পিউ ভট্টাচার্য্য মুখার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
পিউ ভট্টাচার্য্য মুখার্জী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আলোর ব্যাপারী - পিউ ভট্টাচার্য্য মুখার্জী

আলোর ব্যাপারী 

পিউ ভট্টাচার্য্য মুখার্জী




 
 

ঘরটা কাঁপিয়ে ঠিক ভোর পাঁচটায় ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো অ্যালার্মটা। আর ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ইন্দু। তারপর এক সেকেন্ড গোল গোল চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এক চড় মেরে বন্ধ করে দিলো অ্যালার্মটা। কাওকে শুনতে দেওয়া যাবেনা এই শব্দ। আজ মহালয়া, বাড়ির সবাই একজোট হয়ে রেডিওতে মহালয়া শুনছে। ও বলেই শুয়েছিলো, যে রাতে প্রচুর পড়া বাকি, সকালে ওকে না ডাকতে। তাই কেউ এখন ওর এই জেগে যাওয়াটা জানতে পারলেই মহাবিপদ! সব ভেস্তে যাবে তাহলে!
 
তারপর আরও ঠিক দশ মিনিট, ঠিক দশ মিনিটের মাথাতেই ধপ করে একটা ব্যাগ ইন্দুদের বাড়ির পাঁচিল টপকে গিয়ে পড়লো বড় রাস্তায়। তারপর সবার নজর এড়িয়ে ,ভোরের আধা আলো-অন্ধকারে ,নিজে প্রথমে পাঁচিলে উঠে , তারপর সেটা ডিঙিয়ে ঝপ করে এক লাফ মেরে ইন্দু রাস্তায় পড়েই ব্যাগটা কাঁধে তুলে একবার এদিক ওদিক দেখেই দিলো ছুট! ছ’টা কুড়ির ট্রেন, স্টেশনে পৌঁছতেই হবে তার আগে!
………………………
 
ইন্দু, ইন্দ্রাণী সেন। শহরতলির এক প্রতিপত্তিশালী ব্যাবসায়ীর একমাত্র মেয়ে। ইতিহাসে স্নাতকত্তর স্তরের ছাত্রী, ভবিষ্যতে  পি.এইচ.ডি. করার ইছে আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত তার আলাদা ভালোলাগার বিষয়। এমনিতে স্বভাবের দিক থেকে খুবই মিশুকে, দুরন্ত আর পরপোকারী একটি মেয়ে, কিন্তু,
 
সমস্যা একটাই, ওর পরিবার। একটি অত্যন্ত গোঁড়া , সাবেকি এবং দাম্ভিক পরিবারের মেয়ে ইন্দ্রাণী। এবং বিষয়টি নিয়ে ওর সাথে ওর পরিবারের, বিশেষ করে ওর বাবার সারাজীবনের সমস্যা, দূরত্ব। ইন্দু খুব সাধারণ, মাটির সাথে মিশে থাকা একজন মানুষ। সেখানে ওর পরিবার তততাই দেখনদারীতে বিশ্বাসী। সেই নিয়ে নিত্যদিন ওই বাড়ীতে একটা অশান্তি লেগেই থাকে। এই তো কিছুদিন আগেই, ইন্দু গিয়েছিলো ওর ইউনিভার্সিটি থেকে মুর্শিদাবাদে, এডুকেশনল এক্সকারশনে। সেখানে গিয়ে ও বিষ্ণুপুরের একটি পোড়ামাটির শিল্পী মহিলার কুটিরে তাঁর সাথে একরাত কাটিয়েছিলো বলে বাড়ী ফিরে সেই নিয়ে কি ধুন্ধুমার কান্ড! বাবা তো শুরুই করলেন যুক্তিহীন এক কথা দিয়ে –

  • তুমি সম্রাট সেনের মেয়ে, সে কথা আদৌ মনে আছে তোমার?
  • ভুলে যাবার কোন উপায় আছে বাবা?
  • চুপ করো, বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার! তোমার এতটুকু রুচিতে বাধলোনা, ওই নীচুজাতের মানুষগুলোর সাথে থেকে খেয়ে আসতে? ইশশ! আমার তো ভেবেই গা ঘিন ঘিন করছে!
  • নীচুজাত? তা তোমার কাজের ঘরের দেওয়ালে তো একটা বিশাল বড় সাঁওতালি দম্পতির মাটির মুখ-জোড়া টাঙিয়ে রেখেছো বাবা, ওই মূর্তিগুলোও তো তারমানে নীচুজাতের। রেখেছো কেনো?
  • চোপ! এত মুখে মুখে কথা বলতে কোত্থেকে শিখছো? বিভিন্ন ছোটলোকদের সাথে মিশে মিশেই বোধহয়?
এরপরে আর কোন কথা বাড়ায়নি ইন্দু। কার সাথেই বা বলবে কথা? এই বাড়িতে কেউ বুঝবেনা ওর অনুভূতিগুলো। কেউ বুঝবেনা, যে যখন সেবারে বিষ্ণুপুরে গিয়ে ওদের ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো, আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে গিয়েছিলো বলে হোটেলে ফেরা সম্ভব হয়নি, তখন ওদের সাথের গাইড ভদ্রলোক কত যত্ন করে ওদের সবাইকে ওঁর মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এসে ওখানেই রাতটা কাটিয়ে দিতে বলেছিলেন। এই বাড়ির কেউ বুঝবেনা, যে ওই ভদ্রমহিলা সেইরাতে এদের সবার খাবার জোগার করতে গিয়ে নিজে সম্পূর্ণ না খেয়ে রাতে শুয়ে পড়েছিলেন, ইন্দু সেটা নিজে চোখে দেখেছিলো। ভদ্রমহিলা একচোখে একদম দেখতে পান না, আরেক চোখে একদম ঝাপসা দেখেন, তাই নিয়েও অহর্নিশি পরিশ্রম করে পোড়ামাটির মূর্তি বানান, তারপর সেগুলো হাটে বেচে নিজের আটবছরের মেয়েকে নিয়ে কোনরকমে সংসার চালান। আর এতকিছুর পরও সেবারে পরেরদিন সকালে ওঁর কুটির থেকে চলে আসার সময় ইন্দুরা যখন ভদ্রমহিলার হাতে একহাজার টাকা তুলে দিতে যান, ভদ্রমহিলা কিছুতেই তা নেন না, অকপটে উত্তর দেন  -
  •  ট্যাকা দেতেছো দিদিভাই? ও মা গো, তা তোমাদিগের ঘরে হঠাত কইরা অতিথি আইলে তোমরা বুজি তাদের থিকা ট্যাকা নাও?
এই কথার পর আর টাকা দেওয়া যায়না। শুধু যেটা দেওয়া যায়, তা হলো বুক ভরে ভালোবাসা, এক মুঠো অনুভূতি, আর এক আকাশ ভালোলাগার হাসি। আর সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যায় অনেকটা খাঁটি আন্তরিকতার রেশ। ইন্দু অবশ্য সেই রেশের খানিকটা ফেরতও দিয়ে এসেছে ওই কঙ্কাবতী নামের মহিলাকে। আসার আগে ওঁকে জাপটে ধরে ভীষণ জোরে ওঁর গালে একটা চুমু খেয়ে এসেছে। তাতে আবার ওই মহিলা কেমন যেন থম মেরেও গিয়েছিলেন, হাঁ করে ইন্দুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তারপর বলেছিলেন, -
  • তুমি কে গা মা? কোত্থেকে আইছো? এই পোড়া জেবনে এমন শীতল জল ঢালতাছো ক্যান? এরপর যে কষ্ট হবে বেশি গো। তোমরা বরং এইবার এইসো। দুগগা দুগগা!
তারপর চলে এসেছিলো ইন্দুরা। এবার এইসব কিকরে বোঝাবে ও ওর বাবাকে, যে কেন ও এইসব ‘নীচুজাত’এর মানুষদের সাথে মেশে? আর শুধু বাবা কেনো? সেদিন ওইদলে ওর বয়ফ্রেন্ডও ছিলো, অনীক। সেও তো রিতীমত চোটপাট করছিলো তারপরে ইন্দুর সাথে। কি দরকার ওদের সাথে এত আদিখ্যেতা করবার? ওরা নাকি রোজ স্নান করেনা, গায়ে গন্ধ, কত ভাইরাল স্কিন ডিজিজ থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইন্দু সেসবে কোন উত্তর দেয়নি, চুপ করে শুধু ভাবছিলো, ও চলে আসার সময় কঙ্কাবতীর ওই রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার মুখে, কোটরে ঢোকা দুটো ঘোলা চোখের ছলছলে জলটা! আর বুকটা মোচর দিয়ে আসছিলো ওর!
………………………
 
ক্যাঁচ করে শব্দ করে জীপটা থামতেই সম্বিৎ ফিরে পেলো ইন্দু! এতক্ষণ এইসব ভাবতে ভাবতে ও খেয়ালই করেনি, যে কখন এতটা সময় কেটে গেছে। ড্রাইভার হাঁকতেই তড়িঘড়ি নামলো ও জীপ থেকে, তারপর গাড়ির ছাদ থেকে নিজের ব্যাগটা নামিয়ে কাঁধে নিতেই গাড়িটা চলে গেলো। আর ও, মুখ ঘুরিয়ে দেখলো সামনের দিকে। কতদিন পরে আবার, কঙ্কাবতীর গ্রাম!
 
আসলে মাঝে মাঝেই ও খোঁজ রাখতো ফোনে কঙ্কাবতীর। দুদিন আগে শুনেছে, যে কঙ্কাবতী না কি একদমই কোন চোখে দেখতে পাচ্ছেনা। সম্পূর্ণ অন্ধ। তাই ওঁর রুজিরুটিও বন্ধ। এইদিকে এখন ট্যুরিস্ট সীজন থাকায় ওর বাবা কিছু টাকা দিয়ে ওকে সাহায্য করতে পারলেও, সময় একদমই দিতে পারছেননা। এইসব শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি ইন্দু। ছুটে এসেছে। আর আসার আগে, মা কে উদ্দেশ্য করে নিজের ঘরে একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছে, -
“ মা, বেশিদিন নয়, মাত্র আট-দশদিনের জন্য একটু যাচ্ছি আমি। বাবাকে বলবে যেন থানা পুলিশ না করে। খুব দূরে যাচ্ছিনা। আর কারও সাথে পালাচ্ছিওনা। অনীক নির্ঘাত আমার খোঁজ করতে বাড়ীতে আসবে, ও আমার বয়ফ্রেন্ড, সেটাও তোমরা জানতে না, তাই ফিরে ওটা নিয়েও একটা হল্লা হবে বাড়িতে জানি। আর অনীককে বলবে আমাকে দিনে একশোবার ফোনে ট্রাই করার কোন দরকার নেই। আমার ফোন বন্ধ থাকবে। আমি ফিরে আসবো, দশমীর আগেই। সাবধানে থেকো। ইন্দু।“  
………………………
 
এরপর ষষ্ঠীর দিন সকাল –
চারিদিকে পুজো পুজো রব। দেবীর বোধন আছে আজ। মন্ডপে মন্ডপে চলছে চক্ষুদান পর্ব। কিন্তু, ওইদিকে সেনবাড়িতে সবকিছু খুব চুপচাপ। কারণ বাড়ির কুলাঙ্গার মেয়ে ইন্দু উধাও। ওর কথামতই থানা-পুলিশ কিছু করেননি সম্রাট সেন। অবশ্য তাতে কিছুটা নিজের মানরক্ষার তাগিদও আছে বটে। পাড়া-প্রতিবেশীকে বলা হয়েছে, যে ও আবার ওর ইউনিভার্সিটি থেকে কোথাও পড়াশোনার ট্যুরে গেছে।
 
এরপর বেলা তখন বারোটা। ইন্দুর মা তখন ওদের বাড়ির সদর দরজার সামনে তুলসী গাছে জল দিচ্ছেন, এমন সময় ঠং করে দরজাটা খোলার আওয়াজ হলো। আর সঙ্গে সঙ্গে উনি তাকালেন দরজার দিকে। আর তক্ষুনি , ওঁর হাত থেকে ঠকাস করে গঙ্গাজলের ঘটিটা মাটিতে পড়েই গড়িয়ে গেলো অন্য দিকে! আর উনি চিৎকার করে উঠলেন, “ইন্দু! এ কি হয়েছে তোর !!”
 
ওইদিকে বিষ্ণুপুরের এক হাসপাতালে, চেয়ারে দুদিকের দুই হাতলে দুহাত রেখে সোজা হয়ে বসে আছেন কঙ্কাবতী। ডাক্তার আসতে আসতে ওর চোখের পট্টীটা খুলে ফেলছেন। আর জিজ্ঞেস করছেন, “প্রথমে কাকে দেখতে চান?” কঙ্কাবতীর তাতে সোজা-সাপটা উত্তর – “আজ্ঞে, যারে দেখতে সাই, সে তো এহন এহেনে নাই ডাক্তারবাবু। বাড়ি সলে গিসে।“
 
এইদিকে বাড়ির সদর দরজা থেকে আস্তে আস্তে গুটি গুটি পায়ে বাড়িতে ঢোকার জন্য এগোচ্ছে ইন্দু। তার এক চোখে এখনও ব্যান্ডেজ করা, সাথে কালো চশমা, হাতে একটা লাঠি। শান্ত অথচ ভীষণ কঠিন গলায় মা কে শুধু উত্তরে বললো, “চিন্তা কোরোনা মা, একটা চোখ একদম ঠিক আছে এখনও। দিন দশেকের মধ্যেই একদম বিন্দাস হয়ে যাবো।“
মা তাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, বললেন, “আজ ষষ্ঠীর দিন, লোকের ঘরে কত আনন্দ, তুমি আমার এ কি সব্বোনাশ করলে ঠাকুর?”
 
“আজ ষষ্ঠীর দিন, কত আনন্দ, চক্ষুদান হলো মায়ের, গাঁয়ের দুগগাতলায় যাবি তো কঙ্কা?” ওইদিকে ও চোখে আবার দেখতে পাওয়ায়, আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রশ্নটা করে ফেললেন কঙ্কাবতীর এক প্রতিবেশিনী। উত্তরে অবশ্য কঙ্কাবতী বললেন, “নাহ! শুধু বাড়িই যাবো। কতবার দেখবো ঠাকুর?”
  • ও মা, এইবারে একখানও ঠাকুর দেখলি কই? হাসপাতালেই তো সিলি। - বললেন ওই মহিলা।
 
সবশেষে, ওর এই কথাটার উত্তরে, কঙ্কাবতী তার চেয়ারের হাতলগুলো শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, -
  • ওই ঠাকুরও তো এই হাসপাতালেই সেলো। এহন এই আমার সোক্ষুতে আসে! যাবার আগে আবার আমারে দু-গালে দুইটা সুমা দে গ্যাসে! ইন্দু দিদিমনি! ইন্দু দিদিমনি!
 
 
--সমাপ্ত--
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি