দেবাশীষ তালুকদার লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দেবাশীষ তালুকদার লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

যে আলো আঁধার ছুঁয়েছে - দেবাশীষ তালুকদার

 

 যে আলো আঁধার ছুঁয়েছে
দেবাশীষ তালুকদার
 
 
       আমার উত্তপ্ত মিডিয়াম সাইজ ল্যাটেতে আমি যখন গভীর মনোযোগের সাথে চকোলেট পাউডার মেশাচ্ছিলাম, সোহম ততক্ষনে ক্যাফের একটা উইন্ডো সীটে বসে পড়েছে। আমি কফিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে তার দু ভুরু নাচিয়ে বলল,
— “শ্রেয়সী, সত্যিকারের ভালবাসায় তোমার বিশ্বাস আছে?”
আমি ফিক করে হেসে জানলার বাইরে তাকালাম। সূর্যটা ততক্ষনে ডুবে গেছে। গোধূলির সূর্যবিদায়ের তখন অনেক রঙ। সোহম টেবিলে আলতো নক করতেই আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— “তোমরা আমেরিকায় বড় হওয়া কিডজ্ আবার সত্যিকারের ভালবাসার ধার ধারছো কবে থেকে? তোমাদের তো কারোর চোখের দিকে তাকালেই প্রেম হয়ে যায়!”
সে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল,
— “ওহ্ শ্রেয়সী! not again!”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— “ঠিক আছে! কিন্তু সোহম, আমার যে ট্রু ফলস্ কোনরকম ভালবাসাতেই বিশ্বাস নেই! যত যাই বল ওসব ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’- টাইপ ভালবাসার দিন পৃথিবীতে আর নেই।“
— “কখনো প্রেমে পরোনি? সিরিয়াসলি...?”
— “কে বলেছে পরিনি? অনেকবার পরেছি।“
সোহম সব কটা দাঁত বের করে বলল,
— “ওয়াও! তবে শুনতে চাই ম্যাম!”
আমি কফিতে বিরাট একটা চুমুক দিয়ে বললাম,
— "তুমি কতক্ষণ শুনতে পারবে বলে মনে কর?”
— "তুমি যতক্ষণ বলতে পারবে বলে মনে কর!”
আমি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললাম,
— "সোহম, টিনেইজ লাইফে আমি প্রথম যার প্রেমে পড়েছিলাম, সে আমার বাড়ির সামনে রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতো। সে খেলতো আর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিল্ করতাম। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমি আবিষ্কার করলাম, ক্লাস এইটে পড়ুয়া সেই ইচড়েপাকা ছেলেটির একটি গার্লফ্রেন্ড আছে।… তোমার এইসব লেইম স্টোরি শুনতে ভাল লাগছে?”
— “না লাগছে না, এসব ষ্টুপিড স্টোরি সবার লাইফেই মোটামুটি কমন। আমি তোমার ট্রু লাভস্টোরি শুনতে চেয়েছি!!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
— “ট্রু..? আমি তোমাকে আগেই বলেছি সোহম, ওসব ট্রু লাভস্টোরি বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।”
— "কিছু নেই’....কথাটির পেছনেও অনেক কিছু থাকে....তাইনা??”
 
       আমি ঠোঁট চেপে এক মুহুর্ত চুপ করে সোহম এর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চাইতে ভাল আর কেউই বোধহয় জানেনা, যে এই সোহম ছেলেটি আমাকে এভারেজের থেকে একটু বেশিই পছন্দ করে। আমেরিকার এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমি যখন বন্ধুহীনতায় মোটামুটিভাবে নিজেকে একঘরে করে ফেলছিলাম, ঠিক সেই সময়েই সোহম এর সাথে আমার পরিচয়। এই 'ভালবাসা' বা 'প্রেম' বিষয়ে আমার বাজে ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকলে এতদিনে আমি হয়ত ওকে ভালোবেসে ফেলতাম। আমার ওপর এই সোহমের এতটা আন্তরিক অনুভূতি থাকবার পরেও কিন্তু ও আমার নিজের চারপাশে তুলে রাখা দেয়ালটা কখনও ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেনি। দেয়ালের ওপাশে থেকেই সে আমার সঙ্গে থাকে, আর অপেক্ষা করে এই ভেবে– কোনদিন হয়ত আমি নিজেই তাকে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেব। আমি আমার প্রচন্ড আক্ষেপটাকে চেপে রেখে সোহম এর দিকে তাকালাম। কেন যে আমি এই ছেলেটিকে এখনও ভালবাসতে পারিনা..! ক্ষনিকের আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বললাম,
— "সোহম, আমার জীবনের একমাত্র সত্যিকারের ভালবাসাটি এসেছিল ঠিক পঞ্চমবার, কারো ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হবার পর। আমি ছেলেটিকে প্রচন্ড ভালবাসতাম, হ্যা! ঠিক যেমন করে সিনেমার নায়িকারা সব ভুলে গিয়ে প্রেমিকের জন্য মরে যেতে চায়, আমি তাকে ঠিক তেমন করেই ভালবাসতাম। অথচ আমার জীবনের সেই সত্যি ভালবাসাটি কদিন টিকেছিল জানো? কেবলমাত্র সাত মাস সতেরদিন। সে চলে যাবার পর আজ অবধি কেটে গিয়েছে সাড়ে ছয় বছর…! অথচ দেখ, আমি দিব্যি বেঁচে আছি। তাই my dear সোহম, এই মুহুর্তে তোমাকে সাক্ষী রেখে আমি শ্রেয়সী, শপথ করে বলছি– 'এ পৃথিবীতে সত্য ভালবাসার গল্প বলে কিচ্ছু নেই!'"
সোহম কিছুক্ষণ থমথমে একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আমি হাসিমুখে দুইহাত দিয়ে কফিমগের উষ্ণতা নিতে থাকি।
--- "জানো সোহম সত্যিই কি অবাক করা ব্যাপার! এতগুলো দিন চলে যাওয়ার পরেও অনির্বাণের কথা ভাবলে আজও আমার চারপাশটা কেমন যেন শীতল হয়ে আসে! অনির্বাণ কিংবা তার স্মৃতি, ধীরে ধীরে তার সব কিছুই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে আমার মন থেকে। তার অপলক চেয়ে থাকা চোখ, ঠোঁটের এককোণ বাঁকানো হাসি, হাসবার অছিলায় তার ডানদিকে তাকিয়ে ছাড়া দীর্ঘশ্বাসের শব্দ!! আমি কি তাকে ভালবাসিনি? অথচ এতটা ভালবাসা দেবার পরেও সে আমার হয়ে কখনো থাকেনি...।"
— "কেন থাকেনি সে?”
— "ক্যারিয়ার। এই ড্যাশিং স্টেটসের হাতছানি আর কে রুখতে পারে বলো? আমিতো কোন ফ্যাক্টরই ছিলাম না! নিজের ক্যারিয়ারের জন্য এত দূরে চলে আসবার ডিসিশান সে যখন একাই নিয়ে ফেলেছিল, আমি তখন তার জন্যে ছিলাম শুধুই একটা দেওয়াল, যাকে সে অবলীলায় ভেঙ্গে যেতে পারে, যাকে ভেঙ্গে যাওয়ার দায়বদ্ধতায় একটা সেকেন্ডেও তার চোখের পাতা কখনও ভিজে উঠবেনা!”
— “কষ্ট হয়নি?”
— “হাসবে। শুনলে তুমি হাসবে।”
সোহম অপরাধীর মত মুখ করে বলল,
— “হাসব কেন?”
আমি ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
— "আমাদের সাত মাস সতের দিনের সম্পর্ক যখন শেষের দিকে, আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে রাত কাটিয়ে দিতাম। আমাকে কেউ কোনদিন কখনো কাঁদতে দেখেনি, সেই আমি রাতের পর রাত চোখের জল ফেলতাম। কেউ সেটা দেখেনি, তাই সবটুকু অপারগতা নিজের কাছে রেখে আমি চলে এসেছিলাম।”
— “তারপর?”
— "অনির্বাণের জন্য আমি যেদিন শেষবারের মত কেঁদেছিলাম, সেদিন কলকাতা শহরের বুকে প্রচন্ড শীত নেমেছিল। বাসে জানলার পাশের একটা সিটে বসে আমি সেদিন দুহাত শক্ত করে আমার মোবাইলটাকে চেপে ধরেছিলাম, যে মোবাইলে আসা একটি টেক্সটে অনির্বাণ আমাকে জানিয়েছিল,
– 'ভালবাসা নামক একঘেয়েমিতে তার এখন বিরক্তি চলে এসেছে, আমি যেন তাকে আর ধরে না রাখি'। টেক্সট্ পড়া শেষ হতেই সেদিন আমার চোখ থেকে শেষ কয়েক ফোঁটা কষ্ট ঝরে পরেছিল। তারপর থেকে অনির্বাণের জন্য আমি আর কোনদিন কাঁদিনি! সেই শেষবারের মতো কাঁদবার ঠিক দুদিন পর আমি অনির্বাণকে নিজে ডেকে বলেছিলাম— ‘অনির্বাণ, তুমি মুক্তি চাও? যাও আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।’ সোহম, আমার ট্রু লাভস্টোরির সেখানেই এন্ডিং হয়েছিল!”
 
      এতটুকু বলবার পর সোহম এর সামনে আমি সেদিন আর একটা কথাও বলতে পারিনি। আমার নিজেকে সেদিন সম্পূর্ণভাবে ব্ল্যাংক মনে হচ্ছিল। ফল সিজনের সেই হালকা শীত আমাকে প্রচন্ড রিক্ততায় মেরে ফেলতে চাইছিল যেন! কেন জানিনা, সোহমও সেদিন আর কিছু জানতে চায়নি, চুপচাপ আমাকে তার জ্যাকেটে জড়িয়ে আমাকে আমার ফ্ল্যাটে ড্রপ করে এসেছিল। অথচ আমার কথাগুলো আমি সেদিন শেষ করতে পারিনি। সোহম আমার কাছে যে সত্যি ভালবাসার গল্প শুনতে চেয়েছিল, সেই ভালবাসার অকল্পনীয় মৃত্যুকে আগলে রেখে আমি কিভাবে আজও বেঁচে আছি– সেই গল্পগুলো আমার ওকে বলা হয়নি। আমি হয়ত ড্রাকুলার মতই একাকী জীবন্মৃতের জীবন বেছে নিয়েছিলাম। আমাকে আমার নিজের হাতে শপে দিয়ে অনির্বাণও হয়ত ভাল কাজটাই করেছিল। তাই হয়তো নিজেকে নিয়ে আমি এখন ভালই আছি। যে ক্যারিয়ারের জন্য অনির্বান বহুদুরে চলে গিয়েছিল, আমিও সেলফিশের মত সেই ক্যারিয়ারকে কেন্দ্র করেই একদিন বাড়ি ছেড়েছিলাম। তবে একটা ব্যাপার কি পাঠক জানেন, নিজেকে এই পৃথিবীতে খুব অযোগ্য মনে হলে অনেক দূরের কোন দ্বীপে কাউকে নিয়ে বেঁচে থাকবার মতো একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। খুব অলস দুপুরে পৃথিবীতে যখন বৃষ্টি নামে না – কল্পনার সেই দ্বীপে তখন প্রিয় মানুষটির সাথে বৃষ্টিতে ভেজা যায়। অনির্বাণ চলে যাবার পর আমার সে স্বপ্নটা আর নেই।
এরপর আকাশ নীল থেকে লাল হল, আর লাল থেকে আঁধার– আর আমিও ভুলে গেলাম যে, আমারও একটা আকাশ ছিল।
প্রিয় অনির্বান, আমি এখন আর ভুল ভেবে ভুল করিনা। আমি এখন বুঝতে শিখেছি, হালকা রঙের আলতো রোদও বরফ নদীর মত শীতলতা ছড়াতে পারে। এখন চাইলেও তুমি আমাকে আর রাংধনু দেখাতে পারবে না। আমার আকাশে এখন আর কোন বৃষ্টি নেই, আমার সব না পাওয়াগুলো এখন শুধুই শুভ্র, ঠিক তুষারের মতন। আমার চারপাশের পৃথিবীটা ছোট হতে হতে আমার জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমিও সেই জানলার পাল্লা এঁটে দিয়েছি চিরদিনের মতো। অনির্বাণ, আমি যে চিরকাল আঁধার ভালবেসেছি, আলোতে আমার কেমন করে পোষাবে বলো? আমার এই আঁধারেই সোহম একটু একটু করে আলো জ্বালিয়ে এসেছে অনেকদিন ধরে। আমি ওকে আগে কোনদিন বলিনি আমার একটা গল্প আছে। এখানে আসবার পর আমি যখন সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম, এই সোহম তখন আলোর মত ঝলমল করা হাসিমুখ নিয়ে আমার পাশে বসে থাকত। প্রথমদিকে আমি বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলতাম,
— "সোহম, তুমি সর্বক্ষণ এইভাবে যে আমার পাশে বসে থাকো, সেটা কিন্তু একটুও মানায় না, জানো সেটা?”
সোহম ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়ে বলত,
— "তুমি এত রেসিস্ট, শুধুমাত্র আমার গায়ের রঙ ফর্সা নয় বলে তুমি আমাকে বেমানান বললে?”
— "তুমি কি ইচ্ছে করেই এমন করো? এত হাসিখুশি একটা মানুষ হয়ে আমার মত বোরিং পাবলিকের সাথে কি করে মিশছো?”
— "আমার যে ভাল লাগে, আমি কি করতে পারি?”
আমি সোহম এর এই অসম্ভব ইনোসেন্ট কথাবার্তায় আটকে যাই। সেই তো, আমরা মানুষরা বড় অসহায়; আমাদের ভাল লাগলে – আমরা কি করতে পারি?
সোহমকে এরপর আমি আর “না” করতে পারিনি। তার ভাল লাগে আমার সাথে থাকতে, আর ওর এই ভাল লাগার স্বীকৃতিটা আমি যদি নাও দিতে পারি, তবুও সে একইভাবে থাকবে আমার সাথে। ওর কি এভাবে বাঁচতে পেরেও ভাল লাগবে! কে জানে!
কিন্তু সেদিনের সেই সন্ধ্যায়, আমাকে বাড়িতে ছেড়ে আসবার পরদিন থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ, ছেলেটা যেন বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। আমার গল্প শুনে ও কি কোন আঘাত পেয়েছে তবে!!
আমার কখনো মন খারাপ হলে আমি আমার বাড়ির কাছে ছোট্ট একটা পাহাড়ে চলে যাই। উঠতে পারা যায় এরকম মোটামুটি একটা টিলার উপর গিয়ে আমি লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি। কখনও চিৎকার করি, আবার কখনো বাকি সময়টাতে ছবি আঁকি। আমাকে ফলো করে সোহম একদিন চলে এসেছিল এখানে। আমি বিরক্ত হয়ে ওকে চলে যেতে বলায় ও কাচুমাচু হয়ে বলেছিল,
— "মনে কর, সোহম কোন মানুষ নয় – আমি সোহম একটা পাহাড়। কোন ফাংশান নেই। তবু থাকি!!”...
আজ আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে ওর ওই কথাটা মনে পরতেই ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। পাশে তাকিয়ে সোহম নামের সেই পাহাড়টিকে দেখার খুব ইচ্ছে হল আমার। সত্যি! মানুষের মন কি বিচিত্র একটি জিনিস! কোইন্সিডেন্স কিনা জানিনা, ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই আমার মোবাইলে সোহম এর একটি কল এলো। আমি ফোন রিসিভ করতেই সে আলতো গলায় বলল,
— " শ্রেয়সী, আমি তোমার কাছ থেকে একটু সময় চাইতে পারি? তোমাকে একটা গল্প বলার ছিল।”
আমি আমার দীর্ঘশ্বাস আটকে বললাম,
— "সোহম, অনেক দিন তোমাকে দেখিনি! আমি আজ তোমাকে দেখতে চাই।“
সোহম যখন আমার পাশে এসে বসল, আমি বুঝতে পারলাম যে এই সোহমকে আমি আগে দেখিনি। আমি তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরেই ও একটু ইতস্তত করে বলল,
— "ইয়ে আমি ঠিক আছি । আমি......”
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
— "তোমার গল্পটা?“
সোহম এর দৃষ্টি হঠাৎ করে কোথায় যেন চলে গেল, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই ও বলতে শুরু করল--
— "আমার গল্প, একজন শ্রেয়সীর কিংবা একজন অনির্বানেরই গল্প। আমি যখন আন্ডারগ্র্যাড কোর্স শেষ করলাম, তখন একটা ফ্যামিলি ট্যুরে দেশে গিয়েছিলাম দুই মাসের জন্য - বাবার বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে ছিলাম সেই সময়টা। সপ্তাহ দুয়েক যেতেই আমি লক্ষ্য করলাম, আমার ছোটবোন শোহিনী কোন একটা ব্যাপারে কেমন যেন বিহেভ করছে। প্রথমটায় টিনেইজ মেন্টালিটি ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে বুঝতে পারি প্রবলেমটা আসলে অন্যকিছু। প্রথমবার দেশে বেড়াতে এসে শোহিনী প্রেমে পড়ে গিয়েছিল বাবার সেই বন্ধুর ছেলের। আমি গোপনে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ছেলেটি ইতিমধ্যেই একটি রিলেশানে আছে। ওর নাম ছিল অনির্বান। শ্রেয়সী নামের একটি মেয়ের সাথে তার রিলেশান।“
আমি তখনো আঙ্গুল দিয়ে মাটির উপর নকশা কেটে চলেছি। সোহম যখন এইটুকু বলে থেমে গেল, আমি একবারের জন্যেও বিচলিত না হয়ে বললাম,
— "চুপ করে থেকো না, সোহম আমি শুনছি।“
— "আমি যখন শোহীনি কে ডেকে সত্যি কথাটা বললাম – শোহিনী বুঝল। বলল, এই ভালোবাসার অনুভূতিকে আর সে মনে ধরে বসে থাকবেনা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম আর এরই মধ্যে আমাদের আবার ফিরে যাবার সময়ও হয়ে এল। আমেরিকা ফিরে এসে সবাই সবার মত কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে গেলেও আমি লক্ষ্য করলাম, শোহিনী আর আগের মত নেই। সে যদিও বোঝাতে চাইছে যে সে ঠিকঠাক আছে, নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম – ওর আসলে কিছুই ঠিক নেই। ওর পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া– সবকিছুই ব্যালেন্স হারাতে লাগল। একদিন মাঝরাতে ও সুইসাইড এটেম্পট করতে গেলে, আমি ভাগ্যক্রমে উপস্থিত হয়ে যাওয়াতে ওকে বাঁচাতে পারলাম। আমার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় শোহিনী বলতে বাধ্য হল, সে আর থাকতে পারছেনা। অনির্বানের সাথে তার এখনো মেসেঞ্জারে কন্ট্যাক্ট হয়। সে নাকি ওকে তার লাভারের ছবিও দেখিয়েছে। ওর এতকিছু মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে শোহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকি – ওকে এভাবে হয়ত কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেনি। সেদিন ওর কান্না দেখে আমি প্রচন্ড বাজে একটা ডিসিশান নিই – আমি ঠিক করি, যে কোন মূল্যেই হোক না কেন অনির্বানকে আমি শোহিনীর কাছে নিয়ে আসব। আর এরপর অনির্বানের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ – ওকে দেশের বাইরে আনার ব্যাপারে যত প্ররোচনা দেওয়া যায় সবটাই আমি করতে লাগলাম দিনের পর দিন। প্রথমদিকে ওর যে খুব একটা আগ্রহ ছিল তা নয়, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ওর রেজাল্ট যখন মনমত হল না, তখন ও আস্তে আস্তে নিজের ডিসিশান বদলাতে শুরু করল। ওর ডিসিশান যখন পেরেন্টস পর্যায়ে চলে গেল, তখন আমাদের দুই ফ্যামিলি মিলে ওর ডিসিশানের রোডওয়ে টা আরেকটু ইজি করে দিল। আর সেই ইজি রোডওয়েটা ছিল – শোহিনীর সাথে অনির্বানের বিয়ে।“
এতটুকু শুনেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি । দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— "আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছে না, সোহম“ সোহম মাথা নেড়ে বলল,
— “না, আমাকে বলতেই হবে শ্রেয়সী, সেই বিয়ের রাতেই আমি প্রথম বুঝতে পারি, যে শোহিনীর জন্য আমি আরেকটি মেয়ের সাথে কি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি! আমার সেই অপরাধবোধ আমাকে প্রতিটা দিন শাস্তি দিতে থাকে। প্রায়শ্চিত্ত করব বলে আমি শ্রেয়সীকে খুঁজে বের করি। দূর থেকে তাকে যখন আসতে দেখতাম, আমার ইচ্ছে করত – আমি দু হাত জোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু আমি পারতাম না। শেষ পর্যন্ত মেসেঞ্জারে তার সাথে কন্ট্যাক্ট করি। শ্রেয়সী, আমি আমার পরিচয় তোমাকে দিতে পারিনি। কিন্তু তোমার কি সেই মানুষটিকে মনে আছে যার সাথে কখনও দেখা হবেনা বলে তুমি তাকে তোমার সব কথা বলেছিলে? আমি জানিনা, তুমি ভুলে গেছ কিনা – কিন্তু ততদিনে আমি আরও একটি অন্যায় করে ফেলি। আমি বুঝতে পারি, আমার এ জীবনের সব ভাললাগা আমি তোমায় দিয়ে ফেলেছি। যখন সবকিছু তোমাকে বলতে যাব, ঠিক তখনই ভাগ্য তোমাকে নিজে থেকেই আমার দুয়ারে এনে দিল। তুমি জানালে, যে তুমি দেশের বাইরে আসছো আর যে জায়গায় আসার কথা বললে আমি ঠিক সেখানেই থাকি। আমার অপরাধী মন আবার চাইল, সব নতুন করে শুরু করতে। আমি মেসেঞ্জার অফ করে দিলাম – তোমাকে সরাসরি এপ্রোচ করলাম নতুন পরিচয়ে। কিন্তু দেখ, তবুও তুমি আমাকে ভালবাসতে পারলে না। তোমার অজান্তেই আমি তোমার সমস্ত দুঃখের কারন – অথচ তুমি সেটা বুঝতেও পারলে না। কিন্তু আমি আর তোমাকে ঠকাতে পারলাম না শ্রেয়সী। এই মুহুর্তে তোমার সবচেয়ে ঘৃণার মানুষটি যদি আমি হয়ে থাকি, আমি একটুও অবাক হব না। কিন্তু যেভাবেই হোক, should end it......আমি জানিনা আমার অ্যাটোন্মেন্ট কি হতে পারে – দুঃখিত বলবার যোগ্যতাও আমার নেই, শেয়শ্রী।”
অনেক্ষন চুপ করে থাকবার পর আমি শুধু বলেছিলাম,
— "সোহম, একে অপরের প্রতি অনেকটা অনুভূতি থাকার পরেও এ জীবনে একসাথে থাকাটা অনেক সময় সম্ভব হয়না। তোমার অপরাধ কতটুকু আমি জানিনা – আমি শুধু জানি, আমাকে আঁকড়ে রাখবার মত ভালবাসা অনির্বাণের কাছে ছিলনা। অনির্বান তার বর্তমানের জন্যই অনেক বেশি মূল্য দিয়েছিল, আর সেই মূল্যটা ও নিজের ইচ্ছেতেই দিয়েছিল। ওর নিজের ইচ্ছে না থাকলে তোমার কথা ও শুনত না!”
সোহম কিছু একটা বলতে চাইছিল, আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম কোন এক অচেনা চাঁদের আলোয় ওর চোখে জল চিকচিক করছে। একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ও বলল,
— “তুমি কখনও তোমার কল্পনায় আমাকে দেখোনি, তাইনা শ্রেয়সী? আজকের পর থেকে 'ওয়ান পারসেন্ট অফ সামথিং' নামক চান্সটাও আমার আর নেই, তাইনা? আমি তোমাকে আর কোনদিন বোঝাতে পারব না, তুমি আমাকে ভালবাসতে না পারলেও আমার তাতে কোন ক্ষতি নেই। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। যার কাছ থেকে আমি সব কেড়ে নিয়েছিলাম, তার কাছেই আমার অস্তিত্ব পড়ে রইল। শ্রেয়সী, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে? তুমি কি আমাকে মনে রাখবে?...“
আমি ওর কথার সেই সুর অসমাপ্ত রেখেই সেদিন চলে এসেছিলাম। সোহম আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, আর আমি ওকে অপরাধী না ভাবতে পারার অপরাধে দূরে চলে গিয়েছিলাম। অনেক দূরে। সেদিনের পর সোহম এর সাথে আমার যেদিন আবার দেখা হল – তার মধ্যে কেমন করে যেন কেটে গিয়েছিল সাড়ে তিন বছর। আমরা দুজনই তখন বছর ত্রিশ এর। ছেলেমানুষি ভালবাসায় হাস্যকর শিকারে পরিনত হয়ে হাহাকার করবার বয়স তখন আমাদের আর নেই।
-
সেই একই পাহাড় – আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। জানিনা কেন আমি ভেবে নিয়েছিলাম, সোহমও একই রকম থাকবে। যে সত্যিকারের ভালবাসায় আমার একটুও বিশ্বাস ছিল না, আমি ধরে নিয়েছিলাম সেই ভালবাসা নিয়ে সোহম আমার অপেক্ষায় থাকবে। সেদিন সে সত্যিই আমার অপেক্ষায় ছিল।
— "সোহম, এই পাহাড়টিকে তোমার মনে আছে?"
— "শুধু মনে রাখা ? আমার কাছে তো এই পাহাড়টাই ছিল, শ্রেয়সী।"
—"আর আমি ভেবেছিলাম, ভুলে যাব। ভেবেছিলাম, যদি একদিন আমাকে ছাড়াই তোমার দিন ভাল যায়, যদি একদিন তোমাকে ছাড়াই আমার ভোরের স্বপ্নগুলো দিন হয়ে যায়, আমি আবার এখানে ফিরে আসব। তোমাকে আয়োজন করে মিস করব।"
— “তারপর ?”
— “পারিনি। It hurts ! সোহম ! যতটা আমি নিতে পারব বলে ভাবতাম, তার চেয়ে কষ্টটা যে আমার অনেক বেশি ছিল।”
— "একটা কথা জানো শ্রেয়সী? মানুষ চাইলেই যেমন ভালবাসতে পারেনা, তেমনি চাইলেই ভুলে যেতে পারেনা। খুব বেশি হলে হয়ত অভিনয় করতে পারে।"
— “তুমি করোনি কেন – অভিনয়?”
— “জানিনা। তোমার অপেক্ষায় থাকতে আমার ভাল লাগত – আমি কি করতে পারি?”
ভোরের প্রথম আলোয় হঠাৎ করে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার দুচোখ অজান্তেই ভেসে যাচ্ছে।
— "সোহম! এতদিন পরে, আমি আবার নতুন করে ভালবাসতে শিখলাম কেন! বলতে পারো??......

............................

Debasish Talukdar



চন্ডীবাবু - দেবাশীষ তালুকদার

 

চন্ডীবাবু 
দেবাশীষ তালুকদার 
 
 
 
            চন্ডীবাবুর সাথে আমার পরিচয় রিকশায়। আমি রিকশার প্যাসেঞ্জার, আর তিনি চালাচ্ছেন। শোভাবাজার থেকে উঠেছি, মেসে ফিরবো। রিকশায় উঠলে রিকশাচালকদের সাথে কথা বলার পুরনো অভ্যাস আমার।
-- নাম কি আপনার?
-- আজ্ঞে চন্ডী দলুই।
-- আচ্ছা চন্ডীবাবু! আপনি যে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা চাইলেন, কাজটা কি ঠিক করলেন?
রিকশা চালাতে চালাতে পেছন ফিরে চন্ডী বাবু একবার অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবতঃ এই প্রথম কেউ তাকে বাবু সম্বোধন করলো।
-- শুরুতে বেশী চাওন লাগে। আমি ২০ টাকা চাইলে আপনে বলতেন ১০ টাকায় যাইবেন?
-- অন্যরা হয়তো বলতো কিন্তু আমি বলতাম না। আপনি ৪০ টাকা থেকে যে ২০ টাকায় নামলেন, এটা কি ঠিক হলো? আপনি হবেন গিয়ে এক কথার মানুষ! তাইনা! ২০ টাকা বলবেন, ২০ টাকাই। কথার নড়চড় হবে না....
আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধাক্কাটা লাগলো। ঠিক টাউন স্কুলের কাছে তেরাস্তায় বাম সাইড থেকে হঠাৎ করে আসা একটা স্কুটার ধাক্কা দিলো ঠিক রিকশার সামনের চাকা বরাবর। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ খুলে দেখি চন্ডী বাবু আরেকটু দূরে পড়ে আছেন। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তা লাল হয়ে গেছে। গোটা বাহান্নর মতো বয়স, মুখটা তখনো হাসি হাসি।
আমার কয়েক জায়গায় কেটে গেলেও সিরিয়াস কোন ব্যাথা পাইনি। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে চারদিকে ভীড় জমে গেছে। রাস্তার দুজনের সহায়তায় চন্ডীবাবু কে নিয়ে গেলাম আর.জি.কর মেডিকেলে। কাঁটাছেড়ার জন্য সামান্য ব্যান্ডেজ আর ব্যাথার ওষুধ দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু চন্ডীবাবুর অবস্থা গুরুতর। দু ব্যাগ রক্ত লাগবে। ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এক ব্যাগ আমি দিলাম, আরেক ব্যাগ জোগাড় করলাম।
চন্ডী বাবুর মোটামুটি সুস্থ হতে আট দিন লাগলো। প্রথম দুদিন আমিই ছিলাম পাশে, তৃতীয় দিনে ওনার স্ত্রী আর আট বছরের কন্যার খোঁজ পাওয়া গেলো। এর মধ্যে একটা ইনকোর্স পরীক্ষা, দুটো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। তারথেকে বড় কথা, চন্ডী বাবুর চিকিৎসার খরচ সাড়ে সাত হাজার টাকা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠে গেলো আমার। মেসে থাকি, টিউশনি করি। সাড়ে সতশো টাকাই অনেক টাকা, আর এখানে সাড়ে সাত হাজার। চন্ডী বাবুর স্ত্রী হাতের দুটো চুড়ি বিক্রি করে পাচ হাজার টাকা আনলেন, আমি ধারদেনা করে দেড় হাজার আনলাম। বাকি হাজার টাকা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মাফ করে দিলেন।
-
-- আপনে কি কামডা ঠিক করলেন কন তো?
-- কি করেছি?
-- আপনে অন্য রিকশায় উঠছেন ক্যান আজকে দুপুরে?
-- তাড়া ছিল একটু, আপনাকে ফোন করার মতো সময় ছিল না।
-- আমি চন্ডী বাঁইচা থাকতে আপনের ভাড়া দিয়া অন্য রিকশায় ওঠা বন্ধ। এস্টপ! ফিনিশ! কল করবেন, আমি উইড়া আসুম। দরকার হইলে প্যাসেঞ্জার মাঝপথে নামাই দিয়া চইলা আসুম।
 
        আমি হাসলাম। গত তিন বছর ধরে চন্ডীবাবু আমাকে নিয়ে রিকশা চালায়। সকালে মেসের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি কলেজে আসি। তারপর সে খেপ মারতে যায়। বন্ধুরা দেখে হাসে, কেউ কেউ টিপ্পনিও মারে। আমার ক্লাস রুটিন ওনার মুখস্ত। ক্লাস শেষ হলে বের হয়ে দেখি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গত তিন বছরে একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জরুরী কাজে কোথাও যেতে হলে ওনাকে ফোন করতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির। প্যাসেঞ্জার নিয়ে খুব দূরে কোথাও যান না, কাছাকাছিই থাকেন যাতে ফোন করলে সবসময় পাই। অন্য কোন রিকশায় উঠলে রাগ করেন, শিশুসুলভ অভিমান। এই যেমন আজকে। আমি অনেক মানা করেছি, কোন কিছুতেই তাকে মানানো যায়নি। এই ব্যাপারে প্রচন্ড একগুঁয়ে, একরোখা। কখনোই ভাড়া নেন না, কোনো ভাবেই নেওয়ানো যায় না।
বিকালে টিউশনিতে যাই। রাতে ফেরার পথে আমরা রিকশায় কলকাতা শহরের এদিক সেদিক ঘুরি। চা খাই। আড্ডা দিই। সত্যি বলতে তিন বছরে চন্ডীবাবু আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে গেছেন। মন খুলে গল্প করি ওনার সাথে। তিন বছরে চন্ডী বাবুর আর্থিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। গ্রামে জমিজমার বিবাদের জন্য সর্বস্ব হারিয়ে কলকাতায় এসে রিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে বিবাদ মিটেছে আমার এক পুলিস আত্মীয়র সহায়তায়। কিছু জমি বিক্রি করে কৃষ্ণনগরে মনোহারি দোকান দিয়েছেন, তার ছোটভাই চালায়। মাঝে মাঝে বলি,
-- চন্ডীবাবু, আর কতদিন রিকশা চালাবেন? টাকাপয়সা তো কামাচ্ছেন, এবার একটু আরাম করুন।
-- যতদিন বাঁইচা থাকি, রিকশা চালামু। আপনের রক্ত যতদিন আমার শরীলে আছে, আপনের জন্য রিকশা চালামু।
--মানুষের শরীরে রক্ত চার মাস বাঁচে। এরপর নতুন রক্ত তৈরী হয়। আমার রক্ত যা ছিলো, ফিনিস হয়ে গেছে এতোদিনে।
-- আপনেরে কইছে। দুই পাতা পইড়া বেশী জাইনা গেছেন? রক্ত আজীবন থাকে শরীলে।
আমি বোঝাতে গেলেই, তর্ক শুরু হয়...।
রাত বাড়ে। চন্ডীবাবুর সাথে কলকাতা শহর ঘুরছি আমি। আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শেখাই, গল্প করি। চন্ডী বাবু মনোযোগী শ্রোতার মতো শোনে। ডিপার্টমেন্টের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বান্ধবীদের গল্প, স্যারদের গল্প, টিউশনির গল্প। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন পড়ালেখা আর বিজ্ঞানেরও গল্প। গাউসের ছোটবেলার গল্প, এডিসন কিভাবে এডিসন হলো, আর্কিমিডিসের ইউরেকা, লাইবনিজের ক্যালকুলাস, ফার্মার লাস্ট থিওরেমের গল্প। চন্ডীবাবু কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করে,
-- এই যে মনে করেন আপনে রিকশায় বইসা আছেন। এখন আপনে পা দিয়া যতই ঠেলেন, রিকশা কিন্তু এক পাও সামনে যাইবো না। এইডা ক্যামনে হয়?
আমি তখন নিউটনের তৃতীয় সুত্র বোঝাই। চন্ডীবাবু উপহাসের হাসি হাসে।
-- আমি মাটিতে ঠেলা দিলে মাটিও আমারে ঠেলা দেয়? এইসব উল্টাপাল্টা ভুলভাল পড়াইয়া কলেজগুলা আপনেগো মাথাটা নষ্ট করতাছে।
আমরা চায়ের দোকানে দাঁড়াই, চা খাই। এই শহরের বেশীরভাগ চায়ের দোকানদার আমাদের চেনে। রাতে একটা পাগলা ধরনের কলেজের ছেলে আর এক রিকশাওয়ালা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আরেকটু রাত হলে চন্ডীবাবুর ঘরে যাই, ওনার মেয়েকে পড়াই। ওনার মেয়ের বয়স এখন এগারো, আমাকে দেখলে বাবার মতোই অভিমান করে। "কাকু, এতো দেরী করে আসো কেনো?"
-
-- আপনেরে একটা কথা বলুম। শোভাবাজার লঞ্চঘাটের সামনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন চন্ডীবাবু।
-- কি কথা?
-- আমার একটা শখ, আপনে যখন বিয়া করবেন, কোনো পেরাইভেট ভাড়া করবেন না। আমার রিকশাতে যাইবেন, আমার রিকশাতেই বউ নিয়া আসবেন। আমি টাকা জমাইছি, বিয়ার দিন নতুন রিকশা কিনুম। আপনাদের দুইজনরে নিয়া রিকশা চালামু।
-- বিয়ের দিন রিকশায়? বৌ তো কিপটা বলে বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
-- দিবো না। আপনার বউ আপনার মতোই ভালো হইবো। ওনারে আর আপনারে নিয়া রিকশায় বাইর হমু। আপনারা পিরিতের আলাপ করবেন, আমি কানে হেডফুন দিয়া রাখুম।
আমি হাসি চাপতে চাপতে বললাম,
-- চন্ডীবাবু, মনে করুন পড়ালেখা শেষে আমার বড়ো চাকরী হলো। অফিস থেকে তো গাড়ি দেবে। তখন তো গাড়িতে চড়তে হবে। তখন কি করবেন?
মূহুর্তে চন্ডী বাবুর মুখের হাসি চুপসে গেল। চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চোখের কোণে হালকা একটু জল চিকচিক করছে। আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। কথাটা বলাই উচিৎ হয়নি।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে চন্ডীবাবু মৃদু স্বরে বললেন,
— তাইলে আর কি করার, ডেরাইভিংটা শিখা লাগবো। এই মাসেই শুরু কইরা দেই! কি কন? এক ওস্তাদের লগে আমার চিনা-পরিচয় আছে। বাস চালানি শিখলে পেরাইভেটও পারুম, ঠিক কিনা?
আমি এবার হতম্ভব হয়ে যাই। এটাকে কি বলা যায়? ভালোবাসা? এই ভ্যালেন্টাইনদের যুগে, রিকশাওয়ালাদের চড় মারার যুগে এই ভালোবাসার স্থান কোথায়? আপনারা কি বলেন?
..........
 
Debasish Talukdar