শ্রদ্ধার্ঘ্য
এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল
ঘুমানোর
আগে আধ শোওয়া হয়ে মোবাইলে ফেসবুক ঘাঁটছি । বছর খানেক হল হেডমিসট্রেস
হিসেবে জয়েন করেছি আমার নিজেরই স্কুলে।এ এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। এই স্কুল
থেকেই আমি মাধ্যমিক পাস করি। এই পদে বহাল হবার পর থেকে ফেসবু টেসবুক করার
সময় খুবই কম পাই । ওই ঘুমানোর আগে মিনিট দশ পনেরো বা আধ ঘণ্টাটাক ।
বরাবরই
আমি বেশি রাত জাগি না। মোটামুটি এগারোটা সওয়া এগারোটায় লাইট অফ করে নিদ্রা
দেবীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দি।সবেমাত্র মধ্য চল্লিশ । অনিদ্রা রোগ কাকে বলে
এখনো জানিনা।
হঠাৎ
ফ্রেণ্ড সাজেসানের একটা প্রোফাইল পিকচারে চোখ আটকে গেল।প্রণতি রায়।আমাদের
বড়দি।কি চরম রাশভারি মানুষ ছিলেন। দোহারা চেহারা।উঁচু রাগী চোয়াল।দুটো
জ্বলন্ত চোখ আর দৃঢ় চিবুক।সব মিলিয়ে চরম ভয় আর ভক্তি মেশানো এক অনুভূতি কাজ
করত আমাদের ছাত্রীদের মধ্যে।
ছাত্রী বেলায় কোনো দিনও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস হয়নি।একটু অবাক হলাম ফেসবুকে ওনার প্রফাইল দেখে।ঢুকে পড়লাম ওনার ওয়ালে।
খুবই অল্প কিছু পোষ্ট , শেষ পোষ্টটা তাও আবার বছর খানেক আগের ।
দোনামনা করতে করতে ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্টটা পাঠিয়েই দিলাম।
এরপর
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। ভুলেও গেছি ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্ট পাঠানোর ব্যাপারটা
।হঠাৎ একদিন নোটিফিকেশনে দেখি ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্ট একসেপটেড বাই প্রণতি
রায়।খুব জানতে ইচ্ছা করল রাশভারি মানুষটা এখন কেমন আছেন। এখনও কি তেমনটাই
বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাওয়ানোর মতন মেজাজটা বহাল আছে ! এখনও কি আগের মতন
কোনও আর্ম চেয়ারে বসে বই পড়েন অনেক্ষণ! কোথায় আছেন! কিভাবে দিন কাটান!
প্রথমে
প্রোফাইল পিকচার আর কভার পিকচারে লাইক দিলাম।তারপরে ইনবক্সে প্রণাম জানিয়ে
নিজের নাম আর মাধ্যমিক কত সালের ছাত্রী লিখে,প্রশ্ন করে রাখলাম আপনি কেমন
আছেন ।উত্তর পাওয়ার আশা যদিও অতি ক্ষীণ ছিল।
সপ্তাখানেক
কেটে গেছে।কোনও উত্তর নেই।ইচ্ছা করেই লিখলাম, বড়দি যেখানেই থাকুন সুস্থ
থাকুন। ভালো থাকুন। আর আপনার স্নেহাশীষ থাকুক আমার সাথে।
আবারও
সপ্তাহ খানেক কেটে গেল।তবুও একদিন মাথায় কি খেয়াল চাপল লিখলাম, জানেন আমি
এখন কুসুমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন বড়দি হয়েছি। বড়দি, আপনার ফোন নম্বরটা
পেলে খুব ভালো হতো। প্রয়োজনে অনেক কিছু বিষয়ে আপনার থেকে পরামর্শ নিতাম।
তারপর
দিন সকালেই দেখলাম , প্রণতি রায় ফোন নম্বর দেননি বটে তবে লিখে রেখেছেন
,কিছু প্রয়োজন হলে মেসেজ কোরো। স্নেহাশীষ রইল। দেখলাম রাত বারোটায় মেসেজটা
করেছেন বড়দি।
ফোন নম্বর দেননি দেখে মনটা একটু দমে গেলেও শেষ পর্যন্ত রিপ্লাই করেছেন এটাই অনেক মনে হলো।
এর
মাসখানেক পরে স্কুলে ক্লাস ফাইভের ভর্তির ব্যাপারে একটু গোলোযোগের উদ্রেক
হলো। পরামর্শ চেয়ে মেসেজ করলাম।পরদিন সকালে দেখলাম , রাত একটা নাগাদ
রিপ্লাই করেছেন।গোলোযোগটা মোটামুটি মিটিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম ওনার পরামর্শ
মতন।
সেদিন
নার্ভটা সারাদিনই বেশ উত্তেজনায় টানটান ছিল। তাই ঘুম আসতে চাইছিল না
সহজে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল।ফেসবুক ঘেঁটে
যাচ্ছি।হঠাৎ দেখলাম রাত এগোরোটায় বড়দিকে করা ধন্যবাদ জানিয়ে যে মেসেজ
করেছিলাম তার উত্তর এসেছে।
সামনেই
স্কুলের এক শত বৎসর পূর্তির আনন্দানুষ্ঠান ।দিনক্ষণ জানিয়ে বড়দিকে
আমন্ত্রণ জানালাম।পোষ্টাল অ্যাড্রেস চাইলাম আমন্ত্রণ লিপি পাঠানোর জন্য।
উত্তর
এলো নতুন করে আর ঠিকানা জানাবার কিছু নেই।তুমি এই যে আন্তরিক আমন্ত্রণ
জানালে এই যথেষ্ট। লজ্জা পেলাম, তাইতো বটে, আগের সব বড়দি বা দিদিদের ঠিকানা
তো স্কুলেই যত্ন সহকারে অ্যাড্রেস রেজিষ্টারে রাখা থাকে।সেই দেখেই বিশেষ
বিশেষ অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়।
শত
বর্ষ উদযাপন কমিটি গঠিত হল। বিশাল ধুন্ধুমার আয়োজন।হাজারটা ঝামেলার মধ্যে
আলাদা করে আর আমন্ত্রণ পত্র প্রেরণ কমিটির কাছে খোঁজ নেওয়াও হলো না, আর
সবার সাথে প্রণতি রায় বড়দিকেও আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছে কিনা।
দিনে
তিনেকের প্রোগ্রামের আজ শেষ দিন।সেই সকাল এগারোটায় শুরু হয়েছে। আজ শেষের
প্রোগ্রামটাতে ম্যানেজিং কমিটির দাবী অনুযায়ী কলকাতার কোনও এক নামী
ব্যাণ্ডের দলকে আনা হয়েছে।রাত নটা বাজছে ।প্রোগ্রাম এখনও
তুঙ্গে।বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কার আর নেওয়া যাচ্ছিল না।দোতলায় আমার অফিস রুমে
এসে নিজের চেয়ারটায় অবসন্ন শরীরটা এলিয়ে দিলাম।সামনের বিশাল মাঠটার
এক্কেবারে শেষ প্রান্তে স্টেজ।এই রুমে শব্দের রেশ বেশ কম।আমার রুমের ভারি
পর্দাগুলোর পেছনে কাঁচের স্লাইডিং জানালাগুলো পুরো বন্ধ ।
টিউবের আলোটা চোখে জ্বালা ধরাচ্ছিল।নিভিয়ে দিলাম।তার বদলে ফলস্ সিলিং এর একটা রিসেস্ড বাল্ব জ্বেলে রাখলাম।
স্কুল
বিল্ডিংটা জমির উত্তর গা ঘেঁষে পূব পশ্চিম বরাবর অফিস সেকসান ।আর পশ্চিম
দিকের বিল্ডিংটা উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে বিশাল মাঠের পশ্চিম
বাউণ্ডারি বরাবর এগিয়ে গেছে মাঠের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ।
আমার
রুমের বাম দিকে ক্লার্ক গ্রুপ ডি ষ্টাফ দের বসার জায়গা একটা পার্টিশান এর
তফাতে।আর ডানদিকে টিচার্স রুম।আমার চেয়ারটা থেকে দু দিকের দুটো কাটা দরজা
দিয়ে একদিকে ক্লার্ক রুম আর একদিকে টিচার্স রুমটা দেখা যায়।লম্বা ফাঁকা
টিচার্স রুমটার সারি সারি চেয়ার আর খাঁ খাঁ টেবিলগুলো শুদ্ধ সমস্ত ঘরটা এই
রাতের পরিবেশে কেমন যেন অচেনা লাগল।একটা মাত্র টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে।আমি
শক্তি সম্পদের অপচয় একদম পছন্দ করিনা, এটা দারোয়ান দাদা এ কয়দিনে জেনে
গেছে, আর তেমন ভাবেই লোক বিহীন ঘরে সব আলো ফ্যান নিভিয়ে রাখাতে সচেষ্ট
থাকে।
আমার রুম,টিচার্সরুম, ক্লার্ক রুম এসবের সামনে বরাবর একটা লম্বা টানা করিডর।আর করিডরটার উত্তর দিকের বিশাল হলটা হলো লাইব্রেরী রুম।
হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল সামনের করিডরটাতে একফালি সরু আলো এসে পড়েছে লাইব্রেরী রুমের খোলা দরজাটা দিয়ে।
লাইব্রেরী
রুম আজকের দিনে তালা বন্ধ থাকারই কথা।এমনটা কেন হল !অনিচ্ছা সত্ত্বেও
উঠলাম।খোলা দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাইব্রেরীর খোলা দরজাটা দিয়ে
ঢুকলেই বামদিকের দেওয়ালে সুইচ বোর্ড। আলোটা নিভিয়ে দিতে ভেতরে ঢুকলাম।এ
আমার বড় প্রিয় জায়গা। সারি সারি বইয়ের রাকে আপন জন, বইয়েরা।মধ্যেটায় ফাঁকা
জায়গা।কয়েক সারি রিডিং টেবিল পাতা আছে।
চেয়ারে ও কে বসে ? আর এই আরাম চেয়ারটাই বা এলো কোথা থেকে?
আমাদের
সেই বড়দি প্রণতি রায় হাতের বইখানা মুড়ে আমার দিকে সরাসরি চাইলেন।মুখে
মৃদু হাসি।আমি প্রণাম করতে ভুলে যাই।অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করি বড়দি একা এখানে
বসে? কতক্ষণ এসেছেন? চলুন, আমার রুমে চলুন।
তিনি
হেসে বলেন , তোমার আমন্ত্রণ ভুলিনি ।কি ,খুশি তো! এই লাইব্রেরী হলটা আমার
বড় প্রিয় জায়গা। নিজের মনের মতন করে একে সাজিয়ে ছিলাম ।এই স্কুলে থাকতে
ছুটির পর বেশ কিছুটা সময় আমি এই লাইব্রেরীতেই কাটাতাম।যেখানেই থাকি না কেন
,আমি মনে মনে এখানকার আলো আঁধারি বাতাস এসবের সাথে মিশে থাকি ।এখানকার সব
কিছুর সাথে আমার আত্মা মিশে আছে। পরিবার জীবনে আবদ্ধ হইনি কোনও দিন। তাই
ছুটির শেষে বাড়ি ফেরার তাড়াও অনুভব করিনি কোনো দিন। এই লাইব্রেরিতে বসে কত
কিছু লিখেছি।
মনে
পড়ে গেল বড়দির প্রোফাইলে দেখেছিলাম ওনার লেখা কবিতার বই প্রকাশনের ছবি।বলি
, বড়দি এখনো লেখালেখি করেন নিশ্চয়ই।ম্লান হেসে বলেন আর হয়ে ওঠে না ওসব।
তবে
আমার সময়ে অফিস রুমের একটা স্টীল আলমারির মধ্যে একটা ফাইলে আমার লেখা বেশ
কিছু প্রবন্ধ ছিল।সেগুলো আর ছাপান হল না।ভুলেই গেছিলাম অনেকদিন সেসবগুলোর
কথা।
আমার
মনে পড়ে যায় এই একতলার একটা রুমে অনেক পরিত্যক্ত জিনিসের সাথে দুটো স্টীল
আলমারীও রয়েছে।কিন্তু তাতে কি আর আগের কোনো জিনিসপত্র পাওয়া যাবে! তবুও
বলি বড়দি, আমি দেখব , যদি লেখাগুলো থেকে থাকে কোথাও।
হঠাৎ মনে পড়ে এতক্ষণ ধরে কথাই বলে যাচ্ছি শুধু, প্রণামটুকুও করিনি পর্যন্ত।
নীচু হয়ে প্রণাম করতে যাই ।থাক থাক বলে তিনি মুহূর্তে চেয়ারটা ছেড়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরেন।
চারিদিকের ঝিম ধরা বাতাসে যেন আলোড়ন জাগে।
এক
ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্ষে আমার মজ্জা পর্যন্ত যেন কেঁপে ওঠে।চোখ মেলে
দেখি আমার রুমের চেয়ারেই বসে আছি।জানুয়ারীর তীব্র শীতেও আমার কপালে বিন্দু
বিন্দু ঘাম।
পরে জেনেছিলাম প্রণতি রায় আমার এই স্কুলে বড়দি হয়ে আসার বছর কয়েক আগেই মারা গেছিলেন।স্কুলে তাঁর শোক সভাও হয়ে গেছে।
আমাদের গ্রুপ ডি দিদি, শ্রদ্ধাদি বরাবরই পুরাতন সব কাগজ , ফাইল যত্ন করে রেখে দেন, এটা এই স্কুলে বড়দি হয়ে এসে থেকে দেখছি।
একদিন শ্রদ্ধাদির কাছে সেই ফাইল সম্বন্ধে জানতে চাই, আর পেয়েও যাই সেই ফাইল। প্রণতি রায়ের লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ।
আজ
ঘুমানোর আগে যথারীতি ফেসবুক ঘাঁটছি।নোটিফিকেশনে দেখলাম গতকাল রাত বারোটায়
,পোষ্টটাতে বড়দি লাভ রিঅ্যাক্সন দিয়েছেন।কিন্তু পোষ্টটাতে ঢুকে দেখলাম
ওখানে ওনার সেই রিঅ্যাক্সান নেই।
গতকাল
প্রণতি রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহটির ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বড়দিকে ট্যাগ
করে প্রবন্ধ সংগ্রহটির ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেছিলাম গতকাল রাত এগারোটায়।
আমাদের প্রিয় বড়দির প্রতি শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
:-সমাপ্ত: -
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি