সুশান্ত কুমার সাঁতরা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সুশান্ত কুমার সাঁতরা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

একটি নিরীহ খুনের গপ্পো - সুশান্ত কুমার সাঁতরা

 

 একটি নিরীহ খুনের গপ্পো
সুশান্ত কুমার সাঁতরা 

 


    যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু জল আর জল। বিশাল জলরাশি এপাড় থেকে ওপাড় দেখা যাচ্ছে না। কিছু সামুদ্রিক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে জলের উপর দিয়ে। পাড়ে আছড়ে পড়ছে সাদা ফেনিল ঢেউ, একের পিঠে এক, একটা ভাঙছে তো, পরক্ষণেই আরেকটা জেগে উঠছে সমুদ্রের বুক থেকে। যেন কোন বিশাল ফনাধারী সাপ। আওয়াজ কি তার! যেন রোষে গরগর করছে। এখন ঘড়ির কাঁটা সকাল দশটা ছুঁয়েছে। সমুদ্রের পাড়ে রোদ ঝলমল করছে। রঙীন ছাতার তলায় কিছু লোক বসে রয়েছে প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে। অনেকে স্নান করছে জলে। কিছু লোক সমুদ্রের ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের পাড় ধরে।  কিছু নৌকা ফিরে আসছে পাড়ে। হয়ত নৌকার খোলে ভরা আছে, তাদের সামুদ্রিক সংগ্রহ।

    হোটেল সি-রকের ব্যালকনিতে বসে সমুদ্রের ছবি দেখছে নীল। ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে সিধে। অফিসের কাজে মাঝে মাঝেই ওর আনাগোনা হয় এখানে। রুম নম্বর তিনশো তিন ওদের অফিসের জন্য বরাদ্দ। তিনতলায় এই ঘর আর আশেপাশের ঘর গুলো থেকে সমুদ্রকে অবলীলায় দেখা যায়। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় " সী ফেসিং রুম"।

    আজ যখন সকালে এসে উঠল ও হোটেলে তখন ঘড়ির কাঁটা বলছিল আটটা বাজে। একঘন্টা নীচের ওয়েটিং হলে কাটাতে হল, কারন চেক ইন টাইম সকাল নটা। তারপর চেক ইন করে, রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে ব্যালকনি থেকে সমুদ্রের শোভা দেখল কিছুক্ষণ। মন ভরে গেল। হাওয়া আসছে  হু হু করে । চায়ের কাপটা একটু আগেই শেষ করে ফেলেছে সে। খালি কাপটা সাদা প্লেটের ওপর পড়ে রয়েছে এখন। একেবারে রিক্ত, শুধু তলানির চা টুকু জানান দিচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেই সেখানে ছিল ধূমায়িত এক কাপ গরম চা। চা টা করেও এরা খাসা। এলাচি দেওয়া। খেতেও বেশ সুস্বাদু।

    রাতে সাগর আরো মায়বী হয়ে ওঠে, তখন সাগড়ের এক অন্য রূপ। শহরের যেমন দিনের আর রাতের রূপ অন্যরকম। মানুষ যেমন একা একরকম আর সবার মাঝে আর এক রকম। সমুদ্রও ঠিক তেমনি, দিনে তার একরকম রূপ এবং রাতে তার রূপ অন্যরকম। রাতের সমুদ্র অনেকটা লাস্যময়ী রহস্যে ঘেরা কোনো এক নারীর মতন। তার পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজের মত ফেনিল জল রাশি পাড়ে আছ্ড়ে পড়ে, সেখানে নীল নীল আলো দেখা যায়, যেন মনে হয় জোনাকিরা খেলে বেড়াচ্ছে জলের উপর দিয়ে। প্রস্ফুটিত চাঁদের আলোর ঝর্নায় যতবার সমুদ্রকে দেখেছে নীল, ততবারই নব রূপে তাকে আবিষ্কার করেছে সে । সমুদ্র পাড়েই  বড় উথাল পাথাল, কিন্ত ভেতরে বেশ শান্ত। 

    নীল ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসে লবিতে দাঁড়াল। এখান থেকেও সমুদ্রটাকে স্পষ্ট দেখা যায়।

দাদা, নমস্কার।

    নীল তাকিয়ে দেখে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বছর ত্রিশ-বত্রিশের এক ভদ্রলোক। বেশ সুশ্রী। পরনে জলপাই রঙের বারমুডা আর সাদা একটি টি সার্ট। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি নিয়ে সুঠাম চেহারার ভদ্রলোকের চোখে কালো ফ্রেমের একটা চশমা।

প্রতুত্তরে নমস্কার জানায় সেও।

আপনি? সহাস্যে প্রশ্ন করে নীল।

"আমার নাম স্বদেশ। গড়িয়াতে আমার বাড়ি।
সস্ত্রীক চলে এসেছি পুরীতে উইক এন্ড কাটিয়ে ফিরব।" এই তো তিনশ দু নম্বরে উঠেছি। অনেকক্ষণ থেকেই আপনাকে দেখছি। আলাপ করার লোভ সামলাতে পারলাম না কিছুতেই। তাই যেচেই চলে এলাম। আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করেন নি?

    না না একেবারেই নয়। এতে মনে করার কি আছে বলুন তো। বরঞ্চ আমার খুব ভাল লাগল। অফিসের কাজ নিয়ে আমাকে মাঝে মাঝেই  আসতে হয় এখানে। আমাদের কোম্পানির একটা শাখা আছে এখানে, সেইজন্যই __নীল বলে ওঠে।

    ও হো! আপনার তো রথ দেখা আর কলা বেচা একসাথে হয়ে যাচ্ছে মশায়। হা হা করে হেসে উঠলেন স্বদেশ। আপনার নামটা তো জানাই হল না। সিগারেট খাবেন নাকি? বলে একটা গোল্ড ফ্লেক বাড়িয়ে দিলেন নীলের দিকে।

    এমনিতে  নীল সিগারেট খায় না বিশেষ। তবে আজ সে নিল। দুজনে ফস করে সিগারেট জ্বালাল একসাথে।

আমার নাম নীল। নীল রায়।

    বা বেশ সুন্দর নাম তো আপনার। আকাশ নীল। সমুদ্র নীল। আপনিও নীল। হা হা হা। আবার সেই প্রাণখোলা হাসি। একাই এসেছেন, সাথে বৌদিকে নিয়ে আসতে পারতেন। সমুদ্র সৈকত আমার দারুণ লাগে জানেন তো। সন্ধ্যায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পাড়ে বসে থাকব। বেশ লাগে জানেন, সব পিছুটান নিমেষে ভুলে শুধু বসে বসে ঢেউ গুনতে।

    স্বদেশের প্রাণখোলা হাসি আর আলাপচারিতায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের দুজনের সখ্যতা হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওদের আড্ডা চলল। কিছুক্ষণ পরে স্বদেশ নীলকে নিজেদের রুমে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে নীল প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল বটে। তবে স্বদেশের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। 

    ডোর বেল বাজাতেই স্বদেশের স্ত্রী দরজা খুলে দিল। স্বদেশ বলল__ সোনালি, ইনি হলেন নীল। আমাদের নেবার। তাই আলাপ করে ফেললাম, প্রতিবেশী বলে কথা। কি বলো?

আসুন আসুন। সোনালি সহাস্যে আমন্ত্রণ করেন নীলকে।

    নীল আর স্বদেশ সোফাতে বসে।  সোনালি বসল বিছানায়। বাঙালির আড্ডা হবে আর চা হবে না, এরকম কখনো হয় কি! এক্ষেত্রেও তা হল না। রিসেপশনে ফোন করে তিন কাপ চায়ের অর্ডার হল। এইমাত্র চা খেয়েছি আমি, নীল বলল বটে। তবে তার সেই ওজর আপত্তি ধোপেও টিকল না।

সোনালি যেমন নাম। তেমনই তার গায়ের রঙ। গমের মতন ফর্সা। বড় বড় চোখ। সুন্দর করে আঁকা ভ্রূ যুগল আর তার তলায় কালো দুটো চোখ যেন কালো দুটো ভ্রমর। সোনালি তার দেহ সৌষ্টভকে অতি  যত্ন সহকারে ধরে রেখেছে। বয়স সোনালির ত্রিশের ঘর পার করেছে বেশ কয়েকবছর হল।  তবে দেখলে চট করে আন্দাজ করা মুসকিল। সব মিলিয়ে ওকে সুন্দরী বলা যেতেই পারে এবং পুরুষমানুষের হৃদকম্পন বাড়ানোর জন্য এ রূপ যথেষ্ট। একটা হলুদ রঙের হাউসকোটে সোনালিকে একটি বউকথাকও পাখির মতন লাগছিল নীলের।

আপনারা সমুদ্রে যাবেন না? নীল
বলে ওঠে।

    না এখন এই রোদে আর বেরোব না, গেলে সেই সন্ধ্যায় আর আগামীকাল সকালে সমুদ্র স্নান_সোনালি বলে ওঠে।

    চা আসে। চা খাওয়ার শেষে আরো কিছুক্ষণ গল্পস্বল্পের পর নীল নিজ রুমে ফিরে আসে। ফিরে এসে দেখে তাঁর ফোনে ছটা মিসকল। ফোনটা সে ভুল করে ছেড়ে গেছিল। মিস কল তাঁর স্ত্রীর। সাথে সাথে কল ব্যাক। প্রথমে ও প্রান্ত গরম হয়ে গেল, একপ্রস্থ ঝড় উঠল।তারপর কিছুক্ষণ পরে শান্ত হলে ঝড়, ফোন কাটল নীল। স্নান সেরে, ফোন করে রুমেই খাবার আনাল। খেয়ে দেয়ে হোয়াটস অ্যাপে কিছু মেসেজ চেক করে, অফিসের কিছু দরকারি মেইল চেক করে, শুয়ে পড়ল সে। ভরা পেটে বিছানায় পড়তেই  অচিরেই ঘুম এসে গেল তাঁর।

    ঘুম ভাঙল ডোর বেলের আওয়াজে। দরজা খুলে দেখে স্বদেশ আর সোনালী। ওরা তৈরি হয়ে সমুদ্র পাড়ে যাচ্ছে। সোনালি স্কার্ট আর টপ পরেছে। তাকে বাচ্চা মেয়েদের মত লাগছিল। স্বদেশ সেই বারমুডাটা আর টি শার্টটাই পরেছে। তবে এখন মাথায় রয়েছে তার একটি বেতের তৈরি হ্যাট।

    ঘুমোচ্ছিলেন বুঝি? আমরা সমুদ্রের পাড়ে যাচ্ছি। ভাবলাম আপনি যাবেন কি না? তাই ডাকলাম__ স্বদেশ বলে ওঠে।

আচ্ছা। আপনারা এগোন আমি একটু পরেই আসছি___নীল সহাস্যে বলে ওঠে।

    স্বদেশ আর সোনালি চলে গেলে। নীল মুখ হাত ধুয়ে। একটা জিন্স আর টি শার্ট পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে এগোল সমুদ্রর পাড়ের দিকে। পুরীর সমুদ্র পাড় সন্ধ্যায় একটা বড়সড় বাজারের মতন। দোকান আছে বেশ কিছু। চা, ঝালমুড়ি, ফুচকা তো আছেই। এছাড়া রাস্তার উপর বেশ কিছু দোকান। সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাঁটতে থাকে সে। জল এসে এসে ফিরে ফিরে যাচ্ছে, তার সাথে সাথে পরাণ জুড়ানো হাওয়া।

    এই যে আমরা এখানে স্যার___স্বদেশের উল্লাস ভরা আওয়াজে, নীল তাকিয়ে দেখে ওরা দুজনে সমুদ্রের পাড়ে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে। ওদের একটু পাশেই এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা পায়ে তেল মালিশ করাচ্ছেন। নীল এগোল। এখানে চেয়ারের ভাড়া আছে। ঘন্টায় কুড়ি টাকা করে।

    এটা ওটা গল্প হল কিছুক্ষণ। চা, ঝালমুড়ি খাওয়া হয়। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে নীল হোটেলে ফিরে আসে। ওরা কেনাকাটা করতে যায় দুজনায়। কেনাকাটা করতে মেয়েদের বিশেষ ভাল লাগে। তাছাড়া ঘুরতে এসে, বাড়ির লোক, বন্ধুবান্ধবদের জন্য ছোট ছোট উপহার কিছু কিনতে তো হয়ই। এছাড়াও দামদর্ করে কেনার মধ্যে একটা মজা লুকিয়ে থাকে। একটা হার জিতের খেলা এটা। একটু কমাতে পারলেই মনে হয়, জিতে গেলাম। কিন্তু ক্রেতা কি কখনো জেতে? প্রশ্নটা থেকেই যায়। বলা যেতেই পারে অল্প হেরেছি অথবা বেশি হেরেছি কেনাবেচায়, কিন্তু হারে বারে বারে ক্রেতাই বোধহয়। তবু পতঙ্গের মত আগুনে সে ঝাঁপ দেয় প্রতিবার।

    সোনালি আর স্বদেশ দোকানে দোকানে ঘুরল কিছুক্ষণ। সোনালি কিছু মেয়েদের ব্যাগ কিনল। কিছু চাদর। স্বদেশ কিছুটা কাজু কিনল। এখানকার কাজুগুলি আয়তনে একটু বড় ও মুচমুচে হয়। সোনালি কেনাকাটা সেরে, একটা হোটেলে খেতে ঢুকল। খাওয়া দাওয়া সেরে একটু দেরী করেই ওরা ফিরল।

    নীলের কাল দশটার সময় অফিস। অফিস  থেকেই গাড়ি আসবে। একটা অফিসের ট্রেনিং সেশন রয়েছে। নতুন একটা প্রোডাক্ট লঞ্চ হবে তাঁদের। তাঁর একটা প্রেজেনটেশন আছে স্লাইড শোয়ের মাধ্যমে । সব ঠিক ঠাক আছে, তবু একটু দেখে নিল সে।

    স্বদেশ আর সোনালি বেশ আলাপি। ওরা নীলের সাথে বেশ ভাব করে নিয়েছে। নীল যদি সস্ত্রীক আসতো তাহলে বেশ ভালোই হত। কিন্তু সে আর হল না, কারন নীলের স্ত্রী মানে অনন্যার মায়ের বাড়িতে একটা নেমতন্ন ছিল। তাই ও এল না। পাশের রুমে দরজা খোলা বন্ধের আওয়াজে নীল বুঝতে পারল। ওরা দুজন ফিরল।

    রাত বাড়ছে। নীল দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে, তাই তাঁর চোখে ঘুম আসছিল না। সে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। দেখে স্বদেশ আর সোনালিও দাঁড়িয়ে আছে। স্বদেশ আবার সিগারেট বাড়াল। ওরা দুজনে সিগারেট জ্বালাল।

    আপনি কোথায় ডিনার করলেন? স্বদেশের প্রশ্নে নীল বলল_ হোটেলের রুম সার্ভিস নিয়ে নিয়েছিলাম। এদের তৈরি খাবার কিন্তু বেশ সুস্বাদু বুঝলেন স্বদেশ বাবু। আমি তো প্রায় আসি, এখানেই খাই, বলতে পারেন এদের খাবারের প্রেমে পড়ে গেছি। হা হা হা...
আপনারা কোথায় খেলেন?

আমরা ড্রাগন বলে খেলাম। স্বদেশ বলে ওঠেন।

আরো কিছু কথা হল দু একটা । সিগারেট শেষ করে নীল ঘরে চলে এল। ওরা তখনও বাইরে।

    নীল ঘুমোতে চেষ্টা করল। কিছুতেই ঘুম আসছে না। স্ত্রীর সাথে কথা হল। জানলা দিয়ে সমুদ্রের পাড়টাকে দেখা যাচ্ছে। একেবারে খালি,এখন পাড়ে কেউ নেই। শুধু আছে জল আর জল। দূরে টিম টিম আলো জ্বলা কোনো ট্রলার, রুজির সন্ধানে পাড়ি দিয়েছে। আকাশে আধখানা চাঁদের থেকে ঠিগরে পড়া আলোর ছটা সমুদ্রের বুকে এসে মিলেছে। নীলের বুকটা হু হু করছিল। এমন পরিবেশে সারা শরীরে একটা রোমাঞ্চ জেগে উঠছিল। সে জঙ্গলের বিরহকাতর কোনো এক পুরুষ পাখির মত কামাতুর হয়ে উঠছিল। অনন্যার জন্য মন কেমন করছিল তাঁর।  ঘুমের জায়গা পরিবর্তনের জন্য হোক বা দুপুরে একটু বেশী ঘুমের কারনেই হোক নীলের চোখে ঘুম আসছে না কিছুতেই। কিছুক্ষণ বিছানার উপর উসখুস করে সে ঘর ছেড়ে বাইরে লনটাতে এল। হাওয়া আসছে খুব। স্বদেশদের ঘরের দরজা এখন বন্ধ। ওরা ঘুমিয়েছে বোধহয়। নীল রেলিংএর ওপর ভর দিয়ে রাতের সমুদ্রর রূপ আহরণ করতে লাগল। মনটাও তাঁর ঐ সমুদ্রের বাতাসের মতন হু হু করছিল অনন্যার জন্য। এমনি সুন্দর হাওয়া, মায়াবী জোছনা ভরা রাত। আর সে একা। এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নীল হারিয়ে যাচ্ছিল চিন্তার শ্রোতে। হঠাৎই একটা আওয়াজে তার সম্বিত ফিরল।

    আওয়াজটার উৎসটা স্বদেশদের ঘর থেকেই।  ওদের ঘরের লাইট গুলো জ্বলে উঠেছে এখন। এত রাতে ওরা জেগে। ঘড়িতে রাত দেড়টা তখন।

    হঠাৎই একটা জোড়ালো আওয়াজ।
নীল স্পষ্ট শুনতে পেল। সোনালি চিৎকার করে বলছে, " কিল দ্যাট বাস্টার্ড!
আমাকে জঘন্য ভাবে ছুঁয়েছে শয়তানটা" জাস্ট কিল! কিল স্বদেশ! ডোন্ট লিভ" উত্তেজনায় সোনালি ইংরেজি বলছে।

    নীল মনে মনে ভাবছে সে কি ভুল শুনল! সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্থানুবতের মত দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এত রাতে ওদের ঘরে কে? কাকে মারার কথা বলছে সোনালি? এই কথাগুলি বারবার নীলকে ভাবাতে লাগল।  নীলের সারা শরীর ঘামতে লাগল। যদিও সমুদ্র অকৃপণ হিমেল হাওয়া ছড়িয়ে যাচ্ছিল সব কিছুকে উপেক্ষা করে।

    নীল কি করবে এখন? হোটেলের লোকজনকে ডাকবে, না কি স্বদেশদের ঘরে নক করবে। এই ভাবতে ভাবতে ঘেমে উঠল সে। একটু একটু ভয়ও করছে তার। অপরিচিত হোটেল প্রতিবেশী। ক্ষণিকের আলাপ।  এ কি ঝামেলায় পড়ল সে!  তাকে না আবার কোনো অযাচিত ঝামেলায় ফাঁসতে হয়।

"পালাবি পালা, শালা পালা, কতদূর যাবি, আমার বৌএর শরীরে হাত, তোর এতবড় সাহস! এখানেও পেছন ছাড়লি না", এবার  স্বদেশের গলার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেল নীল, আর  পরক্ষণেই একটা ভারি কিছুর আওয়াজ হল। "যা পৃথিবী থেকে পালা এবার বাস্টার্ড। আমার বউ এর গায়ে হাত, তোকে দুমড়ে মুচড়ে দেব, শয়তান!"।

    নীল থরথর করে কাঁপছে, ঘামছে সে কুলকুল করে।  সে দেখতে পাচ্ছে আগামীকাল পুলিশ যখন আসবে, ওদের সাথে তাকেও থানায় যেতে হচ্ছে। কাল অফিস মিট। সে কি করবে? এখনই পালাবে নাকি।  না না, তা কি করে হয়  তাহলে তো সন্দেহটা তার দিকেই ধেয়ে আসবে।

"কাল ভোরে ভোরে লাশটা পাচার করে দেব খন। এখন পড়ে থাক ও ব্যালকনিতে। এস সোনা শুয়ে পড়। আমি থাকতে তোমার ভয় কি! স্বদেশ সোনালির উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে"।

    কিছুক্ষণ পরেই লাইট বন্ধ হল তিনশ দুই এ। আবার সব চুপচাপ। নিশ্চুপ। যেন কিছুই ঘটে নি। সমুদ্রের ঢেউ এর আওয়াজ আর হাওয়ার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না এখন। 

    নীল আর দাঁড়াবার সাহস করল না, কোনোমতে ঘামতে ঘামতে নীল পায়ে পায়ে নিজের রুমে এসে ঢুকল, আস্তে করে দরজা দিয়ে, চোখে মুখে জল দিল কিছুটা। তারপরে ঘুমোতে চেষ্টা করল।

    ঘুম কিন্তু এল না। আসবেই বা কিভাবে? পাশের ঘরে একটা খুন হয়েছে। যার ঘটনাবলী সে নিজের কানে শুনেছে। কাল হয়ত থানাতে তাকে সাক্ষীও দিতে হবে। কি উটকো ঝামেলায় ফাঁসল সে এবারে।

    এভাবেই রাত ভোর হল। সকালে আবার বৃষ্টি হল একপ্রস্থ। ভোর হতেই সে তৈরি হয়ে নিল। ভোরে ভোরেই বেরোবে সে। ফ্রেস হয়ে   ফাইল নিয়ে ঘর থেকে বেরোতেই দেখে  স্বদেশ দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের বাইরে নির্বিকার। চোখে মুখে কোনরূপ অস্থিরতা নেই। কালকের ঘটনার কোনরূপ ছাপ নেই মুখের উপর।

    তাহলে কি লাশ লোপাট করে দিয়েছে ভোর রাতেই?__নীল মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে।

    সুপ্রভাত দাদা। সাত সকালে কোথায় চললেন। আপনার তো দশটায় যাওয়ার কথা ছিল__স্বদেশ প্রশ্ন করে নীলকে।

    একজন খুনী কিভাবে এতটা নির্লিপ্ত হতে পারে?  নীল কিছুতেই বুঝতে পারছে না। বডিটা কি তাহলে  সরিয়ে ফেলেছে নাকি?  নাকি সে কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখল? নীল ভাবতে থাকে নিশ্চুপ। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে___ভাবলাম একটু আগেই বেরোই। আপনারা সমুদ্রের পাড়ে যাবেন না। একটা দেঁতো হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল সে।

    যাব সোনালি তৈরি হচ্ছে। বাইরে আসলেই যাব_ স্বদেশ বলে ওঠে।

আপনিও চলুন না আমাদের সাথে। আমাদের কটা ছবি তুলে দেবেন___হাসতে হাসতে সোনালি বেরিয়ে এসে বলল।

    নীল ভাবছে সে কি বলবে?  সুন্দরী তরুণীর আমন্ত্রণ অস্বীকার করবে, নাকি রাজি হয়ে যাবে। একটু পরেই যখন জানাজানি হবে, তখন। কিছু বলে ওঠার আগেই স্বদেশ হাত ধরে টানতে লাগল নীলের __চলুন তো।

    না না আপনারা যান। আমার একটা কাজ আছে। কিছু মনে করবেন না প্লিজ। এই বলে নীল ওদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারটা কোনোভাবে এড়াল।

    ওরা দুজনে বেরিয়ে যেতেই। নীল এক ছুটে রিসেপশনে গেল। সেখানে গিয়ে সে বলল রুম নম্বর তিনশো দুই নম্বরে খুন হয়েছে কাল রাতে। সে নিজের কানে শুনেছে। খুনিরা এখন বাইরে গেছে, কিন্তু ডেডবডি এখনো ব্যালকনিতেই আছে নিশ্চয়ই। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ওদের রুম খুললেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে।

    রিসেপশনে বসে থাকা ভদ্রলোকটি খবরের কাগজ পড়ছিলেন এক কাপ চা নিয়ে হাতে। নীলের কথা শুনে চমকে উঠলেন। হাত থেকে চায়ের কাপ চলকে বেশ কিছুটা চা পড়ে গেল।খবরের কাগজ ফেলে বলে উঠলেন__কি বলছেন আপনি? খুউউউন!

নীল বলে__হ্যাঁ খুন! খুন! খুন মানে মার্ডার।

রিসেপশনে বসে থাকা ভদ্রলোকটি  বলেন___ ওনারা চাবি ছেড়ে গেছেন।

    হোটেল ম্যানেজারের কাছে ফোন যায়, সে প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, ওনাদের অনুপস্থিতি ওদের ঘর খুলতে। কিন্তু নীল যখন বলে__যে ওনারা যদি  ঘর না খোলেন,তাহলে সে পুলিশে খবর দেবে। আর যখন পুলিশ আসবে, আপনার হোটেলের বদনাম হবে।

    ম্যানেজার রাতের সিসি টিভি ফুটেজ দেখলেন ফাস্ট ফরোয়ার্ড মুডে, কাউকেই হোটেলের রুমের আসেপাশে দেখা যায় না। নীলকে লবিতে দেখা যায়।

    ম্যানেজার বাবু  নীলকে বলেন__যে বোর্ডারের অনুমতি ছাড়া ওনার রুমে প্রবেশ করা ঠিক হবে না। ওদের ডাকা হোক। তারপর রুমে ঢুকে দেখা যাবে। লাশ থাকলে পুলিশে কল করা হবে

নীল বলে কিন্তু ওদের বললে তো হবে না, যে আমি বলেছি, অন্য কিছু বলে ঢুকতে হবে ওনাদের ঘরে।

ম্যানেজার বাবু নীলকে বলেন__সেটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন ।

এরপর ম্যানেজার বাবু স্বদেশের মোবাইলে ফোন করলেন।

    সমুদ্রর পাড়ে প্রাতঃভ্রমণের মজাই আলাদা, সোনালির চটি আর নিজের চটি জোড়া হাতে নিয়ে স্বদেশ হাঁটছিল আর সোনালি জলে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে হাঁটছিল। ঢেউ এসে নগ্ন পায়ে চুম্বন করে ফিরে যাচ্ছিল, পরক্ষণেই আবার ফিরে আসছিল। আনন্দে উচ্ছলে সোনালি এক মুক্ত বিহঙ্গের মতন দু হাত ছড়িয়ে উপভোগ করছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বদেশ ফ্রেমবন্দি করছিল ভোরের সূর্যের আলোকে শুভ্র ঢেউএর পাড়ে আছড়ে পড়ার ছবি আর সাথে সাথে সোনালির ছবি।

    ঠিক তখনই পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। হোটেল ম্যানেজারের ফোন। ডাকছে ওদেরকে তাড়াতাড়ি , ফোন ঠিক করতে এসেছে। কাল তো ঠিকই ছিল ফোন, বিগড়াল কখন ফোনটা? স্বদেশের রাগ হচ্ছিল। তবু সে বলল__আচ্ছা আসছি।

    কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরল। ম্যানেজার বাবু একজন লোককে নিয়ে ওদের ঘরের দিকে এগোল।

    নীল ভাবল সে দশটাতেই যাবে অফিসের গাড়ি আসলে পরে। একবার ওদের ঘরে ঢুকে দেখতে হবে, যদি কিছু অপরাধের চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু কিভাবে ঢোকে সেটাই ভাবছিল সে।  নীল যেটা চাইছিল সেটাই হল।

স্বদেশ, নীলকে উদ্দেশ্যে করে বলল_ আপনি যান নি?

না এখনো যাই নি। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসলেন__নীল বলে ওঠে।

"আর বলবেন না। এই যে ম্যানেজার বাবু ফোন করলেন। তাই তো  চলে আসত হল। চলে আসুন আমাদের ঘরে। এক রাউন্ড চা হোক। তারপরে আপনি না হয় যাবেন আপনার অফিসে।

    সোনালির মুখ থমথমে। ফোন আসাতে বেশ বিরক্ত হয়েছে, সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

    ঘরে ঢুকে নীল দেখল, বিছানা একটু এলোমেলো। বিবাহিত দম্পতির বিছানা তা একটু এলোমেলো তো হবেই। আর তেমন কোন অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না নীলের। ম্যানেজার আর  নীলের সাথে চোখে চোখে কথা হল। ফোন নিয়ে লোকটা একটু ঘেঁটেই বলল ঠিক হয়ে গেছে ফোন, ঠিকঠাক ফোন ঠিক করতে আর কতটা সময় লাগে। ম্যানেজার বাবু ব্যলকনিতে গেলেন কিন্থু ওনার চোখে কোনোকিছুই পড়ল না।

    চায়ের অর্ডার হল। নীল বলল একটু ব্যালকনিতে যাব আপনাদের, ওখান থেকে সমুদ্র কেমন লাগে, দেখি। নীল গিয়েও কিছু দেখতে পেল না। তাহলে কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু কি ভাবে? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে নীলের।

ম্যানেজার বাবু একটু বিরক্ত দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকালেন। নীলের খুব খারাপ লাগতে লাগল। তবে কি সে ভুল শুনল?

    র মধ্যে চা এসে হাজির। ম্যানেজার বাবুর জন্যেও এসেছে। চা খেতে খেতে নীল কথাটা পাড়ল।

"স্বদেশ বাবু একটা কথা বলি, জানেন তো, কাল রাতে আমি একটা ভীষণ দু:স্বপ্ন দেখেছি। যার কারনে আমার মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত।

স্বদেশ আর সোনালি সমস্বরে বলে উঠল__কি দু:স্বপ্ন?

নীল কাল রাতের কথাগুলো স্বপ্নে'র ছলে ওদেরকে শোনাল । নীল থামতেই একটা অদ্ভুদ ঘটনা ঘটল।

    সোনালি লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, অপরদিকে স্বদেশ এত জোরে হেসে উঠল, যে ম্যানেজার বাবুর চায়ের কাপ একটু হলে হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল।

    তারপর স্বদেশ নীলের হাত ধরে বলল__আপনারা লাশটা খুঁজে পাননি তো! চলুন আমি  দেখাচ্ছি আপনাদের কে, ওটা ব্যলকনিতেই আছে। আপনি স্বপ্ন দেখেন নি নীল বাবু, সত্যি গতকাল আমাকে এই খুনটা করতেই হয়, না করে কোন উপায় ছিল না জানেন।  আপনিই বলুন, যদি কেউ আপনার চোখের সামনে আপনার স্ত্রীর  শ্লীলতাহানি করে। আপনি কি চুপ করে বসে থাকবেন? থাকবেন না নিশ্চয়ই। তাই আমিও থাকিনি। ও সোনালিকে বিশ্রী ভাবে ছোঁওয়ার পর, সোনালি যখন ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। আমি ওকে তাড়া করি, প্রথমে ও খাটের তলায় ঢোকে, ওখান থেকে তাড়া খেয়ে ব্যালকনির দিকে দৌড়াল। আমার হাতে তখন এই মোটা শরৎ রচনাবলিটা ছিল, এটা দিয়েই ওর মাথা আর শরীরটাকে চিঁড়েচ্যাপ্টা করে দিয়েছি। বাস্টার্ডটা ওখানেই পড়ে আছে। চলুন দেখাই আপনাদেরকে।

    ওরা সকলে মিলে গিয়ে দেখল ব্যালকনির এক কোনায় এখনো বডিটা নিথর হয়ে উল্টে পড়ে আছে। কিছু লাল  পিঁপড়ে এসে ভিড় জমিয়েছে ওর কাছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত পুরো দু-তিনমাসের খোরাকের জোগাড় হয়ে যাবে ওদের। 

    নীল অবাক চোখে দেখল চিত হয়ে শুয়ে থাকা বডিটার দিকে আর মনে মনে স্বগতোক্তি করল _  মৃত্যু অবধারিত জেনেও কেন যে তোরা সুন্দরী মহিলাদের প্রতি আকৃষ্ট হস বারে বারে কে জানে!

    নীল হাসতে হাসতে সোনালি আর স্বদেশের উদ্দেশ্যে বলল__ আচ্ছা, আমার অফিসের গাড়ি আসার সময় হচ্ছে। আমাকে এবার বেরোতে হবে। তবে যাবার সময় থানায় একটা খবর দিয়ে যাব যে, স্বদেশে বাবু বিদেশ বিভুঁইএ এসে একটা মার্ডার করে ফেলেছেন।

    স্বদেশ হাসতে হাসতে বলে_ আমি নিরুপায় ছিলাম দাদা। এছাড়া আর কোনো  উপায় ছিল না আমার।

    বিকালে কিন্তু আপনি আমাদের সাথে ডিনার করছেন নীল বাবু, এত বড় একটা রহস্য উন্মোচনের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে আপনার জন্য ট্রিট।

    আমার ভীষণ ভয় জানেন তো ঐ প্রাণীটিকে__ একগাল হেসে সোনালি বলে ওঠে।

    ম্যানেজার বাবু পিঁপড়ে ধরা বডিটাকে সরানোর জন্য ক্লিনার ডাকতে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন__আমি অন্তত দুঃখিত ম্যাডাম। এখনি আরশোলা মারার স্প্রে ভাল করে ছিটিয়ে দিতে বলছি, যাতে পুনরায় আপনাদের কোনো অযাচিত অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়।

সমাপ্ত

Susanta Kumar Santra