ধারাবাহিক - মহাপ্রস্থানের পথে - -অয়ন দাস

 

ধারাবাহিক
 
 
 
 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস


 
|| ষষ্ঠ  পর্ব  ||

-৩০-

পাটনা থেকে দেরাদুন যাবার ফ্লাইটে বসেছিল শ্রীময়ী আর রাতুল। গতকাল মুকেশ কুমারের খুনের ব্যাপারে লোকাল থানার সাথে শ্রীময়ীর মধ্যস্থতায় কলকাতার পুলিশও জড়িয়ে গেছে। কারণ প্রফেসর নন্দীর হত্যা রহস্য আর মুকেশ কুমারের খুন, অনেকটা একই ছাঁচে মনে হওয়ায় দুটো তদন্ত আলাদা ভাবে না করে একসাথেই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গোটা ঘটনার মুখ্য ইনভেস্টিগেটিং অফিসার হিসেবে শ্রীময়ীকে নিযুক্ত করা হয়েছে। একটা খুন যে তাকে এতদূর এমন একটা জটিল রহস্যের সামনে এনে দাঁড় করাবে তাকে তা শ্রীময়ী স্বপ্নেও ভাবেনি।

দেরাদুন যাবার কারণ ডঃ বিধান শর্মার সাথে দেখা করা। ওখানেই ওঁর বসবাস। গতকাল রাতেই ওনার সাথে বিস্তারিত কথা হয়েছিলো এবং পুরো ঘটনা বলার পরই ওনাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে যাতে কোনোভাবেই অচেনা কারো সাথে অন্তঃত বারো ঘন্টা দেখা না করে। তার মধ্যেই শ্রীময়ীরা ওনার ওখানে পৌঁছে যাবে। তখন সবিস্তারে ওনাকে সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করা যাবে। আর তাছাড়া ওনার কাছ থেকেও বেশ কিছু তথ্য দরকার। তাই যতক্ষণ না শ্রীময়ী এবং রাতুল ডঃ শর্মার বাড়ি পৌঁছচ্ছে, ওনাকে একপ্রকার ঘরবন্দী থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

শ্রীময়ীর পাশেই রাতুল বসে রয়েছে। আসনটাকে আনত করে মাথাটা একটু পিছনে হেলিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়লো নাকি! সত্যি ও যে কি করে জড়িয়ে পড়লো এর মধ্যে সেটাই ভাবছিলো শ্রীময়ী। একটা সময় ওদের মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠতে গিয়েও মাঝপথে কোথায় যেন একটা তাল কেটে গিয়েছিলো, সেই আজ তার সাথে এতটা ওতপ্রোতভাবে এই তদন্তে জড়িয়ে সাহায্য করছে। এই কেসে যদি শ্রীময়ী একটুও এগিয়ে থাকে তাহলে সেখানে অনেকাংশেই রাতুলের একটা কৃতিত্ব রয়েছে।

আলতো করে ওর মাথায় হাত ছোঁয়ায় শ্রীময়ী। রাতুলের চুল গুলো একটু এলোমেলো করে দেয়। ওর কোনো সাড়া শব্দই নেই। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ এতদিন পর ওর জন্য কোথাও একটা মারাত্মক টান অনুভব করে। যেন মনে হয় রাতুলকে আঁকড়ে বোধহয় আবার স্বপ্ন দেখতে পারে সে। এবারে কিছুতেই সম্পর্কটাকে দূরে ঠেলে দিতে মন চায় না।

পরক্ষণেই কোনো এক অজানা ভয় এসে চেপে ধরে শ্রীময়ীকে। বাবার কথা মনে পড়ে যায়। কতদিন মানুষটাকে দেখেই নি সে। বছর খানেক আগে যখন হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছিলেন শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন শ্রীময়ীর জন্য। বড় ভাষা ভাষা ছিল সে চিঠি-
" তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি একটা সুন্দর ভবিষ্যত। এতগুলো দিন যে তোমায় আঁকড়ে রেখেছি, এবার খানিক নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি যে তুমি নিজেই নিজের আত্মরক্ষা করতে সক্ষম। এবার আমি চললাম মহাপ্রস্থানের পথে, এক মহার্ঘ্য কে সঙ্গে নিয়ে। উদ্দেশ্য একটা পরম্পরাকে আজীবন সুরক্ষিত করে যাওয়া। জানিনা আর দেখা হবে কিনা, তবে এটুকু বলে যাই সৎপথে থেকো, দেশের স্বার্থে দশের জন্য নিজেকে সমর্পণ করো।"

এ লেখা সে অনেকবার পড়েছে। মাথামুন্ডু বোঝেনি। কী সেই বিশ্বাস যা তাঁকে সুরক্ষিত করতে এমন ভাবে চলে যেতে হলো। 'মহাপ্রস্থান'- শব্দটা খুব চেনা। মহাভারতে পাণ্ডবরা সমস্ত দায়িত্ব ভার তাদের উত্তর পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে হিমালয়ের পথে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার বাবা কেন এরকমটা লিখলেন? আর মহার্ঘ্য বলতে ঠিক বোঝাতে চেয়েছেন, এসব বহু চেষ্টা করেও কোনো অর্থ খুঁজে পায়নি শ্রীময়ী।

-" কীরে কী এত ভাবছিস ?", রাতুলের প্রশ্নে চমকে ওঠে শ্রীময়ী। ওর এতক্ষণে ঘুম ভাঙলো।
-" না কিছুনা। তোর ঘুম হলো ?", মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী। ওর এই হাসিটা সত্যি মন কেড়ে নেয় যেন।
-" হ্যাঁ ভালোই হলো একচোট। আর বোধহয় বেশিক্ষণ নেই ল্যান্ড করতে ?", একটু আড়মোড়া ভেঙে বললো রাতুল।
-" আধঘন্টা মতো আছে।"
-" হুম, কি অদ্ভুত তাই না রে শ্রী ?"
-" কোনটা অদ্ভুত ?"
-" এই যে এমন একটা তদন্তে যাচ্ছি যেটার সাথে মহাভারত, ভগবদগীতা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে আর যে ফ্লাইটে এখন যাচ্ছি তার নম্বর খানাও কি অদ্ভুত ভাবে মিলে মিশে যাচ্ছে এসবের সাথে!", নিজের বোর্ডিং পাশ টা কোলের ওপরে রাখা ছিলো রাতুলের, সেদিকে তাকিয়েই কথা গুলো বললো রাতুল। "
-" মানে ? এর সাথে ফ্লাইট নম্বরের কি সম্পর্ক ?", জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী।
রাতুল একটু ভেবে নিয়ে বললো, " 6E, 0108- এটাই নম্বর তো ?"
-" হ্যাঁ, কিন্তু...", শ্রীময়ী কে শেষ করতে না দিয়েই রাতুল বললো, " 1080 সংখ্যা টা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে না ?"
-" মহাভারতের দিক থেকে দেখলে শ্রীকৃষ্ণের ১০৮ নাম মনে আসে।"
-" হ্যাঁ। ঠিক তাই। এই ১০৮ সংখ্যাটি খুব পবিত্র ধরা হয় বুঝলি। পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে যা দূরত্ব তা ঠিক সূর্যের ব্যাসের ১০৮ গুণ। আবার চাঁদ আর পৃথিবীর দূরত্ব হলো চাঁদের ব্যাসের ১০৮ গুণ। এবার এই ১ আর ৮ যোগ করলে দাঁড়ায় ৯ যা বৈদিক যুগে সর্বোত্তম সংখ্যা হিসেবে ধরা হতো। সে যুগে অনেক কিছুই ১ আর ৮ দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। যেমন মহাভারতে ১৮ টি পর্ব। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ১৮ দিন ধরে হয়েছিলো। এরকম কত হাজারো ব্যাখ্যা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে নির্ণয় করা যায়। কাজেই এসব কে কি নিছক গল্প গুজব বলে ঠাওড়ানো যায় ?"

রাতুলের এই অসাধারণ বিশ্লেষণ শ্রীময়ীকে শুধু মুগ্ধই করলো না, ওর এই ব্যাখ্যা যেন এই কেসটাকে নতুন ভাবে চিনতে শেখাল শ্রীময়ীকে।

শ্রীময়ী চুপ করে শুনে গেলো কথাগুলো। হঠাৎই ওর একটা কথা মনে এলো। প্রফেসর নন্দীর বাড়ির ঠিকানাটার মধ্যেও কি অদ্ভুত সমাপতন। বাড়ির নাম 'পাঞ্চজন্য', মানে শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খের নাম, আর সেটা অবস্থিত '১০/৮, আর ব্যানার্জি রোড'- ১০/৮ ; এখানেও সেই ১০৮ সংখ্যাটা কি কাকতলীয় ভাবেই না এসেছে।

এখন আর এটাকে শুধুই কোনো হত্যা রহস্য বলে ভাবতে পারা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ঢুকে গেছে ইতিহাস, পুরাণ সব কিছু। নিছক সিরিয়াল কিলিং বলে ভাবতে শুরু করেও, রাতুলের এই কথাগুলো শুনে হোঁচট খেলো শ্রীময়ী।

-৩১-

দেরদুন এয়ারপোর্ট থেকে ডঃ বিধান শর্মার বাড়ি মাইল তিনেক মতো হবে। ওদের গাড়ি যখন ঢুকছে ডঃ শর্মার বাড়ি তখন বেলা পড়ে এসেছে অনেকটা। শ্রীময়ী গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই ফোন করলো ডঃ শর্মাকে, যাতে উনি নির্দ্বিধায় দরজা খুলতে পারেন। উনি বোধহয় ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। প্রায় একরকম ছুটে এসেই দরজা খুললেন। শ্রীময়ী পরিচয় পত্র দেখিয়ে যখন ভেতরে এলো, ওনার বাড়ির মিউজিক্যাল ঘড়িতে দুপুর তিনটে বাজছে।

দেরাদুনে এর আগে রাতুল বা শ্রীময়ীর কেউই আগে আসেনি। রাতুল একবার হরিদ্বার এসেছিল বটে, কিন্তু উত্তরাখণ্ড বলতে ওই শেষ আসা। তাছাড়া খুব একটা এ চত্বরে আসেনি কোনোদিন। এদিকটা ওয়েদার বড় মনোরম। গরমও নেই। আবার ঠিক ঠাণ্ডাও বলা যায় না।


-" আচ্ছা পঁচিশ বছর আগে গুজরাটের লোথালে ঠিক কি হয়েছিলো বলুন তো ডঃ শর্মা ? দয়া করে কোনো কথা গোপন করবেন না। এর আগে পরপর দুটো খুন হয়ে গেছে। ঈশ্বর না করুন তৃতীয় ভিকটিম হবার সম্ভাবনা কিন্তু আপনার ওপরেই প্রবল ভাবে বর্তায়। কাজেই কো- অপারেট করুন প্লিজ", শ্রীময়ী ডঃ শর্মার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো।

সন্ধ্যায় ডঃ শর্মার বাড়িতে একটা গভীর আলোচনায় তিনজনেই মগ্ন ছিলো। বাইরের অজানা বিপদ কখন যে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে কেউ জানে না। সময়মতো বিধান বাবুর বাড়িতে আসতে পেরেছে ওরা এটাই অনেকটা নিশ্চিন্তির বিষয়।

শ্রীময়ীর প্রশ্নের উত্তরে ডঃ শর্মা একটু থম মেরে বসে রইলেন খানিক। শ্রীময়ী আবারো জিজ্ঞেস করলো, " দয়া করে বলুন। এই কেসটা আর পাঁচটা সাধারণ কেসের মতো নয় কিন্তু। আপনার কাছ থেকে কথাগুলো জানা দরকার স্যার।"

ডঃ শর্মা একটু মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপর বলতে লাগলেন-
" পঁচিশটা বছর বড় কম সময় নয়। কিন্তু সেসব ঘটনা বার বার মন থেকে দূর করতে চাইলেও ভুলতে পারিনি। লোথালে আমরা গিয়েছিলাম মোহেঞ্জোদারোর কিছু অবশেষ দেখতে। নতুন করে পারমিশন নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছিলো। আমি, মুকেশ আর জনার্দন পুরোভাগে ছিলাম এই অভিযানে।"
-" তারপর ?", শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো।
-" সেই কাজের সূত্রে আমাদের সাথে আলাপ হয় ভূদেব সিংয়ের সাথে। উনিও আমাদের কাজে সহায়তা করছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে উনি জনার্দনের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। আমার সাথে সেই আমার প্রথম দেখা।"
-" আচ্ছা আপনারা কি কোনো পোড়ামাটির ফলক নিয়ে গবেষণা করছিলেন, মানে এমন একটা ফলক যাতে কৃষ্ণার্জুনের রথচিত্র খোদাই করা?"

ডঃ শর্মা একটু অবাক হয়েই তাকালেন দুজনের দিকে।

-" আপনারা তাহলে জানেন যে ব্যাপারে। দেখুন প্রথমে আমি কিছুই জানতাম না। পরে ভূদেব সিং নিজেই দেখিয়েছিল সেটা। ওটা নাকি ওদের বংশের অভিজ্ঞান। ভূদেব সিং ও তার পরিবার বহু বছর ধরে রক্ষা করে এসেছে সেই ফলকটাকে।"
-" কিন্তু এটার এত গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণ কি ?", রাতুল জানতে চাইলো।

ডঃ শর্মা বললেন, "তার আগে বলি মহাভারতের যুদ্ধের পর আর্যাবর্তে অর্জুন পৌত্র পরীক্ষিত এবং তার বংশধরেরা প্রধানত শাসন চালিয়ে যেতে থাকে এটা বোধহয় অনেকেই জানেন। কিন্তু এটা কি আপনাদের জানা আছে যে পরবর্তী কালে আরো একটি জনজাতি, পরীক্ষিত এবং তাঁর বংশধরদের সর্বোতভাবে সাহায্য করে যায় শাসনক্ষেত্রে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে।
এঁরা হলেন মহান কর্ণের বংশধরেরা। হ্যাঁ মহানই বটে। মহাভারতের শ্ৰেষ্ঠ যোদ্ধা আমি মনে করি অর্জুন নয়, তিনি হলেন কর্ণ। শুধু ভাগ্যের পরিহাস আর রাজনৈতিক স্বজনপোষনের স্বীকার হয়ে যাঁর নায়ক হয়ে ওঠা হয়নি।
সেই কর্ণের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে একটা সত্য নিজেদের কাছে লুকিয়ে আসছে। সে এমন এক নিগূঢ় জ্ঞান, এক অসামান্য বীজমন্ত্র যা শুধু বংশ পরম্পরায় তাদের কাছেই গচ্ছিত রয়েছে। এর প্রয়োগে গোটা বিশ্ব করায়ত্ত হওয়া সম্ভব।"
-" আদপে সেটা কিসের বীজমন্ত্র ছিলো ?"
-" আপনারা ব্রহ্মশির অস্ত্রের নাম শুনেছেন, যা  মহাভারতে অশ্বথামা প্রয়োগ করে পাণ্ডবদের সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সেটা রুখে দিয়ে নতুন করে গোটা পৃথিবীর জীবনদান করেছিলেন। পরবর্তী কালে এই অস্ত্রের
জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ প্ৰদান করে যান কর্ণের পুত্র বৃষকেতুকে। তারপর থেকে সেই জ্ঞান বা বীজমন্ত্রটি অঙ্গরাজ কর্ণের প্রতিটি বংশধরেরা সযত্নে রক্ষা করে আসছে পারিবারিক একটি অভিজ্ঞানের দ্বারা। এই ফলকটা হলো সেই অভিজ্ঞান। এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সেই বীজমন্ত্র যা ওই অমোঘ অস্ত্রের প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হয়। ওই সঙ্কেত আর ছবি সেটাই নির্দেশ করে। আর এই 'ঢিলোঁ' সম্প্রদায়ের লোকজন হলো অঙ্গরাজ কর্ণের বংশধর। একথা কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে সত্য।"
-" কিন্তু তা কী করে সম্ভব ? মানে সেযুগে কি ফলকে খোদাই করে রাখার চল ছিলো ? সবটাই তো হতো মুখে মুখে শুনে"।
-" না সেযুগে ছিলো না। কিন্তু পরবর্তী কালে খোদাই করা হয় যাতে কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়। পরম্পরাকে অক্ষত রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্য। হাজার হোক এ আমাদের এক সোনালী ইতিহাসের স্বাক্ষর। কোনো পশ্চিমী আরোপিত ধারণা নয়, সেটা প্রমাণ করবার জন্যই এই ফলকের নির্মাণ করা হয়েছিলো বলে আমি মনে করি।"

এবারে শ্রীময়ী প্রশ্ন করলো, " কিন্তু কর্ণর বংশধরেরাই কেন ? অন্য কেউ নয় কেন ?"

ডঃ শর্মা বললেন, " কারণ তিনিই তো জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব। তাই তাঁর পুত্রদেরই এই জ্ঞান প্রদান করে যাওয়া হয়। পরবর্তী কালে কুরু পাণ্ডবদের বংশধরেরা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও 'ঢিলোঁ' রা কিন্তু সগৌরবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এরা যোদ্ধা হিসেবে ছিলো অতুলনীয়। এমনকী ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এই 'ঢিলোঁ' সম্প্রদায়ের লোকজন যে বিদ্রোহ গড়ে তোলে তা বলতে গেলে ইংরেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। কাজেই ইতিহাসে এদের গুরুত্ব অনেক। দিল্লী শহরের নামকরণ তো এঁরাই করেছিলেন।
'ঢিলোঁ' বংশের এক রাজা ঢিল্লু তৎকালীন ইন্দ্রপ্রস্থের কাছে 'ঢিল্লি' শহরের ব্যুৎপত্তি ঘটান যা আজকের দিল্লী নামে পরিচিত।
আর কি অদ্ভুত ব্যাপার, ভারতবর্ষের সর্বশেষ এবং বর্তমান রাজধানী সেই দিল্লীই হয়ে গেল শেষমেশ।"

-৩২-

রাতুল এতক্ষণ মন দিয়ে সবটা শুনছিলো। এবারে জিজ্ঞেস করলো, " সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ভূদেব সিংয়ের কাছে এই ফলকটা এলো কীভাবে ?"
-" ভূদেব সিং এই বংশেরই লোক। কাজেই ওনার কাছে এরকম কোন ফলক থাকাটা মোটেই আশ্চর্যের না।"

শ্রীময়ী সবটা শুনে প্রশ্ন করলো, " আচ্ছা একটা নিউজ দেখেছিলাম লোথালে নাকি একটা ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে, সেই ব্যাপারে একটু আলোকপাত করতে পারেন।"
-" দেখুন ওটা আমার মতে পুরোটাই ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছিলো। ওই ফলকটার ব্যাপারে একটু বেশি জানাজানি হয়ে যাওয়ার ফলেই ওটা ঘটানো হয়", বেশ স্পষ্ট করেই কথা গুলো জানালেন ডঃ শর্মা।
-" কে এরকম ঘটিয়েছিল বলে মনে হয় আপনার ?"
-" ওই ট্রিপ টায় একজন সাংবাদিক ছায়ার মতো লেগেছিলো আমাদের সাথে। মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিলো একটা স্টোরি করবার। কিন্তু ফলকটার কথা জানতে পেরে, ওটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে জানতে পেরে সেটা হাতানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিল। সরাসরি প্রমাণ আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি জানি ওটার প্রতি ওনার কী পরিমাণ লোভ ছিলো। সেই জন্যই আগুন লাগিয়ে একটা ম্যাসাকার করে ফাঁক তালে ফলকটা নিয়ে নেবার একটা প্ল্যান বানিয়েছিল। "
-" তাহলে ফলকটার কী হলো শেষ অব্দি?", প্রশ্ন করলো রাতুল।
-" সুশান্ত বাবু শেষ অবধি ওটার নাগাল পায়নি। সেই অগ্নিকুন্ড থেকে আমরা তিনজন কোনক্রমে রক্ষা পাই। জনার্দন প্রানের ঝুঁকি নিয়ে ফলকটিকে উদ্ধার করেছিলো। শুধু একটাই আক্ষেপ, ভূদেব সিং আর তার স্ত্রী দুজনেই সেখানে তখন উপস্থিত ছিলো। ওদের আমরা বাঁচাতে পারিনি। আর সুশান্ত বাবু ততক্ষণে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন কোনো কিছুই করতে না পেরে।"

শ্রীময়ী অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, " কিন্তু সুশান্ত বাবু যে বললেন ওখানে আপনাদের মধ্যে কোনো অশান্তি হয়েছিলো, আপনারা নাকি জোর করে ফলকটা নেবার চেষ্টা করেছিলেন, বলে..."
-" মিথ্যে কথা, ওই লোকটা অত্যন্ত ঝানু। এসব কিছু বানিয়ে বলেছে। ওই এসবের পেছনে রয়েছে। কর মতো দুমুখো সাপ আর দুটি নেই। ওখান থেকে ফেরত আসার পরও বহুদিন ছিনে জোঁকের মতো লেগেছিলো আমাদের পেছনে, শেষমেশ কিছু উদ্ধার করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়।"
-" বুঝলাম। তারপর কী হলো?"
-" জনার্দন বেশ কিছুদিন ওটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলো। ওটার নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলো যে কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতো না, পাছে ওটার ওপর কোনো বিপদ আসে। তার ওপর সুশান্ত যেভাবে পেছনে লাগে ওটা কাছে রাখা আর সেফ ছিলো না। শেষমেশ ও ওটার যোগ্য উত্তরাধিকারী কেই সমর্পণ করে দেয় ফলকটা।"
-" কার কাছে?", অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করে শ্রীময়ী।
-" ভূদেব সিংয়ের বোন উমার কাছে। সে তখন কলকাতাতেই থাকতো।"
-" কী নাম বললেন উমা !" চমকে ওঠে শ্রীময়ী।
-" হ্যাঁ, উমা আর ওর স্বামী সযত্নে সেটাকে রক্ষা করে কিছু কাল, তারপর উমা মারা যাবার পর থেকে সেটা ওর স্বামীর কাছেই আছে।"

শ্রীময়ীকে হঠাৎ করে প্রচন্ড উত্তেজিত লাগছে যেন। চোখ দুটো স্থির ভাবে তাকিয়ে ডঃ শর্মার দিকে। রাতুল ওর মধ্যে এই পরিবর্তনটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো।

শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো, " এই ভূদেব সিংয়ের নিজের বোন উমা, এনার স্বামীর নামটা কী ছিলো জানতে পারি ?"
-" কলকাতার একজন নাম করা সায়েন্টিস্ট ডঃ শঙ্কর ব্যানার্জি।"

-৩৩-

-" ওরা যে এখানে এসেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত", বৃষকেতু কথা বলছিল ফোনে। ওপাশের গলাটা আজ স্বাভাবিকের থেকে একটু যেন বেশি উদ্বেগপূর্ন। চিন্তিত স্বরে বললেন বৃষকেতুর এই ধর্মযুদ্ধের নেপথ্যে থাকা সারথি, " তাহলে সেই সুযোগটা নিও তুমি। মনে রেখো ওরা এতদূর যখন আসতে পেরেছে ওদের অগ্রাহ্য করাটা কিন্তু মুর্খামি হবে।"
-" তাহলে ?"
-" আমি চাই এবারে তুমি পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করো। আমার দেরাদুন পৌঁছতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। তার মধ্যে ওদের প্রত্যেকটি মুভমেন্ট আমার জানা দরকার। সেই মতো আমি দেরদুন থেকে রওনা হবো। সময় মতো তোমার সাথে আমার মোলাকাত হবে। জেনে রেখো, এটাই অন্তিম সুযোগ। বিধান শর্মার কাছ থেকে যাবতীয় তথ্য নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নামতে হবে বৃষকেতু। তোমার পরিবারের ধ্বংসের কারণ হিসেবে শুধুমাত্র এই লোকটিই বাকি রয়েছে। বাকিদের কর্মফল তাদের নিজ গন্তব্যে নিয়ে গেছে। একমাত্র ডঃ শর্মাই বলতে পারবে ফলকটা এই মুহূর্তে কোথায় এবং কার কাছে রয়েছে। ওটা যেভাবে হোক হস্তগত করতেই হবে। সময় খুব বেশি আর আর হাতে নেই।"
-" ঠিক আছে। আমি সময়মতো সব আপনাকে জানাচ্ছি।"
-" ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।"

ফোনটা রেখে এগিয়ে গেলেন সুশান্ত সেনগুপ্ত। দিল্লী এয়ারপোর্টে এসেই বৃষকেতুর সাথে কথা বলে নেওয়াটা জরুরী ছিলো, কারণ এরপরের পদক্ষেপটা হয়তো বৃষকেতুকে একাই নিতে হবে। যতক্ষণ বিধান শর্মা জীবিত আছেন কোনো ভাবেই তাঁর সামনে আসা চলবে না। তাহলে এতদিন তিল তিল করে গড়ে ওঠা এত পরিকল্পনা সবকিছু ভেস্তে যাবে। সেটা কিছুতেই হতে দিতে পারেন না সুশান্ত সেনগুপ্ত। পঁচিশ বছর আগে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল। এবার আর কোনো ভুল করবেন না। কিছুতেই না। বৃষকেতুকে তুরুপ করে এতদিন ঘুঁটি সাজিয়েছেন তিনি। পন্ডশ্রম হতে দিতে পারেন না কিছুতেই।

ইতিমধ্যে তাঁর ফ্লাইটের ঘোষণা হয়ে গেছে। দেরাদুনগামী বিমান যে টার্মিনাল থেকে ছাড়বে সেদিকেই এগিয়ে গেলেন তিনি।

-৩৪-

-" হোয়াট! কী বলছেন আপনি ?", শ্রীময়ী মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠলো ডঃ শর্মার কাছে নিজের বাবার নাম শুনে। ওর চোখদুটো লাল হবে গেছে সব কথা শুনে, " এ হতেই পারে না, আপনি মিথ্যে বলছেন।"

ডঃ শর্মাও অবাক হয়ে গেছেন। বললেন, " মিথ্যে বলবো কেন। শঙ্করকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। উমার সাথে ওর বিয়ের পর আমরা একসাথে কত আড্ডা মেরেছি, সেসব দিনগুলো আজ ভুলতে পারিনা। মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে উমা যেদিন মারা যায়, শঙ্করের সেই কান্না আজও আমায় বিহ্বল করে দেয়। এসব যে সত্যি কথা এর কী প্রমাণ আপনাকে দি বলুন তো, যদি আপনার বিশ্বাস না হয়।"

শ্রীময়ী তখনো স্বাভাবিক হয়নি। ওর মধ্যে আবেগের এমন বহিঃপ্রকাশ ডঃ শর্মাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। উনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন খানিক।

খানিকটা পর ধাতস্থ হলো শ্রীময়ী। তারপর চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে আসা অশ্রুবিন্দুটা নিজের হাতেই মুছে নিয়ে বললো, " সরি, আমি একটু এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম। আপনি বোধহয় জানেন না যে ডঃ শঙ্কর ব্যানার্জি আমার বাবা। আমার সবথেকে আপনজন। আর মায়ের নামটুকুই জানি খালি। উমা। ওই জন্যই তো বাবা আমার নাম রাখেন শ্রীময়ী।
কয়েকটা ছবি ছাড়া ওনার কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই।"
-" না না না সরি কিসের বেটি। তুমি বোধহয় আমায় চিনতেই পারো নি। চেনার কথাও নয় যদিও। শঙ্করের সাথে আমার পরিচয় অনেকদিনের। তোমাদের বাড়ি গেছি বেশ কয়েকবার। আমারই ভুল যে সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ এতবড় হয়ে গেছে যে চিনতেই পারিনি", বলে সস্নেহে শ্রীময়ীর মাথায় হাত রাখলেন ডঃ শর্মা।

শ্রীময়ী আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। একটাই কথা অস্ফুটে বলতে লাগলো বারবার, " বাবা যে আজ প্রায় বছর খানেক নিখোঁজ। কোন খোঁজ আমি পাইনি হাজার চেষ্টা করেও। কিন্তু স্বপ্নেও এটা ভাবিনি যে এই কেসের সমাধান করতে এসে আমায় শেষ পর্যন্ত বাবার সম্মুখীন হতে হবে। কে জানে কোথায় আছে মানুষটা।"

তারপর শ্রীময়ী এক এক করে ওর বাবার চলে যাওয়া, শেষ চিঠিটার কথা সব বললো। ডঃ শর্মা সব শুনে বললেন, " তার মানে যে মহার্ঘ্য টিকে নিয়ে গেছেন উনি, সেটা ওই দুর্মূল্য ফলকটাই। ওটার নিরাপত্তা নে সমস্ত ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধে সেটা শঙ্কর ছাড়া কেই বা ভালো বুঝবে।"
-" কিন্তু কেন ? নিয়ে গেছেন কেন ? আর কোথায়ই গেছেন ? কিছুই তো জানি না আমি শর্মা আঙ্কেল। বাবার কোনো খবরই আমার কাছে যে নেই", সজল চোখে বললো শ্রীময়ী।
-" আমায় বেশ কিছুদিন আগে একটা লেটার পাঠিয়েছিল। ফোন নম্বর ছিলো না আমার কাছে, কাজেই সেভাবে যোগাযোগ আর হয়ে ওঠেনি শেষের দিকে। ওয়েট আমি চিঠিটা নিয়ে আসছি।"

রাতুল আর শ্রীময়ী কে বসতে বলে ডঃ শর্মা নিজের স্টাডিরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন চিঠিটার খোঁজে...।




|| সপ্তম   পর্ব  ||


-৩৫-

একটু পরেই ডঃ শর্মা নিজের স্টাডিরুম থেকে শঙ্কর বাবুর পাঠানো চিঠিটা নিয়ে এসে দেখালেন ওদের। তেমন কিছু লেখা নেই। শুধুই কিছু খবরাখবর নেওয়ার কথা রয়েছে। আর ওঁর নিজের মেয়ের জন্য উদ্বেগ ধরা পড়েছে প্রতিটি ছত্রে। কেমন আছে সে, কী করছে এসব নিয়ে শঙ্কর বাবুর উদ্বেগের অন্ত ছিলো না।
আসলে ওনার ফিরে আসার কোনো উপায় ছিলো না। তার একটা বড় কারণ ওই ফলকটা সঙ্গে থাকলে ওনার এবং ওনার পরিবারের ওপরে সঙ্কট আসতে পারে। সেই জন্যই এই অজ্ঞাতবাস।

চিঠিটা পড়ে শ্রীময়ী কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের কোণে জলের রেখাটা দেখতে পেলো রাতুল। সে শ্রীময়ীর পাশে এসে দাঁড়ালো। বললো, " চিন্তা করিস না শ্রী। এতদূর যখন এসেছি এর শেষ দেখেই ছাড়বো। আর সম্ভব হলে সেই সাথে তোর বাবার খোঁজটুকুও অবশ্যই নিয়ে আসবো। কথা দিলাম।"

মুখটা তুলে একবার তাকালো শ্রীময়ী। ওর চোখ দুটো ভেজা। কাঁদছে না, কিন্তু গভীর এক দৃষ্টি সে চোখে। আজ ওর পাশে ওর বাবা না থাকলেও এমন মানুষেরা আছেন যারা ওকে ভরসা দিতে পারে, এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিতে পারে। এটাই অনেক নয় কি !

-" আচ্ছা এই চিঠিটা যে ঠিকানা থেকে এসেছে, সেখানে একবার খোঁজ করলে হয় না ?", জিজ্ঞেস করলো রাতুল।
-" এড্রেসটা বলছে তালুকা গ্রাম উত্তরাখণ্ডে। এখান থেকে মোটামুটি একশো পঁচিশ মাইল হবে জায়গাটা।"
-" তাহলে তো কাল ভোর ভোর রওনা হলে সন্ধ্যের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারি। কারণ এই হত্যালীলা বন্ধ করতে বা অপরাধীকে ধরতে হলে ওনার কাছে পৌঁছনো আবশ্যক। কী বলেন ডঃ শর্মা ?", জানতে চাইলো রাতুল।
-" গুড আইডিয়া। কালই বেরিয়ে পড়া যাক তাহলে", বলে উঠলেন ডঃ শর্মা।

শ্রীময়ীও ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। কিছু বললো না মুখে। ওই একমাত্র জানে ওর মনের মধ্যে কী চলছে।

দেরাদুন শহরে রাত নেমেছে। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। রহস্যময় উপত্যকা আজ বড় নিস্তব্ধ, চুপচাপ। কেউ জানে না কী হতে চলেছে। শুধু এক নতুন ভবিষ্যৎ যেন উঁকি মারে নক্ষত্র খচিত আকাশের কালো পর্দা সরিয়ে।

স্বপ্নেরা কখনো মরে না। জেগে থাকে নিদ্রাহীন ভাবে।

-৩৬-

ঠিক সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ গাড়ি এসে পড়লো। ড্রাইভার মুকুন্দ রাঠোর আগের দিনই রাতুলদের দেরাদুন এয়ারপোর্ট থেকে ডঃ শর্মার বাড়ি নিয়ে এসেছিলো। রাতুল ওনার ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখেছিলো। তাই আগেরদিন রাতেই ওকে বলে দেওয়ায় একদম সময়মতো এসে উপস্থিত হলো।
প্রত্যেকে তৈরি হয়েই ছিলো। বেশ খানিকটা খাবার দাবার সঙ্গে নিয়ে নিলো সবাই। এতটা দীর্ঘ পথ যেতে হবে, বলা যায় না পথে কখন কোথায় কী হয়।

শ্রীময়ী সকাল থেকেই মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই চঞ্চল হয়ে পড়ছে। সেটা কি এতদিন পর বাবাকে খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনা নাকি এই দুর্দান্ত কেসের পরিসমাপ্তির পথে যেতে পারার আনন্দ বোঝা যাচ্ছে না। সেই সাথে নিজের একটা অন্য পরিচয় পাবার মত অনন্য ব্যাপারও রয়েছে।

'ঢিলোঁ' সম্প্রদায়ের রক্ত তার গায়েও বইছে, যাদের আদপে মহান কর্ণের বংশধর বলা হয়ে থাকে। সূর্যদেবের বংশধর বলেই কি ভোরের ওই রক্তবর্ণ দিবাকর অত প্রিয় তার ? সূর্যপ্রণামে খুঁজে পায় এক নিবিড় সান্ত্বনা। কি আশ্চর্য এই কালচক্র যা মহাভারত আর বর্তমান সময়কে মিলিয়ে দিচ্ছে নির্বিশেষে!

হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো শ্রীময়ীর। বাংলায় কথোপকথন হচ্ছে দেখে রাতুল বুঝতে পারলো সম্ভবত কলকাতার অফিস থেকে কোনো ইনফরমেশন আছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হবার পর শ্রীময়ীর চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে হয়ে এলো। মিনিটখানেক পর, " ঠিক আছে দেখছি আমি", বলে ফোনটা কেটে দিয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

-" কী ব্যাপার রে, এনি প্রবলেম ?", রাতুল জিজ্ঞেস করলো।
ডঃ শর্মাও উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রীময়ীর দিকে।

খানিকক্ষণ পর শ্রীময়ী বলে উঠলো, " ওই স্কাউন্দ্রেল সুশান্ত পুরোপুরি মিথ্যে বলেছিলো। ওর ওসব অসুস্থতা একটা ভণিতা মাত্র। আমার সোর্স বলছে ও ফ্লাইটের টিকিট কেটে দেরাদুন এসেছে। ডঃ শর্মা মিথ্যে বলছেন না।
শুধু তাই নয়, ও নাকি গত কয়েক বছরে মাঝে মাঝেই গুজরাট গেছে। এয়ারপোর্টের রেকর্ড তাই বলছে।
আমাদের সব মুভমেন্ট ও ফলো করে যাচ্ছে। খারাপ উদ্দেশ্য না থাকলে কেউ এরকম ফলো করবে না, অন্তঃত মিথ্যে বলে তো নয়ই। কিন্তু খবর পাচ্ছে কি করে ? কে ওর হয়ে কাজ করছে ?"
-" নান আদার দ্যান বৃষকেতু সিং ওরফে বিকাশ যে দু দুটো খুন করে এখন হয়তো ডঃ শর্মার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করেছে। আমি নিশ্চিত ও আর ভূদেব সিংয়ের ছেলে একই লোক। এখন বুঝতে পারছি ওই শ্লোক গুলো লেখার তাৎপর্য কী ?", চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললো রাতুল।
-" কী তাৎপর্য ?"
-" এখানে বৃষকেতু হলো পার্থ আর সুশান্ত হলো তার সারথি। পুরোনো ঘটনার বদলা নিচ্ছে বৃষকেতু। সম্ভবত ওকে দিয়ে একাজ করাচ্ছে সুশান্ত সেনগুপ্ত শুধুমাত্র ওই ফলকটার লোভে। সেটা পেলে বৃষকেতু কে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আর বোকার মতো বৃষকেতু ওর কথায় বিশ্বাস করে এই হত্যালীলা কে একটা ধর্মযুদ্ধ মনে করে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। বেচারা জানেও না আসল সত্যি টা কী ?"
-" তার মানে ও অজান্তেই ওই শ্লোক লিখে রেখে আমাদের ক্লু দিয়ে গেছে, যে ও একা নয়, ওকে পরিচালনা করা হচ্ছে।"
-" ঠিক তাই রে শ্রী। এবার ও আমাদের পেছনে ধাওয়া করবে শিওর।"
-" উঁহু এইবারে ও সফল হবে না। আমি হতে দেবো না", দৃঢ়চিত্তে বলে ওঠে শ্রীময়ী।

-৩৭-

গাড়িতে দেরাদুন থেকে তালুকা আসতে প্রায় ঘন্টা দশেক সময় লাগে। রাস্তা খুব যে মসৃণ তা মোটেও না। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা এবড়ো থেবড়ো ভাবে সর্পিল গতিতে পাকদন্ডির মতো এঁকেবেঁকে চলেছে। দুপাশে বিরাটাকায় মহীরুহের দল নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এ পথ হিমালয়ের আপন ক্রীড়াঙ্গন। এখানে জীবন ও মৃত্যু দুইই হলো পায়ের ভৃত্য। ভয়ংকর সুন্দরী পাহাড়ি উপত্যকা দু হাত ছড়িয়ে বিস্তৃত।

বিকেল চারটের দিকে শ্রীময়ীরা সাঁকরি গ্রামে এসে পৌঁছলো। হিমালয়ের কোলে ছোট একটা জনপদ। খানিক চা বিরতি সেরে আবার গাড়ি রওনা দিলো তালুকার উদ্দেশ্যে। সাঁকরি থেকে তালুকা চোদ্দ কিলোমিটার রাস্তা আরো বেশি খাড়াই। সেখানে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। এখানেই শঙ্কর বাবুর সর্বশেষ ঠিকানা পাওয়া গেছে। খোঁজ করতে হবে। কিন্তু তারও আগে যেটা দরকার সেটা হলো মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। বেশ শীত করছে এবার। পাহাড়ের ঢালে দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। এখুনি একটা থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলে মুশকিল।

শেষ মেশ একটা হোম স্টে জুটে গেলো। ব্যবস্থা মন্দ নয়। একটাই ঘর পাওয়া গেলো। সে যা হোক, কিছু একটা হলেই হলো। রাত টুকু কাটানো নিয়ে কথা। ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হলো। কারণ এরপর কোথাও যেতে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কারণ, গাড়ি যাবার রাস্তা এখানেই শেষ হয়েছে।

-৩৮-

পরদিন ভোরেই শঙ্কর বাবুর ঠিকানাটার উদ্দেশ্যে তিনজন মিলে বের হলো। শ্রীময়ী তার আগে লোকাল থানার সাথে একটা যোগাযোগ সেরে রাখলো। থানা বেশ দূর যদিও। ফোনেই প্রাথমিক আলাপ সেরে ওসির সাথে কয়েকটা দরকারি আলোচনা করে নিলো। বলা যায় না কখন কোথা থেকে বিপদ আসতে পারে। এখনো অব্দি সেভাবে সমস্যা হয়নি। এখন ভালোয় ভালোয় শঙ্কর বাবুর খোঁজ পেলেই হলো।

খোঁজ অবশ্য পাওয়া গেলো, কিন্তু সেক্ষেত্রে হতাশই হতে হলো ওদের। যে ঠিকানা থেকে চিঠিটা লিখেছিলেন সেখান থেকে সামান্য দূরেই সোমেশ্বরের মন্দির। এখানেই বেশ কিছুদিন পূজারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন শঙ্কর বাবু। অবশ্য শঙ্করনাথ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। একটু পাশেই ভগবান ঠাকুরের আস্তানা। উনিও মন্দিরের একজন পূজারী স্থানীয় মানুষ। তাঁর সাথেই শঙ্করনাথ থাকতেন। কিন্তু জানা গেলো, কয়েকমাস আগে তিনি আরো ওপরের দিকে চলে যান। কাজেই এখানে খোঁজ করে। বিশেষ লাভ আর হবে না।

শ্রীময়ী অনেক আশা নিয়ে এসেছিলো। স্বভাবতই বেশ ভেঙে পড়লো। হতাশ ভাবে বললো, " এবারে কী ভাবে খুঁজবো আমি ?"
রাতুল বললো, " শোন, আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, তোকে উনি চিঠিতে লিখেছিলেন যে মহাপ্রস্থানের পথে চললেন। তাই তো?"
-" হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো..."
-" সেটার মানে এই পথেই উনি গিয়েছেন। গন্তব্য সম্ভবত স্বর্গারোহিনীর দিকে। কারণ মহাভারতে মহাপ্রস্তানিকা পর্বে এই অঞ্চলেরই উল্লেখ আছে কিন্তু। আমাদের মনে হয় সেই পথ বরাবর এগোতে হবে।"

-" রাতুলবাবু একদম ঠিক কথা বলেছেন। এরপর আরো ওপরে উঠলে ওসলা। তারপরে আসবে হর কি দুন। শঙ্কর যদি সত্যি কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করতে চায় তো আমার মনে হয় ওর গন্তব্য হর কি দুন হয়ে স্বর্গরোহিনী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেটাই মহাপ্রস্থানের পথে সঠিক মার্গ হবে।"

-" আজ হাতে যা সময় রয়েছে তাতে ওসলা অব্দি পৌঁছনো যাবে কিন্তু রাত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে...", রাতুলের কথাটা শেষ করতে দেয় না শ্রীময়ী।
বললো, " সময় নষ্ট করা যাবে না। জানিনা সুশান্ত আর বৃষকেতু কি প্ল্যান করছে। কাজেই যতটা সম্ভব এগিয়ে থাকায় উচিত। যতই রাত হোক। আমি আজই যেতে চাই। "

-৩৯-

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজনে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। অবশ্য এবারে ওদের সঙ্গী হলো আরো একজন, খোঁজ খবর নিতে গিয়েই এক শিখ ছোকরার সাথে দেখা হলো। বয়স বেশি না। মধ্য তিরিশের কোঠায়। একমুখ দাড়ি গোঁফ, মাথায় পাগড়ি। সে নাকি এ অঞ্চলে অনেকদিন গাইডের কাজ করে। একপ্রকার জোর করেই যেন সঙ্গে জুটে গেল ছেলেটি। মালপত্র সব হোম স্টে তেই রেখে দেওয়া হলো। মালিক ভদ্রলোকটি বেশ উপকারী মানুষ। উনিই বললেন ফিরতে যখন এই পথেই হবে, তখন সব মালপত্র নিয়ে যাবার মানে হয় না। দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গাইড ছেলেটির সাথে তিনজনেই বেরিয়ে পড়লো।


ওসলা যাবার পথ বেশ দুর্গম হলেও এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য যেন প্রকৃতি উজাড় করে রেখেছে চারপাশে। একদিকে হিমালয় অপার মহিমান্বিত হয়ে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, অপর দিকে খাদের অতলে খরস্রোতা সুপিন নদী লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে সমানে। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাঝে মাঝেই ভেড়ার পাল দেখা যাচ্ছে, তাদের পালক যে মানুষ গুলো তারা তাদের ভেড়াগুলোকে চড়তে দিয়ে পাহাড়ের খাঁজে বসে খাবার দাবার আয়োজন করে আগুন জ্বালিয়ে বসে রয়েছে। বেশ একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

রাতুল আর ডঃ শর্মা বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে ইতিউতি চেয়ে দেখছে। সত্যি প্রকৃতির এই অপার রূপের কাছে সব কিছুই যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। উদ্ধত হিমালয়ের কাছে সব কেমন গৌণ লাগে যেন। হঠাৎ একটা শকুন মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো। ডঃ শর্মা বললেন, "এ জায়গায় যে অনেক শকুন দেখা যায় পড়েছিলাম কোথাও, আজ চাক্ষুষ করলাম। শুনেছি এদের দেখা পাওয়া নাকি খুব শুভ।"

রাতুলও সেদিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা শুনে মৃদু হাসলো খালি। কিন্তু শ্রীময়ীর মুখটা গম্ভীর হয়ে রয়েছে। কেন যে তার একটা অস্বস্তি হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। পর পর চারজন এগিয়ে চলেছে সারিবদ্ধ ভাবে। পেছন থেকে এক এক করে ডঃ শর্মা, রাতুল আর শ্রীময়ী। একদম সামনে গাইড ছেলেটি। ওরা তিনজন বেশ হাঁফিয়ে উঠলেও গাইড ছেলেটি এত চনমন করছে, যে বাকিদের ওর সাথে তাল রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এই পাহাড়ি চড়াইয়েও গাইড ছেলেটা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছে-

" জব রাত কে গ্যাহরে সন্নাটে
গ্যাহিরি সি নিন্দ মে শোতে হে
এক মেলা য্যয়সা লাগতা হ্যায়
বিখরা বিখরা ইয়ে শুনাপন
ইয়াদো কে সায়ে এয়সে মে
করনে লাগতে হে আলিঙ্গন"

ক্রমশ..... ( আগামী পর্বে সমাপ্য)
 



Ayan Das