প্রবন্ধ - শুধু মানিক - ঋত্বিক চক্রবর্ত্তী

 

শুধু মানিক
ঋত্বিক চক্রবর্ত্তী


একথার কোনো দ্বিমত বা সন্দেহ নেই যে বিশ্ব চলচিত্রের মানচিত্রে ভারতের আক্ষরিক অর্থে রেখাঙ্কন প্রথম যার হাতে, তিনি - সত্যজিৎ রায় I মানুষের জীবন ঘিরে নির্মিত ওনার চলচিত্রগুলোর জনমানসে প্রভাব ও চিরকালীন প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করতে গেলে বুঝতে হবে তার প্রেক্ষাপট ও উপাদান I

সকল শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে চলচিত্র যে অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী মাধ্যম তা সন্দেহাতীত I আঠারোশো শতকের শেষদিকে ক্যামেরার মাধ্যমে চলমান চিত্রায়নের পর থেকেই, এই মাধ্যমের উপযোগিতা ও অপরিমিত সম্ভাবনা, মানুষকে যেমন আগ্রহী করেছে এর প্রযুক্তিশীল বিবর্তনের ওপর, তেমনি ভাবিয়েছে চলচিত্রের আসল বিষয়বস্তুর ওপর I একটি মুহূর্তের প্রতিফলন থেকে শুরু করে, নির্বাক চলচিত্রের হাত ধরে যখন সবাক বা টকিজ ছবির আগমন ঘটে তখন আমেরিকা, ইউরোপ ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি জাপান বা ভারতেও এর জনপ্রিয়তা সাড়া ফেলে দেয় I এরপর চলচিত্রে আসে এক যুগান্তকারী রূপান্তর I বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর চলচিত্র মহলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুধরণের প্রভাবই পরে I যুদ্ধের জন্যে যেমন চলচিত্রের প্রগতিশীল বিবর্তনে আসে বাধা, ক্ষয়ক্ষতি তেমনি তার থেকে জন্ম নেয় এক অন্য তাগিদ I বিভিন্ন দেশ যেমন তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ও সেনা-সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্যে শুরু করে এর ব্যবহার, ঠিক তেমনিই একদল চিন্তাশীল মানুষ এই মাধ্যমকে তার বিপরীতমুখী হাতিয়ার করে আর্থসামাজিক অবস্থার প্রতিফলকরূপে I চলচিত্রের নিউ ওয়েভ , ইতালিয়ান নিও-রিয়ালিজম ইত্যাদির জন্ম হয় I সাধারণ মানুষের জীবন , কষ্ট ও আনন্দ ঘিরেই থাকে এর বিষয়বস্তু I তবুও গোটা বিশ্বে যখন চলচিত্রের এই ব্যাপক রূপান্তর, ভারতবর্ষে তখনও যেন চলচিত্রের সারমর্ম বেশ কিছুটা অবাস্তব ও জীবন থেকে দূরে I কিছু জীবনীভিত্তিক ছবি ছাড়া বাকি সবই যেন, আধ্যাত্বিক না হয় অবাস্তব গল্প ঘিরে , যা সেই সমকালীন পরিস্থিতিতে বেশ অপ্রাসঙ্গিক , বেমানান ও মানুষের নিত্য জীবনের বিপরীত মেরুতে I এ কথা তরুণ সত্যজিৎকে ভাবিয়েছে বারবার I

বিশ্ব চলচিত্রের প্রতি অগাধ আগ্রহ, বাংলা সাহিত্যে প্রতিফলিত বাংলাদেশের রূপ ও অবস্থা , বিশ্ব-বন্দিত চলচিত্রকার জাঁ রনোয়ার সান্নিধ্য আর বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজে যুক্ত থাকার জন্যে বিদেশী সিনেমার সাথে একাত্ম পরিচিতির যে এক অদ্ভুত নৈস্বর্গিক সূত্রধারা তৈরী হয়েছিল তাতেই সত্যজিতের কর্মযজ্ঞের প্রতি আকর্ষণের সূত্রপাত I ভিত্তোরিও দি'সিকার 'বাইসাইকেল থিভস'এ মানুষের জীবনের উপাদান সত্যজিৎকে তার চিত্রনির্মাণে করে একাগ্র ও অনড় I এই ভীত আর জীবন উপলব্ধির হাত ধরে আসে ভারতের নিউ ওয়েভ চলচিত্র তথা এক নতুন ইতিহাসের সূচনা I

এবার আলোকপাত করা যাক এই নতুন ইতিহাসের বিভিন্ন বৈশিষ্টমূলক দিক ও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ওপর I ওনার সমস্ত ছবির চরিত্র চিত্রায়ন , নির্দেশনা বা চিত্রনাট্যের বহুল চর্চিত দিকগুলো ছাড়া দেখা যাক কিছু বিশেষ উপলব্ধ বৈশিষ্টগুলোকে। রায়সাহেবের চলচিত্র চিন্তাশীলতার ভিতেই ছিল যে ভাবনা তা হলো , ‘ Cinema is the highest form of commercial art.’ তাই নরনারীর জীবন থেকে উঠে আসা ঘটনার প্রতিফলন তার সৃষ্টিতে। শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ, অভিনয়, আবহ সঙ্গীত সবকিছুতেই প্রাধান্য ছিল মানুষের জীবনযাত্রার। বিভিন্ন সময়ে তাঁর ছবিগুলোর পর্যালোচনায় যে জিনিসটি সবার আগে উঠে আসে তা হলো দৃশ্যনির্মানে তিনি কি ভীষন রকম জোর দিয়েছেন বিশদ প্রাসঙ্গিক সুক্ষ্মতার খুঁটিনাটিতে ও তার অন্তর্নিহিত শিক্ষায় I বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আসল আউটডোর শুটিং লোকেশান বা বস্তুগত জিনিসের ব্যবহার অথবা অব্যর্থ সংলাপ চয়ন চিত্রনাট্যকে দিয়েছে এক অন্যমাত্রা। অপু ত্রয়ীতে যেমন উঠে আসে একটি জীবনের রুপান্তরের দিক , তেমনি গোচর হয় চরিত্রগুলোর মানসিক ও নৈতিক ওঠানামা। যেমন প্রকট হয় চরিত্রকেন্দ্রীক ঘটনাপ্রবাহ , অন্যদিকে কলকাতা ত্রয়ীতে (প্রতিদ্বন্দী,সীমাবদ্ধ ও জনঅরণ্য) প্রকট হয় তৎকালীন আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন। সামাজিক অস্থিরতায় সুস্থীতিশীল বা বিদ্ধস্ত অবস্থার বিভিন্নশ্রেণীর চরিত্রকে যেন চালিত করে পারিপার্শ্বিক অবস্থান ও তার অঙ্গুলিহেলন। 'অপুর সংসার' এর এক দৃশ্যে বন্ধু পুলুর সাথে কথোপকথনে যেমন দেখা যায় এক জীবনমুখী দৃঢ় প্রত্যয়ের আবেদন তেমনি ' প্রতিদ্বন্দী 'এর শুরুতে শবযাত্রার নেগেটিভ ফিল্মিংএর দৃশ্য চিরসত্য মৃত্যুর এক অসামান্য নিদর্শন I এছাড়া জনঅরণ্য বা চারুলতার দৃশ্য বিশেষে ব্যবহৃত Freeze Frame Shot ও আকস্মিক স্তব্ধতার মাধ্যমে তিনি অনবদ্যভাবে বুঝিয়েছেন দ্বন্দের দিকটি। নায়কের টাকার সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বা রেল লাইন এ চাঁদের আলোর প্রতিফলন মানুষের অন্তর্দ্বন্দকে কি অসাধারণ প্রতীকী রূপে দেখায় I আরো ‘মহানগর’এর শেষ দৃশ্যে দেখানো ভাঙা বাতি হোল্ডার কি চমৎকার ভাবে সংশয়ের মুখে ফেলে দেয় দর্শকবৃন্দকে । দৃশ্য সম্পাদনার বিভিন্ন স্তরে তিনি একাধারে ব্যবহার করেছেন জাম্পকাট, ডিসল্ভ বা মন্টেজের মতো দুর্ধর্ষ সব কারিগরি উপাদান । এইসবের খুঁটিনাটি নিয়ে অশেষ কাজকর্ম তার । চলচিত্রের বিষয় চয়নে তিনি বারবার আশ্রয় নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ঠিক তেমনই তিনি সেই রবীন্দ্রনাথকে যথাযত ভাবে প্রোথিত করেছেন বিশ্ব জনমননে । তবে সেই কার্যসিদ্ধিতে তিনি বারবার রুপান্তর ঘটিয়েছেন উৎস সাহিত্য থেকে তাঁর চিত্রনাট্যে । তবে তা সবই গল্পের তাৎণিক অবস্থানুপযোগী দরকারে। ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে খাঁটি ভারতীয়ত্ব। দৃশ্য বা সংলাপে প্রভাব এসেছে উপনিষদ হতে পুরাণ বা পাঁচালী । ‘অপু ত্রয়ী’ বা ‘আগন্তুক’ বা ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ তে বারবার এসেছে ধর্মের আসল ব্যবহার বা প্রয়োজনীয়তার কথা । নারী সত্তা , তাদের সংকট , সামাজিক অবস্থান ফিরে ফিরে এসেছে বারবার ‘তিন কন্যা’, ‘চারুলতা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘অভিযান’, ‘মহানগর’ ও আরও কতো কিছুর মাধ্যমে।

তাঁর সমস্ত চলচিত্রের বিভিন্ন অংশে শব্দ ও সংগীতের যে সুগভীর প্রয়োগ দেখা যায় তা বোধহয় পাওয়া যায় না বিশ্ববন্দিত অনেক চিত্রপরিচালকের কাজে I শব্দ ও সংগীতেরও প্রতীকীরূপে ব্যবহার ছিল অনিবার্য I 'মহানগর' এর একদৃশ্যে নায়ক-নায়িকার চাকরির অনিশ্চয়তার মাঝে পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা রেডিও চ্যানেল চেঞ্জ এর মাধ্যমেই হোক বা 'গুগাবাবা' র রাজার গানের আসরে বিভিন্ন গায়কের বৈচিত্রপূর্ণ সংগীত পরিবেশনাতেই হোক তা সবই অন্তর্নিহিত এক বার্তারই প্রতীক মাত্র I 'ঘরে বাইরে' তে কিশোর কুমারকে দিয়ে তিনি রবিঠাকুরের গান গাওয়ালেন কোনো তথাকথিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে দিয়ে নয় কারণ, চরিত্র সন্দীপ একজন সাধারণ মানুষ কোনো নির্ভুল রবীন্দ্রশিল্পী নন বলে I বেশকিছু জায়গায় কোনো আবহসংগীতের বদলে শুধু কিছু বাদ্যশব্দ যেন এক অন্য মাত্রা দেয় I প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সংগীতের এক অনবদ্য সংমিশ্রনে তাঁর সংগীত সৃষ্টির প্রয়োগ I
 
ছোটদের ছবিগুলোতে তিনি বিশেষভাবে ছিলেন মনোযোগী I বহু চরিত্রের মাধ্যমেই তিনি ছোটদের আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতেন জ্ঞানসংগ্রহের দিকে I ফেলুদা , সিধুজ্যাঠা , মনমোহন (যদিও সে অর্থে 'আগন্তুক' ছোটদের ছবি নয়) এইসব চরিত্রগুলোর অগাধ পড়াশুনা ও জ্ঞান দেখে বাস্তবিকই একটি শিশু ও কিশোর মনে জানার জগতে অবগাহন ছিল অবশ্যম্ভাবি I 'হীরক রাজার দেশে'র ভিন্ন বয়সে ভিন্ন উপলব্ধি মানুষকে ভিন্ন ভাবে ভাবিয়েছে বারবার I

অন্যান্য চলচিত্রের মতোই বিভিন্ন তথ্যচিত্রগুলো ছিল যেমন তথ্যপূর্ণ তেমনি সরস ও উপভোগ্য I নামিদামি অভিনেতা ছাড়াও তিনি অনামী এবং অনভিজ্ঞদের ব্যবহার করেছেন অনবদ্য ভাবে প্রয়োজনীয় জায়গায় I

এই কথাগুলো শেষ হওয়ার নয় I অনেক কিছু বলার তাই ছন্নছাড়া হতেই হয় সময় ও শব্দের কৃপণতার কাছে  I শুধু আপামর বাঙালি জনমানসে না বিশ্বদর্শক মননে তথা প্রখ্যাত চলচিত্রকার যেমন কুরোসাওয়া , বার্গম্যান, মৃনাল, ঋত্বিক থেকে শুরু করে স্কোরসেসে বা নোলান ও তাঁর গুণগ্রাহী I তাই মনে হয় -

‘যতই আনো পরশ-পাথর না হয় সোনা হিরে,

দেখলে মানিক দেখবে না কেউ অন্য কিছু ফিরে।'

 
......