প্রবন্ধ - স্বামী বিবেকানন্দ : প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার - ড: দিলীপ দত্ত

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার

ড. দিলীপ দত্ত

 

 

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন প্রকৃত মানুষ গঠনের রূপকার। কি ছিল তাঁর চালিকা শক্তি? স্বামীজির সমস্ত মন জুড়ে ছিল একটাই চিন্তা— কীভাবে এবং কত শীঘ্র তিনি তাঁর আপামর দুর্দশাগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে জাগ্রত করে তুলবেন

১৮৯৩ খৃীষ্টাব্দে শিকাগো শহরে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত অনুষ্ঠিত ধর্মমহাসভায় স্বামীজির বক্তৃতা সকলের প্রাণে লেগেছিল। কী ছিল সেই বক্তৃতায়? শুধুই কি ধর্মোপদেশ? না, তাঁর বক্তৃতায় ছিল ভারতের চিরন্তন জ্ঞানের বার্তা, সম্প্রীতি ও সদিচ্ছার বার্তা, শক্তি এবং নির্ভীকতা, সর্বজনীন ভালোবাসা এবং সেবার বার্তা! বিজয়ী বীররূপে সংবর্ধিত হয়েও তাঁর হৃদয় এক অদ্ভুত করুণ রসে আর্দ্র ছিল। বারংবার তাঁর মনে দারিদ্র্য-পীড়িত ভারত এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ আমেরিকার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য প্রতীয়মান হয়ে উঠতো। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে হাজার হাজার দারিদ্র্য-নিপীড়িত ভারতবাসীকে জাগ্রত করার কাজে কে এগিয়ে আসবে? কে তাদের মুখে রুটি জোগাবে? তিনি কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারবেন? ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্দশা-লাঞ্ছিত মানুষের জন্য তাঁর হৃদয়ের এই গভীর ভালোবাসা অচিরেই এক উদ্দীপকে পরিণত হয় যা ভবিষ্যতে তাঁর প্রকৃত মানুষ গঠনের সমস্ত কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে।

কি ছিল স্বামীজির দর্শন?  স্বামী বিবেকানন্দের সবচেয়ে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি ছিল সর্বজনীন ধর্মের প্রতি তাঁর উদার চিন্তাধারা স্বামীজি ধর্ম ও ধারণার অপার বৈচিত্র্যে আনন্দ খুঁজে পেতেন। তিনি তাদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মননে ও চিন্তনে সর্বজনীন ধর্মের ধারণাটি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে অনুসরণ করে। তিনি বলতেন  সকলের সঙ্গে আমাদের সমান আচরণ করা উচিত, যারা সব দিক দিয়ে দুর্বল তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের সচেষ্টা হওয়া উচিত। আমাদের উচিত কোনও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সেই অবস্থায় উন্নীত করা যেখানে সে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে এবং তাকে তার নিজ পথে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়। এখানেই নিহিত আছে তাঁর ‘প্রকৃত মানব সৃষ্টির মৌলিক দর্শন।

 কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন? ইংরাজি শব্দ Man একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ শব্দ। M (Morality) অর্থাৎ নৈতিকতা, A (Activeness) অর্থাৎ সক্রিয়তা এবং N (Nature) অর্থাৎ প্রকৃতি—এই তিনের উপস্থিতিই তো একজন প্রকৃত মানুষের পরিচয়। তার নৈতিকতা হতে হবে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। তাকে শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই স্বার্থপরতা বিসর্জন দিতে হবেস্বামীজি বিশ্বাস করতেন যে নিজের দিব্যস্বরূপের প্রতি জ্বলন্ত বিশ্বাস থাকলে তবেই ব্যক্তি তাঁর শক্তি, ক্ষমতা এবং মনুষ্যত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে

স্বামীজি প্রকৃত মানুষ গঠনের এই নতুন কর্মকাণ্ডকে তার গভীরতম অর্থে, সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ব্যক্তি নিজেই তাঁর অভিভাবক হয়ে উঠুককীভাবে দেহ ও মনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা যায় সেই শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কীভাবে ধাপে ধাপে তার অন্তর্নিহিত পার্থিব এবং স্বর্গীয় সমস্ত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে অসীম অনন্তের মাঝে তার সত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় সেই পথের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। একবার যদি ব্যক্তি তার অপরিহার্য ঐশ্বরিক প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে যায়, তখন সে, শক্তি, নির্ভীকতা, প্রফুল্লতা এবং উদারতার খনি সম্বলিত একজন নতুন মানুষে পরিণত হয়।

মানুষ গড়া কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনাকে স্বামীজি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে ভারতে তাঁর শিষ্য এবং হিতৈষীদের কাছে লেখা চিঠিগুলির মধ্যে সেটা স্পষ্ট দেখা যায়

২০ আগস্ট, ১৮৯৩, স্বামীজি ব্রাসি মিডো থেকে আলাসিঙ্গাকে লিখলেন, পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, ঈশ্বরের প্রতি অনন্ত বিশ্বাস নিয়ে এবং বুকে সিংহের ন্যায় সাহস নিয়ে দরিদ্র, পতিত এবং নিপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি দ্বারা উদ্বেলিত হয়ে এই পবিত্র ভূমির প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে মুক্তির বাণী প্রচার করতে হবে এবং সাহায্যের বার্তা, সামাজিক উত্থানের বার্তা এবং সমতার বার্তা প্রচার করতে হবে।

২ নভেম্বর, ১৮৯৩, তিনি আবার শিকাগো থেকে আলাসিঙ্গাকে চিঠি লিখে বললেন রামনাদের রাজা সহ অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মধ্যে ভারতের জনগণের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে এবং এই সব ধনবান ব্যক্তিদের দরিদ্র দেশবাসীদের সাহায্য করার কারণ বোঝাতে।  

২ ডিসেম্বর, ১৮৯৩, স্বামীজি শিকাগো থেকে তাঁর শিষ্য হরিপদ মিত্রকে লিখলেন, ‘আমি আমার কৌতূহল মেটাতে বা নাম-যশের লোভে এই দেশে আসিনি, আমি এখানে এসেছি আমার দরিদ্র ভারতবাসীর সহায়তার জন্য কোনো উপায় খুঁজে পেতে। যদি ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে তোমার কাছে ধীরে ধীরে সেগুলোর অর্থ পরিষ্কার হবে।’

১৯ মার্চ, ১৮৯৪, স্বামীজি শিকাগো থেকে তাঁর সন্ন্যাসী ভাই শশীকে চিঠি লিখলেন,  ‘এমন একটি দেশ যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ মহুয়া ফুলের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে এবং এক কি দুই লক্ষ সাধু বা কয়েক লক্ষ ব্রাহ্মণ এই দরিদ্র মানুষগুলোর রক্ত চুষে খাচ্ছে, তাদের উন্নতির জন্য সামান্যতম প্রচেষ্টা ছাড়াই। এটা কি ধর্ম, নাকি শয়তানের নাচন?

১৫ জানুয়ারি, ১৮৯৭-তে ভারতে ফিরে এসে স্বামীজি এক মুহূর্তকাল সময় নষ্ট না করে, তাঁর দেশবাসীর মনের অস্থির অবস্থা পুনর্বাসনের জন্য আশু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন।  তাঁর একমাত্র প্রচেষ্টা ছিল মানুষের এই দুঃখ-দুর্দশাময় মুহ্যমান জীবনকে উচ্চতর আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত করা।  স্বামীজি বলেছিলেন, আমরা প্রত্যেকেই একটি অসাধারণ ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী যা আমাদেরকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং স্থায়ী সৌন্দর্য এনে দিতে পারে। তবুও, আমরা আমাদের ঐশ্বরিক ঐতিহ্য ভুলে নিজেদেরকে নিঃস্ব ভাবতে শুরু করি। এবং এই ভাবনাই যে কোনও ব্যক্তির অসুস্থতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয়দের মানসিক স্বাস্থ্যের এমন দীনতা দেখেই স্বামীজি তাঁর মানুষ গড়ার কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন।

স্বামীজি তিন রকমভাবে তাঁর 'মানুষ গড়ার' মিশন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। প্রথমত, তিনি ভারতীয়দের, বিশেষ করে যুবসমাজের কাছে তাঁর উদ্দীপক আহ্বান জানিয়েছিলেন।  দ্বিতীয়ত, তিনি তরুণদের মনে মাতৃভূমির প্রতি চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তৃতীয়ত, তিনি স্ব-সংস্কৃতির একটি পাঠ প্রদান করেছিলেন যেখানে স্বামীজি জ্ঞানের উপাসনা, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং নিঃস্বার্থ কাজের উপর যথাযথ জোর দিয়ে একটি সমন্বিত জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

যুবসমাজ স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে তাদের অদম্য ত্রাণকর্তাকে খুঁজে পায়। স্বামীজি যুবসমাজকে পরের হিতে গভীরভাবে চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেন দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে যাতে আমরা আমাদের হৃদয়ের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছে যেতে পারি।

উপসংহারে বলা যেতে পারে যে  স্বামীজির এই ‘মানুষ গড়া’র প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছিল তখন থেকে যখন তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসেছিলেন এই ধারণা তাঁর মনের মধ্যে আরও  গভীরভাবে প্রোথিত হয় যখন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, সাধনার উচ্চতম স্তর যেখানে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে অসীমের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেখানে পৌঁছানোর জন্য তাঁর জন্ম হয়নি বরং তিনি সন্ন্যাস, ধর্ম এবং সমস্ত প্রকার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার মানবিক উন্নতিকল্পে এবং সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ, দৃঢ়স্বরে স্বামীজিকে দরিদ্র ও নিপীড়িতদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে তাঁর জীবন উৎসর্গ করার উপদেশ দেন তিনি আরও বলেন যে নরেন তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি এবং আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের ভিত নাড়িয়ে দেবে। সুতরাং এখানে বলাই যায় শ্রীরামকৃষ্ণই স্বামীজিকে তাঁর মানুষ গড়ার কর্মযজ্ঞে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। মাতৃভূমির জন্য ভাবনা তাঁর কাছে ছিল শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর মতোই অপরিহার্য।

খালি পেটে ধর্ম করা হয় না— গুরুদেবের এই কথা স্মরণে রেখে এবং অহংবাদী বিশ্বাসে নিষ্ঠা না রেখে স্বামীজি দরিদ্রদের উন্নতি সাধন এবং তাদের প্রতিপালন করাই তাঁর ধর্মের প্রথম কর্তব্য হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। বস্তুত, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ছিলেন মাত্র।  তিনি কখনওই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, কিংবা জাতি গঠনের যুগের সূচনা করেননি।  তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর, প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ।  আর তাঁর আরাধনার দেবী ছিলেন তাঁর মাতৃভূমি। স্বামীজির হৃদয় তাঁর মাতৃভূমি সম্পর্কিত যে কোনও কিছুর জন্য রোমাঞ্চিত ও স্পন্দিত হত। সেখানে না ছিল কোনও ভয়, না ছিল দুর্বলতা, না সঙ্কোচ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতমাতার সমস্ত দোষত্রুটি ও দুর্বলতা তাঁর দোষ প্রকৃতপক্ষে তার নিজের দুর্বলতা। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর অন্তর্নিহিত সত্তা ভারতমাতার আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।  স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন যে অধিকাংশ ভারতমাতার সন্তানেরা ক্ষুধা, দুর্দশা এবং শিক্ষার অভাবে জর্জরিত। এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, এক বা একাধিক ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং একটি উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া উদগ্র বাসনা কেবল স্বার্থপরতার চরম উদাহরণই নয়, এটি একটি গুরুতর অপরাধও বটে। সমতার প্রধান শর্ত সমাজের একটি অংশের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা খর্ব করা এবং সর্বজনীন উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির স্বার্থে জাতীয় আয় সবার জন্য সমানভাবে বিতরণ করা। এই ধারণাগুলি যা তাঁর মনের গভীরে প্রোথিত ছিল, তা দিয়েই স্বামীজি তাঁর 'মানুষ গড়ার' মিশন গঠন করেছিলেন।

 

..........................