বুদ্ধিং যস্য
জয়তী রায় মুনিয়া
নাইজেরিয়ার লেগস বন্দর। দাঁড়িয়ে আছে চৌষট্টি হাজারটনের কার্গো জাহাজ,
এম ভি কনক -নারী। তার পেটের মধ্যে থেকে খালাস হল পোষা প্রাণীদের জন্য
খাবার। খাবার গুলো আনা হয়েছে আর্জেন্টিনা থেকে। একমাস ধরে নোঙর ফেলে আছে
এখানে। কাজ চলছে।
লেগস বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়বে আগামীকাল। লক্ষ্য হিউস্টন। মুম্বাই থেকে
যাত্রা শুরু হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ব্যস্ততা তুঙ্গে। ক্যাপ্টেন স্বামীনাথন ,
চিফ ইঞ্জিনিয়ার রণজিৎ সাহা , বাকি লোকজন সহ জাহাজে লোক প্রায় চল্লিশজন।
মাল খালাস করছে দশাসই চেহারার নাইজেরিয়ান কুলিরা। দারিদ্রতা এদের বানিয়ে
দিয়েছে রুক্ষ্ম। নৃশংস।
আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে , আমেরিকার হিউস্টন বন্দরে যাবে, জাহাজ কনক-নারী, তুলবে রাশিকৃত গম।
ফিস ফিস করে ক্যাপ্টেন বলে:
:হে চিফ! রাস্তা নিরাপদ নয়। প্রচুর আফ্রিকান জলদস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার তো নতুন বিয়ে। সোনা দানা আছে না কি?
বিরক্ত গলায় উত্তর দেয় চিফ রণজিৎ--সে আর বলতে স্যার! এত করে বারণ করলাম।
কিন্তু নতুন বউ। রোজ সাজবে গুজবে। রোজ একটা করে গয়না পরবে।
---দেখবে কে? তুমি?
---স্যার। সমুদ্রের লোনা জল। আর আকাশের পাখি। ওরাই দেখবে। সামনের পনেরোদিন তো ওরাই সঙ্গী আমাদের।
গলা খুলে হেসে উঠল দুই নাবিক। দুই পুরুষ। কিছুক্ষণ পরেই তারা পাড়ি দেবে ,
অতল গভীর রহস্যময় সাগর। পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। আধুনিকতম যন্ত্র হার
মেনে যায় প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার কথা আগাম জানান দিতে। আর সেই সঙ্গে
সাগরদস্যুর দল। এরা বেশিরভাগ দরিদ্র আফ্রিকান। যেমন দুরন্ত গতির, তেমনি
নিষ্ঠুর। ভয়ঙ্কর চেহারা। কালো, তালগাছের মত লম্বা, ক্রুর চাউনি। হাতের থাবা
এমন যে, তার মধ্যে ঢুকে যাবে মানুষের মাথা। খুব দ্রুত কাজ করে এরা। কথা না
শুনলে , নিমেষের মধ্যে গুলি চালিয়ে দেয়। অকারণ হত্যাও করে কখনো কখনো।
**********
পিছনে সাদা ফেনা উড়িয়ে নীল সাগরের বুক চিরে মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এম
ভি কনকনারী। সকাল নয়টা বেজে চার মিনিট । গন্তব্যর দিকে এগোতে আরো পনেরোদিন
বাকি...মানুষের হিসেবমতো। প্রকৃতির ক্ষমতা রাখে হিসেব উল্টে দেওয়ার।
জাহাজ যখন জলে, তখনো কাজ চলে। পেটের ভিতর পুরো কারখানা। মেশিনপত্র।
ইঞ্জিনরুম। উপরে ক্যাপ্টেন , অফিসারদের ঘর। খাবার মেস। ডেকের উপর পাতা
চেয়ার। পাশে বার। চেয়ারে পা তুলে অলস ভঙ্গিতে বসে ছিল রুণা। রণজিৎ পই পই
করে বলেছিল--তুমি চাইলে থেকে যেতে পারো। এই ট্রিপে জাহাজে কোনো মহিলা থাকছে
না। তুমি একলা হয়ে যাবে।
রুণা শোনেনি। এটা ওর হানিমুন ট্রিপ। কেউ না থাক --সেটাই তো ভালো।
নির্জনতার সঙ্গে ভাগ করে নেবে ভালোবাসা। ইঞ্জিনরুমে ডিউটি শেষ করেই , দুজনে
একসঙ্গে হয়। এই আর্জেন্টিনা থেকে ওরা ফিরে যাবে ভারতের দিকে। সেটা অনেক
লম্বা সফর।
সমুদ্র দেখে
দেখে আশ মেটেনা । জলের রঙ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে জলের চরিত্র। কখনো
রেগে যাচ্ছে, কখনো উতলা বাতাস আর লোনা জলের ঝাপটায় আদুরে, কখনো দার্শনিকের
মত নির্লিপ্ত। রুণা বক বক করে সাগরের জলের সঙ্গে, ডেকের রেলিংয়ে চিবুক
ঠেকিয়ে--গলা ছেড়ে গান শোনায়। মাঝসমুদ্রের জল শান্ত হয়ে তার সব আবেগ ধারণ
করে। মুগ্ধ রুনা ভাবে--সমুদ্রের মত প্রেমিক বাস্তবে কেন হয় না?
************
রণজিৎ ভীষণ খুঁত খুঁতে। সব কিছুতেই চিমটি কাটা মন্তব্য। জাহাজে ওঠার
আগে, গয়না দিল মা । তাতে এমন বলার কি দরকার ছিল যে--জাহাজে তোমায় কে দেখবে?
এমন কেউ বলে? গভীর অভিমান নিয়ে সাগরের দিকে তাকায় রুনা। প্রত্যেক
সম্পর্কের ভিতর ছোট্ট করে লুকিয়ে থাকে পরকীয়ার বীজ। রুণার মনে হয়, সাগর
যদি প্রেমিক হত তার? সে যাই বলুক, যত তুচ্ছ আবেগ, অভিমান--সাগর চুপ করে
শোনে। নিজের ভাষায় উত্তর দেয়। সব পুরুষের এই বোধ নেই। তাদের পুরুষালী
দুনিয়ায় মেয়েলী অভিমান ঠাঁই পায় না।
মনে পড়ে পার্থর কথা। আবোল তাবোল যাই বলত রুণা, পার্থ মন দিয়ে শুনত।
কিন্তু বিয়ের বাজারে ধনী রঞ্জিতের কাছে হেরে গেল পার্থ। কবি পাত্র কখনো
দাঁড়াতে পারে ইঞ্জিনয়রের কাছে? আজ মনে হয়, দিনের শেষে যদি অতৃপ্ত মন নিয়ে
সোনার পালঙ্কে শুতে হয়--তবে সেই সম্পর্ক, ব্যাংকের ভল্টে তুলে রাখা গয়নার
মত। নিরাপদ কিন্তু আটপৌরে জীবন থেকে অনেক দূরের।
**************
জাহাজে ডিনার সারা হয়ে যায়, সন্ধ্যে ছটার মধ্যে। তবে ইঞ্জিনরুম খোলা
সারারাত। শিফট ডিউটি চলে। আজ রাত নয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত ইঞ্জিনরুমে
থাকবে রণজিৎ। তাছাড়া , চিফ ইঞ্জিনয়রের ফোন খোলা থাকে সারারাত । স্ত্রীকে
সতর্ক করে এবং আদর করে রণজিৎ পা বাড়াল ইঞ্জিনরুমের দিকে। যা থাকে সমুদ্রের
জলের তলায়। জাহাজ শিল্পটাই অদ্ভুত। তার পেটের মধ্যে থাকে আমদানী রপ্তানীর
জিনিস। যার জন্য তাকে মনে করা হয় নারী। ship is she। আর sea is he।
**************
দরজায় প্রবল ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল রুণার। তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই দেখে রণজিৎ --
:জাহাজ আক্রমণ করতে আসছে জলদস্যুর দল। তোমার যা কিছু আছে নিয়ে চলো ক্যাপ্টেনের ঘরে।
রুণা
হতবাক। জলদস্যু? ---ফাস্ট--রণজিৎ তীব্র স্বরে বলল। হাউসকোট গায়ে চাপিয়ে ,
গয়নার পাউচ বগলদাবা করে ছুটে চলল, করিডরের শেষ মাথায় ক্যাপ্টেনের ঘরে।
স্বামীনাথন আর দুজন সিকিউরিটি গার্ড বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
---ভল্ট আমার ঘরে। ওরা এখানেই আসবে। রণজিৎ , তুমি বাকিদের দেখো। একটি
প্রাণ ও যেন না যায়। রুণা এখানে রইল। গো। যাও। আদেশ করল ক্যাপ্টেন।
বন্ধ দরজা। রণজিৎ কোথায় গেল কে জানে?
ক্যাপ্টেন বললেন--ওটা তোমার জুয়েলারি প্যাক? ভল্টে রাখো।
---আমার কাছেই থাক।
বলে হাত তুলে, মখমলের পাউচ দেখাল রুণা--এটা গায়ের চাদরের ফাঁকে ঢুকে যাবে।
---কি আছে? হিরে? ডায়মন্ড?
ম্লান মুখে মাথা নাড়ল রুণা। হিরের ছোট ছোট গয়না। দেখতে বড় না। কিন্তু প্রচুর দাম।
---are you sure? ওরা কিন্তু জানে, মহিলারা শরীরে গয়না লুকিয়ে রাখে। কিছুই বাঁচবে না। শুধু প্রাণ থাকলেই হল।
রুণা বিবর্ণ মুখে ঘাড় হেলায়। ক্যাপ্টেনের ঘরে সোফার কোনায় চুপ করে বসে থাকে। মিনিট পাঁচেক ও কাটেনা। দমদম ঘা পড়তে থাকে দরজায়:
:হে ক্যাপ্টেন । ওপেন দি ডোর। ক্যাপ্টেন--- গম্ভীর কর্কশ গলায় কেউ বলে।
সেই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন স্বামীনাথন যেন এক পাহাড় হয়ে যান। একাই
এগিয়ে এসে দরজা খোলেন। হুড়মুড় করে ঢোকে তিনজন অতিকায় কালো মানুষ।
প্রত্যেকের হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। মুখ ভাবলেশহীন। চোখ গুলো ঘুরছে। রুণার
মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। ক্যাপ্টেন গম্ভীর স্বরে বলল--
:হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? উত্তরে একটা লোক স্টেনগান সোজা ধরল তাক করে। মাতালের গলায় বলল:
:ওপেন ওপেন। ফাস্ট ফাস্ট। অন্য দুজন ভয়াল দৃষ্টিতে তাকাল রুণার দিকে।
দেরি করে লাভ নেই দেখে, ক্যাপ্টেন খুলে দিলেন , ভল্ট। ভিতরে ডলারের তাড়া
দেখে খুশিতে শিশ দিয়ে উঠল তারা। কোমর দুলিয়ে নেচে নিল একটু। তারপর ফিরল
রুণার দিকে---হে লেডি? ওপেন ব্রেসলেট।
এভরিথিং।
রুণা তাড়াতাড়ি লোহা বাঁধানো আর কানের যে সামান্য সোনা খুলে দিল। তারা সন্তুষ্ট হলো না। খুব চালাক এরা। বলল:
:নো। ইটস নট এনাফ! হু ইস শি?
চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওয়াইফ- শুনে কর্কশ রাগী গলায় বলল:
:লেটস গো টু ইয়োর রুম। ফাস্ট ফাস্ট।
একরকম
ঠেলতে ঠেলতে তাকে নিয়ে এল নিজের ঘরে। ক্যাপটেন দৌড়ে এলেন সঙ্গে। তন্ন তন্ন
করে খুঁজে বিশেষ কিছু পেল না। তবে, খুব একটা অ-খুশিও মনে হল না তাদের ।
এমনিতেই অনেক কিছু পেয়েছে। প্রচুর ডলার, শুকনো খাবার, দামী হুইস্কি --সব
নিয়ে--হে ক্যাপ্টেন। স্লিপ ওয়েল...বলে শিষ দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তের
মধ্যে রাত আর কুয়াশায় হারিয়ে গেল ওদের স্পিড বোট। যে হুকওয়ালা দড়ির মই
ঝুলিয়ে, জাহাজের রেলিং বেয়ে টপাটপ উঠে পড়েছিল, সেটাও সঙ্গে নিতে ভুলল না।
********
একটা প্রবল ঝড় যেন তছনছ করে দিল সকলকে। প্রাণের চেয়ে বড় আর কিছু নেই।
প্রাণ বেঁচে গেছে, এতেই খুশি সবাই। আফ্রিকান জলদস্যু এখন পৃথিবীর প্রায় সব
সাগর জুড়ে তান্ডব করে বেড়ায়। জাহাজে রক্ষী থাকে। কিন্তু দস্যুদের
হিংস্রতার কাছে তারা সব নস্যি। আক্রমণ হবে কি না হবে, পুরোটাই জাহাজের
ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সবাই রুণাকে নিয়ে পড়ল। গয়না কোথায় তোমার? হাতেই তো ছিল। কোথায় গেল?
রুণা
ধীর পায়ে উঠে, সামনেই রাখা ক্যাপ্টেনের মস্ত বড় গামবুট তুলে নিয়ে এল। সবার
অলক্ষ্যে ওটার মধ্যেই গয়নার মখমলের পাউচ ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে। রাখে বুদ্ধি
মারে কে?
................................. অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার