জঠর শরিক - সৌভিক দাস

জঠর শরিক
সৌভিক দাস

 



 

নভেম্বর ২০১৯

 

ডক্টর গাঙ্গুলি রিপোর্ট হাতে হতবাক হয়ে বসে রইলেন। চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে মুঠোয় ধরলেন থুতনি। লুপ্তপ্রায় মডেলের অতিবক্তা এসির আওয়াজ আর দুই ডাক্তারের ঊর্দ্ধগতি হৃদস্পন্দন ব্যতীত ঘরে শব্দ হলো শূন্যি।
 
‘উই আর রুইন্‌ড।’ কপালের ঘাম মোছা শেষ হলে, ডঃ শর্মা নৈশব্দ ভঙ্গ করলেন।

‘এরকম একটা বিরলস্য বিরল ঘটনা ঘটে যাবে, কে জানত? চিকিৎসাশাস্ত্র দিয়ে তো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারিনি। এবার মনে হয় অ্যাস্ট্রলজি শিখতে হবে!’ ডঃ গাঙ্গুলি রাকঢাক ছাড়াই রাগ দেখালেন।

‘এটা বিধাতার পোয়েটিক জাস্টিস!’

‘কোন অন্যায়ের পোয়েটিক জাস্টিস? সরকার নতুন আইন এনেছে পনেরই জুলাই আর আমাদের কেসটা …’

‘জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে শুরু করেছি। তাই সম্পূর্ণ বেআইনি।’

‘এক সপ্তাহের মধ্যে আইন বলবৎ হয় না। … হতেও পারে। … মানে আমি নিশ্চিত নই। … কিন্তু আপনি যে এখন যাত্রাপালার বিবেকের পার্ট করছেন, সেদিন কোথায় ছিল আপনার বিবেক? আমার সায়ে সায় মেলাননি?’

‘ভুল করেছিলাম। এখন কথা না বাড়িয়ে উপায় বার করুন। জলঘোলা হলে, নামের আগে দুটো অক্ষর খুইয়ে হিমঘরে পাঁচ বছর কাটাতে হবে আমাদের।’ ডঃ শর্মা সাবধান করলেন।

‘আমাদের নয় ... আপনাকে। ক্যাশ না নিয়ে চেক নিয়েছেন “আপনি”!’ ক্রুর হাসলেন ডঃ গাঙ্গুলি।

‘সমস্ত প্রেসক্রিপশনে সই আপনার, বাঙ্গালী বাবু!’ ঠোঁটের ওপর সিগ্রেট নাচিয়ে বললেন ডঃ শর্মা। হাসি নামের ফড়িঙটা এবার ডঃ শর্মার ঠোঁটে গিয়ে বসল।
 

এই কথোপকথনের ছ’ মাস আগে

 
জুতোটা খুলে দাঁত বার করা সুকতলার দিকে তাকিয়ে সুখদেব বলল, ‘সব সময় দাঁত বার করে হাসতে হবে না কি? বলছি তো কিছু হয় নি। মাথাটা একটু টিপটিপ করছে। অন্ধকারে খানিক শুলে ঠিক হয়ে যাবে। কিসনকে সব্জি আনতে পাঠিয়ে দে।’

‘উঁ মেজাজ দেখাচ্ছে! মেজাজ তো আমার খারাপ হওয়ার কথা। মে মাস হয়ে এল। দাঁড় করান পাখাটা কবে আসবে? দুপুরের তাতটা তো তোকে সহ্য করতে হয় না।’ চায়ের জল চাপিয়ে অ্যাসবেস্টস চালের দিকে তাকিয়ে, আঁচল দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বলল কাজল।

কাঁধে গামছা ফেলে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সুখদেব বলল, ‘তোর কি মনে হয় বিল্ডিঙের বাবুরা বসে গেট আগলায়, আর আমি ওদের বিছানায় শুয়ে এসির হাওয়া খাই? মে মাসের দুপুরে গার্ড রুমে একদিন বসে দেখ না। তুই চিল্লাতে থাক, আমি চান সেরে আসি।’ পাড়ার টিউবওয়েলের দিকে এগিয়ে গেল সুখদেব। এ বস্তিতে কারো ঘরে এসি নেই, বহু ঘরে পাখাও নেই, গা জুড়নোর জন্য এই সার্বজনীন টিউবওয়েল আছে। খুব স্বাভাবিক কারণে সেটাও জেন্ডার বায়াস মুক্ত নয়।
 
রাতে কিসনের মাথায় হাত বুলিয়ে সুখদেব দেখল ছেলে ঘুমিয়ে কাদা। বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে কাজলের মাদুরে এসে বসল, ‘মা হবি?’

চোখে ঘুম লেগে এসেছিল কাজলের। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল, ‘মাধবী? কে মাধবী?’

‘ধুর! মাধবী নয়। জিজ্ঞেস করছিলাম, মা হবি?’

কাজল আড়চোখে একবার দেখে নিল সুখদেবের লুঙ্গিটা যথাস্থানে আছে কি না। তারপর ধ্যাতানি দিল, ‘আবার মাল খাওয়া ধরেছিস?’

‘আমার সন্তানের মা নয়। অন্যের।’

‘ঝাঁটাটা কোথায় গেল?’

‘পাখা চাই? চাইলে এসিও পাবি। ছেলেকে পেরাইভেট ইংরিজি স্কুলে পড়াতে পারবি।’

‘নিকুচি করেছে পাখার। তুই এত নিচে নামলি শেষকালে। ছি! ছি! শালা রাতের বেলা সোহাগ করে কাছে ডেকে বলছে বউ বেচে খাবে! তুই মরদ না দালাল?’
 
রাতের মাদুর থেকে আনন্দ্‌ শহরের ঊষা প্রজনন কেন্দ্রে কাজলকে নিয়ে যেতে আরো দুদিন লেগে গেল সুখদেবের। সারোগেসি মাতৃত্ব ব্যাপারটা বোঝাতে ডাক্তার ম্যাডামের লাগল আরো এক সপ্তাহ। নারী শরীরে কি করে মাতৃত্বের বীজ বপন হয়, সেটা অনেক ভ্রান্ত ধারণার পর্বত ডিঙ্গিয়ে বারো ক্লাসে পৌঁছে বুঝেছিল কাজল। দশ ক্লাসে পড়ার সময় দশেরার দুপুরে পাড়ার শারুখ-চুলো জিতেন্দ্রর সঙ্গে যে ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেছিল, সেটা বুঝতে পেরে সেদিন শিউড়ে উঠেছিল সে। আজ ডাক্তার ম্যাডামের কথা শুনে মনে হলো, জীবনে এতো জটিলতা আনার জন্য সুখদেবকে বাড়ি ফিরে আচ্ছা করে ঠ্যাঙ্গাই। কিন্তু চার লাখ টাকার অঙ্কটা চিন্তাভাবনার ডিম্বাশয়ে স্বপ্নের ভ্রূণ স্থাপন করে দিল।

‘অন্য মরদের সঙ্গে শুতে হবে না তো?’ বারবার জিজ্ঞেস করছে কাজল আর সুখদেব বারবার বোঝাচ্ছে, ‘না রে বাবা! সব ইনজেকশনেই হবে।’ ইনজেকশনটা কতটা মোটা হবে সেটা ভেবে দুশ্চিন্তায় ছিল কাজল। কিন্তু ডাক্তার ম্যাডাম একটা ভিডিও দেখিয়ে সব বুঝিয়ে দিলেন। একজন মনোবিদ দায়িত্ব নিলেন কাজলের সংস্কার সঙ্ক্রান্ত সমস্যার।
 
‘এতদিন সেন্টারে থাকব, ছেলেটাকে কে দেখবে?’

‘আমি আছি তো। শনিবার করে নিয়ে আসব।’

‘কিসান জিজ্ঞেস করবে না, মা বাড়ি থেকে দূরে কী করছে?’

‘বলব মা হৃতিক রোশনের সিন্‌মায় হিরোইনির পার্ট করছে।’

‘ধ্যাত! … আচ্ছা, ওরা বলছে আমায় ভালো ভালো খেতে দেবে - চাপাতি, ভাত, দাল, সব্জি। শনিবার করে কৌটো নিয়ে চলে আসবি? কিসনের জন্য সব পাঠিয়ে দেব … তোর জন্যও ... একা একা ভালো খাবার গলা দিয়ে নামবে না রে ...’ ধরে আসা গলা দিয়ে বাকি কথাটা উঠল না।

‘ন’মাসের জন্য তো সংসারে দুজন হয়ে যাব। কিসনকে ভালোমন্দ খাইয়ে রাখার দায়িত্ব আমার।’

ক্লিনিকের এসিটার দিকে তাকিয়ে কাজল বলল, ‘আমিও অনেকবার ভেবেছি। আমি চোখ বুজলে সংসারের হাল ফিরতে পারে। একজনের মাইনেতে তিনটে পেট ...’ আগের কথাটা বলা যে ঠিক হয়নি, সেটা বুঝে কাজলের কাঁধে হাত রাখল সুখদেব। ‘কিন্তু যেই মনে হয়েছে আমি গেলেই তুই আর একটা জুটিয়ে নিবি, অমনি মনে হয়েছে অমন মরার মুখে ঝাঁটা মারি।’ নিমপাতা খাওয়া মুখে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিল সুখদেব।
 
 

মে ২০১৯; বস্টন, আমেরিকা

 
ফার্টিলিটি ক্লিনিক থেকে ফিরে নিজের কম্প্যুটার টেবিলে নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করে বসল রোশনি। মেসেঞ্জারে অনেকে উঁকিঝুঁকি মারছিল। নিজের স্টেটাস ‘নট অ্যাভেলেবল’ করে তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। পাঁচ মিনিট ফাস্ট করে রাখা ঘড়িতে দেখাচ্ছে ন’টা বাজতে দশ। জানলার কাচে রোদ বিদায় জানাচ্ছে। ফোনটাকে বোবা বানিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। ঠোঁট কথা না বললেও মনটা তখনো ডাক্তারের সঙ্গে দরাদরি করে চলেছে।

‘সত্যিই আমি মা হতে পারবো না? কোনও উপায় নেই? এখন তো মেডিক্যাল সায়েন্স এতো প্রগ্রেস করেছে!’

‘চিকিৎসার বাঁদর উন্নতির বাঁশ বেয়ে যত ওপরে ওঠে, শরীরের নতুন নতুন সমস্যা সেই বাঁশে আচ্ছা করে তেল লাগায়। ডাক্তার হিসেবে আমার কাজ হলো ওষুধ দিয়ে তোমাকে বিনোদন জোগান, শরীর ঠিক করার কাজ সময়ই করে। এক্ষেত্রেও তুমি সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারো। হয়ত তোমার গর্ভাশয়ের সমস্যাটা তিনিই সারিয়ে দিলেন … কিন্তু ততদিন কতগুলো অ্যাবোরশনের ধকল নেবে? আর একবার মেনোপজ হয়ে গেলে, হাতে অপশান থাকবে একটাই … অ্যাডপ্‌শন … তাই যা বললাম ভেবে দেখো।’
 
স্রিনি ফ্রিজে খাবার তোলায় ব্যস্ত ছিল। মাঝপথে কাজ ফেলে রোশনির সামনে গিয়ে বসল।
‘Why don’t you see the brighter side of it? তুমি যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে ছ’মাস লিভে চলে যেতে, তোমার ক্যারিয়ারে কতটা প্রভাব পড়ত। কিন্তু এখন তোমার হাতে বিকল্প রইল। তুমি মা হোচ্ছ, but somebody else is becoming pregnant. তোমার ক্যারিয়ারে কোনও প্রভাবই পড়ছে না।’

‘আর মাতৃত্বের জার্নিটা?’

‘একটা ইউজলেস জার্নির জন্য নিজের ব্রাইট ক্যারিয়ার বরবাদ করবে?’

‘আমাকে একটু একলা থাকতে দাও।’ চোখটা বুজে কথাটা বলল রোশনি। রোশনির কাছে স্রিনি আজও অন্য গ্রহের মানুষ।
‘ও শিয়োর।’
স্রিনি দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রেড সক্স আর ইয়াঙ্কিজের সাইত্রিশ হাজার সমর্থক ভিড় জমাল বৈঠকখানায়। বন্ধ দরজা দিয়ে বারবার ভেসে আসতে লাগল বেসবল মাঠের হর্ষোল্লাস। রোশনি কানে হাত দিল।
 

জুন ২০১৯; আনন্দ্‌, গুজরাত

 

প্রসূতি সদনের আধুনিকতা দেখে মনটা অনেক হাল্কা লাগল রোশনির। এমনি এমনি আনন্দ্‌ শহরটাকে ভারতবর্ষের বেবি ফ্যাক্ট্রি বলা হয় না! ভ্রূণ সঞ্চয়ের ব্যবস্থা, কাজলের স্বাস্থ্য, সম্ভাব্য মায়েদের যত্নের যোগাড় - সব দেখেশুনে সারোগেসি আয়োজকের সঙ্গে চুক্তিপত্রে সই করে দিল। বস্টন থেকে স্রিনি আসতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সেমিনার থাকায়। একা হাতে সব সামলাতে পারবে কি না একটা শঙ্কা ছিল মনে। এ দেশে নিকটাত্মীয় বলতে কেউ নেই। তাই না চাইতেও প্রতিনিধি মাতৃত্বের জন্য পরিবার বহির্ভুত মহিলা এবং সব কিছু আয়োজনের জন্য নিজের দৌড়ঝাঁপটাই সম্বল হলো রোশনির।
 
‘রোশনি ম্যাডামের হাজব্যান্ডের সই আসতে দেরী হচ্ছে কেন?’ বেতার মাধ্যমে ডঃ শর্মার উৎকণ্ঠা ভেসে এলো।
‘চলে আসবে এক সপ্তাহের মধ্যে।’ ডঃ গাঙ্গুলি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।
‘১৫ তারিখ পার্লামেন্টে সারোগেসি বিল পাশ হলে, এই কেসটা তো হাতছাড়া হবেই, কমার্শিয়াল সারোগেসির ব্যবসা লাটে উঠবে। তার আগে যতটা পারা যায় কেস তুলুন বাজার থেকে।’
‘কেস তুলুন মানে! অলিতে গলিতে বড় বড় ছাতার তলায় টেবিল পেতে মাতৃত্ব ফেরি করে বেরাব না কি?’
 
সই-সাবুদ, প্রক্রিয়ার যোগাড়যন্ত্র, কাজলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আই ভি এফ কুরিয়ারের মাধ্যমে হিমায়িত ভ্রূণের আমেরিকা থেকে ভারতবর্ষে পদার্পণ আর কিসনের হাজার প্রশ্নের উত্তর পেড়িয়ে কাজলের শরীরে ভ্রূণ স্থাপন হলো জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে। কাজলের আয় হলো কিঞ্চিৎ কুমেরুমুখি আর রোশনির ব্যয় সুমেরুগামী; দুজনের গচ্চা আধিকারিকদের খচ্চাপানি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতরে।
সংসদে নতুন সারোগেসি আইন পাশ হয় ১৫ই জুলাই। মাতৃত্ব ট্যুরিজমের শিরোপা হারায় ভারতবর্ষ। সেই সঙ্গে বন্ধ হয় কেরায়া গর্ভ ঘিরে বন্ধ্যা বিবেকের কারবার। ভাড়াটে গর্ভধারিনীদের সংসার সাজানোর স্বপ্নগুলোও তাঁর সঙ্গে ভেঙ্গে তছনছ হয়। আর বিদেশী যেসব কাপলদের কাছে একমাত্র ভারতবর্ষের সুলভমূল্য সারোগেট মায়েরাই ছিল সামর্থ ও রুচির আওতায়, তাঁদের হয়ত ছোট্ট দুটো পায়ে টলমল হাঁটা দেখা হবে না আর কোনওদিন। বিদেশী মানেই বিল গেটস, এ ধারনা ভুল!
 

অক্টোবর ২০১৯; আনন্দ্‌, গুজরাত

 

সুখদেব ঝুঁকি না নিয়ে সঙ্গে উকিল নিয়ে এল ডঃ শর্মার আদি চেম্বারে। অবলুপ্তির মুখোশ দেখে কেউ বলবে না কয়েক মাস আগেও এ ঘরে মাসে কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে।
উকিল বাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘কিসের চুক্তিভঙ্গ? চুক্তিতে লেখা ছিল কাজলকে গর্ভবতী ঘোষণা না করা পর্যন্ত সুখদেব আর কাজলের মধ্যে দাম্পত্য নৈকট্যের অনুমতি নেই। আপনাদের রিপোর্টই বলছে কাজলের দ্বিতীয় গর্ভসঞ্চার প্রথমটি ঘোষণার পর। আমরা অন্য ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এরে কয় superfetation। অন্য প্রাণীদের মধ্যে ব্যাপারটা অতটা বিরল না হলেও, মনুষ্য সমাজে অতি বিরল। অর্থাৎ রোশনি দেবীর ভ্রূণ দ্বারা গর্ভবতী হওয়ার পরও কাজলের ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ হয় নি!’
‘কিন্তু রোশনি দেবীর পরিবার তো রিফান্ড দাবী করছেন। নয়ত আদালতে যাবেন ওঁরা।’ ডঃ গাঙ্গুলির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা স্পষ্ট।
‘সে আপনাদের আর রোশনি দেবীর ব্যাপার। সুখদেবের পাওনা আটকালে আমরা আদালতে যাব। আর ব্যাপারটা আদালত অবধি গড়ালে আপনাদের কি খুব একটা সুবিধে হবে?’
হঠাৎ নীরব হওয়া ঘরে নানান্‌ সম্ভাবনা, সুযোগ, বিপদ সকলের মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল।

উকিল বাবু নীরবতা ভঙ্গ করলেন, ‘আপনাদের তো মশাই Catch 22 অবস্থা। দুদিকেই আদালত। কিন্তু একটা ব্যাপার বলুন তো। পেটের দুই সন্তান যে দু জোড়া বাপ মায়ের, সেটা কীভাবে জানতে পারলেন?’

‘আমেরিকার যে ভ্রূণ ব্যাঙ্ক রোশনি দেবীর এম্‌ব্রায়ো হিমায়িত করার দায়িত্ব নেয়, সাম্প্রতিক অতীতে ভ্রূণ-ভ্রান্তির দায়ে তাদের কাঠগড়ায় তোলে এক ফিটজেরাল্ড দম্পতি। অন্য এক দম্পতির এম্‌ব্রায়ো ফিটজেরাল্ড দম্পতির বলে চালায় তারা। সেই সংবাদটি পড়ার পর মিঃ স্রিনি noninvasive prenatal DNA testing দাবী করেন। মায়ের রক্তে বাচ্চার ডি-এন-এর কিছু ফ্র্যাগ্‌মেন্ট যায়। সেটা টেস্ট করলে গর্ভস্থ বাচ্চার সঙ্গে মাতা পিতার ডি-এন-এ ম্যাচ করা যায়। স্রিনিবাবু নিশ্চিন্ত হতে চান, এ তাঁরই সন্তান। যমজ সন্তান ব্যাপারটা আগেই ধরা পড়েছিল। এবার ধরা পড়ল দুই সন্তান পৃথক দম্পতির। পালিত হচ্ছে একই মায়ের জঠরে। এক বিরলস্য বিরল ঘটনা।’ ডঃ শর্মা ব্যাখ্যা করলেন।

‘এতে স্রিনিবাবুর সমস্যাটা কোথায়?’

‘ওঁর মনে হচ্ছে পুষ্টি ভাগাভাগিতে এটা ওঁর সন্তানের সুষ্ঠু বৃদ্ধির পথে অন্তরায়।’

‘ডাক্তারি উপায়ে ওঁদের বুঝিয়েছেন।’

‘ডাক্তারি, মোক্তারি সব উপায়ে বুঝিয়েছি, মশাই। গোঁয়ার গোবিন্দ সেকেন্ড জেনেরেশন ‘দেসি’। উনি গর্ভপ্রক্রিয়া বন্ধ করতে চাইছেন, সঙ্গে রিফান্ড।’

‘মানুষ ঈশ্বর হয়ে গেল, অ্যাঁ। জীবন নিয়ে আসছি, ফ্রিজে রাখছি, জন্মের আগেই দুনিয়া ঘোরাচ্ছি, ইচ্ছে না হলে ফেলে দিচ্ছি!’ উকিল বাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলেন। ‘সে ওদের রিফান্ড করুন না করুন, আমার মক্কেলের টাকাটা ছাড়ুন। আপনাদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না।’

‘সবার মঙ্গলের জন্য উপায় একটা আছে। মিঃ স্রিনি তাতে রাজি হয়েছেন। এবার সুখদেব রাজি হলে কাজলের পারিশ্রমিক পাঁচ লাখে নিয়ে যেতে পারি।’ সস্তার দেওয়াল ঘড়িটা বলে উঠল ‘ঠিক, ঠিক’। 

 

নভেম্বর ২০১৯; কাজলের জঠর
 

দুগ্গা জিজ্ঞেস করল, ‘অপু চোখ খোল! আমায় দেখতে পাচ্ছিস?’
অপু চোখ খুলে তাকাল। অন্ধকার। কানের কাছে একটা টিপটিপ শব্দ। আর পায়ের তলায় লুব ডুব লুব ডুব। হঠাৎ কেমন যেন দোলা লাগল।
স্নেহসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে অপু বলল, ‘তুই কে?’
‘আমি তোর দিদিভাই রে!’
‘এতো অন্ধকারে তুই দেখতে পাচ্ছিস কী করে?!’
‘তোর এক সপ্তাহ আগে এসেছি, চোখ সয়ে গেছে।’
‘আরে … আরে … আরে … তোর বেলুনটা দিয়ে আমার বেলুনটাকে গুঁতোচ্ছিস কেন?’
‘এতটুকু ঘরে থাকব আর গুঁতোগুঁতি হবে না। এটাকে তুই বেলুন পেয়েছিস? এটাকে বলে amniotic sac।’ দুগ্গা উত্তর দিল।
‘শোন, এক সপ্তাহ বড় বলে দিদিগিরি ফলাসনি।’
‘শাট আপ। এখনও নাক টিপলে amniotic fluid বেরোয়! শুনে রাখ, যত বড় হব তত ধাক্কাধাক্কি বাড়বে।’

‘দিদিভাই, আমি ভাবছি বড় হব না। নল দিয়ে খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, জলের মধ্যে কেমন ভেসে বেড়াচ্ছি। এই বেশ ভালো আছি রে। এর বাইরেটা কী রকম কে জানে?’

‘অমনি করে বলে না। তোকে বড় হতে হবে। পেটের আদর ছেড়ে বেরিয়ে মায়ের কোলের আদর খাবি। কত্ত মজা হবে।’

‘বলছিস! আমার না আনন্দে ওঁয়া ওঁয়া করে ডাকতে ইচ্ছে করছে। তুইও যাবি তো? দুজনে খুব হাত পা ছুঁড়ে খেলা করব। এখানে হাত পা ছড়াতেই পারছি না।’

‘না রে অপু। শুনলাম ওরা বলছে দুজনকে বাইরে আনা সম্ভব নয়। তাই একজন যাবে আর অন্যজন যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যাবে। আমাকেই বোধহয় যেতে হবে রে।’

‘না না … কিছুতেই নয়। আমি তোকে ছাড়া কোত্থাও যাব না। তুই তোর বেলুনটাকে আমার ওপর চাপিয়ে রেখে দে তো। তোকে বার না করে আমাকে বার করতেই পারবে না।’

এই সময় একটা লম্বা ছুঁচ মতো জিনিস দেখতে পেয়ে অপু জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি দিদি ওটা কী রে?’

দুগ্গা দেখতে পেয়ে বলে ওঠে, ‘শুনলাম ওটা দিয়ে আমার বেলুনে হাওয়া পুরে দেবে। তারপর air embolism বলে একটা ব্যাপার ঘটবে আর আমার আর বাইরেটা দেখা হবে না। যাওয়ার আগে তোর সঙ্গে কথা হলো, দুটো হুটোপাটি হলো। খুব মজা হলো। তোর হাতদুটো একটু বাড়াবি ভাই। কচি কচি হাতদুটো একটু ছুঁয়ে দেখব … অপু … কী রে … অপু … অপু … অপু … কী রে … কী হলো … অপু … অপু …’

 
জুন ২০২০
 

শিকাগোর আকাশটা আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ হয়ে চকচক করছে। অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্রিনি ঘুম পারাচ্ছে অপুকে। ঘরের মধ্যে বোতলে দুধ রেডি করছে রোশনি। বাইরের ঘরে সাফাইয়ের কাজ সেরে দুগ্গাকে কোলে নিয়ে কাজল ঢুকে পড়ল শোওয়ার ঘরে। মেয়েটাকে বেবি কটে শুইয়ে দিতে হবে। রোশনি মেমসাহেবের মেয়ে। তারপর স্রিনি সাহেবের কোল থেকে নিজের ছেলেটাকে নিয়ে, দুধ খাইয়ে, দুগ্গার পাশে শুইয়ে দিতে হবে। যতক্ষণ না অপু পাশে এসে শুচ্ছে, দুগ্গা হাত পা ছুঁড়ে খেলাই করতে থাকবে। অনেক রাতে গ্লেনভিউয়ের ‘দেসি’ গ্রসারি স্টোরের কাজ সেরে ফিরবে সুখদেব। স্রিনি সাহেবই খরচা করে সুখদেব আর কাজলকে নিয়ে এসেছেন বিদেশে। গ্রসারি স্টোরে চাকরিও জুটিয়ে দিয়েছেন। সুখদেব এসে দেখবে রোজকার মতো আজকেও অপু দুগ্গা হাতে হাত রেখে ঘুমিয়ে কাদা। অপুকে কোলে নিয়ে কাজল আর সুখদেব চলে যাবে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে! আর যাওয়ার সময় পিছন ফিরে একবার দেখে নেবে মানুষ থেকে দেবতা হয়ে ওঠা স্রিনি সাহেব আর রোশনি মেমসাহেবের দিকে।
 

এরকম ইউটোপিয়ান টেলি সিরিজের মতো গল্পটা শেষ করতে পারলে ভালো হতো। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে অপুর সিলেক্টিভ অ্যাবরশানে সুখদেবের অনুমতি প্রদানের দুঃসংবাদটা দিতে হোত না আপনাদের!

........................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি


 

 

 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by