জয়ন্ত দে লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জয়ন্ত দে লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

এই ভালো বাসা বাসি - জয়ন্ত দে

 

এই ভালো বাসা বাসি

জয়ন্ত দে


 

 

আনন্দী হাঁটতে পারে না। আনন্দীর পা কখনও মাটিতে পড়ে না। সারাদিন ও হুইলচেয়ারের চাকায় চাকায় ঘোরে। ঘর থেকে  উঠোন। উঠোন থেকে বাগান। যেমনভাবে চলকে যাওয়া জল আপনা হতে গড়িয়ে যায়, ঠিক তেমনভাবে। যেমনভাবে বুনো ফুলের গন্ধ বাতাসের ডানায়, হাওয়ার পাখায় চড়ে ঘোরে, ঠিক তেমনভাবেই আনন্দীর এই বাড়ির ভেতর ঘোরে।

এই বাড়িটা দুর্গের মতো।

তবে এ-বাড়ির গেটে প্রহরী নেই। মানা আছে। বারণ আছে। তাই কেউ ঢোকে না। সবাই গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। পিন্টুও দাঁড়ায়।

মিসেস রাও যদি পারমিশন দেন, তখন লোহার বিশাল গেট খুলে ঢুকে পড়া যায়। জগদম্বা যদি হাতছানি দিয়ে বলে— কাম। তখন ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু আমাকে মিসেস রাও, জগদম্বা পুরো পারমিশান দিয়েই রেখেছে। তাই আমি যখন খুশি, যেমন খুশি এ বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। বাগান পেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকতে পারি— আনন্দী! আনন্দী!

আমার ডাকে আনন্দী সাড়া দেয় না। আমি অপেক্ষা করি। আবার ডাকি। আনন্দী! আমার সামনে ক্রমশ জলছবির মতো একটু একটু করে ফুটে ওঠে আনন্দী। চাকায় চাকায় চলে এসে বারান্দার শেষ প্রান্তে থামে।

আনন্দী জলভ্রষ্ট মৎস্যকন্যা।

মৎস্যকন্যারা মাটির পৃথিবীতে হাঁটতে পারে না। ও একদিন গভীর সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে। তখন ওর গায়ে নুনগন্ধ ছিল। তখন ওর গায়ে সমুদ্রফেনার আলপনা ছিল। হাতে কোনও এক ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুল ছিল। এমনটি আমি দেখিনি, কিন্তু জানি। এমনটিই হওয়ার কথা। ওর মাথার চুল যখন ওড়ে তখন মনে হয় নীলতিমির ফোয়ারা!

পিন্টু দুচোখ গোল গোল করে বলল, ‘তাই! মৎস্যাকন্যাদের এমনই হয়!’

‘তাই তো হওয়ার কথা! এটাই স্বাভাবিক।’ আমি বললাম।

পিন্টু ফিসফিস করে বলল, ‘তুই জানলি কীভাবে? কে বলল তোকে।’

‘নাম বলা বারণ।’

‘বারণ!’

‘হ্যাঁ বারণ। তার নাম যদি বলি— মারাত্মক কিছু একটা হবে?’

‘কী হবে? ভষ্ম হয়ে যাবি।’

‘না, আমি নুনের পুতুলের মতো গলে যাব।’

‘একটু পরিষ্কার করে বল ভাই।’ পিন্টু আমার দিকে এগিয়ে আসে। ঘন হয়ে বসে।

আমি বলি, ‘ওর বাস —গভীর সমুদ্রে। আনন্দী মৎস্যকন্যা। শাপগ্রস্ত হয়ে, জলভ্রষ্ট হয়ে এই মাটির পৃথিবীতে এসেছে। তাই এই বাড়ি দুর্গের মতো তৈরি করা হয়েছে, ওকে রাখার জন্য। যতদিন ও মাটির পৃথিবীতে থাকবে ততদিন ও এই বাড়িতে থাকবে। তারপর সময় ফুরলে, শাপ মুক্ত হয়ে সমুদ্রে ফিরে যাবে।’

পিন্টু আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে। বুঝে পায় না কী বলবে, কী বলা উচিত? পিন্টু ফিসফিস করে ‘আনন্দী শাপগ্রস্ত, আনন্দী জলভ্রষ্ট! ও যদি শাপমুক্ত হয়ে ফিরে যায় ভালোই হবে বল ভাই!’

আমি হ্যাঁ, না কোনও উত্তর দিই না।

পিন্টু দুচোখ ছল ছল করে, আকুল হয়ে বলে, ‘তখন আর আনন্দী আমাদের বন্ধু থাকবে না। আমরা আর ওকে দেখতে পাব না।’

পিন্টু কথায় আমি অন্যদিকে তাকালাম।

পিন্টু বলল, ‘আমি শুনেছি, পড়েওছি— খুব ভালোবাসলে ওরা এখানে এসে আটকে পড়ে। ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে, আর যেতে পারে না। হ্যাঁ রে, আনন্দীকে কি কেউ তেমন করে ভালোবাসে না...। কেউ ভালোবাসে না!’

আমি পিন্টুর কথায় ঠোঁট টিপে থাকি।

আনন্দী আমার প্রেমিকা নয়। কিন্তু প্রেমিকা হতেই পারত। আমি কতদিন কন্যাদিঘির নির্জনতায় চিৎকার করে বলেছি— আনন্দী আমি তোমাকে ভালোবাসি।

কিন্তু কোনওদিন আনন্দীকে ওর সামনে এসে একথাটা বলতে পারিনি। মনে হয় আমি পাপ করেছি। পিন্টু হয়তো ঠিক কথাই বলছে, ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেওয়া খুউব খুউব দরকার ছিল।

পিন্টু ফিসফিস করল, ‘কেন ওকে কেউ ভালোবাসে না?’

আমি বলতে পারি না, আমি ভালোবাসি।

পিন্টু বলে, ‘ওকে সবাই খোঁড়া মেয়ে বলে। ওর দু পা নাকি দুর্বল!’

আমি চুপ করে থাকি।

‘আচ্ছা রক্ত দেওয়া যায়, চোখ দেওয়া যায়, কিডনি দেওয়া যায়, আচ্ছা কাউকে পা দেওয়া যায় না?’

‘কী জানি, যায় হয়তো? কিন্তু কে দেবে তার দুটো পা! আর দিলেই কি আনন্দী নেবে? ওর তো পায়ের দরকার নেই। ওর চাকা আছে। ও তো চাকায় চাকায় ঘোরে।’

পিন্টু বলে, ‘সবাই ভাবে ওর পা নেই। ভাই আমি দেখেছি—ওর পায়ের পাতা  খুব সুন্দর। যেন শালুকপাতা! সবাই ভাবে, ও হাঁটতে পারে না, খোঁড়া!’

আমি বলি, ‘আসলে কেউ তো জানে না ও মৎস্যকন্যা, ও হাঁটবে কেন, ও তো ভেসে ভেসে সমুদ্র যাবে।’

‘না আমরা ওকে সমুদ্রে যেতে দেব না।’ পিন্টু বলে।

পিন্টু উঠে দাঁড়ায়, বাতাসে দু’হাত ছড়িয়ে বলে, ‘আমরা ভালোবাসার বাঁধ দেব। পারব না? কী রে পারব না? আমরা দুজন মিলে ওকে যদি খুব ভালোবাসি... কেমন হবে?’

আমি স্থির চোখে পিন্টুকে দেখি। পিন্টু কী স্পষ্ট গলায় ভালোবাসার কথা জানাতে পারল, তবে আমি কেন এমন করে ভালোবাসার কথা বলতে পারি না? বলতে পারি না—আনন্দী আমি তোমাকে ভালোবাসি!

আমার তো পারমিশন আছে, ওদের বাড়িতে যাওয়ার। আমার তো পারমিশন আছে ওদের এঘরে ওঘরে ঘুরে বেড়ানোর।  শুধু ওদের পাশের বাড়ি ছেলে বলে নয়, প্রতিবেশী বলে নয়, ওরা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে বাবা বলে ডাকে। তবে আমি কেন এমন করে থমকে থাকি? তবে আমি কি অতটা ভালোবাসতে পারিনি? হঠাৎ আমি উঠে দাঁড়াই। তারপর চিৎকার করে বলি—আনন্দী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে সঙ্গে পিন্টুও চিৎকার করে—আনন্দী আমি তোমাকে ভালোবাসি।

.............................


অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার