কেশ কাহিনী
জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি
'উরেব্বাস '-
যেন
চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেলাম একটা । গভীর ঘুম থেকে একেবারে ঝাঁকুনি দিয়ে
উঠে বসেছি বিছানায় । এসিটা বাইশে চলছে তবু গলা-কপাল ঘামে জবজব করছে ।
ঘড়িতে পাঁচটা ,তার মানে ভোর হয়েছে । ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! এমন
দুঃস্বপ্ন হলেও কী সত্যি হয়! ইতিপূর্বে ভুরিভুরি দুঃস্বপ্ন দেখেছি । বলতে
গেলে দুঃস্বপ্নের ভাঁড়ার আমার পরিপূর্ণ । শুধু কামিজ পরে সালোয়ার না পরে
বিয়েবাড়ি চলে যাওয়া , ভূগোল পরীক্ষার দিন রুটিন ভুলে জীবন বিজ্ঞান পড়ে
গিয়ে খাতায় ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আঁকা, সর্বসমক্ষে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়া
ইত্যাদি ভ্যারাইটিস দুঃস্বপ্ন আমার দেখা আছে । কিন্তু 'আজি এ প্রভাতে ' এ
কেমনতর দুঃস্বপ্ন দেখলাম! অবশ্যি এর পিছনে একটা গূঢ় কারণ আছে । কোনো
অবচেতনের চিন্তাভাবনা নয়, চেতনস্তরেই এর কারণ ঘোরাফেরা করছে ।
কোনোকালে
আমি যে কাজ করি না, কাল সে কাজ করেছি । রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঘন্টাখানেক
ধরে ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে, ইনিয়ে-বেনীয়ে, ফুল-মালা জড়িয়ে একলক্ষ রকমের
চুলবাঁধা দেখেছি । যে মানুষের আজীবন একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেল করা
ছাড়া ভাগ্যে আর কিচ্ছু জুটল না তার কী অতোরকম হেয়ার স্টাইল পেটে সয়, থুড়ি
মনে সয়! সইলো না । হেয়ার স্টাইল, হেয়ার-ফল হয়ে দুঃস্বপ্নে হানা দিল । যত
চুল আঁচড়াই, ততো ওঠে, উঠতে উঠতে শেষে মাথা ফাঁকা আর স্বপ্নের ইতি ।
তড়িঘড়ি খাট থেকে নেমে বড়ো আলোটা জ্বালিয়ে মাথাটা ভালো করে আয়নায়
দেখলাম । নাঃ, যে কুড়ি-পঁচিশটা নিজেদের মধ্যে দুগজ দূরত্ব মেনটেন করে বসে
ছিল, তেমনই বসে আছে । একেবারে সমূলে বিনাশ হয় নি । দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি,
একসময় কী চুল ছিল আমার ! ফিমাসে বাবা বিশু নাপিতের সেলুনে চুল কাটাতো ।
বয়স্ক বিশু জেঠু বাটিছাঁট দিতে দিতেই হাঁপিয়ে যেত । ক্লাস এইটে উঠে দেখলাম
বন্ধুদের চুল কোমর সইসই । অতএব শখ গেল, আমিও চুল রাখবো । বাটি ছেড়ে দোকান
থেকে ফিতে কিনে আনলাম । কাকিমা অ্যায়সা টাইট করে চুল বেঁধে দিতে লাগলো যে
মাথাময় আঁটফোঁড়া বেরিয়ে গেল । তাও সহ্য করলাম । বৃহত্তর সুখের জন্য ক্ষুদ্র
কষ্ট মেনে নিলাম । ফনফন করে চুল বাড়লো, মাধ্যাকর্ষণের টান অগ্রাহ্য করে
সোজা আকাশের দিকে উঠে পড়লো । অন্যদের যেখানে বেনী খুললে চুল ঝমর করে পিঠে
পড়ে, আমার সেখানে উর্দ্ধমুখী । ছোট্ট বৃত্তাকার মুখের উপরিভাগে রাশি রাশি
তারকা রাক্ষসীর মতো চুল । আচিরেই নাম জুটল- কাঠির মাথায় আলুর দম ।
পুজোপার্বনেও শ্যাম্পু করে বেরোতে পারি না । আয়নায় মুখ দেখলেই মনে হয় যেন
মা চামুন্ডা । কোনোরকমে রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুলের পুঁটুলি বেঁধে মা দুর্গার
সামনে গিয়ে জোড়হস্তে প্রার্থনা করি-
"মা চুলের ভার কমিয়ে গায়ে একটু গত্তি লাগিয়ে দাও !"
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-কুটুম সবাই বলে-
"যা খায় , পুষ্টি সব চুলেই টেনে নেয়, শরীরে কিছু লাগে না ।"
প্রত্যেক প্রার্থনার তাই কমন টপিক-
"চুল একটু কমিয়ে চেহারাটা একটু শুধরে দাও মা "
প্রার্থনা
মঞ্জুর হল কিন্তু যখন হওয়ার তখন না হয়ে একযুগ পরে হলো । এত্ত সিরিয়াসলি মা
অবশেষে আমার প্রার্থনা শুনলেন যে কহতব্য নয় । চেহারা বাড়তে লাগলো যে
রেটে, হু হু করে চুলও উঠতে লাগলো সেই রেটে । তখনো ব্যালেন্স ছিল না, এখনো
ব্যালেন্স রইলো না । এখন কোমরে পেটে কেজি কেজি মেদ, মাথায় দু-চারটে চুল ।
সামনের পুজোয় বোধকরি ও কটাও থাকবে না । টাক মাথায় প্রার্থনাহীন ঠাকুর
প্রণাম করতে যাবো । যা স্বপ্ন দেখলাম তাতে তো আশঙ্কায় সিলমোহর পড়ে গেল ।
ঐ যে কথায় আছে না- morning shows the day, morning -এর স্বপ্নও তেমনি
সারাদিনটাকে তেতো করে দিয়েছে । অফিসে গিয়ে তোম্বামুখে ফাইলের পাতাগুলো
নাড়াচাড়া করা দেখে পাশের টেবিলের লাবণি দি জিজ্ঞেস করলেন-
"কী হয়েছে রে তোর্সা? মুড অফ,"
ভীষণ চোখ ভদ্রমহিলার । কী আর বলবো!-
"নাঃ, তেমন কিছু না । ঐ একটা বাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ ।"
"বাজে স্বপ্ন? খুব খারাপ কিছু? ভোরবেলা দেখেছিস নাকি?"
অগত্যা
বলতেই হয় । গড়গড়িয়ে বলে আমারও মনটা একটু হাল্কা হয় ।ভেবেছিলাম উনি হাসবেন
কিন্তু দেখি কিনা উনি ওঁনার ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা কার্ড বের
করে দিলেন-
"নে, অনেক তো বিউটি পার্লার ঘুরলি, এবার ডাক্তার দেখা ।"
"ডাক্তার !" চশমাটা চোখে আর একটু এঁটে কার্ডটা দেখি---
Dr. Ruchira Roy
MBBS, MD(Dermat)
Dermatologist, Cosmetologist
For appointment contact-
"ফোন করবো?"
"হ্যাঁ, কর ।"
" আজই?"
" হ্যাঁ, মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা । আজ বুধবার । দেরি কীসের?"
"নেবো অ্যাপয়েন্টমেন্ট?"
'অবশ্যই, যদি না স্বপ্ন সত্যি করতে চাস ।"
লাবণি
দির কথায় বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে আমার । তাড়াতাড়ি ফোন লাগাই ।
পনেরোশো টাকা গুগল পে করে অ্যাপো ফিক্সড করি । আগামী রবিবার, বেলা সাড়ে
দশটায় । বলেই দিল- টাইম নিয়ে যেতে ।
"রবিবার লাবণি দি ।"
"বেশ । খুব নাম শুনি । দেখ তোর উপকারই হবে ।"
বুধবার থেকে রবিবার ঠিকই এসে যায় । কলার কাঁদির মতো চুল টিকটিকির
লেজের মতো হয়ে যায়, এক্স এস সাইজ ডাবল এক্স এল হয়ে যায় আর বুধবার থেকে
রবিবারের দূরত্ব আর কতটুকু । ঠিক সাড়ে দশটায় ক্লিনিকে হাজির হই । কাঁচের
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি । চারখানা এসির হাওয়ায় ভিতরটা যাকে বলে- 'চিল্ড'। আলো
পিছলে যাওয়া ঝকঝকে টাইলসের মেঝের উপর সারি সারি স্টিলের চেয়ারে অপেক্ষমান
বেশ কয়েকজন । আমি সোজা রিসেপশনের সামনে যাই, নাম বলি । হাস্যমুখী
রিসেসশনিস্ট বাকির পাঁচশো টাকা নিয়ে বলেন-
"বসুন "
"সাড়ে দশটায় টাইম ছিল।"
"হ্যাঁ, ম্যাডাম এখোনো আসেননি । আপনি দশ নম্বরে আছেন ।"
ও
বাবা ! তারমানে এখন দীর্ঘ অপেক্ষা । চেয়ারে গিয়ে বসি । আশেপাশে চকচকে
স্কিন, ঝকঝকে একঢাল চুলের মহিলাদের অপেক্ষারত দেখে মনে ভরসা পাই যে বোধহয়
ঠিক জায়গাতেই এসেছি । পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষণে বেশ কিছুটা সময় কাটার পর
ভিতরে আসার কাঁচের দরজাটি খুলে একজন অত্যন্ত সুন্দরী যুবতী ঢোকেন । বয়স
আন্দাজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে । রিসেসশনিস্টের তৎপরতা দেখে বুঝি ইনিই ডাক্তার ।
পায়ে কালো হাইহিল জুতো, নীল জিন্স, সাদা শার্ট, চোখে চৌকোনা কালো
ফ্রেমের চশমা কিন্তু এ কী! ভুল দেখছি নাকি! মাথায় তো উইগ মানে পরচুলা ।
রঙবাহারি কিন্তু পরচুলা । আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয় । দুনিয়াসুদ্ধ
লোকের চুল দেখে বেড়াই আমি । এ পরচুলা না হয়ে যায় না ।
এ কী ডাক্তার দেখাতে এলাম আমি! চুল ওঠার চিকিৎসা করাতে এলাম যার নিজেরই মাথায় পরচুলা তার কাছে!
পৃথিবীটা দুলে ওঠে আমার । চেয়ারে বসে বসেই মনে হয় এবার পড়ে যাবো ।
চোখদুটো ঝাপসা ঝাপসা লাগে । একটা মাত্র খড়কুটো পেয়েছিলাম তাও ভেসে গেল ।
লাবণি দি তো জানে না হেন জিনিস নেই অথচ এটা জানতো না! ধুর ছাই কী হবে আর
ডাক্তার দেখিয়ে! চলে যাবো? টাকা তো আর ফেরত দেবে না । দু হাজার টাকা! থাক,
টাকা দিয়েছি যখন দেখিয়েই যাই । দেখি ডাক্তার কী বলে!
গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে থেকে অবশেষে ডাক আসে । লাল আঁচিলের সমস্যা নিয়ে
ঢোকা একজন ধবধবে ফর্সা মারোয়াড়ি ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসবার পর আমি চেম্বারে
ঢুকি । সুসজ্জিত একটা ছোট্ট ঘর । ঘরের উজ্জ্বল আলো ছাপিয়ে ডাক্তারের
হাসিমুখ আমাকে অভ্যর্থনা জানায়-
"বসুন । কী সমস্যা?"
আবার হতাশা ফিরে আসে আমার মনে । বলে আর কী হবে? তবু বলি-
"চুল উঠছে খুব ।"
"ওঃ" - বলে সোজা আমার দিকে উঠে আসেন । মাথাটা ধরে নেড়েচেড়ে, চুলের গোড়ায় গোড়ায় আঙুল চালিয়ে দেখে নিজের সিটে গিয়ে বসেন ।
" হ্যাঁ । বেশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে মাঝখানটা । আমি ওষুধ আর একটা শ্যাম্পু দিচ্ছি । কাজ না হলে অন্য থেরাপি স্টার্ট করবো ।"
"আদৌ কিছু হবে?"
"মানে?"
"মানে আদৌ কী কিছু হবে? হলে কী আর আপনি পরচুলা পরতেন ।"
"ওঃ,
এই ব্যাপার, বুঝে ফেলেছেন "- বলে হাসতে হাসতে উনি পরচুলাটা খুলে ফেলেন ।
কী সুন্দর করে কাটা মাথাভর্তি ছোট্ট ছোট্ট চুল ওঁনার । হাঁ হয়ে যাই আমি-
"পরচুলা পরেছেন কেন?"
"স্টাইল করে পরেছি । অনেক বড়ো চুল ছিল যখন পরতে পারতাম না । এখন চুলটা কাটার পর একটু ট্রাই করেছি ।"
"চুলটা কাটলেন কেন?"
"আসলে
আমার এক বন্ধুর একটা এন জি ও আছে । ওরা ক্যান্সার পেশেন্টদের জন্য উইগ
বানায় আসল চুল দিয়ে । সেগুলো দেখে আপনিও বুঝতে পারবেন না ।"
ওঁনাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠি-" আমিও কী চুল দিতে পারি? এ তো মহান কাজ।"
"আপনি? হ্যাঁ, তা পারেন বৈকি । "
"তাহলে ঠিকানাটা একটু লিখে দিন ।"
"আচ্ছা , বেশ ।"
" চুল ছোট করে কাটলে তো চুল ওঠাও কমে, তাই না "
চোখের এককোনায় হাসির ঝলক খেলে যায় ওঁনার-
"হ্যাঁ তা কমে, অবশ্যই কমে ।"
তড়বড় করে আমি বলে উঠি-
"আর উইগটা কোথা থেকে কিনেছেন তাও লিখে দেবেন ।"
"কেন?"
"বলা তো যায় না, যদি দরকার পড়ে।"
"না, না, আমি থাকতে দরকার পড়বে না ।"- বলে প্রাণখুলে হাসতে থাকেন ডক্টর রুচিরা ।
লোকে বলে- কেশই নাকি বেশ, কেশেই যাবতীয় সৌন্দর্য । ভুল, একদম ভুল । আসল সৌন্দর্য নিহিত থাকে হাসিতে, প্রাণখোলা হাসিতে ।।
.............................
সমাপ্ত
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি