বরুণ সরকারের শেষ লেখা - রণি বসু

 

বরুণ সরকারের শেষ লেখা
রণি বসু
 

 


  রাতে ছাদে শুয়ে ঘুমোনো আমার বরাবরের অভ্যেস। এটা কেবল গ্রীষ্মের গরমের জন্যই নয়, এর একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে আমার কাছে। সেটা হল আকাশের আকর্ষণ। দিনের আকাশ নয়, রাতের আকাশ। যে আকাশ নির্মেঘ, তারাভরা। তাই বৃষ্টির দিন এমনিতেও আমি ঘরেই ঘুমোই, কারণ সেদিনগুলোয় তারাদের দেখা যায় না।

  কীভাবে এই টান তৈরি হল তা আমি নিজেই বুঝতে পারি না। তবে রাতের খোলা আকাশের নীচে শুয়ে শরীরে-মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করি। চোখ খুলে বা চোখ বুজে। এই শান্তি আমি আর কোথাও কিছুর মধ্যেই খুঁজে পাইনি।

  আমার জীবনের একাকিত্বও ঘুচে যায় তারাভরা আকাশের সান্নিধ্যে। ঘুমের মধ্যে মনে হয় অসংখ্য কণ্ঠস্বর আমাকে একটানা কিছু বলে চলেছে। সেসব আমি বুঝতে পারি না। ওদের ভাষাটা আমার পরিচিত নয়, কিন্তু তাও আমার অল্প চেনা চেনা লাগে। তবে কথার অস্পষ্টতার জন্যই বোধগম্য হয় না তা। যেন মনে হয় শতকোটি আলোকবর্ষ দূরের কেউ ডাক দিচ্ছে আমাকে, আমাকে বলতে চাইছে কিছু। তারপরেই মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে ঘুমমাখা আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পাই আকাশের সেই তারাগুলো, শুধু তারা। আর কেউ কোথাও নেই।

  আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি ওদের কথাগুলো উপলব্ধি করার। কারণ ওরা আমায় ডাকছে বহুদিন, বহুবছর ধরে, যবে থেকে আমি ছাদে ঘুমোনো শুরু করেছি। কিন্তু আমি সে ডাকে সাড়া দিতে পারছি না, কারণ সাড়া দিতে গেলেই ঘুম ভেঙে যায়। তাই আজকাল আমার মনটা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারি না। ওই দুর্বোধ্য ডাক সারা দিনরাত আমার মাথার ভিতরে প্রতিধ্বনিত হয় যেন। পাগল পাগল লাগে।

  তবে এই অস্থিরতাই যেন শাপে বর হল। আমি ভাবতে পারিনি যে মাথার ভিতর এই চঞ্চল ঢেউগুলোই অবশেষে একদিন এক প্রবল ধাক্কায় খুলে দেবে আমার মনের দরজা। হ্যাঁ, অবশেষে আমি শুনতে পেলাম সেই দূরাগত বার্তা। শুধু শোনা নয়, কীভাবে যেন অনুধাবন করতেও পারলাম। ওরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যদিও এখনও আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি না। এ এক অশরীরী আহ্বান। তবে এই আহ্বানে এক অদ্ভূত মায়ার টান আছে। ওরা যেন আমার সাত জন্মের আত্মীয়। আমি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারছিলাম না ওই ডাকের আকর্ষণ।

  ওরা বলল, 'অনেকদিন অপেক্ষা করিয়েছ। আজ তুমি প্রস্তুত?'

  আমি ঘোর লাগা মস্তিষ্কে মাথা নাড়াই। হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। আমি আর আমার মধ্যে নেই। ঘুমের মধ্যেও এ যেন এক অন্যরকম ঘুমের নেশায় আমি আচ্ছন্ন।

  তবে একসাথে দু'টো ঘুম বোধহয় ঘুমোনো যায় না। কারণ এরপরেই আমার পার্থিব ঘুম ভেঙে গেল আচমকাই। কিন্তু থেকে গেল সেই অপার্থিব মহাজাগতিক ঘোর। প্রথমে ঠাহর করতে পারলাম না কী হচ্ছে। সোজা হয়ে শুয়েছিলাম, চোখ খুলতেই দেখলাম সেই রহস্যময় কালো রাক্ষুসে আকাশ, কিন্তু সেই রাক্ষসের ভয় ম্লান করে দিয়েছে ছোটোবড়ো সাদা আলোকবিন্দুগুলো। আমার হাত-পা যেন অবশ। হতাশ মনে ভাবলাম, আজকেও ঘুমটা ভেঙে গেল মোক্ষম সময়ে, পৌঁছাতে পারলাম না ওদের কাছে। আজও ওরা অধরাই থেকে গেল।

  কিন্তু না। আমি পিঠের নীচে কোনো কঠিন মেঝে টের পেলাম না। নরম হাওয়ার বিছানা। আর আমার চারিদিকে নেই ছাদের চার দেওয়ালের চৌহদ্দি। আমি উঠছি, আরও উপর দিকে উঠছি। ছাদ থেকে শূন্য, শূন্য থেকে মহাশূন্যে। কালো আকাশ একইরকম আছে, কেবল উজ্জ্বল আলোকবিন্দুগুলো বড় হতে হতে আলোকপিন্ডের রূপ ধারণ করছে ক্রমশ। তবে কি আজই আমার এই দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান? আজই কি আমি জানতে পারব এই আকাশ, এই তারার দেশ আমাকে টানে কেন? কী সম্পর্ক আমার ওদের সাথে?

  জলতেষ্টা পাচ্ছিল খুব। কিন্তু আমল দিলাম না। মন বলছিল এক চিরশান্তির দেশে আমি পাড়ি দিয়েছি। সেখানে একবার পৌঁছে যেতে পারলে এরকম ছোটোখাটো অস্বাচ্ছন্দ্য বা অস্বস্তির আর কোনো জায়গা থাকবে না। আমি আবার চোখ বুজলাম। মনের ভিতর একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি কাজ করছিল। আজ আমার মুক্তি। কে বলে মৃত্যুর আগে মুক্তি নেই? আমি তো না মরেই উপভোগ করছি সেই মুক্তির আনন্দ। আর নেই রোজকার অফিস যাওয়া, বসের অকারণ ঝাড়, প্রতিবেশীর 'পাগলা' বলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ শোনা কিংবা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাওয়া। আঃ, এই শান্তি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়!

  আরও কতক্ষণ এভাবে ভেসে ছিলাম জানি না, কারণ সময়ের হিসাব করিনি আর কেউই হাতঘড়ি পরে শোয় না। অনেকক্ষণ পরে চোখ খুললাম আবার, গায়ে গরম হলকা লাগায়। তারাগুলোর খুব কাছে এসে পড়েছি। সত্যি বলতে কী, ওদের হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে যতটা নিরীহ মনে হত, এখন কিন্তু আর ততটা মনে হচ্ছে না। বরং ওই কালো আকাশ দানবের অসংখ্য জ্বলন্ত চোখের মতো লাগছে। আমার অল্প ভয় ভয় করছে যেন এবার। আমি কি আকাশের মায়াজালে জড়িয়ে নিজেকে বিপদে ফেললাম? সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরগুলোই বা কানে আসছে না কেন আর?

  দেখলাম, আমি এগিয়ে যাচ্ছি একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের দিকে। নিজেকে থামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, পারলাম না। আমি যেন এক মহাজাগতিক গতি প্রাপ্ত হয়েছি। আমি আর আমার মধ্যে নেই! ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অবর্ণনীয় ভয়ে চোখ বুজে ফেলি আমি।

  আর ঠিক তখনই আবার শুনতে পাই ওদের কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য, এবার অনেক কাছে! গমগম করছে যেন। ওরা সমস্বরে বলে উঠল, 'এসেই যখন পড়েছ, তখন এত ভয় কীসের? তুমি তো জানো - আমরাই তোমার বন্ধু, তোমার আপনজন। ভয় পেও না। চোখ খুলে ওই দেখো, তোমার মা, তোমার বাবা। তোমার সামনেই। তুমি দেখতে চাও না ওদের?'

  আমার ছোটোবেলাটা কেটেছে চাইল্ড কেয়ার হোমে। পরে জেনেছিলাম, ওঁরা আমাকে যেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তার আগের দিনই কাছাকাছি একটা জলাশয়ে উল্কাপাত হয়েছিল। সেই জলাশয়ের ধার থেকেই আমাকে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু মা-বাবা? তাঁদের সন্ধান আমি কোনোদিন পাইনি!

  আজ সেই মা-বাবা আমার সামনে? আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলাম। কিন্তু একী! এ তো দু'টো বিশাল তারা! একদম কাছে। ওগুলোর গরম হলকায় আমি পুড়ে যাচ্ছিলাম। ওহ্, অসহ্য!

  আমি আবার শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম, ব্যর্থ হলাম। আমার শরীরটা যেন ক্রমশ কাঠকাঠ, জড় পদার্থের মতো হয়ে যাচ্ছে। ঘাড়টা কোনোমতে ঘুরিয়ে নীচের দিকে তাকালাম, মাথা ঘুরে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেললাম আবার। এবার যা হবে সবই আমার নিয়তি।

  আর তখনই অনুভব করলাম, উত্তপ্ত অগ্নিপিণ্ডগুলো স্পর্শ করে ফেলেছে আমার শরীর। আআআআআ, অসহ্য উত্তাপে আমি পুড়ে যাচ্ছি, আর পারছি না! শুনতে পাচ্ছি চারদিকে প্রবল অট্টহাসি। সেই কণ্ঠস্বরগুলোর! যেন ওদের খুব আনন্দ! কিন্তু ওরা আসলে কারা? তারারা কি কথা বলে, হাসে? চামড়া পোড়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি আমি। মুক্তি পাওয়া সত্যিই সোজা নয়।

  তারপর একসময় মরে আসতে লাগল আমার শরীরের সমস্ত কষ্ট, অস্বস্তি। নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে। ওদের হাসিও থেমে গেছে। এখন আবার সমস্বরে বলে উঠল ওরা, 'আর ভয় নেই। তুমি এখন আমাদেরই একজন। আমরাই তোমার হারানো পরিবার, আপন করে নাও আমাদের…..'

  আমার অগ্নিগোলকের ন্যায় দেহটায় এখন কোনো প্রাণের স্পন্দন টের পাওয়া যাবে না আর। কিন্তু আমি 'হ্যাঁ' বললাম, যেটা কেবল আমার স্বজাতি, আকাশের ওই লক্ষ লক্ষ তারারাই বুঝতে সক্ষম হবে।

       *        *        *        *        *        *        *       

  এ ডায়েরি আমার বন্ধু বরুণের। ও টুকটাক লেখালিখি করত আমার মান্থলি সায়েন্স-ফ্যান্টাসি ম্যাগাজিন 'সাইফাই'-তে। লিখত দারুণ, এমনিতে মানুষও ভালো। তবে এটা আমারও মনে হত যে ও সত্যিই কিছুটা 'পাগলা' ছিল।

  ক'সপ্তাহ আগে 'সাইফাই'-এর স্পেশাল ইস্যুর জন্য ওকে একটা লেখা দিতে বলেছিলাম। সে লেখা আর হাতে পাইনি, কারণ তার আগেই ও বাড়ি থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেছিল।

  কিন্তু আজ সকালে অফিসে এসে আমার টেবিলে দেখতে পেলাম কালো ডায়রিটা। কোথা থেকে এল, কে রাখল, কেউই কিছু বলতে পারল না। খুলে দেখলাম, ডায়েরির প্রথম পাতায় নাম লেখা বরুণ সরকার।

  একেবারে নতুন ডায়েরি। শুধু শুরুর তিনটে পাতায় আঁকাবাঁকা প্রায় পাঠের অযোগ্য হরফে এইটুকু লেখা। যদিও বরুণের হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিল।

  যদি বরুণের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এই 'গল্প'-ই সত্যি হয়, তাহলে সেসব কথা পরে এই ডায়েরিতে লিখল কে? অনেক ভেবেও কূলকিনারা করতে পারলাম না। একসময় ভাবা বন্ধ করে দিলাম, কারণ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা হয় না।

  তবে ঠিক করলাম স্পেশাল ইস্যুতে বরুণের গল্পের জায়গায় ওর নাম দিয়ে ডায়রির এই তিনটে পৃষ্ঠাই ছেপে দেবো। আশা করি পাঠক ভালোই খাবে। গল্পের একটা নামও ঠিক করে ফেলেছি - 'তারা'ই আমার আত্মীয়। মন্দ নয় - তাই না?

[সমাপ্ত]
 অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার