বরফ যখন গলল - অদিতি ঘোষ দস্তিদার

 বরফ যখন গলল
অদিতি ঘোষ দস্তিদার

 

 

 

-১-

ডাস্টবিনটা হাতে সবে তুলেছে, মিতুলের কানে এল একটা অদ্ভুত চিৎকার!
দেখেছ কান্ড! ঠিক পেছন পেছন এসেছে! অসহ্য!
এ ম্যা! ওর হাতে ওটা কী! ইসস, একটা মরা পাখি!
"ফেলো, এক্ষুনি ওটা ফেলো পুতুলি!"
কথা শোনার কোন লক্ষণই নেই!
"কী হল? ফেলো বলছি! শিগগির ফেলো! নোংরা! ডার্টি!"

খুব হাওয়া দিচ্ছে আজ! এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি! তাও কী ঠান্ডা এখনও এখানে! হপ্তাখানেক আগে হয়ে গেছে বরফঝড়! সেই বরফ আজ পর্যন্ত একটুও গলেনি! গলবে কী করে! দিনের বেলাতেও তো তাপমাত্রা শূন্যের বেশ নিচেই।
হাওয়ায় ময়লা ফেলার ড্রামটা রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। জানলা দিয়ে দেখতে পেয়েই মিতুল তাড়াতাড়ি গায়ে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে বেরিয়েছিল তুলে আনতে। পেছন পেছন দরজা ঠেলে কখন যে এই মেয়েটাও বাইরে চলে এসেছে, টের পায়নি!
ভুলেই গেছিল আজ শনিবার! পুতুলির স্কুল ছুটি।
বার বার বলাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে নিজেই ফেলে দিতে এগিয়ে এল মিতুল। পুতুলির ছোট্ট হাতের গোটা তালু জুড়ে শোয়া চোখ বোজা একটা চড়াইপাখি! কিন্তু মরা নয়! মাঝেমাঝে থরথর করে কাঁপছে পাখিটা!
'মরেনি এখনও, কিন্তু আয়ু আর ওর বেশি নেই!' চারপাশে তাকাল মিতুল। অন্য পাখিদের কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না, পাশের ঝোপঝাড়ে আছে হয়ত! মনে মনে একটু দোলাচলে পড়ল। ফেলে দিয়ে গেলে মরে যাবে নির্ঘাত! কিন্তু ঘরে রাখলেই কি বাঁচবে?
 ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে খুব! পাখিটা আবার কেঁপে উঠল! পুতুলি আর একটা হাত দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিল পাখিটাকে।
ড্রামটা গ্যারেজে রেখে পুতুলিকে ধরে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল মিতুল!
 

-২-

নিউ জার্সি ছেড়ে আপস্টেট নিউ ইর্য়কের এই হিমপুরী বাফেলোয় স্প্রিংব্রেক কাটাতে আসবে এটা আগে কোনদিন ভাবেনি মিতুল। কানাডার বর্ডারের কাছে এই বাফেলো! এক ফুট দু'ফুট বরফ পড়া এখানে জলভাত! এই সময় নিউ জার্সিতে কী  মজা, সত্যিই বোঝা যায় স্টেটটার নাম গার্ডেন স্টেট্ কেন। ঠান্ডা আছে ঠিকই, কিন্তু বনে বনে বসন্তের ছোয়াঁ। গাছে গাছে চেরি, ম্যাগনোলিয়া, এদিকে মাটিতে ড্যাফোডিল আর টিউলিপের পসরা। চারদিকে রঙের বাহার! বড্ড ভালোবাসত মিতুল এই সময়টাকে!
 কিন্তু এখন মিতুলের কাছে সব রংই ফিকে, ফ্যাকাশে - বরফের শীতলতা সারা মন জুড়ে। তাই স্প্রিংব্রেক পড়ার আগেই মাকে জানিয়েছিল মানি মানে মাসিকে জানিয়ে দিতে। ছুটির দশদিন ওখানেই কাটাবে!
মানি তো আনন্দে অস্থির! সত্যি বলতে কী একসময় তো মিতুল অন্ত প্রাণই ছিল মানির! মিতুল যখন এক বছরেরটি, তখনই মানি এদেশে এসেছিল পি এইচ ডি করতে - মিতুলদের বাড়ির কাছের একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ নিয়ে। এখান থেকেই তারপর পোস্ট ডক্টরেট শেষ করে কলেজে চাকরি। সবই কাছাকাছির মধ্যেই। চাকরি পাবার পর অবশ্য এপার্টমেন্ট কিনেছিল কিন্তু সে আর কত দূর? উইকেন্ড এলেই মানি এসে হাজির!
চাকরি করতে গিয়েই তো সুনুমেসোর সঙ্গে আলাপ হল! মানির কলিগের কাজিন!
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার! একেবারে যেন রাজপুত্তুর!
মানির যখন বিয়ে হল মিতুল তখন ফোর্থ গ্রেডে! কী ভালোই না বাসত সুনু মেসো!
সব গন্ডগোল হয়ে গেল এইটার জন্যে! পুতুলি!
যখন প্রথম শুনেছিল মানির বেবি আসছে, মিতুল আনন্দে আত্মহারা। কী খুশি বোনকে দেখে! ছোট্ট একটা ডল - সেই থেকেই তো নাম পুতুলি। বড় আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। তারপর সব আস্তে আস্তে কেমন যেন বদলে গেল। একদম ছোটতে বোঝা যায়নি, কিন্তু দিনে দিনে পুতুলি…  
মানি অবশ্য সারাক্ষণ বলে, "আমার পুতুলি একদম স্পেশ্যাল, সবার থেকে আলাদা তাই না সোনা?
পুতুলি তখন হাসে, কী বোঝে কে জানে, মানির চোখে তখন এক অজানা মায়া জ্বলজ্বল করে!
পুতুলি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অশান্তি শুরু মাসি মেসোয়, তারপর তো ডিভোর্স, মিতুল সে বছর নাইনে।  
সবাই ছি ছি করলেও মিতুল তেমন দোষ দিতে পারেনি মেসোকে। পুতুলিকে দেখলে তখন ওরই কেমন যেন লাগত! খালি এসে এসে চেপে জাপটে ধরে, লালায় গা ভিজে যায়, শরীরের মধ্যে কেমন যেন করে।
 অমন হ্যান্ডসাম মেসোর তো খারাপ লাগবেই, তাই না!
ডিভোর্সের পর পরই মানি নিউ জার্সি ছেড়ে পুতুলিকে সঙ্গে করে এই ধ্যাড়ধেড়ে বাফেলোয় চাকরি নিয়ে এল! খুব মন খারাপ হয়েছিল বাড়ির সবার! মিতুলের তো কথাই নেই। জ্ঞান হওয়া থেকে মানিই তো ছিল সব রকম আহ্লাদ পাবার উৎস! অনেকবার বলেছিল মাকে, “মানিকে বারণ কর না মা, যেন না যায়!”
মা একটাও কথা বলেনি উত্তরে। মিতুল নিজে তখন চেষ্টা করেছিল।
মানি মিতুলকে জড়িয়ে ধরে চুপ করেছিল অনেকক্ষণ। তারপর ওর মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলেছিল, “এই তো ঘন্টা কয়েকের রাস্তা, ছুটি পেলেই তুই চলে আসিস।”
কেন যাবে মিতুল? বয়েই গেছে! মানি কি একবারও ভেবেছে মিতুলের কষ্ট? এখন শুধু পুতুলিকে নিয়েই মত্ত, পুতুলি ছাড়া আর কেউ যেন কোনদিন ছিলই না!
মিতুল আগে বাফেলোয় একবারই এসেছে। বছরদুয়েক আগে। কানাডা যাবার পথে একদিনের হল্ট ছিল! মা এসেছে তারপর বেশ কয়েকবার, ও নানান অজুহাতে এড়িয়ে গেছে!  
মানি বোধহয় আন্দাজ করতে পারে মিতুলের অপছন্দের কারণ, কিন্তু বুঝতে দেয় না! মিতুল অবশ্য ভাবতেও পারেনি যে তার আসার কথা শুনে মানি এত খুশি হবে। ফোন করতে একটু বাধ বাধই লেগেছিল। আসার পরও যাকে বলে মাথায় করে রেখেছে। এত কাজের মধ্যেও সারাক্ষণ মিতুলের পছন্দ, সুবিধে অসুবিধে সব কিছুতেই তীক্ষ্ণ নজর! সামলে সামলে রাখে পুতুলিকেও। কিন্তু পুতুলি একটু ফাঁক পেলেই মিতুলের কাছে চলে আসে, আবোল তাবোল ভাষায় কী সব বলে, গায়ে মাথা ঘষে! যদিও পুতুলির আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে নানা রকম থেরাপির সুফলে, কিন্তু ওকে দেখলেই মিতুলের বড্ড বিরক্তি লাগে!

-৩-

ভেতরে এসে মিতুল আর একবার চেষ্টা করলো।
"পুতুলি, ওটা আমাকে দিয়ে দাও, ওরকম করে না, কথা শোন!"
পুতুলি সোজা ঘরের দিকে এগোল। পা টা একটু টেনে টেনে হাঁটে। ওকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমে হাত ধুতে যাবে, মানি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। একটা মিটিং ছিল সকালে, সেই সুযোগেই পুতুলি বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
"মানি, দেখ একটা পাখি বাইরে বরফে পড়েছিল, পুতুলি তুলে নিয়ে এসেছে।
"সে কী? দেখি মাগো তোমার হাতে ওটা কী?"
আলতো করে ওপরের হাতটা সরিয়ে পাখিটাকে দেখাল পুতুলি।
"ওমা! আহারে! ওকে এখন জুতোর বাক্সে তুলোর মধ্যে রাখতে হবে!"
আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে গেল মিতুলের।
সব ব্যবস্থা করে পাখিটাকে যখন জুতোর বাক্সে শোয়ান হল তখন তার কাঁপুনি একটু কমেছে! কথা না বাড়িয়ে মিতুল দোতলায় ওর ঘরে চলে গেল।

-৪-

চার বছর আগে, মিতুল যখন এইটথ গ্রেডে, ওদের পাড়ায় নতুন বাড়ি কিনে এল ম্যাথুরা। একই ক্লাসে ভর্তি হল। আস্তে আস্তে মিতুলের মনে ম্যাথু একটা পাকাপাকি জায়গা করে নিল, কিন্তু একথা আর কেউ জানল না। টেনথ গ্রেডের মাঝামাঝি একটা ফিল্ড ট্রিপে গিয়ে মিতুল জানতে পারল ম্যাথু ভালোবাসে মোরাকে।
 খুব মনখারাপ হয়েছিল কদিন। কিন্তু মেনে নিয়েছিল। মন দিয়েছিল পড়াশোনা, গান বাজনায়। তবে ম্যাথুর সঙ্গে বন্ধুত্ব আগের মতই ছিল।
দেখতে দেখতে ইলেভেন শেষ হয়ে টুয়েলভ। স্কুলের শেষ ধাপ। সিনিয়র ইয়ার।
ইলেভেনে থাকতেই কলেজে ঢোকার পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে মিতুলের। গরমের ছুটির পর আবার স্কুল!
ইন্ডিয়ায় যেতে হয়েছিল সেই ছুটিতেই মিতুলদের। দিম্মার শরীর হঠাৎ খারাপ হওয়ায়। মানিও গেছিল পুতুলিকে নিয়ে।
খুব জ্বালিয়েছিল পুতুলি সেখানেও। খুব রেগে গেছিল একদিন মিতুল! মা প্রচন্ড বকেছিল। শুধু দিম্মা বুঝেছিলেন মিতুলকে।
“বুঝি দিদি, তোর অভিমান, কী করবি বল, ওর তো বোধ নেই!”
নেই তো নেই! জেনে কী করবে মিতুল? মিতুল শুধু জানে, ওই মেয়েটার জন্যেই মাসি আর মেসোর আদর হারাতে হল!

-৫- 

ফিরে আসতেই ম্যাথুর মেসেজ ।
মোরার সঙ্গে ব্রেক আপ। ভীষণ ডিপ্রেশন!
মিতুল কি তখন মনে মনে খুশি হয়েছিল? অনেক ভেবেছে পরে, নিজের মনেই চলেছে অসংখ্য প্রশ্ন উত্তর! কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কিছুতেই ম্যাথুকে জানাবে না তার গোপন ভালোবাসার কথা।
 কিন্তু সব সংকল্পই ভেসে গেল বাঁধ ভাঙ্গা ভালবাসার তোড়ে!
সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি যেন এক নিমেষে কেটে গেল। মার্চের শেষে সিনিয়র প্রম। এদেশের হাইস্কুলের সবচেয়ে বড় উৎসব!
Promenade Dance!
এক এক জোড়া ছাত্র আর ছাত্রীর যুগলে নাচ। কিন্তু শুধু নাচ তো নয়, এই প্রম্ ঘিরে কত কত ভাবনা, রাগ অনুরাগের পালা।
মিতুলদের স্কুলে সিনিয়র প্রমে পরতে হয় লং গাউন।  
পাড়াতেই এক ঝাঁক বন্ধু মিতুলের! এতদিনে তারা সবাই জেনে গেছে ম্যাথু আর মনামী মানে মিতুলের সম্পর্কের কথা!
প্রম ড্রেস কিনতে যাবার কথা বন্ধুদের সঙ্গে। ম্যাথুও যাবে। কোন রঙে তাকে বেশি মানাবে সেটা বেছে দেবার জন্যে আবদার জানিয়ে রেখেছে মিতুল বেশ কিছুদিন আগে!
অপেক্ষা আর অপেক্ষা! এল না ম্যাথু। ফোন সুইচড অফ!
ড্রেস কেনা হল না। ফিরে এসে ম্যাথুর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ম্যাথু বাড়ি নেই। বেরিয়েছে মোরার সঙ্গে!

-৬-

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। পুতুলি আজ সারাদিন পাখিটার সামনে থেকে ওঠেনি। মানি ওখানেই খাইয়ে দিয়েছে। দুবার বাথরুমে নিয়ে গেছে জুতোর বাক্স সঙ্গে নিয়ে। স্পিচ থেরাপিস্ট এসে পাখির কাছেই বসেই পুতুলিকে ট্রেনিং দিয়ে গেছেন। মিতুলের কানে এসেছে সব। নিজেও একবার দেখে এসেছে খাবার সময় নিচে নেমে। পাখিটার কাঁপুনি কমেছে।  কিন্তু চোখ এখনও খোলেনি! আমল দিতে চাইছে না, তাও কেমন যেন একটা চাপা টেনশন হচ্ছে পাখিটাকে নিয়ে।
বাঁচবে তো?
আর একটা ভাবনাও মনে কেমন যেন  ঘুরপাক খাচ্ছে! পাখিটা মরে গেলে পুতুলির মনে কী রকম রিঅ্যাকসন হবে? মেয়েটার কি মৃত্যু বা বিচ্ছেদের বোধ আছে?
ভাবনাটা মুহূর্তের মধ্যেই আবার ঝেড়ে ফেলেও দিতে চাইছে মিতুল!
হলে হবে! মানি বুঝবে! মিতুলের কী? ও তো আর কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে যাবে!

-৭-

ম্যাথুর সঙ্গে মোরার ভাব হয়ে গেলো।  ম্যাথু অবশ্য এসেছিল ওকে সরি বলতে।
মিতুল কথা বাড়ায়নি।
বন্ধুবান্ধব কারুর সঙ্গে এই ব্যাপার নিয়ে একটুও কথা বলেনি মিতুল। তবুও কানে কথা তোলার লোকের অভাব ঘটেনি, তারা গায়ে পড়ে জানিয়ে গেছে আসলে ম্যাথু ওর সঙ্গে মিশেছিল যাতে মোরা জেলাস হয়ে ফিরে আসে।  
 নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছিল। প্রম্ নাইটে যায়নি। মা বাবা কিছু একটা আন্দাজ করেছিল কিন্তু একটাও প্রশ্ন
করেনি। পড়াশোনায় মন ঢেলে দিয়েছিল মিতুল। একটু চেষ্টা করতেই বিকেলের দিকে একটা কোচিং সেন্টারে কাজও পেয়ে গেছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই  স্প্রিং ব্রেক।  আর কদিন পরেই তো ছিটকে যাবে সবাই যে যার কলেজে, তাই অনেক প্ল্যান ছিল আগে থেকেই এবছর। কিন্তু মিতুলের একটুও ভাল লাগছিল না। পাড়ায় থাকলে বন্ধুরা ছাড়বে না। জোর করে এখান সেখান নিয়ে যাবে, এড়ানো মুশকিল। পুরনো প্রসঙ্গ তখন উঠবেই। সেইসব বিড়ম্বনার হাত থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়েই পাড়া ছাড়া এই ছুটিতে!  
আর কটা দিনই বা স্কুল! জুনের মাঝামাঝি অবধি। আগে থেকেই প্ল্যান আছে, সামারে মানে জুন, জুলাই আগস্টে কিছু অ্যাপ্রেন্টিসের কাজ করবে দূরের একটা কলেজে! থাকবে সেখানেই! তারপর ফিরে এসেই সেপ্টেম্বরে চলে যাবে পাকাপাকিভাবে চার বছরের কলেজে! মাঝে কোনরকমে এই স্প্রিং ব্রেকটা কাটানো। মা বাবার এই সময় পুরোদমে কাজ। তাই মিতুল ছুটি নেবার অনুরোধ করতে চায়নি। পাড়া ছেড়ে থাকার এছাড়া আলাদা কোন অপশন আর ছিল না। তাই একরকম বাধ্য হয়েই মানির কাছে চলে এসেছে।  

 -৮-

পুরোনো কথা মনে আসতে আবার বুকের ভেতরে মোচড় দিল। এখন মিতুল একটু একটু বুঝতে পারে কেন মানি পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে এত দূরে চলে এসেছিল। চেনা চারপাশ আরও যেন বাড়িয়ে দেয় বিচ্ছেদের বেদনা।
মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে একটু জোরে গান চালিয়ে দিল মিতুল। আর তখনই মানি এসে দরজায় দাঁড়াল।
"কী করি বলতো? কাঁপুনি তো কমেছে, কিন্তু কিছু খেতে তো দিতে হবে পাখিটাকে, তাই না? দুধ দেব?"
আবার সেই পাখি? উফফ! উত্তর দিতে ইচ্ছে না করলেও মিতুল বলে ওঠে,
"পাখিরা তো ম্যামাল নয়! দুধ খাবে?"
"তাহলে? বাড়িতে বার্ড ফুড আছে দেব?''  
 যেমন মা তেমন মানি! শীতকালে পাখিরা খাবার পায় না বলে বাইরে বার্ড ফিডার ভরে ভরে খাবার রাখে!
"কিন্তু সে তো শক্ত দানা মানি!"
"জলে ভিজিয়ে নরম করে দেব? আসবি তুই একটু? আমার কেমন ভয় ভয় করছে!"
যত সব পাগলের কান্ড! মুখে কিছু না বলে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাধ্য হয়েই গান বন্ধ করে উঠে আসে মিতুল।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় মানি। মিতুলের হাতদুটো ধরে বলে ওঠে, “পাখিটা যদি না বাঁচে কী হবে বলতো? মেয়েটা এমন করে ওকে নিয়ে বসে আছে - আমি আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না!"
 বুকের মধ্যেটা এবার মুচড়ে উঠল মিতুলের! মানিকে কোনদিন এত অসহায় দেখেনি। সব সময় স্ট্রং, সেলফ ডিপেন্ডেন্ট!  একই সমস্যা নিয়ে ভাবা একটু আগের চিন্তাগুলোয় নিজেকে বড্ড ছোট মনে হল। কিন্তু কী ই বা করতে পারে মিতুল?
হঠাৎ জলে ডোবা মানুষের হাতে যেন খড়কুটো!  
"মানি, ওকে ORS খাওয়ালে হয়না? মানে নুন চিনির জল?"
"দেওয়া যায় পাখিদের?"
"মনে তো হয়, দাঁড়াও গুগুল করি..., মানি মানি, এই দ্যাখো…"
ফোনের দিকে একঝলক তাকিয়েই মানির বিষণ্ণ চোখে ঝিলিক!
হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে মাসি বোনঝি।
নেমে এসে আবার থমকে দাঁড়ায় মিতুল।
"মানি লেখা ছিল ইলেক্ট্রোলাইট, নুন চিনির জলের কথা তো স্পষ্ট করে বলা নেই! ঠিকঠাক প্রোপোরশনটা তো হবে না!"
"মনে পড়েছে, ঘরে আছে রে! মাসখানেক আগে পুতুলির পেট খারাপ হয়ে ছিল, তখন কেনা হয়েছিল। মনে হচ্ছে ওটা আরো পাতলা করে দিলেই হবে।"  

তুলোয় ভিজিয়ে এক এক ড্রপ পাখিটার ঠোঁটে ফেলে মিতুল। গড়িয়ে পড়ে যায় বেশির ভাগটাই! বার বার পাখিটার বুকের দিকে তাকায়। বেঁচে আছে! খুব ক্ষীণ হলেও ছোট্ট সাদা পেটটা ওঠানামা করছে। চোখ এখনো বোজা।
সময় কেটে যাচ্ছে। এক মিনিটও অন্য দিকে তাকাচ্ছে না কেউ। হঠাৎ ঠোঁটদুটো একটুখানি ফাঁক করলো পাখিটা!
সুযোগ বুঝে তক্ষুনি এক ড্রপ জল ঢেলে দিল মিতুল। তারপর আলতো করে হাতে তুলে নিল পাখিটাকে।
"একটু সোজা করে রাখি মানি, বলা তো যায় না যদি চোক করে!"
পাখিটা খানিক পরে আবার হাঁ করল। আবার।   
আবার। আবার। ঘন ঘন।  
তারপরই চোখটা খুললো।
মাসি আর বোনঝির মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি! আলতো করে পাখিটাকে বাক্সে শুইয়ে দিল মিতুল।
পুতুলি তখনি মিতুলকে জোরে চেপে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষতে লাগল। সঙ্গে অবোধ্য কথা।
মিতুলের সারা মুখে লালা! সেই ভাবেই ছোট বোনকে এই প্রথমবার জড়িয়ে ধরল দিদি!

পাখিটা ডানা ঝাপটাল।  বিরাট দুজোড়া ডানা! আদর করে ঘিরে নিচ্ছে মিতুল আর পুতুলিকে। কী নরম ওর বুক, কী ওম পালকের গভীরে…।


..................................

অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার