রসিকের সংসার - ভবেশ দাস



রসিকের সংসার
ভবেশ দাস
 

 
 

সাধন চট্টোপাধ্যায়ের এক এবং অনাদী স্ত্রী মায়ারানি ছাড়া এলাকার সকলেই বেশ রসিক মানুষ বলেই জানে। এ হেন অভিযোগের একটা কারণ অবশ্য আছে। সাধনবাবু একটু হিসেবী মানুষ। বাইরের দুনিয়ায় না হলেও নিজ সম্রাজ্যে সকল হিসেবী পুরুষদের কিপ্টে বলে তাচ্ছিল্য করা হয়। এ কথা শাস্ত্রে না হলেও গৃহবিজ্ঞানে উল্লিখিত। 
 
ছুটির দিনে বাজার যাবার আগে আর এক প্রস্থ চায়ের আবদারে তার গিন্নি মুখে অগ্নিশলাকা সংযোগে বলে উঠেন, "রসিক না আরোকিছু। ও সব বাইরের লোকের কাছে রঙ্গ-তামাশা করে ভালো সেজে থাকা। ও হচ্ছে, ঘর জ্বলানে পর ঢলানে ব্যাটাছেলে। আমার জীবন পোড়া কাঠ-কয়লা করে দিলে গা।" সাধনবাবু ব্যাগ নিয়ে বেরবার সময় মৃদু হেসে বলে যান," বাক্যহীনা ভার্যা সংসারে শান্তির ফলদায়িনী।"
 
 মধ্য পঞ্চাশের সাধনবাবু বাজার করতে খুব ভালোবাসে। তার চরিত্রটাই শুধু নয়, বেশভূষাও  বেশ সেকেলে গোত্রের। আজকের এই দুরন্ত ফোর'জির যুগেও সাধনবাবু ঢোলা পাজামা ও গায়ে ফতুয়া চাপিয়ে চোখে কালো ফ্রেমের চশমা এঁটে খুশি মনে বাজার করেন। নিজের বারে রবি-মশাই আপন কিরণে সাধনবাবুর অর্দ্ধচন্দ্র টাকে চন্দ্রকলা ভেবে বিকিরণ ঘটিয়ে চলেছে অবিরত। 
 
বাজারে ঢোকার মুখে  জনৈক পরিচিত আধুনিক মনস্ক  ব্যক্তি প্রশ্ন করেছেন, "আরে চ্যাটার্জীবাবু ঠাকুরদার আমলের পোশাকটা কোথায় তোলা ছিল এদ্দিন?" সাধনবাবু রসিয়ে জবাব দেন, " দাদুর পাজামা কোথায় দেখলেন মশাই; এতো অর্ধাঙ্গীনির শখে কেনা পালাজো পরেছি। আধুনিক সাজার সাথে সাশ্রয়ও হল।"
 
জবাব পেয়ে সেই ব্যক্তির মুখ চুন হলেও আশেপাশের লোকজন বাক্যরসের খাবি খাওয়া দেখে সাধনবাবু বেশ আমোদ পেলেন। তারপর দুলকি চালে বাজারে প্রবেশ করলেন।

বাজারের বিকিকিনির মূল জায়গায় পৌঁছানোর আগে এলাকার গলি তস্যগলিতে ঢোঁ-মারা কর্তব্য মনে করেন সাধনবাবু। এতে  তার পরতার সওদার সাথে মাঝেমধ্যে ফাউ হিসাবে বিড়ম্বনাও জোটে।
 
তারকভোলার তীর্থস্থান থেকে আসা এক ক্ষেপচুরিয়াস বুড়ি শেষপাতের বেগুন সাজিয়ে বসে আছে গালে পানঠুসে। সাধনবাবু বুড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে বসলেন। গলায় সরগমের তৃতীয় সুর খেলিয়ে সাধনবাবু বললেন, " ঠাম্মা তোমার কানা বেগুনগুলো ক'নয়ায় দেবে গো?" বুড়ির বোধহয় পানে চুন অধিক পড়েছে। তাই নরম জিভে  চুনের শান ধরিয়ে খ্যাঁকখেকিয়ে বলে উঠল,"চোকে কি ন্যাবা হয়েছে বাচার? এমন তেল চুকচুকে বেগুনকে কানা দেখছো! চশমা খুলে দেখো বাচা,
তোমার চোকে পোকা পড়েছে মনে হয়, এই আমি বলে রাখলুম।"
সাধনবাবু মনে মনে ভাবলেন, প্রথম বউনিটা না কেচিঁয়ে যায়। তাও লড়ে যাওয়ার মানসিকতায় মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
" তোমার সরেস বেগুন তোমার থেকেও কচি গো ঠাম্মা।" বুড়ি এবারে খানিক নরম হয়ে ঠোঁটের পর্দা তুলে পানের ছোপ লাগা আধক্ষয়া পাঁচটি দাঁত বের করে বলে উঠে, " আর তেলাতে হবে না বাচা। কুড়ি টাকায় বেচছিলুম তুমি না হয় আঠেরো টাকা দিও।"
 শেষ পর্যন্ত খেলার মাঠের দড়ি টানাটানি প্রতিযোগিতার মতো টেনে হিঁচড়ে পনেরো টাকায় রফা করে বেগুন বগলদাবা করলেন সাধনবাবু।
 
 একটু এগিয়ে সাধনবাবু দ্যাখেন, এক তমসাঘন রাত্রির বর্ণের মাঝ বয়সি মাসি কপালে অগ্নি বর্ণ  টিপ পরে অপরিচিত ভদ্রলোকের সাথে কপি নিয়ে দরদস্তুর করছেন। পরিস্থিতি দেখে সাধনবাবুর মনে হচ্ছে, যেন রিঙের ভেতর দুই ফাইটার বক্সিং করছেন।  স্বগোত্রের লোক পেয়ে সাধনবাবুও  পড়িমরি করে পৌঁছালেন সেখানে।
উপস্থিত হয়ে বুঝলেন ম্যাচ ড্র হয়েছে। সেই ভদ্রলোক দাম মিটিয়ে ব্যাগে কপি ভরে স্থান ত্যাগ করলেন। সাধনবাবু কোন কথা না বলে দুটি কপি ঝপাঝপ ব্যাগে পুরলেন;কালীকেশ্বরী মাসির হাতে কুড়ি টাকা গুঁজে দিয়ে। সেই মাসি কুড়ি টাকা হাতে পেয়ে ললাটের অগ্নি,চোখে হেনে বলল, " ও বাবুর সাইথে জো দরটি হইছে তু ক্যান ও পয়সায় কপি লিবি?"  সাধনবাবু ফাজিল হেসে বললেন, " ওই লোকটা তোমার জামাই হয়? না বাংলা সিনেমার নায়ক দেব! যার জন্য ওর থেকে বেশি টাকায় কপি বেচবে আমাকে।" কালীমাসি বুঝল এ ব্যাটা সব নজর রেখেছে তাই পয়সা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সাধনবাবুকে বলল, " ও ব্যাটা আমার জামাই বটেক, তু তো সতীন পো কিনা।"
 
সাধনবাবু মনে মনে হেসে চললেন একটু দূরে মটরশুটির ঝুড়ির দিকে।
সদ্য গোঁফ গজানো ছোঁড়া, পা-ফাটা লো-ওয়েস্ট জিন্স ও স্কিন টাইট গেঞ্জী পরে কাঁধে গামছা রেখে কড়াইশুটির বাজরার উপর আর্দ্ধেক ঝুঁকে হাত চালিয়ে শুটি গোছ করছে। সাধনবাবু মটরশুটি দেখার আগে ছোঁড়ার কোমরে নজর গেল। প্যান্ট নিতম্ব থেকে নেমে যায় আর কী। দু'পাছার মাঝের কানা গলি দর্শন করে সাধনবাবুর মুখ চুলকিয়ে উঠলেন। কিছু একটা বলার জন্য মুখ হাঁ করতে যাবার মুহূর্তে ছেলেটা  দাঁড়িয়ে উঠল। মুখের কথা গিলে নিয়ে  ঝুড়িতে চটপট হাত দিয়েই সাধনবাবু চারটে শুটি তুলে ছাড়াতে ছাড়াতে গালে পুরছেন আর টকখাই মেজাজে বলছেন, " ভালো না কড়াই। মিষ্টতা নেই। তা তোমার ছিবড়ে কড়াই কত করে?"        
 
ছেলেটি তৎক্ষণাৎ টেঁটিয়া হয়ে বলে উঠে, 
" মাল কিনে তবে খান। আমার শ্বশুরের জমিদারি নেই। ফকটে খাচ্ছেন আবার দর জানতে চাইছেন।"       
 
 দরদামে ঠিক  পোষালো না কড়াইশুটি। আবার এগোতে থাকলেন। ছেলেটি ঔদ্ধত্যের সাথে বলল, " বেলার দিকে সব কাঙালিরা  বাজারে আসে ভেজা খেতে।"
 
এ সব কথা সাধনবাবু গায়ে মাখেন না। বন্ধু মহলে বলেন, একযুগ স্ত্রী সঙ্গ করলেই গায়ের চামড়া নিজে থেকেই গন্ডারের হয়ে যায়।          
এক লুঙ্গি পরা সব্জি বিক্রেতা হাঁটুর উপরে লুঙ্গি তুলে ঘসঘস চুলকাচ্ছে ও ঊর্ধ্বশ্বাসে বলছে,  "ক্যাডবেরি কুমড়ো, নিয়ে যাও সস্তা--সঙ্গে আনো বস্তা।" 
আশেপাশের বিভিন্ন লোকজনের বিভিন্ন রকম কথা শব্দের কোলাজ তৈরি হয়ে বাজার সরগরম। কত রকমের মানুষ তাদের বিভিন্ন রকমের স্বভাব। সাধনবাবু এসব দেখেন। আর ভাবেন, মায়ারানি কেন যে শপিংমল থেকে কেনাকাটার জন্য ঝোঁক তোলে! সে সব নিরস নিরেট জায়গায় যেতে সাধনবাবুর মন সায় দেয় না।
 
সাধনবাবু ইতি-উতি চাইছেন আর খুঁজে দেখছেন কার থেকে পরতায় আরো কী বাগানো যায়। ঘোঁচ মতো একটা জায়গা দিয়ে কার্নিক ঘেঁষে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেলেন সাধনবাবু টাকে কিছুর স্পর্শ পেয়ে। এক মাঝ বয়স্ক লোক  একটু উঁচু জায়গায় বসে সাধনবাবুর মাথায় ধনেপাতার বান্ডিল বুলিয়ে দিয়েছে চামরের মতো। সাধনবাবু তার দিকে তাকাতেই লোকটি বলে উঠল,  "কচি কচি ধনে --বেচি বাজারের কোনে।" সাধনবাবু  কান সকড়ি করা হাসি দিয়ে বললেন, "কত করে কত্তা তোমার ধনে?" দু'জন রসিক মানুষ আলাপ আলোচনা চালাচ্ছেন তাদের প্রয়োজন মেটাতে। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে বাজারের হৃষ্টপুষ্ট বেরসিক বোকাপাঁঠা ধনেপাতার সতেজ গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে সাধনবাবুর দু'ঠ্যাঙের পাশ গলে ধনেপাতার আঁটি ধরে টেনেছে। সেই বোঝাই করা ধনেপাতার উপর সাধনবাবুর পাজামার দড়িটাও ঝুলছিল। অবলা প্রাণী সবুজের সাথে দড়ির পার্থক্য করতে না পেরে একটু জাবর কেটেছে।  বুড়ো লোকটা তাই দেখে যেমনি, "হেঁই হেঁই" করে উঠছে, অমনি সাধনবাবুর কোমরে টান পড়েছে। আসলে এতক্ষণ বাজার করা ও রসালাপের মোহে সাধনবাবুর হুঁশ ছিল না কখন তার পা'জামা নাড়া ঝুলে পড়েছে। 
 
রসেবশে সাধনবাবু বাজার থেকে বেরনোর মুখে দ্যাখেন এক বুড়ো মতো লোক হেটো ধুতি ও মলিন চাদর গায়ে লঙ্কা,লেবু নিয়ে তীর্থের কাকের মতো হা-পিত্যেস করে বসে আছেন। সাধনবাবু তার সামনে ধপ করে বসে লেবু বাছতে বাছতে বললেন,
"তা বুড়োকত্তা,তোমার চিমসানো লঙ্কা ও নিরস লেবুর কত দিতে হবে।" বুড়ো সারাদিনের ক্লান্তি ফেলে মিচকে হেসে বলে, " আমার মতো আমার গাছেরও বয়স হয়ে যে গো। ঝাঁঝ আর রস কি থাকে মালের। যা আছে নাও। সস্তায় দিয়ে দেবো।"
 সাধনবাবু মনের সুখে সম্পূর্ণ লেবু-লঙ্কা নিয়ে নিলেন।
এই ভাবে সাধনবাবু বাজার ঘুরে-ফিরে সস্তা দরে 
শোঁষ ধরা মুলো, হেজে যাওয়া শাক, নধরকান্তি গোটা কুমড়ো নিয়ে যখন বাড়ি ঢুকলেন তখন দ্বি--
প্রহরের সূর্যের তাপে পাড়ার লোকেরা গা সেঁকছে।
মায়ারানি সাধনবাবুকে দেখেই কাংস কন্ঠে পাড়া মাথায় করে বলে উঠলেন, " ভিখিরির সাথে
ঘর সংসার করে আমার জীবন ভাজাপোড়া হয়ে গেল গা। মাঝে মাঝে মনে হয়ে, সংসারের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে হাতে খাঁড়া নিয়ে রণনেত্য করি গে।"  
 
 সাধনবাবু জিভ দিয়ে একটু চুকচুক শব্দ করে
বলে উঠেন, " মায়ার সংসারে সবই মায়া।"
দিনের তপন সন্ধ্যার সময় তপস্বীর রূপে যখন পাটে বসেন তখন জগৎসংসারেও স্নিগ্ধতা নেমে আসে। 
সন্ধেবেলা স্ত্রীকে বেসনে ডুবিয়ে চারটি কুমড়ি ভেজে দিতে বলেছেন সাধনবাবু। মুড়ির সাথে মচমচে কুমড়ি ভালোই মজে। মায়ারানি কুমড়ো কাটতে গিয়ে দেখে কুমড়োর ভূতি থেকে পচা গন্ধ ছাড়ছে। ভেতরের শাঁস পুরো হেজে-মজে আছে। 
সাধনবাবুর সামনে সেই কুমড়ো ধরে মায়ারানি বললেন, " সস্তার তিন অবস্থা।" উগ্র ঝংকার না দিয়ে তীব্র কটাক্ষ হেনে মায়ারানি রান্নাঘরে চলে গেলেন। সাধনবাবু উদাসীন দার্শনিকের মতো ঝিম ধরে বসে রইলেন। 
 রাত বাড়ে। সংসারের আর এক খন্ডযুদ্ধ মশারী টাঙানো নিয়ে তোলপাড় হবার ভয়ে, ঘরে ঘরে বাঙালি পুরুষের বিরক্তিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য সাধনবাবু বিছানায় শয্যা নেন স্বহস্তে মশারী গুঁজে। মায়ারানি গেটে তালা ঝুলিয়ে এসে বিছানায় ঢোকেন। বালিশে মাথা দিয়েও গজগজ করতে থাকেন বাঙালি রমণীদের প্রতিভু হয়ে। সাধনবাবু মায়ারানিকে উদ্দেশ্য করে বেশ ভাব রসে তান ধরে বলেন,
" বুক পেতেই রেখেছি। চড়ে যাও। দুপুরে বলছিলে না নেত্যকালী হবার সাধ তোমার। শোন, কালীর নিচে শিব শুয়ে থাকে শব হয়ে। এতে দেবাদিদেব ছোট হয় না। কালীর দৃঢ়তা প্রকাশ পায় শুধু।"
 মায়ারানি ডুকরে কেঁদে উঠে সাধনবাবুর বুকে মাথা গুঁজে দিলেন।
..................................... 

অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার