নিনিয়া
জয়দীপ
প্রিয়
ফুলের নামে মেয়ের নাম রেখেছিলো 'নিনিয়া' । সে মেয়ে বেশীদিন বাঁচল না ।
সেবার ভাদ্রের শেষে মায়ের দয়ায় মারা গেল । সনাতন সামলে নিলেও মেনে নিতে
পারলো না বৈজয়ন্তী । সোমত্ত মেয়ে আবেগ বেশী , জীবন যৌবনে ভরপুর । দিন দিন
শুকিয়ে যেতে লাগলো । হাতে পায়ে আগের মতো জোর নেই । চুলে পাক ধরেছে । দেখে
মনে হয় একধাক্কায় মেয়েটার বয়স বাইশ থেকে বাহাত্তর হয়ে গেছে । সারাদিন কারুর
সাথে কথা বলে না । উঠানের এককোনায় নিনিয়া ফুলের বাগানে বসে থাকে । নিনিয়া
এক প্রকার বন্য ফুল দেখতে অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মতো তবে রঙটা বাদামি । একটা
মিষ্টি গন্ধ আছে । সেটা সবসময় পাওয়া যায় না রাতের দিকে বাতাসে ছড়িয়ে থাকে ।
লোকমুখে শোনা যায় সে গন্ধ নাকি সর্বনাশী যে মানুষ একবার পায় সে পাগল হয়ে
যায় । সনাতন কিংবা বৈজয়ন্তী কেউই এসব মানে না । তারা কোনোদিন এমন গন্ধ
পায়নি । বৈজয়ন্তীর প্রিয় ফুল । সারাদিন বাগানেই বসে থাকে রাতে কিছু একটা
মুখে দিয়ে দরজায় আগল দেয় । সনাতনকে পর্যন্ত ঢুকতে দেয়না । সনাতন বোঝে তাই
পাশের ঘরে রাত কাটায় । দোতলা বাড়ি সব মিলিয়ে ছয়খানা ঘর । বাড়িতে ঘরের তো
অভাব নেই লোকের অভাব ।
আষাঢ় মাসের রাত । মেঘে চাঁদ
ঢেকে রেখেছে । সনাতন বারান্দায় কয়েকবার পায়চারী করে কোনের চেয়ারে এসে বসলো ।
মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে । শুধু মেয়েটার মুখ মনে পরছে । বেঁচে থাকলে আজ
সংসারে লক্ষ্মী বিরাজ করতো । ঝলমল করতো এবাড়ির প্রতিটি কোনা । নিকষ কালো
আকাশের দিকে তাকিয়ে সনাতনের মনে হল নিনিয়া যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে ।
তাকে ডাকছে । সনাতন বুকের বাঁদিকে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো । সে
স্পষ্ট দেখতে পেল নিনিয়া কাছে এসে তার নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বুকে । সনাতন
তাকে জড়িয়ে ধরল । চোখভরা জল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ,'এতদিন কোথায় ছিলি মা?'
-'এইতো বাবা তুমি চলে এসো এখানে'
-'দাঁড়া তোর মাকে ডাকি'
-'মা চলে আসবে তুমি চলো'
-'চল মা '
সনাতন
মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে চলল বারান্দা পেরিয়ে ভুবনডাঙ্গা ছেড়ে এক অন্য জগতের
দিকে । বৈজয়ন্তী পড়ে থাকলো একা । ইহলোকের মায়া কাটিয়ে ফিরে যাবার সময় তখনও
আসেনি তার । নিনিয়া ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসের পরতে পরতে । গুমোট
ভাবটা এখন আর নেই, একটা ফিনফিনে হাওয়া বয়ে চলেছে বাড়িটার চারপাশে । কোথাও
বৃষ্টি হয়ে মেঘ হালকা হয়ে গেছে ।
***
হেলেদুলে
গাড়ি এগিয়ে চলেছে ভুবনডাঙ্গার মাটির পথ ধরে । লাল মাটির পথ । পথের দুধারে
কাশফুল ফুটেছে । সামনের মাসেই পুজো । হারু নিজের মনে কিছু একটা বিড়বিড় করছে
। ছইয়ের ভীতর থেকে রানী মুখ বাড়িয়ে বলল 'হারানকাকা কোথাও একটু জিরিয়ে নিতে
হবে মেয়েটার বোধহয় জ্বর এসেছে ' ।
হারু পিছন ফিরে বলল 'গ্রাম আসতে এখনও দুই ক্রোশ'
-'দেখোনা কোথাও দাঁড়ানো যায় কিনা '
-'দেখছি' ।
রানীর
ভাগ্য জন্ম থেকেই খারাপ । জন্মের পর মাকে খেল বিয়ের পর স্বামী সেই যে
পোয়াতি অবস্থায় বাপের ঘরে রেখে দেশান্তর হল পাঁচবছর আর কোন খবর নেই । বাপটা
ছিল সেও গতবছর ইহলোক ত্যাগ করেছে । হারু নিঃসন্তান । ছোটবেলা থেকে রানীকে
নিজের সন্তানের মতোই দেখেছে । এখন তার বাড়িতেই থাকে । রানীর ফুটফুটে একটা
মেয়ে আছে । বছর চার বয়স ।সাতদিন হল মায়ের দয়া হয়েছে । দূরগাঁয়ে ভালো কবরেজ
আছে সেখানেই যাচ্ছে হারু আর রানী সঙ্গে চারবছরের হেমন্তি । কিছু একটা দেখে
গরুগুলোকে থামালো হারু । গাড়ির নীচ থেকে লন্ঠনটা নিয়ে এগিয়ে গেল । রানী
ছইয়ের মধ্যে থেকেই জিজ্ঞাসা করলো 'কি হলগো কাকা থামলে কেন?' ।
-'একখান ভাঙ্গা বাড়ি আছে'
-রাতটুকু থাকা যাবে?'
-'দেখে আসছি' ।
কিছুক্ষণ
বাদে হারু লন্ঠন হাতে ফিরে এলো । ছইয়ের কাছে গিয়ে বলল ,'চল মা বারন্দায়
আগুন জ্বালা যাবে । ভোর হতে আর মাত্র আধপ্রহর,কোনরকমে কাটিয়ে দেব' ।
-'তাই চলো মেয়েটার গা তো জ্বরে পুড়ে গেল একটু জলপট্টি দিতে হবে' ।
হারু
জলের বালতি ,লন্ঠন আর দেশলাই বাক্স আর মাদুর নিলো । রানী হেমন্তিকে কোলে
নিয়ে দুটো ছেঁড়া কাঁথা নিয়ে নিলো । তারপর তারা দুজনে বারান্দায় গিয়ে আগুন
জ্বালালো । সামনেই একটা ফুলের বাগান । এরম ফুল আগে কখনো দেখিনি রানী বা
হারান । ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে কিন্তু রঙ বাদামী । একটা মিষ্টি সুবাস
ভেসে আসছে । মহুয়া ফুলের মাদকের থেকেও তীব্র। দুজনের শরীর খুবই ক্লান্ত হয়ে
এসেছে । বলদদুটো গেটের সামনের ঘাসগুলো চিবিয়ে যাচ্ছে । হরেন বালতিটা নিয়ে
উঠতে উঠতে বলল ,'আমি দেখি আশেপাশে কোথাও জল পাই কিনা'
-'একা ভয় করে',হারানের দিকে তাকিয়ে বলে রানী ।
-'আরে দূর আগুন আছে তো ভয় কিসের'
-'না'
-'জলটা তো নিয়ে আসতে হবে খুকিকে পট্টি দিবিনা'
-'সাবধানে যাও' ।
লন্ঠন
হাতে বাড়ির পিছনের দিকে গেল হারান , চারিদিকে ঘাসে ছেয়ে গেছে । কয়েকটা ঝি
ঝি ডেকে চলেছে । তারা থেমে গেলে যেন সময় থেমে যাবে । চারপাশের নিস্তব্ধতা
যেন হার মেনেছে এই ঝি ঝি র ডাকে তাই ওদের এত আনন্দ ।হারান লন্ঠন হাতে এগিয়ে
যায় জলের সন্ধানে ।মিষ্টি গন্ধটা এখনও তার পিছু ছারেনি । নিজেকে অন্যদিনের
থেকে একটু বেশী ক্লান্ত মনে হল যেন অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ । তবুও
সে চলেছে বিরামহীন ভাবে।এক বালতি জল তার দরকার ।
***
-'কে?'
-'আমি রানী'
-'কোলে ওটা..'
-'আমার মেয়ে হেমন্তি'
-'অ'
-'তোর মেয়ে নেই'
-'আমার ফুল আছে'
-'কি ফুল'
-'ওই যে উঠানের ওদিকে'
-'কি নাম ফুলগুলোর?ভারী মিষ্টি গন্ধ'
-'নিনিয়া , আমার মেয়ে'
-'ধুর ফুল আবার কারুর মেয়ে হয় নাকি'
-'তোর যেমন কথা কেন হবে না । ওরা রোজ আমার সাথে কথা বলে খেলা করে'
-'ধ্যাত যতসব বাজে কথা'
-'দেখবি?নিনিয়া একবার এদিকে আয়', লম্বা ডাক পারে বৈজয়ন্তী ।
একটা
ভারী হাওয়া বয়ে যায় বাড়িটার উঠান দিয়ে । ফুলগুলো রানীরদিকে তাকিয়ে হেসে
ওঠে । খিলখিল করে হেসে ওঠে রানী ও বৈজয়ন্তী দুজনেই । কোল থেকে হেমন্তিকে
নামিয়ে রানী বলে ,'যা ওদের সাথে সই পাতাগে যা আমি একটু জিরিয়ে নিই' ।
হেমন্তি কোল থেকে নেমে হাসতে হাসতে ফুলগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
'সই কৈ সই কৈ'।
পানের পিকটা ফেলে দিয়ে বৈজয়ন্তীও হাসতে হাসতে বলল 'ভারী মিষ্টি মেয়ে তোর আয় পান খাবি?' ।
রানী নিমগাছের ডালে বসতে বসতে বলল 'দে একখান জর্দা দিয়ে ' ।
বৈজয়ন্তী
উত্তর দেয়না । একটা বাতাস ভাঙা বাড়ির বারান্দায় ঘুরপাক খেতে থাকে । সেই
বাতাসে ছড়িয়ে আছে একটা মিষ্টি গন্ধ । মহুয়া ফুলের থেকেও তীব্র । ঘুম আসে
সেই গন্ধে । লোকে বলে সর্বনাশী এই সুবাস । যে একবার পায় সে পাগল হয়ে যায় ।
সেই বাতাস বারান্দা ছেড়ে উঠান তারপর গোটা বাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। শেষ রাতের
জ্যোৎস্না এসে পড়েছে নিনিয়া ফুলের ওপর । কয়েকটা ঝি ঝি ডেকে চলেছে , আর কেউ
কোথাও নেই ।
***
এরপর কেটে গেছে
বহুবছর । এখন সেই বাড়ি আর নেই । সরকারি পিচ রাস্তা হয়েছে । আশেপাশের জমিতে
কারখানা বসেছে । ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে । এখন অন্ধকার নেই কোথাও । শুধু
রয়েছে লোকমুখে প্রচলিত কয়েকটা গল্প । হারান ,রানী আর হেমন্তিকে সেদিন খুঁজে
পাওয়া যায়নি শুধু পরদিন মাঝমাঠে লোকেরা দুটো গরুকে মাঠের ধান খেতে দেখে
ধরে নিয়ে যায় খোঁয়াড়ে । কেউ নিতে আসেনি । পরে বিক্রি করে দেওয়া হয় । কেউ
কেউ বলে আজও নাকি একটা গরুর গাড়ির শব্দ পাওয়া যায় মাঝরাতে ওই পিচরাস্তায় ।
সন্ধ্যে বেলায় বাজারে বয়স্কদের আড্ডায় কিংবা শিশু না ঘুমলে মা এই গল্প বলে
শিশুকে ভয় দেখায় । শিশু ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় । তারপর তলিয়ে যায়
স্বপ্নদেশের গভীরে । সেখানে হয়তো দেখা হয় হেমন্তি কিংবা নিনিয়ার সঙ্গে ।
সবই লোককথা । এমন কত লোককথা ছড়িয়ে আছে আমাদের গাঁয়ে গঞ্জে । সবই কি সত্য
হয়!! কি জানি হতেও পারে ।।
[সমাপ্ত ]
Joydip