রক্তিম লস্কর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রক্তিম লস্কর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সমুর অজ্ঞাতবাস - রক্তিম লস্কর

 

সমুর অজ্ঞাতবাস

রক্তিম লস্কর 



***এক***

 

    সেদিন সকাল থেকেই সমু বেশ টেনশনে। তার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সে ঠাকুর ঘরের সকল দেবদেবীকে ভালো করে প্রণাম করে নেয়। ঠাকুমা তার প্রিয় নাতির কপালে দিয়ে দেয় দইয়ের ফোঁটা।

সমুর ভালো নাম সুমিত চৌধুরী। সে বনগাঁর সুভাষপল্লীতে থাকে। তার বাবা রঞ্জিত চৌধুরী বনগাঁ কলেজে অঙ্ক পড়ান। আর সমুর দিদি হিমিকা গত বছরই মাধ্যমিকে প্রচুর নম্বর নিয়ে পাশ করেছে। তাই তো বাড়িতে কথায় কথায় দিদির সাথে সমুর রেজাল্ট নিয়ে তুলনা করা হয়।

সমুদের স্কুলের নাম আবার তার দাদু ফণীভূষণ চৌধুরীর নামে। ওনার উদ্যোগেই তাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাই স্কুলের শিক্ষক থেকে ছাত্র সকলেই তাকে এক ডাকে চেনে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক হাঁটা পথে সমু পৌছে যায় স্কুলে। এদিকে স্কুলে এসে সমুর মাথায় হাত। একে তো সে পড়াশোনায় খুব একটা ভালো নয়। তার উপর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাও তার ভালো হয়নি। সে ভেবেছিল এবারও ঠাকুর দেবতার আশীর্বাদে সে উতরে যাবে।  

কিন্তু তা আর হল না। রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল সমু পরীক্ষায় ফেল করেছে। অর্থাৎ সে পরের ক্লাশে আর উঠতে পারবে না। এদিকে ওর সব বন্ধুরা ভালো ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে গেছে। অথচ যত কৃপণতা সমুর নম্বরের বেলা!   

স্কুল থেকে মার্কশিট নিয়ে মাথা নিচু করে সমু বের হয়ে আসে। এরপর সে কি করবে ভেবে পায়না। সে অঙ্কে পেয়েছে মাত্র পনেরো। বিজ্ঞানের নম্বরও সেই কুড়ির ঘরে। এই মার্কশিট নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে বাবার একটা মারও যে নিচে পড়বে না সেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। এর উপরে রয়েছে মা’র বকা ও দিদির দিদিগিরি। বাড়িতে তার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হয়ে উঠবে।

রাস্তায় যেতে যেতে সমু ঠিক করে এই মুখ নিয়ে সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। বরং সে চলে যাবে সোজা অজ্ঞাতবাসে। সেখানে কেউ তাকে চিনবে না, জানবে না। সেখানে গিয়ে ভালো কিছু করে সে বাড়ির সকলকে দেখিয়ে দেবে।

কিন্তু সমু যাবেটা কোথায়? কাছে পিঠে সেরকম যাওয়ার জায়গা বলতে সেই কোলকাতা। তাও ট্রেনে করে যেতে হয়। তার দৌড় আবার সেই দমদমে পিসির বাড়ি অবদি। তাও সেই সময় বাবা, মা ও দিদি সাথে ছিল।

এদিকে সমুর পড়নে স্কুলের পোশাক। পিঠে স্কুলের ব্যাগ। আর পকেটে টিফিনের জন্য মা’র দেওয়া মাত্র পাঁচটা টাকা। তাকে দেখে স্কুলফেরত ছাত্র ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। এদিকে সূর্য তখন প্রায় মধ্য গগনে। কিন্তু সমুর সেদিকে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই।

প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটা পথে সমু এসে পৌছায় বনগাঁ ষ্টেশনে। সে দেখে একটু বেলা হয়েছে বলে ষ্টেশনে খুব একটা লোকজন নেই। স্টেশনে এসে সে আশপাশটা একটু ভালো করে দেখে নেয়। স্টেশনে চেনাশোনা কেউ থাকলে তার আবার অজ্ঞাতবাসে যাওয়া আটকে যেতে পারে।

ইতিমধ্যে স্টেশনে একটা লোকাল ট্রেন এসে দাড়ায়। আর ট্রেন থামা মাত্রই প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে থাকা লোকজন উঠতে শুরু করে। সেই সাথে সমুও উঠে পড়ে ট্রেনে। কিছুক্ষণ পরে জোরে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। সমু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

 

***দুই***

 

    সমু ট্রেনে উঠে দেখে ভিতরে প্রচুর সিট খালি। সে জানলার ধারে একটা ভালো সিট পেয়ে যায়। সে স্কুলের ব্যাগটা কোলে নিয়ে সেখানেই বসে পড়ে। ট্রেন ছাড়তেই বাইরে থেকে ফুরফুর করে হাওয়া এসে লাগে তার গায়ে। এই প্রথম একা একা ট্রেনে যেতে তার বেশ ভালোই লাগে।

সমু দেখে কামরার ভিতর বিভিন্ন ধরণের লোক বসে রয়েছে। তার ঠিক পাশেই বসেছে এক সাপুড়ে। সে তার সাপের ঝুড়ি রেখেছে ঠিক সিটের নিচে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে এক পিস বের হয়ে পড়লে সমূহ বিপদ। সেই ভয়ে সমু পা নাড়াতেও সাহস পায় না।

আর সমুর ঠিক উল্টোদিকের জানালায় বসেছে একটা মোটামতন লোক। সমুদের কামরায় বাদাম ভাজা থেকে আরম্ভ করে যত খাবার দাবার উঠছে তাদের সকলের কাছ থেকেই লোকটা কিছু না কিছু কিনছে। আর তারপর কপাকপ করে সেগুলো খাচ্ছে।  

চোখের সামনে এসব দেখে সমুরও খুব খেতে ইচ্ছে করে। সেই সাত সকালে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ইতিমধ্যে তার বেশ খিদেও পেয়েছে। কিন্তু তার পকেটে পড়ে রয়েছে সবেধন নীলমণি পাঁচ টাকা। এই টাকা কখন কিভাবে লাগবে সে জানে না। তাই সে চুপটি করে বসে থাকে। 

সেই মোটামতন লোকটির পাশে বসেছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি অনেকক্ষণ ধরে সমুকে দেখে যাচ্ছেন। সমুর পড়নে স্কুলের পোশাক ও সাথে স্কুলের ব্যাগ। আর সে একা একা যাচ্ছে ট্রেনে। তাকে দেখে যে কেউ সন্দেহ করতেই পারে। সমু অবশ্য লোকটির দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না। সে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে চলেছে।

এছাড়া সমুদের কামরায় রয়েছে কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের মহিলা। তাদের সাথে রয়েছে গোটা দুয়েক বাচ্চা। এছাড়া দরজার সামনে মাল নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন। তারা হয়তো কোলকাতার দিকে যাবে। চলন্ত ট্রেনের আওয়াজের মাঝে লোকজনের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে।

সমু এর আগেও বার কয়েক ট্রেনে চড়েছে। অবশ্য প্রতিবারই বাবা ছিল তার সাথে। দমদমে রয়েছে তার এক পিসীর বাড়ি। সেখানেই সে বার কয়েক গিয়েছে বাবা, মা ও দিদির সাথে। সেই সুবাদে এদিকের কিছু কিছু স্টেশনের নাম সে জানে।

একেকটা করে স্টেশন আসছে। ট্রেনটা একটু থেমে আবার চলতে শুরু করছে। আর সেই সাথে পিল পিল করে লোক উঠছে ট্রেনে। দেখতে দেখতে ট্রেনটা গোবরডাঙা স্টেশনে এসে থামে। আর সেই সঙ্গে সমুর পাশে বসা সাপুড়ে লোকটা তার সাপের ঝুড়ি নিয়ে নেমে যায়। আর সমু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। অবশ্য তখনও সে জানে না তার জন্যে কি অপেক্ষা করে আছে এর পরে।  

এর পরের স্টেশন মসলন্দপুর। পরের স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই সমুর উল্টোদিকে বসে থাকা মোটামতন লোকটা নেমে যায়। আর সেই সাথে এক দঙ্গল লোক উঠে পড়ে ওই ট্রেনের কামরায়।

পাশে বসা লোকটা নেমে যেতেই উল্টোদিকে বসা বয়স্ক ভদ্রলোকটি জানালার ধারে এসে বসেন। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রায় আট দশজন লোক এসে হাজির হয় সমুদের সিটের সামনে। তারা একপ্রকার জোর করে সমুকে সরিয়ে দেয় জানালার ধার থেকে। আর উল্টোদিকের জানালায় বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোককেও তারা একইভাবে সরিয়ে দেয়। এতগুলো লোকের সামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

 

***তিন***

 

    সমুদের একপাশে সরিয়ে লোকগুলো বসে যায় সিটে। অবশ্য সবার বসার জায়গা হয়না। বাকিরা ওখানেই দাড়িয়ে পড়ে। আশেপাশের লোকেদের তাতে বেশ অসুবিধা হয়। কিন্তু কেউ কিছু বলে না।  

লোকগুলোকে দেখে সমুর মনে হয় ওদের বয়স ত্রিশের মধ্যেই। সকলের পড়নে প্যান্ট ও টি শার্ট। আর তাদের কথার মাঝে শোনা যায় নানারকম গালাগালি। কামরায় থাকা অন্য লোকেদের তারা বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয়না।

এদিকে পাশের লোকগুলোর চাপে সমু একটু ভিতরের দিকে কোনমতে বসেছে। পাশের যাত্রীদেরও সেই একই অবস্থা। কিন্তু ভয়ে সকলে মুখ বন্ধ করে রাখে।

এদিকে লোকগুলো তাস খেলার প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। দুই দিকের সিটের মাঝে গামছা বিছিয়ে শুরু হয় তাস খেলা। সমু আগে লোকাল ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে অফিস যাত্রীদের তাস খেলার কথা শুনেছিল। এই প্রথম সে ঘটনাটা দেখতে পায়।

এদিকে ট্রেন চলতে থাকে। আর চলন্ত ট্রেনে সমুদের কামরায় চলতে থাকে তাস খেলা। আর সেই সাথে চলে লোকগুলোর হই হুল্লড়

ইতিমধ্যে ট্রেন এসে ঢোকে দত্তপুকুর ষ্টেশনে। যথারীতি লোকজনের ওঠানামা চলতে থাকে। কিন্তু সময় হয়ে গেলেও  ট্রেন আর ছাড়ার নাম করে না। ট্রেনের ভিতরে বসা লোকেরা বিরক্ত হয়ে ওঠে।

এরই মাঝে কয়েকজন লোক ছুটতে ছুটতে জানিয়ে যায় যে দত্তপুকুর ষ্টেশনে চেতনা এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সমুদের কামরার দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকজন হাওয়া হয়ে যায়।  

সমু চেতনা ট্রেনের কথা আগে শুনেছে। সাধারণত টিটিরা লোকাল ট্রেনে উঠে টিকিট পরীক্ষা করে না। কিন্তু মাঝেমধ্যে চেতনা ট্রেনে করে একদল টিটি এসে হাজির হয় কোন ষ্টেশনে। তারপর তারা সকলের টিকিট পরীক্ষা করে। আর টিকিট না পেলে সেই লোকগুলোকে তারা ধরে নিয়ে চলে যায়।

এদিকে চেতনার খবর পেয়ে ট্রেনের কামরার লোকজনের চেতনা যেন হঠাৎ করে জাগ্রত হয়। সমুদের কামরায় থাকা বেশ কিছু লোক এদিক ওদিক দিয়ে নেমে যায়।

এদিকে চেতনা ট্রেনের কথা শুনে সমুরও টেনশন শুরু হয়ে যায়। সে তাড়াহুড়োয় বনগাঁ থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছে। আর সেই সাথে টিকিটও কাটা হয় নি। অবশ্য তার পকেটে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। সেই টাকায় অবশ্য টিকিট কাটাও যেত না।  

এদিকে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যায় প্ল্যাটফর্মে কিছু কালো কোট পড়া লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা সামনে যাকেই পাচ্ছে তার টিকিট পরীক্ষা করছে। যার টিকিট পাচ্ছে না তাকে ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে কালো কোট গায়ে দুইজন টিটি এসে হাজির হয় সমুদের কামরায়। তারা এক এক করে সকলের টিকিট পরীক্ষা শুরু করে। তাই দেখে সমুর প্যালপিটিশন বাড়তে থাকে।  

এরপর এক টিটি এসে হাজির হয় সমুদের সিটের সামনে। পাশের লোকেদের টিকিট দেখে এসে টিটি  ভদ্রলোক সমুকে বলে, “খোকা তোমার টিকিট কোথায়?”

সমু মাথা নেড়ে বলে, “নেই”।

সমুর পোশাক ও ব্যাগ দেখে টিটির সন্দেহ হয়। সে আবার জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কার সাথে ট্রেনে যাচ্ছ?”

ঠিক সেই মুহূর্তে সমুর মনে একটা দুষ্টু বুদ্ধি জেগে উঠে। সে ইচ্ছে করে তার পাশে বসা জানালার ধারের লোকগুলোকে দেখিয়ে দেয়।

এরপর টিটি গিয়ে হাজির হয় তাস খেলতে থাকা লোকগুলোর সামনে। সামনে টিটিকে দেখে তাদের খেলা থেমে যায়। লোকগুলোর চেহারায় সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

টিটি বলে, “আপনাদের টিকিট দেখান?”

একজন জবাব দেয়, “আমাদের তো টিকিট নেই।“

টিটি ভদ্রলোক বলে, “টিকিট নেই মানে? টিকিট দেখান। নাহলে অন্য ব্যবস্থা আছে।“

লোকটি জবাবে বলে, “আমরা এই ভাবেই ট্রেনে যাতায়াত করে থাকি। কিছু করার থাকলে করে নিন।“

ইতিমধ্যে টিটির কথা শুনে অন্য টিটিও চলে এসেছে। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে বাক বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। চেতনার টিটিদের সাথে যে রেল পুলিশ থাকে সেটা বোধহয় লোকগুলোর জানা ছিল না।

কামরার ভিতরে চেঁচামেচি চলতে থাকে। সেই শুনে প্ল্যাটফর্ম থেকে এক দল পুলিশ এসে হাজির হয়। এরপর শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি। এরই মাঝে লোকগুলো পকেট থেকে ছুরি বের করে। কিন্তু পুলিশদের কাছে রয়েছে বন্দুক। তাই পুলিশের সাথে লোকগুলো আর পেরে উঠে না।

ভর দুপুরে দত্তপুকুর ষ্টেশনে দাড়িয়ে থাকা বনগাঁ লোকালের কামরায় চলে এক জমজমাট ঘটনা। রেল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় সেই লোকগুলো। তাদের হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্ল্যাটফর্মের দিকে। যাওয়ার সময় সমুকেও সাথে করে নিয়ে যায় একজন টিটি।

 

***চার***

 

    এদিকে সমু না ফেরায় চৌধুরী বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে যায়। সেই সকালবেলা ছেলেটা রেজাল্ট আনতে গেছে স্কুলে। কিন্তু তারপর থেকে তার আর কোন পাত্তা নেই।

সমুকে না দেখে বাড়ির সকলের খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সমুর মা ততক্ষণে কাণ্ণা জুড়ে দেন। সাথে তার ঠাকুমা সঙ্গ দেন। এদিকে সকাল থেকে ভাইকে না দেখে দিদি হিমিকাও পাগলের মত করতে থাকে। এমনিতে ভাইয়ের সাথে অল্পবিস্তর খুনসুটি করলেও ভাইকে সে খুবই ভালোবাসে।  

সমুর বাবা রঞ্জিত চৌধুরী গিয়েছিলেন কলেজে। বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে তিনিও ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে এসেছেন বাড়িতে। বাড়ি ফিরেই তিনি একে একে সব জায়গায় ফোন করেছেন।

ছেলের স্কুলের রেজাল্টের খবর তিনি অবশ্য আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন। তা নিয়ে বাড়ি ফিরে ছেলেকে একটু বকাঝকা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তার আগেই যে তার ছেলে এরকম করে বসবে তা তিনি বুঝতে পারেন নি।

দুপুরের মধ্যে সারা সুভাষপল্লীতে সমুর হারিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ার লোকেরাও সমুর খোজে দফায় দফায় বাড়িতে হানা দিতে থাকে।

ইতিমধ্যে সমুর বাবা ছেলের বন্ধুদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন। দমদমে সমুর পিসির বাড়িতেও খবর নেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় সমুকে খুজে পাওয়া যায় না। 

শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না দেখে সন্ধ্যাবেলায় রঞ্জিতবাবু  গিয়ে হাজির হন বনগাঁ থানায়। থানার বড়বাবুর পরামর্শমত মিসিং ডায়েরি করা হয়। কিন্তু সেখান থেকেও কোন খবর পাওয়া যায় না।

এদিকে সারা বনগাঁ চষে রাত ন’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন রঞ্জিতবাবু। কোথাও তিনি ছেলেকে খুজে পাননি। তিনি একপ্রকার পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন। এদিকে বাড়ির পরিস্থিতি বেশ খারাপ। সমুর মা ও ঠাকুমা কাঁদতে কাঁদতে এক প্রকার বিছানা নিয়েছেন। সমুর দিদিরও সেই একই অবস্থা।

এরকম একটা সময় রঞ্জিতবাবুর মোবাইলে একটা ফোন আসে। বনগাঁ থানা থেকে ফোন করে জানায় যে সমুর খবর পাওয়া গেছে। তাকে নিয়ে রেল পুলিশের একটা দল আসছে বনগাঁয় সমুর বাড়িতে। 

সারাদিন পরে বাড়ির ছেলের খবর পেয়ে চৌধুরী বাড়িতে যেন স্বস্তি নেমে আসে। সমুর মা ও ঠাকুমা এসে বসেন বাইরের ঘরে। তার দিদিও চলে আসে সেখানে। খবর পেয়ে যায় পাড়ার লোকেরাও। তারাও দলে দলে এসে  ভিড় জমায় সমুদের বাড়ির সামনে।  

প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে পুলিশের একটা গাড়ি এসে দাড়ায় সমুদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায় সমুকে। সারাদিন পরে সমুকে দেখে বাড়ির সকলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

সমুকে সাথে করে এক পুলিশ অফিসার এসে ঢোকেন সমুদের বাড়ির ভিতরে। ছেলেকে দেখে রঞ্জিতবাবু পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেন,

“সমুকে পেলেন কোথায়?”

“ওকে পাওয়া গেছে দত্তপুকুর স্টেশনে। ডাউন বনগাঁ লোকালের কামরায়।”

“বনগাঁ লোকাল! ট্রেনে ও কি করছিল?”

“কি করেনি সেটা বলুন? আপনার ছেলের জন্যে আজকে আমরা এক দল দাগি দুষ্কৃতীকে ধরতে পেরেছি।”

“বলেন কি?”

“হ্যাঁ, মিস্টার চৌধুরী। এরকম স্মার্ট সাহসী ছেলে আজকের দিনে দেখাই যায় না।”

“সমু কিনা শেষে...”

রঞ্জিতবাবু আর কথা শেষ করতে পারেন না। ইতিমধ্যে ভিতরের সমস্ত কথা বাইরে থেকে শুনে নিয়েছে পাড়ার লোকেরা। তারা বলতে শুরু করে, “থ্রি চিয়ার্স ফর সমু, হিপ হিপ হুররে।“

এই সময় সমুর আর এসব ভালো লাগে না। সে ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে।  
 
 *** সমাপ্ত ***
 
 Raktim laskar