অন্য পূজো
শাশ্বতী মুন্সী
গলির
চৌমাথার মোড়ে গাড়িটা এসে দাঁড়াতে ভাড়া মিটিয়ে ক্যাব থেকে নেমে পড়লো
মালবিকা | কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ এবং ডানহাতে ধরা ভারী বিগ শপারটা নিয়ে মিনিট
দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলো বাড়ির সদরে | কলিং বেলের সুইচে আলতো চাপ দিতে
সুরেলা ধ্বনির অনুরণন ভেসে এলো দরজার ওপ্রান্ত থেকে | একটু অপেক্ষার পরে
শাশুড়ি মা দরজা খুলতে সিঁড়ির নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাঁ-হাতি দেওয়ালের এক
সাইডে ভ্যানিটি ব্যাগটা বিগ শপারের ওপরে রাখলো | তারপর হাত-পা ধুয়ে ব্যাগ
দুখানা রেখে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে এক গ্লাস ঠান্ডা জল বৌমার দিকে এগিয়ে
দিয়ে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন হেমলতা দেবী | পুরো জলটা পান করতে ঘর্মাক্ত
শরীরের গরম ভাব খানিক জুড়োলো | মালবিকার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে
হেমলতাদেবী বললেন,
-" খুব পরিশ্রম গেলো না.. তা, এতো দেরি হলো যে.. সব কেনাকাটা আজই করে নিলে?"
-"
হ্যাঁ মা, কিনতে যখন গেছি তাই আর কিছু বাকি রাখলাম না.. হাফ ইয়ার্লি
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে স্কুলে আর ছুটি পাবো না.. তাছাড়া ভাদ্রের বিজবিজে
গরমে ভিড় ঠেলে বারবার যেতেও বিরক্ত লাগে..!"
-" তা যা
বলেছো, পূজো এলেই যেন কেনাকাটার হিড়িক লেগে যায়.. নাও, এবার তোমার
ছেলেপুলেদের সামলাও দিকি নি, বিকেল থেকে মা কখন আসবে, কতগুলো জামা নিয়ে
আসবে, আমাদের নিয়ে গেলো না কেন --- প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিলো
আমায়.."
ওনার কথা শেষ হওয়া
মাত্র দোতলার সিঁড়ি দিয়ে দুপদাপ করে নেমে একছুটে সোজা ড্রয়িং রুমে ঢুকে
কোনো দিকে না তাকিয়ে মায়ের দু'পাশে বসে পড়লো চার মিনিটের ছোট-বড় দুই ভাইবোন
| মালবিকার যমজ সন্তান -- তাতান আর তুতুন | দু' জোড়া হাতের আদরের ভঙ্গির
বাহুডোরে তার শরীরের ক্লান্তি নিমেষে উধাও | ওই অবস্থায় আবদ্ধ থেকে নরম
স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
-" সারাদিন দুষ্টুমি করিস নি তো.. খেয়েছিস ঠিক মতো? "
-" একটুও দুষ্টু করি নি মা... ঠাম্মি কাঁটা ছাড়িয়ে দিতে মাছ দিয়ে সব ভাত খেয়ে নিয়েছি আমরা.. ", একসাথে বললো দুজনে |
-"
বাহ্.. কিন্তু লক্ষ্মী সোনার ঠাম্মিকে অতো প্রশ্ন করে জ্বালাতন করছিলে
কেন? আমি তো বলেই গেছি কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি.. ভিড় আর রাস্তায় জ্যাম ছিল
বলে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো..
হাতের বন্ধন শিথিল করে ঠাম্মির দিকে বারেক তাকিয়ে নিলো তাতান | বলে,
-" ঠাম্মি যে কিছুতেই বলছিলো না আমাদের জন্য জামা প্যান্ট কিনে আনবে কিনা.."
-" তোদের পুজোর পোশাক তো কেনা হয়ে গেছে.."
-" সে তো দুটো বাবা দিয়েছে, পিসি আর জেঠু একটা করে, মামারবাড়িটা বাকি আছে আর মাসি এখনো দেয় নি.. "
দাদার কথার খেই ধরে নেয় তুতুন | দুঃখী স্বরে বললো,
-" তুমি কিন্তু এবারে একটাই জামা কিনে দিলে মা..!"
দুই হাতের বেড়ে ছেলেমেয়েকে কাছে টেনে মালবিকা বোঝায়,
বাবা,
মায়েরা অনেক টাকা উপার্জন করলেই যে পুজোতে গন্ডা খানেক জামা কিনে দেবে,
এটা কক্ষনো ভেবে রাখবি না..পাঁচ দিন পুজোতে পড়ার মতো জামা হলেই সন্তুষ্ট
থাকতে হয়.. কখনো ভেবেছিস, যেসব ছোট ছেলেমেয়েরা সিগন্যাল, বাস স্টপেজে ঘুরে
ঘুরে হাত পেতে ভিক্ষা করে পয়সা চেয়ে খাবার কিনে খায়, তারা ক'টা জামা পায়
পূজোতে কিংবা আদৌ পায় কি না! সারাবছরই যাদের লোকের ফেলে দেওয়া পুরনো ছেঁড়া,
রং চটা জামা পরে কাটাতে হয়, তারা যে নতুন জামা পাওয়ার কথা ভাবতেই পারে
না.. অর্থের জোর আছে এমন লোকেদের উচিত এইসব পথশিশুদের জন্য সাধ্যমতো কিছু
করা.. পুষ্টিকর খাবার, পোশাক, দেওয়া, প্রয়োজনে কোনো সংগঠন বা সংস্থার সঙ্গে
যোগাযোগ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা.. তাই এবারে একটা জামা কম হলে সেই
টাকায় যদি ৪/৫টি শিশুকে জামা কিনে দিই, তাতে কি তোদের মন খারাপ হবে?
সোফার সামনে রাখা পোশাকে ঠাসা বিগ শপারটার দিকে তাকিয়ে তুতুন বললো,
-" ওতে কি তাহলে সব ওদেরই জামা,প্যান্ট আছে..!"
বোনের মনোভাব অন্যদিকে ঘোরাতে তাতান বলে ওঠে,
-" শুনলি না মা কি বললো.. ওরাও আমাদের মতো মায়ের দেওয়া নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখবে..
-"
প্যান্ডেলে গিয়ে তোরা যেভাবে ঠাকুর দেখিস, আনন্দ করিস, ভালো ভালো খাবার
খাস, ওরা সেসবের কিচ্ছু পায় না বলেই তো এ বছরটা শুধু ওদের জন্যই আলাদা
পুজোর বন্দোবস্ত করেছি আমরা.. ", বললো মালবিকা |
-"
তোমাদের অফিসের মাঠে পূজো হবে বলেছো, তাহলে বাবার মামবাড়ির দূর্গা পূজোতে
যাবে না তুমি? ", বালকসুলভ প্রশ্ন উচ্চারিত হয় তাতানের কণ্ঠে | একটু ভেবে
নিয়ে মালবিকা উত্তর দেন,
-" যাবো তো বটেই.. তবে
অন্যবারের মতো যে থাকতে পারবো না, পূজোর কিছু দায়িত্ব আমাকেও নিতে হয়েছে,
তবে অষ্টমী বা নবমীর দিন যখন হোক ঠাকুর দর্শন করে আসবো.. ",
বৌমার কথায় স্মিত হাসেন হেমলতা দেবী |
পেশায়
স্কুল শিক্ষিকা(ভূগোল) মালবিকা বসুরায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে
যুক্ত | সহকারী সভাপতি | সারা বছর এই সংগঠন বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প
ভিত্তিক কাজ করে থাকে | এবারে তারা ঠিক করেছেন, পথশিশুদের নিয়ে দূর্গাপূজো
করবে | সংগঠনের নানা কাজে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর শহরের ঘিঞ্জি
বস্তি, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছুটে যায় প্রতিনিধিরা | চলতি
বছর তেমনই এক প্রকল্পের কাজে দলের প্রতিনিধিত্ব করে বাঁকুড়ার কুলতলি
গ্রামে গিয়ে মালবিকা দ্যাখে, ছোটদের কেউ অপটু হাতে সযত্নে প্রতিমা গড়ছে,
কেউ বানাচ্ছে শোলার ফুল, আবার কেউ করছে দরমার কাজ | কৌতূহল বশে জিজ্ঞেস
করতে ১২ বছরের মন্টু জানায়,
-" বাবা ঠাকুরদাকে মাটির ঠাকুর বানাতে দেখেই শিখে নিয়েছি | মনের কল্পনায় মূর্তি গড়তে ভালো লাগে.. "
বোঝে,
মাটির তাল নিয়ে খেলতে খেলতে ছোট্ট আঙ্গুল গুলো অজান্তেই কারিগরিতে দক্ষ
হয়ে উঠেছে | তাদের এই সহজাত দক্ষতাকে অভিনব রূপে ব্যবহার করার ভাবনা আসে
মালবিকা'র মাথায় |
সংগঠনের
সভাপতি এবং সকল প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয় অফিসের পাশের খোলা
মাঠে দূর্গা পূজোর আয়োজন করা হবে | কুমোরটুলির অর্ডারী প্রতিমা নয়,
গ্রামের খুদে মৃৎশিল্পীদের তৈরী একচালায় সপরিবারে দেবী দূর্গা পূজিত হবেন |
ঠাকুর গড়বে প্যান্ডেলের ভেতরে বসে | অন্দরসজ্জায় থাকবে বালক-কিশোরদের
হাতের কাজের ছোঁয়া | গ্রাম থেকে এসে এই সময়টা অফিসের অব্যবহৃত ঘরে থাকবে
ওরা এবং খাওয়ার খরচা ব্যয় হবে সংগঠনের ফান্ড থেকে |
দাতাগোষ্ঠী,
স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের সহায়তায় বেসরকারি সংগঠনের ফান্ডে অর্থের
সংকুলান হয় না | বিভিন্ন মানব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত করে থাকেন |
মালবিকা'র স্বামীও প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে অর্থ দান করেন | সমাজসেবী
সত্ত্বা, উদার হৃদয়, কর্মোদ্যমী প্রয়াস -- এ হেনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের
অধিকারী স্ত্রী'র জন্য গর্ব অনুভব করেন চিরদীপ বসুরায় |
কারিগরি
বিদ্যে আর শিল্প-শৈলীর মেলবন্ধনে অপূর্ব সুন্দর প্রতিমা গড়ে নাবালক
শিল্পীরা | বাঁশ, দরমা দিয়ে বানানো প্যান্ডেলের অভ্যন্তরীণ সাজে লাগে শোলা
কেটে রং-তুলি বুলিয়ে তৈরী নকশাদার চিত্রালংকার | রাত নামলে শহর ভেসে যাওয়া
উজ্জ্বল আলোর রোশনাইয়ের মাঝে জাঁকজমকহীন মণ্ডপে শোলার ফুলের ভেতর জ্বলে ওঠে
রঙিন টুনি লাইট |
জনা
৫০ পথশিশু এবং গ্রামের ওইসব ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাফ/ফুল শার্ট, হাফ/ফুল
প্যান্ট, ফ্রক, স্কার্ট টপ, চুড়িদার ইত্যাদি পোশাক বিতরণ করা হয় মহালয়ার
দিন | ভাত, লুচি, খিচুড়ি, লাবড়া, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, মাছ, মাংস,
পায়েস, দই, মিষ্টি.. পাঁচদিন ধরে চারবেলা পাত পেড়ে খাওয়ানো হলো পূজোর
ঢালাও খাবার |
শিশু,
বালক বয়সী একঝাঁক কচিদের হাসি-মজা- কলরোলে মণ্ডপের ভেতর এবং প্যান্ডেলের
বাহির মুখরিত হয় অনাবিল আনন্দ-তরঙ্গে | রোদ ঝলমলে পূজো প্রাঙ্গন জুড়ে
আন্দোলিত হয় খুশির গন্ধ মাখা শরতের মনোরম বাতাস | নতুন ছন্দে উৎসব উপভোগের
অভিপ্রায়ে মালবিকার সন্তানেরাও এই ক'টি দিন সংগঠন-মাঠের পূজোয় সামিল হয় |
মৃৎশিল্প
এবং হস্তশিল্পের কল্যাণে কলকাতার ঠাকুর দর্শনের সুযোগ মিললো গ্রামীণ
জনপদের বাসিন্দাদের | আর নিজেদের পূজোর আনন্দ-আহ্লাদে মেতে উঠলো কলকাতার
ঠিকানাহীন পথবাসীরা |
শহরের সঙ্গে গ্রামকে মিশিয়ে দেওয়ার মানবতা'র পূজোয় ধ্বনিত হলো মনুষ্যজাতির জয়গান |
....................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি