পাড়ায়।
এসপ্ল্যানেড। ফলে আসা যাওয়া একই সঙ্গে করতাম আমরা।
আর একটা
মারাত্মক ঘটনার কথা ভুলতে পারি না আমি। দু বাড়ি থেকেই তখন আমাদের বিয়ের
কথাবার্তা চলছে। পুলক জাগছে আমার অন্দরেও। প্রবালের এ বিষয়ে তেমন কোনো
উৎসাহ দেখতাম না। আমার একটা সম্বন্ধ প্রায় পাকা হবার মুখে। বাবা, মা, বোনের
পছন্দ হয়েছে। এবার আমার পালা।
যেদিন দেখতে যাব সেদিন কি মনে হতে
প্রবালকে বললাম সঙ্গে যেতে। বাড়ির সবাই ভীষণ রাগ করল। যে ছেলের যখন তখন জেদ
চাপে, তাকে নিয়ে এরকম জায়গায় কেউ যায়! আমারও তখন টেনশন হতে শুরু করল। কেন
যে বলতে গেলাম। এখন আর মানা করতে পারব না। যা থাকে কপালে বলে বেরিয়ে পড়লাম
প্রবালকে নিয়ে।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। বুঝে গেছেন তো ঘটনাটা কী ঘটেছিল। আমাদের বাড়ির পছন্দ করা পাত্রীকে ও বিয়ে করবে বলে জেদ ধরে বসল।
না,
ব্যাপারটা তা ঘটেনি। জেদ প্রবাল ধরেছিল ঠিকই। সে মারাত্মক অবস্থা। পাত্রীর
বাড়ির লোক তো এই অ্যাম্বুলেন্স ডাকে তো সেই পাগলাগারদে নিয়ে যাবার গাড়ি
ডাকে আর কি! শেষে অনেক কষ্টে আমিই ব্যাপারটা সামলাই এবং প্রবালকে ওখান থেকে
বের করে আনি। ওর বক্তব্য ছিল, ' এই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি না, ব্যাস। ' কী
কারণে এই জেদ, ঈশ্বর জানলেও জানতে পারেন, প্রবালের সঙ্গে সে বিষয়ে কোনো
কথা পরে হয়নি।
পাত্রীর বাড়িতে এমন কান্ড ঘটাতে তারা বিয়েতে পিছিয়ে
গেলো। যদিও আমার এখানে কোনো দোষই ছিল না একমাত্র ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া
ছাড়া। কিন্তু ওদের হয়তো সেটাতেই মনে হয়েছে যে, আমিও সম্পূর্ণ সুস্থ নই।
নাহলে জানা সত্বেও এরকম বন্ধুকে কেউ নিয়ে যায়!
এই ঘটনার বছরখানেক
বাদে আমার বিয়ে হয়। প্রথম প্রথম আগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে প্রবালের বাড়ির
লোক ওর বিয়ে দিতে সাহস পায় না। প্রবালও খুব যে একটা আগ্রহ প্রকাশ করত বিয়ের
ব্যাপারে, তাও নয়। ও অবিবাহিতই থেকে গেলো।
আমার স্ত্রী রত্নাকে
আমি বিস্তারিত বলে রাখাতে প্রবাল সম্পর্কে ও সতর্ক থাকত। মাঝেমধ্যেই চলে
আসত প্রবাল, জমিয়ে আড্ডা দিতাম আমরা। বার দুয়েক প্রবালের প্রবল জেদের
সম্মুখীন হয়েছে রত্না। একবার তো ফুলদানিতে রাখা গ্ল্যাডিওলা ফুল রত্নার
খোঁপাতে গোঁজার জেদ চাপলো ওর। সে কি বিপদ!
রত্নাই শেষে সামলালো
ব্যাপারটা। একটা স্টিক বের করে কাঁচি দিয়ে ডান্ডি ছোট করে খোঁপায় গুঁজে এসে
দাঁড়াল। তাই দেখে জোঁকের গায়ে নুন পড়ার মতো গুটিয়ে গেল প্রবাল। এই
মধ্যবয়েসে আবারও একবার ওর জন্য মায়া লাগলো আমার। এটা হয়তো সত্যিই একটা
অসুখ। নাহলে এতদিনে ঠিক হয়ে যেত। জীবনটাই অন্যরকম হয়ে গেলো ছেলেটার।
একসময়
অনেক ডাক্তার দেখিয়েছিলেন প্রবালের বাবা। কিন্তু জেদ সামলানোর ওষুধ কেউ
দিতে পারেনি। নার্ভ ঠান্ডা করার ওষুধ দিয়েছিল কেউ একজন। সেই ওষুধ খেয়ে
সারাদিন ঘুমতো প্রবাল। আসলে, জেদ তো ওর সবসময়ের সঙ্গী ছিল না, কখনো সখনো
চাপত। সমাধান কিছু হয়নি তাই।
কেটে যাচ্ছিল দিন ভালো-মন্দ মিশিয়ে।
হাফ সেঞ্চুরি পার করলাম আমি আর প্রবাল। মাস তিনেকের ছোট-বড় ছিলাম আমরা।
রত্না বলল, ' প্রবালদাকে ডাকো বাড়িতে। আমি মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন রেজালা
বানাচ্ছি, পঞ্চাশে পেরনোর সেলিব্রেশন হোক।' হইহই করে কাটলো সেই সন্ধেটা
যদিও সেদিন আমাদের কারুরই জন্মদিন ছিল না।
এরপর কেটে গেছে আরো
তিনটে বছর। এক সকালে ফোন এলো প্রবালের বাড়ি থেকে, প্রবাল গুরুতর অসুস্থ হয়ে
হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বেড নং ইত্যাদি জেনে বিকেলে অফিসের পর গেলাম
প্রবালকে দেখতে। নাকে অক্সিজেন মাস্ক, স্যালাইন চলছে, আরো নানান যন্ত্রপাতি
লাগানো দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এত বছরে শারিরীক ভাবে তেমন অসুস্থ হতে
দেখিনি ওকে।
আমাকে দেখে হাত নাড়ল। বেডের পাশে চেয়ার নিয়ে বসলাম।
মাস্কে মুখ ঢাকা থাকাতে কথা বিশেষ বলতে পারছিল না প্রবাল। তাছাড়া একটা
আচ্ছন্ন ভাবও ছিল। সিস্টারকে জিগ্যেস করে জানলাম সিওপিডি। রক্তে অক্সিজেনের
মাত্রা কমে গেছে আর কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে গেছে। সিস্টারকে
আমার ফোন নম্বর দিয়ে বললাম, ' প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবেন। '
পরের দিন
কাজের চাপে অফিস থেকে বেরতে দেরি হয়ে গেল বলে প্রবালকে দেখতে যেতে পারলাম
না। ভিসিটিং টাইম শেষ হয়ে গেছে। আগামীকাল যাবই ভেবে বাড়ি ফিরলাম। রত্না
গেছে ওর দিদির বাড়ি। এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফিরবে। ও থাকলে রোজই যেত প্রবালকে
দেখতে।
ঘুমের ভেতরে মনে হল মোবাইল বাজছে। হুঁশে ফিরে তড়িঘড়ি ফোন ধরলাম। অ্যাতো রাতে কার ফোন রে বাবা!
' হ্যালো? '
' আমি মিশন হসপিটাল থেকে বলছি। আপনি মিস্টার সপ্তক সোম বলছেন তো?'
' হুম।' হৃৎপিণ্ডের শব্দ কানে বাজছে। প্রবালের কিছু হলো নাকি?
'
স্যার, আপনাকে একবার আসতে হবে হাসপাতালে। মিস্টার দত্তকে সামলানো যাচ্ছে
না। আপনাকেই পাশে চাইছেন উনি। এত উত্তেজিত হয়ে পড়াতে সমস্ত প্যারামিটার
গোলমাল করছে। ডক্টর হাসান আপনাকে খবর দিতে বললেন। এই সময় আপনাকে বিরক্ত
করার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।
খানিক্ষণ সময় নিয়ে বললাম, ' ওকে, আসছি।'
বেডসাইড
টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে অন করে দেখলাম চারটে পঁচিশ। একটু পরেই ভোরের আলো
ফুটবে। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরব ঠিক করলাম। আধঘন্টা শুয়ে নিই। নিশ্চই
প্রবালের জেদ চেপেছে আবার। কিন্তু ওই অত যন্ত্র লাগানো চারদিকে, তার মধ্যে
কী এমন করছে যে ডাক্তার, সিস্টাররা মিলে সামলাতে পারছে না? আমাকে দেখলেই কী
শান্ত হবে? জেদের চাহিদা না মেটা পর্যন্ত তো থামে না দেখে আসছি এতকাল ধরে।
এই সব ভাবতে ভাবতে পাঁচটা বেজে গেলো। উঠে পড়লাম।
কেবিনের দরজা
ঠেলে ঢুকতেই থমকে গেলাম। ডাক্তার সিস্টার মিলিয়ে জনা পাঁচেক মানুষ ঘিরে
রয়েছে প্রবালকে। উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। একজন সিস্টার ঘুরে
আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, ' আপনি... মি. সোম তো? অ্যাতো দেরি করলেন কেন? উনি
তো পাগলের মতো আপনার খোঁজ করছিলেন। আসুন, এদিকে আসুন।
এগিয়ে গেলাম
প্রবালের বেডের দিকে। ছ নম্বর অনুভূতি জানান দিল, প্রবালের শেষ অবস্থা। চোখ
যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আমাকে দেখতে পেয়েই হঠাৎই চিৎকার করে উঠল, ' আমি
যাচ্ছি, তোকে নিয়ে যাব। ' তারপরেই কেমন নেতিয়ে পড়ল।
উপস্থিত সিসটারদের একজন বলল, সারাদিন এই কথাটাই বলে গেছেন উনি। ' সপ্তক আসছে, একসঙ্গেই গন্তব্যে যাব আমরা। '
.....................
Chumki Chatterjee
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি