দীপান্বিতা দে রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দীপান্বিতা দে রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

দাস্তান-এ-গুল - দীপান্বিতা দে রায়




দাস্তান-এ-গুল

দীপান্বিতা দে রায়

 

    আরাকান রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের কোলে ছোট একটা দুর্গ। দুর্গের শেষ প্রান্তের একটি মাত্র ঘরে মাটির প্রদীপ জ্বলছে টিমটিম করে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে অন্ধকার নেমে এসেছে। এই ঘরটি রাণীমার জন্য বরাদ্দ। দুর্গের বাকি ঘরগুলোতে কোনো আলোর সংকেত নেই। সেগুলিতে আত্মগোপন করে আছেন কয়েকজন, একমাত্র রাজা ছাড়া তাদের পরিচয় কারো কাছেই নেই। সেই দুর্গেরই এক ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন এক শাহ়্জাদা। একে একে প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে যার।

    এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো এক নারী মূর্তি। মাথায় তার রেশমি কাপড় ঢাকা। 

..."তুমি এসেছো গুলরোখ? সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর কোনো উপায় নেই, আমার এই হাতে একমাত্র পুত্রের রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছো গুল। তাকে হারিয়েছি আমি, সে আজ মৃত, আমার নিয়তি আসছে আমাদের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে, নিস্তার নেই গুল..."

...."মৃত্যুর মুখে একদিন আমিও ছিলাম শাহ়্জাদা, আপনি আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন সেই জাহান্নাম থেকে, আমার রূহ আপনার গোলাম। আপনাকে ছুঁতে পারবে না ওই কাফের মগ রাজা। আপনি অনুমতি দিন।" 

    শাহজাদার ঘরে কিছুক্ষন থেকে বেরিয়ে এলেন গুলরোখ।

    সময়টা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আগ্রাসী থাবা বিস্তারিত হয়েছে ভারতবর্ষের সর্বত্র। শাহ সুজা ব্যতিরেকে সব ভাইকে হত্যা করে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের নিকট থেকে আওরঙ্গজেব সিংহাসন প্রায় নিষ্কণ্টক। কিন্তু নিষ্কৃতি নাই শাহজাদা সুজাকে না সরানো পর্যন্ত। আওরঙ্গজেবের নিকট হতে প্রাণ রক্ষা করতে উপায় একটাই, ভারতবর্ষ ত্যাগ। আগে ভারতবর্ষ ত্যাগ, তাঁর পর সমুদ্র পথে পশ্চিমে মক্কা হয়ে পারস্য বা তুরষ্কে। স্ত্রী, তিন কন্যা এবং এক পুত্র সহ নিরুপায় সুজা আশ্রয় ও সহায়তার জন্য যোগাযোগ করেন আরাকান রাজের সাথে। 

    খাজোয়ার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে পরাজিত সুবেদার শাহ সুজা ১ এপ্রিল ১৬৫৯ সালে রাজমহল ত্যাগ করে তাণ্ডায় আশ্রয় নেন। ৬ এপ্রিল ১৬৬০-এ তিনি প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) এবং পরে সেখান থেকে আরাকান যাত্রা করেন। 

    আরকান রাজ আশ্বস্ত করেন সহায়তার। আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলা পিছু ধাওয়া করলে শাহ সুজা তার অনুগত কিছু সেনাপতি এবং তাদের অধীনে বিপুল সংখ্যক মোঘলযোদ্ধাদের নিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে নাফ নদীর তীরে পৌঁছান। কিন্তু আরকান রাজার শর্ত অনুযায়ী সকল যোদ্ধাদের সেখানেই বিদায় জানিয়ে মাত্র কিছু দেহরক্ষী নিয়ে নাফ নদী পার করে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ উপস্থিত হন শাহ সুজা। 

    উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় আরকানের রাজসৈন্যরা। রাজা ‘চন্দ্রসুধর্ম্ম’ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন শাহ সুজার মক্কা গমনে সহায়তায়। 

    সন্মুখে আরাকান বাহিনী এবং পেছনে মীর জুমলার বাহিনীর ভয় থাকায় মোগল সেনারা অপেক্ষাকৃত দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে তাদের প্রথম দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলীকদম’। কিন্তু সেখানে নিরাপদ রূপে থাকা দীর্ঘদিন সম্ভব নয় জানতেন শাহাজাদা।

    এদিকে নানা ছুতোয় ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছিলো মক্কা যাত্রার জাহাজের বন্দোবস্ত। ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটছিল শাহাজাদার, যেন নিজ দুর্গেই বন্দী শাহাজাদা নিরুপায় হয়ে দিন গুনছিলেন নিজের মৃত্যুর। ইতিমধ্যে আরাকান রাজের চক্রান্তে হারিয়েছেন নিজের জ্যেষ্ঠপুত্রকেও।

    পিয়ারী বানো বেগম ছিলেন শাহ সুজার দ্বিতীয় স্ত্রী। শাহজাহানের আমলে বাংলার দ্বিতীয় সুবেদার আজম খানের কন্যা ছিলেন পিয়ারী বানো। তিনি ছিলেন সার্থকনামা। পরমা সুন্দরী ও বিদুষী এই মহিলা তাঁর বুদ্ধির দীপ্তিতে তৎকালীন বঙ্গীয় উচ্চকোটির সামাজিক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। শেষ সময়ে উনি ছিলেন শাহজাদার পাশে। 

    কিন্তু এই গল্প নেহাতই ইতিহাসের বিবরণ নয়, এই গল্প এক নারীর। এই গল্প এক সাধারণের রাজ পরিবারের প্রতি আনুগত্যের। ইতিহাস এই গল্পে পথ হারালে তার সম্পূর্ণ দায় তার গল্পকারের, দাস্তান-এ-গুল এক অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প, এক কুহেলিকার গল্প।

--------------------------------------------------------------- 

    শীত এখনো আসেনি, তবে কুয়াশা ঢাকা – শিশির ভেজা  রাতে শীতের পদধ্বনি শোনা যায়।

    শেষ রাতে যখন পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে তন্দ্রা, ঠিক তখনই উন্মুক্ত হলো দুর্গের অন্তঃপুরের দরজা। এক নারী মূর্তি একলা পথে পেরিয়ে এলেন দুর্গের। অজানা কারণে দ্বাররক্ষক কেউ নেই পাহারায়। দুর্গের গায়ে টিমটিম করে জ্বলা আগুন মশালগুলোও নিভে আসছে। এ কোন ঘোর অন্ধকারের ইঙ্গিত? নারী মুর্তিটি এক মুহুর্তের জন্য থামলেন। তারপর আবার অগ্রসর হলেন সামনের দিকে, পেছনে পরে রইলো পাহাড়ের আড়ালে থাকা আলীকদম দূর্গ।

    তমাশাচ্ছন্ন রাতের কালো মেঘে ঢাকা পরেছিল এক ইতিহাস, আজ সেই গল্পই শোনাবো আপনাদের। এক বিশ্বাসঘাতকের গল্প, আর একজন নিজের শেষটুকু দিয়ে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়ার এক গল্প।

    পর্বতের উত্তর দিকে আছে একটা জঙ্গল, সেখানে মানুষের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে, কিছু আদিবাসী আসে শিকারের লোভে, তবে হিংস্র পশুদের আস্তানা এই জঙ্গল। নারী মুর্তিটি জঙ্গলের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়ালেন, একা। কিছুটা সময় পরে সেই জঙ্গলের পথে এলেন এক সুপুরুষ যুবক। ঠিক যেন পাথর কেটে এই কিন্নরের জন্ম হয়েছে। চওড়া কাঁধ, পিঠের পেশি শক্ত হয়ে নেমে এসেছে কোমরের উপত্যকায়। আবলুশ কাঠের মতো গায়ের রঙ তার, একমাথা ঝাঁকড়া চুলের গোছা, মাথায় চুড়ো করে বেঁধে রাখে। হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে পুরুষটি, হয়তো অন্য কারো অধীনস্থ তার স্বত্তা। তাই মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। নারী মুর্তি তাকে অনুসরণ করলো, প্রবেশ করলো জঙ্গলে, সেখানে একটা শিবিরের মাঝে একটাই মশালের আলো জ্বলছে। খুব কম তার আলো। তবু সেই আলোতেও বোঝা যায় সেই শিবিরে কেউ প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে। নারী মুর্তি প্রবেশ করলেন শিবিরে। পুরুষটি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। অটল প্রহরী হয়ে। 

    নারী মুর্তি খুলে ফেললেন তার মাথায় দেওয়া রেশমি কাপড়। নিস্তেজ হয়ে আসা আলোতেও নারী মুর্তিকে চিনতে অসুবিধা হলো না। এই সেই গুলরোখ। কিন্তু রূপের ছটায় হার মানে হুর পরীরাও। শাহাজাদার সাথে এই বাঁদী কে প্রথম যেদিন দেখেছিলেন আরকান রাজ চন্দ্রসুধর্ম, সেদিনই মত্ত হয়েছিলেন এর প্রেমে। পেতে চেয়েছিলেন নিজের করে। কিন্তু মগ রাজার প্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হন শাহ়্জাদা। মনের মধ্যে প্রেমের আগুনটা জ্বালিয়েছিল যে নারী আজ সে নিজেই দাবী করে সাক্ষাতের। উপেক্ষা কর‍তে পারেনি রাজা, তাই গোপনে জঙ্গলে এই মিলনের ব্যবস্থা করেন উনি। 

    হটাৎ কালো আকাশ ভেঙে বাজ পরলো কান ফাটানো শব্দে।
    মুহুর্তের জন্য অসাবধান হলেন গুলরোখ। তার গায়ের পাতলা দুধ সাদাটে রঙের ওড়না ভেদ করে উপত্যকার গভীরে হারিয়ে গেলো রাজা চন্দ্রসুধর্মের চোখ। 

     চারিদিক অন্ধকারের মাঝে এক শুভ্র আলো আচ্ছন্ন করেছে শিবিরকে। ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে এলেন রাজা। পুরুষালি গন্ধ অনুভব করলো গুলরোখ। দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো আবেশে। আসতে আসতে বন্দী হলো গুলরোখের শরীর, রাজা চন্দ্রসুধর্ম্মের বাহুপাশে।

    এদিকে বাইরে উত্তাল হচ্ছে ধরণি, আজই যেন শেষদিন তার। বহু অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রেমিকের উত্তাল ভালোবাসায় চমকে চমকে উঠছে। শুষ্ক রুক্ষ ধরণি সিক্ত হচ্ছে।

"দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ,
দিকে দিকে হল দীর্ণ–"

    তিরতির করে কাঁপছিলো গুলরোখ। রাজা আশ্রয় দিলো তাকে। এই নারী ছিল রাজার কল্পনারও অতীত। আজ বহ্নি পতঙ্গের ন্যায় ধরা দিয়েছে সে নিজেই। গুলরোখের গোলাপি ঠোঁটের উৎসে এসে রাজা থমকে গেলেন। চন্দন সুরভীত দেহ পল্লব তার। গোলাপের মতো কোমল তার ত্বক। গুলরোখের পেলব পীঠ বেয়ে নেমে এলো রাজার হাত, আরো গভীরে। নাভিমূলের গ্রন্থিতে এসে আটকে গেলো সে। ততক্ষণে গুলরোখের কেশ সজ্জা বিন্যস্ত করেছে রাজা চন্দ্রসুধর্ম। এক এক করে শরীরের সব আবরণ উন্মুক্ত করেছে তার। সম্পুর্ণ নিরস্ত্র, নির্বস্ত্র গুলরোখ। যদিও শিবিরের পাশেই লুকিয়ে আছে রাজার সেনা, প্রহরায় তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাস, তবুও সাবধান হতে চান রাজা। গুলরোখের মেঘের মতো চুলের রাশি নেশা সৃষ্টি করছে। আচ্ছন্ন করছে রাজাকে। প্রেমের নেশার এক অদ্ভুত গন্ধ আছে, সেই গন্ধই মেতে উঠেছে রাজা। আজকের রাতের জন্য গুলরোখ তার, তারপর খুব শীঘ্রই আসবেন বাদশা আওরঙ্গজেব। একবার শাহজাদা সুজাকে পেলেই মিলবে প্রচুর উপঢৌকন। মিলবে বাদশার নিরাপত্তা। 

    কিন্তু ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হচ্ছিলেন রাজা, গুলরোখের শরীরের গন্ধে নেশা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করেছে রাজাকে। নিঃশব্দে এক সময় লুটিয়ে পরলেন রাজা। পাশেই লুটিয়ে পরলেন গুলরোখ। প্রাণহীন নিথর দুটো দেহ মৃত্যু যন্ত্রনায় নীল হতে শুরু করেছে। শিবিরের বাইরে প্রতিক্ষায় দ্বাররক্ষক কিন্তু ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, রাজা নিজে না ডাকলে।

    বিশ্বাসঘাতকের শিবিরে সে নিজেই এসেছিল আজ অস্ত্র হয়ে। সারা শরীরে ছিল বিষের আধার। গুলরোখ জানতো শিবির থেকে সে ফিরে আসতে পারবেনা। শাহজাদার ভীষণ বিপদ, মগরাজ নিজের কথা রাখেননি, তাই মৃত্যুকে সঙ্গী করেই সে এসেছিল।

    সেদিন রাতের অন্ধকারে দুর্গের পশ্চিমের দ্বার খুলেছিল ঠিক সেই সময় যখন গুলরোখ উত্তরের দ্বারে। রাজা চন্দ্রসুধর্ম্ম ছিলেন গুলরোখের অপেক্ষায়। তাই কারো নজরে আসেনি শাহাজাদা অন্যপথে পাড়ি দেয় তার স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে। কুয়াশার মায়াজালে আচ্ছন্ন রইলো ইতিহাসের একটা অধ্যায়। তারপর কী হয়েছিল তা ইতিহাস নিরুত্তর, কোথাও বর্ণিত আছে আওরঙ্গজেব পুত্র মোহম্মদই শাহজাদা সুজাকে সাহায্য করেছিলেন সেদিন। গুলরোখের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন মোহাম্মদ। কিন্তু সেই ইতিহাস হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।

-সমাপ্ত

 Dipanwita DeyRay