ভৌতিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ভৌতিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আহ্বান - অবন্তী পাল


আহ্বান
অবন্তী পাল
 

 

 

...১...

 
১০৫ ফুট উচ্চতায়, নেলসন মনুমেন্টের ছাদে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ হাল্কা ফুরফুরে পালকের মতন নির্ভার লাগছিল। ওপরে অন্তহীন নীল আকাশ, মাঝে শোঁ-শোঁ করে বয়ে চলেছে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর অনেক অনেক নীচে আপন খেয়ালে রাজপথ দিয়ে এঁকে-বেঁকে এগিয়ে চলেছে স্বপ্নিল নগর এডিনবরা, স্কটল্যান্ডের রাজধানী।

আমি আর আমার দুই বান্ধবী রুশ্মি আর তনুজা সপ্তাহান্তে ক্লান্তি ঘোচাতে রবিবারের দুপুরে এসেছি ক্যালটন হিলসে। পায়ে হেঁটে প্রিন্সেস স্ট্রিট থেকে কিছুটা দূরত্বে অবস্থিত এই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট একটা বিশিষ্ট পর্যটনকেন্দ্র। এই উচ্চতা থেকে দেখা যায় ন্যাশনাল মনুমেন্ট, এডিনবরা'র ইতিহাস জুড়ে যার উপস্থিতি প্রগাঢ়। ওই দূরে দেখা যায় আর্থার'সি সিট – একটা চ্যাপ্টানো পাথুরে টিলার মতন যেটা আসনের আকার নিয়েছে। কয়েকশত ফুট নীচে সন্ত অ্যান্ড্রু'স হাউস, হলিরুড প্যালেস, স্কটিশ পার্লামেন্ট বিল্ডিং প্রমুখ সব ঐতিহাসিক স্থাপত্য। আর খুব সতর্কভাবে যদি দেখা যায়, তাহলে চোখে পড়ে কয়েক শতাব্দীব্যাপী স্তরে-স্তরে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন শহর।

এককালে এই সমুদ্রবাণিজ্যকেন্দ্রিক দেশ ইংরেজদের হাতে যেভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে, তার হাহাকার আজও বুঝি চাপা আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে আসে তার ৭টা স্তর ভেদ করে। এমনই ঠান্ডা হাওয়ায় তারা ঘুরে ফিরে বেড়ায় অন্ধকার অলি-গলি, ভগ্ন স্থাপত্য আর হাজারো নাগরিকদের মনে। এতো ওপরে, সেই হাওয়ার ফিসফিসানি বুঝি বার্তাবাহী হয়ে বয়ে আনে কতদূরের অশ্রুত সংলাপ , বলে যেতে চায় চাপা পড়ে যাওয়া শহরের গুপ্ত কথা। ভাবনার ছেদ ঘটল তনুজা’র ডাকে

‘মোহিনী, অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, চল এবার নীচে নামি’

সায় দিলো রুশ্মিও
‘হ্যাঁ, আকাশ কালো হয়ে আসছে, নির্ঘাত ঝড় আসবে। তাছাড়া দুর্গ বন্ধ করে দেওয়ার সময়ও হয়েছে’

‘তোরা না কি যে করিস’ একটু বিরক্তির স্বরে আপত্তি জানালাম আমি, ‘এইমাত্র আসলাম। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি যে একটু হাওয়ায় ধুয়ে নেবো, সেই অবকাশটুকুও দিবি না’

‘অনেক্ষন এসেছি আমরা! তাকিয়ে দেখ আর ২-৩জন লোক বাদে কেউই নেই’ ধমকের সুর তনুজার।

'তোরা নাম, আসছি আমি' তক্ষুনি নামতে নারাজ আমি।

ওরা নামতে শুরু করলে, মনুমেন্টের দিকে ঘুরে তাকালাম। ১৪৩টা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছি ১৮০৭ সালের নির্মিত এই দুর্গে, সমুদ্রতল থেকে ৫৬১ ফুট উঁচুতে। ছাদের মাথায় দেখা যায় ১৫০ বছরের পুরোনো টাইম-বল, যেটা সময়ের জানান দিত সামনের নর্থ-সি দিয়ে নৌযাত্রারত ‘পোর্ট অফ লেইথ’ আর ‘ফার্থ অফ ফোর্থ’-এর জাহাজদের। এডিনবরা রাজপ্রাসাদের 'ওয়ান ও' ক্লক' ফায়ারিং-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে, এই টাইম-বল ওঠানো হয় প্রতিদিন দুপুর ১টায়। ঐতিহাসিক এই কালো গোলকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম সূর্যের তেজ স্তিমিত হয়ে আসছে। সমগ্র আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। প্রিন্সেস স্ট্রিটের ওপরে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা স্কট মনুমেন্ট একটা কালো অশনী ছায়া ফেলেছে রাজপথে। নাহ, আর থাকা যাবে না। হাওয়ার বেগ অনেক গুন বেড়ে গেছে, কয়েক পারদ নীচে নেমেছে তাপমাত্রা। বরফশীতল হাওয়া আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সংকেত দিতে লাগলো

‘মোহিনী, ফিরে যাও, ফিরে যাও…’

এতক্ষনে খেয়াল হলো, ছাদে আমি সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে আছি।

...২...

কয়েকটা সিঁড়ি নামতে না নামতেই শুনতে পেলাম, প্রবল ঝড় এসে গেছে বাইরে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নামার চেষ্টা করলাম। এমনিতেই দেওয়ালজোড়া অবরুদ্ধ অন্ধকার এই সর্পিল সিঁড়িতে, তায় আবার জানলা দিয়ে যেটুকু রোদ্দুর আসে, সেটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এখন। 

কতগুলো সিঁড়ি নেমেছিলাম জানিনা, এমন সময় দেখি সামনের বাঁকের অবতরণস্থলে কেউ একজন দেওয়ালমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে আমার মুখোমুখি হলেন একজন অতিবৃদ্ধা, মলীন জামাকাপড় পরিহিতা ভদ্রমহিলা।

স্মিত হেসে পাশ কাটিয়ে নামতে যাবো, এমন সময় ভদ্রমহিলা এমনভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন যে দুটো সিঁড়ি পিছিয়ে উঠে যেতে বাধ্য হলাম।

তারপর অতন্ত্য ক্ষীণ অথচ অনুনয়ের কণ্ঠে বললেন
'ইয়ং লেডি, আমার নাত্নিকে কি ছাদে দেখেছো?'

'না ম্যাডাম, আমি তো আর কাউকেই ছাদে দেখিনি, সকলেই নেমে গেছে' আমি নরম সুরে বললাম

'সেই কখন ছাদে উঠেছে ডেলা, এখনও নামছে না দেখে আমি উঠতে বাধ্য হলাম'

'কিন্তু ওপরে তো আর কেউই নেই, আমি দেখেই নামছি। তাছাড়া ভীষণ ঝড় উঠেছে বাইরে, কারুর ওখানে থাকা সম্ভবও নয়। আপনার নাত্নি নিশ্চয়ই নীচে নেমে অন্য কোথাও গেছে। চলুন নীচেই অপেক্ষা করবেন' আমি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।

'ওহ নো নো' মুখের সামনে হাত নেড়ে উনি প্রবল আপত্তি জানালেন। এবার চমকে উঠলাম আমি। ভদ্রমহিলার হাতগুলো এই অন্ধকারেও দেখে মনে হয় প্রাচীন, নখগুলো ধূলিমাখা, ক্ষয়ে যাওয়া। এতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে এখানে উঠতে দেওয়া হলো কিভাবে? উনি পুনরায় বললেন
'আমি নিশ্চিত, ডেলা এখানেই আছে। আমি ওকে নামতে দেখিনি'

এক মুহূর্ত থেমে বললেন
'ইয়ং লেডি, তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে? একবার দেখে আসবে? আমার ডেলা ছাদেই আছে'

ভারী মায়া হলো ভদ্রমহিলার ওপর। হয়তো নাত্নিকে না দেখতে পেয়েই, রক্ষক-কর্মীদের চোখের আড়ালে হন্যে হয়ে ছুটে এসেছেন এখানে। আমি বললাম

'আমি দেখছি, আপনি এইখানেই অপেক্ষা করুন'

গুনে গুনে ৫৮টা সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে এলাম। ঝড় কমেছে, বৃষ্টি আসন্ন। তবুও ছাদটা একবার চক্কর কেটে দেখলাম। কেউ কোত্থাও নেই। মিনিটখানেকের মধ্যে নামতে লাগলাম, কিন্তু কয়েকটা সিঁড়ি নেমেই, থতমত খেয়ে গেলাম। বড়োজোর ১০-১২টা সিঁড়ি নেমেছি। সেই ভদ্রমহিলা দেখি ইতিমধ্যে উঠে এসেছেন এতোদূর। এতো তাড়াতাড়ি উঠলেন কিভাবে?

'পেলে? আমার ডেলা কোথায়?' ভদ্রমহিলা দুইদিকের সঙ্কীর্ণ দেওয়াল আঁকড়ে উঠছেন। 

আমি ওনাকে তাড়াতাড়ি ক্ষান্ত করার অভিপ্রায়ে বললাম
‘নো ম্যাডাম, ওপরে কেউ নেই, আপনার কিছু ভুল হচ্ছে'

'না, ওই তো গলা পাচ্ছি কাদের… তুমি শুনতে পাচ্ছ না? ওপরের দিকটা দেখেছিলে?' 

ওপরের দিকে দেখবো! সেখানে কারুর কিভাবে যাওয়া সম্ভব? বিশালাকার টাইম-বল আছে সেখানে। কিন্তু দক্ষ কর্মী ছাড়া ওখানে যাওয়া তো সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। 

কিন্তু ওনার পীড়াপীড়িতে আবার উঠতে বাধ্য হলাম। না তো উনি আমার কথা শুনছেন, না আমাকে নামতে দিচ্ছেন।

'দেখুন আমার মনে হয় নীচে নেমে নিরাপত্তাকর্মীদেরকেই জানানো ভালো' খোলা ছাদে এসে আমি এবার পরিষ্কারভাবে জানালাম।

'ওহ নো নো, ওদেরকে কক্ষনো কিছু জানবে না, ওরা যদি আমার নাত্নীকে ধরে নিয়ে যায়!'

'মানে? ধরবে কেন? ও কি কিছু করেছে?'

'আমার ডেলা নিষ্পাপ শিশু। ও কি কিছু করতে পারে? কিন্তু তুমি শোনোনি এখানকার অভিশপ্ত ইতিহাস? আমাদের সাধারণ নাগরিকদের ওপর কিভাবে ঘৃণ্য অত্যাচার করা হতো, তার ছাপ তো শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রকট। শোনো শোনো, ওই যে তুফানও বলছে আজ… নিয়ে যাবে, ওরা আমার ডেলা’কে নিয়ে যাবে… ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার চাইল্ডকে আমার কাছে' ওনার কণ্ঠস্বর ক্রমশ উগ্র হয়ে উঠলো।

ভদ্রমহিলার উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আর এই যুগে দাঁড়িয়ে কোন রক্তক্ষরিত অতীতের কথা বলছেন? বুঝতাম হয়ত উনি মানসিক-ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন, হয়তো ওনার অতীতে ঘটে গেছে ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা। কিন্তু আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দিচ্ছিল যে এটা কোনো সাধারণ হাহাকার নয়। ছাদে উনি প্রবেশ করেননি, দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির সর্বপ্রথম ধাপে। কিন্তু সেখান থেকেও দেখা যাচ্ছে ওনার চোখ প্রায় কোটরে, দৃষ্টি বলে কিছু থাকারই কথা নয়। জামাকাপড় যেন কত প্রাচীনকালের, জরাজীর্ণ মলিন। জীবন্ত মানুষের চামড়া যে এতো কোচকানো আর ফ্যাকাশে হয়, সেটা অভাবনীয়। সর্বোপরি, এমতবস্থায় উনি তরতরিয়ে উঠে এলেন কিভাবে এতোগুলো সিঁড়ি টপকে?

কথা বলতে বলতে আমি ছাদের একেবারে ধারে চলে এসেছি। এক অজানা শিহরণে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে আর ঠিক তখনই ভদ্রমহিলা দন্ত্যহীন হাসি হেসে বললেন

‘আমার কাছে এসো, মাই ডেলা' দুই-হাত প্রসারিত আমারই দিকে!

চোখ কপালে তখন আমার। আমি বলার চেষ্টা করলাম
'আমি আপনার ডেলা নই, আমি মোহিনী। আপনার কোথাও ঘোরতর ভুল হচ্ছে' কিন্তু মুখে এসব বললেও, এক-পাও নড়ার ক্ষমতা ছিলো না আমার। ওই অন্ধ কোটরের চাহনি মনে হলো আমাকে ঝিমিয়ে দিচ্ছে।

আবারও ভদ্রমহিলা বললেন ‘সেই কবে থেকে আমার ডেলাকে খুঁজে চলেছি। এইভাবে কেউ পালিয়ে বেড়ায়? এই টাওয়ারে ওর আসার জন্য আমি রোজ অপেক্ষা করে থাকি। আজ যখন অবশেষে তাকে পেয়েছি, তখন কার ভরসায় ওকে ফেলে রেখে দেব এই ভয়ঙ্কর শহরে? এসো মাই চাইল্ড, আমরা ফিরে যাই আমাদের স্বস্থানে’

এতো ওপর থেকে চিৎকার করলে তো কেউ শুনতেও পাবে না। এতক্ষনে কি দূর্গের ফটক তালাবন্ধ হয়ে গেছে? এই ১০৫ ফুট ওপরে কি আজ তাহলে আমার অযাচিত সমাপ্তি ঘটবে?

তখনও উনি স্থির আমার দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলে চলেছেন

‘কাম টু মি ডেলা' প্রায় অবক্ষয় হয়ে আসা দুই বাহু আমার দিকে প্রসারিত।

হঠাৎ চমকে ভাঙার মতন, হুড়মুড়িয়ে ছাদে প্রবেশ করলো রুশ্মি আর তনুজা।

'কিরে, পাগল হয়েছিস? এতক্ষণ কি করছিস ছাদে? জানিস কখন তালাবন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এই দুর্গের? আধা ঘন্টা হয়ে গেল তুই নামছিস না দেখে আমরা বাধ্য হয়ে অনেক বলে-কয়ে উঠে এলাম উপরে' অনবরত বলেই চলেছে ওরা

হয়তো কিছু বুঝতে পেরে রুশ্মি বললো

'এই, কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো?'

আমি কোনরকমে জিজ্ঞাসা করলাম

‘ওই বয়স্ক ভদ্রমহিলা কোথায় গেলেন?'

'কে বয়স্ক ভদ্রমহিলা? এখানে তো কেউই নেই' অবাক হলো তনুজা,

'তুই জানিস সারা দুর্গে তুই ছাড়া আর একটা মানুষ ছিলো না। এই তো আমরা উঠে এলাম সবটা' বললো রুশ্মি

'কিন্তু ওই ভদ্রমহিলার জন্যই তো আমি আটকা পড়ে গেছিলাম, উনি খুঁজছিলেন ওনার নাত্নিকে…' 

কিন্তু ওরা কেউই আমার কথা বিশ্বাস করলো না। কোনোরকমে ওই সিঁড়িগুলো অতিক্রান্ত করে নেমে এসেছিলাম। মনে হচ্ছিলো সর্বক্ষন কেউ যেন আমার ঘাড়ের কাছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছে।

সেই রাতে তনুজা আমাকে বোঝালো
'শোন মোহিনী, এই শহরের আনাচে-কানাচে অনেক অন্ধকার রহস্য লুকিয়ে আছে। সেগুলো উন্মোচন করার অথবা তাদের হদিশ পাওয়ার সদিচ্ছা যদি তোর না থেকে থাকে, তাহলে এরকম ডাককে উপেক্ষা করাই শ্রেয়'

কিন্তু রুশ্মি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো
'যত্তসব আবোলতাবোল কথাবার্তা। আজ যা ঘটেছে সব তোর মনের ভ্রম। কাজের এতো চাপ, সেই সকালে বেরিয়ে রোজ রাত করে বাড়ি ফিরিস। বিশ্রাম হচ্ছেনা তোর মোটেই, তাই এসব ভুলভাল হ্যালুসিনেশন হয়েছে'

‘আজ তোরা ঠিক সময়ে না এসে পড়লে যে কি হতো, আমি ভাবতেই পারছিনা' এটুকুই বলতে পারলাম আমি। ঘটনাটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।


...৩...


আজ সপ্তাহের প্রথম দিন হওয়ায়, কাজের চাপ ভালোই ছিলো। কাজের মধ্যে গতকালের ঘটনা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। ব্যাগপত্র গুটিয়ে যখন বেরোই, তখন রাত ১০:০৩ বাজে। আজ একটু বেশিই দেরী হয়ে গেছে। অফিস প্রায় ফাঁকা।

বেরিয়ে বাস-স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছি বাসের অপেক্ষায়। ১০:১৫য় আজকের মতন এই রুটের শেষ বাস আছে। সারাদিন ধরে টিপটিপ বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় মনে হচ্ছে বরফ নখের থাবা বসাচ্ছে। এতো রাত্রে আর কোনো প্যাসেঞ্জের নেই, থাকার কথাও নয়। এটা পুরোপুরি অফিসপাড়া। একেকটা অফিস অন্যের থেকে অনেকটা দূরে। কাছাকাছি কোনো লোকালয় অথবা দোকানপাট নেই।

রাস্তার উল্টোদিকের বাস-স্ট্যান্ডে, টিমটিমে আলোটা আচমকা কাঁপতে লাগলো। ঠিক তার তলায় নজরে পড়লো কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, হাত বাড়িয়ে ডাকছে আমাকে। কেউ কি, ইনি তো গতকালের সেই বয়স্কা ভদ্রমহিলা!

উনি কি আমাকে নিতে এসেছেন তাহলে, আবারও?

........................................ 
অলঙ্করণ :-   রিচা দাস



শ্রদ্ধার্ঘ্য - এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল

শ্রদ্ধার্ঘ্য

এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল

 


 



ঘুমানোর আগে আধ শোওয়া হয়ে মোবাইলে ফেসবুক ঘাঁটছি । বছর খানেক হল  হেডমিসট্রেস হিসেবে জয়েন করেছি আমার নিজেরই স্কুলে।এ এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। এই স্কুল থেকেই আমি মাধ্যমিক পাস করি। এই পদে বহাল হবার পর থেকে ফেসবু টেসবুক করার সময় খুবই কম পাই । ওই ঘুমানোর আগে মিনিট দশ পনেরো বা আধ ঘণ্টাটাক ।

বরাবরই আমি বেশি রাত জাগি না। মোটামুটি এগারোটা সওয়া এগারোটায় লাইট অফ করে নিদ্রা দেবীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দি।সবেমাত্র মধ্য চল্লিশ ।  অনিদ্রা রোগ কাকে বলে এখনো জানিনা।
হঠাৎ ফ্রেণ্ড সাজেসানের একটা প্রোফাইল পিকচারে চোখ আটকে গেল।প্রণতি রায়।আমাদের বড়দি।কি চরম রাশভারি মানুষ ছিলেন। দোহারা চেহারা।উঁচু রাগী চোয়াল।দুটো জ্বলন্ত চোখ আর দৃঢ় চিবুক।সব মিলিয়ে চরম ভয় আর ভক্তি মেশানো এক অনুভূতি কাজ করত আমাদের ছাত্রীদের মধ্যে।
ছাত্রী বেলায় কোনো দিনও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস হয়নি।একটু অবাক হলাম ফেসবুকে ওনার প্রফাইল দেখে।ঢুকে পড়লাম ওনার ওয়ালে।
খুবই অল্প কিছু পোষ্ট , শেষ পোষ্টটা তাও আবার বছর খানেক আগের ।
দোনামনা করতে করতে ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্টটা পাঠিয়েই দিলাম।

এরপর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। ভুলেও গেছি ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্ট পাঠানোর ব্যাপারটা ।হঠাৎ একদিন নোটিফিকেশনে দেখি ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্ট একসেপটেড বাই প্রণতি রায়।খুব জানতে ইচ্ছা করল রাশভারি মানুষটা এখন কেমন আছেন। এখনও কি তেমনটাই বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাওয়ানোর মতন মেজাজটা বহাল আছে ! এখনও কি আগের মতন কোনও আর্ম চেয়ারে বসে বই পড়েন অনেক্ষণ! কোথায় আছেন‌! কিভাবে দিন কাটান!

প্রথমে প্রোফাইল পিকচার আর কভার পিকচারে লাইক দিলাম।তারপরে ইনবক্সে প্রণাম জানিয়ে নিজের নাম আর মাধ্যমিক কত সালের ছাত্রী লিখে,প্রশ্ন করে রাখলাম আপনি কেমন আছেন ।উত্তর পাওয়ার আশা যদিও অতি ক্ষীণ ছিল।

সপ্তাখানেক কেটে গেছে।কোনও উত্তর নেই।ইচ্ছা করেই লিখলাম,  বড়দি যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন। আর আপনার স্নেহাশীষ থাকুক আমার সাথে।

আবারও সপ্তাহ খানেক কেটে গেল।তবুও একদিন মাথায় কি খেয়াল চাপল লিখলাম, জানেন আমি এখন কুসুমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন বড়দি হয়েছি। বড়দি, আপনার ফোন নম্বরটা পেলে খুব ভালো হতো। প্রয়োজনে অনেক কিছু বিষয়ে আপনার থেকে পরামর্শ নিতাম।
তারপর দিন সকালেই দেখলাম , প্রণতি রায় ফোন নম্বর দেননি বটে তবে লিখে রেখেছেন ,কিছু প্রয়োজন হলে মেসেজ কোরো। স্নেহাশীষ রইল। দেখলাম রাত বারোটায় মেসেজটা করেছেন বড়দি।

ফোন নম্বর দেননি দেখে মনটা একটু দমে গেলেও শেষ পর্যন্ত রিপ্লাই করেছেন  এটাই অনেক মনে হলো। 

এর মাসখানেক পরে স্কুলে ক্লাস ফাইভের ভর্তির ব্যাপারে একটু গোলোযোগের উদ্রেক হলো। পরামর্শ চেয়ে মেসেজ করলাম।পরদিন সকালে দেখলাম , রাত একটা নাগাদ রিপ্লাই করেছেন।গোলোযোগটা মোটামুটি মিটিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম ওনার পরামর্শ মতন।
সেদিন নার্ভটা  সারাদিনই বেশ উত্তেজনায় টানটান ছিল। তাই ঘুম আসতে চাইছিল না সহজে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল।ফেসবুক ঘেঁটে যাচ্ছি।হঠাৎ দেখলাম রাত এগোরোটায়  বড়দিকে করা ধন্যবাদ জানিয়ে যে মেসেজ করেছিলাম তার উত্তর এসেছে।

সামনেই স্কুলের এক শত বৎসর পূর্তির আনন্দানুষ্ঠান ।দিনক্ষণ জানিয়ে বড়দিকে আমন্ত্রণ জানালাম।পোষ্টাল অ্যাড্রেস চাইলাম আমন্ত্রণ লিপি পাঠানোর জন্য।
উত্তর এলো নতুন করে আর ঠিকানা জানাবার কিছু নেই।তুমি এই যে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানালে এই যথেষ্ট। লজ্জা পেলাম, তাইতো বটে, আগের সব বড়দি বা দিদিদের ঠিকানা তো স্কুলেই যত্ন সহকারে অ্যাড্রেস রেজিষ্টারে রাখা থাকে।সেই দেখেই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়।

শত বর্ষ উদযাপন কমিটি গঠিত হল। বিশাল ধুন্ধুমার আয়োজন।হাজারটা ঝামেলার মধ্যে আলাদা করে আর আমন্ত্রণ পত্র প্রেরণ কমিটির কাছে খোঁজ নেওয়াও হলো না, আর সবার সাথে প্রণতি রায় বড়দিকেও আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছে কিনা।

 দিনে তিনেকের প্রোগ্রামের আজ শেষ দিন।সেই সকাল এগারোটায় শুরু হয়েছে। আজ শেষের প্রোগ্রামটাতে ম্যানেজিং কমিটির দাবী অনুযায়ী কলকাতার কোনও এক নামী ব্যাণ্ডের দলকে আনা হয়েছে।রাত নটা বাজছে ।প্রোগ্রাম এখনও তুঙ্গে।বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কার আর নেওয়া যাচ্ছিল না।দোতলায় আমার অফিস রুমে এসে নিজের চেয়ারটায় অবসন্ন শরীরটা এলিয়ে দিলাম।সামনের বিশাল মাঠটার এক্কেবারে শেষ প্রান্তে স্টেজ।এই রুমে শব্দের রেশ বেশ কম।আমার রুমের ভারি পর্দাগুলোর পেছনে কাঁচের স্লাইডিং জানালাগুলো পুরো বন্ধ ।

টিউবের আলোটা চোখে জ্বালা ধরাচ্ছিল।নিভিয়ে দিলাম।তার বদলে ফলস্ সিলিং এর একটা রিসেস্ড বাল্ব জ্বেলে রাখলাম।
স্কুল বিল্ডিংটা জমির উত্তর গা ঘেঁষে পূব পশ্চিম বরাবর অফিস সেকসান ।আর পশ্চিম দিকের বিল্ডিংটা উত্তর দিক থেকে  দক্ষিণ দিকে  বিশাল মাঠের পশ্চিম বাউণ্ডারি বরাবর এগিয়ে গেছে মাঠের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ।

আমার রুমের বাম দিকে ক্লার্ক গ্রুপ ডি ষ্টাফ দের বসার জায়গা একটা পার্টিশান এর তফাতে।আর ডানদিকে টিচার্স রুম।আমার চেয়ারটা থেকে দু দিকের দুটো কাটা দরজা দিয়ে একদিকে ক্লার্ক রুম আর একদিকে টিচার্স রুমটা দেখা যায়।লম্বা ফাঁকা টিচার্স রুমটার সারি সারি চেয়ার আর খাঁ খাঁ টেবিলগুলো শুদ্ধ সমস্ত ঘরটা এই রাতের পরিবেশে কেমন যেন অচেনা লাগল।একটা মাত্র টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে।আমি শক্তি সম্পদের অপচয় একদম পছন্দ করিনা, এটা দারোয়ান দাদা  এ কয়দিনে জেনে গেছে, আর তেমন ভাবেই লোক বিহীন ঘরে সব আলো ফ্যান নিভিয়ে রাখাতে সচেষ্ট থাকে।

আমার রুম,টিচার্সরুম, ক্লার্ক রুম এসবের সামনে বরাবর একটা লম্বা টানা করিডর।আর করিডরটার  উত্তর দিকের বিশাল হলটা হলো লাইব্রেরী রুম। 
হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল সামনের করিডরটাতে  একফালি সরু আলো এসে পড়েছে লাইব্রেরী রুমের  খোলা দরজাটা দিয়ে।
 লাইব্রেরী রুম আজকের দিনে তালা বন্ধ থাকারই কথা।এমনটা কেন হল !অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলাম।খোলা দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাইব্রেরীর খোলা দরজাটা দিয়ে ঢুকলেই বামদিকের দেওয়ালে সুইচ বোর্ড। আলোটা নিভিয়ে দিতে ভেতরে ঢুকলাম।এ আমার বড় প্রিয় জায়গা। সারি সারি বইয়ের রাকে আপন জন, বইয়েরা।মধ্যেটায় ফাঁকা জায়গা।কয়েক সারি রিডিং টেবিল পাতা আছে।

চেয়ারে ও কে বসে ? আর এই আরাম চেয়ারটাই বা এলো কোথা থেকে? 

আমাদের  সেই বড়দি প্রণতি রায় হাতের বইখানা মুড়ে আমার দিকে সরাসরি চাইলেন।মুখে মৃদু হাসি।আমি প্রণাম করতে ভুলে যাই।অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করি বড়দি একা এখানে বসে? কতক্ষণ এসেছেন? চলুন, আমার রুমে চলুন।

তিনি হেসে বলেন , তোমার আমন্ত্রণ ভুলিনি ।কি ,খুশি তো! এই লাইব্রেরী হলটা আমার বড় প্রিয় জায়গা। নিজের মনের মতন করে একে সাজিয়ে ছিলাম ।এই স্কুলে থাকতে ছুটির পর বেশ কিছুটা সময় আমি এই লাইব্রেরীতেই কাটাতাম।যেখানেই থাকি না কেন ,আমি মনে মনে এখানকার  আলো আঁধারি বাতাস এসবের সাথে মিশে থাকি ।এখানকার সব কিছুর সাথে আমার আত্মা মিশে আছে। পরিবার জীবনে আবদ্ধ হইনি কোনও দিন। তাই ছুটির শেষে বাড়ি ফেরার তাড়াও অনুভব করিনি কোনো দিন। এই লাইব্রেরিতে বসে কত কিছু লিখেছি।

মনে পড়ে গেল বড়দির প্রোফাইলে দেখেছিলাম ওনার লেখা কবিতার বই প্রকাশনের ছবি।বলি , বড়দি এখনো লেখালেখি করেন নিশ্চয়ই।ম্লান হেসে বলেন আর হয়ে ওঠে না ওসব।
তবে আমার সময়ে অফিস রুমের একটা স্টীল আলমারির মধ্যে একটা ফাইলে আমার লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ ছিল।সেগুলো আর ছাপান হল না।ভুলেই গেছিলাম অনেকদিন সেসবগুলোর কথা।

আমার মনে পড়ে যায় এই একতলার  একটা রুমে অনেক পরিত্যক্ত জিনিসের সাথে দুটো স্টীল আলমারীও রয়েছে।কিন্তু তাতে কি আর আগের কোনো জিনিসপত্র পাওয়া যাবে! তবুও বলি বড়দি, আমি দেখব , যদি লেখাগুলো থেকে থাকে কোথাও।
হঠাৎ মনে পড়ে এতক্ষণ ধরে কথাই বলে যাচ্ছি শুধু, প্রণামটুকুও করিনি পর্যন্ত।
নীচু হয়ে প্রণাম করতে যাই ।থাক থাক বলে তিনি মুহূর্তে চেয়ারটা ছেড়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরেন।
চারিদিকের ঝিম ধরা বাতাসে যেন আলোড়ন জাগে।
এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্ষে আমার মজ্জা পর্যন্ত যেন কেঁপে ওঠে।চোখ মেলে দেখি আমার রুমের চেয়ারেই বসে আছি।জানুয়ারীর তীব্র শীতেও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

পরে জেনেছিলাম প্রণতি রায় আমার এই স্কুলে বড়দি হয়ে আসার বছর কয়েক আগেই মারা গেছিলেন।স্কুলে তাঁর শোক সভাও হয়ে গেছে।
আমাদের গ্রুপ ডি দিদি, শ্রদ্ধাদি বরাবরই পুরাতন সব কাগজ , ফাইল যত্ন করে রেখে দেন, এটা এই স্কুলে বড়দি হয়ে এসে থেকে দেখছি।
একদিন শ্রদ্ধাদির কাছে সেই ফাইল সম্বন্ধে জানতে চাই, আর পেয়েও যাই সেই ফাইল। প্রণতি রায়ের লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ। 

আজ ঘুমানোর আগে যথারীতি ফেসবুক ঘাঁটছি।নোটিফিকেশনে দেখলাম গতকাল রাত বারোটায় ,পোষ্টটাতে বড়দি লাভ রিঅ্যাক্সন দিয়েছেন।কিন্তু পোষ্টটাতে  ঢুকে দেখলাম ওখানে ওনার সেই রিঅ্যাক্সান নেই।

 গতকাল প্রণতি রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহটির ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।  বড়দিকে ট্যাগ করে প্রবন্ধ সংগ্রহটির ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেছিলাম গতকাল  রাত এগারোটায়। আমাদের প্রিয় বড়দির প্রতি শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

:-সমাপ্ত: -
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি
 

 

আজব কথা - তপাশ্রী (তপা ব্যানার্জী)

 


আজব কথা 
তপাশ্রী (তপা ব্যানার্জী)
 

 



বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা | ক্লাস নাইনে উঠে বেশ কটা টিউশন নিয়েছে রিয়া | অঙ্কের টিউশনটা স্কুলের কাছে সপ্তাহে দুদিন | বান্ধবীদের সাথে স্কুল ফেরার সময় হাঁটাপথে চলে যায় | যাবার সময় বাড়ির লোক না গেলেও ফেরার সময় অবশ্যই বাবা নয় মা নিতে আসে, একা ফিরতে হয় না রিয়াকে | তখন একটু সন্ধ্যে হয়ে যায় - চারিদিক ফাঁকা - লোকালয় কম | গলিপথে পোষ্টের আলোগুলি তেমন স্পষ্ট নয় |

.......আগেরদিন থেকেই স্যার এর শরীরটা খারাপ করেছে | সেদিন ডাক্তারের কাছে যাবে বলে একটু তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে ছুটি দিয়েছিল |এদিকে বর্ষাকাল ; কখন বৃষ্টি আসবে কেউ বলতে পারে না | আজ সবাই আসে নি, বান্ধবী বলতে পিংকি স্যারের বাড়ির পাশেই থাকে একাই চলে গেল | পাপড়ি বলল, "ওর ভাই সাইকেল নিয়ে আসবে ওকে নিয়ে যাবে |" রিয়া একা বসে থেকে কি করবে ! একাই রওনা দিল | ভাবলো মাঝপথে বাড়ির কেউ নিশ্চয় নিতে আসবে; দেখা হয়ে যাবে |

.........স্যারকে এই কথা বলেই রিয়া রওনা দিল | কিছুটা পথ যাবার পর গলিটা শেষ হলেই বড় রাস্তা পড়বে, ততক্ষণে বাড়ির কেউ এসে যাবে | এমনটা ভেবে হাঁটতে শুরু করলো | বড় গাছের ছায়ার সঙ্গে মেঘলা দিনের আলো-আঁধারের খেলায় হঠাৎ বেশ অন্ধকার হয়ে গেল, সন্ধ্যে তেমন হয় নি | গলির পথ যেন শেষ হয় না, এদিকে গাছের ছায়ার ফাঁকে রিয়া আবছা একটা মানুষের ছায়া লক্ষ্য করলো | মনে হলো কেউ ফলো করছে | পেছনে ফিরে বেশ কয়েকবার দেখলেও তেমন কিছুই চোখে পড়লো না, ভাবল ও কিছু না | আবার হাঁটতে শুরু করলো | ছায়াটা যেন এখন বেশ স্পষ্ট হতে লেগেছে | এবার একটু ভয় লাগছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না | একলা জনমানব শূন্য পথ | মাঝে মাঝে বড় বড় গাছগুলি আপাতদৃষ্টিতে রাস্তার ধারে রক্ষী সেজে সতর্ক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও তখন ভয়ে যেন গিলে খেতে চাইছে |

....... রিয়া জানে না সত্যিকারের প্রহরী থাকলে কি করতো ! ভয়ে ওর হাত-পা যেন সিটিয়ে আসছে | এখন ফিরতেও পারবে না অগত্যা এগোতে হবে জেনে নিজেকে বড় অসহায় ঠেকছে | কটা বাজে কে জানে, ঘড়িটা দেখে এলে ভালো হতো ! বাড়ির কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন কে জানে ! তাহলে কি অন্য রাস্তা ধরেছে রিয়া ! এমন অনেক প্রশ্ন রিয়ার মনে ঘোরাফেরা করতে লাগল ।

........ "গাছগুলো দেখে তো ঠিক পথেই আসছি মনে হচ্ছে ! হ্যাঁ; এই পথ দিয়েই মায়ের হাত ধরে ফিরি বলে মনে হচ্ছে ! এ কী ! আবার একটা সরু পথ, কোনদিকে গেলে বাড়ি ফেরার সঠিক পথটা পাবো তাও বুঝতে পারছি না | এখানে কোন লোকালয় নেই যে কাউকে পাবো |" আসলে মাঝখানে একটি মাঠ তারপর চারিদিক থেকে এক একটা সরু গলি দেখে রিয়ার সব গোল পাকিয়ে গেছে | এসব ভেবে একবার পেছন ফিরতেই দেখতে পেল একটা লম্বা টুপি পরা লোক এই পথেই হেঁটে আসছে | দেখে মনে একটু সাহস এলো |

একটু উঁচু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা ! বাগদি পাড়ায় যাবো ! কোনদিকে পরবে বলতে পারেন ?"

লোকটি হাতটা নেড়ে ইশারা করলো ডানদিকে |

.......... আবছা আলোতে যা বোঝা গেল,
সেইদিকে এগোতে লাগল নিশ্চিন্তে রিয়া | খানিক গিয়ে থমকে দাঁড়ালো ! একটা চারিদিক গাছে ঘেরা ফাঁকা মাঠ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না | লোকটি ঠিক বলল ! ..... ভেবে ঘুরতেই দেখে কেউ কোথাও নেই | এবার বুঝতে পারলো ও আবার আগের পথে ফিরে এসেছে | একটা বিপদের আশঙ্কা বুঝলো, বাঁচাবার মতো এখন কাউকে পাবেও না ! ঝির ঝির করে আবার বৃষ্টি শুরু হল, কি করবে ! বেশি বৃষ্টিতে জল জমে সঙ্গে মাঠের কাদা তথৈচব অবস্থা হবে | নিজে একা স্কুল ছাড়া পথে বের হয় না বলে অন্য পথের ভরসা পাচ্ছে না, যেন গোলক ধাঁধায় পড়েছে, অগত্যা কি আর করবে ! কিছু বুঝতে না পেরে কান্না পাচ্ছে | কেঁদে কোন লাভ নেই, কে দেখবে ওর চোখের জল ! ভেবে মন শক্ত করে আবার এগোতে শুরু করলো |

........ভাবলো সোজা মাঠ পেরিয়ে ঠিক কোনো বড় রাস্তা পাবে | তখন কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবে । এই ভেবে খুব জোরে হাঁটতে লাগল | খানিক যেতেই দেখছে আবার সেই ছায়া যেন ওর পিছু নিয়েছে ! অথচ তাকে চোখে দেখতে পাচ্ছে না ! ভীষণ ভয় পেয়ে ভীমরি খাবার জোগাড় ! এমন সময় বেশ কিছুটা আগে একটি লোক যাচ্ছে দেখতে পেল | রাস্তার আলোটা এখানে বেশ স্পষ্ট বলে তাকে দেখে মনে একটু বল আর ধড়ে প্রাণটা ফিরে এল রিয়ার ঐ জনশূন্য স্থানে |

গলা চড়িয়ে রিয়া জিজ্ঞাসা করলো ,"শুনছেন ?"

লোকটি পেছন ফিরে একটু অবাক হয়ে খানিক থেমে জিজ্ঞাসা করলো ,"কোথায় যাবে তুমি ? বাড়ির ঠিকানাই বা কি, একা এই পথে কেন ?"

রিয়ার বাড়ি বাগদি পাড়া বলতেই লোকটি খুব চমকে উঠলো !

সে বলল, "তোমার বাবার নাম কি ?"

রিয়া উওর দিল ।

উওর শুনে লোকটি বলল, "বিশ্বনাথদার মেয়ে তুমি ! আমার পাশের পাড়ায় তাহলে আর চিন্তা কি চলো আমার সাথে |"

....... লোকটির কথা শুনে রিয়ার বেশ সাহস আর ভরসা হলো | একরাশ অন্ধকারে যেন একটু আলোর দিশা | সেই পরিস্থিতিতে মেনে নিতে কষ্ট হলেও বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই ।

......কোন উপায়ান্তর না পেয়ে রিয়া এগিয়ে চলল, পথ শেষ হলে কখন বাড়িতে ফিরবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত হলো | পথ যে আর শেষ হয় না, আবছা আলোয় তার ওপর ছায়া পড়ে অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও পেছনে যে একটা লোক হাঁটছে সেটা ভালোই বোঝা গেল | এইভাবে অনেকক্ষণ হেঁটে মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে এসে পড়লো ওরা | উল্টো দিকে রাস্তার ধারে লাইট পোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখলো রিয়ার বাবা বিশ্বনাথ বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন | তাকে দেখে রিয়া পড়ি কি মরি করে এক ছুট দিয়ে বাবার কাছে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এ যাত্রায় |

"এ কী অমন করে দৌড়ে এলি কেন ? বৃষ্টির জন্য লাইট চলে গেছে বলে আমি ঘড়িটার সময় ঠিক ঠাওর করতে পারি নি |"

বৃষ্টি থামতেই তোর মা তাড়াতাড়ি বেরোতে বলল তোকে নিয়ে যাবার জন্য |

"তুই একা কোন পথে এলি আর কার সঙ্গে এলি বলতো ?"

.......তখনও মেয়ে বেশ জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে দেখে বাবার মনে একটা আশঙ্কা হল | উৎকন্ঠা থেকে বাবার মাথায় হাজার প্রশ্ন ভীড় করতে লাগল !

........বিশ্বনাথ বাবু মেয়ের কথায় জড়তা দেখে ভাবলেন ওকে আগে বাড়ি নিয়ে গিয়ে যা জিজ্ঞাসা করার করবো | পথে আর কোন কথা বললেন না | বাড়ি পৌঁছাতেই মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না, দেখে মনে হবে কেউ খুব বকাবকি করেছে |

...... কিছু বুঝতে না পেরে মা সরাসরি রিয়ার বাবার দিকে তীরটা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ গো মেয়েকে কি খুব বকেছো ? নাকি স্কুলে কিছু হয়েছে ?"

......কিছুই বললেন না বিশ্বনাথবাবু ।
বাধ্য হয়ে মেয়েকে এবার একটু বকুনির সুরে মা বললেন, "কি হয়েছে পরিষ্কার করে বলবি তো !"

......রিয়ার মুখে সব শুনলেন তারা | ঐ ছায়ার মতো মানুষটার কথা শুনে বাবা-মা দুজনেই হেসে উঠলেন | শেষের লোকটি তাদের পরিচিত সেটা দেখেছেন বিশ্বনাথবাবু |

.......পরে টুপি পরা লোকটি পথ দেখিয়েছে শুনে দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন |রিয়া অতটা পথ একা এসেছে শুনে মা তো ভীষণ রেগে গেলেন | অবশ্য সবটা শুনে রাগ প্রশমিত করে মেয়েকে বকতে ছাড়েন নি | বড় কোন বিপদ ঘটলে তারা নিজেদের ক্ষমা করতে পারতেন না |

বারবার বারণ করা সত্বেও কেন একা ফিরতে গেল অপেক্ষা না করে | ভবিষ্যতে যেন এমন না করে সেটা বলে রাখলেন মেয়েকে |

.......অনিতাদি বললেন, "অনেকেই ঐ মাঠের পথ ধরে সকালে গেলেও সন্ধ্যার পর থেকে কেউ যায় না | তুই একা ঐ পথ ধরে এসে ভুল করেছিস বটে ! কিছু যে হয় নি এই বেশি !"

...... রিয়া মায়ের কথায় কিছু একটা ইঙ্গিত লুকানো আছে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো, "কেন মা বলো না ?"

....."না ও সব আমরা বিশ্বাস করি না, তবে এর আগেও অনেকেই এমন সব ঘটনা দেখেছে বলে শুনেছি | তুমি কেন যে ঐ মাঠের ভেতরের বড় বড় গাছের ছায়া ঘেরা পথ দিয়ে ফিরতে গেলে কে জানে !"

রিয়ার কৌতুহল ভীষণ বেড়ে গেল মায়ের কথাগুলি শুনে !

......অনিতাদি বলতে লাগলেন, "ঘটনাটা হল অনেক বছর আগে ওখানে একটা বড় বাগান ছিল | তাতে বড় বড় আম জাম কাঁঠাল ছাড়াও অনেক গাছ ছিল | মাঠের ধারে নিম, তেঁতুল, বট, অশ্বত্থ আরও কি সব গাছ ছিল | তখন কারা যেন সেই ফলের গাছগুলি কেটে দেয় জমিটা বিক্রি করবে বলে | যার জমি সে পরে জানতে পেরে মামলা - মোকদ্দমা করে, জমিটা বিক্রির হাত থেকে বাঁচে | এসব শুনেছি তোমার দাদু-ঠাম্মার কাছে |"

.......সেই থেকেই জমিটা ফাঁকা পড়ে আছে | মাঝে চারপাশের ছেলেরা জমিটায় খেলাধূলা করেছে বলে মাঠ নাম হয়েছে | আমাদের পাড়ার দুজন পর পর ঐ তেঁতুল না নিম গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে ভয়ে ও পথে কেউ যায় না | অনেকেই বলে এখনও তাদের প্রেতাত্মা নাকি ঘোরাফেরা করে | এসব শুনে জমির মালিক তাদের বাড়িতে অনেক পূজাপাঠ - যজ্ঞ করেছে, তবু মানুষের মনে সেই ভয়টা রয়েই গেছে |

.......কথাগুলি বলতেই মাকে ধরে রিয়া বলে উঠলো, "আমি তাহলে যাকে দেখলাম সেটা কে ? সেই ভূত না প্রেআত্মা বলে - তাই ?" বলেই মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো | বাবা-মা তখন মেয়ের চোখেমুখে জলের ছাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরায় আর বুঝিয়ে বলে ওসব কিছু না, ছায়াকে ভয়ে তুই অমন দেখেছিস | সেদিন মেয়েকে সাত্ত্বণা দিলেও পরেরদিন সকালবেলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারা ।

.......ডাক্তার দেখে বললেন, "খুব ভয় পেয়েছে সেই আতঙ্ক থেকে একটা ট্রমা কাজ করছে | কিছুদিন বিশ্রাম আর একটু পথ্য খেলে ঠিক হয়ে যাবে | ততদিন একা বেরোতে দেবেন না |"

" যারা এই গল্পটি পড়ে ভূতে বিশ্বাস করলেন না, তারা যেন এমন জনশূন্য পথে একলা কখনও পেছনে ফিরে দেখবেন না | "

         .................................
 
অলঙ্করণ :-  পায়েল খান
 

 

সেই চাদরখানা - মধুমিতা সেনগুপ্ত


সেই  চাদরখানা 
মধুমিতা সেনগুপ্ত 
 

 




      এই চাকরিটা এবারে ছেড়ে দিতে হবে । এত বাজে কোম্পানি একে তো মাইনে কম দেয় তার ওপর মেয়েদের বিপদ অপদ নিয়ে কিছুই ভাবে না । নিজের মনে গজ গজ করতে করতে রিপা অটোতে ওঠে । ভেজা ছাতাটা ভাঁজ করে ঝেড়ে নেয় বাইরে । তারপর প্লাস্টিকের বড় প্যাকেটে ঢুকিয়ে নেয় ।  সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি নামায় সে ম্যানেজার বাবুকে বার বার  অনুরোধ করেছিল সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ছেড়ে দিতে । হামবাগ লোকটা খুবই গোঁয়ার এবং ভীষণ স্বার্থপর ।  যথারীতি আটটার আগে উনি কিছুতেই ছাড়লেন না । এভাবে আর চালানো যাচ্ছে না । নেহাৎ টাকার বিশেষ প্রয়োজন নাহলে প্রায়ই রাতের ট্রেনে ফিরতে তার ভীষণ ভয় হয় ।  

       লকডাউনের পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে বলে আবার সে কাজে যেতে পারছে । সংসারে একটু সুরাহা হয়েছে । নিজের যাতায়াত টিফিন খরচ রেখে মায়ের হাতে হাজার সাতেক টাকা তুলে দিতে পারে । মায়ের মলিন প্রায় রক্তশূন্য মুখে একটা নিশ্চিন্ত হাসি ফুটে ওঠে । ওই ভরসার হাসিটুকু টিকিয়ে রাখতেই মলম কারখানায় ওষুধ ওষুধ গন্ধের মধ্যেই সে মুখ নিচু করে কাজ করে যায় । একঘর ভাড়াটে আছে । ওই টাকাটা খুবই কাজে লাগে । 
   
      ছোট ভাইকে স্মার্টফোন কিনে দিতে হয়েছে । তার স্কুলের মাইনে দিতে হয় । তার  অনলাইন ক্লাসের জন্য নেট খরচ চালাতে হয় । আট মাস আগে কোরোনায় বাবার অকাল মৃত্যুতে তাদের মোটামুটি গোছানো জীবনটাতে দারিদ্রের ধুলো জমে গেছে । বাড়িতে বসে থাকলে বাবার সঞ্চয় করা টাকা শেষ হয়ে যাবে দ্রুত তাই পাড়ার একজনকে ধরে মলম কারখানার চাকরিটা জোগাড় করে রিপা ডুবন্ত সংসারের হাল ধরেছে । অনলাইনে বি এ ফাইনাল পরীক্ষা টা দিয়েছে রেসাল্ট বার হলে হয়ত এর থেকে ভালো একটা চাকরি পাবে । এই আশাতেই সে বসে আছে । 

    শিয়ালদহে ঢুকে দৌড়ে গিয়ে  আটটা পঞ্চাশের শিয়ালদহ রানাঘাট লোকালটা পেয়ে যায় রিপা ।  ভীষণ বাজে একটা  দিনের পর আচমকা বড়সড়  প্রাইজ পাওয়ার মত জানলার ধারের সিটটা পেয়ে যায় । পাশের কারখানার বনানীও আজকে দেরিতে ফিরছে । নিজের কলিগের জন্য রাখা সিটটা রিপাকে সে ছেড়ে দেয় । প্রচন্ড ভিড় ট্রেনটাতে।  সাধারণত এই সময় ট্রেনগুলো অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকে কিন্তু বৃষ্টির জন্য  বোধহয় ভিড় আজকে ঠাসা । আজ ওর মস্ত ভুল হয়েছে । নিজের কমদামি মোবাইলটা বাড়িতেই ফেলে রেখে এসেছে। বনানীর ফোন নিয়ে বাড়িতে জানিয়ে দেয় ফিরতে রাত হবে ।  

     রুমাল দিয়ে ঘড়িটা বেঁধে রেখেছিল রিপা । সেটা খুলে ঘড়িটা ব্যাগে রেখে ক্লান্ত মুখটা মুছে হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে নেয় । অভ্যাস হয়ে গেছে । এরপর দুজনেই যে যার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নামে অজস্র নিন্দা মন্দ করতে থাকে । সামান্য কটা টাকা দেয় বলে এরা যেন মাথা কিনে নিয়েছে । রাতবিরেতে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এরা একদমই ভাবে না । এই ট্রেনটা প্রায় এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট বাদে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পায়রাডাঙ্গা পৌঁছাবে । বৃষ্টির দাপটে যদি মাঝরাস্তায় কোথাও আটকে যায় তাহলে তো আর কথাই নেই । 

      ট্রেন ছাড়া মাত্র জানালা বন্ধ করে দিতে হলো । বৃষ্টির ছাট আসছে ভেতরে । দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিপা জানালাটা বন্ধ করে দেয় । কি লাভ হল জানালার পাশে বসে !  আধভেজা রুমালটা মুখে চাপা দিয়ে রিপা পিছনে ঘাড় হেলিয়ে বসে থাকে । এত ক্যাচর ম্যাচরের মধ্যেও তার তন্দ্রা চলে আসে । শারীরিক ক্লান্তির জন্য এরকম দমবন্ধ অবস্থাতাতেও ওর বিশ্রামের অসুবিধা হয়না ।

       স্বপ্নে দেখে একটা নির্জন রাস্তায় সে হাঁটছে । সামনে থেকে একটা আপাদমস্তক চাদর জড়ানো লোক এগিয়ে আসে । চাদরটা তো খুবই চেনা । সামনে আসতেই সে চিনতে পারে । লোকটি তার বাবা । বাবাকে দেখে সে ভাবে বাবা কি করে আসলেন এখানে ! বাবার যেন কি হয়েছিল একটা । কি যেন ঘটনাটা ঘটেছিল যার জন্য তার বাবার এভাবে আসা একদমই অসম্ভব ! কিন্তু কিছুতেই সে ঘটনাটা মনে করতে পারে না । যাক গে এসব পরে ভাবা যাবে । বাবাকে জড়িয়ে ধরতে যায় রিপা কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তার বাবা দু পা পিছিয়ে যান । তারপর বলেন ―“ এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে রানাঘাটে ছোটখাটো কোনো কাজ জোগাড় করে নে । আমার বন্ধু অনিমেষের কাছে যা । ও তোকে একটা কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করে দেবে । এই যে রাত দুপুরে  ফিরিস আমি কত চিন্তায় পড়ি বলতো । " 

       বাবা হয়ত আরো কিছুক্ষণ স্নেহ মাখানো বকুনি দিতেন কিন্তু বনানী ওকে ডেকে জাগিয়ে দিলো । 
―“ এই ওঠ ওঠ । বাচ্চাদের মতো স্বপ্ন দেখে হাসছিস । পাগল মেয়ে । শোন চাকদা আসছে আমি নেমে যাচ্ছি । পায়রাডাঙ্গায় ঠিক করে নামিস আবার ঘুমিয়ে পড়িস না যেন । সাবধানে বাড়ি যাস । রিক্সা নিয়ে নিস স্টেশন থেকে । ঠিক আছে ? বৃষ্টিটা মাঝখানে থেমেছিল আবার মুষলধারে নামলো । বাড়ি ফিরে ফোন করিস । টা টা । " 

    ঘাড় নেড়ে সব কথাতেই সম্মতি জানিয়ে হাসে রিপা । জানালা খুলে একটু সরে বসে । ট্রেন প্রায় খালি হয়ে গেছে । বেশ কিছুটা লেট করেছে ট্রেন । বাড়ি পৌঁছাতে রাত এগারোটা বাজবে । বনানী জাগিয়ে না দিলে বাবা হয়ত আরো কিছু বলতেন । একদম চাইলেই ছুঁতে পারা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা । একবার জড়িয়ে ধরে সে বলতেও পারলোনা যে বাবা আর ছেড়ে যেও না । এখন তার মনে পড়লো বাবাকে চিরবিদায় জানানোর সময় ওই নতুন চাদরটা বার করে মা বাবাকে চাপা দিয়েছিলেন । 

     ঝাপসা চোখদুটো মুছে নিয়ে রিপা সামনের দিকে ব্যাগটা নিয়ে দুহাত গলিয়ে নেয় । ওড়নাতে ভালো করে গিঁট মেরে ছাতা বার করে এগিয়ে যায় দরজার দিকে । ট্রেন থেকে নেমে সে দেখে স্টেশনে একমাত্র মহিলা সেই । সবাই দৌড়াচ্ছে দেখে সেও দৌড়ে যায় । কিন্তু সে পৌঁছানোর আগেই গুটি কয়েক রিক্সা যাত্রী নিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যায় । বেশি জল জমায় অটো চলছে না । 

     দুটো রাস্তা আছে । একটা একটু নির্জন রাস্তা কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে গেলে মিনিট দশেক কম সময় লাগবে । অন্যটা মেইন রোড ।  একটু ইতস্ততঃ করে রিপা শর্টকাট রাস্তাটা ধরে যতটা সম্ভব জোরে পা চালায় । এই রাস্তার দুধারে অনেক নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে । যে কয়েকটা বাড়ি আছে সেগুলোতে বাসিন্দারা খিচুড়ি আর ওমলেট খেয়ে চাদর চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । রাস্তার দুধারে ইট বা স্টোন চিপস উঁচু ঢিবির মতো অন্ধকার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে । রাস্তার সব লাইট জ্বলছে না । 

        হটাৎ রাস্তার জমা জলের উপর পিছন থেকে হাঁটার ছপ ছপ শব্দ কানে আসায়  রিপা ভয় পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় । শরীর হিম হয়ে যায় তার । দুটো লোক । একটা ছাতা মাথায় বেশ জোরে তার দিকে এগিয়ে আসছে । একজনের মুখে জ্বলন্ত বিড়ি । রিপা যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই ঘটলো । আগামীকাল এই রাস্তার ধারেই তার নৃশংস ভাবে খুন হওয়া শরীরটা পড়ে থাকবে কাদা জলের মধ্যে । রিপা আর ভাবতে না পেরে পাশের একটা ইটের পাঁজার পাশ দিয়ে দৌড়ে একটা নির্মিয়মান বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। 
      
          প্রথমেই রেলিংহীন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যায় । ব্যাগটা আর ওড়নাটা খুলে একটা অন্ধকার জায়গায় রেখে জানালার জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায় । লোক দুটো মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ওকে খুঁজছে । হটাৎ একজন ওর চটির ছাপ দেখতে পায় বাড়িটার ঠিক সামনে জমা কাদার মধ্যে । একটা অশ্লীল সিটি মেরে লোকটি বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে । পিছনের লোকটি তাকে অনুসরণ করে । 
         পা থেকে চটি খুলে হাতে নিয়ে আবার উপরের দিকে উঠতে থাকে আতঙ্কিত রিপা । একসময় সে ছাতে উঠে আসে । লোক দুটিও ছাতে এসে হাজির হয় । তুমুল বৃষ্টির শব্দ রিপার আতঙ্কিত আর্তনাদের শব্দ চাপা দিয়ে রাখে । একটি লোক দৌড়ে কাছে এসে তাকে এত জোরে চড় মারে যে রিপা মাটিতে ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত  পায় । তারপর সে জ্ঞান হারায় । 

        জ্ঞান ফিরে রিপা দেখে সে একটা ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে । বাইরে বাজ পড়ছে । হাত দুটো সামনের দিকে বাঁধা । দড়িটা মুখের কাছে এনে টানাটানি করতে করতে একটা হাত খুলে ফেলে রিপা । মাথার যন্ত্রণার জায়গায়  হাত দিয়ে  বুঝতে পারে মাথা থেকে রক্ত পড়ছে । কামিজের অনেকটা ছিঁড়ে গেছে । পাশের ঘরে দুটো লোক কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে । আরো কাউকে ডাকছে বোধহয় । অপরাধের সঙ্গী হিসেবে বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে চাইছে বোধহয় । ফোনের ওপাশের লোকটি বা লোকেরা মনেহয় পুলিশের ভয় দেখায় । 

       কান খাঁড়া করে কথাগুলো শুনে ধীরে ধীরে উঠে বসে রিপা । জানালা দিয়ে লাফ দিলে কেমন হয় । কিন্তু তখনই একটা লোক যমদূতের মতো সামনে এসে দাঁড়ায় । তারপর রিপাকে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে শুইয়ে দেয় । প্রচন্ড লড়াই চালায় রিপা । তারপরেই এক আশ্চর্য কান্ড ঘটে । লোকটাকে কেউ যেন সজোরে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় । লোকটি বোঝে এটা রিপার পক্ষে অসম্ভব । 

―“ এই কে বে অন্ধকারে .." বাকি কথা লোকটির মুখেই থেকে যায় । অন্য লোকটি একটি বাঁশের বড় টুকরো আর মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ঘরে ঢোকে । সে দেখে তার সঙ্গী কে শূন্যে উঠিয়ে কেউ  গ্রিল আর পাল্লা বসানোর কাজ বাকি জানালার মধ্যে দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলো । উড়ন্ত লোকটির আর্তনাদ ভেসে আসে । শেষে  নিচ থেকে সজোরে ধপ করে কিছু ভারি জিনিস পড়ার শব্দ শোনা যায় । 

        হাড় হিম হয়ে যাওয়া হাত থেকে খসে পড়ে বাঁশের টুকরো । সম্পূর্ণ অদৃশ্য কোনো শক্তি তার সঙ্গীকে যমের বাড়ি পাঠিয়েছে বুঝতে পেরে অন্য লোকটি অস্ফুটে কি সব বলে হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে । 

     রিপা দেখতে পেয়েছে সব । তার শরীর কাঁপছে কান্নার আবেগে । ফ্রেম হীন জানালার ওপাশের বৃষ্টির আবছা পর্দার ফ্রেমে চাদর জড়ানো পাজামা পরা নিজের বাবাকে চিনতে তার এতটুকু ভুল হয়নি । সে কোনমতে উঠে দাঁড়ায় । দেওয়াল ধরে ধরে নিচে নেমে আসে । দোতলার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে নিজের ব্যাগ খুঁজে পায় । ওড়নাটা বেশ শুকিয়ে গেছে । সেটা ভালো করে গায়ে জড়াতে গিয়ে মনে হয় ওড়নাটা কি একটু ভারি আর বড় হয়ে গেছে । এত কথা ভাবার মতো তার মনের অবস্থা তার নেই । চটি দুটো বোধহয় ছাতেই পড়ে আছে । রিপা কাঁপা শরীরে বাইরে বের হয়ে  সেই লোকটার মৃতদেহ টপকে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় । 

      ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করে রিপা । বাবাকে ডাকে পাগলের মতো কিন্তু কোনো উত্তর পায় না । বৃষ্টি অনেক ধরেছে । বহু কষ্টে সে বাড়ি ফেরে । 

       বাড়ির সামনে জল জমেছে । রিপার মা বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন । ছেলে অনেক বার এগিয়ে গিয়ে দিদিকে আনতে চাইলেও তিনি যেতে দেন নি । আর দেরি হলে তিনি নিজেই ছেলেকে নিয়ে বের হবেন । ঠিক এই দিনেই মেয়েটা মোবাইল ফেলে গেছে । যদিও বনানী জানিয়েছে চাকদা অবধি দুজনে একসাথেই ছিল । তাহলে কেন এত দেরি হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না । রাস্তার আলোয়  দূর থেকে মেয়েকে আসতে দেখে দরজা খুলে দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন । 

      একটু ধাতস্থ হয়ে শান্ত ভাবে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢোকেন । ছেলেকে গরম চা করতে বলে গামছা এগিয়ে দিয়ে তিনি নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন । 

―“ এটা তুই কোথায় পেলি ! এটাতো তোর .." বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মা এর কথা শুনে নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে রিপা । অন্ধকারে আসতে আসতে সে বুঝতে পারেনি । পাড়ার কাছে এসে রাস্তার লাইট দেখেছিল সে । কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়নায় লক্ষ্য করেনি তার গায়ে ওড়না ভেবে সে জড়িয়ে নিয়েছিল তার বাবার শেষ যাত্রার চাদরখানা । 

    কান্নায় ভেঙে পড়ে রিপা । সব ঘটনা গুছিয়ে বলতে তার আরো সময় লাগবে যে ...।।

...................................
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি  
 

 

শয্যা - রিয়া ভট্টাচার্য

 

শয্যা
রিয়া ভট্টাচার্য 
 

 


ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যেতেই এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগলো তমালের। 

গন্ধটা বড়ো উগ্র, যেন নাকের ভেতরের রোমকূপ জ্বালিয়ে দেয়। নাক কুঁচকে তমাল বোঝার চেষ্টা করে আদপে সে কোথায় আছে। জায়গাটা বড় প্রশস্ত, তবে অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ও অতিরিক্ত ঠান্ডা যেন ঝিম ধরে আছে ঘরটার ভেতরে৷ ঘরটায় কোনো জানালা নেই, তবে নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে না তমালের। ঘরে সে একাও নয়৷ এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে বেশ কিছু মানুষ। একে অপরের সঙ্গে কথা জুড়েছে তারা। ফিসফিস শব্দে আলাপ করছে তারা, মাঝেমধ্যে ঠান্ডা চোখে তাকাচ্ছে তমালের দিকে৷ 

তড়িঘড়ি উঠে বসতে গিয়ে ব্যথাটা প্রথম টের পেলো তমাল। বুকের বাঁদিকটা যেন অবশ হয়ে আছে। যেন কোনো ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাকে৷ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে একমুহূর্তের জন্য মাথা ঘুরে গেলো তার। 

টলে পড়তে গিয়েও টেবিলটা ধরে সামলে নিলো সে৷ এতক্ষণ সে এমন একটা শক্ত খটখটে টেবিলে শুয়ে ছিলো ভাবতেই মাথা গরম হয়ে গেলো তমালের। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির টপ এক্সিকিউটিভ তমাল বরাবরই বিছানা নিয়ে খুঁতখুঁতে। নরম বিছানা না হলে ঘুম হয়না তার। তবে এতক্ষণ সে কিকরে ঘুমিয়েছিল এই শক্ত টেবিলে! তবে কি অপহরণ করা হয়েছে তাকে! এই লোকগুলিই বা কারা! 

কোনোক্রমে টলতে টলতে পাশের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় তমাল, চোখ বন্ধ করে বাবু হয়ে বসে থাকা গম্ভীর লোকটিকে রুক্ষভাবেই প্রশ্ন করে, 

" এটা কোন জায়গা? আমি এখানে এলাম কিকরে!" 

" শ শ শ শ! "  ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে ইশারা করে লোকটা। ফিসফিস করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, 

" এখানে চিৎকার করা মানা। বস রেগে যাবেন। " 

" কে আপনাদের বস! আমায় কেন উঠিয়ে এনেছে সে! দেখুন, যদি আপনারা ভাবেন আমায় আটকে রাখলে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট আটকে দেওয়া যাবে তবে ভুল করছেন। আমার টিম খুবই প্রশিক্ষিত। আমি না থাকলেও কালকের কনফারেন্স ঠিকই উৎরে দেবে তারা। পুলিশ ততক্ষণে ঠিকই খুঁজে নেবে আমাকে। একটাকাও মুক্তিপণ পাবেন না আপনারা৷ " 

এতগুলো কথা বলে হাঁ করে শ্বাস নেয় তমাল। আজকাল অল্পতেই বড্ড হাঁপিয়ে যাচ্ছে সে। শরীরটা ভারী দুর্বল। 

" আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! তখন থেকে চ্যাঁচামেচি করছেন। বলেছি তো, আপনার টাকাপয়সা বা কোম্পানির বিনিয়োগ সম্পর্কে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। " 

" তবে আমায় এখানে আটকে রেখেছেন কেন? কেন তুলে এনেছেন আমাকে!" 

" আপনাকে কেউ তুলে আনেনি। এখানে কেউ কাউকেই তুলে আনেনা, সবাই নিজের ইচ্ছায় আসে। " 

তমালকে স্তম্ভিত করে নীচু গলায় বললো লোকটা। তার কথায় এতোটাই দৃঢ়তা ছিলো যে মাথা নীচু করে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে বাধ্য হলো তমাল। তার খুব মনে আছে, গতকাল অফিস থেকে বেরিয়ে মেট্রো ধরে বাড়ি ফিরছিলো সে। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায় ট্রেনটা৷ নিভে যায় কামরার সমস্ত আলো। লোকজনের দলবদ্ধ চিৎকারের মাঝেই বুকে প্রবল ব্যথা অনুভব করে তমাল। চোখের পাতা ঝাপসা হতে শুরু করলে কোনোক্রমে সে বসে পড়ে সামনের সিটে, তারপর আর তার কিচ্ছু মনে নেই। 

" আচ্ছা এটা কি হাসপাতাল? কিন্তু হাসপাতাল তো এমন হয়না!" 

" হাসপাতাল! তা বলতে পারেন। এখানে জীবনের সব অনুভূতিগুলো কেটে বাদ দেওয়া হয়, মানুষ হালকা হয়ে যায়। " 

মুচকি হেসে বললো লোকটা। 

" মানে! কি বলতে চাইছেন!" উত্তেজিত হয়ে জানতে চায় তমাল। 

ততক্ষণে আরো কিছু মানুষ সরে এসেছে তার দিকে। উগ্র গন্ধটায় দমবন্ধ হয়ে আসছে তমালের। গন্ধটা আসছে লোকগুলোর শরীর থেকেই, কি মাখে এরা! 

খসখসে ঠান্ডা চামড়ার স্পর্শ পেতেই চমকে ওঠে সে। একটা হাত আঁকড়ে ধরেছে তাকে, যেন প্রবোধ দিতে চাইছে তাকে, নিষ্প্রাণ স্বরে বলছে, 

" ভয় পেও না তমাল! আমাদের যে এখন ভয় পেতে নেই!" 

ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় তমাল। মরামাছের মতো চোখধারী লোকগুলির উদ্দেশ্যে শাসানোর সুরে বলে, 

" আমায় যেতে দিন। যা চান পাবেন, কিন্তু আমায় এখানে আটকে রাখলে কিচ্ছুটি পাবেন না৷ " 

" এখানে কারো কিচ্ছু চাওয়ার নেই তমাল। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডী শেষ হয়েছে অনেক আগেই। "

ধীরগলায় বলে বসে থাকা মানুষটি। 

" তবে আমায় এখানে আটকে রেখেছেন কেন! আমি বাড়ি যাবো!" 

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে একধাক্কায় সরিয়ে লোহার ভারী দরজাটার দিকে এগোয় তমাল, মাথাটা যেন ঝিমঝিম করে ওঠে তার। এই একটি দরজা ছাড়া ঘরটিতে আর কোনো দরজা নেই। ঠান্ডা ভাবটা অসহ্য হয়ে উঠছে ক্রমেই। তমাল কাঁপছে। 

অনেক কসরতের পরেও ভারী দরজাটা একচুলও নিজের জায়গা থেকে সরলো না। তমালের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামছে। অর্গলহীন দরজা এতো ভারী হয়! 

" ওই দরজা তুমি হাজার চেষ্টা করলেও খুলতে পারবেনা তমাল। তবে চিন্তা নেই, বেশ কিছুক্ষণ পরেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে তুমি। তোমার পরিবার নিতে আসছে তোমাকে। " 

শান্তস্বরে বলে লোকটি। 

" এ এটা কোন জায়গা!" 

তমালের কথা যেন জড়িয়ে যায়। বাতাসে ভর দিয়ে ফিসফিস করে উত্তর আসে, 

" এটা মর্গ! তুমি লাশঘরে শুয়ে ছিলে। " 

" এসব কি বলছেন! কিচ্ছু হয়নি আমার। আমি বাড়ি যাবো। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশে আর একমুহূর্ত থাকবোনা আমি৷ এই শক্ত টেবিলে কেউ শুতে পারে! আমার ঘুম পাচ্ছে। " 

জেদি শিশুদের মতো ঠোঁট ফোলায় তমাল। 

" এ টেবিল তোমার সাময়িক শয্যা তমাল। একটু পরেই এখান থেকে বেরিয়ে যাবে তুমি তোমার শেষ শয্যার উদ্দেশ্যে। এই টেবিলের থেকেও তা বেজায় শক্ত, উষ্ণও বটে! এত উষ্ণতা সহ্য করতে অসুবিধা হবে তোমার৷ যতোটা পারো শীতলতা মেখে নাও এখন। " 

শান্ত কথাগুলো যেন গরম সীসার মতো আছড়ে পড়ে তমালের কানে। হতভম্ব হয়ে লোকগুলোর দিকে এগিয়ে যায় তমাল। অন্ধকারে এখন চোখ সয়ে এসেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে লোকগুলির কপালের সেলাইয়ের দাগ। তাদের পায়ের আঙুলে বাঁধা সাদা কাগজের টুকরোটা দেখা যাচ্ছে। এইতো, এমন টুকরো তো তমালের পায়েও রয়েছে! 

অজান্তেই নিজের কপালে হাত চলে যায় তার। সেলাইয়ের ক্ষত বড়ো টাটকা, কপাল বেয়ে চুঁইয়ে নামা কালো রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে আগেই। বাইরে কিছু মানুষের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ তারা এগিয়ে আসছে এদিকেই। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো পায়ে পায়ে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের টেবিলে, আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ছে তারা, তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমে। হঠাৎ শরীরটা পালকের মতো হালকা লাগছে তমালের। যেন এক ফুঁয়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে সে, আছড়ে পড়বে বৈতরণীর পাড়ে। 

নিজের টেবিলে বসতে বসতে পাশের লোকটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তমাল, 

" বস কে?" 

" যার কাছে জীবন ও মৃত্যু বড়ো তুচ্ছ। শরীর ও অশরীর যার কাছে কোনো বাধা নয়৷ মানুষ তাকে ঈশ্বর ডাকে, প্রার্থনা জানায়। আমাদের কিচ্ছু প্রার্থনা করার নেই, কেবল নির্দেশ পালন করা আছে। " 

শুয়ে পড়তে পড়তে বললো লোকটা। ভারী দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেছে। সেখান থেকে ছলকে পড়ছে আলো। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তমালের। আলো আর সহ্য হচ্ছে না তার। একঝাঁক পরিচিত মুখ ভীড় করে আছে দরজার বাইরে। তাকে নিতে এসেছে তারা। কিন্তু তমালের এখন এই ঠান্ডা টেবিলে শুয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে, কারো সঙ্গে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা তার। উগ্র গন্ধটা একটু একটু করে ঝাপসা হচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসার আগে এক ঝটকায় মনে পড়ে তমালের, গন্ধটা ফর্মালিনের! লাশের গায়ে লেগে থাকা একমাত্র পারফিউম।। 

(সমাপ্ত)
 
অলঙ্করণ :-   রিচা দাস 

 

রক্ত তামসী - অয়ন দাস


রক্ত তামসী
অয়ন দাস
 

 


..১..

 ভারী সুন্দর হয়েছে সরোবর খানা। পশ্চিমদিকের ঘন অরণ্য আর পূবের রাজপ্রাসাদ। এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে টলটলে জলে কানায় কানায় ভর্তি এই সরোবর। 

একটা সময় মজে গিয়ে সামান্য এক পুস্করিণীর ন্যায় মুখ লুকোতো প্রাসাদ প্রাঙ্গনের ওপারে। রাজ অট্টালিকার জাঁকজমকের সাথে সেটা বড়োই বেমানান লাগতো।

শেষে মহারাজ অমর সিং একদিন উঠে পড়ে লাগলেন এটির সৌন্দর্যায়ন করতে। ভার পড়লো প্রবীণ মন্ত্রী প্রয়াগনাথের ওপর। প্রথমটায় একটু ইতস্তত করলেও মন্ত্রী মহোদয় যখন বুঝতে পারলেন মহারাজ একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন তাঁর ওপর, মাথা পেতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। হাজার হোক,অমর সিং কে ছোট থেকে দেখে আসছেন তিনি। একপ্রকার অভিভাবকই বলা চলে তাঁকে। তাই সমস্যায় পড়লে বা সর্বশেষ পরামর্শ হিসেবে প্রয়াগনাথ এখনো কাঞ্চনগড়ের প্রধান ভরসা।

প্রয়াগনাথ অবশ্য নিরাশ করেননি। কাজটা যে সফল ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন তিনি, বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ নিজেও খুব ভালো করে জানেন। তিনি রাজমন্ত্রী। যেকোনো দায়িত্ব তাঁর ওপর নিশ্চিন্তে দিয়ে দেওয়া যায় তা বিলক্ষণ জানেন মহারাজ। এর আগেও এমন বহুকাজ তিনি পোক্ত হস্তে সামলেছেন। এটা তো তুচ্ছ একটা ব্যাপার। আসলে বয়স বেড়েছে বলেই হয়তো আজকাল অল্পতেই অহেতুক চিন্তা করেন। 

সরোবরের চেহারা পাল্টে এখন রীতিমতো এক বিস্ময়কর চিত্রপটের অবতারণা করে যেন। যেটা ছিল নিতান্তই একটা মরে যাওয়া ডোবা, এখন তার অপার নীল জলরাশিতে প্রতিফলিত হয় অস্তগামী সূর্যের লালিমা।

রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে ঝুলন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়ালে এক অসাধারণ দৃশ্য ফুটে ওঠে। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো জলরাশি, কত গভীর আর বিরাট তার পরিধি। তার মধ্যে মাছের খেলা, মাছরাঙার ছোঁ মেরে শিকার ধরা দেখে যারপরনাই খুশি হন মহারাজ আর তাঁর আদরের রাজকন্যা রঞ্জাবতী। ওঁদের চিত্ত হয় বিগলিত।

একসময় সেই খুশির খবর পৌঁছয় বৃদ্ধ প্রয়াগনাথের কাছেও। তিনিও পুলকিত হয়ে ওঠেন। এই আনন্দ আর সন্তোষের চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার যে হয় না।

সরোবরের ধারে বসে বসে এসব ভাবছিলেন, হঠাৎই শুনতে পেলেন ঘোড়ার খুরের শব্দ। দুজন রাজসৈনিক এগিয়ে আসছেন তাঁরই দিকে। অবাক চোখে তাকালেন প্রয়াগনাথ।

ঘোড়ার পিঠ ঠেকে নেমে এল এক সৈনিক। বলল, "মহারাজ আপনাকে তলব করেছেন মহোদয়।"

বৃদ্ধ মন্ত্রী ভাবলেন নিশ্চয় মহারাজ তাঁর ওপর খুশি হয়েছেন। তাই বোধহয় হাঁক পড়েছে। মৃদু হেসে বললেন,  "আমি ঠিক জানতুম যে মহারাজ আমায় অবশ্যই স্মরণ করবেন। তা কি এক্ষুনি যেতে হবে ?"

-" আজ্ঞে হ্যাঁ মন্ত্রীমশাই, তেমনই আদেশ পেয়েছি", উত্তর দিলো সৈনিক।
-" বেশ তবে চলো", বলে উঠে পড়লেন প্রয়াগনাথ।

প্রয়াগনাথকে নিয়ে যখন দুজন সেপাই দ্রুত অশ্বচালনা করে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রাসাদ অভিমুখে ধাবিত হল, কাঞ্চনগড়ের আকাশে সূর্য অনেকখানি হেলে পড়েছে পশ্চিমাভিমুখে। সরোবরের জলে শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ রক্ততিলক এঁকে আসন্ন প্রদোষের আবাহন করছে।

..২..

রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেই প্রয়াগনাথ বুঝলেন পরিস্থিতি বেশ থমথমে। মহারাজ অমর সিং একাগ্রচিত্তে বসে কিছু ভাবছেন। দুচোখে তাঁর সাংঘাতিক ভ্রুকুটি। ব্যাপার তো ভালো ঠেকছে না। প্রয়াগনাথ জিজ্ঞেস করলেন,
-" কোন দুঃসংবাদ আছে নাকি মহারাজ ? আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে! "

-" চিন্তার তো কারণ রয়েছে মন্ত্রিমশাই। আজ এই নিয়ে পাঁচ পাঁচটি বাচ্চা হারিয়ে গেল। আর আশ্চর্য ভাবে সবাই ঠিক ওই জঙ্গলের দিক থেকেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকছে না আমার", বেজার মুখ করে কথাগুলো বললেন মহারাজ।

প্রয়াগনাথ শুনে একটু আশ্চর্যান্বিত হলেন। বললেন, 
-" সেকি মহারাজ জল তাহলে এতদূর গড়িয়েছে! কিন্তু তাহলে তো একটা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এখুনি কিছু করা দরকার।"
-" সেই উদ্দেশ্যেই আপনাকে ডাকা। ইতিপূর্বে বহু সংকটকালীন পরিস্থিতিতে আপনার সদবুদ্ধি কাজে লেগেছে। এবারেও কিছু একটা ভাবতেই হবে। এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রজাগণ অযথা আতঙ্কিত না হয়ে পড়ে", মন্ত্রীমশাইকে পাশে পেয়ে একটু আশাবাদী হয়ে কথাগুলো বললেন মহারাজ।

প্রয়াগনাথ দৃঢ় কন্ঠে জানালেন,
-" আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো মহারাজ।" 

বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ এবার গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন। সমস্যা সত্যি গুরুতর। একটা উপায় না করলেই নয়। এমতাবস্থায়  প্রত্যেকে যখন এই আপদকালীন পরিস্থিতিতে কী উপায়ে সমাধান বেরোবে সেই নিয়ে আলোচনায় মশগুল, ঠিক তখনই এক তরুণ রাজপুত্র যিনি এতক্ষন রাজসভার এক স্থানে বসে এই গুরুগম্ভীর কথাবার্তা শুনছিলো। এবার বলে উঠলো,
-" মহারাজ আমায় যদি আজ্ঞা দেন আমি নিজে একবার ওই জঙ্গল তল্লাশি করে দেখতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই জঙ্গলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সব রহস্যের সমাধান। "

প্রয়াগনাথ এই তরুণের দিকে একবার তাকালেন। 

শাল্বকুমার। 

পড়শি রাজ্য নিবাত পুরের মহারাজ মাধব সিংহের পুত্র এই শাল্বকুমার। কয়েকদিন আগেই রঞ্জাবতীর সাথে এই তরুণ রাজকুমারের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। তার পর বহুদিন এই গৃহেই বসবাস করে আসছে শাল্বকুমার। তার উৎসাহ দেখে রাজামশাই বললেন,
- কিন্তু তুমি যা বলছো তা যে কতটা কঠিন কাজ তা জানো? শ্বাপদ সঙ্কুল ওই অরণ্যে ওভাবে খানাতল্লাশী করা কিন্তু...।"

মহারাজের কথা শেষ হয়না। শাল্বকুমার বলে ওঠে, 
-" আমায় একবার সুযোগ দিন না মহারাজ।"

 অমর সিং খানিক ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন,
-" না না তুমি একা গিয়ে বিপদে পড়তে পারো। সে কাজ নেই।"

শাল্বকুমার কিন্তু নাছোড়বান্দা। সে বললো,
-" কিন্তু মহারাজ রহস্য তো ওই জঙ্গলেই। এভাবে বসে আলোচনা করার চেয়ে একবার গিয়ে দেখলে হত না। পরে যদি দেরি হয়ে যায়।"

 প্রয়াগনাথ দেখলেন ছেলেটার কোথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তিনি বললেন,
-" মহারাজ রাজকুমার শাল্ব ঠিক বলেছেন। ওখানে আমাদের সেপাই পাঠাতেই হবে। এবং তা রাত্রে। যাতে কেউ জানতে না পারে। প্রজাদের অজান্তে একাজ সারতে হবে আমাদের। আর তাছাড়া উনি তো একা যাবেন না। আমাদের সৈন্যরা ওঁর সাথেই থাকবে।"

শাল্বকুমার কৃতজ্ঞ চিত্তে বৃদ্ধ মন্ত্রীর দিকে একবার তাকালো। যেন এতদিন কিছু একটা করতে মুখিয়ে ছিল সে। যাতে করে প্রমান দিতে পারে সে এই রাজপরিবারের সুযোগ্য জামাতা। আজ সেই সুযোগ দুয়ারে অপেক্ষমান। তা হাতছাড়া করতে কোনোমতে রাজী নয় রাজকুমার। 

মহারাজ প্রথমে একটু দোটানায় ছিলেন। কিন্তু শাল্বকুমারের দুর্দমনীয় সাহস আর উৎসাহ দেখে মত বদলাতে বাধ্য হলেন। কুমার বলবান, দূরদর্শী- সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। দেখাই যাক না একটা সুযোগ দিয়ে।

আসলে রাজমশাইয়ের মন সায় দিচ্ছিলো না কিছুতেই। হাজার হোক তাঁর একমাত্র কন্যার হবু স্বামী সে। কিন্তু শেষমেশ শাল্বকুমারের কথাই রইলো। মন্ত্রিমশাইয়ের অভয়ে মবারাজ অমর সিং সায় দিয়েই দিলেন।

ঠিক হলো পরদিন সন্ধ্যাকালেই রাজকুমার শাল্ব তার সেনাবাহিনী নিয়ে এই নৈশ অভিযানে ব্রতী হবে। এই অদৃশ্য শত্রু দমন কার্যে সেই অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেবে। সঙ্গে অবশ্য অভিজ্ঞ সেনাপতিরাও থাকবেন। যে করেই হোক এই বিপদ থেকে রক্ষা করতেই হবে। এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে তবেই সভা ছাড়লো রাজকুমার শাল্ব।

..৩..

রাজপ্রাসাদ থেকে নিজ গৃহে ফেরার পরই প্রয়াগনাথ বুঝলেন পুত্র বলকিনাথ এখনো বাইরে। এই পুত্রটিকে নিয়ে প্রয়াগনাথের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সে যেন কিছুতেই কোনো নিয়ম কানুন মানতে চায় না। মাঝে মাঝেই এমন দিনকয়েকের জন্য উধাও হয়ে যায়। কোথায় যে থাকে, কী করে তা তিনি পিতা হয়েও বুঝতে পারেন না।

ও জন্মলগ্ন থেকেই মাতৃহারা। তাই ছোট থেকেই যেন বড্ড জেদি, একগুঁয়ে। একবার যেটা ভেবে নেয়, সেটা সে করেই ছাড়ে। একবার তো রাজদ্রোহের কবলে পড়তে পড়তেও বেঁচে গিয়েছিল, সেও তার পিতারই অনুকল্যাণে। কিন্তু তার পরেও বলকিনাথের কোনো পরিবর্তন হয় নি। তাই বৃদ্ধ পিতা একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছেন। পুত্রের খবর রাখা তাঁর পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু পিতার এই চিন্তার একফোঁটাও কি পুত্র বলকিনাথের মধ্যে প্রতিফলিত হয় ? বোধহয় না। নইলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতাকে ছেড়ে শিমুল পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের এই গোপন আস্তানায় এমন ঘোরতর সাধনায় মগ্ন হতে পারতো না।

বেদে বুড়ির কাছে তন্ত্রবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। কাঞ্চনগড়ের রাজকন্যার কাছে সেই যেদিন অপমানিত হয়েছিল, তার পর থেকেই তাকে হস্তগত করতে উঠে পড়ে লেগেছে সে। সোজা উপায়ে হবে না জেনেই এই বাঁকা উপায়টি বেছে নিয়েছে।

আর নেবে নাই বা কেন ? কী দোষ ছিল তার ? বংশ কৌলিন্যে খাটো নাকি এক মামুলী মন্ত্রীর ছেলে বলে অবজ্ঞা, কোনটা ?

বলকিনাথের মনে হয় ওসব কিছুই না, রাজকুমারীর গুমোরই হল প্রধান কারণ তাকে তাচ্ছিল্য করবার।

অমন অপ্সরাতুল্য রূপ দেখে একদিন আচম্বিতে প্রেম নিবেদন করে বসেছিল সে। রাজকুমারী রঞ্জাবতী তখন সখীদের সাথে শিবমন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলো। কোনো এক ফাঁকে কমল দীঘির পারে দাঁড়িয়েছিলো কয়েক মুহূর্ত। তখনই বলকিনাথ সামনে এসে দাঁড়ায়।

বলকিনাথের হঠকারী কথায় হয়তো একটু অসংলগ্নতা লক্ষ্য করেছিলো রাজকুমারী। প্রত্যুত্তরে মন্ত্রীপুত্রকে বলেছিল,
-" আপনার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আপনি এক সামান্য মন্ত্রী পুত্র। আর আমি এই রাজ্যের রাজকন্যা।"

বলকিনাথ খানিকটা হতবাক হয়ে পড়ে প্রথমে। তার তো অন্য কোনো মতলব ছিলো না। সে প্রকৃত অর্থেই প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিলো। প্রেমের মানদন্ড যে কোনো কালেই জাতিভেদ বা বর্ণভেদে হয়না। 

বিস্মিত হয়ে বলকিনাথ বলে,
-" এ কী বলছেন রাজকুমারী ! প্রণয়ে কি গোত্র বিচার করা চলে ? তাছাড়া আমার তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। আপনাকে আ..আমি যে...!"

রাজকুমারী গর্জে উঠেছিলো, " চুপ করো দুর্বিনীত। একজন বাগদত্তা রাজকন্যার সাথে এমন কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তার জন্য তোমায় আমি কী করতে পারি জানো ?"

-" না না রঞ্জাবতী। আপনি ভুল বুঝছেন। ওই রাজকুমার অপেক্ষা বেশি সুখী রাখবো আপনাকে আমি। এ আমার অঙ্গীকার রইলো।"
-" এতো সাহস ? ওই মুখে আমার নাম নিলে তোমার সর্বনাশ হবে। নীচ, আমি কিনা কাঞ্চনগরের মহারাজ অমর সিংয়ের কন্যা। আর তুমি এসেছ এই দুঃসাহস দেখাতে ! আজই তোমায় রাজদ্রোহের কারণে অভিযুক্ত করবো আমি। সৈন্য গণ বন্দী করো এই শয়তানকে।"
-" না না শোনো এ কাজ...এই এই কী করছো ছাড়ো", সেপাইদের চিৎকারে বলকিনাথের মিনতি চাপা পড়ে যায়। 

এক সামান্য মন্ত্রীর পুত্র কিনা সে রাজ্যের রাজকন্যার দিকে হাত বাড়ায়, তাও যেখানে রাজকন্যা বাগদত্তা। সৈন্যরা কোনোমতেই রেওয়াত করে না বলকিনাথকে।

টেনে হিঁচড়ে সকলের সামনে দিয়ে যখন মন্ত্রীপুত্রকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, বলকিনাথ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
-" ভুল করলে রাজকুমারী। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ আমি নেবই। কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকে ছাড়বো না।"

..৪..

সেদিন কেউই নূন্যতম দয়া দেখায়নি বলকিনাথের প্রতি। বদলে তার কপালে দুর্বিষহ ঘৃণা আর অপমান জুটেছিলো অনবরত। 

রাগে দুঃখে হতাশায় পাগল হয়ে গিয়েছিল বলকিনাথ। কিছুতেই মানতে পারেনি সে এমন কান্ড হতে পারে তার সাথে। 

যদিও তেমন ক্ষতি তার হয়নি। কারণ তার পিতা প্রয়াগনাথ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সাময়িক সমস্যার সমাধান করেছিলেন। কিন্তু রাজাদেশে তাকে শহরের বাইরে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সে একপ্রকার নির্বাসনই বটে।

তারপরেও লোকচক্ষুর আড়ালে পিতা প্রয়াগনাথ তাকে নিজগৃহে সকলের অজান্তে মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে আসেন, কিছুদিন রেখে দিয়ে অন্তঃত পিতৃধর্ম পালনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। শুধু বলকিনাথ যেন স্থির থাকতে পারে না। সর্বদাই প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকে। তাই নিভৃতে সাধনা করে চলেছে আজ বেশ কয়েক বছর। উদ্দেশ্য তন্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে এই রাজ্য, রাজা, রাজকন্যার দ্বারা হওয়া যাবতীয় হেনস্থার বদলা নেওয়া।


বেদে বুড়ি এসে ধমক দেয় বলকিনাথকে,
-" ওইভাবে মন চঞ্চল করে হবে গা ? তোর নাকি সাধন হবে এইভাবে ?         ছো: !!!" 

বলকিনাথ অসহ্য ভাবে উঠে পড়ে। সত্যি তার মন অসম্ভব আনচান করছে। বার বার মনে হচ্ছে কবে তার শরীরের জ্বালা জুড়োবে, কবে তার প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। এই সাধনা সফল হলে সে হবে যাবতীয় শক্তির অধীশ্বর। ভুত, প্রেত, ডাকিনী, শাখিনী সব হবে তার করায়ত্ত। কালাজাদুর একচ্ছত্র সম্রাট হবে সে। বনবে মহাযোগী বলকিনাথ। 

তারপর হাকিনী আহ্বানে ডেকে নিয়ে আসবে সেই রাজকন্যাকে। বশীভূত করে রাখবে। প্রথমে রাজা, তারপর গোটা রাজ্য সব একে একে প্রোথিত হবে তার চরণতলে। তখন রাজকন্যা কোন ছাড় ! কুৎসিত লোভে চিকচিক করে ওঠে তার দুচোখ।

 সঙ্গে সঙ্গে চমক ভাঙে বেদে বুড়ির কথায়,
-" বলি কালকের তিথি মনে আছে তো। কালই সেই বিশেষ তিথি। কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী। তোর সাধনা সম্পূর্ণ হবে কাল।"

বলকিনাথ উদাস ভাবে উত্তর দেয় ,
-" জানি মা"
-" জানিস যখন এমন বিচ্ছিরি মুখ করে আছিস কেন রে হতভাগা?" বুড়ি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে।

-" না না মা। ও কিছু না।"
-" শোন বাপু, মনের জোরটাই আসল। এমন চঞ্চল হলে চলবে না কো। বলি সব জোগাড় হয়েছে ?"
-" হ্যাঁ মা, আমার সব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়ে গেছে", অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে বলে উঠল বলকিনাথ। 

এই বেদে বুড়িকে সে মা বলেই ডাকে। তার কাছেই পেয়েছে তন্ত্রের গূঢ় মন্ত্রখানি। আজ সাধনায় শেষ লগ্নে সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করেছে। শুধু বাকি একটাই জিনিস। একটা লাশ। পূর্ণ বয়স্ক একটা মৃতদেহের ওপর করতে হবে শব সাধনা। তবেই পরিপূর্ণ হবে এতদিনের এত অক্লান্ত চেষ্টা।

..৫..

রাতের প্রহর কেটে যাচ্ছে দ্রুত। আরো গভীরতর অমানিশায় এই জঙ্গল ঢেকে যাচ্ছে। বেদে বুড়ির কথা অনুযায়ী আজই সাধনার শেষ চরণটি পূর্ণ করতে হবে। সাধনা একবার সফল হলেই এই পৃথিবীর সর্বোত্তম ক্ষমতাটি অর্জিত হবে। তারপর তার বদলা সম্পূর্ণ হবে। এরপরেই প্রয়োগ করবে একটি  মোক্ষম বাণ। মারণ ক্রিয়ায় রাজামশাই ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিনাশ করবে প্রথমে। তারপর যে রাজকন্যা তাকে একদিন তিরস্কার করেছিল, যার জন্য তাকে শহর ছেড়ে এতদূর পালিয়ে আসতে হয়েছে তাকে বশীভূত করে নিজের অভীষ্ট সিদ্ধি করবে সে।

বলকিনাথই হবে এই কাঞ্চনগড়ের পরবর্তী সম্রাট। আর রাজকুমারী রঞ্জাবতী হবে তার পাটরানী। আর যদি নিতান্তই বাধ সাধে বিধি, তবে রঞ্জাবতীকে নিজের পায়ের তলায় দাসী হিসেবে প্রক্ষেপ করবে। যে তার হতে পারেনি সে আর কারো হতে পারে না। কখনো না।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বলকিনাথ। লক্ষ্য নিকটেই। কিন্তু এই সর্বশেষ ধাপটাই হলো সবচেয়ে কঠিন। শবসাধনায় এতটুকু ভুল ত্রুটি সাধকের মৃত্যু পরোয়ানা ডেকে আনতে পারে।

 বেদে বুড়ি তাকে অঘোর মার্গে এই সাধনার কথা বলেছে। লাশ কোনো স্ত্রীর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় হঠাৎ করে মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া খুব মুশকিল। এদিকে শহরে ঢোকার উপক্রম করলেই রাজপেয়াদার হাতে পড়ার সম্ভবনা বিলক্ষণ রয়েছে। তাহলে উপায় ?

সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ একটা ক্রূর চিন্তা খেলে গেলো বলকিনাথের মাথায়।

মনে মনে বলকিনাথ ভাবলো, এর পর হয়তো দুনিয়া তাকে বিশ্বাস ঘাতক বলবে। সে বলুক, বলকিনাথ থোড়াই ওসবের তোয়াক্কা করেছে কখনো। আর যে উপায় নেই। এই নৃশংসতাই অঘোর মার্গের প্রথম শিক্ষণ। আজ নাহয় হোক তার মহরত।

ধীর পায়ে বলকিনাথ এগিয়ে গেলো বেদে বুড়ির কাছে।

-" এসেছিস ?", চোখ বুজেই বলে উঠলো বেদে বুড়ি।

বলকিনাথ প্রচন্ড সংযত কন্ঠে বললো, " আদেশ করুন মা।"

বুড়ি চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলো এতক্ষণ। এবার চোখ খুলে বললো, " বোস এখানে। সবকিছু জোগাড় হয়েছে? পাঁঠার মাংস, মদ ভুজ্জি ?"
" হ্যাঁ মা। সব কিছু", বললো বলকিনাথ।
" বেশ, আর মড়াটা এনেছিস ? বাসী পচা আনিস নি তো ?"

বলকিনাথ চুপচাপ রয়েছে দেখে বেদে বুড়ি ধমকে ওঠে,
-" কীরে আঁটকুনির ব্যাটা, মড়া এনেছিস ?"

বলকিনাথের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। অশীতিপর বুড়ির বয়স তো কম হয়নি। মন্ত্র যা শেখার তা শিখেই নিয়েছে। এখন বুড়িকে রাস্তা থেকে সরাতে পারলে তারই লাভ। তাহলে তন্ত্রসাধনায় তার সমতুল্য আর কেউ থাকবেনা। মনে মনে এতক্ষণ যা ফন্দি এঁটেছিলো, সেটা প্রতিপন্ন করতে মনস্থির করলো এক লহমায়।

ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে সজোরে তার গলাটা চেপে ধরল বলকিনাথ। একফোঁটা চিৎকার করার সময় পেল না বুড়ি।
দাঁতে দাঁত চেপে বললো বলকিনাথ, 
-" মড়া তো আমি তোকেই বানাবো রে বুড়ি। তারপর তোর ওপরেই আমি সাধনা করবো।"

দম আটকে এলো বেদে। অতিকষ্টে ' শয়তান' শব্দটা বললো অস্ফুটে। দুই কষ বেয়ে তখন গ্যাজলা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু বলকিনাথের বলিষ্ঠ দুই হাত থেকে রেহাই মিললো না বুড়ির।

কয়েক মুহূর্তের ছটফটানি, তারপরই সব শেষ।

..৬..

শাল্বকুমার ও তার সেনাবাহিনী ততক্ষণে নৈশঅভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। লক্ষ্য একটাই- এতদিন ধরে ঘটে আসা নানাবিধ অপহরণ ও অপরাধের বিনাশ সাধন যা বেশ কিছুদিন ধরেই হয়ে চলেছে জঙ্গলের কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর দ্বারা।

পথ বিপদসংকুল। তাতে আবার শ্বাপদের ভয়ও রয়েছে। কিন্তু শাল্বকুমার অবিচল ভাবে এগিয়ে চলেছে। যেভাবেই হোক অভীষ্ট লক্ষ্যে তাকে পৌঁছতে হবেই। মহারাজকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অমর্যাদা কোনো মতেই করবে না সে।

বৃদ্ধ প্রয়াগনাথও এই অভিযানে শাল্বকুমারের সাথে রয়েছেন। তাঁর সন্দেহ আপন পুত্রের প্রতিই। সে যে তন্ত্র সাধনার জন্য নরবলি দিতেও পারে, এমনটা অনেক দিন ধরেই সন্দেহ করেছিলেন তিনি। একদিন এক বেদে বুড়ির সাথে জঙ্গলে দেখেওছিলেন পুত্রকে। তাদের উপাচার দেখে বড়োই আশ্চর্য হয়েছিলেন। বিভিন্ন মরা পশুপাখির হাড় মাংস আর রক্ত। এ কি স্বাভাবিকতার লক্ষণ ? মোটেও না। তবে কি কোনো নিষিদ্ধ তন্ত্রের প্রতি ঝুঁকেছে সে ? কে জানে! প্রশ্ন করেও সদুত্তর মেলেনি পুত্রের কাছ থেকে।

প্রয়াগনাথ জানেন যে পথ সে অবলম্বন করেছে তা শুধু ভয়ঙ্কর নয় ঘৃণ্যও বটে। তাই যতই তিনি পিতা হন, দেশের স্বার্থে, দশের কল্যাণে যদি নিজের পুত্রকে সাজা দিতেও হয়, তাও তিনি পিছপা হবেন না। 


ওদিকে বলকিনাথের শব সাধনার সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত। প্রথমে বুড়ির লাশটাকে ভালো করে সুগন্ধী জল দিয়ে স্নান করিয়ে ধুপ ও ধুনো দিয়ে শোধন করে যথাস্থানে এনে রাখলো।

রাতের শেষ প্রহর আসন্ন। এবারে বলকিনাথ বসবে সাধনায়। একে একে সমস্ত উপাচার গুছিয়ে নিয়ে বসল। তার পরনে কৌপিন। সামনে জ্বলছে ধুনীর আগুন। সামনে কোনো প্রাণীর রক্ত সমন্বিত একটি পাত্র। সেই থেকে একটু রক্ত কনিষ্ঠ আঙ্গুলে নিয়ে তাই দিয়ে আঁকল এক একটি ত্রিভুজ। তারপর ঠিক উল্টো করে আরো একটি ত্রিভুজ এঁকে চক্রাকারে পরিবৃত করল যা দিয়ে আসলে ছটি কোণকে ঘেরাটোপ দেওয়া হল। দুটি ত্রিভুজ থেকে উৎপন্ন ছটি কোণেই রাখা হল বিচিত্র উপকরণ- সাপের লেজ, ইঁদুরের পা, মোষের মাংস প্রভৃতি ছটি বস্তু।

তারপরই মৃতদেহ থেকে এক খন্ড মাংস ও দেহরোম নিয়ে ধুনীর আগুনে অর্পণ করল। শুরু হলো এক ভয়ংকরতম সাধনা- হাকিনী সাধনা।

বলকিনাথ উঠে বসলো শবের ওপর। তারপর দুই হাতের তর্জনী ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল নিজের নাভীদেশের কাছে এনে পরস্পরের সাথে ছোঁয়াল। মনে মনে কল্পনা করতে লাগলো এক বিশেষ অন্ত্রের- রক্তসূর্য্যচক্র। আর শুরু হল গুরুগম্ভীর গলায় এক হাড়হিম করা পুজো পাঠ। প্রথমে মায়ের পুজো, চিবিয়ে চিবিয়ে কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো এক একটি মন্ত্র-

।। ওঁ শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা ।।
।। ওঁ শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা ।।


তারপরই এক অশরীরির আবাহনী মন্ত্রে রাতের বনভূমি শিহরিত হয়ে উঠতে লাগল বারবার। সেই সাথে ধুনীর আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে থাকল একের পর এক আহুতি। 

এ এক অনন্য সাধনা। সফল হলে মোক্ষলাভ, নইলে নিশ্চিত মৃত্যু।

সাধনার  অন্তিম লগ্নে চূড়ান্ত মোক্ষের আশায় কাতর হয়ে শবের উদ্দেশ্যে পুষ্প অর্পণ করতে লাগলো সে। বুঝতেও পারল না কখন তার শিয়রে এসে উপস্থিত হয়েছে শাল্বকুমার ও তার সেনাবাহিনী।

প্রয়াগনাথ নিজের পুত্রকে এই অবস্থায় দেখে চমকে উঠলেন। বুড়ির মৃতদেহ দেখেই তাঁর বুঝতে বাকি রইল না এখানে ঠিক কী হচ্ছে। সামনেই হাঁড়ি কাঠ। হয়তো বাচ্চাগুলোর বলি দেওয়া হয়েছিল এখানেই। তাঁর পুত্রই তবে হত্যাকারী!

শাল্বকুমারের আর তর সইলো না। কোমর থেকে অসি বের করে তছনছ করে দিতে লাগলো সমস্ত উপকরণ পুজো সামগ্রী। 

ঠিক তখনই চোখ খুলল বলকিনাথ।

দুচোখে যেন নরকের আগুন জ্বলছে তার। চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করল,
-" কে তুই ? এত বড় সাহস আমার পুজোর জিনিস ভেঙে দিস !"

শাল্বকুমারের চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। গর্জে উঠলো, 
-" বন্ধ করো এসব পুজো পাঠ। একের পর এক বাচ্চা এই জঙ্গলে উধাও হয়েছে। তুমি নির্ঘাত জানো সে ব্যাপারে। বলো আমায় ? কী করছো এসব?" 

হিমশীতল কন্ঠে কথাগুলো শুনেও কোনও উত্তাপ দেখা দিলো না বলকিনাথের অন্তরে। তখনও ভাঁটার মত জ্বলছে তার দুই চোখ। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে এমন ঘোরতর জঙ্গলেও তাকে বাধার মুখে পড়তে হবে।

শাল্বকুমার উদ্যত তলোয়ার দেখিয়ে আবারও বলল,
-" চুপ করে থেকো না। বলতে তোমাকে হবেই। নইলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ওই হাঁড়িকাঠ প্রমাণ করছে তুমি নরবলি দিয়েছ নির্ঘাত।"

অদূরে একটা হাঁড়িকাঠের দিকে নির্দেশ করলো শাল্বকুমার

বলকিনাথ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,
-" রাজকুমার তুমি জানো না কী করছ। ওই বাচ্চারা কেউ মরে নি। ওদের মায়ের কাছে অর্ঘ্য দিয়েছি। মা ওদের রক্তপান করে খুশি হয়েছেন। "

প্রয়াগনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার মানে তাঁর সন্দেহই সঠিক। বলকিনাথই এসবের মূলে রয়েছে। যাকে তিনি রাজরোষ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, যে তাঁর আপন রক্ত সেই কিনা এত বড় ষড়যন্ত্রে সামিল! কিন্তু এই মৃতদেহটি কার ? মনে হচ্ছে এ সেই বেদে বুড়ি! একেও কি তাঁর পুত্রই হত্যা করেছে ? কিন্তু এসব কেন করেছে সে, তার কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।

উত্তর অবশ্য তিনি শীঘ্রই পেলেন। শাল্বকুমারের অস্ত্র দেখে বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে বলকিনাথ বলে উঠল,
-" এই রাজ্য আর তোদের থাকবে না। সাধনাবলে আমিই হবো অধীশ্বর। তাই বলছি সরে যা। বাধা দিলেই মায়ের কোপ নেমে আসবে এই রাজ্যে। এই যে দেখছিস বেদে বুড়ির লাশ। এই আমার গুরুমা। আজ তাঁর দেহের ওপর সাধনা করেই আমার অপমানের বদলা নেব। আমি তন্ত্র সাধক বলকিনাথ। আমার পুজোয় বিঘ্ন ঘটাতে আসিস না।"

শাল্বকুমার রাগে ফুঁসছিলো। এতবড় কথা। রাগত কন্ঠে বলে উঠলো
- " শেষবারের মত বলছি এসব বন্ধ করে চল আমার সাথে। তুমি যা করছ তা অন্যায়।"

-" আর রঞ্জাবতী যে আমায় সেদিন তিরস্কার করল সেটা অন্যায় নয় ? কী দোষ আমার ? আমি মন্ত্রী পুত্র এটাই আমার অপরাধ ?" রক্তচক্ষু হয়ে বললো বলকিনাথ। 

শাল্বকুমার এই কালা সাধনার উপাসকের মুখে তার নিজের বাগদত্তার নাম শুনে থমকে গেল। এত বড় সাহস! তার সামনে তারই প্রেমিকার নাম নেয়। নাঃ এর কোনো ক্ষমা নেই। এই পাপিষ্ঠ খুনি, অপহরক, বিশ্বাসঘাতক। এর শাস্তি একটাই, মৃত্যু।

প্রচন্ড রাগে দিশাহারা হয়ে বললো শাল্বকুমার,
-" কী বললি তুই শয়তান ? রঞ্জাবতীর নাম মুখে আনিস ? এত বড় আস্পর্ধা ?"

হা হা করে হাসতে থাকে বলকিনাথ। তারপর সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে ওঠে,
- " শোন রে মূর্খ। তোদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমার পিতার মতো কাপুরুষ আমি নই। রঞ্জাবতীকে আমি বশীভূত করেই ছাড়বো। ওকে আমি না পেলে কাউকে পেতে দেবো না আর। আমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটিয়েছিস। কাউকে রেহাই দেব না।"

..৭..

দূর থেকেই এসব শুনছিলেন প্রয়াগনাথ। বিপদ আসন্ন দেখে ছুটে এলেন। তারপর নিজের পুত্রের এই সাংঘাতিক কার্যকলাপ দেখে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
-" এ কী অনাসৃষ্টি করছিস বলকি! এ কাজ করিস না। ক্ষমা চা এখুনি, আমি বলছি তুই এখনই ক্ষমা চাইবি।"

বলকিনাথ তখন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। বললো,
-" কীসের ক্ষমা? তোমরা সবাই নিকৃষ্ট। এমনকি তুমি নিজেও পিতা। তোমাদের জন্যই আজ আমি এখানে। রাজা রাজ্য রাজকন্যা কিছুই আমার সাথে নেই। কিন্তু আমিও ছাড়ব না। সব কিছু এই সাধনবলেই করায়ত্ত করব। হাকিনী কে আহ্বান করবো আমি।"

শাল্বকুমার খানিক থমকে গেছিল প্রয়াগনাথকে দেখে। এই ঘৃণ্য লোকটি মন্ত্রী মশাইয়ের পুত্র !

প্রয়াগনাথ কিন্তু চিনতে পারেন না তাঁর আপন পুত্রকে। এত জিঘাংসা জমেছিলো তার মনে! এতো বিদ্বেষ! এ যে ক্ষতি বই অন্য কিছু করবে না কারো। নাঃ বলকিনাথ ক্ষমারও অযোগ্য। 

আরক্ত নয়নে তিনি রুখে দাঁড়ালেন পুত্রের সামনে। বললেন,
- "তবে রে শয়তান! তোর এত সাহস ? কী ভেবেছিস তুই হাকিনী আহ্বানে সবাইকে বশীভূত করবি? তাহলে শোন। আমিও এক ন্যায় নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। আমার কাছে দেশ আগে, কর্তব্য আগে। এই হাকিনী ডাকিনী এদের ওপরেও আছেন আর এক মহাশক্তি। মহাডামরি ভৈরবী। তিনি পরব্রহ্ম। মহাকালের ধারক। তাঁর উপাসক আমি। আমায় তুই ভয় দেখাচ্ছিস ? যতই তুই আমার পুত্র হ, তোর পাপের ভাগীদার আমি অবশ্যই হতে পারি না।"

-" রঞ্জাবতী আমার। তাকে কাউকে পেতে দেব না। সে শুধুই আমার। আমায় তিরস্কার করলেও আমি তাকে ছাড়বো না। কেউ আটকাতে পারবে না। দেখি তুমি কতবড় শক্তির উপাসক", বলেই বলকিনাথ আবারো সাধনার প্রস্তুতি নিতে উদ্যত হয়।

শাল্বকুমার এতক্ষণ সবই শুনছিলো। এতক্ষণ মন্ত্রী পুত্র বলে খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়লেও ওই কথা গুলো শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। রাজধর্ম আগে, তারপর বাকি সমস্ত।

- " তবে রে শয়তান", বলে সবেগে অসি চালনা করল সে বলকিনাথের দিকে। 

কিন্তু ধূর্ত বলকিনাথ বোধহয় তৈরি হয়েই ছিলো। মুহূর্তে সরে গেলো নিজের পিতার দিকে। তারপরই পার্শ্ববর্তী এক সৈনিককে সপাটে ধাক্কা মেরে তার তরোয়াল হস্তগত করে আপন পিতাকেই পেছন থেকে জাপটে ধরে অসিখানা প্রয়াগনাথের কন্ঠনালীর একদম কাছে ধরে শান্ত গলায় বললো,
- " রাজকুমার আমায় তুমি এখনো চেনো নি। সাধনায় বিঘ্ন ঘটালে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। তার জন্য নিজের পিতাকেও রেওয়াত করবো না আমি।"

সহসা এমন পরিস্থিতিতে শাল্বকুমার থতমত খেয়ে গেলো। লোকটা এভাবে প্রতি আক্রমণ করবে এ যে ধারণার অতীত। 

প্রয়াগনাথ তখনও রাগে ফুঁসছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন, 
-" থামলে কেন কুমার। চালায় অসি। আমি মরলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু এই নরাধমটিকে শেষ করে দাও। ওটাই রাজাদেশ, সে যতোই আমার পুত্র হোক না কেন।"

আপামর সৈন্য সামন্তরাও থমকে গেছে। কী করবে কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বলকিনাথ অসম্পূর্ণ সাধনা ছেড়ে নিজের কুটিল বুদ্ধিতে সকলকে কাবু করে ফেলেছে। শাল্বকুমারও অসহায়ের মতো তাকিয়ে। 

বলকিনাথ আবার বলে উঠলো, 
- " এবার কী করবে রাজকুমার? রক্তপাত হবেই। কিন্তু মরবে তোমরা। আমিই..." 

বলকিনাথের কথা শেষ হলো না। অকস্মাৎ ঝড় উঠলো যেন। সেকি হাওয়ার তান্ডব! এই নিবিড় অরণ্যে প্রতিটি গাছ এমন প্রচন্ড দুলতে লাগলো যেন প্রলয় এসেছে। আর ঠিক তখনই সবার চোখ পড়লো সেই বেদে বুড়ির মৃতদেহের ওপর। 

একি! সেটা যে এখন সটান উঠে বসেছে। মুখে প্রচন্ড এক রাগ, তীব্র ঘৃণার আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। চোখ দুটো লাল। মরা মানুষের দেহে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে আবার। 

বলকিনাথ পর্যন্ত এ দৃশ্য দেখে চমকে উঠলো। সে হাঁ হাঁ করে সাধন স্থলের দিকে দৌড়লো। কিন্তু না , ততক্ষনে যা হবার তা হয়ে গেছে। হাকিনী তন্ত্রে অসম্পূর্ণ সাধনা মহাবিপদ ডেকে আনে। আর তার জন্য সবথেকে বড় মাশুল দিতে হয় স্বয়ং সাধককে। 

 হাকিনী এখন বেদে বুড়ির দেহে অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সে যে ক্ষুধার্ত। তাকে যে সাধনপ্রক্রিয়ায় ডাকা হয়েছে তাতে খুঁত থেকে গেছে। এবারে যে বলকিনাথকে তার পরিণাম ভুগতেই হবে।

প্রচন্ড হাওয়ার দাপটে ছিটকে পড়লো বলকিনাথ। চারদিকে ভয়ানক সব চিৎকার, অশরীরিদের আর্তনাদ আকাশ বাতাস বিদারিত করে দিচ্ছে। বলকিনাথ হাজার চেষ্টা করেও উঠতে পারলো না।  

হাকিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি বড় তান্ত্রিকেরও অসাধ্য। বলকিনাথ সেখানে কোন ছাড়! 

বেদে বুড়ির দেহটা এখন শূন্যে উঠে ভাসছে। এক নারকীয় হাসি তার মুখে। কুৎসিত কদাকার সেই মুখ কী বীভৎস ! যেন পাতাল থেকে উঠে আসা এক রাক্ষুসী।

 হঠাৎই প্রচন্ড রাগে, সেই ভয়াল দর্শন প্রেতযোনী ঝাঁপিয়ে পড়লো বলকিনাথের ওপর। 

তারপর সজোরে তার ঘাড়টা ধরে উল্টো দিকে মোচড় দিয়ে দিল। বলকিনাথের কোনো কিছুই করার অবকাশ রইলো না। চলচ্ছক্তিহীন দেহটা সটান ভূপাতিত হল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি বেদে বুড়ির শরীর থেকে বের হয়ে পাক খেতে খেতে আকাশে মিলিয়ে গেলো।

একটা আর্তনাদ আর ধপ করে একটা শব্দ হতেই প্রয়াগনাথ দেখলেন তার পুত্র ধরাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছে। একটা রুধির ধারা ফিনকি দিয়ে বের হলো বলকিনাথের মুখ থেকে।

প্রয়াগনাথ আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে। পুত্রের এমন অবস্থায় ভেঙে পড়লেন তিনি। হোক সে তান্ত্রিক, কালা জাদুর অধিকারী, হোক সে রাজদ্রোহি; তবুও তো সে তার পুত্র। বলকিনাথের ভূপাতিত দেহ আঁকড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রয়াগনাথ। তখনও সে দেহে অল্প প্রাণের লক্ষণ রয়েছে। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করে মৃত্যুপথযাত্রী বলকিনাথ বলে উঠল,
-" সব মরবে, মহামারী হয়ে শেষ হয়ে যাবে। এ আমার অভিশাপ। রঞ্জাবতী শুধুই আমার। এ জন্মে , পরের জন্মে, সব জন্মে। "

তারপরই সব শেষ। চারিদিক শান্ত হয়ে এলো। গভীর অরণ্যের এই নিভৃতস্থানে পড়ে রইলো এক ভয়ঙ্কর উপাসকের দেহ আর কয়েকটা মানুষজন। সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু মহীরুহ আর অন্ধকারের এক মিশমিশে আচ্ছাদন। 

শাল্বকুমার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না প্রয়াগনাথকে সান্ত্বনা দেবার। শুধু অন্ধকারে নিভু নিভু ধূনির আগুনের ম্লান আলোয় দেখলো বৃদ্ধ প্রয়াগনাথ অসহায়ের মতো আকুলি বিকুলি করছে। আজ যে তিনি নির্বংশ হলেন।

..৮..

কিন্তু কাঞ্চনগড় রক্ষা পায়নি এরপর। বলকিনাথের কালাজাদুর প্রভাব ছিল অমোঘ। বেদে বুড়ি তাকে কিছু তন্ত্র গুণ নিশ্চই প্রদান করেছিলো; তাই বোধহয় কিছুদিনের মধ্যেই এক সাংঘাতিক মহামারী গ্রাস করল গোটা কাঞ্চনগড়কে। 

কেউ বাঁচে না। একে একে সব প্রজা, এমনকি রাজপরিবারের সকলেই প্রাণ হারালো। সবশেষে রঞ্জাবতীও সেই ভয়াবহ মহামারীর শিকার হয়ে অভিশাপের কলা পূর্ণ করল। ধ্বংস হয়ে গেল কাঞ্চনগড় নগরী। 

বেঁচে রইলেন শুধু প্রয়াগনাথ। কেন জানি না মহামারীর প্রকোপ তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। হয়তো পুত্র হয়ে এমন কিছু করে গিয়েছিল বলকিনাথ যাতে একমাত্র তার পিতাই বেঁচে থাকে, নাকি সকলকে মরতে দেখে পিতাকে তার সাক্ষী হয়ে থাকবার অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো তা ঈশ্বরই জানেন। সে ছিলো এক মহাতামসের উপাসক। রক্ত ছাড়া যে অর্ঘ্য দিতে পারতো না। চেয়েছিলো মহামোক্ষ। বদলে জুটেছিল ভয়ানক এক মৃত্যু। মরণ যাত্রায় দেওয়া কালাভিশাপ ফলে গিয়েছিল অক্ষরে অক্ষরে। 

প্রয়াগনাথের আর কোনো খবর পাওয়া যায় নি। তবে কানাঘুষো শোনা যায় তিনি নাকি পরে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সব কিছু চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন একসময়। 

কেউই সঠিক বলতে পারে না তাঁর সম্বন্ধে। শুধু আশপাশের অনেক জায়গায় আজও আড়াইশো বছর পরে কান পাতলে শোনা যায় এক অসহায় বৃদ্ধের কাতর আর্তনাদ, এক অপরিসীম হাহাকার। যিনি সবকিছুর বিনিময়ে নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকতে চেয়েছিলেন। হয়তো এই ভীষন কর্তব্যপরায়ণতাই তাঁর জীবনে এক ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে নেমে এসে সবকিছু ছাড়খার করে দিয়েছিলো।

সমাপ্ত।
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার