প্রবন্ধ - আয়ুষ্কাল নির্ধারণের পারকিনসন- পীযুষ রঞ্জন ঘোষ
প্রবন্ধ - স্বামী বিবেকানন্দ : প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার - ড: দিলীপ দত্ত
স্বামী বিবেকানন্দ : প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার
ড. দিলীপ দত্ত
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার। কি ছিল তাঁর চালিকা শক্তি? স্বামীজির সমস্ত মন জুড়ে ছিল একটাই চিন্তা— কীভাবে এবং কত শীঘ্র তিনি তাঁর আপামর দুর্দশাগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে জাগ্রত করে তুলবেন।
১৮৯৩ খৃীষ্টাব্দে শিকাগো শহরে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত অনুষ্ঠিত ধর্মমহাসভায় স্বামীজির বক্তৃতা সকলের প্রাণে লেগেছিল। কী ছিল সেই বক্তৃতায়? শুধুই কি ধর্মোপদেশ? না, তাঁর বক্তৃতায় ছিল ভারতের চিরন্তন জ্ঞানের বার্তা, সম্প্রীতি ও সদিচ্ছার বার্তা, শক্তি এবং নির্ভীকতা, সর্বজনীন ভালোবাসা এবং সেবার বার্তা! বিজয়ী বীররূপে সংবর্ধিত হয়েও তাঁর হৃদয় এক অদ্ভুত করুণ রসে আর্দ্র ছিল। বারংবার তাঁর মনে দারিদ্র্য-পীড়িত ভারত এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ আমেরিকার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য প্রতীয়মান হয়ে উঠতো। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে হাজার হাজার দারিদ্র্য-নিপীড়িত ভারতবাসীকে জাগ্রত করার কাজে কে এগিয়ে আসবে? কে তাদের মুখে রুটি জোগাবে? তিনি কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারবেন? ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্দশা-লাঞ্ছিত মানুষের জন্য তাঁর হৃদয়ের এই গভীর ভালোবাসা অচিরেই এক উদ্দীপকে পরিণত হয় যা ভবিষ্যতে তাঁর প্রকৃত মানুষ গঠনের সমস্ত কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে।
কি ছিল স্বামীজির দর্শন? স্বামী বিবেকানন্দের সবচেয়ে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি ছিল ‘সর্বজনীন ধর্মের’ প্রতি তাঁর উদার চিন্তাধারা। স্বামীজি ধর্ম ও ধারণার অপার বৈচিত্র্যে আনন্দ খুঁজে পেতেন। তিনি তাদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মননে ও চিন্তনে সর্বজনীন ধর্মের ধারণাটি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে অনুসরণ করে। তিনি বলতেন সকলের সঙ্গে আমাদের সমান আচরণ করা উচিত, যারা সব দিক দিয়ে দুর্বল তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের সচেষ্টা হওয়া উচিত। আমাদের উচিত কোনও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সেই অবস্থায় উন্নীত করা যেখানে সে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে এবং তাকে তার নিজ পথে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়। এখানেই নিহিত আছে তাঁর ‘প্রকৃত মানব সৃষ্টির’ মৌলিক দর্শন।
কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন? ইংরাজি শব্দ Man একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ শব্দ। M (Morality) অর্থাৎ নৈতিকতা, A (Activeness) অর্থাৎ সক্রিয়তা এবং N (Nature) অর্থাৎ প্রকৃতি—এই তিনের উপস্থিতিই তো একজন প্রকৃত মানুষের পরিচয়। তার নৈতিকতা হতে হবে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। তাকে শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই স্বার্থপরতা বিসর্জন দিতে হবে। স্বামীজি বিশ্বাস করতেন যে নিজের দিব্যস্বরূপের প্রতি জ্বলন্ত বিশ্বাস থাকলে তবেই ব্যক্তি তাঁর শক্তি, ক্ষমতা এবং মনুষ্যত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
স্বামীজি ‘প্রকৃত মানুষ গঠনের’ এই নতুন কর্মকাণ্ডকে তার গভীরতম অর্থে, সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ব্যক্তি নিজেই তাঁর অভিভাবক হয়ে উঠুক। কীভাবে দেহ ও মনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা যায় সেই শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কীভাবে ধাপে ধাপে তার অন্তর্নিহিত পার্থিব এবং স্বর্গীয় সমস্ত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে অসীম অনন্তের মাঝে তার সত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় সেই পথের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। একবার যদি ব্যক্তি তার অপরিহার্য ঐশ্বরিক প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে যায়, তখন সে, শক্তি, নির্ভীকতা, প্রফুল্লতা এবং উদারতার খনি সম্বলিত একজন নতুন মানুষে পরিণত হয়।
‘মানুষ গড়া’ কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনাকে স্বামীজি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে ভারতে তাঁর শিষ্য এবং হিতৈষীদের কাছে লেখা চিঠিগুলির মধ্যে সেটা স্পষ্ট দেখা যায়।
২০ আগস্ট, ১৮৯৩, স্বামীজি ব্রাসি মিডো থেকে আলাসিঙ্গাকে লিখলেন, পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, ঈশ্বরের প্রতি অনন্ত বিশ্বাস নিয়ে এবং বুকে সিংহের ন্যায় সাহস নিয়ে দরিদ্র, পতিত এবং নিপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি দ্বারা উদ্বেলিত হয়ে এই পবিত্র ভূমির প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে মুক্তির বাণী প্রচার করতে হবে এবং সাহায্যের বার্তা, সামাজিক উত্থানের বার্তা এবং সমতার বার্তা প্রচার করতে হবে।
২ নভেম্বর, ১৮৯৩, তিনি আবার শিকাগো থেকে আলাসিঙ্গাকে চিঠি লিখে বললেন রামনাদের রাজা সহ অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মধ্যে ভারতের জনগণের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে এবং এই সব ধনবান ব্যক্তিদের দরিদ্র দেশবাসীদের সাহায্য করার কারণ বোঝাতে।
২ ডিসেম্বর, ১৮৯৩, স্বামীজি শিকাগো থেকে তাঁর শিষ্য হরিপদ মিত্রকে লিখলেন, ‘আমি আমার কৌতূহল মেটাতে বা নাম-যশের লোভে এই দেশে আসিনি, আমি এখানে এসেছি আমার দরিদ্র ভারতবাসীর সহায়তার জন্য কোনো উপায় খুঁজে পেতে। যদি ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে তোমার কাছে ধীরে ধীরে সেগুলোর অর্থ পরিষ্কার হবে।’
১৯ মার্চ, ১৮৯৪, স্বামীজি শিকাগো থেকে তাঁর সন্ন্যাসী ভাই শশীকে চিঠি লিখলেন, ‘এমন একটি দেশ যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ মহুয়া ফুলের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে এবং এক কি দুই লক্ষ সাধু বা কয়েক লক্ষ ব্রাহ্মণ এই দরিদ্র মানুষগুলোর রক্ত চুষে খাচ্ছে, তাদের উন্নতির জন্য সামান্যতম প্রচেষ্টা ছাড়াই। এটা কি ধর্ম, নাকি শয়তানের নাচন?’
১৫ জানুয়ারি, ১৮৯৭-তে ভারতে ফিরে এসে স্বামীজি এক মুহূর্তকাল সময় নষ্ট না করে, তাঁর দেশবাসীর মনের অস্থির অবস্থা পুনর্বাসনের জন্য আশু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। তাঁর একমাত্র প্রচেষ্টা ছিল মানুষের এই দুঃখ-দুর্দশাময় মুহ্যমান জীবনকে উচ্চতর আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত করা। স্বামীজি বলেছিলেন, আমরা প্রত্যেকেই একটি অসাধারণ ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী যা আমাদেরকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং স্থায়ী সৌন্দর্য এনে দিতে পারে। তবুও, আমরা আমাদের ঐশ্বরিক ঐতিহ্য ভুলে নিজেদেরকে নিঃস্ব ভাবতে শুরু করি। এবং এই ভাবনাই যে কোনও ব্যক্তির অসুস্থতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয়দের মানসিক স্বাস্থ্যের এমন দীনতা দেখেই স্বামীজি তাঁর ‘মানুষ গড়ার’ কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন।
স্বামীজি তিন রকমভাবে তাঁর 'মানুষ গড়ার' মিশন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। প্রথমত, তিনি ভারতীয়দের, বিশেষ করে যুবসমাজের কাছে তাঁর উদ্দীপক আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি তরুণদের মনে মাতৃভূমির প্রতি চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তৃতীয়ত, তিনি স্ব-সংস্কৃতির একটি পাঠ প্রদান করেছিলেন যেখানে স্বামীজি জ্ঞানের উপাসনা, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং নিঃস্বার্থ কাজের উপর যথাযথ জোর দিয়ে একটি সমন্বিত জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
যুবসমাজ স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে তাদের অদম্য ত্রাণকর্তাকে খুঁজে পায়। স্বামীজি যুবসমাজকে পরের হিতে গভীরভাবে চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেন দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে যাতে আমরা আমাদের হৃদয়ের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছে যেতে পারি।
উপসংহারে বলা যেতে পারে যে স্বামীজির এই ‘মানুষ গড়া’র প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছিল তখন থেকে যখন তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এই ধারণা তাঁর মনের মধ্যে আরও গভীরভাবে প্রোথিত হয় যখন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, সাধনার উচ্চতম স্তর যেখানে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে অসীমের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেখানে পৌঁছানোর জন্য তাঁর জন্ম হয়নি বরং তিনি সন্ন্যাস, ধর্ম এবং সমস্ত প্রকার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার মানবিক উন্নতিকল্পে এবং সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ, দৃঢ়স্বরে স্বামীজিকে দরিদ্র ও নিপীড়িতদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে তাঁর জীবন উৎসর্গ করার উপদেশ দেন। তিনি আরও বলেন যে নরেন তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি এবং আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের ভিত নাড়িয়ে দেবে। সুতরাং এখানে বলাই যায় শ্রীরামকৃষ্ণই স্বামীজিকে তাঁর ‘মানুষ গড়া’র কর্মযজ্ঞে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। মাতৃভূমির জন্য ভাবনা তাঁর কাছে ছিল শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর মতোই অপরিহার্য।
‘খালি পেটে ধর্ম করা হয় না’— গুরুদেবের এই কথা স্মরণে রেখে এবং অহংবাদী বিশ্বাসে নিষ্ঠা না রেখে স্বামীজি দরিদ্রদের উন্নতি সাধন এবং তাদের প্রতিপালন করাই তাঁর ধর্মের প্রথম কর্তব্য হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। বস্তুত, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ছিলেন মাত্র। তিনি কখনওই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, কিংবা জাতি গঠনের যুগের সূচনা করেননি। তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর, প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। আর তাঁর আরাধনার দেবী ছিলেন তাঁর মাতৃভূমি। স্বামীজির হৃদয় তাঁর মাতৃভূমি সম্পর্কিত যে কোনও কিছুর জন্য রোমাঞ্চিত ও স্পন্দিত হত। সেখানে না ছিল কোনও ভয়, না ছিল দুর্বলতা, না সঙ্কোচ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতমাতার সমস্ত দোষত্রুটি ও দুর্বলতা তাঁর দোষ প্রকৃতপক্ষে তার নিজের দুর্বলতা। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর অন্তর্নিহিত সত্তা ভারতমাতার আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন যে অধিকাংশ ভারতমাতার সন্তানেরা ক্ষুধা, দুর্দশা এবং শিক্ষার অভাবে জর্জরিত। এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, এক বা একাধিক ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং একটি উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া উদগ্র বাসনা কেবল স্বার্থপরতার চরম উদাহরণই নয়, এটি একটি গুরুতর অপরাধও বটে। সমতার প্রধান শর্ত সমাজের একটি অংশের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা খর্ব করা এবং সর্বজনীন উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির স্বার্থে জাতীয় আয় সবার জন্য সমানভাবে বিতরণ করা। এই ধারণাগুলি যা তাঁর মনের গভীরে প্রোথিত ছিল, তা দিয়েই স্বামীজি তাঁর 'মানুষ গড়ার' মিশন গঠন করেছিলেন।
..........................
প্রবন্ধ - শুধু মানিক - ঋত্বিক চক্রবর্ত্তী
অন্যান্য চলচিত্রের মতোই বিভিন্
এই কথাগুলো শেষ হওয়ার নয় I অনেক কিছু বলার তাই ছন্নছাড়া হতেই হয় সময় ও শব্দের কৃপণতার কাছে I শুধু আপামর বাঙালি জনমানসে না
দেখলে মানিক দেখবে না কেউ অন্য কিছু ফিরে।'
প্রবন্ধ - একশ বছর বাদে কী এই পৃথিবীআদৌ বাসযোগ্য থাকবে? - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
প্রবন্ধ - জয়নগরের মোয়া, জয়নগরের জয়চণ্ডী - সমুদ্র বসু
জয়নগরের মোয়া, জয়নগরের জয়চণ্ডী
সমুদ্র বসু
জয়নগর। নামটা শুনলেই মনে পড়ে নাকি এক সুস্বাদু মিষ্টির? হ্যাঁ, জয়নগর মানেই মোয়া।
জয়নগরের মোয়া। মোয়ার জন্মস্থান এই গ্রামের ইতিহাসও মোটে হেলাফেলার নয়। রায়মঙ্গল কাব্যে উল্লেখ মেলে ‘বড়ুক্ষেত্রে’র। এই বড়ুক্ষেত্রই বহরু। উনিশ শতকের শুরুতে এই গ্রামের জমিদারি পান নন্দকুমার বসু। তিনি ঠিক করেন এই বহরুতেই মথুরা-বৃন্দাবন স্থাপন করবেন। সেই ইচ্ছে অনুযায়ী, বহরুতেই তৈরি হয় শ্যামসুন্দরের মন্দির। সেই মন্দিরের গায়ে দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী গঙ্গারাম ভাস্কর। এই বহরুতেই ছোটোবেলা কেটেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। আর, এসবের পাশাপাশি রত্নগর্ভা এই গ্রামই জন্ম
দিয়েছিল বাঙালির অতিপ্রিয় মোয়ার।
উনিশ শতক তখনও ফুরোয়নি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহরু গ্রামের যামিনীবুড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন। তাঁর নিজের খেতেই চাষ হত কনকচূড় ধান। সেই কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে নলেন গুড় মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে তিনি পরিবেশন করলেন একটা অনুষ্ঠানে। এমন জিনিস আগে কেউ খায়নি। ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। এভাবেই জন্ম নিল মোয়া। আজ্ঞে, জয়নগরে নয়। তবে, জয়নগর টাউনের মধ্যেই একটি গ্রাম পঞ্চায়েত, বহরুতে। শিয়ালদা থেকে রেললাইন বরাবর গেলে জয়নগরের ঠিক আগের স্টেশন এই বহরু।
যামিনীবুড়োর তৈরি সেই মোয়ায় অবশ্য খই আর নলেন গুড় ছাড়া উপকরণ বলতে আর কিছুই ছিল না। সেই মোয়াকে আজকের আদল দিলেন দুই বন্ধু জয়নগরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু আর নিত্যগোপাল সরকার। দুজনে মিলে ঠিক করলেন এই মোয়া তৈরি করে বিক্রি শুরু করবেন। এতদিন হাটুরে, চাষী, গেরস্তরা ইচ্ছে হলেই খই, গুড়ে মেখে মুখে পুরে দিতেন। এবারে শুরু হল সেই মোয়ারই বাণিজ্যিক উৎপাদন। মোয়াতে মিশল গাওয়া ঘি, খোয়া ক্ষীর। খই আর গুড়ের জুটিও আরো অন্তরঙ্গ হল। ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’ সেই শুরু হল মোয়ার ‘জয়নগর’ তকমার আড়ালে পথচলার শুরুয়াৎ। সালটা ১৯২৯।
এবার কালক্রমে জয়নগরের মোয়া এমনই বিখ্যাত হয়ে উঠল যে তার নামের ভারে ধামাচাপা পড়ে গেল জন্মদাত্রী বহরুর নাম। এই নব্বই বছরে জয়নগর-মজিলপুরেই গজিয়ে উঠেছে প্রায় আড়াইশোটি
2
মোয়ার দোকান। তবে, জয়নগর স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে বাসরাস্তার পাশে ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আজো দাঁড়িয়ে। আজো এই দোকানের খ্যাতি বুঁচকিবাবুর দোকান হিসেবেই। কিন্তু, শোনা যায়, স্বাদের খ্যাতিতে এই দোকানকেও এখন টেক্কা দিচ্ছে কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পঞ্চানন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বা রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মোয়া।
কোয়ালিটির ফারাকে মোয়ার দামেরও হেরফের হয়। দেড়শো টাকা কেজি থেকে দাম পৌঁছতে পারে পাঁচশো-সাড়ে পাঁচশো টাকা কেজিতেও। এক-এক কেজিতে কুড়িটি করে মোয়া। খাঁটি জয়নগরের মোয়ার ক্ষেত্রে খই আর গুড়ের রসায়নটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়। খই মানে কনকচূড়। বাংলায় মরিশাল নামে আরেক রকমের খইয়ের ধানও চাষ হয়। স্বাদে, গন্ধে কনকচূড়ের থেকে ঢের পিছিয়ে এই ধান। অথচ, কলকাতা ও শহরতলির বাজারে ‘জয়নগরের মোয়া’ তকমার আড়ালে গিজগিজ করছে এই মরিশাল খইয়েরই মোয়া। একইসঙ্গে, আসল নলেন গুড় পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে এখন। উৎকৃষ্ট মোয়ার জন্য প্রয়োজন খাঁটি নলেন গুড়। জিরেন খেজুর কাঠ থেকে রস সংগ্রহ করে শিউলিরা (যাঁরা খেজুর রস
সংগ্রহ করেন) রেখে দেন তিন দিন। তারপর, সেই রস সামান্য আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়। এই নলেন গুড় আর কনকচূড়ের গুণমানে খামতি হলে প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম রং, ফ্লেভারের। যাঁরা রসিক, তাঁদের জিভ দিব্যি ধরতে পারে সেই ‘নকল’ স্বাদ। অতএব, আসল মোয়া চাখতে গাঁটের কড়ি ফেলতেই হবে। সেই জন্যেই কেজি প্রতি মোয়ার দাম পাঁচশোও ছাপিয়ে যায় হরবখত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলপি-কাকদ্বীপ-নামখানায় ৪০০ বিঘার বেশি জমিতে আজো চাষ হয় কনকচূড় ধান। জিরেন কাঠের খেজুর রস অবশ্য দুর্লভতর হচ্ছে দিন-দিন।
হেমন্ত শেষ হতে না হতেই মোয়া তৈরির মরসুম শুরু হয়ে যায় জয়নগর-মজিলপুর-বহরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। অসংখ্য পরিবারের সারা বছরের রোজগার এই কয়েক মাসের মোয়া তৈরি ও বিক্রি থেকেই উঠে আসে। মোয়াতে নলেন গুড়, খইয়ের সঙ্গে মেশে গাওয়া ঘি, এলাচ, পেস্তা, খোয়া ক্ষীর। ওপরে কিসমিস, কাজু। ঘি, পেস্তা, ক্ষীরের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে দামের হেরফের ঘটে। চাহিদা বাড়লেও দাম ঊর্দ্ধমুখী হয় মাঝেমাঝেই।
জয়নগরের মোয়ার আধিপত্যে কীভাবে যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে মোয়ার আবিষ্কর্তা যামিনীবুড়োর গ্রাম বহরু। যদিও, বহরুর মোয়া স্বাদে কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই জয়নগরের মোয়ার থেকে। বহরু বাজারের ওপরেই ‘শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ মোয়া তো বিখ্যাত। প্রায় একই উপাদান, কিন্তু জয়নগরের মোয়ার থেকে বহরুর মোয়া যেন কিঞ্চিৎ নরম। জয়নগরের মোয়ায়
ক্ষীরের আধিক্য সামান্য বেশি, আর বহরুর মোয়ায় গুড়ের। স্বাদের বিচারে কে সেরা— তা নিয়ে অবশ্য রসিকদের মধ্যে বিবাদের শেষ নেই।
3
স্বাদে পিছিয়ে না থাকলেও খ্যাতিতে বহরুর মোয়া ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি জয়নগরের। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, বহরুও বৃহত্তর জয়নগরেরই অংশ। সেই যুক্তিতে বহরুর মোয়াও জয়নগরের মোয়া। বহরুর মোয়া-বিক্রেতা-নির্মাতারা এই কথা মোটেও মানতে চান না। খ্যাতিতে পিছিয়ে থাকলেও আলাদা অস্তিত্বের এই গৌরব তাঁরা ছাড়তে রাজি নন।
১৮৫৫ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকে ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও স্বদেশপ্রেমের ডাকে যখন সবে একটু একটু করে স্বায়ত্বশাসনের দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সেই তখন থেকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত সমৃদ্ধশালী নগরী জয়নগর-মজিলপুর ও সেখানকার কৃতি সন্তানরা এঁকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিতে ধ্রুবতারার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে অবস্থান করে। স্বায়ত্বশাসনের অধিকার ছিনিয়ে আনার প্রস্তুতিপর্বে ১৮৬৫ সালে প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ বিদ্যাসাগরের সভাপতিত্বে প্রথম তৈরি হল জয়নগর টাউন কমিটি। সেই কমিটি গঠনের মাত্র চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে ১লা
এপ্রিল তা জয়নগর পৌরসভা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যা দক্ষিণ ২৪ পরগণাসহ সারা বাংলার প্রাচীন পুরসভাগুলির মধ্যে অন্যতম।
একসময় এই জয়নগর ও মজিলপুরের বুক চিরে প্রবল ধারায় প্রবাহিত হয়ে যেত আদিগঙ্গার ধারা যা আজ মৃতপ্রায় এবং মানুষ তাঁকে অধিগ্রহণ করে নিয়ে মিত্রগঙ্গা, ঘোষগঙ্গা, বোসগঙ্গা নাম দিয়ে পুকুরের ন্যায় প্রতিপালন করছেন। কিন্তু, কোন সভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা কতখানি তা ইতিহাসে হরপ্পা, মহেঞ্জাদারো, সিন্ধু-গাঙ্গেয় সভ্যতা দেখলে বোঝা যায়। অপরদিকে আমরা
পুরাণে খুঁজলে দেখি সত্যযুগে নারায়ণ ক্ষীরোদসাগরের তীরে, ত্রেতায় রামচন্দ্র সরযু নদীর তীরে, দ্বাপরে কৃষ্ণ যমুনার কুলে, কলিতে জগন্নাথ সাগরপারে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ভাগীরথী গঙ্গার ঘাটে অবস্থান করে তাঁদের লীলা সম্পন্ন করেন। তাছাড়া কাশী, বারানসি, হরিদ্বার, পুরীধামের অবস্থান এই নদীমাতৃক সভ্যতার পক্ষে সওয়াল করেছে। ঠিক তেমনি আজ থেকে ২৪৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৭৫ সালের আগে পর্যন্ত এই স্থানে গঙ্গার মাহাত্ম্য বিদ্যমান ছিল এবং অবিভক্ত বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার সমৃদ্ধস্থান ছিল এই জয়নগর। মজিলপুর তার অনেক পরে সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে গঙ্গার মজে যাওয়া বক্ষে বাসস্থান গড়ে তোলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যশোরের চন্দ্রকেতু দত্ত ও তাঁদের কুলগুরু শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতা ছিলেন।
মজার বিষয় ১৭৭৫ সালে যখন মুর্শিদকুলি খাঁ বেতরের কাছে খাল কেটে গঙ্গার মূল ধারা ঘুরিয়ে সরস্বতী নদীর মরা খাত দিয়ে বজবজ, রায়চক, ফলতা, ডায়মণ্ডহারবারের পাশ দিয়ে সাগরের মুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে মেশায় তখন থেকে আদিগঙ্গার মৃত্যু ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।
4
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য আদিগঙ্গার তীর ধরে চক্রতীর্থ ভ্রমণ করে জয়নগর হয়ে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে গমন করেন। এই স্থানের পণ্ডিত মানুষদের তর্কশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের কারণে একে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হত। ঘটনাচক্রে, এই জলপথে আগত বিদেশী মগ, পর্তুগীজ, ফরাসী জলদস্যুরা প্রায়শই জয়নগরে লুট সন্ত্রাস চালাত এবং নিকটবর্তী জঙ্গলে ঢেকে থাকা মগরাহাট এলাকায় লুকিয়ে থাকত। কথিত আছে এই মগ দস্যুদের নামানুসারে মগরাহাটের নামকরণ হয়েছে।
এই জয়নগরের রাজা নীলকণ্ঠ মতিলাল করদ রাজা হিসাবে রাজা সুবুদ্ধিরায়ের রায়নগর রাজ্য তথা রায়মঙ্গল ঠেকে সূর্যপুর ও পশ্চিমে সরস্বতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এলাকার কিছু অংশ শাসন করতেন। এক হাজার এক সালে যখন সমগ্র জয়নগর ভেসে যায়, রায়নগর রাজ্যের অধিকাংশ জনশুন্য হয়ে পড়ে। নীলকণ্ঠ মতিলাল মগধের যুদ্ধে প্রাণ হারালে তার ভাই সপরিবারে যশোরে চলে যান,
কিন্তু কয়েক পুরুষ পরেই ঐ বংশের সুপুত্র গুনানন্দ মতিলাল পৈতৃক সম্পত্তি ও কুলদেবী জয়চন্ডী দেবীকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের সাথে সাথে সেই মূর্তির পাশে দারুকাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত নতুন মূর্তি রচনা করা হয়। সেই থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১০১৮ বছর পূর্ব থেকে এই দেবী পূজিত হয়ে আসছেন। এই দেবীর নামে জয়নগরের নামকরণ বলে মনে করা হয়। এই দেবীর প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে একপক্ষকালব্যাপী রূপপরিবর্তনের মেলা ও পূজা হয়ে আসছে। এই
জয়চন্ডী দেবীই যে জয়নগরের নামের সুত্রপাত সেটার ইতিহাস ব্যক্ত করতে হবে। অনেকে জয়নগরে বসবাস করছেন কিন্তু এই ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
এই জয়নগরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বৈষ্ণব ও শাক্তদের নানা দর্শনীয় স্থান যার মধ্যে রয়েছে ময়দা গ্রামে অবস্থিত ত্রেতা যুগে ময়দানব পূজিত পাতালভেদী ময়দানবেশ্বরী কালীবাড়ি, জয়নগরের চিকিৎসা প্রসিদ্ধ ধন্বন্তরী কালী, রাধাবল্লভজীউ মন্দির, শ্যামসুন্দর জীউ মন্দির, মহাপ্রভু জীউ মন্দির, জগন্নাথবাটী ধাম ইত্যাদি। তবে সে সব গল্প করতে আরো খানিক সময়
লাগবে। আপাতত পুজো শেষে শীতকাল এলে জয়নগরের মোয়া খাওয়ার সময় তার ইতিহাসটুকু যদি কবার মনে করা হয় তাতেই সার্থক হবে এই জায়গার মাহাত্ম্য।
কৃতজ্ঞতা- সনৎকুমার পুরকায়েত, অনিতেশ চক্রবর্তী
........................
প্রবন্ধ - আবার বছর কুড়ি পরে - ঊর্মিলা সেন
আবার বছর কুড়ি পরে
ঊর্মিলা সেন
এ বছর ৯/১১ হবে কুড়ি বছর পূর্ত্তি। তার ঠিক আগেই জো বাইডেন সরকার আফগানিস্তান থেকে সেনা সরাতে শুরু করে - প্রত্যাহার পর্ব শুরু হয় এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে। নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ৩১শে অগস্টের একদিন আগেই ৩০শে অগস্ট শেষ মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আশরাফ ঘানি সরকারের পতন হয়, তালিবানরা পঞ্জশির বাদে প্রায় গোটা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আফগানিস্তান আবার কুড়ি বছর অতীতে ফিরে যায়।
তালিবানরা অবশ্য মুখে বলছেন তারা নিজেদের পাল্টিয়েছেন -কুড়ি বছর আগের সেই বীভৎসতা আফগানিস্তান আর প্রত্যক্ষ করবে না। এমন কি তারা এও বলছেন যে যারা আশরাফ ঘানি সরকারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন , তাদের প্রতিও নব্য তালিবানদের কোন বিদ্বেষ নেই। কিন্তু কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলছে এ শুধু কথার কথা। ভারত তথা বিশ্বের আতঙ্ক এই যে তাহলে কি আফগানিস্তান আবার আস্তে আস্তে দুষ্কৃতীদের চারণভূমি হয়ে উঠবে ?কেননা পাকিস্তানের সম্পূর্ণ মদত রয়েছে তালিবানদের উত্থান এবং অপাশবিক আচরণে। পাকিস্তান প্রধান মন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন যে আফগান জনগণের দীর্ঘ দাসত্বের অবসান হয়েছে। বস্তুতপক্ষে প্রতিটি সেনাদল যেখানে একটি দেশের সাথে যুক্ত থাকে,পাক সেনা সেখানে দুটি দেশের সাথে যুক্ত। দখল করা সহজ ,কিন্তু দেশ চালনা বা শাসন করা অনেক কঠিন কাজ। গোটা বিশ্ব আজ তাকিয়ে আছে আফগানিস্তানের তালিবান শাসনের প্রকৃতির দিকে -আগের বার পাঁচ বছর যখন ওরা দেশ শাসন করেছিলেন ,তারই কি পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে আবার ? মুখে তালিবান নেতারা বলছেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা ওঁরা আর ফিরিয়ে আনবেন না। বর্তমান তালিবান সরকার নারী অধিকার ,শিক্ষা এবং চাকরী নিয়ে ওয়াকিবহাল। প্রশ্ন হচ্ছে অর্থ কোথা থেকে আসবে ?মাদক দ্রব্য বিক্রী করে দেশ চালানো যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিশ্বের পোস্ত উৎপাদনের ৯০% তৈরী হয় আফগানিস্তানে। এই কারণে অর্থের জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
ভারতীয় নেতারা তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে বা কেমন রাখা উচিৎ তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। যদিও তালিবান নেতা আনাস হুক্কানি বলেই দিয়েছেন তারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে নাক গলাবেন না।
আবার যেহেতু ভারত আগামী দু বছর U N Sanction Committee র সদস্য থাকবে,তাই আর্থিক সাহায্য আফগানিস্তান কতটা পাবে তার অনেকটাই ঠিক করবে ভারত। তাই তালিবানরাও ভারতকে চটাতে চাইছেন না।
ভারতের সর্ব বৃহৎ আশঙ্কা হল আফগানিস্তানের মাটি যদি কোনও ভাবে ভারত বিরোধী চক্রান্তের উৎস ভূমি হয়ে যায়- কেননা দুষ্কৃতীদের দল আল কায়দার সাথে তালিবানদের যে গভীর সুসম্পর্ক রয়েছে।এই আল কায়দার সঙ্গে পাকিস্তানের দুই জঙ্গি সংগঠন লস্কর - ই -তোইবা এবং জয়েশ-ই - মহম্মদের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে।
তালিব নেতা হুক্কানি অবশ্য বলেছেন ভারত অসমাপ্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি আফগানিস্তানে শেষ করুক। সেই জন্যও ভারতকে আফগানিস্তানের প্রয়োজন। আফগানিস্তান দুষ্কৃতীদের বিচরণ ক্ষেত্র যাতে না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখছে রাশিয়া, চীন এবং ইরান ও। যদিও এই তিনটি দেশ আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং তালিবানদের উদ্ভবে যারপরনাই স্বস্তি লাভ করেছে। তালিবরা ১৯৯০ এর দশকের মহিমায় ফিরে গেলে তা গোটা বিশ্বের পক্ষেই অত্যন্ত উদ্বেগজনক হবে।
পূর্ববর্তী দুই আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই এবং আশরাফ ঘানি পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। তাই ভারতের সঙ্গে তাদের মৈত্রী বন্ধন অটুট ছিল। গত দুই দশকে আফগানিস্তানের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত ২২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
পাকিস্তান তালিবানদের চালাচ্ছে। পাকিস্তান তালিবদের দ্বিতীয় স্বদেশ।
তালিব নেতা হুক্কানি অবশ্য বলেছেন ভারত অসমাপ্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি আফগানিস্তানে শেষ করুক। সেই জন্যও ভারতকে আফগানিস্তানের প্রয়োজন।তবে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা সাফ জানিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার যুদ্ধে আমেরিকাকে হারানোর পর তাদের লক্ষ্য ইয়েমেন , সোমালিয়া , প্যালেস্টাইন এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতা অর্জন। শোনা গেছে জনৈক পাকিস্তানী সমর কর্তা দাবী করেছেন যে তালিবান যোদ্ধারা ক্রমে কাশ্মীর সীমান্ত পার হয়ে ঢুকবে। এমন কি , তালিবান বিজয়ের পর কাশ্মীর উপত্যকায় জনতার একাংশকে প্রকাশ্যে উচ্ছাস করতে দেখা গেছে। এতে নয়া দিল্লীর কপালে ভাঁজ পড়েছে সন্দেহ নেই।
ভারত সুদ্ধ সমগ্র বিশ্ব আজ অনুধাবন করার চেষ্টা করছে তালিবান ১ এবং তালিবান ২ এর মধ্যে সত্যিই কোন বৈশিষ্ট্যগত ফারাক আছে কি না - তালিবান ১ বামিয়ানে ষষ্ঠ শতাব্দীর দুটি বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করেছে,তালিবান ২ ইতিমধ্যেই গজনীর তোরণ ধ্বংস করেছে।
সুতরাং সময় বলবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল,না তালিবানরা গোটা বিশ্বের চাপে এবং প্রগতিশীল আফগানিস্তানের অধিবাসীদের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহে নিজেদের খোলনলচে বদলে ফেললেন |
........