নায়কী কানাড়া - গৌতম সাহা

 


নায়কী কানাড়া  
গৌতম সাহা
 

       বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক চটকলের অফিসে সামান্য চাকুরে সুধীরবাবু। অজাতশত্রু, ভালো মানুষ বলেই চেনে তাকে মানুষজন। আসাধারণ মেধা সম্পন্ন না হলেও পড়াশোনায় আর পাঁচটা ছাত্রদের থেকে খুব একটা পিছিয়েও ছিলেন না তিনি। সেই মাঝারিয়ানার সুবাদেই কলেজের গণ্ডি পেরিয়েই পাড়াতুতো কাকার সামান্য সুপারিশে পাওয়া এই চাকরি। স্ত্রী গৌরী প্রকৃত অর্থেই দেবী দুর্গার মতন। যেমন তার রূপ, তেমনি তার স্বভাব। অসম্ভব সুপুরুষ সুধীরবাবু যখন কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী গৌরীকে নিয়ে যান মানুষজন এই জুটিকে প্রশংসা না করে পারেন না। গৌরীও তার স্বামীকে নিয়ে গর্বিত। সুধীরবাবু যে শিল্পী। ছাত্রাবস্থাতেই কি করে যেন তার মাথায় গানের ভূত চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। অথচ এই বংশে গানের চর্চা যে তেমন ছিল তা নয়। সুধীরবাবু যে কী করে এই পথে চলে এলেন তা সবার কাছেই আশ্চর্যের। শুধু চলে এলেন না, নিজ অধ্যাবসায়ে, একনিষ্ঠ সাধনায় কিভাবে নিজেকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেটা সত্যিই কল্পকাহিনীর মতন।
ফুলশয্যার দিন নতুন বউকে কাছে নিয়ে সুধীরবাবু আর কী কী বলেছিলেন তা মনে করতে না পারলেও একটা কথা কোনদিন ভুলবেন না গৌরী।
-“তোমার এক সতীন আছে জানো তো?’’ অবাক বিস্ময়ে নতুন বউ এর লজ্জা আর দ্বিধা নিয়ে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন গৌরী। সেই সংশয় মাখা অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন সুধীরবাবু। হাত ধরে নববধূকে খাট থেকে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “চল, তোমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।’’ বলে হাত ধরে তাকে নিয়ে এসেছিলেন পাশের ঘরে। ঘরের কোণায় রাখা বিশাল আকৃতির এক তানপুরার সামনে দাঁড় করিয়ে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী কে বলেছিলেন সুধীরবাবু, “এই তোমার সতীন, নাও বন্ধুত্ব করে নাও।’’
 
      এই ব্যাপার! বাপরে বাপ, বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একেবারে! উনি যে শিল্পী, গান যে ওনার প্রাণ, এ তো জানে গৌরী। এলাকার মানুষজন সবাই চেনে ওকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা গায়ক হিসাবে। গৌরী তো বিয়ের সম্বন্ধের সময়েই জানে তা। তাও এমনভাবে ভয় দেখাতে হয়! রাগই হয়ে যায় গৌরীর একটু। কিন্তু নতুন বউ এর কি আর রাগ দেখানো সাজে! মুখে তাই রাগের ভাব না এনে মৃদু স্বরে বলে ওঠেন গৌরী, “আমি জানি, গান আপনার সবকিছু, সবাই আপনাকে আপনার গানের জন্য শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।’’
-“তুমিও নিশ্চয়ই চাইবে যে তোমার স্বামীকে সবাই এইভাবে শ্রদ্ধা করুক, সম্মান করুক।’’
 
      বুঝেছিলেন গৌরী। হাজার হোক, তিনিও অভিজাত পরিবারের কন্যা। কোন কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী তা বোঝার শিক্ষা তার আছে, বোধও। মুখ নিচু করেই আশ্বস্ত করেছিলেন তার স্বামীকে, “আমি আপনার সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। আপনি আগের মতই আপনার সাধনা নিয়ে থাকবেন, আমার জন্য কখনো আপনার এই সাধনায় বিঘ্ন ঘটবে না, আমি কথা দিলাম।’’
সংগীত অন্ত প্রাণ এক শিল্পীর কাছে তার স্ত্রী’র থেকে ফুলশয্যার দিনেই এর থেকে বেশী প্রাপ্তি কী থাকতে পারে! আপ্লুত হয়েছিলেন সুধীরবাবু। প্রথমদিনের সেই প্রাণে মধু ঢেলে দেওয়া আশ্বাস, তার পরে প্রকৃত অর্থেই তার সংসারকে মা দুর্গার মত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার সাধনার উৎকৃষ্ট বাতাবরণ প্রস্তুত করে দেওয়া- ভীষণরকম ভাবে ভালোবেসে ফেললেন তিনি তার স্ত্রী’কে। বছর ঘুরতেই গৌরীদেবীর কোল জুড়ে জন্ম নিল তাদের প্রথম পুত্র সন্তান। ভালোবেসে গৌরী তার নাম রাখলেন রামানুজ।
 
*******
 
       সুধীরবাবুর খ্যাতি তার বিবাহের পরে বেড়েই চলেছে। মফস্বলের একটু নামকরা যে কোন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে সুধীরবাবুর উপস্থিতি, সংগীত পরিবেশনা সেই আসরে অন্য মাত্রা যোগ করে। এই তল্লাটে তার সমকক্ষ শিল্পী খুব কমই আছে, এই নিয়ে শ্রোতৃমহলে কোন দ্বিমত নেই। অথচ কলকাতার শিল্পী মহলে তার বিশেষ কোন নাম নেই, পরিচিতিও। কারণ অবশ্য একটা আছে। সুধীরবাবু মূলত যার কাছে সংগীত শিক্ষা করেছেন সেই পন্ডিত দীনকর রাও এর সঙ্গে কলকাতার নামজাদা সকল শিল্পীরই এক অঘোষিত বৈরীতা আছে। কেন, তা অবশ্য জানেন না সুধীরবাবু। অনেকেই মনে করেন যে দীনকর রাওয়ের সাথে তারই গুরুভাই তথা কলকাতা সংগীত সমাজের পুরোধা শিল্পী কুলদারঞ্জন বাবুর এক ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণই দীনকর রাওকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। জানেন না ঠিক সুধীরবাবু। তবুও দীনকর রাও কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার পর তাঁরই গুরুভাই এর কাছে তালিম পাবার জন্য, তাঁর সান্নিধ্যে আসার জন্য এক বিশিষ্ট শুভানুধ্যায়ীর অনুরোধে তার সঙ্গেই কুলদারঞ্জন বাবুর কাছে গিয়েছিলেন সুধীর।
কলকাতার শিল্পীদের স্বভাবসুলভ তাচ্ছিল্যভরা ভঙ্গীতে করা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন সুধীর।
- “কার কাছে শেখা হয়েছে?’’
-“আজ্ঞে, পন্ডিত দীনকর রাও....।’’
-“ওহ, দীন-কর! তা বেশ। কী গাওয়া হয়? খেয়াল? নাকি দীনকর এর মতন ঠুংরি? হা হা হা হা।’’
 
       তাচ্ছিল্যভরা অট্টহাসিতে ভেসে গিয়েছিল বালিগঞ্জের সুবিশাল সেই বাড়ি। ভালো লাগেনি সুধীরবাবুর। হাজার হোক গুরুনিন্দা শুনে, গুরুর প্রতি অবহেলা দেখে তাঁর কাছে নতুন করে শেখার কিংবা শিক্ষার জন্য তদবির করতে মন সায় দেয়নি আর। আর কারো অনুরোধে তার শিল্পী সত্তাকে পদদলিত করে কখনো কলকাতায় যাননি তিনি। গানের ঘরোয়া আসরে ক্কচিৎ কদাচিৎ আমন্ত্রণ পেয়েছেন, গেছেন, গান গেয়ে মাত করে এসেছেন, কিন্তু অনুষ্ঠানের তদবির করতে কিংবা কারও কৃপা পেতে কলকাতা মুখো হননি তিনি। যা তিনি তার গুণ্মুগ্ধদের থেকে পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট। পাশাপাশি তিনি এটাও জানতেন যে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, আরো শিখতে পারলে ভালো হতো। মনে হতো আরো কোথায় শিখতে পারা যায়! কন্ঠসংগীতের আরো জটিল পথগুলোতে আলোকপাত কে করবে? কে দেখাবে আলো, কে চেনাবে পথ? কলকাতায় তো তার উপায় নেই, তাহলে তো কলকাতা ছাড়তে হয়! কিন্তু তার উপায় কোথায়? স্ত্রী, পুত্র, সংসার, চাকরী ফেলে তো আর অনির্দিষ্টের পথে পা বাড়ানো যায়না। সর্বোপরি, গৌরীকে ছেড়ে থাকবার কথা তিনি যে ভাবতেই পারেন না। তাই মনে ক্ষুধা থাকলেও যা পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন সুধীরবাবু।
 
*******
 
       কিন্তু শোভা কিছুতেই ছাড়বে না। এই আর একজন অদ্ভুত মেয়ে শোভা। টিটাগড় এর কেল্ভিনশন জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজারের স্ত্রী। নিজে ডাকসাইটে গাইয়ে। সবাই বলে তার গান চোখ বুজে শুনলে আখতারী বাঈ গাইছে না শোভা গাইছে এটা আলাদা করা যায়না। টালিগঞ্জের নামকরা ফিল্ম ডিরেকটরেরা অবধি শোভা গাঙ্গুলীকে দিয়ে কোনো গান গাইয়ে নিতে পারলে বর্ত্তে যান। কিন্তু সে গাইবে না। রেডিওর বি হাই আরটিস্ট সে। মুড নেই তো প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেওয়া তার কাছে কোন ব্যাপারই না। নিজে পারিবারিকভাবে রাজবাড়ির মেয়ে হওয়ায় রাজকীয় স্বভাব তার চলনে, বলনে কথাবার্তায়, আচার আচরণে। কাউকে সে পাত্তা দেয়না।
এহেন শোভা কিন্তু সুধীরবাবুর ভীষণ ফ্যান। একদিন তার বাড়ির এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সুধীরবাবু গাইলেন কৌশী কানাড়া। বড় প্রিয় রাগ তার এই কৌশী কানাড়া। বস্তুত যেকোন কানাড়া অঙ্গের রাগই তার প্রিয়। তার গুণমুগ্ধরা বলে, ‘কানাড়ার রূপ আপনার গলায় আরো বেশি খোলে’।
গঙ্গার ধারের সেই বিলাসবহুল বাংলোর প্রতিটা কোণ দিয়ে যেন ঝরে পড়ছিল কৌশী কানাড়ার অপূর্ব সুর।
"রাজন কে শিরতাজ"
প্রেম বিরহের অদ্ভুত মেলবন্ধনে কৌশী কানাড়ার সুর আর গঙ্গার দিক থেকে মৃদু মন্দ ভেসে আসা শীতল বাতাস কী যে স্বর্গীয় বাতাবরণ তৈরী করেছিল তা একমাত্র সংগীতের ঈশ্বরই জানেন। মাঝ খামাজে ঠুংরী গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন সুধীরবাবু।
সবার শেষে গাইবার কথা শোভা দেবীর। তিনিই এই অনুষ্ঠানের আয়োজক, উদ্যোক্তা, তিনিই শেষ শিল্পী। কিন্তু শোভা নিজে বেঁকে বসলেন। বললেন, “সুধীরদা’র এই গানের পরে আজ আমি আর গাইতে পারবো না।’’
শোভার এই রাজরাণীর মতন স্বভাব ও মেজাজ সম্বন্ধে সবাই ওয়াকিবহাল। কারো সাহস হলো না আর কিছু অনুরোধের। সময়ের আগেই এলাহি রাত্রিকালীন ভোজনের সূচনা করা হল। সবাই যখন ওই রাজকীয় ভোজনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত, হাতে পানীয়ের গ্লাস নিয়ে সুধীরকে গঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন শোভা। গঙ্গার দিকে মুখ করে রাখা লোহার বেঞ্চে বসে সুধীরের একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে ঈষৎ জড়ানো গলায় বললেন তিনি, “তোমাকে যদি এই জগতের কাছে বিখ্যাত না করে যাই সুধীর’দা, আমার নাম তবে শোভা গাঙ্গুলী নয়। সারা দেশের মানুষের কাছে তোমার নাম আমি পরিচিত করে যাবো।’’
ভয় পেলেন সুধীর। তিনি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। বড়লোকের মতিগতি তিনি বোঝেন না, তাদের কথার অর্থও। দ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। কী বলবেন এই অপূর্ব মোহময়ী নারীর কথার উত্তরে! বোঝেন না সুধীর, চুপ করে থাকেন।
 
*****
 
       ফ্যাক্টরী থেকে সবে ফিরেছেন সুধীর। গোধূলির আলো মেখে গেটের বাইরে ছাই রঙা বিরাট একটা কন্টেসা এসে দাঁড়ালো। ঊর্দি পরা ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সুধীরের হাতে একটা চিরকূট ধরিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুই বুঝতে পারলেন না সুধীর, শুধু পড়লেন, ‘তানপুরাটা শুধু সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
শোভার হুকুম। ইতস্তত করেন সুধীর। গৌরীর সাথে শোভাকে নিয়ে বহুবার তার কথা হয়েছে। আজ অবধি গৌরী কোনদিনও সুধীরের কোন মহিলা গুণমুগ্ধা, ছাত্রী কিংবা অতি উৎসাহী মহিলা শ্রোতাকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। তবুও কেমন যেন বাধো বাধো লাগে সুধীরের। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসেন গৌরীই। সমস্ত বিষয়টা যেন চোখের পলকে বুঝে ফেলেন তিনি। আলমারি থেকে পাটভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবী স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে চোখের তারার ইশারায় বুঝিয়ে দেন, “যাও।’’ কৃতজ্ঞতায় মনটা আর্দ্র হয়ে যায় সুধীরের। গৌরীকে কি বলবেন ভেবে পাননা তিনি, শুধু এক মুহূর্তের জন্য তার হাতটা আঁকড়ে ধরেন গভীর ভরসায়।
অন্যদিনের মতন নয় আজ এই গঙ্গার ধারের বিশাল বাংলো। কেমন যেন একটু চুপচাপ, বাইরের পোর্টিকোয় দুটো বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। কী গাড়ি কে জানে! কেউ কি এসেছে? শোভার যা পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান তাতে কোন এস্টেটের মহারাজার পরিবারের লোকের আসাটাও আশ্চর্যের নয়। সুধীরকে তলব কি তাহলে তেমন কোন বিশিষ্ট অতিথিকে গান শোনাবার জন্য? বুঝতে পারেন না সুধীর।
 
       সামনের বিশাল সেগুন কাঠের মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে তানপুরা হাতে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে দৌড়ে এল শোভা। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল গঙ্গার দিকের একটা বড় মাপের ঘরে। ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যান সুধীর। ঘর জুড়েই ফরাশ বিছানো, অথচ কোন শ্রোতা নেই। এক প্রান্তে তাকিয়া শোভিত মঞ্চের আদল! অবাক বিস্ময়ে শোভাকে প্রশ্ন করতে যান সুধীর। মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেন শোভা। ফিসফিস করে বলেন, ‘একজনের সামনে তোমাকে গান গাইতে হবে সুধীর’দা, আমার মান রাখতে হবে আজ। আমি তাঁকে বলিনি এখনও যে এমন একজন শিল্পীর গান শোনাবো তাঁকে যে তিনি চমকে যাবেন।’
কেমন যেন সামান্য নার্ভাস হয়ে যান সুধীর। এমনিতে তার এই দোষ নেই, তানপুরা নিয়ে বসলে তিনি খুব তাড়াতাড়িই আত্মস্থ হয়ে যান। কিন্তু আজ কেন জানি একটু সংশয়েই পড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘কে তিনি?’
-‘তুমি তাড়াতাড়ি তানপুরা বেঁধে নিয়ে গান তো শুরু কর। আমি চাই তোমার গান তাঁকে টেনে নিয়ে আসুক এখানে’।
শোভা’র মুখের চাপা উত্তেজনাও নজর এড়ায় না সধীরবাবুর। ইতিমধ্যেই গুটিগুটি পায়ে কয়েকজন সংগীতপীপাসু পরিচিত, অপরিচিত মানুষজন ঘরে প্রবেশ করেছেন, লক্ষ্য করেন সুধীর। তারাশঙ্কর তার সাথে তবলা সঙ্গত করে। অবাক বিস্ময়ে তবলার ব্যাগ হাতে তাকেও ঘরে ঢুকতে দেখেন সুধীর।
একটা ছোটখাট সংগীত সভার আয়োজন করা হয়েছে চুপিচুপি, হয়ত কিছুটা তড়িঘড়ি করেই, অথচ তার কোন আগাম ফরমান নেই। অবাকই হন সুধীর। বেশ কিছু পরিচিত শ্রোতাদের উপস্থিতিতে আর তিনি নতুন করে ভাবেন না কিছু। প্রশ্ন করেন, “কিছুই তো প্রস্তুতি নেই নি, কী গাই বলো তো?”
-“সেদিনের সেই কৌশী কানাড়াই গাও।” আবদার করে শোভা।
মাটিতে শোয়ানো তানপুরা কোলে তুলে নেন সুধীর। খড়জের তারকে সামান্য মোচড়ে সূক্ষ্ম ভাবে ডি শার্পের সা তে মিলিয়ে নিতে নিতে বলেন, “আজ কৌশী না, নায়কী কানাড়া গাইবো।” শিল্পীর চোখের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত শ্রোতারা বুঝতে পারেন, আত্মস্থ হচ্ছেন সুধীর; সুরের রঙে ভাব মিশিয়ে নায়কী কানাড়াকে প্রতিষ্ঠা করা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অনতিদূরে গঙ্গার পাড়ে রাসমণির ঘাটে তখন সন্ধারতি শেষ হয়েছে। কালো চাদরে মুড়ে রাত্রি নেমেছে গঙ্গার উপরে।
"ক্যায়সে সমঝাউ তনরঙ্গওয়া"
 
        সুরের মোচড়ে উথাল পাথাল হয়ে উঠছে এই পুরনো দিনের বাংলো বাড়ি। সুধীরকে যেন আজ কোন এক অতিপ্রাকৃত শক্তি ভর করেছে। সুধীরের গলায় নায়কী কানাড়া আজ অবধি কেউ শোনেন নি তার পরিচিতরা। শুনেছেন আভোগী কানাড়া, কৌশী কানাড়া। দরবারি কানাড়া তো অজস্রবার। কিন্তু নায়কী কানাড়া? জীবনে এই প্রথম। প্রথমবারেই জীবনে প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া নায়কী কানাড়ায় মাতিয়ে দিলেন তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের। সুরের বিস্তারে রাগের রূপকে প্রতিষ্ঠা করে তার সপ্তকের সা তে স্থিত হচ্ছিলেন সুধীর। বিলম্বিতের অন্তরার মুখটাকে ধরার পরিকল্পনা করে এগোচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এই সময় ঘরের বাইরে যেন একটু মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। অন্তরার গানের মুখ ধরতে গিয়েও পিছিয়ে এলেন সুধীর, সামান্য সময়ের জন্য মনোসংযোগ ছিন্ন হল।
-“কৌন গা রাহা হায়, কৌন গা রাহা হায়” বলতে বলতে টলোমলো পায়ে যিনি ঘরে ঢুকলেন তাকে দেখে সুধীর একা নয়, থমকে গেলেন উপস্থিত সক্কলে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কারো, কে ইনি? ঠিক দেখছি তো? মৃদু, অতি মৃদু ফিসফাস এর আওয়াজও থেমে গেল যখন পরিপূর্ণ মদিরার পাত্র হাতে সুধীরের সামনে প্রায় তিন হাত দুরত্বে এসে পা গুটিয়ে বসে পড়লেন ওই বিস্ময় আগন্তুক। মাথা ঝোকানো সেই পরিচিত ভঙ্গীতে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন, “গা বেটা, গা, বহুত আচ্ছা, গা...”।
 
*******  
 
        ঘুম আসছে না আজ সুধীরের কিছুতেই। যেন এখনও ঘোরের মধ্যে আছেন। সামনে বসে আছেন তার অন্যতম সংগীত দেবতা পন্ডিত ভীমরাও যোশী, আর তিনি তার সামনে গাইছেন! আর পন্ডিত যোশী সুরের দ্যোতনায় “ওয়া ওয়া”, সাপাট তানের বিদ্যুৎ গতির ছোবলে “কেয়া বাত কেয়া বাত” করছেন!
তার পরে যা ঘটল তা তো তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। সত্যিই কি এমন ঘটেছিল? কী করে সম্ভব হল এটা! বিলম্বিত শেষ করে তিনি দ্রুতের খেয়াল এ যাবেন ভাবছেন, হাতের পাত্র কে একটু দূরে সরিয়ে রেখে পন্ডিতজি বলে উঠলেন, “ইয়ে তো নায়কী কানাড়া হ্যায়, অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”।
আর এক ধরণের নায়কী কানাড়া শুনালেন পন্ডিতজি। দশ মিনিট। সুরের চলনের পৃথক রাস্তায় হেঁটে আবার ফিরে এলেন সুধীরের গাওয়া নায়কী কানাড়ায়, দুই একটা ছুট তান করে গানের খেই ধরিয়ে দিলেন সুধীরকে। অনির্বচনীয় এক স্বর্গীয় পরিবেশের সাক্ষী হয়ে থাকলেন উপস্থিত গুটিকয়েক শ্রোতা। রাজরাণীর মত যার চালচলন সেই শোভার চোখের কোণেও আনন্দাশ্রু চিকচিক্ করে উঠলো।
*****
খাটের উপরে কি শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে গৌরী! পাশে তার ছেলে । মায়ের বুকের ভিতর মুখ গুঁজে সেও গভীর নিদ্রামগ্ন। ঘুমোতে পারছেন না একমাত্র সুধীর। বাড়ি ফিরে গৌরীকে সবিস্তারে গল্প করেছেন আজকের ঘটনা। গৌরী ভীষণ খুশী হয়েছে, কিন্তু গৌরী জানেননা এই ঘটনার প্রকৃত অনুভূতি কেমন! সারা দেশ যাঁর গানে মোহিত হয়ে থাকে সেই জগতবিখ্যাত পন্ডিত ভীমরাও যোশী তার সাথে নায়কী কানাড়ার সুর মিলাচ্ছেন, গাইছেন একই বন্দিশ! একসাথে! তাকে বলে দিচ্ছেন, “অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”! গৌরী যতই তার গানের সমর্থক হোক, এই অপার্থিব অনুভূতির যে সূক্ষ্মতা তা সে ধরতে পারবে না। সুধীরের গায়ে যে লেগে আছে পন্ডিতজির আলিঙ্গনের স্পর্শ! গান শেষ হতেই নিজে থেকে উঠে এসে সুধীরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। অনেক আশীর্বাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি সুধীরকে বলে উঠলেন, “তু মেরে পাশ চলা আ, পুনে মে। ওয়াহা ম্যায় তুঝকো আউর শিখাউঙ্গা। সারা দেশ তুঝে পহেচানেগা”।
গৌরীর নিদ্রামগ্ন, পবিত্র, দেবীর মতন মুখটাকে আবার দেখেন সুধীর। দেখেন ছেলের কচি কচি হাত দুটিকে। আবার মনে পড়ে সেই জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বরের নির্দেশনা।
“নৌকরী?! মা সরস্বতী কা আশীর্বাদ জিসকে উপর হ্যায়, উনহে নৌকরী কি ফিকর হোনা নেহি চাহিয়ে। নৌকরী ওয়াক্রী ছোড়, পুনা চলা আ, মেরে পাস...”।
বড় দ্বন্দ্বে পড়ে যান শিল্পী। কী করবেন তিনি! কোন পথে হাঁটবেন! উত্তর খুঁজে পান না। নিদ্রামগ্ন মা আর ছেলের ওই পবিত্র দৃশ্য তাকে বিহবল করে তোলে।
না, না, এ মহা পাপ হবে। তার নাম, তার খ্যাতির জন্য এদেরকে ছেড়ে সুদূর পুনা চলে যাওয়া ঘোর অন্যায় হবে। এই অন্যায় করতে পারবেন না সুধীর। নাই বা হল তাতে তার দেশজোড়া নাম!
খাটের পাশ থেকে আস্তে নেমে দাঁড়ান সুধীর। যে পাঞ্জাবী পরে তিনি আজ গাইতে গেছিলেন তা ঝোলানো ছিল দেওয়ালে সাঁটা সাবেকী ডায়মন্ড আকৃতির কাঠের হুকে। সেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে আনলেন সুধীর। দেখলেন ওই রাতের আবছায়াতেও। পন্ডিত ভীমরাও যোশীর নিজের হাতে লিখে দেওয়া তাঁর পুনা’র বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কাগজটা মাথায় ঠেকালেন তিনবার। দেওয়াল আলমারি খুলে ভাতখন্ডেজির বই বের করে নায়কী কানাড়ার পাতা টা খুললেন। কাগজের টুকরোটা সেই পাতায় রেখে বই বন্ধ করে আলমারিতে তুলে রাখলেন সুধীরবাবু।
 
******* শেষ *******
Goutam Saha