হাসির গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
হাসির গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

কেশ কাহিনী - জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি

 

কেশ কাহিনী
 জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি 
 

 
 

 'উরেব্বাস '- 
যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেলাম একটা । গভীর ঘুম থেকে একেবারে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বসেছি বিছানায় । এসিটা বাইশে চলছে তবু গলা-কপাল ঘামে জবজব করছে । ঘড়িতে পাঁচটা ,তার মানে ভোর হয়েছে । ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! এমন দুঃস্বপ্ন হলেও কী সত্যি হয়! ইতিপূর্বে ভুরিভুরি দুঃস্বপ্ন দেখেছি । বলতে গেলে দুঃস্বপ্নের ভাঁড়ার আমার পরিপূর্ণ । শুধু কামিজ পরে  সালোয়ার না পরে বিয়েবাড়ি চলে যাওয়া ,  ভূগোল পরীক্ষার দিন রুটিন ভুলে জীবন বিজ্ঞান পড়ে গিয়ে খাতায় ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আঁকা,  সর্বসমক্ষে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়া ইত্যাদি ভ্যারাইটিস দুঃস্বপ্ন আমার দেখা আছে । কিন্তু 'আজি এ প্রভাতে ' এ কেমনতর দুঃস্বপ্ন দেখলাম!  অবশ্যি এর পিছনে একটা গূঢ় কারণ আছে । কোনো অবচেতনের চিন্তাভাবনা নয়,  চেতনস্তরেই এর কারণ ঘোরাফেরা করছে । 
কোনোকালে আমি যে কাজ করি না,  কাল সে কাজ করেছি । রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঘন্টাখানেক ধরে ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে,  ইনিয়ে-বেনীয়ে,  ফুল-মালা জড়িয়ে একলক্ষ রকমের চুলবাঁধা দেখেছি । যে মানুষের আজীবন একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেল করা ছাড়া ভাগ্যে আর কিচ্ছু জুটল না তার কী অতোরকম হেয়ার স্টাইল পেটে সয়,  থুড়ি মনে সয়! সইলো না । হেয়ার স্টাইল, হেয়ার-ফল হয়ে দুঃস্বপ্নে হানা দিল । যত চুল আঁচড়াই,  ততো ওঠে,  উঠতে উঠতে শেষে মাথা ফাঁকা আর স্বপ্নের ইতি ।

        তড়িঘড়ি খাট থেকে নেমে বড়ো আলোটা জ্বালিয়ে মাথাটা ভালো করে আয়নায় দেখলাম । নাঃ,  যে কুড়ি-পঁচিশটা নিজেদের মধ্যে দুগজ দূরত্ব মেনটেন করে বসে ছিল,  তেমনই বসে আছে । একেবারে সমূলে বিনাশ হয় নি । দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি,  একসময় কী চুল ছিল আমার ! ফিমাসে বাবা বিশু নাপিতের সেলুনে চুল কাটাতো । বয়স্ক বিশু জেঠু বাটিছাঁট দিতে দিতেই হাঁপিয়ে যেত । ক্লাস এইটে উঠে দেখলাম বন্ধুদের চুল কোমর সইসই । অতএব শখ গেল,  আমিও চুল রাখবো । বাটি ছেড়ে দোকান থেকে ফিতে কিনে আনলাম । কাকিমা অ্যায়সা টাইট করে চুল বেঁধে দিতে লাগলো যে মাথাময় আঁটফোঁড়া বেরিয়ে গেল । তাও সহ্য করলাম । বৃহত্তর সুখের জন্য ক্ষুদ্র কষ্ট মেনে নিলাম । ফনফন করে চুল বাড়লো,  মাধ্যাকর্ষণের টান অগ্রাহ্য করে সোজা আকাশের দিকে উঠে পড়লো । অন্যদের যেখানে বেনী খুললে চুল ঝমর করে পিঠে পড়ে,  আমার সেখানে উর্দ্ধমুখী । ছোট্ট বৃত্তাকার মুখের উপরিভাগে রাশি রাশি তারকা রাক্ষসীর মতো চুল । আচিরেই নাম জুটল- কাঠির মাথায় আলুর দম । পুজোপার্বনেও শ্যাম্পু করে বেরোতে পারি না । আয়নায় মুখ দেখলেই মনে হয় যেন মা চামুন্ডা । কোনোরকমে রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুলের পুঁটুলি বেঁধে মা দুর্গার সামনে গিয়ে জোড়হস্তে প্রার্থনা করি-
"মা চুলের ভার কমিয়ে গায়ে একটু গত্তি লাগিয়ে দাও !"
পাড়া-প্রতিবেশী,  আত্মীয়-কুটুম সবাই বলে- 
"যা খায় , পুষ্টি সব চুলেই টেনে নেয়,  শরীরে কিছু লাগে না ।"
প্রত্যেক প্রার্থনার তাই কমন টপিক-
"চুল একটু কমিয়ে চেহারাটা একটু শুধরে দাও মা "

প্রার্থনা মঞ্জুর হল কিন্তু যখন হওয়ার তখন না হয়ে একযুগ পরে হলো । এত্ত সিরিয়াসলি মা অবশেষে আমার প্রার্থনা শুনলেন যে কহতব্য নয় । চেহারা বাড়তে লাগলো যে রেটে,  হু হু করে চুলও উঠতে লাগলো সেই রেটে । তখনো ব্যালেন্স ছিল না,  এখনো ব্যালেন্স রইলো না । এখন কোমরে পেটে কেজি কেজি মেদ,  মাথায় দু-চারটে চুল । সামনের পুজোয় বোধকরি ও কটাও থাকবে না । টাক মাথায় প্রার্থনাহীন ঠাকুর  প্রণাম করতে যাবো । যা স্বপ্ন দেখলাম তাতে তো আশঙ্কায়  সিলমোহর পড়ে গেল ।

      ঐ যে কথায় আছে না- morning shows the day,  morning -এর স্বপ্নও তেমনি সারাদিনটাকে তেতো করে দিয়েছে । অফিসে গিয়ে তোম্বামুখে ফাইলের পাতাগুলো নাড়াচাড়া করা দেখে পাশের টেবিলের লাবণি দি জিজ্ঞেস করলেন-
"কী হয়েছে রে তোর্সা? মুড অফ,"
ভীষণ চোখ ভদ্রমহিলার । কী আর বলবো!-
"নাঃ,  তেমন কিছু না । ঐ একটা বাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ ।"
"বাজে স্বপ্ন? খুব খারাপ কিছু? ভোরবেলা দেখেছিস নাকি?"
অগত্যা বলতেই হয় । গড়গড়িয়ে বলে আমারও মনটা একটু হাল্কা হয়  ।ভেবেছিলাম উনি হাসবেন কিন্তু দেখি কিনা উনি ওঁনার ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা কার্ড বের করে দিলেন-
"নে,  অনেক তো বিউটি পার্লার ঘুরলি,  এবার ডাক্তার দেখা ।"
"ডাক্তার !" চশমাটা চোখে আর একটু এঁটে কার্ডটা দেখি---
             Dr. Ruchira Roy
            MBBS, MD(Dermat)
          Dermatologist,  Cosmetologist
         For appointment contact- 

"ফোন করবো?"
"হ্যাঁ,  কর ।"
" আজই?"
" হ্যাঁ,  মঙ্গলে ঊষা,  বুধে পা । আজ বুধবার । দেরি কীসের?"
"নেবো অ্যাপয়েন্টমেন্ট?"
'অবশ্যই,  যদি না স্বপ্ন সত্যি করতে চাস ।"
লাবণি দির কথায় বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে আমার । তাড়াতাড়ি ফোন লাগাই । পনেরোশো টাকা গুগল পে করে অ্যাপো ফিক্সড করি । আগামী রবিবার,  বেলা সাড়ে দশটায় । বলেই দিল- টাইম নিয়ে যেতে ।
"রবিবার লাবণি দি ।"
"বেশ । খুব নাম শুনি । দেখ তোর উপকারই হবে ।"

       বুধবার থেকে রবিবার ঠিকই এসে যায় । কলার কাঁদির মতো চুল টিকটিকির লেজের মতো হয়ে যায়,  এক্স এস সাইজ ডাবল এক্স এল হয়ে যায় আর বুধবার থেকে রবিবারের দূরত্ব আর কতটুকু । ঠিক সাড়ে দশটায় ক্লিনিকে হাজির হই । কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি । চারখানা এসির হাওয়ায় ভিতরটা যাকে বলে- 'চিল্ড'। আলো পিছলে যাওয়া ঝকঝকে টাইলসের মেঝের উপর সারি সারি স্টিলের চেয়ারে অপেক্ষমান বেশ কয়েকজন । আমি সোজা রিসেপশনের সামনে যাই,  নাম বলি । হাস্যমুখী রিসেসশনিস্ট বাকির পাঁচশো টাকা নিয়ে বলেন-
"বসুন "
"সাড়ে দশটায় টাইম ছিল।"
"হ্যাঁ,  ম্যাডাম এখোনো আসেননি । আপনি দশ নম্বরে আছেন ।"

ও বাবা ! তারমানে এখন দীর্ঘ অপেক্ষা । চেয়ারে গিয়ে বসি । আশেপাশে চকচকে স্কিন,  ঝকঝকে একঢাল চুলের মহিলাদের অপেক্ষারত দেখে মনে ভরসা পাই যে বোধহয় ঠিক জায়গাতেই এসেছি । পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষণে বেশ কিছুটা সময় কাটার পর ভিতরে আসার কাঁচের দরজাটি খুলে একজন অত্যন্ত সুন্দরী যুবতী ঢোকেন । বয়স আন্দাজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে । রিসেসশনিস্টের তৎপরতা দেখে বুঝি ইনিই ডাক্তার । পায়ে কালো হাইহিল জুতো,  নীল জিন্স,  সাদা শার্ট,  চোখে চৌকোনা কালো ফ্রেমের চশমা কিন্তু এ কী! ভুল দেখছি নাকি! মাথায় তো উইগ মানে পরচুলা । রঙবাহারি কিন্তু পরচুলা । আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয় । দুনিয়াসুদ্ধ লোকের চুল দেখে বেড়াই আমি । এ পরচুলা না হয়ে যায় না । 
এ কী ডাক্তার দেখাতে এলাম আমি! চুল ওঠার চিকিৎসা করাতে এলাম যার নিজেরই মাথায় পরচুলা তার কাছে!

      পৃথিবীটা দুলে ওঠে আমার । চেয়ারে বসে বসেই মনে হয় এবার পড়ে যাবো । চোখদুটো ঝাপসা ঝাপসা লাগে । একটা মাত্র খড়কুটো পেয়েছিলাম তাও ভেসে গেল । লাবণি দি তো জানে না হেন জিনিস নেই অথচ এটা জানতো না! ধুর ছাই কী হবে আর ডাক্তার দেখিয়ে! চলে যাবো? টাকা তো আর ফেরত দেবে না । দু হাজার টাকা! থাক,  টাকা দিয়েছি যখন দেখিয়েই যাই । দেখি ডাক্তার কী বলে!
     গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে থেকে অবশেষে ডাক আসে । লাল আঁচিলের সমস্যা নিয়ে ঢোকা একজন ধবধবে ফর্সা মারোয়াড়ি ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসবার পর আমি চেম্বারে ঢুকি । সুসজ্জিত একটা ছোট্ট ঘর । ঘরের উজ্জ্বল আলো ছাপিয়ে ডাক্তারের হাসিমুখ আমাকে অভ্যর্থনা জানায়-
"বসুন । কী সমস্যা?"
আবার হতাশা ফিরে আসে আমার মনে । বলে আর কী হবে? তবু বলি-
"চুল উঠছে খুব ।"
"ওঃ" - বলে সোজা আমার দিকে উঠে আসেন । মাথাটা ধরে নেড়েচেড়ে,  চুলের গোড়ায় গোড়ায় আঙুল চালিয়ে দেখে নিজের সিটে গিয়ে বসেন ।

" হ্যাঁ । বেশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে মাঝখানটা । আমি ওষুধ আর একটা শ্যাম্পু দিচ্ছি । কাজ না হলে অন্য থেরাপি স্টার্ট করবো ।"
"আদৌ কিছু হবে?"
"মানে?"
"মানে আদৌ কী কিছু হবে? হলে কী আর আপনি পরচুলা পরতেন ।"
"ওঃ, এই ব্যাপার, বুঝে ফেলেছেন "- বলে হাসতে হাসতে উনি পরচুলাটা খুলে ফেলেন । কী সুন্দর করে কাটা মাথাভর্তি ছোট্ট ছোট্ট চুল ওঁনার । হাঁ হয়ে যাই আমি-
"পরচুলা পরেছেন কেন?"
"স্টাইল করে পরেছি । অনেক বড়ো চুল ছিল যখন পরতে পারতাম না । এখন চুলটা কাটার পর একটু ট্রাই করেছি ।"
"চুলটা কাটলেন কেন?"
"আসলে আমার এক বন্ধুর একটা এন জি ও আছে । ওরা ক্যান্সার পেশেন্টদের জন্য উইগ বানায় আসল চুল দিয়ে । সেগুলো দেখে আপনিও বুঝতে পারবেন না ।"
ওঁনাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠি-" আমিও কী চুল দিতে পারি? এ তো মহান কাজ।"
"আপনি? হ্যাঁ,  তা পারেন বৈকি । "
"তাহলে ঠিকানাটা একটু লিখে দিন ।"
"আচ্ছা , বেশ ।"
" চুল ছোট করে কাটলে তো চুল ওঠাও কমে,  তাই না "
চোখের এককোনায় হাসির ঝলক খেলে যায় ওঁনার-
"হ্যাঁ তা কমে,  অবশ্যই কমে ।"
তড়বড় করে আমি বলে উঠি-
"আর উইগটা কোথা থেকে কিনেছেন তাও লিখে দেবেন ।"
"কেন?"
"বলা তো যায় না,  যদি দরকার পড়ে।"
"না,  না,  আমি থাকতে দরকার পড়বে না ।"- বলে প্রাণখুলে হাসতে থাকেন ডক্টর রুচিরা ।
   লোকে বলে- কেশই নাকি বেশ,  কেশেই যাবতীয় সৌন্দর্য । ভুল,  একদম ভুল । আসল সৌন্দর্য নিহিত থাকে হাসিতে,  প্রাণখোলা হাসিতে ।।
.............................
                              সমাপ্ত 
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 


হারাধনবাবুর ভুঁড়ি কিসসা - দেবাজীব সরকার

 

হারাধনবাবুর ভুঁড়ি কিসসা
দেবাজীব সরকার


 

 হারাধনবাবুর ভুঁড়ি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গত কয়েক মাসে যত পরিমাণ ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট শরীরের ভেতরে গেছে, তার বেশিরভাগই সঞ্চয় হয়েছে, খরচ করার সুযোগ পান নি। এই শেষ দশদিনে হারাধনবাবুর তিনখানা প্যান্টের কোমর তিন ইঞ্চি করে বাড়ানোর পর গিন্নির যত রাগ গিয়ে পড়ে হারাধনবাবুর ঐ নাদুস নুদুস ভুঁড়ির ওপর।
--- খালি পড়ে পড়ে ঘুমোবে আর ভুঁড়ি বাড়াবে, এ ছাড়া আর কোনো কাজ আছে তোমার? এই বলে দিলুম, আর কোনো প্যান্টের কোমর বাড়াতে পারবো না, যদি ভুঁড়ি না কমাও, তোমার একদিন কি আমার একদিন।

গিন্নির এই রণচন্ডী হুঙ্কারে ভালোমানুষ হারাধনবাবু বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ভুঁড়ি কমানোর উপায় খুঁজতে শুরু করলেন।   বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এলো ভুঁড়ি কমানোর হাজার একটা উপায় । কেউ বললো, হাঁটতে শুরু করো, কেউবা বললো দৌড়ও। আবার এই বয়সে কেউ সাইকেল চালানোর বুদ্ধিও দিলো। কিন্তু হারাধনবাবুর কোনোটাই মনঃপূত হলো না, সাইকেল তো নয়ই। কারণ এই বয়সে নতুন করে সাইকেল চালানো শিখবেন, এটা ভাবতেই গায়ে জ্বর এলো। আসলে হারাধনবাবু একটু সুখী টাইপের মানুষ তো, ওনার আবার ভুঁড়ি কমানোর জন্য এত পরিশ্রম সহ্য হবে না। আর এটাও হারাধনবাবুর মাথায় এলো, এই বয়সে সাইকেল চালানো শিখলে পাড়ার লোকে আবার না মাথার ব্যামো ভেবে বসে। অনেক আলোচনার পর তারাপদবাবু বললেন, -"শোনো হে হারাধন, এতকিছু না ভেবে পাশের পাড়ার "সাধনা জিম ও যোগ ব্যায়াম কেন্দ্র" তে ভর্তি হয়ে যাও । যোগ ব্যায়ামে মন শান্তও হবে আর ভুঁড়িও কমবে।" প্রস্তাবটা হারাধনবাবুর মন্দ লাগলো না।
        ‌গুটি গুটি পায়ে চললেন যোগ ব্যায়াম কেন্দ্রে খোঁজ নিতে। হারাধনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে কর্ণধার কমলাক্ষ পুততুন্ডি হেঁড়ে গলায় প্রথমেই জানিয়ে দিলেন ভর্তির সময় তিনশো টাকা আর মাসে দুশো টাকা।
হারাধনবাবুর পরের প্রশ্নটা ছিল, "আচ্ছা, পুততুন্ডিবাবু কতদিনে আমার ভুঁড়িটা তিন ইঞ্চি কমবে বলতে পারেন?" এই প্রশ্ন শোনার পর  কমলাক্ষবাবু মুখের যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন, তাতে হারাধনবাবুর এটুকু বোধগম্য হলো যে তিনি বেমক্কা একটা অর্থহীন প্রশ্ন করে ফেলেছেন।
নাক-মুখ কুঁচকে ভ্রু ওপরে তুলে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে কমলাক্ষবাবু বললেন,  -"দেখুন, মশাই, আপনার ভুঁড়ি কতদিনে কত ইঞ্চি কমবে, সেটা আমি বলবো কি করে? আমি কি জ্যোতিষ চর্চা করতে বসে আছি এখানে? আপনার সাধনা আর ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করছে।"
হারাধনবাবু মনে মনে বললেন, টাকা নেবে তোমরা আর ভুঁড়ি কমার সময় আমার সাধনা আর ইচ্ছাশক্তি।
মুখে কিছু বলার অভিপ্রায় থাকলেও  কমলাক্ষবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলাই সমীচীন মনে করলেন।
--- তাহলে কবে থেকে আসবো?
হারাধনবাবুর প্রশ্ন শুনে কমলাক্ষবাবু    আবার ভ্রু কুঁচকে বললেন, -"যবে থেকে ভুঁড়ি কমানোর ইচ্ছে হবে। সঙ্গে টাকাটা অবশ্যই আনবেন ।
--- "হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাকা তো আনবোই।" মনে মনে বললেন বিনা পয়সায় কি আর করতে দেবেন। "তাহলে, আগামী কাল থেকে আসবো" বলে হারাধনবাবু উঠে পড়লেন।
       হারাধনবাবু চিন্তা করতে লাগলেন, আগামী বেশ কিছুদিন এই কমলাক্ষবাবু নামক রসকষহীন খিঁটকেল মানুষটার সঙ্গে কিছুক্ষণ করে কাটাতে হবে, যদিও এটা ভেবে নিজেকে সান্তনা দিলেন যে গিন্নির মুখ ঝামটার থেকে এটা ঢের ভালো । বাড়ি ফিরে গিন্নিকে বললেন, -"শুনছো,যোগ ব্যায়াম কেন্দ্রে ভর্তি হবো বলে খোঁজ নিয়ে এলাম, কাল থেকে সকালে যেতে হবে।"
--- উফ্, এতদিনে একটা কাজের কাজ করলে।
        পরের দিন ভোরবেলা গিন্নি বহু কষ্টে ঠেলেঠুলে হারাধনবাবুকে ঘুম থেকে তুলে যোগ ব্যায়ামে পাঠালেন। প্রথম দিন কমলাক্ষবাবুর ছাত্র রণজয় বেশ কিছু যোগাসন দেখিয়ে বললো, -"এই আসনগুলো প্র্যাকটিস করুন।" বেশ কিছুক্ষণ নীরস বদনে চেষ্টা চরিত্র করার পরে যখন বুঝলেন এর থেকে ভালোভাবে তার পক্ষে আসন করা সম্ভব নয়, তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে রণজয়কে বললেন, -"আজ হয়ে গেছে, আবার কালকে ।" রণজয় বললো, -"আপনি বাড়িতেও এই আসনগুলো প্র্যাকটিস করবেন কিন্তু ।"
হ্যাঁ, হ্যাঁ করতে করতে হারাধনবাবু বেরিয়ে এসে হাঁফ ছাড়লেন যেন একজন অনিচ্ছুক বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল, কোনোভাবে স্কুল ছুটি হলেই বাঁচে। বাড়িতে যোগ ব্যায়াম  প্র্যাকটিসের নামগন্ধ করলেন না হারাধনবাবু। পরের দিন গিন্নি আবার ঠেলেঠুলে ব্যায়াম শিখতে পাঠালেন। কিন্তু হারাধনবাবু আজ বেশ দেরী করে এলেন। গিন্নি মনে মনে খুশী হলেন, যাক, ব্যায়ামে আগ্রহ বাড়ছে।
        হারাধনবাবু অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই কাজের মেয়ে শেফালী এসে কাজ করতে করতে গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলো, -আচ্ছা, বৌদি, দাদাবাবু কি ঐ ফোঁস ফোঁস করতে যায়? হারাধনবাবুর বৌ রেগে গিয়ে বললো, -"কি যা তা বলছিস? ফোঁস ফোঁস করে মানে?"
--- আরে বৌদি, ঐ নাক দিয়ে আওয়াজ করে না, কি বলে বলো না...
--- উফ্, তোকে নিয়ে আর পারি না, ওটাকে যোগ ব্যায়াম বলে।
--- হ্যাঁ, ঐ যা হোক....
শেফালীর কথা শেষ হতে না দিয়েই হারাধনবাবুর বৌ শশব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলেন, -"তুই কি করে জানলি রে?"
--- আরে বৌদি, আমি তো ঐ বাড়িতেও কাজ করি। মামাবাবু মানে বুড়োটা খুব খিঁচ খিঁচ করে, ছেড়েই দিতাম, কিন্তু মামীটা খুব ভালো, তাই ছাড়তে পারি না।
এদিকে হারাধনবাবু অফিসে বেশ গর্বের সঙ্গে জানালেন, তিনি যোগাসনে ভর্তি হয়েছেন ভুঁড়ি কমাবার অভিপ্রায়ে। সে কথা শোনামাত্র দত্তবাবু, পাকড়াশীবাবু, সেনদা মিলে এতসব যোগার নাম এবং তার উপকারের ফিরিস্তি দিলেন যে হারাধনবাবুর মনে হলো, এই দেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে একজন করে যোগগুরু থাকা অসম্ভব নয় । তিনি সব আসনের নাম শোনার পর প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলেন যোগব্যায়াম কেন্দ্রে তাকে কি কি আসন করতে বলেছিল। যদিও সব কিছু সামলে পরের দিন হারাধনবাবু নিজে থেকে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে যোগ ব্যায়াম করতে চলে গেলেন। এত আগ্রহ দেখে হারাধনবাবুর বৌ কিছুটা শঙ্কিত আর আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। শেফালী কাজে আসার পর ওকে ডেকে বললেন, -অ্যাই শোন্, একটা কাজ করতে পারবি?"
--- কি কাজ বৌদি?
--- তুই তো বললি, ঐ বাড়িতে কাজ করিস, যে বাড়িতে দাদাবাবু ব্যায়াম শিখতে যায়।
--- হুমম, তো?
--- তুই শুধু খেয়াল রাখবি, দাদাবাবু ঠিক ঠাক ব্যায়াম করছে কিনা? এই খবরটুকু দিতে পারবি?
শেফালী তাচ্ছিল্যভরা উত্তর দিলো,- "ওহ্ বৌদি, এটা কোনো কাজ হলো?  লোকের ঘরের খবর আনার ব্যাপারে এই শেফালী এ পাড়ায় এক নম্বরে। এ তো শেফালীর বাঁয়ে হাত কা খেল্ ।
শেফালীর উত্তরে হারাধনবাবুর বৌ নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, -"যাক্, বাঁচালি...."
কথা শেষ হবার আগেই শেফালী পা নাচাতে নাচাতে হাত পেতে বললো, -"কিন্তু বৌদি, হাতে কিছু না পড়লে তো মুখ দিয়ে কিছু বেরোবে না।"
হারাধনবাবুর বৌ রেগে গিয়ে বললেন, -"হতচ্ছাড়া, তোর সবেতেই খালি টাকা। ঠিক আছে, তোকে  প্রত্যেক দিন দশটাকা করে দেবো।"
--- বড্ড কম হয়ে গেল বৌদি, ঠিক আছে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিলাম, কিন্তু যেদিন বেকিং নুজ দেবো, সেদিন বোনাস লাগবে কিন্তু । রাজী থাকলো বলো।
--- ঠিক আছে, হতভাগা।
--- পয়সা পেলে শেফালী ওসব গালাগালিতে কিছু মনে করে না।
শেফালীর গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেলো। তার পরের দিন হারাধনবাবু যথারীতি সময় মেনে যোগব্যায়াম করতে ছুটলেন। শেফালী তো অপেক্ষায়, কখন হারাধনবাবু ঢুকবে? একটু পরে হারাধনবাবু ব্যায়াম করতে ঢুকলেন। শেফালী লক্ষ্য করলো, একটু বাদেই ওখানে জিম করতে ঢুকলো হারাধনবাবুর দুটো বাড়ির পরে থাকা শর্মিলা বৌদি। শেফালী তো অন্য কিছুর গন্ধ পেতে শুরু করেছে, ওড়নাটা মাথা দিয়ে জড়িয়ে ঘরে ঝাড়ু দিতে ঢুকলো। হারাধনবাবু তো গদগদ হয়ে শর্মিলা বৌদির সঙ্গে কথা বলেই চলেছে। শেফালী ঝাড়ু দিতে দিতে শুনতে পেলো শর্মিলা বৌদি বলছে, দাদা, কালকেই আপনাকে বললাম, বৌদির কিন্তু একদম ঠিক হয় নি, আপনাকে জোর করে ‌ভুঁড়ি কমানোর জন্য ব্যায়াম করতে পাঠানো।
--- কি আর করি বলুন, এমন চেঁচামেচি শুরু করলো, যে না এসে আর পারলাম না।
--- আপনাকে কিন্তু ভুঁড়িতে খুব হ্যান্ডসাম লাগে ।
হারাধনবাবু লাজুকভাবে বলে উঠলেন, -"কি যে বলেন।"
হঠাৎ শেফালী লা লা লা লা করে গান করতে করতে ঝাড়ু নিয়ে একদম হারাধনবাবুর কাছে এসে বললো, -ওহ্, দাদাবাবু, দেখি সরো তো একটু পরিষ্কার করে ঝাড়ু দিয়ে নিই।
হারাধনবাবু তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বললেন,-" কি রে তুই?"
-- হুমম, আমি তো অনেকদিন থেকে এই বাড়িতে কাজ করি।
হারাধনবাবুর শেফালীকে দেখার পর আর মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না, সেই দেখে শর্মিলা বৌদি আবার মিষ্টি করে বলে উঠলেন, -"কি হলো, দাদা, আপনি চুপ করে গেলেন যে, আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না বুঝি?"
হারাধনবাবুর বুক ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে, মুখে আসল কারণটাও বলতেও পারছেন না, তাও মুখে কষ্ট করে হাসি এনে বললেন, -"না না, তা কেন হবে? ভালোই লাগছে তো।"
হঠাৎ একটা কাশির আওয়াজ এলো, বুঝলেন শেফালী সব শুনেছে। আর সময় নষ্ট না করে হারাধনবাবু চুপচাপ লক্ষ্মী ছেলের মতো যোগাসন করতে বসলেন। প্রায় আধ ঘন্টা ব্যায়াম করার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে শেফালীকে এড়িয়ে হারাধনবাবু চুপি চুপি বেরোতে যাবেন, সেই সময়ে শর্মিলা বৌদি আবার অন্য ঘর থেকে বলে উঠলেন -"বাইই...দাদা, আবার কালকে দেখা হবে।"
হারাধনবাবুর তখন শেফালীর ধাক্কায় প্রাণ যাই যাই, এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন। কোনোরকমে "আমি যাই" বলে বেরিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, -উফ্, কি বাঁচান, বেঁচেছি।"
হঠাৎ পেছন থেকে শেফালীর "দাদাবাবু" ডাকে রীতিমতো কেঁপে উঠলেন। কিন্তু মুখে একরাশ বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, -"বল্, কি বলবি? আমার তাড়া আছে, অফিস যেতে হবে।"
--- হ্যাঁ, দাদাবাবু, আমারও তাড়া আছে, অত সময় নেই। বলছিলাম কি, আজকের এই ঘটনাগুলো বৌদি শুনলে মনে কতটা দুঃখ পাবে, তুমি ভেবে দেখেছো?
হারাধনবাবু মিষ্টি করে বললেন, -"তুই তো লক্ষ্মী মেয়ে, এগুলো কেউ বলে নাকি?"
--- হুমম, কিন্তু শেফালীর আবার হাতে কিছু না পড়লে যখন তখন মুখ খুলে যায় । ভেবে দেখো।
--- তুই মহা শয়তান তো। কত নিবি মুখ বন্ধ রাখতে।
--- দেখো, দাদাবাবু সোজা একটা হিসাব বলি, তুমি আরো বেশ কিছু দিন  এখানে আসবে, তুমি যতদিন এখানে আসবে, বিশ টাকা করে দেবে, আমার মুখ একদম আঠা দিয়ে বন্ধ করে রাখবো।
হারাধনবাবু মুখ ভেঙিয়ে বললেন, "টাকা গাছে ফলে বুঝি? খুব সস্তা, তাই না? তুই যা পারিস, বলে দে।" বলেই হন্ হন্ করে হাঁটা দিলেন।
পেছন থেকে শেফালী বলে উঠলো, -"যাই, তাহলে বৌদিকে খবরটা দিয়েই আসি।"
হারাধনবাবু আবার ঘুরে পেছনে দুʼপা এসে বললেন, -"আরে রাগ করছিস কেন? আমি তো মজা করছিলাম। তবে টাকাটা একটু কম কর। "
---ঠিক আছে, তোমার কথা ভেবে পাঁচ টাকা কমালাম, পনেরো টাকার কম হবে না, এই বলে দিলুম।
অগত্যা শেফালীর প্রস্তাবেই রাজী হয়ে বিরস বদনে বাড়ী ফিরলেন।
এইভাবেই বেশ কয়েকদিন চলতে থাকলো। হারাধনবাবু আর শর্মিলা বৌদির কথপোকথন সব জমা হতে থাকে শেফালীর হার্ড ডিস্কের মেমোরীতে আর দিন প্রতি পনেরো টাকায় সেটা ডিলিটের ব্যবস্থা করেছেন হারাধনবাবু।
বেশ কিছুদিন পরে হারাধনবাবুর গিন্নি শেফালীকে জিজ্ঞেস করলেন, -"কি রে, এতদিন হয়ে গেলো, কিছু খবর দিতে পারলি না?"
শেফালী মনে মনে চিন্তা করলো, দুʼদিক থেকেই যখন আমদানী হচ্ছে, তখন এই ব্যবসাটা বন্ধ করে লাভ নেই।
শেফালী বললো, "না গো বৌদি, দাদাবাবু খুব মন দিয়ে ঐসব করে, তবে মাঝে মাঝে কথাও বলে।"
--- সত্যি বলছিস তো, মন দিয়ে করে? হারাধনবাবুর গিন্নির কথায় শেফালী বললো, -"এই দিব্যি খেয়ে বলছি, শেফালী মিথ্যে কথা বলে না।"
--- ঠিক আছে, খবর পেলেই আমায় দিবি কিন্তু ।
এর মধ্যে মাস দুয়েক কেটে গেছে। শেফালীর তথাকথিত ব্যবসাও ভালো চলছে। হারাধনবাবুও এই দুʼমাসে তার গিন্নির নির্দেশ মতো তিন ইঞ্চি ভুঁড়িও কমিয়ে ফেলেছেন, অবশেষে একদিন হারাধনবাবু শর্মিলা বৌদির মায়া ত্যাগ করে যোগাসনে আসা বন্ধ করবেন ঠিক করে পুততুন্ডিবাবুকে বললেন, "ভাবছি আগামী কাল থেকে আর আসবো না।"
পুততুন্ডিবাবু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলে উঠলেন, -"আপনার যা ইচ্ছে, এতে আমার কি বলার আছে? ইচ্ছে হলে আসবেন নাহলে আসবেন না।"
শেফালী কি ভাবে যেন এই কথা শুনে ফেলায় ওর মাথায় চিন্তা এলো ওর এত সুন্দর সাধের ব্যবসার দফারফা হয়ে যাবে ।
শেফালী দুঃখ দুঃখ মুখ করে হারাধনবাবুকে বললো, -"এটা ঠিক করছো দাদাবাবু, গরীবের পেটে এভাবে নাথি মারছো? তুমি এখানে না এসে এইভাবে আমার আমদানী বন্ধ করে দিচ্ছো? ঠিক আছে, দাদাবাবু আমার যদি আবার সব কথা মনে পড়ে যায়, তাʼলে আমাকে দোষ দিও না। ভেবে দেখো।"
হারাধনবাবু দেখলেন এ তো মহা বিপদ। ইচ্ছে না থাকলেও তাই পরেরদিন থেকে আবার হারাধনবাবু আবার যোগাসন কেন্দ্রে হাজির হয়ে ব্যায়াম করা শুরু করলেন আর শেফালীর আমদানীও চলতে থাকলো দুʼতরফেই।
এদিকে যোগ ব্যায়ামের কল্যাণে বেশ কিছুদিন বাদে হারাধনবাবু মেপে দেখলেন তার ভুঁড়ি আরো দুʼইঞ্চি কমে গেছে, হারাধনবাবুর এখন গভীর চিন্তা, কি করে উনি ওনার প্যান্টগুলোকে সামলাবেন।
............................................
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 


জলপাই রঙের শাড়ি - সুদীপ ভট্টাচার্য

 

জলপাই রঙের শাড়ি
সুদীপ ভট্টাচার্য 
 



বল্টুদা প্রকৃত অর্থে গোবেচারা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান মাঝে মধ্যেই। যেমন ধরুন, জিনিস হারিয়ে ফেলার সময় কেমন জানি অদ্ভুতুরে স্বভাবের হয়ে যান তিনি। আশ্চর্যের যেটা সেটা হলো তিনি যে সত্যি সত্যিই তা হারিয়েছেন প্রাথমিক ভাবে বুঝতেই পারেন না। ফলে না বোঝার ভান করে থাকেন। এতে বৌদির রাগ বাড়ে। বৌদির ধারনা জন্মায় যে বল্টুদা জেনে শুনে এই না বোঝার ভান করে থাকেন। আদতে সেরকম কিন্তু একেবারেই নন বল্টুদা এটা বোঝাবে কার সাধ্যি।

জলপাই রঙের একটা বুটিকের শাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না বৌদি। লডাউনের কিছুদিন পরের ঘটনা। সবে মাত্র চারিপাশ হাঁসফাঁসের থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। বাতাস বইছে টলমল করে। মানুষের মনে প্রবল টেনশানের সঙ্গে সঙ্গে অল্প করে মুক্তির স্বাদ ফিরে এসেছে। প্রচুর নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে এখন। দোকানপাট খুলছে এক এক করে। কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান যেমন খুলছে, শাড়ির বুটিকের দোকানও খুলছে। আর শুধু সেটাই নয় প্রায় চার পাঁচ মাস ঘরবন্দী, স্টাইল বন্দী বাঙালি মহিলাদের কাছে স্যানিটাইজার বা সাবানের থেকেও শাড়ি বেশী আকর্ষণীয়।

জলপাই রঙের শাড়ি পাচ্ছেন না বৌদি। তন্ন তন্ন করে ঘরের চারপাশ খুঁজলেন। আলমারির প্রত্যেককটা তাক খুঁজলেন। বাড়িতে চারটে আলমারি। পৌনে চারটে আলমারি জুড়ে বৌদির অবস্থান, একটি ছোটো, পাতলা, হাল্কা, প্লাস্টিকের আলমারির অর্ধেকের অর্ধেক খানা বল্টুদার কপালে জুটেছে। তাতেই কোনমতে বল্টুদার সংসার। এ নিয়ে সামান্য মুখ খুলেছো তো নারী আন্দোলন আর নারীর প্রতি অবিচারের ভয় দেখান বৌদি। সেন্টিমেন্টাল ইস্যু। তাই অর্ধেকের অর্ধেক আলমারি থাক, সর্ব সাকুল্যে দুটি তাকই থাক, ভিতর আর বাহিরের আভূষনের গন্ধ মাখা মেশামেশিই থাক, ঘামে চপচপ মুখ দেখা দেখি থাক, কিন্তু তাক আর বেশী চাইবেন না বল্টুদা সেটা মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছেন। নিজের এহেন আলমারির কথা মনে এলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বল্টুদা, তারপরেই গলা ছেড়ে গান ধরেন "যা গেছে তা যাক, যাক।" আজও গলা ছেড়ে সেটাই গাইতে শুরু করে দিলেন বল্টুদা। আর গাইবি তো গা একেবারে বৌদির কানের ডগায়।
আর যাবে কোথায়। চেঁচিয়ে উঠলেন বৌদি, "বল্টে, আমার জলপাই রঙের শাড়ি যে তুমিই ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছো সেটা নিয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। তার উপর আবার আনন্দে গান করা হচ্ছে, যা গেছে তা যাক? যাবে না কিছুতেই বল্টে। শাড়ি না পেলে তোমার আনন্দের দিন কিছুতেই যাবে না। এই আমি বলে রাখলুম। "

এটা অভিশাপ না ভয় দেখানো সেটা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি বল্টুদা। এমনটা প্রায়ই ঘটে। এইতো গেলবারের শীতে ঝাল ঝাল লঙ্কা, কাসুন্দি, সরষের তেল, বিট নুন, ধনে পাতা দিয়ে জম্পেশ একটা কদবেলের আচার করে ছাদে নিয়ে গিয়েছিলো বৌদি। বরিবারের দুপুর, বল্টুদার অফিস ছিলো না, নীচের ঘরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। বৌদি ছাদে গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন আরাম করে বই পড়বেন, আর কদবেলের আচারের স্বাদ নেবেন বলে। হঠাৎ বল্টুদার চিৎকার। দরকারে কিছুক্ষনের জন্যে নীচে নেমে আসতে হোলো বৌদিকে। বই আর কদবেলের আচার ছাদে রেখেই চলে আসেন তিনি। তারপরই লেগে যায় দক্ষযজ্ঞ। ছাদে ফিরে বৌদি আর কদবেলের আচার খুঁজে পান না। ফাঁকা বাটি। কি সাংঘাতিক কান্ড। দিনে দুপুরে ডাকাতি। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলোনা আচার। ওদিকে বৌদির সমস্ত রাগ গিয়ে পরল বল্টুদার উপরে। প্রায় দুশো ডেসিবেল শব্দ তান্ডবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বৌদি, ম্রিয়মাণ বল্টুদা। এমন চলতেই থাকলো বল্টুদার প্রতি। বল্টুদা বুঝেই উঠতে পারিছিলেন না দোষটা ঠিক কি করলেন। বুঝে ওঠার আগেই যত দোষ নন্দ ঘোষের মত বল্টুদার উপরে বর্ষিত হল। অবশেষে সব ঝামেলার শেষে বৌদি হঠাৎ করে উপলব্ধি করলেন বই পড়তে পড়তে পুরো আচারটাই তিনি খেয়ে ফেলেছেন। আর পুরোটাই যখন খেয়ে নিয়েছেন, বাটিতে আচার থাকবে কি করে? সে যাত্রায় বৌদির স্মৃতি ফিরে আসায় রক্ষে পেয়েছিলেন বল্টুদা। সব ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। জল আরো ঘোলা হয়। নাটক চলতেই থাকে। বল্টুদার বর্ষা কাটেনা কিছুতেই। কিন্তু ওই, কেমন নির্বাক হয়ে যান বল্টুদা। মনেই পরেনা আসলে করেছেনটা কি।

এহেন বল্টুদা আবার চাপে পরলেন জলপাই রংয়ের শাড়ি নিয়ে। বৌদির খুব পছন্দের শাড়ি। লকডাউনের মনখারাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে আজকাল বৌদি এসব কিনে আনছেন। কয়েকদিন আগে বল্টুদাকে বলে রেখেছেন যেভাবে জিনিস বাড়ছে তাতে চতুর্থ  আলমারির আরো একটা তাক তার চাই। একজন পুরুষ মানুষের জামাকাপড়ের জন্যে আর কতটুকুই বা জায়গা লাগে, একটা তাকই যথেষ্ট।  বল্টুদা সামান্য উত্তেজনায় কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন সেদিন, বৌদির রক্তচক্ষু দেখে আর এগোলেন না সে পথে, বরং রাগটাকে নিমেষে মৃদু মুখ চাপা হাসিতে পরিনত করে দাঁত খিটমিট করে বলে উঠলেন "নিশ্চই নিশ্চই, বাড়ির সব কটা আলমারি তোমার বাবার, ইয়ে মানে আমার শ্বশুরমশাইয়ের নিজের হাতে বানানো, তার মেয়ে ইচ্ছেমতন ব্যবহার করবে নাতো কে করবে?" 

বল্টুদার কথাটা বলার সময় হুঁশ ছিলো না। করোনা হয়েছিলো কিছুদিন আগে। করোনা নাকি মস্তিস্কেও ছাপ ফেলে যাচ্ছে। সেরকমই কিছু একটা। নাহলে এমন ভয়ঙ্কর কথা বলবার বেহিসেবী সাহস বল্টুদা পান কি করে? অতঃপর বৌদি গম্ভীর হলেন। পরপর সাতদিন রান্না করেন নি বৌদি। গুম মেরে বসেছিলেন। বল্টুদা প্রতিদিন গুনে গুনে ডজন খানেক বার ক্ষমা চেয়েছেন, কিন্তু রাগ ভাঙেনি বৌদির। অবশেষে আজকাল হোম ডেলিভারি চলছে। তবে হ্যাঁ, মেনু কিন্তু পছন্দ করে দিচ্ছেন বৌদি। আজ দুপুরে ভেটকি মাছ হলে রাতে চিকেন, দুপুরে পমপ্লেট হলে রাতে মাটন, দুপুরে কাতলা হলে রাতে বিরিয়ানি। এর চাইতে হাজার খানেক গালাগাল আর কয়েকশো ধমক দিলেও বোধয় ভালো ছিলো। হজম হয়ে যেত। কিন্তু এমন হোম ডেলিভারির খাবারের বিল কিছুতেই হজম হচ্ছে না বল্টুদার। বল্টুদা নিজেকেই নিজের মারতে ইচ্ছে হলো। সামান্য রাগেন না বল্টুদা, কি যে হলো, একটু হাসি মুখে রাগ দেখিয়েছেন কি, পকেট ফাঁকা।

জলপাই রঙের শাড়ি পাচ্ছেন না বৌদি। কয়েকদিন আগের কেনা। সব রাগ গিয়ে জমা হল বল্টুদার কপালে। বেধড়ক ঝাড়, মুখে। বল্টুদার ঝাড় খেয়ে অভ্যেস হয়ে গেছে। বৌদির চোদ্দপুরুষের স্বভাব, সে তো আর এমনিতে যাবে না। বৌদির মা ঝাড়তেন তার বর কে, মায়ের মা ঝাড়তেন তার বর কে, তার মায়ের মা। পুরো চোদ্দপুরুষের ব্যাপারস্যাপার, নারী  ঝাড়েন, পুরুষেরা কান বন্ধ করে শোনেন। তাও না হয় আজকাল বল্টুদা ঝাড়বার টাইমে হেডফোন কানে লাগিয়ে জম্পেশ হিন্দি গান চালিয়ে দেন। আর দিদি নাম্বার ওয়ানের মত ওই হেডফোন কানে দিয়ে বৌদির লিপ রিডিং করে রিএক্ট করেন। যখন বুঝতে পারেন বৌদি মোটামুটি শান্ত, তখন বল্টুদা কান থেকে হেডফোন নামিয়ে নেন। পাকাপাকি বন্দোবস্ত আর কি। 

যাই হোক এদিনও তাই করলেন বল্টুদা। বৌদির জলপাই রঙের বুটিকের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। সব রাগ গিয়ে পরলো বল্টুদার উপর। এমনকি বল্টুদা তার অন্য কোনো বান্ধবীকে শাড়িটা দিয়েছেন বলেও বৌদি দোষারোপ শুরু করে দিলেন। হেডফোনে তখন বাজছিলো একটা মজার গান। বল্টুদা চোখ বুজে সামান্য হেসে উঠলেন। বৌদি ভাবলেন বৌদির কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন বল্টুদা। যেন হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, কে হে তুমি, আমার যাকে ইচ্ছে দেবো, তোমার কি? 

প্রচন্ড রাগ জমা হচ্ছে বৌদির মনের গভীরে। যা বারুদ ভরা আছে, বিরাট কিছু বিস্ফোরণ যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। বৌদি একটা হাতা হাতে নিলেন, একেবারে রনচন্ডী। কোমড়ের আঁচল নিলেন গুটিয়ে। এগিয়ে আসছেন বল্টুদার দিকে। মুখে অসম্ভব রাগ, যেন এই পৃথিবীটাকেই ধ্বংস করে দেবেন তিনি। প্রায় কাছে চলে এলেন বল্টুদার। বল্টুদা আরামে বসে কানে হেডফোন গুঁজে শুনছিলেন নাটক। নাটকের নাম অবাক জলপান। বৌদি প্রায় কাছে চলে এসেছেন বল্টুদার। হাতের হাতাটা শক্ত করে ধরা। সবে মাত্র হাতা হাতে হাত মাথার উপরে তুলেছেন বৌদি, এমন সময়...

বল্টুদা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিলেন। বৌদি প্রচন্ড উত্তেজিত। বল্টুদা তখন কেমন নির্বাক হয়ে নাটক শুনছেন, অবাক জলপান। নাটকের মধ্যে লেখা আছে একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? বল্টুদা তখন সেই জায়গাটাই পড়ছেন। খুবই আকর্ষণীয় অংশটা। বৌদি তখন হাতা হাতে বল্টুদার সামনে। বল্টুদা খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রায় অজান্তেই বৌদির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন " জল পাই কোথায়?" 

সামান্য এটুকু কথা। নড়ে গেলো যেন চারিপাশ। বৌদি কেন জানি নিজের শাড়ির দিকে তাকালেন একবার। আশ্চর্য, তার পরনেই তো সেই জলপাই রঙের শাড়িটা। যেটা নিয়ে এত তোলপাড়। 

বল্টুদা কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্ত থাকেন। এই ঘটনাতেও চুপচাপ ছিলেন।
 
.........................................
 
অলঙ্করণ :-  দেবাদৃতা দাস 
 

 
 

ধারাবাহিক - পান্তা দিদার গুপ্তধন - কেয়া চ্যাটার্জী

 

ধারাবাহিক

পান্তা দিদার গুপ্তধন
কেয়া চ্যাটার্জী
 
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এইখানে 
 
 
                                    || অন্তিম  পর্ব  ||

                           
 ― ওই যে পশু পাখীর, ভূতের আওয়াজ শোনার ক্ষমতা?

―ভূতের ইয়ে, থুড়ি তেনাদের কথা আমি শুনতে পাই। তবে সে ক্ষমতা কিভাবে পেলাম তা আমি জানিনা। আমার ঠাকুর্দা একসময় পূজো অর্চনা করতেন। ঝাড়-ফুঁক, ভূত তাড়ানো এসবেও বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমি একটু বড় হতে তার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াতাম। কিছু মন্ত্র শিখেছিলাম। ঠাকুর্দার চ্যালা হিসেবে বেশ বিশ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখনই হয়তো কাজ করতে করতে এই ক্ষমতাটা চলে এসেছে। বুঝলি তো?

“আর পশু-পাখীর ভাষাটা?” বললাম আমি।

 দাদু বলল, “হ্যাঁ রে সেই কথাতেই তো আসছি।”

“এরপর কলকাতা থেকে একটা বাসে চেপে এসে পৌঁছলাম একটা ডকে। ডক বুঝিস তো? যেখান থেকে জাহাজ ছাড়া হয়। জায়গাটার নাম খিদিরপুর। তা সেখানে এসে কোথায় যাবো, কি করবো ভাবতে ভাবতে একদল শ্রমিকের সাথে ভিড়ে গিয়ে কিছু বাক্স নিয়ে ঢুকে পড়লাম জাহাজের ভেতরে। কেউ কাউকে চিনি না। কোথায় যাচ্ছি না জানিনা। রাত্রে খেতে বসে ধরা পরে গেলাম। মাথাপিছু রসদ মিলছে না। ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ভারী অমায়িক মানুষ। আমার উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে হয়তো তার মায়া হলো। কাজের বিনিময়ে খাবারের শর্ত দিলেন। মাইনে পত্তর কিছু পাবো না। আমি তাতেই রাজি। এই বা কি  কম। কথায় আছে। পেটে খেলে তবেই না পিঠে সয়। চারদিন তিনরাত সমুদ্রের উথাল পাথাল সহ্য করার পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। জায়গাটার নাম আন্দামান। মনে হলো না বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসেছি। যেন আবার আরেক বঙ্গে পৌঁছে গেছি। গাছগাছালিতে ভরা, নির্মল একটা জায়গা। মজার ব্যাপার এখানেও সবাই বাংলা বলে। আর এখানেই আছে ভারতের ইতিহাসের সেই কুখ্যাত জেলখানা সেন্ট্রাল জেল। আন্দামানের জলের রং  কালচে। তাই একে বলা হত কালাপানি। এটা নাকি একটা দ্বীপ। সমুদ্রের মাঝে একটা ছোট্ট ভূমি। সেখানেই দিন কাটাতে শুরু করলাম। কতো কাজই না করেছি। মাছ ধরা, বেচা, জেলের পিওন, ব্যবসা, নৌকা চালানো, মুটে মজুর কি না করেছি। যত কাজ করেছি তত কাজের প্রতি নিষ্ঠা বেড়েছে। বুঝেছি কোনো কাজই ছোট নয়।”

    প্যাঙলাদা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি চিমটি কেটে চুপ করিয়ে বললাম, “তারপর কি হলো দাদু?” দাদু বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে আবার শুরু করলেন, “তা ওই আন্দামানেই আমার রোমাঞ্চকর জীবনের হাতে খড়ি। সারা সপ্তাহ এদিক ওদিক কাজ করি আর শুক্কুরবার বেরিয়ে পরি কখনো জঙ্গলে, কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো বা ভাঙাচোরা বাড়িঘরের ভিতরে। কি না দেখেছি। রস আইল্যান্ডে জাপানিদের বাসস্থান, হাভলক আইল্যান্ডের তারা ভরা আকাশ, নীল আইল্যান্ডের ঘন নীল স্বচ্ছ জল। মাড ভলকানো। এভাবে বেশ ভালোই যাচ্ছিল দিন কিন্তু ওই যে টাকা রোজগারের সূতোয় আটকে থাকাটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। সেই তো পিছুটান। সেই তো শিকড়ে আটকে থাকা। একদিন বেশ কিছু জমানো টাকা আর জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারট্যাং আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। শুনেছি ওখানেই নাকি জারোয়া উপজাতি থাকে। ওরা ভীষণ হিংস্র। ওদের কয়েকজন অধিবাসীকে সরকার শিক্ষিত করে পাঠিয়েছিল ওদের সমাজে যাতে ওরাও ওই কয়েকজনকে দেখে সভ্য সমাজে এসে জীবন যাপনের কথা ভাবে। যেদিন পাঠানো হলো তারপরেরদিন ওই কজনের কাটা মুন্ডু ওরা রেখে গেল সমুদ্রের ধারে। ওরা নিজেদের গন্ডিতেই খুশি। জারোয়া সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম। ওদের চোখে দেখার ইচ্ছেটা সংবরণ করতে পারলাম না। বি.ট্যাং আইল্যান্ডে নেমে হাঁটা লাগালাম। চারিদিকে উঁচু উঁচু গাছ। ওদের শিকড়, মাথা কোনোটারই হদিশ মেলা কঠিন। একটা ছোট ভোজালি দিয়ে ছোট ছোট আগাছা কেটে পথ বানাতে বানাতে চলেছি। আসলে কোথায় যে চলেছি নিজেই বুঝতে পারছি না। তখনও জারোয়ার দেখা পাইনি। কিন্তু স্থির বিশ্বাস নিশ্চই ওদের সাথে দেখা হবে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আশঙ্কার জন্ম হয়েছে। ওরাও মানুষ, আমিও মানুষ। তবু কতো পার্থক্য। দিনের আলো ফুরিয়ে এলো। আর এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। আমি একটা উঁচু মতন ডালপালা ঘেরা গাছ বেছে তাতে দড়ি আর কাপড়ের সাহায্যে দোলনা মতো বানিয়ে নিলাম। এতেই রাতটা কাটানো যাবে। ভোজালিটা হাতের কাছেই রাখলাম। কোনো পশু আক্রমণ করলে আত্মরক্ষা করা যাবে। তাছাড়াও, ব্যাগে ছিল একটা লাইসেন্সড বন্দুক। জেলে কাজে থাকতে জেলারের থেকে বাগিয়ে রেখেছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসছিল।  মুড়ি-বাতাসা আর জল খেয়ে নিমেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর কি যে হলো? দিনের আলো চোখে এসে লাগতেই বুঝলাম আমি পাশ ফিরতে পারছি না। শুধু তাই নয়, আমি হাত পা নাড়াতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষণ নড়াচড়া ধস্তাধস্তি করে চোখ খুলে দেখলাম আমার হাত পা শক্ত রসি দিয়ে বাঁধা। চিৎকার করে বললাম, “কে আছো, আমায় খুলে দাও। বেঁধে রেখেছো কেন?” কেউ সারা দিল না। এবার চারিদিক ভালো করে দেখলাম। আমি দোলনায় শুয়েছিলাম। এখন পরে আছি মাটিতে। আমার ব্যাগ আর ভোজালি একটু দূরে পরে আছে। জায়গাটায় মনে হলো মানুষের বাস আছে। মাটির একটা অংশ পরিষ্কার করে রাখা, জায়গাটা পোড়াও বটে। যেন রান্না করা হয়েছে ওখানে। ইতস্তত খাবারের টুকরো পরে আছে। ভিতরটা ধক করে উঠল। তাহলে কি আমি কিডন্যাপ হলাম?

     না এইখানে তো সাধারণ মানুষের আসার কথা নয়। তবে কি আমি জারওয়াদের ডেরায় এসে পৌঁছলাম? ভীষণ খুশি হলাম। এত অনায়াসে এভাবে পৌঁছে যাবো আশা করিনি। পরক্ষণে ভয়ও হলো। এরা নাকি নরখাদক। আমায় কি শিকার হিসেবে ধরে আনল নাকি!

     শরীরের যন্ত্রণায়, খিদে তেষ্টায় শরীর আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষন এভাবে পরেছিলাম মনে নেই। হঠাৎ দেখলাম একটা উলঙ্গ বাচ্চা কোত্থেকে দৌড়ে এসে আমার মুখের উপর ঝুঁকে কিছু দেখল। তারপর মুখে অদ্ভুত শিস দিতে শুরু করল। সেই আওয়াজ শুনে চারপাশ থেকে আরো কিছু তেমনি উলঙ্গ নারী পুরুষ বেরিয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওরা এক অদ্ভুত জীব দেখছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। জারোয়ারা শুনেছি আজও পোড়া মাংস খায়। আমায় যদি কাবাব বানিয়ে খেতে চায় এবার, পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার শক্তি টুকুও তো নেই। আবার ইষ্ট নাম জপতে শুরু করলাম। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, একটু জল। কে কি বুঝল কে জানে? আমাকে কথা বলতে দেখে সবাই ভয়ে সরে দাঁড়াল। আমি এবার নিশ্চিত, ভোজালির কোপে না হলেও গলা শুকিয়ে মরে যাবো নির্ঘাৎ। এবার শুনলাম ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। না, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি বা অন্য কোনো মনুষ্য কথিত ভাষা নয়। দুর্বোধ্য সে ভাষা। পৃথিবীর কোন সভ্য ভাষা যে তা নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিছুটা শিষের মতো। যেন অনেকগুলো পাখি গান ধরেছে। আমি আবার বললাম, জল। এবার ওদের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ বেরিয়ে এসে একটা পাতার বাটি থেকে জল ঢেলে দিল আমার মুখে। তখন আমার পিপাসার্ত শরীরে ওই নোনতা সমুদ্রের জলই অমৃত। এবার যেন শরীরে বল পেলাম। বললাম, “আমায় খুলে দাও। আমি তোমাদের ক্ষতি করবো না।” পুরুষটি মাথা নেড়ে উঠে গেল। সন্দেহ হলো লোকটি কি আমার কথা বুঝল? তাহলে মাথা নেড়ে না বলল কিভাবে? একটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে রাখা হলো আমাকে সারাদিন। অনেক রকমের খাবার দেবার চেষ্টা করল ওরা কিন্তু সে সব খাবার দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠল। সন্ধ্যে নামতেই জায়গাটায় কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো হলো। সেদিনের শিকার করা একটা হরিণ আর খরগোশ ঝলসাতে দেওয়া হলো সেই আগুনে। আমার গা গুলাতে শুরু করল। কেন যে বাড়ি ছাড়লাম। কেন যে এডভেঞ্চারের ভূত মাথায় চাপল। সত্যি বলছি তখন বাড়ীর কথা খুব মনে পড়ছিল। যখন মনে মনে নিজের মুণ্ডুপাত করছি তখনই জঙ্গল ভেদ করে আবির্ভুত হলেন এক সাধুবাবা। ঠিক যেন সুনীল গাঙ্গুলির সবুজ দ্বীপের রাজা। লম্বা লম্বা সাদা  দাঁড়ি গোঁফ, পরনে সাদা ধুতি আর উত্তরীয়, হাতে একটি পাত্র। চোখে এক অদ্ভুত চাউনি। উনি আসতেই সেই জারোয়াগুলি সরে দাঁড়াল। লোকটি একটি পাথরের ওপর বসলেন। সবাই একে একে তার সামনে এসে বসল। শিকারের সময় প্রাপ্ত ক্ষত গুলি এগিয়ে দিল ওঁর দিকে। উনি নাড়াচাড়া করে একটি লেপন লাগিয়ে দিলেন। কাউকে বা কিছু খাইয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিত উনি সভ্য সমাজের। কিন্তু এখানে কি করছেন? আমি ওঁর সাথে কথা বলার একটা ফন্দি আটতে শুরু করলাম। তবে কোন ভাষায় উনি স্বচ্ছন্দ তা বুঝতে পারছিলাম না। যদিও এই কদিনে হিন্দি বলতে শিখে গেছি। 

    সকলে আবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই ভদ্রলোক আমার সামনে একটি পাথরে এসে বসলেন। আমায় চমকে দিয়ে উনি বললেন, “ এখানে কি করতে?” আমি সাগ্রহে বলে উঠলাম, “আপনি বাঙালী?” উনি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আমি ভারতীয়। মানুষ। কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের নই। এই জাতের চক্করে কারোর আর ভারতীয় হওয়া হলো না ” তারপর আমার দিকে তাকালেন, “এখানে এই মানুষগুলোকে নিজের মতো করে থাকতে দিলেই ভালো। এরা সভ্য হলেই এই উপজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সরকার চেষ্টা করছে ওদের সংরক্ষণের কিন্তু মানুষগুলো থাকতে দিলে তো। ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাসে পরিণত করে ওরা। কি করতে এসেছো এখানে বলো?” ওঁর ধমকে কেঁপে উঠে বললাম, “আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। সত্যি বলছি। শুধু একবার ওদের দেখতে এসেছি।” 

― দেখতে এসেছো? ওরা কি চিড়িয়াখানার জন্তু নাকি? ওরা মানুষ। ঠিক তোমার মতো। শুধু ওরা তোমাদের মতো সভ্য নয়, তোমাদের ভাষা বলতে পারে না। 

    আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এখানে এদের মধ্যে কি করছেন স্যার?” উনি একটু তির্যক হেসে বললেন, “স্যার? প্রাণের দায় পড়লেই স্যার এহ? আমি এখানে এদের বাঁচাতে এসেছি। এরা যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায় তার জন্য আমি ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কি করবে তোমার সমাজ? কি করবে? আমায় পাগল বলবে, আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে, করুক না। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আগেও বন্য গাছপালা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম, আমৃত্যু করবো।”

    ওঁর কথায় কিছুটা আঁচ করতে পারলেও পুরোটা বোঝার জন্য বললাম, “এক্সপেরিমেন্ট? আপনি কি বিজ্ঞানী?" উনি খেপে উঠে বললেন, “না আমি পাগল বিজ্ঞানী। পাগল।” রাগে ওর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। সে কি তেজ মানুষটার! ওই বয়সেও আমার মতো একজন যুবকের মনে ভয় জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কি জানি কি ভেবে একটা শিস দিতেই সেই ছেলেটা যে আমায় জল দিয়েছিল সে ছুটে এল। মহারাজ তাকে বাংলায় বললেন, “ওকে খেতে দে। হাত খুলে দিস, পা বাঁধা থাক।” কথা মতো আমার হাত খুলে আমায় খেতে দেওয়া হলো। ভাত, শাক আর পোড়া মাছ। দুদিনের অভুক্ত পেটে সেটাই যেন অমৃত। গোগ্রাসে গিলে ঢকঢক করে জল খেয়ে আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ছেলেটি আবার আমার হাত বেঁধে দিল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আমায় না বাঁধতে। সে স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিল যতক্ষণ না মহারাজ আদেশ দেন ততক্ষণ সে কিছু করতে পারবে না।”

     গল্প করতে করতে বুঝতেই পারিনি সময়ের হিসেব। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পথ অতিক্রম করে যেখানে এসে পৌঁছলাম দাদু বললেন সেই জায়গাটার নাম বুড়ো বটতলা। প্যাংলাদাদা মুখ ভেটকে বলল, “ধুর বটতলা নয় তো গয়নাতলা। তুমি কোথায় নিয়ে এলে দাদু?” পাগলা দাদু মিটিমিটি হেসে বললেন, “এই বুড়োশিবের গায়ে একসময় লাগানো ছিল বড় বড় সোনার বেলপাতা আর চোখ। মাথার সাপটাও ছিল সোনার। ত্রিশূলটা অবশ্য লোহার ছিল। সবাই মনে করতো খুব জাগ্রত দেবতা, তাই যখন যার মনস্কামনা পূর্ণ হতো, ভগবানকে উপহার দিয়ে যেত। একরাত্রে সেই গয়না চুরি গেল। রে রে রে রে কান্ড। কিন্তু চোরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন থেকে এই জায়গাটাকে  গয়নাতলা বলেও ডাকা হতে লাগল।” আমি একবার বিড়বিড় করে মিলিয়ে নিলাম, “গয়নাতলার বুড়োশিব, দখিন হাওয়ার পাল/ফোকলা বটের ঝাড়ে ঝাড়ে সুলুক সন্ধান।”

    দাদু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাবতে থাকো ছোট নাতি। চলো বুদ্ধি খোলার জন্য একটু পেট ভরানো যাক।” দাদা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এই জায়গার সম্বন্ধে এতো কিছু জানলে কিভাবে দাদু।” দাদু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে দুহাত ওপরের দিকে তুলে চিৎকার করে উঠল, “এ যে আমার জন্মস্থান! আমার গ্রাম!”

    ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপি, চিংড়ি মাছ দিয়ে এঁচোর, পার্শে মাছের ঝাল, চাটনি, মিষ্টি। একটা ছোট্ট ভাতের হোটেলে এরকম এক এলাহী খাওয়া খেয়ে আমাদের মন আনন্দ নিকেতন হয়ে উঠল। প্যাংলাদাদা পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আহ! কি খাওয়া খেলাম রে সুজু! এমন খাবার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিতে পারলেই জীবনটা স্বার্থক।” পাগলা দাদু হেসে বলল, “ঘুমোলে আর গুপ্তধন পাবে না। চলো পা চালাই।” আমরা বললাম, “কোথায়?” এমন সময় মনে হলো, দাদা আশেপাশে নেই। খাওয়ার পর হাত ধুতে গেছিল পাশের ঝোপে এখনো তো ফিরল না। দাদাকে খোঁজা শুরু হলো। হোটেলের ত্রিসীমানায় সে নেই। অনেক হেঁকেও সারা পাওয়া গেল না। আমাদের মাথায় হাত। কোথায় গেল! খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম সেই বুড়োশিবতলায়। দেখি দাদা দাঁড়িয়ে আছে একটা বটগাছের নিচে। প্যাংলাদাদা দাদার মাথায় একটা গাঁট্টা দিয়ে বলল, “এই হতভাগা! এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে? আমরা সবাই তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম।” দাদা তেমনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “এই গাছটা দূর থেকে একটা ফোকলা বুড়োর মতো দেখতে লাগছিল জানিস। দেখ কোটরটা, যেন একটা দাঁত বিহীন বুড়ো দাদু। পান্তা দিদার ধাঁধায় আছে না, ফোকলা বটের ঝাড়ে ঝাড়ে সুলুক সন্ধান।” আমি একবার মনে মনে একটা ছক কষে নিয়ে বলে ফেললাম, “তার মানে এই মন্দিরের দক্ষিণ দিকে এই ফোকলা বটগাছের পূর্ব দিকে আমাদের যেতে হবে। কারণ সূর্য তো পূবদিকেই ওঠে। সেখানে কথামতো থাকতে হবে ধানের ক্ষেত। তাইতো দাদু?” দাদু হেসে বললেন, “বাহ! মাছের মাথা খেয়ে দুই নাতির বুদ্ধি তো বেশ খোলতাই হয়েছে দেখছি। তোর কি খবর রে প্যাংলা?” প্যাংলাদাদা মাথা চুলকে বলে উঠল, “গুপ্তধন ক্ষেতের মধ্যে লুকানো? মাটি খুঁড়তে হবে তাহলে।” সঙ্গে সঙ্গে কাকতলীয় কিনা কে জানে, একটা কাক প্যাংলাদাদার মাথায় ইয়ে করে পালাল। আমরা হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছিনা। প্যাংলাদাদা ব্যাজার মুখে একবার আকাশের দিকে আর একবার আমাদের দিকে তাকাতে থাকল। দাদু হেসে বললেন, “পেয়ে গেলি তো তোর উত্তর। এবার চল।” দাদু চললেন আগে আগে, আমরা চললুম পিছু পিছু। প্যাংলাদাদা পথে পরে থাকা শুকনো পাতা দিয়ে নিজের নোংরা মাথা পরিষ্কার করতে করতে কাকটার গুষ্টির তুষ্টি করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনে এলো একটা বিশাল বাড়ী। পাগলা দাদু গটগট করে ঢুকে গেল বাড়িটায়। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি পরস্পরের দিকে। দাদু পিছন ফিরে বললেন,“কি রে দাঁড়িয়ে আছিস যে?” প্যাঙলাদা বলল, “এটা কি দিদার বাড়ি?” দাদু হেসে বললেন, “না এটা আমাদের জমিদারের বাড়ি। এখন কেউ থাকে না। সূর্য পাটে চলল। আজ রাতটা এখানেই থাকবো।” আমাদের গলা শুকিয়ে এল। রাতের বেলা ভাঙা বাড়িতে থাকব! এটা তো প্ল্যানে ছিল না। তবু উপায়ন্তর না পেয়ে ঢুকে গেলাম। যা থাকে কপালে বলে। দাদু সাফ সুতরা জায়গা দেখে তার থলের ভিতর থেকে একটা চাদর পেতে বসলেন। আমরাও বসলাম তার পাশে। সকলেরই পেট ভর্তি। খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। মনে পড়ল দাদুর গল্প টি শেষ হয়নি। আমি বললাম, “দাদু, গল্পটা তো শেষ করলে না। তুমি ওখান থেকে ছাড়া পেলে কিভাবে?” দাদু একটা লম্বা হাই তুলে বললেন, “তা খেয়ে দেয়ে সকলে যখন ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। তখন সেই আদিবাসী ছেলেটি এসে আমার বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, “মহারাজ আপনাকে ছেড়ে দিতে বলেছেন। আপনার ব্যাগ পত্র নিন আর পালান।” আমি বললাম, “এই ঘন অন্ধকারে আমি কোথায় যাবো? আমায় যদি কোনো পশু আক্রমণ করে?” ছেলেটি একটু চিন্তিত হয়ে একটি গাছের আড়ালে চলে গেল। আমিও ব্যাগটা বাগিয়ে তার পিছু পিছু চললাম। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। দেখলাম ছেলেটি যে জায়গায় এল সেটি একটি গুহা। সে ভেতরে ঢুকে গেল, আমিও নিঃশব্দে চললাম তার পিছু পিছু। বেশ কিছুটা অলিগলি পথ পেরিয়ে দেখলাম একটা জায়গায় আগুন জ্বলছে। সেই আলোয় দেখলাম মহারাজ একটা চৌপায়ার ওপর বসে ধ্যান করছেন। ছেলেটি একটু গলা খাঁকারি দিতে উনি চোখ মেলে তাকালেন। ছেলেটি আমার কথাগুলি বলল। উনি স্মিত হেসে বললেন, “বাঙালি বাবু যখন চলেই এসেছেন তখন দেখাই করে যান।”  ছেলেটি অবাক হয়ে পিছন ফিরতেই আমায় দেখতে পেল। আমিও অবাক এত ঘন অন্ধকারে আমায় দেখতে পাওয়া অসম্ভব ভেবেছিলাম। ছেলেটি রেরে করে তেড়ে আসতেই মহারাজ তাকে বাধা দিলেন। তারপর আমায় ডেকে বসালেন আরেকটি চৌকির ওপর। 


    আমি অপরাধীর মতো বসলাম। বলা বাহুল্য ওঁর সম্পর্কে আমার কৌতূহল দমন করতে পারছিলাম না। উনি বললেন, “বাঙালির মনে অনেক প্রশ্ন। বরাবর তাই। যখন বাংলাদেশে গাছগাছড়া নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলাম তখনও বাঙালি আমায় পাত্তা দিল না। বলল কেমিক্যাল ওষুধের যুগে এসব গাছ পাতার ওষুধ কেউ পাত্তা দেবে না। আমার দীর্ঘ পনের বছরের পরীক্ষা নিরীক্ষা ওরা বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলেই ধরল না। আমায় পাগল বলে বের করে দিল ইনস্টিটিউট থেকে। তারপর অনেক ঝড় ঝাপ্টার পর এই জঙ্গলে এসে আশ্রয় নিলাম। এদের পূর্বপুরুষরা তোমার মত করেই আমায় ধরে এনেছিল। সেদিন এক জারোয়া শিকার ধরতে গিয়ে আহত হয়েছিল। এরকম হলে ওদের মধ্যে নিয়ম সেই ব্যক্তিকে এক নিভৃত স্থানে রেখে আসার। কারণ সে ওই ক্ষতেই পচে মারা যাবে এটা ওদের স্থির বিশ্বাস। কিন্তু আমি বাধা দিলাম। আমার ভাষা ওরা বুঝল না বটে কিন্তু একজন আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল। আমি ওদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যই ওদের একজনকে সাথে নিয়ে আমার চেনা কিছু গাছগাছড়া খুঁজে আনলাম। তারপর তার প্রলেপ বানিয়ে ওই ব্যক্তির হাতে লাগিয়ে দিলাম। পরেরদিন ক্ষত অনেকটা সেরে গেল। ওরা ভাবল আমি হয়তো কোনো ম্যাজিশিয়ান। ওরা আমায় এখানেই রেখে দিল। আমার প্রয়োজনের সব ওরাই এনে দেয়। যে বিজ্ঞানের জন্য আমি আমার সমাজে ব্রাত্য সেই বিজ্ঞান আমায় ব্রাত্য সমাজের রাজা বানিয়ে দিল।" উনি থামলেন। কতটা কষ্ট, লাঞ্ছনা পেলে একটা মানুষ নিজের সব ছেড়ে এভাবে একদল আদিবাসীর সাথে থাকতে রাজী হয়। তারপর বললাম, “ওদের ভাষা কিভাবে রপ্ত করলেন?” উনি বললেন, “ওদের ভাষা হলো জঙ্গলের ভাষা। এই ভাষা শিখলে তুমি যেকোনো পশু পাখির ভাষা শিখে যাবে।” এই বলে তিনি আমায় জারোয়াদের ভাষা শেখাতে শুরু করলেন। সারা রাত আমি ওঁর কাছে সেই ভাষা শিখলাম। এক এক ধরণের শিষ। কোনোটা মিহি সুরের, কোনোটা খাদের, কোনোটা আবার মাঝারি। তাদের এক একেকটার একেক মানে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য শিক্ষা জীবনের। আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না ওই রাতটা। জীবনের থেকে বড় শিক্ষা হয় না রে। আর কোনো বড় শিক্ষক নেই।

   তারপর দিনের আলো ফুটতেই সেই ছেলেটির সাথে আমায় পাঠিয়ে দিলেন সমুদ্রের দিকে। ছেলেটি এমন পথে আমায় নিয়ে এল যে আমি পিছন ফিরে পথ চিনতেই পাড়লাম না। বুঝলাম, পরে এই পথ খুঁজে পাওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। ছেলেটি সমুদ্রের ধরে একটি জেটিতে এনে দাঁড় করালো। তখন একটি জাহাজ ছাড়ছিল। ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলে ছেলেটি আমায় তুলে দিল জাহাজে। ব্যস আবার নিরুদ্দেশে দিলাম পাড়ি।” 

    গল্প শেষ হলো। অন্ধকারে ভরে গেল চারিদিক। দাদু একটা মোমবাতি জ্বাললেন। ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলে আসছে। প্যাঙলাদা চারিদিক বেশ বিজ্ঞের মতো দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে সে এ ঘর ও ঘর করতে লাগল। আমি আর দাদা মোটামুটি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম দাদুর পাশে শুয়ে। হঠাৎ প্যাঙলাদার চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠলাম। এদিক ওদিক খুঁজে একটা ঘরে এসে দেখলাম দাদা খাটে বসে হাঁপাচ্ছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। আমাদের দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল দাদুকে। শত প্রশ্নেও সে উত্তর দেয় না। ওর চোখ অনুসরণ করে দেখলাম  দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি। একজন ভদ্রমহিলার। মনে হলো এক জমিদার গিন্নী। আমি সেটির দিকে এগোতেই প্যাঙলাদা আমার হাত চেপে ধরল, “যাস না। ছবিটা নড়ছে।” আমি ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, “ধূর তুমিও পারো দাদা। ছবি আবার নড়ে নাকি। হাওয়া লেগেছে হয়তো।” কিন্তু মনে মনে একটু যে ভয় পেলাম না তা নয়। কারণ ঘরটায় কোনো জানলা খোলা নেই। হাওয়া ঢোকার পথ নেই। আমি ছবিটার কাছে যেতেই সত্যিই মনে হলো যেন ভেতরের প্রতিকৃতিটা হালকা মাথা নাড়ল। আমি চমকে পিছিয়ে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমরা দাদুকে জড়িয়ে ধরলাম। সে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল, “চুপ কর চুপ কর। আহ বৌদি। বাচ্চাগুলোকে এত ভয় দেখানোর কি আছে বলো তো?” অমনি উত্তর এল,“বাচ্চাগুলো যে এমন মাথা মোটা। বিশেষ করে প্যাঙলা। তা কি আমি জানতাম ঠাকুরপো?” আমরা অবাক এ যে পান্তা দিদার গলা। আমরা চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে বললাম, “ও দিদা। তুমি এখানে? এখানে থাকো?” উনি বললেন, “আমার অনেকদিনের শখ বুঝলি তো সুজু এই জমিদার বাড়ীতে থাকব। দাসী বাদী এসে পা টিপে দিয়ে যাবে। তা যখন ভূত হয়ে কোথাও জায়গা পাচ্ছিলাম না। দেখলাম এ বাড়ী খানা খালি। ব্যস ঢুকে পড়লাম। তবে মাঝে মাঝে তোদের বাড়ী যেতাম বিড়াল সেজে। আর ঐ মুখ্য প্যাঙলা কে ধাঁধার উত্তর দিতে। তা সে এমন গাম্বাট ছেলে আমাকে দেখলেই ভিরমি খেতো। আমি আর কিছু বলার সুযোগই পেতাম না। তার মধ্যে ঠাকুরপো এসে উঠলেন তোদের বাড়ীতে।  আমার মনে আশার উদয় হলো। তাহলে এবার আমার সেই গুপ্তধন উদ্ধার হবে।" 

    দাদা বলল, “কিন্তু দিদা তুমি যে ধাঁধাটা পুরো বলে যাওনি। আমরা বুঝব কিভাবে?”

    দিদা চিৎকার করে উঠলেন, “বলবো না। হতভাগা গুলো নিজের মাথার গোবর খরচ কর। আর শোন, আমার গুপ্তধন পেলে ওই জিনিসগুলো এনে এই ঘরে রেখে দিয়ে যাবি। যদি হেলা ছেদ্দা করে ফেলে দিয়েছিস তো দেবো তোদের ঘাড় মটকে।”

    দিদার গলা প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল। তারপর সব কিছু শান্ত। যেন ঝড় থেমে গেল। ছবিটা আবার স্থির হয়ে গেল।  আমরা কাঁপতে কাঁপতে আর প্যাংলাদাকে ধরে ধরে  আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই সারারাত কাটিয়ে দিলাম। ঘুম এলেও ঘুমাতে পারলাম না। যদি দিদা চলে আসেন। কিন্তু আমাদের সকলের ভয়ের তোয়াক্কা না করে পাগলা দাদু সারারাত নাক ডেকে ঘুমালো। তার ডাকের চোটে তন্দ্রা এলেও পড়িমরি করে পালাচ্ছিল। আমরা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম সকালের আশায়। এভাবে হয়তো কোনোদিন সকাল দেখার অপেক্ষা করিনি।

     সকাল হতেই আমরা পাগলাদাদুকে টেনে তুললাম ঘুম থেকে। আচমকা এমন আক্রমণে উনি একটু হতভম্ব হয়ে গেলেও পরে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ধুর হতচ্ছাড়া। এতো তাড়াতাড়ি উঠে কি করবো?” আমরা তো এদিকে কিছুতেই এবাড়ীতে থাকবো না। তাকে টেনে বের করলাম রাজবাড়ী থেকে। বাইরেই মুখ হাত ধুয়ে, চা খেলাম, টিফিনের ব্যবস্থা এখানেই করতে হবে। তারপর সারাদিন হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। মাঝে একটা হোটেলে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা। পথ যেন আর ফুরাতে চায় না। বিকেল হয়ে এল। সূর্য ঢলতে শুরু করেছে পশ্চিমে। আমাদের আর পা চলছে না। সারাদিন হেঁটেই কেটে গেল। মনে মনে ধাঁধাটা ভেজেই চলেছি। পড়া বলার মতো মুখস্থ হয়ে গেছে। এবার সামনে এলো একটা বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠের চারিদিকে সারি সারি টিলা। এটাকেই হয়তো দিদা পাহাড় বলে উল্লেখ করেছেন। সেই টিলার সামনে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ধানক্ষেত। প্যাংলাদাদা “পেয়েছি” বলে লাফিয়ে উঠল। আমাদের মনেও আশার সঞ্চার হলো। পান্তাদিদা তাহলে মজা করেনি। কিন্তু ধাঁধাটা যে অসম্পূর্ণ। দাদুর দিকে তাকালাম। তিনিও কি সেই কথাই ভাবছেন? আমার কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “ছোট নাতি বলো এবার?” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “মাটির প্রাসাদ মানে কি দাদু? প্রাসাদ কি মাটির হয়?” দাদু হেসে বললেন, “যার যেটা বাড়ি সেটাই তো তার প্রাসাদ রে ব্যাটা।” তার মানে এই যে সারি সারি মাটির বাড়ি তার মধ্যে একটা পান্তাদিদার বাড়ি আর সেখানেই আছে তার গুপ্তধন। 'মো' মানে কি মোহর? আমরা তড়িঘড়ি পা চালালাম। কিন্তু পান্তাদিদার বাড়ি কোনটি? আমরা তো কেউ চিনিনা। পাগলা দাদুই বলতে পারে। ধাঁধাটা যতটা সহজ ভাবছিলাম ততটা সহজ নয়। দাদু আমাদের এনে দাঁড় করালেন একটি ভাঙা বাড়ির সামনে। মাটির বাড়ি। তার একদিকের দেওয়াল ভেঙে পরে আছে। খড়ের ছাউনিও উড়ে গেছে ঝড়ে। এরকম আরো অবাক বাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। যেন কোনো এক বিধ্বংসী ঝড়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে একটা গোটা গ্রাম।

    প্যাংলাদাদা বলল, “এইটা কি দিদার বাড়ি?” দাদু মাথা নাড়লেন, “এককালে এটাও বাড়ি ছিল রে। ওই দূরে যে বাড়িগুলো দেখছিস ওগুলোর মধ্যে একটা বৌদির বাপের বাড়ী। এটা আমার পৈতৃক ভিটে। কিন্তু যেবার মড়ক লাগলো, বৌদির বাড়ির সবাই মারা গেল। আমাদের বাড়িও রক্ষে পেল না। সারা গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সব যখন শুনলাম তখন আমি অনেক দূরে। ততোদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। আমার কিছু করার জো নেই। ফিরে আসার টাকাকড়ি নেই। বাড়ি ছাড়ার অনেক জ্বালা রে দাদু! অনেক জ্বালা।” দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই কি একটা আওয়াজে তাকিয়ে দেখি প্যাংলাদাদা একটা সরু লাঠি নিয়ে মাটি কোপাতে শুরু করেছে। শক্ত মাটি, রোদে জলে শুকিয়ে ফেটে গেছে। কোপাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে দেখছি যে ছেলের কাজের নামে জ্বর আসে সে কেমন হাতের আস্তিন গুটিয়ে গুপ্তধন খুঁজছে। দাদু রে রে করে উঠলেন, “করিস কি, করিস কি! ভিতের বাড়ি সব হুড়মুড়িয়ে পরবে যে।" প্যাংলাদা হাত নেড়ে বলল, “কিচ্ছু হবে না দাদু। ভরসা রাখো। আমার স্থির বিশ্বাস দিদা এখানেই তার গুপ্তধন পুঁতে রেখেছে। আরে বাবা গল্পে পড়নি? রাজা মহারাজারা ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সম্পত্তি মাটির নীচে, চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখে যেত।” প্যাংলাদা দ্বিগুণ উৎসাহে আবার মাটি কোপাতে শুরু করলো। আমাদেরও নির্দেশ দিল ওকে সাহায্য করতে। আমরা এদিক ওদিক খুঁজেও মাটি কোপানোর কিছু পেয়ে আবার দাদুর পাশে এসে দাঁড়ালাম। দাদুর মুখটা ভীষণ গম্ভীর। দুদিন ধরে তাকে যেমন দেখেছি। তেমন মোটেই না। যেন ভীষণ রেগে গেছেন। যেন এক্ষুনি রাগে ফেটে পড়বেন। হঠাৎ আমাদের তিনজনকে চমকে দিয়ে দাদু চেঁচিয়ে উঠলেন, “থাম, থাম বলছি।”  প্যাংলাদা বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হাতের লাঠিটাও এতক্ষণে ভেঙে গেছে। মাটিটা অবশ্য একটু খানি রূপবদল করেছে। দাদু এগিয়ে এসে বললেন, “তোরা কিচ্ছু জানিস না। বৌদি ঠিক বলেছিল। তোদের মাথায় গোবর ভরা।” বলে একটু এদিক ওদিক দেখলেন তারপর নরম সুরে বললেন, “ওরে মেয়েমানুষ বড় যত্ন জানে রে। ওসব মাটি খুঁড়ে নয়, এমন জায়গায় জিনিসটা রাখবে যা চোখেও পড়বে না আবার হাতের কাছেও। সরে আয়, সরে আয়।” প্যাংলাদাদা লাঠি ফেলে সরে এল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দাদু ঘরের চারপাশ দেখে নিয়ে নির্দেশ দিলেন কুলুঙ্গিতে খুঁজতে। আমরা অবাক। কুলুঙ্গি? কুলুঙ্গি আবার কি জিনিস!  প্যাংলাদা বলল, “এটা কোন ঘর? কুলুঙ্গি বলে কোনো জায়গা আছে নাকি? বাথ্রুমকে কুলুঙ্গি বলা হত নাকি?” দাদু এই কথায় হোহো করে হেসে উঠে দেওয়ালের একটা খোপে হাত ঢুকিয়ে কিছু ভাঙা মোমবাতি আর লোহার টুকরো বের করে আনলেন। বললেন, “এই জায়গাগুলোকে কুলুঙ্গি বলে। তোরা তো পাকাবাড়িতে থাকিস। এসব বুঝবিও না। চোখে দেখিসও নি। চল চল কাজে লেগে পর।” আমরা সঙ্গে সঙ্গে  ছড়িয়ে পড়লাম সারা বাড়িতে। তিনটে ঘর, গোয়াল ঘর, আতুর ঘর, রান্নাঘর সবই খোঁজা হলো কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান কোথাও পাওয়া গেল না। সূর্য তখন অস্তগামী। চারিদিকে অন্ধকারের ছায়া পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁধার নামবে। তখন তো আর এই ভাঙা মাটির বাড়িতে কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া সাপ খোপের ভয়ও আছে। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে হতোদ্যম হয়ে বসে পড়েছি ওই অপরিস্কার মাটিতেই। দূতদিনের পরিশ্রম একদম বৃথা। তারওপর আবার পান্তা দিদার আত্মার শাসানি। জিনিসগুলো না পেলে বাড়ীতে উৎপাতের শেষ থাকবে না। এদিকে বলছেও না যে এই বাড়ী ছাড়ার আগে সে তার গুপ্তধন কোথায় রেখে গেছিলেন। মানুষ নাহয় ভুলে যেতে পারে। ভূত হওয়ার পর তো তার মনে পড়বে সেসব। মাটিতে বসে আছি। আশার প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। হঠাৎ  প্যাংলাদাদার মাথায় কোথা থেকে একটা খাগের কলম এসে পরল। ওপরে তাকিয়ে দেখি খোলা চালের একটা খোপে একটা পায়রা ঘোরাঘুরি করছে। প্যাংলাদাদা আমাদের তুলনায় লম্বা, সে সটান লম্বা লম্বা হাত পা ফেলে ওপরে উঠল। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে রইলাম দাদার দিকে। আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। প্যাংলাদাদা কিছু একটা নাড়াচাড়া করে চিৎকার করে “পেয়েছি” বলে একলাফে নেমে এলো মাটিতে। ওর হাতে দেখলাম একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। কাছে গিয়ে দেখলাম, বাক্সটার গায়ে ধূলো জমে গেছে পুরু হয়ে। ঢাকনার কাঠের ওপর নক্সা করা। একটা ছোট্ট তালা ঝোলানো বটে তবে তা মরচে পরে কালো হয়ে গেছে। মাথায় ঘুরতে লাগল হাজার চিন্তা। ঢাকনার ওপারে কি আছে? মোহর নাকি অন্য কিছু? কি লুকিয়ে রেখে গেছিল পান্তাদিদা? কোনো গুপ্তধনের নক্সাও হতে পারে। প্যাংলাদাদার চোখ চকচক করছে। সে হাত বাড়িয়ে  ধীরে ধীরে ঢাকনাটা খুলতেই আমাদের সব আশা ভস্মের মতো উড়ে গেল। ভেতরে ভর্তি কিছু ছেঁড়া কাগজ, পুরোনো উঁই কাটা বই, একটা খালি দোয়াত আর কিছু খাগের কলম। প্যাংলাদাদা পাংশুটে মুখে বলল, “ এমা! এটা কি?” দাদু কাগজগুলো হাতে নিয়ে একে একে খুলে দেখলেন। তাতে মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা, ‘আমি পড়ি, আমি লিখি’, ‘বীণা কুমারী’, ‘শক্ত, ভক্ত, রক্ত’, ‘একে চন্দ্র ১’ । উঁই ধরা বইগুলি লক্ষ্মীর পাঁচালী, চাঁদমামার গল্প, ঠাকুমার ঝুলি। আমরা সপ্রশ্ন চোখে তাকালাম দাদুর দিকে। তিনি হেসে বললেন, “শিক্ষা। নারীশিক্ষা। এ এক বিরাট গুপ্তধন প্যাংলা। এক যুগে মেয়েরা পড়াশুনার অধিকারী ছিল না। তাদের নিজের প্রতিভা, নিজের ইচ্ছে লুকিয়ে রেখে বাঁচতে হতো। বাড়ির ছেলেরা দশবার ফেল করলেও তাদের পড়া ছাড়ানো হতো না। এদিকে মেয়েগুলো মেধাবী হলেও তাদের প্রাইমারীর পর আর পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হতো না। বৌদিরও মেধা ছিল কিন্তু সুযোগ ছিল না।  বৌদি লুকিয়ে পড়াশুনা করত। তার দাদাদের বই থেকে টুকে টুকে লিখত। আড়াল থেকে পড়া শুনে পড়া মুখস্থ করতো। ওই যে ওই ভাঙা মাটির বাড়িটা ছিল বৌদির বাবার বাড়ি। আমরা সব এক পাড়ার ছেলেমেয়ে। বীণা দিদি, মানে তোদের পান্তা দিদা, এগুলো লুকিয়ে আনত আমার কাছে। আমি বানান শুধরে দিতাম। আর লুকিয়ে রাখতাম আমার ঘরে। তখন আমিও পড়তাম থ্রি ক্লাসে। বীণা দিদিকে পড়া বুঝিয়ে নিজেকে বেশ বিজ্ঞ ভাবতাম। হে হে হে। কিন্তু যেদিন বিয়ের বয়স হলো সব বন্ধ হয়ে গেল। আমার দাদার সাথেই বিয়ের দিন ধার্য হলো। আমি তো বেশ খুশি। বীণা দিদি আমার বৌদি হয়ে আসছে। কতো খেলা হবে, কতো পড়াশুনা শেখাবো দিদিকে। বেশ কিছুদিন চলেওছিল সেইরকম। বৌদি বেশ শার্প ছিলেন। চট করে ধরে ফেলতেন। আমি ইস্কুলের সব পড়া শেখাতাম। আমারও বেশ পড়া হয়ে যেত। কিন্তু নিয়তি। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। সংসারের যাঁতাকলে মেয়েরা শুধুই পেষণ খায়। তাদের বাঁচার সময়টুকু কোথায় যে হারিয়ে যায়। বৌদির কোল জুড়ে খোকা এল, খুকু এল। সংসার বাড়ল। দায়িত্ব বাড়ল। ব্যাস সংসারের যাঁতাকলে বীণা দিদিকে সব স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হলো। কত বুদ্ধিমতি ছিলেন দেখছিস! তোদের কেমন ধাঁধা বলে ভুর্কি দিয়ে দিল। হাহাহা... ”  আমার গলার কাছে কি যেন আটকে এল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সূর্য  যাওয়ার আগে তার শেষ রং ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কতো কষ্ট পেয়েছে দিদা সারাজীবন। সব স্বপ্ন কেমন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল তার। সমাজ শুধরেছে ঠিকই কিন্তু তার অজ্ঞতায় কতো মেয়ে এরকম অন্ধকারে ডুবে গেছে কে জানে! আমরা যে শিক্ষার সুযোগ পাই সেই সুযোগ অবহেলা করি। আর কয়েক বছর আগে এই সুযোগটুকুর জন্য কতো মানুষ চাতকের মতো চেয়ে ছিলেন।

     প্যাংলাদাদা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে একা। ওর মনের ভিতর কি চলছে আমি জানি। দাদুর সঙ্গে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। দাদু তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “কি বড় নাতি, মন খারাপ? গুপ্তধন পাওয়া হলো না, বলো?” প্যাংলাদাদা অস্ফুটে বলল, “শিক্ষাই গুপ্তধন তাই না দাদু?” দাদু মাথা নাড়লেন, “ঠিক বুঝেছিস বাবা। একদম ঠিক।”  প্যাংলাদাদা বলল, “বাবাকে একটু বলবে আমায় আবার ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে?”

    দাদু মাথা নেড়ে হাঁটা লাগালেন। আমরাও চললাম তার পিছু পিছু। হাতে সেই নক্সা করা কাঠের বাক্স। পান্তা দিদার অমূল্য রত্ন। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে যে।

                                            | সমাপ্ত।




Keya Chatterjee

                                 
  
                                        

ধারাবাহিক - পান্তা দিদার গুপ্তধন - কেয়া চ্যাটার্জী

ধারাবাহিক

পান্তা দিদার গুপ্তধন
কেয়া চ্যাটার্জী
 

|| দ্বিতীয় পর্ব  ||

                           
   

     সকলে মিলে চেপে ধরলাম। “বলো দাদু বলো। এতটা পথ কি গল্প না করে কাটানো যায়?” দাদু চোখ বুজে কিছুক্ষন তর্জনী দিয়ে কপালের মাঝখানে টোকা দিয়ে আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“একটু গুছিয়ে নিলাম বুঝলি তো। এত বড় জীবনের এত গুলো ঘটনা বলতে তো সময় লাগে। তা বিশ বছর আগে যখন সেই ডায়েরি খানা পেলাম তখন তো মনের মধ্যে যতো সুপ্ত ইচ্ছার আগ্নেয়গিরি তার লাভা নির্গমন করে আমায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সেই রাতেই ধুত্তোরি তোর সংসার বলে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই মোড়ের মাথায় পৌঁছে যাওয়া যায়। তারপর আলপথ ধরে কিছুটা এগোলেই ট্রেন লাইন। সেই লাইন ধরে নাক বরাবর পূব মুখো হাঁটলেই স্টেশন। ঠিক করলাম স্টেশনে গিয়ে যেখানকার ট্রেন পাবো, জয় মা কালি বলে উঠে পরব। সেই মতো তো এগোচ্ছি। কিন্তু পথ আর ফুরোয় না। যাচ্ছি তো, যাচ্ছি তো, যাচ্ছি। প্রায় ঘন্টা খানেক বয়ে গেল। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার ওপর ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছে। চির পরিচিত গাছপালা গুলো কেমন যেন অচেনা ঠেকছে। ঠিক যেন কালো কাপড় মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এবার আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি একই পথে বার ছয়েক ঘুরছি। এই আমগাছটা, পুকুরটা, মাটির দালানটা নয় নয় করে বড় পাঁচেক দেখলাম। বুকটা দুরদুর করতে শুরু করল। গাঁয়ে গঞ্জে ভূতের উপদ্রবের কথা কারুর অজানা নয়। আমি তেনাদের বিশেষ একটা পাত্তা দিতাম না কখনোই। কিন্তু তখন ওই অবস্থায় পরে বারবার তেনাদের কথা মনে হতে লাগল। মনে মনে ইষ্টনাম জপতে জপতে পেরোচ্ছি এমন সময় কোত্থেকে ঝুপ করে একটা কালো লোক আমার রাস্তা আটকে দাঁড়াল। আমি থমকালাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাতের টর্চটাও ঠিক এই সময়ই বিগড়েছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “ক-কে?” অমনি জলদ গম্ভীর সুরে উত্তর এল, “আত্মা। অশরীরি। তোরা যাকে বলিস ভূত, প্রেত। হুঁহ যতো সব জঞ্জাল।” শেষ কথাটা শুনেই আমার পিলে চমকে উঠল। এ যে জগন্নাথ স্যারের কথা। হ্যাঁ গলাটাও তাঁরই মনে হচ্ছে। তবু মনে জোর এনে আরেকবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কার আত্মা? ভূতের আওয়াজ তো এত গম্ভীর হয় না।” উল্টো দিক থেকে উত্তর এলো, “কতবার তোদের পড়িয়েছি ভূত বলে কিছু হয় না। তাও তোরা ভুলে গেলি? আমার চল্লিশটা বছর বৃথাই গেল। জঞ্জাল যতসব।” আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। জগন্নাথ স্যার পাঁচবছর আগে মারা গেছেন। আমি এখন তাঁর আত্মার সামনে দাঁড়িয়েই তার সাথে গল্প জুড়েছি! এদিকে ভূত বলছে ভূত বলে কিছু হয়না। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়েছি আবার সেই কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরল। “তা তোর সাথে আমার কিছু দরকার ছিল।” আমার আবার পিলে চমকালো। একে অঙ্কের স্যার তায় আবার ভূত থুড়ি আত্মা। তার আমাকে প্রয়োজন। ঘাড় নেড়ে বললাম, “বলুন স্যার।” তিনি বললেন, “আমার ভিটেটা তো চিনিস। এই গ্রামের সীমান্তের ধূধূ পেরিয়ে পরের ধূধূ। সেখানে তোকে গিয়ে একখানা জিনিস হান্ডওভার করতে হবে।”

― কিন্তু স্যার আমি যে বিবাগী হওয়ার প্ল্যান নিয়ে বেড়িয়েছি।
― এহ, মাছ-মাংস ছাড়া ভাত চলে না সে আবার বিবাগী হবে বলে বেরিয়েছে। জঞ্জাল , জঞ্জাল। জঞ্জাল ভরে গেল দেশটা। 

তারপর উনি কি যেন ভেবে বললেন, “যাহ যাহ তোকে আর আমার কাজ করতে হবে না। আমি অন্য কাউকে ধরছি।” আমি তড়িঘড়ি বলে ফেললাম, “আহা! স্যার এভাবে রাগ করছেন কেন? বলুন না স্যার বলুন কি কাজ?”

স্যার মানে স্যারের ভূত কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, “ঠিক বলছিস? পারবি তো? ফাঁকি দিলে কিন্তু মাঝ রাস্তায় এক পায়ে দাঁড় করিয়ে একশটা অঙ্ক করাবো।” আমি ঘাড় নাড়লাম, “পারবো, স্যার ঠিক পারবো। বলুন না।” মনে মনে বললাম, ঘাড় মটকাবে বলেনি এই আমার বাপের ভাগ্য।  অন্তত অঙ্ক করে বেঁচে তো থাকতে পারবো।

ভদ্রলোক তার ছায়া ছায়া হাত আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। অমনি কোত্থেকে একটা চিঠি এলো উড়ে। চিঠিটা উনি আমার হাতে দিলেন। বললেন, “পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া শরীর তো আর অফিসিয়াল কাজ করতে পারে না। এই চিঠিটা নিয়ে একবার তোমায় কলকাতা যেতে হবে। সেখানে ইউনিভার্সিটির অফিসে এই চিঠিটি দেখালে ওরা আমার নামে একটা সার্টিফিকেট আর পাঁচশত টাকা দেবে। জিনিসগুলো আমার বাড়িতে তোমায় পৌঁছে দিতে হবে।"
সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, “কিসের চিঠি স্যার? আসলে অফিসে গিয়েও তো বলতে হবে কি কাজে এসেছি।”

স্যার বললেন, “কয়েক বছর আগে অঙ্কের একটা শাখা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। সেই নিয়ে তো নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠল। সংসারে শান্তি নেই। ঘনঘন কলকাতা যাচ্ছি, আসছি। চারিদিকে তাড়া তাড়া বই ছড়ানো। তোদের জেঠিমা চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলতেন। তাও লেগেছিলাম সেটা নিয়ে। এ স্কোয়ার, এক্স স্কোয়ার, কিউব, টু দি পাওয়ার টুয়েন্টি। সংখ্যা নিয়ে এদিক ওদিক। ওপরে সংখ্যা, নীচে সংখ্যা, বাঁদিক, ডানদিক, চোখের সাথে মাটির ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে সংখ্যা, খাবার থালায় সংখ্যা, পায়খানার মগে সংখ্যা। চারিদিকে শুধু সংখ্যা আর সংখ্যা। এমনকি গৃহিণীর মুখেও ঘুরে বেড়াচ্ছে সংখ্যা আর সংখ্যা।" স্যার থামলেন। ভূত বলে কি মানুষ না। দম নেওয়ার প্রয়োজন আছে তো নাকি। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “তারপর, বুঝলি তো, একদিন গবেষণা শেষ হলো। কিন্তু ততদিনে শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছে। তাই আর কলকাতায় গিয়ে গবেষণাপত্রটি দিয়ে আসতে পারলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় পোস্ট করে দিলাম। সে পোস্ট গেল তো গেল। তার না পেলাম প্রাপ্তি স্বীকার। না পেলাম কোনো স্বীকৃতি। মাঝখান থেকে অপেক্ষা করতে করতে পট করে পটল তুললাম। তা সেই থেকে এই আমগাছের মগডালে জায়গা করে নিলাম। ওই যে বলে না, আকাঙ্ক্ষা থেকে গেলে আত্মা মুক্তি পায়না। আমার গবেষণাপত্রের খবর না পাওয়া ইস্তক মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। সেই জন্য সারাদিন বাড়ীর উঠোনের নিমগাছে কাক হয়ে বসে থাকতাম। তা আমার গিন্নী আমায় থাকতে দিলে তো। যেই না দেখত একটা দাঁড়কাক ওর সাধের নিমগাছে বসে অমনি মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে লাফাতে শুরু করতো। একে তো তার ওই দশাসই চেহারা, তার উপর কাকের থেকেও কর্কশ গলা নিয়ে এই সারা পাড়া মাথায় তুলে কাক তাড়াতে শুরু করল সকাল সকাল। ভূতেরও তো সহ্যের সীমা থাকে তাই না? তাই কাক থেকে মাছিতে পরিণত হলাম। মাছি হওয়ার পর একটু শান্তি পেলাম। নির্দ্বিধায় বসে থাকতাম বাড়ীর চালে। চিঠি আসবে আসবে করে এই কদিন আগে এল। বিশু পোস্টম্যান ঘন্টি বাজিয়ে দিয়ে গেল। তা আমার গৃহিণী সেটি দেখলেন। দেখলেন তার পটলপ্রাপ্ত স্বামীর নাম জ্বলজ্বল করছে বাদামি রঙের খামের ওপর। তাও সেটি ফেলে দিলেন জঞ্জালের স্তূপে। মটকা গেল গরম হয়ে। এত অচ্ছেদা! বেঁচে থাকলে কতো গবেষণা করতে পারতাম, কতো নাম ডাক হতো। তখন তুমিই গর্ব করে ঘুরে বেড়াতে নাকি? এখন চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল! দেখল না পর্যন্ত কি লেখা আছে! আবার আমি কাক হয়ে  উড়ে এসে বসলাম চিঠির ওপর। হ্যাঁ, বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প মারা এ তো সেই চিঠি। ঠোঁটে তুলে নিয়ে এলাম এই আমগাছে। তারপর স্বমহিমায় ফিরে খাম খুলে পড়ে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার গবেষণাপত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে, একটা শংসাপত্র পাবলিশ করেছে আর পুরস্কার স্বরূপ আমার জন্য পাঁচশ টাকা রেখেছে। আর আমার গবেষণাটি ওদের সিলেবাসে নিয়েছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এদিকে গিন্নির ওপর রাগও হলো চরম। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নাকি জঞ্জালে বালতিতে ফেলে দিল! বদলা নিতে আবার কাক হয়ে বসলাম নিমগাছের ডালে। যেই না উনি কাক তাড়াতে এলেন অমনি মাথায় দুটো ঠুকরে দিয়ে হলাম পগার পার। কিন্তু এই চিঠি নিয়ে কেইই বা যাবে কলকাতা, কেইই বা সেই কাগজ নিয়ে আসবে। এতদিন ধরে অতৃপ্তি নিয়ে লটকে ছিলাম এই আমগাছে” 

এবার আমতা আমতা করে বললাম, “ কিন্তু স্যার একটা প্রশ্ন আছে, এই কাজটা আমাকেই করতে বলছেন কেন? আরো কতো তো লোক আছে গ্রামে।”

স্যার এবার দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “সেটাই তো রে হরি। আমি তো খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম একটা মাধ্যম। যার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারি। কিন্তু কাউকেই পাচ্ছিলাম না। কেউ আমার কথা শুনতে পায়না।  খগেন বাড়ুই ভূত সমাজের মাথা। সে একদিন আমায় ডেকে বলল, বুঝলে জগাদা এমন করে হবে না। যে মানুষ তোমার কথা শুনতে পাবে, সেই মানুষই তোমার কাজ করে দিতে পারবে। তুমি এক কাজ করো এই আমগাছে বসে আসতে যেতে সব মানুষকেই হাঁক দাও। যে তোমার ডাকে সাড়া দেবে তাকেই খপ করে ধরবে। তা একদিন দেখলাম তুই এই গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিস। সবার মতো তোকেও হাঁক দিলাম, “এই হরে” বলে। ভেবেছিলাম হয়তো শুনতে পাবি না। কিন্তু আমায় চমকে দিয়ে, তুই চারিদিকে তাকাতে শুরু করলো। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবারও ডাকলাম। তুই আবার পিছু ফিরলি। আমি এবার নিশ্চিত হলাম তুইই সেই মানুষ যে আমার কাজ করতে পারবি।” 

স্যার থামলেন। আমি ঢোঁক গিলে চিঠিটা পকেটে চালান করলাম। কি করতে বেরিয়েছিলাম, আর কি কাজে ঢুকে পড়লাম। অসুবিধা নেই  এডভেঞ্চারটা কলকাতা থেকেই শুরু হোক। ভূতের ব্যাপার। কাজ না করলে যদি শপথ ভুলে  ঘাড় মোটকে দেয়। অকালে প্রাণটা যাবে। তারপর মাস্টার-ছাত্র এই আমগাছের ডালে পা দুলিয়ে দুলিয়ে অঙ্ক করবে। স্যার যেমন করে এসেছিলেন ঠিক তেমন করেই ভ্যানিস হয়ে গেলেন। আমি কয়েক পা এগোতেই দেখি স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতার ট্রেন আসবে। বসে পড়লাম স্টেশনের সিঁড়িতে। যথাসময়ে ট্রেন এল। আমি টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। মনে একটা খচখচানি রয়ে গেল। বেরোলাম আর ফিরবো না বলে। এদিকে স্যারের কাগজটা দিতে তো ফিরতেই হবে পাশের গ্রামে। দেখা যাক কি হয়। যা থাকে কপালে।

পরেরদিন সকাল সকাল চলে এলাম কলকাতা। সেই আমার প্রথম কলকাতা দর্শন বুঝলি তো। ওহ সে কি অভিজ্ঞতা। ঘুরে ঘুরে একটা ভদ্রস্থ ঘর পেলাম না। যা পেলাম তা টাকায় কুলায় না। অগত্যা আবার স্টেশনে এসে একটা খালি বেঞ্চি দেখে শুয়ে পড়লাম। ও বাবা! সেই বেঞ্চ নিয়েও সে শহরে কতো মারামারি তোরা তো জানিস না। সন্ধ্যে হতে একটা সিরিঙ্গে মতো লোক, খালি গায়ে, হাফপ্যান্ট পরে, আমায় ঠেলে তুলে দিয়ে বলল, “এই এটা আমার বেঞ্চি। তুই কে রে ব্যাটা এসে জুটেছিস?” আমি হাঁ হয়ে গেলাম। সরকারের তৈরি রেল স্টেশন। সেখানকার বেঞ্চ নাকি একজনের সম্পত্তি! তার পাশে দেখলাম আরো কজন এসে জুটেছে। তারাও সিরিঙ্গে লোকটাকে সমর্থন করে আমায় উঠে যেতে বলছে। আমি যারপরনাই অবাক ও হতবাক হয়ে উঠে গেলাম। স্টেশনের বাইরে সিঁড়িতে বসে রইলাম সারারাত।বসে এক রাত কাটিয়েছিলাম বুঝলি প্যাংলা। সেদিন বুঝেছিলাম এই হলো গিয়ে এডভেঞ্চার।

  সকাল হতেই চা-টা খেয়ে রওনা  দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। স্টেশন থেকে কিছুটা পথ হেঁটেই মেরে দিলাম। বাস ভাড়া তো বাঁচবে। তাই অনেক। অফিসে গিয়ে চিঠিটা দিলাম। লোকটি চশমার ফাঁক দিয়ে আমায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হাই তুলে বললেন, “ক্যান্ডিডেট কৈ? তাকে তো আসতে হবে।” আমি ততোধিক বড় হাই তুলে বললাম, “স্যার ক্যান্ডিডেট আসতে পারবেন না।”
― কেন শুনি?
― উনি পাঁচ বছর আগে পটল তুলেছেন। আপনাদের বিচারসভা রায় দিতে এত দেরী করল যে..”
― আপনি ক্যান্ডিডেটের কে?
― ছাত্র। ওঁর স্ত্রী আমায় দায়িত্ব দিয়েছেন।

লোকটি বিশ্বাস করলেন কি না কে জানে। একটা কাগজ আর ফাইল ঘেরা দরজা ঠেলে ঢুকে গেলেন। তারপর একটা বাঁধানো প্রমান সাইজের ফ্রেম এনে আমার হাতে দিলেন। বললেন, “এটা সবার সামনে ফুলের স্তবক সহ দেওয়ার কথা ছিল। উনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যেও কিছু বলতে পারতেন। তা বাঁশ যখন নেই আর বাঁশি বাজবে  কি করে।” একটা কাগজে সই করে বেরিয়ে এলাম জিনিসটা নিয়ে। কাঁচ ও কাঠের সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো শংসাপত্র। স্যারের নাম সুন্দর হাতের লেখায় লেখা।  স্যারের জন্য খুব খারাপ লাগছিল। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সারাজীবন গ্রামের ইস্কুলে পড়ালেন। লোকে বলতো জগন্নাথ মাস্টার সংখ্যা দিয়ে কথা বলে। যে স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করলেন আজীবন সেই স্বপ্ন ধরা দিলেও তা ধরতে পারলেন না। হায় রে, জীবন! কাকে যে তুমি কখন পুষ্পবৃষ্টি দেবে তা তুমিই জানো। শংসাপত্র আর টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে তো এলাম এবার অন্য খেয়াল মাথায় চাপল মাথায়। এ জিনিস তো পার্সেল করতে হবে। অতো টাকা তো ট্যাকে নেই। তাহলে আবার যেতে হবে গ্রামে? এতক্ষনে তো বাড়িতে নিশ্চই সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে  গ্রাম শুদ্ধ লোক জেনে গেছে আমি নিরুদ্দেশ। এদিকে পাশের গ্রামেই যদি ডাংডাং করতে করতে যাই, তাহলেই তো ধরা পড়ে যাবো। উফ, কি বিপদ! পরিবারের জন্য সব ব্যবস্থা করে এসেছি। খাওয়া পড়ার অভাব হবে না জীবনে। ছেলে সাবালক হলে চাকরিটাও পেয়ে যাবে। আর তো ফিরে যাওয়া যায়না। ভাবতে ভাবতে আবার হাঁটতে শুরু করলাম স্টেশনের দিকে। চিন্তা দিয়েছেন যিনি সেই চিন্তামণিই উপায় বলবেন। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়েছি হঠাৎ কাঁধে কেউ যেন হাত রাখল। ফিরে দেখলাম বিশু। আমার ইস্কুলের বন্ধু। এখন কলকাতায় বড় অফিসার। আমায় দেখে একগাল হেসে বলল, “কিরে হরে তুই এখানে?”

মনে পড়ল বিশু সরকারি চাকরি পেয়ে বেশ কিছুদিন আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। কিন্তু আমি ওকে গোটা ঘটনাটা বলতে পারলাম না। ভূতের গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না। উল্টে হাসাহাসি করে মাথাটাই দেবে গরম করে। হাসি মুখে স্যারের শংসাপত্র দেখিয়ে বললাম, “জগন্নাথ স্যারের এই জিনিসটা নিতে এসেছি।” বিশু অবাক হয়ে বলল, “জগন্নাথ স্যারের জিনিস? কিন্তু স্যার তো অনেকদিন হলো মারা গেছেন।” আমি মাথা নাড়লাম, “আরে সে কি আর জানিনা। এ অন্য ব্যাপার।” তারপর বিশুকে চিঠির ব্যাপারটা বললাম। তবে গল্পটা অন্যরকম ছিল। স্যারের বদলে চিঠিটা দিয়ে গেলেন স্যারের স্ত্রী। ওসব কাক, মাছি, মুড়ো ঝাঁটা সব বড়পত্রিকার সম্পাদকের মতো কেটে উড়িয়ে দিলাম। তারপর বললাম, “কিন্তু একটা বিপদে পড়েছি ভাই।”

― বিপদ? কি বিপদ রে?
― আমায় এখুনি এক জায়গায় যেতে হবে। ইমার্জেন্সি। না গেলেই নয়। এদিকে এই জিনিসটা বয়ে নিয়েও বেড়াতে পারছি না। যেখানে যাবো সেখান থেকে ফিরতে অনেক দিন লেগে যাবে। কি করি বলতো?
বিশু স্মিত হেসে বলল, “আগে চল আমার অফিস দেখে আসবি।” ঝাঁ চকচকে বলবো না তবে বিশুর অফিসটা যে বিল্ডিংয়ে সেই পুরোনো ব্রিটিশ আমলের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বিশু আমায় ওর টেবিল ঘুরিয়ে নিয়ে এলো ক্যান্টিনে। চায়ের সাথে বেশ কিছু টা এর বন্দোবস্ত করে আমার কাছ থেকে জগন্নাথ স্যারের ঠিকানা লিখে নিল একটা কাগজে। তারপর একজন পিওনকে  টাকা পয়সা আর ঠিকানা দিয়ে সেদিনই জিনিসটা পোস্ট মারফত পাঠানোর নির্দেশ দিল। আমার কাঁধ থেকে এই বিশাল বোঝাটা যে এত সহজে নেমে যাবে তা ভাবতেই পারিনি। জগন্নাথ স্যার কি আমার ওপর নজর রাখছেন? তিনি কি এসব দেখলেন? দেখে আশা করি ক্ষেপে যাননি। নাহলে এখুনি তাঁর কথা মতো একপায়ে দাঁড় করিয়ে অঙ্ক কষতে দিতেন। বিশুর সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো। গ্রামের হল হকিকত জানলো। আমি কলকাতার রাস্তাঘাট, ট্রেন, অলিগলি বুঝে নিলাম। তারপর ওকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে ঝাড়াহাতপা হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের উদ্দ্যেশে।”
পাগলা দাদু এবার থামলেন। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু ট্রাক্টরের একটানা ঘরঘর আওয়াজ।

“কিন্তু দাদু তোমার সেই বিশেষ ক্ষমতাটা তুমি কি করে পেলে সেটা তো বললে না?” বলল প্যাঙলাদা।
― কোন বিশেষ ক্ষমতা বলতো?



Keya Chatterjee