প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

প্রবন্ধ - আয়ুষ্কাল নির্ধারণের পারকিনসন- পীযুষ রঞ্জন ঘোষ

আয়ুষ্কাল নির্ধারণের পারকিনসন
পীযূষ রঞ্জন ঘোষ 
 

আপনি জানেন আপনি কতদিন বাঁচবেন?

হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন আপনি জানেন না
আমিও ঠিক সেই উত্তরটা দিয়েছিলাম 3 বছর আগে এক নৈশভোজে
অতর্কিত এই প্রশ্নটিই করেছিলেন আমার এই প্রোজেক্টের দিল্লি নিবাসী মনি জৈন, বিজনেস ক্লাব এর একটি টিম ডিনারে

পরবর্তী প্রশ্ন, কতদিন বাঁচবেন বলে আপনার ধারণা?
বড়জোর 70 ,এটাই সব বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড উত্তর.
প্রত্যুত্তরে সেই উত্তর ভারতীয় মহিলা যে কথাটি বলেছিলেন তা আজও আমার কানে বাজে
বিশ্বাস করুন আপনার আয়ুষ্কাল সত্তরের আগেই স্তিমিত হবে আসলে আমাদের অবচেতন মনকে সেই পরিমানই সময় দেওয়া হয় যেটা আমরা বিশ্বাস করি সমস্যা আরো বাড়তে শুরু করে অবসর কালে যখন মনে করি আমাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে

আমার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন তুমি এত জানলে কি করে?
সেই উত্তর আমার জীবন বদলে দিলো চিরতরে বদলে গেল আমার চিন্তন মন্থন জীবন দর্শন
উত্তরের সেদিন ভদ্রমহিলা এটি বলেছিলেন রিড দ্যা পাওয়ার অব ইউর সাবকনশাস মাইন্ড

বইটি যত পড়তে শুরু করে তথ্য আমাদের অবচেতন মনের অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে থাকি এবং সেই বই থেকে দুটো উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে না ধরলে হয়তো আপনারা বিশ্বাস করবেন না যে আমাদের আয়ুষ্কাল আমরা নির্ধারণ করি এবং অবচেতনে প্রোথিত করে রাখি

অবচেতন মন থেকে 75 শতাংশ লোক নেমে আসে আমাদের শরীরে নেতিবাচক ভাবনা মৃত্যুভয় রোগ হয় স্ট্রেস হিংসা মস্তিষ্কে বিক্রিয়া ঘটে তার প্রভাব নামিয়ে আনে আমাদের শরীরে এবং আমাদের নির্ধারিত সময়ে আমরা এগিয়ে যাই আমাদের পরিণতির দিকে
সোর্স চ্যাপটার টু: কিভাবে আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে?
কিভাবে অসৎ উপদেশ একজনকে মৃত্যুমুখী করল

লেখক এর এক আত্মীয় ভারতবর্ষে এসে জ্যোতিষের কাছে যান সেই জ্যোতিষী বলেন তার হৃদপিণ্ড সংকটজনক অবস্থায় এবং উনি এক পক্ষ কালের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করবেন
সেই আত্মীয় তার পরম আত্মীয়দের সেই ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কে বলেন এবং তার মৃত্যুর পর দলিল তৈরি করে ফেলেন কারণ সেই জ্যোতিষের উপদেশ তার অবচেতন মনে পতিত হয়েছিল এবং তিনি সেই সময়ে কাল সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করেছিলেন
আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তী অমাবস্যায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে উনার মৃত্যু হয়
এবার দেখে নেওয়া যাক অবচেতন মনের পরিপ্রেক্ষিতে কি হয়ে থাকতে পারে? আমাদের বাস্তববাদী যুক্তিবাদী চেতন মন কনসাস মাইন্ড বিভিন্ন ব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয় যা বিশ্বাস করে সেই ইনপুট আমাদের অবচেতন মন বা সাবকনসাস মাইন্ড গ্রহণ করে কাজ করতে শুরু করে দেয়
লেখক বইটিতে বলেছেন তারপরও লোক প্রাপ্ত আত্মীয় যথেষ্ট স্বাস্থবান পরিশ্রমী এবং সুখী ছিলেন সেই জ্যোতিষ দর্শন তার বিশ্বাসকে পরিবর্তন করে দেয় সেই জ্যোতিষ যে উপদেশ দেন তা তিনি গভীরভাবে স্বীকার করেন এবং বিশ্বাস করতে থাকেন এক পক্ষকালের মধ্যে উনি মারা যাবেন সেই সেই ব্যাপারে সকলকে বলতে থাকেন সব সময় ভাবতে থাকেন এমনকি উইল করে তার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেন অর্থাৎ উনি নিজেই উনার আয়ুষ্কাল এবং মৃত্যু ডেকে আনেন ক্রমাগত নেতিবাচক চিন্তাধারা শরীরে প্রবেশ করে হৃদরোগের মাধ্যমে

সেই জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী উনি যদি স্বীকার না করতেন, তবে তার শক্তিহীন হয়ে পড়তো উনি জানতেন আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে তাহলে সেই অসদ উপদেশ অবলীলায় অস্বীকার করতেন
যেভাবে একটি তীর বর্ম দ্বারা প্রতিহত হয় ঠিক সেইভাবে কোন অসৎ উপদেশ অবহেলা বা অবজ্ঞা দাঁড়া প্রশমিত হয় হাজার নয় যদি কায়মনোবাক্যে দৃঢ়চেতা হতেন জেতার যন্ত্র তার মস্তিষ্ক বলে চলে এবং অদ্বিতীয় তাঁর কোন হৃদ রোগ হয়নি তবে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও প্রশমিত হয়ে যেত
আসলে প্রত্যেকটি মানুষ এই তার চিন্তন তার মন তার পছন্দ তার বিশ্বাস তার জীবনের পছন্দগুলি তার ভালোবাসা গুলি অবচেতনের নিহিত করে রাখে যেটি আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়

এই ঘটনা থেকে দুটি তথ্য পারকিনসন সূত্র কে প্রমাণ করেন
একপক্ষ কাল অর্থাৎ আমরা আমাদের সময়সীমা ঠিক করি
সুস্থ শরীর কেবলমাত্র নেতিবাচক চিন্তা গ্রহণে অসুস্থ হয়

অর্থাৎ কর্কট রোগ থেকে হূদরোগ সর্বদা আমাদের অবচেতন থেকে শরীরে নেমে আসে এবং নিয়ে যায় পরিণতির দিকে

এই অবচেতনে খারাপ দিক যেমন আছে তেমন ভাল দিকও আছে অত ভালো ভাবলে ভালো হয় আয়ুষ্কাল বাড়ে
ফিরে যায় সেই নৈশভোজের কথোপকথনে
আমি বললাম তাহলে দুরারোগ্য ব্যাধি হলেও আমরা আমাদের আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারি?
অবশ্যই পারেন আমাদের পরিবার হিসেবে উদাহরণ রয়েছে
মনি এই গল্পটি বলতে গিয়ে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে গেল. বলতে লাগলো তার দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবার কথা হঠাৎই প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ডাক্তার বলে দেয় সে কেবল কয়েক মাস বাঁচবে উনার যা বয়স হয়েছিল তাতে শরীরে কেমোথেরাপি নেওয়ার শক্তি ছিল না তাই তার পরিবার থেকে তাঁকে জানানো হয় তার অগ্নাশয় ইনফেকশন হয়েছে তাই ডায়েট রেস্ট্রিকশন এ থাকতে হবে সবাই আশা করেছিলেন যতদিন বাজবি হয়ে বেচেন ভদ্রলোক যথেষ্ট ইতিবাচক ছিলেন আনন্দ করতে ভালোবাসেন সঙ্গে সময় কাটাতে গল্প করতে ভালোবাসতেন
অবাক বিস্ময় উনি প্রায় 5 বছর বেঁচে ছিলেন বিনা চিকিৎসায় যখন মারা গেলেন তখন তার কারণ কর্কট রোগ নয় , উনার মেয়ের অকস্মাত্ পরলোকগমন একথা শুনে উনার স্ট্রোক হয় অর্থাৎ সেই ধাক্কা মস্তিষ্ক নিতে না পেরে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যায়

কিন্তু প্রাথমিকভাবে যদি উনি জানতেন যে ডাক্তাররা আয়ুষ্কাল কয়েক মাস নির্ধারণ করে দিয়েছেন হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারতেন?

হয়তো না উনি যদি দীর্ঘ চেতা হন না কেন এই নেতিবাচক চিন্তা গুলো তার মস্তিষ্কের সমীকরণ সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে এবং অদ্ভুত ভাবে আমাদের ব্রেইনে নেগেটিভ প্যাটার্ন তৈরি করতে পারে


আমাদের অবচেতন মস্তিষ্ক অসীম ক্ষমতাশালী এবং যেকোন রকম কার্যকারিতা করতে পারে
সেটি একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় এই এক্সপেরিমেন্ট এর সত্যতা আমার জানা নেই তবে ইন্টারনেটে এই ঘটনাটি বহুল প্রচলিত

এই পরীক্ষার পরে অবশ্যই আপনাদের মাথায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে অবচেতন মস্তিষ্ক যদি বিষাক্ত রাসায়নিক উৎপন্ন করতে পারে তবে অমৃত উৎপাদন করতে পারে
তাহলে আমরা কেন অমর হইনা

আসলে সম্পূর্ণতা যেমন একটি মিথ তেমন অমরত্ব একটি মিথ
অর্থাৎ আমাদের অবচেতন যে বিশ্বাস করবে তাই হবে এবং যত সময়কাল ধার্য করবে সেই সময়কালেই হবে
যেমন অনন্তকাল চলা একটি টেস্ট ম্যাচ এ একজন দক্ষ ইনফর্ম ব্যাটসম্যান চিরকাল অপরাজিত থাকতে পারে না তেমন একটি অত্যন্ত ইতিবাচক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মস্তিষ্কে অমৃত প্রসব করেও চিরকাল থাকতে পারেন না
বৈজ্ঞানিক জন্মদিনে তার বিরুদ্ধে বলেছেন আমাদের মস্তিষ্ক সদা পরিবর্তনশীল আপনার ব্রেইন এই প্রবন্ধটি পড়ার আগে এবং পরে এক স্টরে থাকবে না ঠিক যেমন সদা পরিবর্তনশীল জীবনের চড়াই-উৎরাই এক সর্বদা থাকেনা

কথা স্বার্থে যদি ধরে নেওয়া যায় মস্তিষ্কের চরম উচ্চতায় আপনার অবচেতন অমৃত নিঃসৃত করে সেটা ডোপামিন অক্সিটোসিনের অধিক ক্ষরণ হতে পারে এবং সেটা ক্রমাগত কয়েক দিন কয়েক মাস হতে পারে তাতে আপনার শরীর বহুগুণে উন্নত হয়ে বহু রোগ নিরাময় হতে পারে উদাহরণ সূত্রে নিজের জীবনের কথা বলি মাইন্ড মাইন্ড পাওয়ার শুরু হওয়ার পূর্বে আমার জীবন বেস্ট নেতিবাচক শরীরে অত্যধিক কোলেস্টেরল ব্লাড প্রেসার 150 100 একটি বাংলা টেলিভিশনে দৈনিক মাইন্ড পাওয়ার সু করাকালীন আমাকে নানাবিধ পজিটিভ পড়াশোনাতে এবং চর্চাতে নিমজ্জিত থাকতে হয় নিজেকে প্রস্তুত করতে নানা প্রকার দৃশ্যায়ন করতে করতে মস্তিষ্ক অত্যন্ত উন্নত চলে যেতে থাকে নিজের মধ্যে এক পবিত্র অসীম ক্ষমতা অনুভূত হয় এবং আশ্চর্যের বিষয় আমার পেশার কোলেস্টেরল সম্পূর্ণভাবে নরমাল হয়ে যায়

অর্থাৎ এই পজিটিভিটি তে থাকাকালীন নিঃসৃত হরমোন কে অমৃত বলা চলে যদি এই পজিটিভিটি অনন্তকাল ধরে রাখতে পারি তবে অবশ্যই অনন্তকাল নীরব থাকতে পারবো আমি দৃঢ় ভাবে বলতে পারি অতীতে মুনি-ঋষিরা কয়েক শতাব্দি বেঁচে থাকার যে মন্ত্র তাই ইতিবাচক স্তরে নিহিত কিন্তু ফিরে আসি বাস্তব জীবনের কথা আমাদের জীবনের 78% চিন্তা ধারা নেতিবাচক অর্থাৎ আপনি ব্যাট করছে যেখানে বেশিরভাগ সাংঘাতিক কঠিন জীবনকে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে তুলনা করা হতো অতিসরলীকরণ হয়ে গেল জীবনযুদ্ধ আরো ভয়ানক যেখানে নানা পরিস্থিতি নানাভাবে আমাদের নেতিবাচক কন্ডিশনিং করে ফেলে অর্থাৎ কেবল এক সময়ে একটি বল আমাদের খেলতে হয় না নানান রকম ইনপুট আমাদের অবচেতন কে প্রভাবিত করতে থাকে সেই প্রভাব নানান রকমের বিশ্বাসের জন্ম দেয় বিশ্বাস থেকে তৈরি হয় স্নায়ু সন্নিধি প্যাটার্ন অর্থাৎ সাইন্যাপস প্যাটার্ন সেই প্যাটার্ন দেহে হরমোন ক্ষরণ এবং নানাবিধ ইনফর্মেশন পাঠাতে থাকে

এবার ধরে নিন আমরা বিশ্বাস করে বসে আছি যে আমাদের 100 বছরের বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয় দেখবেন গোষ্ঠীগতভাবে সমগ্র সমাজ সম্ভবত সকল ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া যায় সেটি প্রমাণ করে 100 বছরের আগেই মৃত্যুবরণ করেন এরকম বিশ্বাস তৈরি হয় নানা ভাবে হয়তো আমরা দূষিত বায়ু রাসায়নিক যুক্ত খাদ্য জীবনধারণের স্ট্রেসকে অবচেতনে ভাবতে ভাবতে শরীরকে কষ্ট দিয়ে কর্কট রোগের জন্মদিন হয়তোবা সামলাতে থেকে ভাবতে শুরু করি এই রকম হয়ে যাবে এবং সেই স্নায়ু সন্নিধি তৈরি করে ফেলি
 
.........................
 

 


প্রবন্ধ - স্বামী বিবেকানন্দ : প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার - ড: দিলীপ দত্ত

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার

ড. দিলীপ দত্ত

 

 

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার। কি ছিল তাঁর চালিকা শক্তি? স্বামীজির সমস্ত মন জুড়ে ছিল একটাই চিন্তা— কীভাবে এবং কত শীঘ্র তিনি তাঁর আপামর দুর্দশাগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে জাগ্রত করে তুলবেন

১৮৯৩ খৃীষ্টাব্দে শিকাগো শহরে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত অনুষ্ঠিত ধর্মমহাসভায় স্বামীজির বক্তৃতা সকলের প্রাণে লেগেছিল। কী ছিল সেই বক্তৃতায়? শুধুই কি ধর্মোপদেশ? না, তাঁর বক্তৃতায় ছিল ভারতের চিরন্তন জ্ঞানের বার্তা, সম্প্রীতি ও সদিচ্ছার বার্তা, শক্তি এবং নির্ভীকতা, সর্বজনীন ভালোবাসা এবং সেবার বার্তা! বিজয়ী বীররূপে সংবর্ধিত হয়েও তাঁর হৃদয় এক অদ্ভুত করুণ রসে আর্দ্র ছিল। বারংবার তাঁর মনে দারিদ্র্য-পীড়িত ভারত এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ আমেরিকার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য প্রতীয়মান হয়ে উঠতো। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে হাজার হাজার দারিদ্র্য-নিপীড়িত ভারতবাসীকে জাগ্রত করার কাজে কে এগিয়ে আসবে? কে তাদের মুখে রুটি জোগাবে? তিনি কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারবেন? ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্দশা-লাঞ্ছিত মানুষের জন্য তাঁর হৃদয়ের এই গভীর ভালোবাসা অচিরেই এক উদ্দীপকে পরিণত হয় যা ভবিষ্যতে তাঁর প্রকৃত মানুষ গঠনের সমস্ত কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে।

কি ছিল স্বামীজির দর্শন?  স্বামী বিবেকানন্দের সবচেয়ে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি ছিল সর্বজনীন ধর্মের প্রতি তাঁর উদার চিন্তাধারা স্বামীজি ধর্ম ও ধারণার অপার বৈচিত্র্যে আনন্দ খুঁজে পেতেন। তিনি তাদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মননে ও চিন্তনে সর্বজনীন ধর্মের ধারণাটি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে অনুসরণ করে। তিনি বলতেন  সকলের সঙ্গে আমাদের সমান আচরণ করা উচিত, যারা সব দিক দিয়ে দুর্বল তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের সচেষ্টা হওয়া উচিত। আমাদের উচিত কোনও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সেই অবস্থায় উন্নীত করা যেখানে সে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে এবং তাকে তার নিজ পথে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়। এখানেই নিহিত আছে তাঁর ‘প্রকৃত মানব সৃষ্টির মৌলিক দর্শন।

 কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন? ইংরাজি শব্দ Man একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ শব্দ। M (Morality) অর্থাৎ নৈতিকতা, A (Activeness) অর্থাৎ সক্রিয়তা এবং N (Nature) অর্থাৎ প্রকৃতি—এই তিনের উপস্থিতিই তো একজন প্রকৃত মানুষের পরিচয়। তার নৈতিকতা হতে হবে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। তাকে শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই স্বার্থপরতা বিসর্জন দিতে হবেস্বামীজি বিশ্বাস করতেন যে নিজের দিব্যস্বরূপের প্রতি জ্বলন্ত বিশ্বাস থাকলে তবেই ব্যক্তি তাঁর শক্তি, ক্ষমতা এবং মনুষ্যত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে

স্বামীজি প্রকৃত মানুষ গঠনের এই নতুন কর্মকাণ্ডকে তার গভীরতম অর্থে, সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ব্যক্তি নিজেই তাঁর অভিভাবক হয়ে উঠুককীভাবে দেহ ও মনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা যায় সেই শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কীভাবে ধাপে ধাপে তার অন্তর্নিহিত পার্থিব এবং স্বর্গীয় সমস্ত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে অসীম অনন্তের মাঝে তার সত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় সেই পথের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। একবার যদি ব্যক্তি তার অপরিহার্য ঐশ্বরিক প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে যায়, তখন সে, শক্তি, নির্ভীকতা, প্রফুল্লতা এবং উদারতার খনি সম্বলিত একজন নতুন মানুষে পরিণত হয়।

মানুষ গড়া কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনাকে স্বামীজি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে ভারতে তাঁর শিষ্য এবং হিতৈষীদের কাছে লেখা চিঠিগুলির মধ্যে সেটা স্পষ্ট দেখা যায়

২০ আগস্ট, ১৮৯৩, স্বামীজি ব্রাসি মিডো থেকে আলাসিঙ্গাকে লিখলেন, পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, ঈশ্বরের প্রতি অনন্ত বিশ্বাস নিয়ে এবং বুকে সিংহের ন্যায় সাহস নিয়ে দরিদ্র, পতিত এবং নিপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি দ্বারা উদ্বেলিত হয়ে এই পবিত্র ভূমির প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে মুক্তির বাণী প্রচার করতে হবে এবং সাহায্যের বার্তা, সামাজিক উত্থানের বার্তা এবং সমতার বার্তা প্রচার করতে হবে।

২ নভেম্বর, ১৮৯৩, তিনি আবার শিকাগো থেকে আলাসিঙ্গাকে চিঠি লিখে বললেন রামনাদের রাজা সহ অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মধ্যে ভারতের জনগণের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে এবং এই সব ধনবান ব্যক্তিদের দরিদ্র দেশবাসীদের সাহায্য করার কারণ বোঝাতে।  

২ ডিসেম্বর, ১৮৯৩, স্বামীজি শিকাগো থেকে তাঁর শিষ্য হরিপদ মিত্রকে লিখলেন, ‘আমি আমার কৌতূহল মেটাতে বা নাম-যশের লোভে এই দেশে আসিনি, আমি এখানে এসেছি আমার দরিদ্র ভারতবাসীর সহায়তার জন্য কোনো উপায় খুঁজে পেতে। যদি ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে তোমার কাছে ধীরে ধীরে সেগুলোর অর্থ পরিষ্কার হবে।’

১৯ মার্চ, ১৮৯৪, স্বামীজি শিকাগো থেকে তাঁর সন্ন্যাসী ভাই শশীকে চিঠি লিখলেন,  ‘এমন একটি দেশ যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ মহুয়া ফুলের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে এবং এক কি দুই লক্ষ সাধু বা কয়েক লক্ষ ব্রাহ্মণ এই দরিদ্র মানুষগুলোর রক্ত চুষে খাচ্ছে, তাদের উন্নতির জন্য সামান্যতম প্রচেষ্টা ছাড়াই। এটা কি ধর্ম, নাকি শয়তানের নাচন?

১৫ জানুয়ারি, ১৮৯৭-তে ভারতে ফিরে এসে স্বামীজি এক মুহূর্তকাল সময় নষ্ট না করে, তাঁর দেশবাসীর মনের অস্থির অবস্থা পুনর্বাসনের জন্য আশু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন।  তাঁর একমাত্র প্রচেষ্টা ছিল মানুষের এই দুঃখ-দুর্দশাময় মুহ্যমান জীবনকে উচ্চতর আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত করা।  স্বামীজি বলেছিলেন, আমরা প্রত্যেকেই একটি অসাধারণ ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী যা আমাদেরকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং স্থায়ী সৌন্দর্য এনে দিতে পারে। তবুও, আমরা আমাদের ঐশ্বরিক ঐতিহ্য ভুলে নিজেদেরকে নিঃস্ব ভাবতে শুরু করি। এবং এই ভাবনাই যে কোনও ব্যক্তির অসুস্থতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয়দের মানসিক স্বাস্থ্যের এমন দীনতা দেখেই স্বামীজি তাঁর মানুষ গড়ার কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন।

স্বামীজি তিন রকমভাবে তাঁর 'মানুষ গড়ার' মিশন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। প্রথমত, তিনি ভারতীয়দের, বিশেষ করে যুবসমাজের কাছে তাঁর উদ্দীপক আহ্বান জানিয়েছিলেন।  দ্বিতীয়ত, তিনি তরুণদের মনে মাতৃভূমির প্রতি চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তৃতীয়ত, তিনি স্ব-সংস্কৃতির একটি পাঠ প্রদান করেছিলেন যেখানে স্বামীজি জ্ঞানের উপাসনা, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং নিঃস্বার্থ কাজের উপর যথাযথ জোর দিয়ে একটি সমন্বিত জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

যুবসমাজ স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে তাদের অদম্য ত্রাণকর্তাকে খুঁজে পায়। স্বামীজি যুবসমাজকে পরের হিতে গভীরভাবে চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেন দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে যাতে আমরা আমাদের হৃদয়ের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছে যেতে পারি।

উপসংহারে বলা যেতে পারে যে  স্বামীজির এই ‘মানুষ গড়া’র প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছিল তখন থেকে যখন তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসেছিলেন এই ধারণা তাঁর মনের মধ্যে আরও  গভীরভাবে প্রোথিত হয় যখন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, সাধনার উচ্চতম স্তর যেখানে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে অসীমের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেখানে পৌঁছানোর জন্য তাঁর জন্ম হয়নি বরং তিনি সন্ন্যাস, ধর্ম এবং সমস্ত প্রকার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার মানবিক উন্নতিকল্পে এবং সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ, দৃঢ়স্বরে স্বামীজিকে দরিদ্র ও নিপীড়িতদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে তাঁর জীবন উৎসর্গ করার উপদেশ দেন তিনি আরও বলেন যে নরেন তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি এবং আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের ভিত নাড়িয়ে দেবে। সুতরাং এখানে বলাই যায় শ্রীরামকৃষ্ণই স্বামীজিকে তাঁর মানুষ গড়ার কর্মযজ্ঞে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। মাতৃভূমির জন্য ভাবনা তাঁর কাছে ছিল শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর মতোই অপরিহার্য।

খালি পেটে ধর্ম করা হয় না— গুরুদেবের এই কথা স্মরণে রেখে এবং অহংবাদী বিশ্বাসে নিষ্ঠা না রেখে স্বামীজি দরিদ্রদের উন্নতি সাধন এবং তাদের প্রতিপালন করাই তাঁর ধর্মের প্রথম কর্তব্য হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। বস্তুত, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ছিলেন মাত্র।  তিনি কখনওই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, কিংবা জাতি গঠনের যুগের সূচনা করেননি।  তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর, প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ।  আর তাঁর আরাধনার দেবী ছিলেন তাঁর মাতৃভূমি। স্বামীজির হৃদয় তাঁর মাতৃভূমি সম্পর্কিত যে কোনও কিছুর জন্য রোমাঞ্চিত ও স্পন্দিত হত। সেখানে না ছিল কোনও ভয়, না ছিল দুর্বলতা, না সঙ্কোচ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতমাতার সমস্ত দোষত্রুটি ও দুর্বলতা তাঁর দোষ প্রকৃতপক্ষে তার নিজের দুর্বলতা। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর অন্তর্নিহিত সত্তা ভারতমাতার আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।  স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন যে অধিকাংশ ভারতমাতার সন্তানেরা ক্ষুধা, দুর্দশা এবং শিক্ষার অভাবে জর্জরিত। এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, এক বা একাধিক ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং একটি উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া উদগ্র বাসনা কেবল স্বার্থপরতার চরম উদাহরণই নয়, এটি একটি গুরুতর অপরাধও বটে। সমতার প্রধান শর্ত সমাজের একটি অংশের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা খর্ব করা এবং সর্বজনীন উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির স্বার্থে জাতীয় আয় সবার জন্য সমানভাবে বিতরণ করা। এই ধারণাগুলি যা তাঁর মনের গভীরে প্রোথিত ছিল, তা দিয়েই স্বামীজি তাঁর 'মানুষ গড়ার' মিশন গঠন করেছিলেন।

 

..........................

 


 

প্রবন্ধ - শুধু মানিক - ঋত্বিক চক্রবর্ত্তী

 

শুধু মানিক
ঋত্বিক চক্রবর্ত্তী


একথার কোনো দ্বিমত বা সন্দেহ নেই যে বিশ্ব চলচিত্রের মানচিত্রে ভারতের আক্ষরিক অর্থে রেখাঙ্কন প্রথম যার হাতে, তিনি - সত্যজিৎ রায় I মানুষের জীবন ঘিরে নির্মিত ওনার চলচিত্রগুলোর জনমানসে প্রভাব ও চিরকালীন প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করতে গেলে বুঝতে হবে তার প্রেক্ষাপট ও উপাদান I

সকল শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে চলচিত্র যে অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী মাধ্যম তা সন্দেহাতীত I আঠারোশো শতকের শেষদিকে ক্যামেরার মাধ্যমে চলমান চিত্রায়নের পর থেকেই, এই মাধ্যমের উপযোগিতা ও অপরিমিত সম্ভাবনা, মানুষকে যেমন আগ্রহী করেছে এর প্রযুক্তিশীল বিবর্তনের ওপর, তেমনি ভাবিয়েছে চলচিত্রের আসল বিষয়বস্তুর ওপর I একটি মুহূর্তের প্রতিফলন থেকে শুরু করে, নির্বাক চলচিত্রের হাত ধরে যখন সবাক বা টকিজ ছবির আগমন ঘটে তখন আমেরিকা, ইউরোপ ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি জাপান বা ভারতেও এর জনপ্রিয়তা সাড়া ফেলে দেয় I এরপর চলচিত্রে আসে এক যুগান্তকারী রূপান্তর I বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর চলচিত্র মহলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুধরণের প্রভাবই পরে I যুদ্ধের জন্যে যেমন চলচিত্রের প্রগতিশীল বিবর্তনে আসে বাধা, ক্ষয়ক্ষতি তেমনি তার থেকে জন্ম নেয় এক অন্য তাগিদ I বিভিন্ন দেশ যেমন তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ও সেনা-সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্যে শুরু করে এর ব্যবহার, ঠিক তেমনিই একদল চিন্তাশীল মানুষ এই মাধ্যমকে তার বিপরীতমুখী হাতিয়ার করে আর্থসামাজিক অবস্থার প্রতিফলকরূপে I চলচিত্রের নিউ ওয়েভ , ইতালিয়ান নিও-রিয়ালিজম ইত্যাদির জন্ম হয় I সাধারণ মানুষের জীবন , কষ্ট ও আনন্দ ঘিরেই থাকে এর বিষয়বস্তু I তবুও গোটা বিশ্বে যখন চলচিত্রের এই ব্যাপক রূপান্তর, ভারতবর্ষে তখনও যেন চলচিত্রের সারমর্ম বেশ কিছুটা অবাস্তব ও জীবন থেকে দূরে I কিছু জীবনীভিত্তিক ছবি ছাড়া বাকি সবই যেন, আধ্যাত্বিক না হয় অবাস্তব গল্প ঘিরে , যা সেই সমকালীন পরিস্থিতিতে বেশ অপ্রাসঙ্গিক , বেমানান ও মানুষের নিত্য জীবনের বিপরীত মেরুতে I এ কথা তরুণ সত্যজিৎকে ভাবিয়েছে বারবার I

বিশ্ব চলচিত্রের প্রতি অগাধ আগ্রহ, বাংলা সাহিত্যে প্রতিফলিত বাংলাদেশের রূপ ও অবস্থা , বিশ্ব-বন্দিত চলচিত্রকার জাঁ রনোয়ার সান্নিধ্য আর বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজে যুক্ত থাকার জন্যে বিদেশী সিনেমার সাথে একাত্ম পরিচিতির যে এক অদ্ভুত নৈস্বর্গিক সূত্রধারা তৈরী হয়েছিল তাতেই সত্যজিতের কর্মযজ্ঞের প্রতি আকর্ষণের সূত্রপাত I ভিত্তোরিও দি'সিকার 'বাইসাইকেল থিভস'এ মানুষের জীবনের উপাদান সত্যজিৎকে তার চিত্রনির্মাণে করে একাগ্র ও অনড় I এই ভীত আর জীবন উপলব্ধির হাত ধরে আসে ভারতের নিউ ওয়েভ চলচিত্র তথা এক নতুন ইতিহাসের সূচনা I

এবার আলোকপাত করা যাক এই নতুন ইতিহাসের বিভিন্ন বৈশিষ্টমূলক দিক ও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ওপর I ওনার সমস্ত ছবির চরিত্র চিত্রায়ন , নির্দেশনা বা চিত্রনাট্যের বহুল চর্চিত দিকগুলো ছাড়া দেখা যাক কিছু বিশেষ উপলব্ধ বৈশিষ্টগুলোকে। রায়সাহেবের চলচিত্র চিন্তাশীলতার ভিতেই ছিল যে ভাবনা তা হলো , ‘ Cinema is the highest form of commercial art.’ তাই নরনারীর জীবন থেকে উঠে আসা ঘটনার প্রতিফলন তার সৃষ্টিতে। শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ, অভিনয়, আবহ সঙ্গীত সবকিছুতেই প্রাধান্য ছিল মানুষের জীবনযাত্রার। বিভিন্ন সময়ে তাঁর ছবিগুলোর পর্যালোচনায় যে জিনিসটি সবার আগে উঠে আসে তা হলো দৃশ্যনির্মানে তিনি কি ভীষন রকম জোর দিয়েছেন বিশদ প্রাসঙ্গিক সুক্ষ্মতার খুঁটিনাটিতে ও তার অন্তর্নিহিত শিক্ষায় I বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আসল আউটডোর শুটিং লোকেশান বা বস্তুগত জিনিসের ব্যবহার অথবা অব্যর্থ সংলাপ চয়ন চিত্রনাট্যকে দিয়েছে এক অন্যমাত্রা। অপু ত্রয়ীতে যেমন উঠে আসে একটি জীবনের রুপান্তরের দিক , তেমনি গোচর হয় চরিত্রগুলোর মানসিক ও নৈতিক ওঠানামা। যেমন প্রকট হয় চরিত্রকেন্দ্রীক ঘটনাপ্রবাহ , অন্যদিকে কলকাতা ত্রয়ীতে (প্রতিদ্বন্দী,সীমাবদ্ধ ও জনঅরণ্য) প্রকট হয় তৎকালীন আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন। সামাজিক অস্থিরতায় সুস্থীতিশীল বা বিদ্ধস্ত অবস্থার বিভিন্নশ্রেণীর চরিত্রকে যেন চালিত করে পারিপার্শ্বিক অবস্থান ও তার অঙ্গুলিহেলন। 'অপুর সংসার' এর এক দৃশ্যে বন্ধু পুলুর সাথে কথোপকথনে যেমন দেখা যায় এক জীবনমুখী দৃঢ় প্রত্যয়ের আবেদন তেমনি ' প্রতিদ্বন্দী 'এর শুরুতে শবযাত্রার নেগেটিভ ফিল্মিংএর দৃশ্য চিরসত্য মৃত্যুর এক অসামান্য নিদর্শন I এছাড়া জনঅরণ্য বা চারুলতার দৃশ্য বিশেষে ব্যবহৃত Freeze Frame Shot ও আকস্মিক স্তব্ধতার মাধ্যমে তিনি অনবদ্যভাবে বুঝিয়েছেন দ্বন্দের দিকটি। নায়কের টাকার সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বা রেল লাইন এ চাঁদের আলোর প্রতিফলন মানুষের অন্তর্দ্বন্দকে কি অসাধারণ প্রতীকী রূপে দেখায় I আরো ‘মহানগর’এর শেষ দৃশ্যে দেখানো ভাঙা বাতি হোল্ডার কি চমৎকার ভাবে সংশয়ের মুখে ফেলে দেয় দর্শকবৃন্দকে । দৃশ্য সম্পাদনার বিভিন্ন স্তরে তিনি একাধারে ব্যবহার করেছেন জাম্পকাট, ডিসল্ভ বা মন্টেজের মতো দুর্ধর্ষ সব কারিগরি উপাদান । এইসবের খুঁটিনাটি নিয়ে অশেষ কাজকর্ম তার । চলচিত্রের বিষয় চয়নে তিনি বারবার আশ্রয় নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ঠিক তেমনই তিনি সেই রবীন্দ্রনাথকে যথাযত ভাবে প্রোথিত করেছেন বিশ্ব জনমননে । তবে সেই কার্যসিদ্ধিতে তিনি বারবার রুপান্তর ঘটিয়েছেন উৎস সাহিত্য থেকে তাঁর চিত্রনাট্যে । তবে তা সবই গল্পের তাৎণিক অবস্থানুপযোগী দরকারে। ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে খাঁটি ভারতীয়ত্ব। দৃশ্য বা সংলাপে প্রভাব এসেছে উপনিষদ হতে পুরাণ বা পাঁচালী । ‘অপু ত্রয়ী’ বা ‘আগন্তুক’ বা ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ তে বারবার এসেছে ধর্মের আসল ব্যবহার বা প্রয়োজনীয়তার কথা । নারী সত্তা , তাদের সংকট , সামাজিক অবস্থান ফিরে ফিরে এসেছে বারবার ‘তিন কন্যা’, ‘চারুলতা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘অভিযান’, ‘মহানগর’ ও আরও কতো কিছুর মাধ্যমে।

তাঁর সমস্ত চলচিত্রের বিভিন্ন অংশে শব্দ ও সংগীতের যে সুগভীর প্রয়োগ দেখা যায় তা বোধহয় পাওয়া যায় না বিশ্ববন্দিত অনেক চিত্রপরিচালকের কাজে I শব্দ ও সংগীতেরও প্রতীকীরূপে ব্যবহার ছিল অনিবার্য I 'মহানগর' এর একদৃশ্যে নায়ক-নায়িকার চাকরির অনিশ্চয়তার মাঝে পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা রেডিও চ্যানেল চেঞ্জ এর মাধ্যমেই হোক বা 'গুগাবাবা' র রাজার গানের আসরে বিভিন্ন গায়কের বৈচিত্রপূর্ণ সংগীত পরিবেশনাতেই হোক তা সবই অন্তর্নিহিত এক বার্তারই প্রতীক মাত্র I 'ঘরে বাইরে' তে কিশোর কুমারকে দিয়ে তিনি রবিঠাকুরের গান গাওয়ালেন কোনো তথাকথিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে দিয়ে নয় কারণ, চরিত্র সন্দীপ একজন সাধারণ মানুষ কোনো নির্ভুল রবীন্দ্রশিল্পী নন বলে I বেশকিছু জায়গায় কোনো আবহসংগীতের বদলে শুধু কিছু বাদ্যশব্দ যেন এক অন্য মাত্রা দেয় I প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সংগীতের এক অনবদ্য সংমিশ্রনে তাঁর সংগীত সৃষ্টির প্রয়োগ I
 
ছোটদের ছবিগুলোতে তিনি বিশেষভাবে ছিলেন মনোযোগী I বহু চরিত্রের মাধ্যমেই তিনি ছোটদের আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতেন জ্ঞানসংগ্রহের দিকে I ফেলুদা , সিধুজ্যাঠা , মনমোহন (যদিও সে অর্থে 'আগন্তুক' ছোটদের ছবি নয়) এইসব চরিত্রগুলোর অগাধ পড়াশুনা ও জ্ঞান দেখে বাস্তবিকই একটি শিশু ও কিশোর মনে জানার জগতে অবগাহন ছিল অবশ্যম্ভাবি I 'হীরক রাজার দেশে'র ভিন্ন বয়সে ভিন্ন উপলব্ধি মানুষকে ভিন্ন ভাবে ভাবিয়েছে বারবার I

অন্যান্য চলচিত্রের মতোই বিভিন্ন তথ্যচিত্রগুলো ছিল যেমন তথ্যপূর্ণ তেমনি সরস ও উপভোগ্য I নামিদামি অভিনেতা ছাড়াও তিনি অনামী এবং অনভিজ্ঞদের ব্যবহার করেছেন অনবদ্য ভাবে প্রয়োজনীয় জায়গায় I

এই কথাগুলো শেষ হওয়ার নয় I অনেক কিছু বলার তাই ছন্নছাড়া হতেই হয় সময় ও শব্দের কৃপণতার কাছে  I শুধু আপামর বাঙালি জনমানসে না বিশ্বদর্শক মননে তথা প্রখ্যাত চলচিত্রকার যেমন কুরোসাওয়া , বার্গম্যান, মৃনাল, ঋত্বিক থেকে শুরু করে স্কোরসেসে বা নোলান ও তাঁর গুণগ্রাহী I তাই মনে হয় -

‘যতই আনো পরশ-পাথর না হয় সোনা হিরে,

দেখলে মানিক দেখবে না কেউ অন্য কিছু ফিরে।'

 
......

 

প্রবন্ধ - একশ বছর বাদে কী এই পৃথিবীআদৌ বাসযোগ্য থাকবে? - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী


 

একশ বছর বাদে কী এই পৃথিবীআদৌ বাসযোগ্য থাকবে?
 অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

 
এই বছরে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের একাধিক শহর
বন্যায় যেভাবে বারবার প্লাবিত হয়েছে, তা আগে কখনও ইতিহাসে হয় নি। চীনের ঝেংঝাও -তে মোটে তিনদিনের মধ্যে যা বৃষ্টি হয়েছে, তা সাধারণত একবছরেও হয় না। তুরকীস্থানের সিজরে শহরে উষ্ণতা ৪৯.১ ডিগ্রি হয়েছে, যা কখনই আগে হয় নি।উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর উপকূলের পাশ দিয়ে এই বছরে যে তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা অতীতে আগে কখনও হয় নি। তাপপ্রবাহের জন্য ফিনল্যান্ডে উষ্ণতা ৩০ ডিগ্রির উপরে চলে গেছে কয়েক মাস আগে, যা আগে কখনও সে এলাকায় হয় নি। এই বছরেই গ্রীনল্যান্ডে বরফের স্তর এতো পাতলা হয়ে গেছে যা লিখিত ইতিহাসে ২০১২ সাল ছাড়া আগে কখনও হয় নি। এই আগে হয় নি, এখন হচ্ছে, নিয়মিত হতে শুরু করেছে- এরকম হাজারটা ঘটনা বলা যায়। এসবের পিছনে কী
তা নিয়ে আজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন প্রশ্ন নেই।
গ্লোবাল ওয়ারমিং কথাটা আজ আমাদের সবার কাছেই খুব পরিচিত। এটা যে কত বড় সমস্যা সেটা প্রতি বছর আমরা আরো বেশী করে টের পাচ্ছি। কখনও তার জন্য দাবানলে একের পর এক জঙ্গল ধবংস হয়ে যাচ্ছে, তো কখনও বারবার ধেয়ে আসছে
এমন ঝড় যা আগে খুব কম সময়ই আসত। কিন্তু পনেরো বছর আগেও এই গ্লোবাল ওয়ারমিং নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতো। একদল বলত গ্লোবাল ওয়ারমিং হল মিথ্যে প্রচার, চিন্তা করার কিছুই নেই। বাড়তি গ্রীন হাউস গ্যাসের সঙ্গে এর কোন
সম্পর্ক নেই। এসব নিয়ে আমি একটা বই লিখেছিলাম ২০০৬ সাল নাগাদ এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য। আসলে তখন আমেরিকার ম্যানুফাকচারিং ও ফসিল ফুয়েল লবি এল নিনো, মিলানকোভিচ এফেক্ট এরকম অন্য নানান কারণ দেখিয়ে প্রশ্ন তুলে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিল, যাতে এসব ইন্ডাস্ট্রির উপরে বাধানিষেধ না আসে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বারবার এসবের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে ইন্সিওরেন্স ইন্ডাস্ট্রির উপরে ক্ষতির বোঝা বাড়তে শুরু হল, তারা সত্যিটাকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করল।

এটা এই কারণেই বললাম মিডিয়া বা রাজনীতি বেশীরভাগ সময় পরিচালিত হয় ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বারা। আমরা সেজন্য এখনও পেট্রোলের দাম বাড়লে তার প্রতিবাদে
ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু গ্লোবাল ওয়ারমিং - এর বিরুদ্ধে সেভাবে কোন কিছুই করি না, যেটা আগামীদিনে আমাদের সবার জীবন ও জীবিকাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।

এখন অবশ্য যে পর্যায়ে চলে গেছে সেখানে আমরা কেউ একা কিছু পরিবর্তন করতে পারব না। এখন আমাদের এই বিষয়ে সরকার ও বড় সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে যাতে সবাই এই বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করে।
বিভিন্ন দেশ গ্রীনহাউস নির্গমন কমানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো পুরোপুরি
মানা হলেও ২১০০ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’ এর মডেল অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের থেকে ২.৭ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে।
প্যারিস এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাকশিল্প যুগের ২ ডিগ্রি
সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখতেই হবে। তা না হলেই সর্বনাশ। ঝড়, দাবানল, খরা, বন্যা, বারবার তাপপ্রবাহ, চাষযোগ্য জমির অভাব, উধাও হয়ে যাওয়া কোরাল রীফ, সমুদ্রতল উঠে আসার মতো হাজারটা কারণে পৃথিবী কিন্তু বাসযোগ্য নাও থাকতে পারে আগামী একশ বছরে। ২ ডিগ্রির বেশী তাপমাত্রা বাড়লে যে কী হতে পারে সেটা কোন ক্লাইমেট মডেল নির্ভুলভাবে বলতে পারে না। শুধু সমুদ্রতল ১০ সেন্টিমিটার বেশী উঠে আসার জন্যই লক্ষ লক্ষ লোক তাদের জীবিকা ও বাসস্থান হারাবে। এই সমস্যা অনেক আগেই বোঝা যাবে, যদিও মারাত্মক রূপ ধারণ করবে ২০৫০ সালের পর থেকে।
 
উন্নতি ও জিডিপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়ে, গ্রীনহাউস
গ্যাস নির্গমন বাড়ে। এজন্য আগামীদিনে যত উন্নতি হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলো যত উন্নত হবে, তত গ্রীনহাউন গ্যাসও বাড়বে।
এর পিছনে দায়ী কার্বনডাইঅক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রীন হাউস গ্যাস।এখন তাই চারদিকে সব জায়গাতেই কার্বন কমানোর আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টা অতো সহজ নয়। একটা প্রসেসে হয়ত কমানো হল, কিন্তু তার জন্য আরেকটা জায়গায় কার্বন ফুটপ্রিন্ট বেড়ে যেতে পারে। এরকম একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আমরা ঠিক করলাম জ্বালানীনির্ভর গাড়ী কিনব না। ইলেক্ট্রিক ভেহিক্যাল ব্যবহার করব।
বিভিন্ন গাড়ীর কোম্পানি এখন এ বিষয়ে পুরোদমে কাজ করছে। কিন্তু এর একটা
সাইডএফেক্ট হবে যে তার জন্য গাড়ীর ব্যবহার অনেক বেড়ে যাবে, কারণ জ্বালানীর খরচ আর লাগবে না। এর জন্য অনেক বেশী সংখ্যক গাড়ী রাস্তায় দেখা যাবে। তার জন্য নতুন রাস্তা তৈরি করতে হবে। তার জন্য আবার কার্বনফুটপ্রিন্ট বেড়ে যাবে, কারণ কংক্রিট-এর রাস্তা মানেই তা তৈরি করার জন্য অনেক বেশী গ্রীনহাউস গ্যাস বেরোবে। একটা কাজের ক্ষেত্রে গ্রীনহাউস গ্যাস কমিয়ে আরেকটা কাজে গ্রীনহাউস গ্যাস বাড়লে, তেমন কিছু লাভ হবে না।

কার্বন ডাই অক্সাইড -এর তুলনায় মিথেন বাতাসে টিঁকে থাকে অনেক কম সময়,
বারো বছর, যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড একশো থেকে হাজার বছর টিঁকে থাকে। সেজন্য মিথেন কমাতে পারলে তা আমাদের তাড়াতাড়ি এই উষ্ণতা বাড়ার হার কমাতে সাহায্য করবে। বিশ্বে কোথায় কী কারণে মিথেন বেরোচ্ছে তা বোঝার জন্য ‘মিথেনস্যাট’ নামক এক স্যাটেলাইট লঞ্ছ করা হয়েছে এই বছরে যা পৃথিবীর চারধারে পাক খেতে খেতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মিথেন কী কী উৎস থেকে আসছে তা চিনহিত করবে। সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কমানোর।
এর প্রভাব কিন্তু সরলরৈখিকভাবে বাড়বে না। একটা সময়ের পরে অনেক
তাড়াতাড়িও বাড়তে পারে। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি সর্বত্র সমানভাবে হবে না।
দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম বাড়বে। রাশিয়া, চীন ও ভারতে তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৩.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ ডিগ্রির মধ্যে। এজন্য কিছু কিছু জায়গায় মানুষ হয়ত আর বাইরে কাজই করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ‘Wet Bulb’ তাপমাত্রা বলে একটা তাপমাত্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যা তাপমাত্রা ও সে জায়গার আর্দ্রতার মিলিত প্রভাবে নির্ধারিত হয় ও সেখানে আদৌ কোন মানুষ বাস করতে পারবে কিনা তা ঠিক করে। এই ‘Wet Bulb’ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপরে গেলে সম্পূর্ণভাবে অবাসযোগ্য হয়ে যায়। বর্তমানে ভারত পাকিস্থানের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় সে তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই কয়েকবার হয়েছে ও আগামীদিনে অনেক জায়গাতেই হবে।
 
এই উষ্ণায়নের জন্য বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ বা দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাও
বাড়বে। সিরিয়া বা সুদানে গৃহযুদ্ধের পিছনেও কিন্তু উষ্ণায়ন ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। আসলে উষ্ণায়নের জন্য বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। বন্যা বা খরার জন্য, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, চাষযোগ্য জমি, পানীয় জল ও খাদ্যের অভাবে অজস্র মানুষ তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বাধ্য হবে। আফ্রিকার সোহেলে, ক্যামেরুন, ইয়েমেন- এ আমরা ইতিমধ্যে এধরণের প্রবণতা দেখছি। কী হবে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ বা কোন প্রতিবেশী দেশ থেকে ভারতে আসতে চায়, সেটা সহজেই অনুমেয়। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে। সেটাই পুরো মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে হতে পারে।
বিভিন্ন দেশ এখন নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যার উপরে ভিত্তি করে এই
তাপমাত্রার বাড়ার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। যেমন আমেরিকা বলছে ২০৫০ এর মধ্যে ‘নেট জিরো’। চীন বলছে ২০৬০ এর মধ্যে ‘কার্বন নিউট্রাল’। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি গুলো যে পাল্টে যাবে না, তাই বা কে বলতে পারে! আমরা দেখেছি
ট্রাম্পের মতো একজন নেতা এসে কীভাবে পুরো সভ্যতাকে পিছনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, কীভাবে প্যারিস চুক্তি অস্বীকার করে নির্দ্বিধায় ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করতে পারে।
মাঝে সময় খুব কম। কে বলতে পারে দশ বছর বাদে কোথায় গিয়ে থাকলে বাঁচতে পারব, সেটাই হয়ত ভাবতে হবে। একটা বড় অংশ অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। অবশ্যই আমরা এমন কিছু নতুন প্রযুক্তি হয়ত পাবো যা দিয়ে বাতাস থেকে কার্বন সরিয়ে নেওয়া যাবে, বা সূর্যরশ্মি কে প্রতিফলিত করে মহাকাশে ফের পাঠানো যাবে যাতে তাপমাত্রা কম বাড়ে। এসব ‘জিও ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর সাহায্য উষ্ণায়ন কমানো যাবে যদিও তার উপরে এখনই ভরসা করা যাবে না। এর অন্য কিছু সাইড এফেক্টও হতে পারে, ও একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের উপরে বিভিন্ন ধরণের প্রভাব পড়তে পারে।
আগামী দিনের রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে উষ্ণায়ন ও উষ্ণায়নকে প্রভাবিত করে
এমন প্রযুক্তি। আমাদের মরণ-বাচন সেটাই নির্ধারণ করবে। জুলাই ২০২১ ছিল
বিশ্বের লিখিত ইতিহাসের সবথেকে উষ্ণমাস। পরের বছর আমরা হয়ত আবার সে রেকর্ড ভাঙব।
আপাতত আমাদের কাজ কী? আমাদের কাজ এ বিষয়ে সরকারকে প্রভাবিত করা যাতে তারা দায়িত্বশীলভাবে এবিষয়ে কাজ করে। একই সঙ্গে নিজেদের দিক থেকেও দায়িত্বশীল হওয়া, গ্লোবাল ওয়ারমিং এর ব্যাপারে অন্যদের সচেতন করা। তা না হলে হয়ত একশ বছর কেন, তার অনেক আগেই এ পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না।
.......................
 

 
 

প্রবন্ধ - জয়নগরের মোয়া, জয়নগরের জয়চণ্ডী - সমুদ্র বসু

জয়নগরের মোয়া, জয়নগরের জয়চণ্ডী
সমুদ্র বসু

 



 


জয়নগর। নামটা শুনলেই মনে পড়ে নাকি এক সুস্বাদু মিষ্টির? হ্যাঁ, জয়নগর মানেই মোয়া।
জয়নগরের মোয়া। মোয়ার জন্মস্থান এই গ্রামের ইতিহাসও মোটে হেলাফেলার নয়। রায়মঙ্গল কাব্যে উল্লেখ মেলে ‘বড়ুক্ষেত্রে’র। এই বড়ুক্ষেত্রই বহরু। উনিশ শতকের শুরুতে এই গ্রামের জমিদারি পান নন্দকুমার বসু। তিনি ঠিক করেন এই বহরুতেই মথুরা-বৃন্দাবন স্থাপন করবেন। সেই ইচ্ছে অনুযায়ী, বহরুতেই তৈরি হয় শ্যামসুন্দরের মন্দির। সেই মন্দিরের গায়ে দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী গঙ্গারাম ভাস্কর। এই বহরুতেই ছোটোবেলা কেটেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। আর, এসবের পাশাপাশি রত্নগর্ভা এই গ্রামই জন্ম
দিয়েছিল বাঙালির অতিপ্রিয় মোয়ার।

উনিশ শতক তখনও ফুরোয়নি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহরু গ্রামের যামিনীবুড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন। তাঁর নিজের খেতেই চাষ হত কনকচূড় ধান। সেই কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে নলেন গুড় মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে তিনি পরিবেশন করলেন একটা অনুষ্ঠানে। এমন জিনিস আগে কেউ খায়নি। ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। এভাবেই জন্ম নিল মোয়া। আজ্ঞে, জয়নগরে নয়। তবে, জয়নগর টাউনের মধ্যেই একটি গ্রাম পঞ্চায়েত, বহরুতে। শিয়ালদা থেকে রেললাইন বরাবর গেলে জয়নগরের ঠিক আগের স্টেশন এই বহরু।

যামিনীবুড়োর তৈরি সেই মোয়ায় অবশ্য খই আর নলেন গুড় ছাড়া উপকরণ বলতে আর কিছুই ছিল না। সেই মোয়াকে আজকের আদল দিলেন দুই বন্ধু জয়নগরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু আর নিত্যগোপাল সরকার। দুজনে মিলে ঠিক করলেন এই মোয়া তৈরি করে বিক্রি শুরু করবেন। এতদিন হাটুরে, চাষী, গেরস্তরা ইচ্ছে হলেই খই, গুড়ে মেখে মুখে পুরে দিতেন। এবারে শুরু হল সেই মোয়ারই বাণিজ্যিক উৎপাদন। মোয়াতে মিশল গাওয়া ঘি, খোয়া ক্ষীর। খই আর গুড়ের জুটিও আরো অন্তরঙ্গ হল। ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’ সেই শুরু হল মোয়ার ‘জয়নগর’ তকমার আড়ালে পথচলার শুরুয়াৎ। সালটা ১৯২৯।

এবার কালক্রমে জয়নগরের মোয়া এমনই বিখ্যাত হয়ে উঠল যে তার নামের ভারে ধামাচাপা পড়ে গেল জন্মদাত্রী বহরুর নাম। এই নব্বই বছরে জয়নগর-মজিলপুরেই গজিয়ে উঠেছে প্রায় আড়াইশোটি

2

মোয়ার দোকান। তবে, জয়নগর স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে বাসরাস্তার পাশে ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আজো দাঁড়িয়ে। আজো এই দোকানের খ্যাতি বুঁচকিবাবুর দোকান হিসেবেই। কিন্তু, শোনা যায়, স্বাদের খ্যাতিতে এই দোকানকেও এখন টেক্কা দিচ্ছে কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পঞ্চানন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বা রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মোয়া।

কোয়ালিটির ফারাকে মোয়ার দামেরও হেরফের হয়। দেড়শো টাকা কেজি থেকে দাম পৌঁছতে পারে  পাঁচশো-সাড়ে পাঁচশো টাকা কেজিতেও। এক-এক কেজিতে কুড়িটি করে মোয়া। খাঁটি জয়নগরের মোয়ার ক্ষেত্রে খই আর গুড়ের রসায়নটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়। খই মানে কনকচূড়। বাংলায় মরিশাল নামে আরেক রকমের খইয়ের ধানও চাষ হয়। স্বাদে, গন্ধে কনকচূড়ের থেকে ঢের পিছিয়ে এই ধান। অথচ, কলকাতা ও শহরতলির বাজারে ‘জয়নগরের মোয়া’ তকমার আড়ালে গিজগিজ করছে এই মরিশাল খইয়েরই মোয়া। একইসঙ্গে, আসল নলেন গুড় পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে এখন। উৎকৃষ্ট মোয়ার জন্য প্রয়োজন খাঁটি নলেন গুড়। জিরেন খেজুর কাঠ থেকে রস সংগ্রহ করে শিউলিরা (যাঁরা খেজুর রস
সংগ্রহ করেন) রেখে দেন তিন দিন। তারপর, সেই রস সামান্য আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়। এই নলেন গুড় আর কনকচূড়ের গুণমানে খামতি হলে প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম রং, ফ্লেভারের। যাঁরা রসিক, তাঁদের জিভ দিব্যি ধরতে পারে সেই ‘নকল’ স্বাদ। অতএব, আসল মোয়া চাখতে গাঁটের কড়ি ফেলতেই হবে। সেই জন্যেই কেজি প্রতি মোয়ার দাম পাঁচশোও ছাপিয়ে যায় হরবখত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলপি-কাকদ্বীপ-নামখানায় ৪০০ বিঘার বেশি জমিতে আজো চাষ হয় কনকচূড় ধান। জিরেন কাঠের খেজুর রস অবশ্য দুর্লভতর হচ্ছে দিন-দিন।

হেমন্ত শেষ হতে না হতেই মোয়া তৈরির মরসুম শুরু হয়ে যায় জয়নগর-মজিলপুর-বহরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। অসংখ্য পরিবারের সারা বছরের রোজগার এই কয়েক মাসের মোয়া তৈরি ও বিক্রি থেকেই উঠে আসে। মোয়াতে নলেন গুড়, খইয়ের সঙ্গে মেশে গাওয়া ঘি, এলাচ, পেস্তা, খোয়া ক্ষীর। ওপরে কিসমিস, কাজু। ঘি, পেস্তা, ক্ষীরের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে দামের হেরফের ঘটে। চাহিদা বাড়লেও দাম ঊর্দ্ধমুখী হয় মাঝেমাঝেই।

জয়নগরের মোয়ার আধিপত্যে কীভাবে যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে মোয়ার আবিষ্কর্তা যামিনীবুড়োর গ্রাম বহরু। যদিও, বহরুর মোয়া স্বাদে কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই জয়নগরের মোয়ার থেকে। বহরু বাজারের ওপরেই ‘শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ মোয়া তো বিখ্যাত। প্রায় একই উপাদান, কিন্তু জয়নগরের মোয়ার থেকে বহরুর মোয়া যেন কিঞ্চিৎ নরম। জয়নগরের মোয়ায়
ক্ষীরের আধিক্য সামান্য বেশি, আর বহরুর মোয়ায় গুড়ের। স্বাদের বিচারে কে সেরা— তা নিয়ে অবশ্য রসিকদের মধ্যে বিবাদের শেষ নেই।

3


স্বাদে পিছিয়ে না থাকলেও খ্যাতিতে বহরুর মোয়া ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি জয়নগরের। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, বহরুও বৃহত্তর জয়নগরেরই অংশ। সেই যুক্তিতে বহরুর মোয়াও জয়নগরের মোয়া। বহরুর মোয়া-বিক্রেতা-নির্মাতারা এই কথা মোটেও মানতে চান না। খ্যাতিতে পিছিয়ে থাকলেও আলাদা অস্তিত্বের এই গৌরব তাঁরা ছাড়তে রাজি নন।

১৮৫৫ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকে ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও স্বদেশপ্রেমের ডাকে যখন সবে একটু একটু করে স্বায়ত্বশাসনের দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সেই তখন থেকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত সমৃদ্ধশালী নগরী জয়নগর-মজিলপুর ও সেখানকার কৃতি সন্তানরা এঁকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিতে ধ্রুবতারার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে অবস্থান করে। স্বায়ত্বশাসনের অধিকার ছিনিয়ে আনার প্রস্তুতিপর্বে ১৮৬৫ সালে প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ বিদ্যাসাগরের সভাপতিত্বে প্রথম তৈরি হল জয়নগর টাউন কমিটি। সেই কমিটি গঠনের মাত্র চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে ১লা
এপ্রিল তা জয়নগর পৌরসভা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যা দক্ষিণ ২৪ পরগণাসহ সারা বাংলার প্রাচীন পুরসভাগুলির মধ্যে অন্যতম।

একসময় এই জয়নগর ও মজিলপুরের বুক চিরে প্রবল ধারায় প্রবাহিত হয়ে যেত আদিগঙ্গার ধারা যা আজ মৃতপ্রায় এবং মানুষ তাঁকে অধিগ্রহণ করে নিয়ে মিত্রগঙ্গা, ঘোষগঙ্গা, বোসগঙ্গা নাম দিয়ে পুকুরের ন্যায় প্রতিপালন করছেন। কিন্তু, কোন সভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা কতখানি তা ইতিহাসে হরপ্পা, মহেঞ্জাদারো, সিন্ধু-গাঙ্গেয় সভ্যতা দেখলে বোঝা যায়। অপরদিকে আমরা
পুরাণে খুঁজলে দেখি সত্যযুগে নারায়ণ ক্ষীরোদসাগরের তীরে, ত্রেতায় রামচন্দ্র সরযু নদীর তীরে, দ্বাপরে কৃষ্ণ যমুনার কুলে, কলিতে জগন্নাথ সাগরপারে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ভাগীরথী গঙ্গার ঘাটে অবস্থান করে তাঁদের লীলা সম্পন্ন করেন। তাছাড়া কাশী, বারানসি, হরিদ্বার, পুরীধামের অবস্থান এই নদীমাতৃক সভ্যতার পক্ষে সওয়াল করেছে। ঠিক তেমনি আজ থেকে ২৪৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৭৫ সালের আগে পর্যন্ত এই স্থানে গঙ্গার মাহাত্ম্য বিদ্যমান ছিল এবং অবিভক্ত বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার সমৃদ্ধস্থান ছিল এই জয়নগর। মজিলপুর তার অনেক পরে সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে গঙ্গার মজে যাওয়া বক্ষে বাসস্থান গড়ে তোলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যশোরের চন্দ্রকেতু দত্ত ও তাঁদের কুলগুরু শ্রীকৃষ্ণ উদ্‌গাতা ছিলেন।

মজার বিষয় ১৭৭৫ সালে যখন মুর্শিদকুলি খাঁ বেতরের কাছে খাল কেটে গঙ্গার মূল ধারা ঘুরিয়ে সরস্বতী নদীর মরা খাত দিয়ে বজবজ, রায়চক, ফলতা, ডায়মণ্ডহারবারের পাশ দিয়ে সাগরের মুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে মেশায় তখন থেকে আদিগঙ্গার মৃত্যু ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।

4

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য আদিগঙ্গার তীর ধরে চক্রতীর্থ ভ্রমণ করে জয়নগর হয়ে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে গমন করেন। এই স্থানের পণ্ডিত মানুষদের তর্কশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের কারণে একে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হত। ঘটনাচক্রে, এই জলপথে আগত বিদেশী মগ, পর্তুগীজ, ফরাসী জলদস্যুরা প্রায়শই জয়নগরে লুট সন্ত্রাস চালাত এবং নিকটবর্তী জঙ্গলে ঢেকে থাকা মগরাহাট এলাকায় লুকিয়ে থাকত। কথিত আছে এই মগ দস্যুদের নামানুসারে মগরাহাটের নামকরণ হয়েছে।

এই জয়নগরের রাজা নীলকণ্ঠ মতিলাল করদ রাজা হিসাবে রাজা সুবুদ্ধিরায়ের রায়নগর রাজ্য তথা রায়মঙ্গল ঠেকে সূর্যপুর ও পশ্চিমে সরস্বতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এলাকার কিছু অংশ শাসন করতেন। এক হাজার এক সালে যখন সমগ্র জয়নগর ভেসে যায়, রায়নগর রাজ্যের অধিকাংশ জনশুন্য হয়ে পড়ে। নীলকণ্ঠ মতিলাল মগধের যুদ্ধে প্রাণ হারালে তার ভাই সপরিবারে যশোরে চলে যান,
কিন্তু কয়েক পুরুষ পরেই ঐ বংশের সুপুত্র গুনানন্দ মতিলাল পৈতৃক সম্পত্তি ও কুলদেবী জয়চন্ডী দেবীকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের সাথে সাথে সেই মূর্তির পাশে দারুকাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত নতুন মূর্তি রচনা করা হয়। সেই থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১০১৮ বছর পূর্ব থেকে এই দেবী পূজিত হয়ে আসছেন। এই দেবীর নামে জয়নগরের নামকরণ বলে মনে করা হয়। এই দেবীর প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে একপক্ষকালব্যাপী রূপপরিবর্তনের মেলা ও পূজা হয়ে আসছে। এই
জয়চন্ডী দেবীই যে জয়নগরের নামের সুত্রপাত সেটার ইতিহাস ব্যক্ত করতে হবে। অনেকে জয়নগরে বসবাস করছেন কিন্তু এই ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
এই জয়নগরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বৈষ্ণব ও শাক্তদের নানা দর্শনীয় স্থান যার মধ্যে রয়েছে ময়দা গ্রামে অবস্থিত ত্রেতা যুগে ময়দানব পূজিত পাতালভেদী ময়দানবেশ্বরী কালীবাড়ি, জয়নগরের চিকিৎসা প্রসিদ্ধ ধন্বন্তরী কালী, রাধাবল্লভজীউ মন্দির, শ্যামসুন্দর জীউ মন্দির, মহাপ্রভু জীউ মন্দির, জগন্নাথবাটী ধাম ইত্যাদি। তবে সে সব গল্প করতে আরো খানিক সময়
লাগবে। আপাতত পুজো শেষে শীতকাল এলে জয়নগরের মোয়া খাওয়ার সময় তার ইতিহাসটুকু যদি কবার মনে করা হয় তাতেই সার্থক হবে এই জায়গার মাহাত্ম্য।

কৃতজ্ঞতা- সনৎকুমার পুরকায়েত, অনিতেশ চক্রবর্তী

........................

 


 

প্রবন্ধ - আবার বছর কুড়ি পরে - ঊর্মিলা সেন

 আবার বছর কুড়ি পরে
ঊর্মিলা সেন


এ বছর ৯/১১ হবে কুড়ি বছর পূর্ত্তি। তার ঠিক আগেই জো বাইডেন সরকার আফগানিস্তান থেকে সেনা সরাতে শুরু করে - প্রত্যাহার পর্ব শুরু হয় এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে। নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ৩১শে অগস্টের একদিন আগেই ৩০শে অগস্ট শেষ মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আশরাফ ঘানি সরকারের পতন হয়, তালিবানরা পঞ্জশির বাদে প্রায় গোটা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আফগানিস্তান আবার কুড়ি বছর অতীতে ফিরে যায়।
তালিবানরা অবশ্য মুখে বলছেন তারা নিজেদের পাল্টিয়েছেন -কুড়ি বছর আগের সেই বীভৎসতা আফগানিস্তান আর প্রত্যক্ষ করবে না। এমন কি তারা এও বলছেন যে যারা আশরাফ ঘানি সরকারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন , তাদের প্রতিও নব্য তালিবানদের কোন বিদ্বেষ নেই। কিন্তু কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলছে এ শুধু কথার কথা। ভারত তথা বিশ্বের আতঙ্ক এই যে তাহলে কি আফগানিস্তান আবার আস্তে আস্তে দুষ্কৃতীদের চারণভূমি হয়ে উঠবে ?কেননা পাকিস্তানের সম্পূর্ণ মদত রয়েছে তালিবানদের উত্থান এবং অপাশবিক আচরণে। পাকিস্তান প্রধান মন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন যে আফগান জনগণের দীর্ঘ দাসত্বের অবসান হয়েছে। বস্তুতপক্ষে প্রতিটি সেনাদল যেখানে একটি দেশের সাথে যুক্ত থাকে,পাক সেনা সেখানে দুটি দেশের সাথে যুক্ত। দখল করা সহজ ,কিন্তু দেশ চালনা বা শাসন করা অনেক কঠিন কাজ। গোটা বিশ্ব আজ তাকিয়ে আছে আফগানিস্তানের তালিবান শাসনের প্রকৃতির দিকে -আগের বার পাঁচ বছর যখন ওরা দেশ শাসন করেছিলেন ,তারই কি পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে আবার ? মুখে তালিবান নেতারা বলছেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা ওঁরা আর ফিরিয়ে আনবেন না। বর্তমান তালিবান সরকার নারী অধিকার ,শিক্ষা এবং চাকরী নিয়ে ওয়াকিবহাল। প্রশ্ন হচ্ছে অর্থ কোথা থেকে আসবে ?মাদক দ্রব্য বিক্রী করে দেশ চালানো যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিশ্বের পোস্ত উৎপাদনের ৯০% তৈরী হয় আফগানিস্তানে। এই কারণে অর্থের জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
ভারতীয় নেতারা তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে বা কেমন রাখা উচিৎ তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। যদিও তালিবান নেতা আনাস হুক্কানি বলেই দিয়েছেন তারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে নাক গলাবেন না।
আবার যেহেতু ভারত আগামী দু বছর U N Sanction Committee র সদস্য থাকবে,তাই আর্থিক সাহায্য আফগানিস্তান কতটা পাবে তার অনেকটাই ঠিক করবে ভারত। তাই তালিবানরাও ভারতকে চটাতে চাইছেন না।
ভারতের সর্ব বৃহৎ আশঙ্কা হল আফগানিস্তানের মাটি যদি কোনও ভাবে ভারত বিরোধী চক্রান্তের উৎস ভূমি হয়ে যায়- কেননা দুষ্কৃতীদের দল আল কায়দার সাথে তালিবানদের যে গভীর সুসম্পর্ক রয়েছে।এই আল কায়দার সঙ্গে পাকিস্তানের দুই জঙ্গি সংগঠন লস্কর - ই -তোইবা এবং জয়েশ-ই - মহম্মদের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে।
তালিব নেতা হুক্কানি অবশ্য বলেছেন ভারত অসমাপ্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি আফগানিস্তানে শেষ করুক। সেই জন্যও ভারতকে আফগানিস্তানের প্রয়োজন। আফগানিস্তান দুষ্কৃতীদের বিচরণ ক্ষেত্র যাতে না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখছে রাশিয়া, চীন এবং ইরান ও। যদিও এই তিনটি দেশ আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং তালিবানদের উদ্ভবে যারপরনাই স্বস্তি লাভ করেছে। তালিবরা ১৯৯০ এর দশকের মহিমায় ফিরে গেলে তা গোটা বিশ্বের পক্ষেই অত্যন্ত উদ্বেগজনক হবে।

পূর্ববর্তী দুই আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই এবং আশরাফ ঘানি পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। তাই ভারতের সঙ্গে তাদের মৈত্রী বন্ধন অটুট ছিল। গত দুই দশকে আফগানিস্তানের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত ২২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
পাকিস্তান তালিবানদের চালাচ্ছে। পাকিস্তান তালিবদের দ্বিতীয় স্বদেশ।
তালিব নেতা হুক্কানি অবশ্য বলেছেন ভারত অসমাপ্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি আফগানিস্তানে শেষ করুক। সেই জন্যও ভারতকে আফগানিস্তানের প্রয়োজন।তবে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা সাফ জানিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার যুদ্ধে আমেরিকাকে হারানোর পর তাদের লক্ষ্য ইয়েমেন , সোমালিয়া , প্যালেস্টাইন এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতা অর্জন। শোনা গেছে জনৈক পাকিস্তানী সমর কর্তা দাবী করেছেন যে তালিবান যোদ্ধারা ক্রমে কাশ্মীর সীমান্ত পার হয়ে ঢুকবে। এমন কি , তালিবান বিজয়ের পর কাশ্মীর উপত্যকায় জনতার একাংশকে প্রকাশ্যে উচ্ছাস করতে দেখা গেছে। এতে নয়া দিল্লীর কপালে ভাঁজ পড়েছে সন্দেহ নেই।
ভারত সুদ্ধ সমগ্র বিশ্ব আজ অনুধাবন করার চেষ্টা করছে তালিবান ১ এবং তালিবান ২ এর মধ্যে সত্যিই কোন বৈশিষ্ট্যগত ফারাক আছে কি না - তালিবান ১ বামিয়ানে ষষ্ঠ শতাব্দীর দুটি বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করেছে,তালিবান ২ ইতিমধ্যেই গজনীর তোরণ ধ্বংস করেছে।
সুতরাং সময় বলবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল,না তালিবানরা গোটা বিশ্বের চাপে এবং প্রগতিশীল আফগানিস্তানের অধিবাসীদের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহে নিজেদের খোলনলচে বদলে ফেললেন | 

........