উখিমঠ দর্শন
ডঃ রবীন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক
স্কন্দপুরাণের
অন্তর্গত কেদারখণ্ডকে মান্ধাতাক্ষেত্র বলা হয়। কথিত আছে সূর্যবংশীয় রাজা
'মান্ধাতা' সিদ্ধিলাভের জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বহুবছর তপস্যার
পর স্বয়ং ভগবান কেদারেশ্বর শিব 'ওঙ্কারেশ্বর'রূপে তাকে দর্শন দেন। সেই
থেকে বর্তমান "ওংকারেশ্বর " উখিমঠ কেদারখন্ডের শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান রূপে
পরিচিত হয়। এরপর ত্রেতা যুগে রাজা মান্ধাতার বংশজ রাজা অতি সুন্দর ভাবে
ওংকারেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে এখানে পঞ্চ কেদারের পূজা হয়
বারোমাস।
রাজা মান্ধাতার বংশজ গাড়োয়াল রাজের
সহযোগিতায় এখানে শৈব ধর্মাবলম্বী সুযোগ্য পুজারী দ্বারা পুজো আরম্ভ
করেন। বিভিন্ন পুস্তকের হিসাব অনুযায়ী এর স্থাপনকাল অবশ্যই দ্বাপর যুগের
কোন এক সময় হয়েছিল।সেই অনুসারে কেদারনাথের পূজা প্রায় পাঁচহাজার বছর
পূর্বে। এখানকার প্রথম রাউল বলা হয় 'শ্রী ভুকুন্ঠ ভৈরব'কে।
ভগবান
শঙ্করকে কৈলাস পর্বত বলা হয়।এখন কথা হচ্ছে কৈলাস কোথায় অবস্থিত? কিছু
মানুষের ধারণা মানস সরোবরই হলো কৈলাস। এর মধ্যে কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু
শুধু মানস সরোবরই কৈলাস নয়,কৈলাসের প্রারম্ভ মাত্র। মানস সরোবর থেকে প্রায়
দেবপ্রয়াগ অর্থাৎ সম্পূর্ণ কেদারখণ্ড এই কৈলাসের অন্তর্গত।বর্তমান
উখীমঠের অন্তর্গত পঞ্চ কেদারের এক কেদার তুঙ্গনাথে বহু তীর্থ যাত্রী
যাতায়াত করেন। সেখান থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে অবস্থিত চন্দ্রশিলা।চন্দ্র
শিলা থেকে কৈলাস সম্পূর্ণরূপে দর্শন করা যায়। গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী এই
দুই ধাম কৈলাসের অন্তর্গত।
স্কন্দপুরাণের বর্ণনানুযায়ী কেদারখণ্ড সীমা হলো হরিদ্বারের উত্তর থেকে
শিবালিক
পর্বতমালা হতে মানস সরোবর ৫০ যোজন লম্বা এবং তমসা থেকে বোদ্ধাঞ্চল
পর্যন্ত ৩০যোজন চওড়া। বর্তমান নামের সাথে সব কিছুর নামের পরিবর্তন হয়েছে।
তবে এটা সত্য যে উত্তরাখণ্ডের পাঁচধাম অবশ্যই কেদারখন্ডে অবস্থিত এবং
কৈলাসের অন্তর্গত।
এক যোজন অর্থাৎ চার ক্রোশ বা ৮ মাইল। এই হিসাব অনুযায়ী ক্লাসের ব্যাপ্তি চারশো মাইল লম্বা ও দুশো চল্লিশ মাইল চওড়া।
উখীমঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে দৃষ্টিগোচর হয় সার বেঁধে দৃশ্যমান কেদারনাথ, মন্দাকিনী,সুমেরু,চোখাম্বা,ভা তৃঘুন্টা এছাড়া বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থিত দেওরিয়া তাল,বালেক,কালিমঠ,ত্রিযুগী নারায়ণ,গুপ্ত কাশী। এগুলি অপূর্ব দর্শনীয় স্থান।
উখিমঠ
যেতে হলে হাওড়া থেকে উপাসনা বা দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার পৌঁছাতে হবে।
স্টেশনের কাছে গিয়ে জি. এম. ও বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে বা মোটর আড্ডা থেকে
গাড়ি বুক করে একে একে ঋষিকেশ-দেবপ্রয়াগ, শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ,
অগস্ত্য মুনি পার হয়ে পথে মন্দাকিনী আর অলকানন্দাকে সাথী করে পৌঁছাতে হবে
উখীমঠ। উখিমঠ ছোট গঞ্জ বেশী ভীড় নেই। তাই আপাত নিরিবিলি আর নির্ঝঞ্ঝাট
জায়গা। উখিমঠ থেকে ছোট রাস্তার নিকটে বহু প্রাচীন সেই ওংকারেশ্বর মন্দির।
মন্দির থেকে বরফে ঢাকা পাহাড় আর মন্দাকিনী নজরে আসে। শোনা যায় পুরাকালে
মহারাজ মান্ধাতা তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন এই উখীমঠে, তারপর
সেখানে শুরু করেন শিবের নামগান ও কঠোর তপস্যা। তপস্যায় তুষ্ট মহাদেব
মান্ধাতার প্রার্থনা অনুসারে বর দেন। কথিত আছে উখিমঠ দর্শন করলেই সমস্ত
কেদারখন্ড দর্শনের পুণ্য পাওয়া যাবে। কারণ এই উখিমঠেই বছরের অর্ধ সময়
নিয়মানুবর্তে পূজা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে অক্ষয়তৃতীয়ার পূণ্যলগ্ন থেকে
ভাতৃদ্বিতীয়া পর্যন্ত পঞ্চকেদারের পূজা যথাস্থানে হয়।এরপর শীতে সমস্তকিছু
বরফাচ্ছাদিত হয়ে পড়লে পঞ্চ কেদারের পূজা সম্ভবপর হয় না, তখন সেই দেবতাদের
পূজা উখিমঠে হয়ে থাকে। বর্ষা ছাড়া উখিমঠে যেকোনো সময় যাওয়া যায়। শুধু
মাত্র বর্ণনা দিয়ে উখিমঠ এর সৌন্দর্য কল্পনা করা যাবে না, দর্শন করে এর
সৌন্দর্য অনুধাবন করতে হবে যা অবর্ণনীয় ও অকল্পনীয়। যারা ভগবানে বিশ্বাস
করেন না তারাও প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হবেন কারণ প্রকৃতি দ্বারা এই
সৌন্দর্য ভারতের সুইজারল্যান্ড বলে মনে হবে।
................................