পিছুটান - বনবীথি পাত্র

 পিছুটান

বনবীথি পাত্র 
 

 
 

-তা ঠিকমত বাজাতে পারবে তো বাপু! ঢাকের বোল ছাড়া পুজোর পরিবেশ সম্পূর্ণ মাটি। আমাদের তো পাঁচ পুরুষের পুজো। আমার ঠাকুর্দার আমলেও দুর্গাপুজোতে ঢোল বাজত। ঢোল আর কাঁসি। ঢাকে কাঠি পড়ত তো চৈত্রমাসে গাজনের সময়।আমাদের গ্রামের গাজন যদি কোনদিনও দেখো তো বুঝবে, সে দুর্গাপুজোকেও হার মানায়।

-দুর্গাপুজো থেকে গাজনে পৌঁছে গেছো? বলি ছেলেটা সবে তো বাড়িতে এসেছে, এখন তো কটাদিন থাকছে এখানেই। তখন না হয় তোমার এইসব গালগপ্পো শুনিও ওকে। একবার চেয়ে দেখো দেখি, মুখখানা কেমন শুকিয়ে গেছে বাছার। কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কে জানে! পথে কিছু পেটে পড়েছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।

দেবতোষবাবু আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গিন্নির কথায় থামতেই হল তাঁকে। বিনু দালানের একপাশে তার ঢাকখানাকে একহাতে আঁকড়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। বাপ মারা যাওয়ার পর বছর বারো-তেরো হল সে দুর্গাপুজোতে ঢাক বাজাতে শহরে আসছে। কিন্তু সে তো কোন ক্লাবের বারোয়ারি পুজোতে ঢাক বাজিয়েছে এতকাল। এই প্রথমবার কোন বনেদি বাড়ির পুজোতে ঢাক বাজাতে এসেছে। ক্লাবের বাবুরা দামদর করে একেবারে সঙ্গে করে ক্লাবে নিয়ে যাবে এই আশাতেই প্রতিবারের মত স্টেশনে বসে ঢাক বাজাচ্ছিল বিনু।  এঁদের বাঁধাধরা ঢাকি শেষমুহূর্তে আসতে পারবে না খবর দেওয়ায় বুড়ো ম্যানেজারের দায়িত্ব পড়েছিল বিকল্প ঢাকি ধরে আনার।স্টেশনে অতজন থাকতে বুড়ো ম্যানেজারের কেন যে তাকেই মনে ধরল তা শুধু মা দুর্গাই জানেন! বিনুর বুকের মধ্যে যেন গঙ্গাফড়িং ফড়ফড় করছে সবসময়। মানে মানে পুজোর দিনগুলো উতরে দিতে পারলে বাঁচে। গিন্নিমার কথা শুনে একটু যেন মনে ভরসা পাচ্ছিল, সত্যিই তার বড্ড খিদে পেয়েছে। আসার সময় চানুপিসি খানিক মুড়ি বাতাসা সঙ্গে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সে আর খাবার অবকাশ হয়নি।

-ও মাখন, মাখন....
ছেলেটা কখন থেকে এখানে বসে আছে, ওকে ওর থাকবার ঘরখানা একটু দেখিয়ে দে না বাপু। যেদিকে খেয়াল রাখব না, সেদিকেই কোন কাজ হবে না। সবগুলো হয়েছে ফাঁকিবাজের শিরোমণি।

গিন্নিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাঁটুর ওপর আধময়লা ধুতি পরা একজন মাঝবয়সী লোক হাজির হয় সামনে।

-মাখন মোটেই ফাঁকিবাজ নয় গিন্নিমা। মেজদাবাবু বাগান পরিষ্কার করার জন্য কাদের ধরে এনেছে জানি না বাপু, দশ মিনিট কাজ করে তো আধঘন্টা বসে জিরোচ্ছে আর বিড়ি খাচ্ছে।

ভবতোষবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। 

-গিন্নিমা যা বলছে তুই সেটা কর, আমি বাগানে গিয়ে দেখছি। মেজো খোকা আর কবে যে মানুষ চিনতে শিখবে!

-চল তোমাকে ঘরখানা দেখিয়ে দিয়ে আমাকে একবার ছোড়দিমণির সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ঢাক আর নিজের পোঁটলাটাকে সঙ্গে নিয়ে মাখনের পিছু পিছু সবে দুপা হেঁটেছে বিনু, তখনই পিছন থেকে গিন্নিমার গলা,

-ঢাকখানাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় চললে! ঢাক এই দালানেই থাক। আমি কাউকে দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে পাঠিয়ে দেব। তুমি চানটা সেরে এখানে চলে এসো। আমি তোমাকে জলখাবার দিতে বলছি। এই দেখো এত কথা বলছি, তোমার নামটাই তো জানা হয়নি এখনও। বলি তোমার নাম কী বাছা?

ঢাকখানাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে বিনু প্রায় হাতজোড় করে বলে,

-আজ্ঞে বৃন্দাবন। সবাই আমাকে বিনু ডাকে।

-অত বড়সড় নামের থেকে বিনুই ভালো। আমিও তোমাকে বিনু বলেই ডাকব। যাও চটপট চান সেরে চলে এসো। জলখাবার খেয়ে নিয়ে তোমার গল্প শুনব।

বিনু সম্মতির ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে। গিন্নিমা মানুষটাকে তার বড্ড ভালো লেগেছে। বেশ একটা মা মা ভাব আছে মানুষটার মধ্যে। কিন্তু গিন্নিমা যে ওর গল্প শুনবেন বললেন, কী গল্প বলবে বিনু! ওর নিজের আর কী গল্প আছে! আবার তখনই হঠাৎ তার উল্টো কথা মনে হয়। তার পুরো জীবনটাই তো গল্পের মত। জন্মে থেকে কোনদিনও তো নিজের মাকেই দেখেনি বিনু। চানুপিসির কোলে পিঠেই বড় হয়েছে ছোট থেকে। গাঁয়ের শেষ প্রান্তে একেবারে নদীর ধারে তাদের বায়েন পাড়া। অতবড় গ্রামে তারা মাত্র চার-পাঁচঘর বায়েন। জমিজমা বলতে কিছুই তাদের ছিল না। কচ্চিৎ কখনও বাবুদের জমিতে কাজের সুযোগ পেত। বিনু ছোটবেলায় কতদিন বাপ খুড়োদের ভাগার থেকে মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে আনতে দেখেছে। নদীর জলে সে সব চামড়া ধুয়ে শুকিয়ে গঞ্জে মহাজনের কাছে বিক্রি করে যা পয়সা পেত, তাই দিয়ে কোনরকমে একবেলা একমুঠো নুন ভাত জুটত। বাবা তো ঢাকের চামড়াও সারা বছর ধরে নিজেই তৈরি করত। সারা বছরের মূল রোজগারটা হত দুর্গাপুজোর সময় শহরে ঢাক বাজাতে এসে। বাবার ঢাকের আওয়াজ শুনেই নাকি শহরের বড় বনেদি বাড়িতে বাবাকে একবারে বাঁধা ঢাকি করে নিয়েছিল। বিনুর এখন আফশোস হয় বাপের সঙ্গে শহরে এসে যদি সেই বনেদি বাড়িখানা চিনে রাখত,  তাহলে তাকে আর প্রতিবছর ঢাকের বায়নার জন্য হাপিত্তেশ করে ইস্টিশানে বসে থাকতে হত না। কিন্তু বিনুর বাজানো কি আর পছন্দ হত তাঁদের? বাবা সারা বছর কত যত্ন করে ঢাক ছাইত। আর এখন তো ঢাকে চামড়ার ব্যবহারই নেই, সব ফাইবার হয়ে গেছে। চামড়ার আওয়াজ আর ফাইবারের আওয়াজে আকাশ পাতাল তফাত। বিনুর কানেও সে তরিতফাৎ ভীষণ ধরা পড়ে।

-এ দেখো,  এই ঘরেই এ কদিন থাকবে তুমি। 

তারপর লম্বা ছাউনির শেষ প্রান্তে আঙুল তুলে মাখন বলে,

-ওইটা হল গিয়ে চানঘর। যাও জিনিসপত্র রেখে, চানটা সেরে নাও তো বাপু। আর ঘর থেকে যাওয়ার সময় ঘরে তালা দিয়ে যাবে। পঞ্চাশ লোকের আনাগোনা এখন বাড়িতে। কিছু হারিয়েছে, চুরি গেছে বললে কর্তামশাই কিন্তু খুব রাগ করবেন। যত্ন করে রাখো এই তালা চাবি। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে মনে করে আমার হাতেই দিয়ে যাবে।

তালা চাবিটা বিনুর হাতে দিয়ে মাখন চলে গেল। বিনু আনমনে চারপাশটা দেখতে লাগল।

একটা বড় লোহার গেট আর তারপরেই বাগানের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের পথ। মোরামের পথ দিয়ে মোটরগাড়িও ঢুকে যায় সহজেই। মোটরগাড়ি রাখার বিশাল জায়গার পাশ দিয়ে বাড়িতে ঢোকার রাস্তা। বাড়ি তো নয় তিনতলা বিশাল প্রাসাদ! ঢুকেই বিশাল ফাঁকা উঠানের একধারে চণ্ডীমণ্ডপ। অন্য তিনধারে চওড়া বারান্দার কোলে সার সার বন্ধ ঘর। ওপর তলায় তাকালে বারান্দার কাঠের কারুকাজ করা রেলিং ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। ফাঁকা উঠোন অনেক ওপরে সেই তিনতলা ছাদের সঙ্গে লোহার তারজালি দিয়ে ঘেরা। রোদ, হাওয়া আসার সুন্দর ব্যবস্থা; অথচ কাকপক্ষীটি ঢুকতে পারবে না। দরদালানের কোন এক ফাঁক দিয়েই মাখন যেন নিয়ে আসে বিনুকে। এটা বাড়ির পিছন দিক। এখানেও বিশাল বাগান। বাগানের পাঁচিলের কাছ ঘেঁষে টিনের ছাউনি দেওয়া পর পর তা প্রায় খান দশের ঘর। এর একটা ঘরেই বিনুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কাছেই কলঘর। দু-চারজন অশপাশের ঘরগুলোয় ঢোকা বেরনো করছে। বিনু তাদের দেখলেও তাদের যেন বিনুকে দেখার বা দুদণ্ড দাঁড়িয়ে বিনুর সঙ্গে কথা বলার অবসর নেই। আড়চোখে বিনুকে একবার জরিপ করেই যে যার কাজে চলে যাচ্ছে। এখানে মনে হয় বাড়ির চাকর বাকর, কাজের লোকজনরা থাকে। বিনু ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চারপাশের সবকিছু দেখছিল। দোতলা তিনতলার ঘরের জানলাগুলো খোলা। কিন্তু কোন মানুষ চোখে পড়ে না। 

-এ কী তুমি এখনও নাইতেই যাওনি! ওদিকে তোমার দেরি দেখে গিন্নিমা আমাকে ডাকতে পাঠালেন। যাও যাও আর দাঁড়িয়ে থেকোনি তো, চান সেরে দুটো খেয়ে নেবে চলো দেখি।

চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল মাঝবয়সী মহিলাটি।

-এ বাড়ির হিরে থেকে জিরে সব আমাকেই সামলাতে হয়। এমন লাজুক, মুখচোরা হয়ে থাকলে পুজোবাড়িতে এত লোকের মাঝে দুবেলা খেতেও পাবে না। তাই খাওয়ার সময় সুযোগ বুঝে খেতে বসে যেও। আর যদি কোন দরকার পড়ে তো কাউকে দিয়ে এই সরলাদিদিকে একটা খবর পাঠিও। 

আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরলা বলে,

-দেশে তোমার মতই আমার একটা ভাই আছে। তোমার মুখটা দেখেই তার মুখটা মনে পড়ে গেল। কতবছর তাকে দেখিনি।

আর কোন কথা না বলে সরলা চলে যায়। বিনু মাখনের দেখিয়ে দেওয়া ঘরের দরজার শিকল খুলে ভেতরে ঢোকে। একখানা ছোট চৌকিতে পরিষ্কার চাদর পাতা। একটা বালিশ আর মশারি রাখা বিছানাতে। পাশে একটা টুলের ওপর জলের কুঁজো রাখা। কুঁজোর মুখে একটা স্টিলের গ্লাস উপুড় করা। বিনু পোঁটলা থেকে নিজের গামছাটা বের করে। কাশির সিরাপের পুরনো শিশি করে আনা নারকেল তেল এক খাবলা নিয়ে মাথায় ডলতে ডলতে কলঘরের দিকে চলেই যাচ্ছিল। মাখনের কথা মনে পড়তেই ফিরে এসে তালা দেয় ঘরে। পোঁটলায় দুটো পুরনো জামাপ্যান্ট আর চানুপিসির দেওয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছাড়া কিছুই নেই তার কাছে। কী আর চুরি যাবে তার! তবু বড়লোকের বাড়ির নিয়ম অগ্রাহ্য করতে সাহস হয় না বিনুর। তালা দিয়ে ছোট চাবিটা হাতে করে কলঘরের দিকে চলে যায়। জীবনে এই প্রথমবার কল ঘুরিয়ে পাইপ লাইনের জলে চান করে সে। চান সেরে একা একা ওই বাড়িতে যেতে কেমন যেন ভয় ভয় করছিল বিনুর। অচেনা কারও মুখোমুখি হলে কী পরিচয় দেবে! গিন্নিমা না থাকলে কার কাছেই বা খাবার চাইবে! এত বড় হল এখনও কোনদিনও কারও কাছে খাবার চেয়ে খেতে শেখেনি বিনু। এখানে তো সবাই তার অচেনা। ভাবতে ভাবতে উঠোনে এসে পৌঁছাতেই গিন্নিমার গলা,

-আমার কী আর কাজ নেই বাছা, সেই কোন কাল থেকে তোমার খাবার আগলে বসে আছি। নাও চটপট এসে খেয়ে নাও দেখি। 

চাওড়া বারান্দায় শালপাতায় খান দশেক লুচি, ডাল আর খানিকটা বোঁদে। ভীষণ খিদে পেয়ে গিয়েছিল বিনুর। আর তাছাড়া লুচি সে বড্ড ভালোবাসে। বিলম্ব না করে প্রায় গোগ্রাসে খেতে শুরু করে বিনু। ওর খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখেই বোধহয় গিন্নিমা হাঁক দেন,

-আর কটা লুচি দিয়ে যা তো টেঁপি।

একটা মেয়ে এসে আরও পাঁচ'ছখানা লুচি দিয়ে যায় বিনুর পাতে। কিছুটা খাওয়া হলে গিন্নিমা শুধান,

-বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

একটা লুচি মুখে ভরে ঘাড় নাড়ে বিনু।

গিন্নিমা অবাক গলায় বলেন,

-বাপ মা?

মাটির ভাঁড়ের সব জলটুকু একঢোকে খেয়ে নিয়ে বিনু বলে,

-কেউ নেই। মাকে কোনদিন চোখেও দেখিনি। বাপ কখনও মায়ের কথা বলেনি।  গাঁয়ের লোকে অবশ্যি অন্য কথা বলে, শহর থেকে বাপ নাকি আমাকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে চানুপিসির কোলে দিয়েছিল। চানুপিসিই আমাকে বড় করেছে।

-তোমার বাপের নাম কী?

হঠাৎ যেন গম্ভীর শোনায় গিন্নিমার গলাটা।

বিনু গলা নামিয়ে জবাব দেয়,

-জগন্নাথ বায়েন।

চমকে ওঠেন গিন্নিমা। কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই মাখন ছুটে এসে বলে,

-বড়দিমণি কী করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন জানি না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে চলে এসেছেন।

গোটা বাড়ি হুলুস্থূল, সবাই আতঙ্কিত। আলুথালু বেশে এক মহিলা প্রায় ছুটে দোতলা থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে সোজা গাড়ি বারান্দার দিকে চলে যায়।

-বাড়িতে এত লোক আর আমার খোকার শুধু জায়গা নেই! জগুঢাকি সেই যে ছেলেটাকে নিয়ে গেল....

শেষ কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পায় না বিনু। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দার এক কোণে। গিন্নিমা অনেক বুঝিয়ে মেয়েকে নিয়ে ওপরতলায় উঠে যান। সেবার পুজোয় মিত্তির বাড়িতে বিনু ঢাক বাজিয়েছিল বটে, কিন্তু গিন্নিমা আর কোনদিন কথা বলেননি বিনুর সঙ্গে....

.......................................