জয়ন্ত চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জয়ন্ত চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

এক নম্বর - জয়ন্ত চক্রবর্তী

 


এক নম্বর

জয়ন্ত চক্রবর্তী 

 



নীরা ও নীরা খুব একটা আলাদা নয়, আবার আলাদাও । আলাদা নয় কারণ, দু'জনেই নীরা । এক বয়সী , একই শহর, একই পাড়া, একই স্কুল , একই ক্লাস । আরও একটা মিল আছে, দু'জনেই মেধাবী । পড়াশুনোয় ভালো । তা'হলে আলাদা কোথায় ? প্রথমজন নীরা চ্যাটার্জী, ফর্সা ,সুন্দরী , স্বাস্থবতী, ধনী , ছটফটে, প্রতিবার ফার্স্ট হয় । দ্বিতীয়জন নীরা দত্ত, শ্যাম বর্ন, চলনসই, রোগা ডিগডিগে চেহারা, নিম্নবিত্ত, শান্ত, ফার্স্ট হয়নি কোনবার, তবে সেকেন্ড হয় । এসবের পরেও দু'জনের মধ্যে আর একটা অদ্ভুত মিল আছে, দু'জনে হলায়-গলায় বন্ধু । 


প্রতিবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষে রেজাল্টের দিনে হেড স্যার নাম ডাকেন, প্রথম নীরা চ্যাটার্জি । দ্বিতীয় নীরা দত্ত । ক্লাসে গুঞ্জন শুরু হয় । এ বারেও ! প্রতিবার একটা মেয়ে ফার্স্ট হয় কী করে ? এটা শুধু অন্যায় নয় অপরাধ ।


হেড স্যার গুঞ্জন শুনে রাগেন না, বলেন , দাঁড়াও দিকি ! আবার সবার নম্বর চেক করতে দাও । দেখি কোন ভুল হয়েছে কি না !


ভুল আর বেরোয় না । অতএব নীরা চ্যাটার্জি ই প্রথম , নীরা দত্ত দ্বিতীয় । ক্লাস সিক্স থেকে টেনের টেস্ট পর্যন্ত প্রথমের নাম ফলক টি যেন আগে থেকে বাংলায় খোদাই করাই আছে, নীরা চ্যাটার্জির নামে ।


মেয়েদের স্কুলের এই ব্যাপারটা এখন এমন গা-সওয়া হয়ে গেছে যে , কেউ আশ্চর্য হয়না । এমনকি অন্য ক্লাসের মেয়েরাও আর নীরা দত্ত কে তার নিজের নামে ডাকেনা , বলে দু'নম্বর । 


----------


দু দু'বারের কাউন্সিলার, আধা গ্রাম আধা শহরের মান্যিগন্যি ভদ্রলোক জগবন্ধু চ্যাটার্জি, স্কুল কমিটির সম্পাদক । আগে চাকরি করতেন, এখন ছেড়েছুড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর রাজনীতি । জনসেবায় মন সঁপেছেন । ওনার ই একমাত্র মেয়ে নীরা । শহরের মাঝমধ্যিখানে দোতলা বাড়ি । সারাদিন লোক আসা যাওয়া করে । হেডস্যার ও যান প্রায়ই । দুর্জনেরা বলে, ভয় ও ভক্তির আঁতাতেই নাকি নীরা চ্যাটার্জি প্রতিবার ফার্স্ট হয় । নইলে …


অপরদিকে বিপত্নীক নরেন দত্তের জ্যেষ্ঠা কন্যা নীরা দত্ত । এবারে মাধ্যমিক দেবে । ছোটটি আড়াই বছরের ছোট, ক্লাস এইট । নীরা যখন ক্লাস ফাইভে তখনই মা'কে হারিয়েছে । দুরারোগ্য ব্যাধিতে । তখন থেকেই দুই বোনের কাছে বাবাই সব । নরেনবাবু স্থানীয় চটকলে ক্লাস ফোর স্টাফ । সকাল সওয়া ছটা থেকে এগারোটা আবার দুপুর সওয়া বারোটা থেকে পৌনে চারটে পর্যন্ত ডিউটি । আসা যাওয়া বাদ দিয়ে মাঝের ওই পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময়ের জন্য বাড়ি আসেন । টানাটানির সংসার, তবু মেয়ে দুটির পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন । 


মেয়ে দুটি পড়াশুনোয় ভালো, অন্যেরা সাহায্য করে । স্কুলের ইংরেজি আর অংকের টিচার বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান বড় টিকে । কিন্তু চিন্তা একটাই, এরপর কি হবে ? স্কুলটি মাধ্যমিক পর্য্যন্ত । এরপর পড়তে হলে তো যেতে হবে বড় শহরে । অনেক খরচা । ফার্স্ট হলে তাও একটা আশা ছিল, স্কুল কমিটি প্রতিবছর স্কুলের প্রথম স্থানিধিকারী কে বৃত্তি দেয় । কিন্তু এ মেয়ে তো ফার্স্ট ই হলো না জীবনে । চিরকাল সেকেন্ড । লোকেরা অবশ্য বলে, এবার ঠিক হবে, দেখে নিও । বোর্ডের পরীক্ষা তো, জগবন্ধু বাবুর ইশারায় তো আর রেজাল্ট তৈরি হবে না । 


----------


ফাইনাল পরীক্ষা । স্কুলেই সিট পড়েছে । প্রথম দিনের ধকল সামলে নিলেও দ্বিতীয় দিনেই কেমন কাবু হয়ে পড়লো দু'নম্বর নীরা । হাতে ঠিক জোর পাচ্ছে না, খাতার দিকে তাকালেই শিরদাঁড়ায় ব্যাথা ওঠে । মাথাটা নুয়ে নুয়ে পড়ে ।  ঘাড় নিচু করে বসে ছিল । শুধু ওইটুকু সময়ের জন্য ঘাড় নিচু । পড়বি তো পড় দৃশ্যটা নজরে পড়লো ইনভিজিলেটরের চোখে । ভাবলেন নকল করছে । কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হচ্ছে, ঘাড় নিচু করে কি লিখেছো ? উঠে দাঁড়াও ।'


দু'নম্বর নীরা উঠে দাঁড়ালো । হেড স্যার সঙ্গেই ছিলেন, বিরক্ত হলেন না । একটু মজা করে হাসতে হাসতে বললেন, 'সাধে কি আর এর নাম দু'নম্বর হয়েছে স্যার । একদম টেনশন নিতে পারে না । এই জন্যই কোনও দিনই একনম্বর হতে পারলো না ।' 

সে কি ইচ্ছে করে এসব করছে ? নীরা দত্ত মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো ।


ইনভিজিলেটর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন দু'নম্বর নীরাকে । কড়া দৃষ্টির সামনে ভয়ে কুঁকড়ে আছে । চোখে ভীতু ভীতু ভাব । ঘেমে নেয়ে ডান হাতের তিনটে আঙ্গুল কালচে নীল । 


ইনভিজেলেটরের চেয়ে থাকা যেন অনন্ত সময়ের জন্য । কিছু মীমাংসা হওয়ার আগেই হেডস্যার হেঁকে বললেন, 'বসো, একটু জিরিয়ে নাও । ভালো করে পরীক্ষা দাও । '


কৃতজ্ঞতায় একেবারে মাটিতে মিশে গেল দু'নম্বর নীরা । লিখতে গেলেই শিরদাঁড়া আবার ব্যাথা করে ওঠে । এক মুহূর্তের জন্য লেখা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো এক নম্বর নীরাকে । পিছনের সিটে চুপটি করে বসে একমনে লিখেই চলেছে । কোন ভ্রূক্ষেপ নেই । কি অসম্ভব রকম শান্ত, সিরিয়াস । অথচ সারা বছর কেমন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফুরফুরিয়ে ঘুরে বেড়ায় । আর সে নিজে ! সারাদিন বইয়ের পাতায় গোঁত্তা মেরে মুখ গুঁজে পড়ে থেকেও জীবনে ফার্স্ট হতে পারলো না । 


তৃতীয় দিনই অংক । ঘন্টা খানেক যেতে না যেতেই এক নম্বর নীরা খাতা জমা দিয়ে চলে গেলো । সারা ক্লাস অবাক । শিক্ষক থেকে অভিভাবক সবাই অবাক । অবাক দু'নম্বর নীরা ও । নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে, নইলে ফাইনাল পরীক্ষায় এমনটি কেউ করে ?  


পরের দিন থেকে আবার সব স্বাভাবিক । দু'নম্বর, এক নম্বর কে ডেকে গত দিনের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পেলোনা । কে জানে, হয়তো কোন নিজস্ব সমস্যা, শেয়ার করতে চায়না । আর জিজ্ঞেস করেনি দু'নম্বর ।


---------


বাতাস আজকে বড়ই অকরুণ । অসহ্য আদ্রতা মানুষের রক্ত পর্যন্ত শুষে নিচ্ছে । আচ্ছা, একটু বৃষ্টি হলে কার কি ক্ষতি হতো ! সকাল যেন এক জায়গায় থেমে আছে, কখন যে দশটা বাজবে কে জানে । 


দশটার কিছু পরেই রেজাল্ট বেরুলো । হেডস্যার লিস্ট সেঁটে দিলেন দেওয়ালে । সকলেরই নাম আছে তবে নীরা চ্যাটার্জির নাম এক নম্বরে নেই । বদলে নীরা দত্ত । নীরা চ্যাটার্জি দু'নম্বর । এতদিনের দু'নম্বর নীরা এসেছে এক নম্বরে । 


'কী, বলেছিলাম না , বোর্ডের পরীক্ষার রেজাল্টে সব পাল্টে যাবে । ' বন্ধুরা পিঠ চাপড়ে দিল । দু'নম্বরের মুখে প্রশান্তি, কাল থেকে ওকে কেউ আর দু'নম্বর বলতে পারবে না । তার জীবনে যা যা পাওয়ার কথা ছিল সবই ওই এক নম্বরটার জন্য এতদিন পাওয়া হয়নি । এবার সব পাবে । সব থেকে ভালো কথা বৃত্তি পেয়ে বড় শহরে পড়তে যেতে পারবে ।


বাবাকে জানাতে হবে । আপনা আপনি জল পড়তে লাগলো দু'নম্বর নীরার চোখ থেকে । এগারোটার ভোঁ বাজতে তখন আর কতই বা দেরি ।


----------


হেডস্যার চা খাচ্ছিলেন, মনটা ভালো নেই । কে এসেছে না দেখেই খেঁকিয়ে উঠলেন, 'তোমার আবার কি চাই । '


'কিছু না,' বলে দু'নম্বর ঢিপ করে একটা প্রণাম করলো হেডস্যার কে । চমকে উঠলেন । শক্ত মাটিতে পড়ে কাপটা ভেঙে গেল । মাথায় হাত ছুঁইয়ে হেডস্যার আশীর্বাদ করলেন , 'আয়ুষ্মতি ভব । জীবনে অনেক উন্নতি করো । ওসব ফার্স্ট সেকেন্ড নিয়ে চিন্তা করোনা , তোমরা দু'জন এ সবের ঊর্ধ্বে ।'


'তোমরা !' এখানে তো দু'নম্বর একা । তোমরা মানে তো এক নম্বর কেও বোঝানো হলো । এতক্ষনে দু'নম্বর নীরার খেয়াল হলো , এক নম্বর তো আসেনি । কী ব্যাপার এক নম্বর আসেনি কেন ? ও কি আগে থেকেই জানতো ? হেড স্যার কে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি রাগলেন না । বরং হেঁয়ালি করে বললেন, 'মার্কশিট টা নিয়ে যাও । '


দু'জনের মার্কশিট বার করে টেবিলে মেলে ধরে বললেন , 'দেখো ।' এক নজর সেদিকে তাকিয়েই দু'নম্বর অবাক । প্রতিটা পেপারে একনম্বর নীরা ওর থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে । শুধু অংক ছাড়া । একজন ছেচল্লিস আর এক জন ছিয়ানব্বই । পাক্কা পঞ্চাশ নম্বরের পার্থক্য । সেই অংক ! 


এক লহমায় হেডস্যারের রুম থেকে বেরিয়ে দু'নম্বর ছুট লাগালো এক নম্বরের বাড়ির দিকে । বাতাসে তখন এগারোটার ভোঁ বাজছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ই নেই ।


---------


ড্রয়িং রুমেই বসেছিল ওরা । জগবন্ধু বাবুর সঙ্গে স্ত্রী আর মেয়ে নীরা । সঙ্গে পাড়ার ক'জন । ওই রেজাল্টের ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল । ওকে দেখে সবাই চুপ । সোফার এক কোনে বসে একনম্বর । উদাস দৃষ্টি । 


দু'নম্বর নীরা ঘরে ঢুকতেই 'কংগ্র্যাচুলেশন' বলে জড়িয়ে ধরলো এক নম্বর । একদৃষ্টে মুগ্ধ ভাবে একনম্বরের দিকে তাকিয়ে দু'নম্বরের চোখে হঠাৎ আবার জল এসে গেল । নিজেকে সামলাতে পারলো না, এক নম্বরের দিকে চেয়ে বললো, 'একটা প্রণাম করতে দিবি । তুই আমার থেকে অনেক অনেক বড় । তুই একনম্বরই থাকবি । আমি চিরকাল দু'নম্বর হয়েই তোর সঙ্গে থাকতে চাই । '

'আমাকে না , আমাকে না, প্রণাম করতে হলে বাবাকে কর । বাবাই তো আমাকে সব শিখিয়ে দিয়েছিল । ভাগ্যিস, আমি সবটা ঠিকঠাক করতে পেরেছি । এখন আমাদের আর একসাথে শহরে পড়তে যেতে কোন বাধা রইলো না । '


এক নম্বরের চোখেও তখন জল থৈ থৈ করছে । জগবন্ধু বাবু সে দিকে তাকিয়ে দরাজ গলায় হাসতে হাসতে বললেন, 'আরে কী হলো, কাঁদছিস কেন তোরা ? জীবনে অনেক পরীক্ষা দিতে হবে । ফার্স্ট সেকন্ড নিয়ে পড়ে থাকলে হবে । যখন যার দরকার তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে । তবেই না বন্ধুত্ব, তবেই না মনুষ্যত্ব ।'


এক নম্বর তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললো, 'কই, কাঁদবো কেন ? তোমার মতো বাবা পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার ।' দু'নম্বর ততক্ষনে জগবন্ধু বাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে ফেলেছে । 'আমায় একটু আশীর্বাদ করুন কাকু । যেন আপনার দেখানো পথে চলতে পারি, যেন আপনাদের মতো মন পেতে পারি ।'

জগবন্ধু বাবুর চোখ দিয়ে তখন জল গড়াচ্ছে, টপ টপ ।


দু'নম্বর জগবন্ধু বাবুর বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো । সূর্য কতদূর এগোলো ? একদিন কি দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি এগোতে পারে না ? সূর্য ঢলে পড়লেই তো পৌনে চারটের ভোঁ পড়বে ।

 

..........সমাপ্ত..........

 

Jayanta Chakraborty