চন্ডীবাবু - দেবাশীষ তালুকদার

 

চন্ডীবাবু 
দেবাশীষ তালুকদার 
 
 
 
            চন্ডীবাবুর সাথে আমার পরিচয় রিকশায়। আমি রিকশার প্যাসেঞ্জার, আর তিনি চালাচ্ছেন। শোভাবাজার থেকে উঠেছি, মেসে ফিরবো। রিকশায় উঠলে রিকশাচালকদের সাথে কথা বলার পুরনো অভ্যাস আমার।
-- নাম কি আপনার?
-- আজ্ঞে চন্ডী দলুই।
-- আচ্ছা চন্ডীবাবু! আপনি যে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা চাইলেন, কাজটা কি ঠিক করলেন?
রিকশা চালাতে চালাতে পেছন ফিরে চন্ডী বাবু একবার অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবতঃ এই প্রথম কেউ তাকে বাবু সম্বোধন করলো।
-- শুরুতে বেশী চাওন লাগে। আমি ২০ টাকা চাইলে আপনে বলতেন ১০ টাকায় যাইবেন?
-- অন্যরা হয়তো বলতো কিন্তু আমি বলতাম না। আপনি ৪০ টাকা থেকে যে ২০ টাকায় নামলেন, এটা কি ঠিক হলো? আপনি হবেন গিয়ে এক কথার মানুষ! তাইনা! ২০ টাকা বলবেন, ২০ টাকাই। কথার নড়চড় হবে না....
আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধাক্কাটা লাগলো। ঠিক টাউন স্কুলের কাছে তেরাস্তায় বাম সাইড থেকে হঠাৎ করে আসা একটা স্কুটার ধাক্কা দিলো ঠিক রিকশার সামনের চাকা বরাবর। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ খুলে দেখি চন্ডী বাবু আরেকটু দূরে পড়ে আছেন। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তা লাল হয়ে গেছে। গোটা বাহান্নর মতো বয়স, মুখটা তখনো হাসি হাসি।
আমার কয়েক জায়গায় কেটে গেলেও সিরিয়াস কোন ব্যাথা পাইনি। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে চারদিকে ভীড় জমে গেছে। রাস্তার দুজনের সহায়তায় চন্ডীবাবু কে নিয়ে গেলাম আর.জি.কর মেডিকেলে। কাঁটাছেড়ার জন্য সামান্য ব্যান্ডেজ আর ব্যাথার ওষুধ দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু চন্ডীবাবুর অবস্থা গুরুতর। দু ব্যাগ রক্ত লাগবে। ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এক ব্যাগ আমি দিলাম, আরেক ব্যাগ জোগাড় করলাম।
চন্ডী বাবুর মোটামুটি সুস্থ হতে আট দিন লাগলো। প্রথম দুদিন আমিই ছিলাম পাশে, তৃতীয় দিনে ওনার স্ত্রী আর আট বছরের কন্যার খোঁজ পাওয়া গেলো। এর মধ্যে একটা ইনকোর্স পরীক্ষা, দুটো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। তারথেকে বড় কথা, চন্ডী বাবুর চিকিৎসার খরচ সাড়ে সাত হাজার টাকা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠে গেলো আমার। মেসে থাকি, টিউশনি করি। সাড়ে সতশো টাকাই অনেক টাকা, আর এখানে সাড়ে সাত হাজার। চন্ডী বাবুর স্ত্রী হাতের দুটো চুড়ি বিক্রি করে পাচ হাজার টাকা আনলেন, আমি ধারদেনা করে দেড় হাজার আনলাম। বাকি হাজার টাকা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মাফ করে দিলেন।
-
-- আপনে কি কামডা ঠিক করলেন কন তো?
-- কি করেছি?
-- আপনে অন্য রিকশায় উঠছেন ক্যান আজকে দুপুরে?
-- তাড়া ছিল একটু, আপনাকে ফোন করার মতো সময় ছিল না।
-- আমি চন্ডী বাঁইচা থাকতে আপনের ভাড়া দিয়া অন্য রিকশায় ওঠা বন্ধ। এস্টপ! ফিনিশ! কল করবেন, আমি উইড়া আসুম। দরকার হইলে প্যাসেঞ্জার মাঝপথে নামাই দিয়া চইলা আসুম।
 
        আমি হাসলাম। গত তিন বছর ধরে চন্ডীবাবু আমাকে নিয়ে রিকশা চালায়। সকালে মেসের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি কলেজে আসি। তারপর সে খেপ মারতে যায়। বন্ধুরা দেখে হাসে, কেউ কেউ টিপ্পনিও মারে। আমার ক্লাস রুটিন ওনার মুখস্ত। ক্লাস শেষ হলে বের হয়ে দেখি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গত তিন বছরে একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জরুরী কাজে কোথাও যেতে হলে ওনাকে ফোন করতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির। প্যাসেঞ্জার নিয়ে খুব দূরে কোথাও যান না, কাছাকাছিই থাকেন যাতে ফোন করলে সবসময় পাই। অন্য কোন রিকশায় উঠলে রাগ করেন, শিশুসুলভ অভিমান। এই যেমন আজকে। আমি অনেক মানা করেছি, কোন কিছুতেই তাকে মানানো যায়নি। এই ব্যাপারে প্রচন্ড একগুঁয়ে, একরোখা। কখনোই ভাড়া নেন না, কোনো ভাবেই নেওয়ানো যায় না।
বিকালে টিউশনিতে যাই। রাতে ফেরার পথে আমরা রিকশায় কলকাতা শহরের এদিক সেদিক ঘুরি। চা খাই। আড্ডা দিই। সত্যি বলতে তিন বছরে চন্ডীবাবু আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে গেছেন। মন খুলে গল্প করি ওনার সাথে। তিন বছরে চন্ডী বাবুর আর্থিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। গ্রামে জমিজমার বিবাদের জন্য সর্বস্ব হারিয়ে কলকাতায় এসে রিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে বিবাদ মিটেছে আমার এক পুলিস আত্মীয়র সহায়তায়। কিছু জমি বিক্রি করে কৃষ্ণনগরে মনোহারি দোকান দিয়েছেন, তার ছোটভাই চালায়। মাঝে মাঝে বলি,
-- চন্ডীবাবু, আর কতদিন রিকশা চালাবেন? টাকাপয়সা তো কামাচ্ছেন, এবার একটু আরাম করুন।
-- যতদিন বাঁইচা থাকি, রিকশা চালামু। আপনের রক্ত যতদিন আমার শরীলে আছে, আপনের জন্য রিকশা চালামু।
--মানুষের শরীরে রক্ত চার মাস বাঁচে। এরপর নতুন রক্ত তৈরী হয়। আমার রক্ত যা ছিলো, ফিনিস হয়ে গেছে এতোদিনে।
-- আপনেরে কইছে। দুই পাতা পইড়া বেশী জাইনা গেছেন? রক্ত আজীবন থাকে শরীলে।
আমি বোঝাতে গেলেই, তর্ক শুরু হয়...।
রাত বাড়ে। চন্ডীবাবুর সাথে কলকাতা শহর ঘুরছি আমি। আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শেখাই, গল্প করি। চন্ডী বাবু মনোযোগী শ্রোতার মতো শোনে। ডিপার্টমেন্টের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বান্ধবীদের গল্প, স্যারদের গল্প, টিউশনির গল্প। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন পড়ালেখা আর বিজ্ঞানেরও গল্প। গাউসের ছোটবেলার গল্প, এডিসন কিভাবে এডিসন হলো, আর্কিমিডিসের ইউরেকা, লাইবনিজের ক্যালকুলাস, ফার্মার লাস্ট থিওরেমের গল্প। চন্ডীবাবু কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করে,
-- এই যে মনে করেন আপনে রিকশায় বইসা আছেন। এখন আপনে পা দিয়া যতই ঠেলেন, রিকশা কিন্তু এক পাও সামনে যাইবো না। এইডা ক্যামনে হয়?
আমি তখন নিউটনের তৃতীয় সুত্র বোঝাই। চন্ডীবাবু উপহাসের হাসি হাসে।
-- আমি মাটিতে ঠেলা দিলে মাটিও আমারে ঠেলা দেয়? এইসব উল্টাপাল্টা ভুলভাল পড়াইয়া কলেজগুলা আপনেগো মাথাটা নষ্ট করতাছে।
আমরা চায়ের দোকানে দাঁড়াই, চা খাই। এই শহরের বেশীরভাগ চায়ের দোকানদার আমাদের চেনে। রাতে একটা পাগলা ধরনের কলেজের ছেলে আর এক রিকশাওয়ালা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আরেকটু রাত হলে চন্ডীবাবুর ঘরে যাই, ওনার মেয়েকে পড়াই। ওনার মেয়ের বয়স এখন এগারো, আমাকে দেখলে বাবার মতোই অভিমান করে। "কাকু, এতো দেরী করে আসো কেনো?"
-
-- আপনেরে একটা কথা বলুম। শোভাবাজার লঞ্চঘাটের সামনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন চন্ডীবাবু।
-- কি কথা?
-- আমার একটা শখ, আপনে যখন বিয়া করবেন, কোনো পেরাইভেট ভাড়া করবেন না। আমার রিকশাতে যাইবেন, আমার রিকশাতেই বউ নিয়া আসবেন। আমি টাকা জমাইছি, বিয়ার দিন নতুন রিকশা কিনুম। আপনাদের দুইজনরে নিয়া রিকশা চালামু।
-- বিয়ের দিন রিকশায়? বৌ তো কিপটা বলে বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
-- দিবো না। আপনার বউ আপনার মতোই ভালো হইবো। ওনারে আর আপনারে নিয়া রিকশায় বাইর হমু। আপনারা পিরিতের আলাপ করবেন, আমি কানে হেডফুন দিয়া রাখুম।
আমি হাসি চাপতে চাপতে বললাম,
-- চন্ডীবাবু, মনে করুন পড়ালেখা শেষে আমার বড়ো চাকরী হলো। অফিস থেকে তো গাড়ি দেবে। তখন তো গাড়িতে চড়তে হবে। তখন কি করবেন?
মূহুর্তে চন্ডী বাবুর মুখের হাসি চুপসে গেল। চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চোখের কোণে হালকা একটু জল চিকচিক করছে। আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। কথাটা বলাই উচিৎ হয়নি।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে চন্ডীবাবু মৃদু স্বরে বললেন,
— তাইলে আর কি করার, ডেরাইভিংটা শিখা লাগবো। এই মাসেই শুরু কইরা দেই! কি কন? এক ওস্তাদের লগে আমার চিনা-পরিচয় আছে। বাস চালানি শিখলে পেরাইভেটও পারুম, ঠিক কিনা?
আমি এবার হতম্ভব হয়ে যাই। এটাকে কি বলা যায়? ভালোবাসা? এই ভ্যালেন্টাইনদের যুগে, রিকশাওয়ালাদের চড় মারার যুগে এই ভালোবাসার স্থান কোথায়? আপনারা কি বলেন?
..........
 
Debasish Talukdar 



Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by