সাফল্যের পিছনে
শুভময় মণ্ডল
অপারেশন
থিয়েটার থেকে বেরিয়ে নিজের ক্যুপে এসেও যেন ঘোর কাটছিল না আমার। এত কঠিন
অবস্থার রুগ্ন শরীরে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করেও সফলভাবে রোগীকে সুস্থ করতে
পারাটা সব সময়ই চ্যালেঞ্জ, তবু আজকেরটা যেন মিরাকেল হয়ে গেল।
দু'জন
সিনিয়র চিকিৎসক সরাসরি না করে দেবার পর, মরিয়া হয়ে রোগিনীর ছেলে আমার
কাছে আসে। নিজের ক্ষমতার গর্ব তার ততক্ষণে ধূলিসাৎ হয়েছে। প্রাথমিক
পরীক্ষার পরেই আমি তাকে জানিয়েছিলাম যে মহিলার শারীরিক অবস্থার দ্রুত
অবনতি হতে শুরু হবে খুব শীঘ্রই, তাড়াতাড়ি ওনার অস্ত্রোপচার করানো ভীষণ
প্রয়োজন।
তখন আমার কথার
গুরুত্ব না দিয়ে, সে তার মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল 'আরও বড় ডাক্তার'-এর
কাছে, সঠিক চিকিৎসার জন্য। যথারীতি ততক্ষণে রোগিনীর মধ্যে তীব্র অসুস্থতার
লক্ষণ প্রকট হতে শুরু করেছে। সেই সিনিয়র ডাক্তারদেরও আর বিশেষ কিছু করার
ছিল না তখন। হয়তো আমি নিজেও ঐ অবস্থায় তাঁকে প্রথমবার চিকিৎসার জন্য পেলে
কখনোই এই রিস্ক নিতে পারতাম না।
যাই
হোক তাঁর ছেলে এসে তো প্রায় আমার পায়ে পড়ার জোগাড়। বলল - আপনার
সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায়, আমি আপনার পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছিলাম। সে
আমার ভুল, কিন্তু তার জন্য দয়া করে আপনি আমার মাকে শাস্তি দেবেন না। আমি
জানতে পেরেছি যে একমাত্র আপনিই চাইলে এখনও আমার মাকে বাঁচাতে পারেন। আমি
নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি, বা আপনি তার জন্য যা করতে বলবেন তাই শাস্তি
হিসেবে আমি মাথা পেতে নেব - শুধু আমার মাকে বাঁচিয়ে দিন।
নিজে
শৈশবে মাকে হারিয়েছি তাই, তার মায়ের জন্য এই আকুতি মিনতিকে কিছুতেই
অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। প্রায় অসম্ভব জেনেও ওই মহিলাকে অপারেশন
থিয়েটারে নিয়ে যাবার রিস্কটা তাই নিয়েই ফেললাম আমি। আজ পর্যন্ত একশ'
সাতাত্তরটা অপারেশন করেছি আমি। কোনো ব্যর্থতার ইতিহাস নেই, সাফল্যের হার
একশ' শতাংশ, আজ পর্যন্ত একজন রোগীরও শারীরিক অবস্থার বিন্দুমাত্র অবনতি
হয়নি আমার অস্ত্রোপচারের পর। এই খবরটা বোধ করি কারোর থেকে পেয়েছিল ওই
ভদ্রমহিলার ছেলে। তাই নিরুপায় হয়েই শেষমেশ মা'কে বাঁচাতে আমারই শরণাপন্ন
হয়েছিল সে।
সে'সব আমি বেশ
বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু ঐ রোগিনীর প্রকৃত শারীরিক অবস্থা ও আশংকার কথা
আমার থেকে ভালোও কেউ জানতো না তখন। তাই মনে মনে সবথেকে বেশি উদ্বেগটা ছিল
আমারই। কেসটা হাতে নেওয়ার পর, আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে যখন আমার
গুরুদেব তথা মেন্টর, শল্য চিকিৎসা-বিশারদ আমার স্বর্গীয় পিতামহের ছবিতে
প্রণাম করছি, তখনও যেন বুক ধুকপুক করছিলো আমার।
অপারেশন
থিয়েটারে ভদ্রমহিলার বাইল ডাক্টের বাইপাস টিউব সেট করার সময়ই ভয়ে আমার
গা শিউরে উঠেছিল - তাঁর লিভার জুড়ে টিউমারের জন্য। ওখানে একটি ভুল করা
মানেই সব শেষ! ওগুলোর ম্যালিগন্যান্সি তখনও কনফার্ম টেস্টেড না হলেও, তার
সম্ভাবনা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেবার নয় বরং সেই সম্ভাবনাই বেশি। যাইহোক,
সেটা ফাইনালি সাকশেসফুল হওয়ার অর্থ হলো - আপাতত তাঁর যকৃত কাজ করতে পারবে,
তবে টিউমারের জন্য চিকিৎসা চালিয়েই যেতে হবে।
অপারেশন
তো সাকশেসফুল হলো কিন্তু আমার ঘোর কাটছিল না এই কারণে যে, নিঁখুতভাবে ঐ
বাইপাসটা আমি সেট করলাম কি করে? এ যে কোটিতে একটা করাও সম্ভব নয় - লিভার
জুড়ে অত টিউমারের জন্য, আগেই বলেছি। আমি তো নিজের এই সাফল্যকে নিজেই
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! আমার ঠাকুরদার ছবিটা হাতে নিয়ে আপন মনেই সে'কথা
ভাবছি, এমন সময় কাঁধে যেন একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে সজাগ হয়ে
বসলাম।
ঠাকুরদার স্বরে কে
যেন নিচুস্বরে কানে কানে এসে বললো - দাদুভাই এ যে আমারও স্বপ্ন ছিল, বড়
ডাক্তার হবো, আমার কাছে চিকিৎসা করতে আসা প্রতিটি রোগীকে আমি সুস্থ করেই
বাড়িতে ফেরত পাঠাবো। অর্থাভাবে আরও উচ্চশিক্ষা লাভ করে উঠতে আমি তো
পারিনি, তাই তোমার শিক্ষার কোনও ত্রুটি রাখিনি। তুমি তো ডাক্তার হওয়ার কথা
চিন্তাই করতে না হয়তো কখনও। সে ইচ্ছে আমিই তোমার মনে সেই শৈশবাবস্থাতেই
সৃজন করেছিলাম।
আমার
চিকিৎসার ক্ষমতা নিয়ে আজও লোকে কত প্রশংসা করে, আমি তাদের চিকিৎসা করে
সুস্থ করেছিলাম বলে গর্ব করে। অকালে মর্ত্যধাম ছেড়ে চলে যেতে না হলে,
ইচ্ছে ছিল শিক্ষা দিয়ে আমিই নিজের হাতে মস্ত বড় চিকিৎসক বানাবো তোমাকেও।
সে তো আর হলো না, তাই এই সূক্ষ্ম শরীরে সর্বদা আমি তোমার সাথে থাকি। তুমিও
মনে রেখো - আমারই রক্ত বইছে তোমার শরীরে, আর তার সঙ্গে আমিও সর্বদা থাকি
তোমার সাথে। ভুল চিকিৎসা তুমি ভুলেও করতে পারবে না। আমি থাকতে তোমার
অস্ত্রোপচারে কোনো রোগীই প্রাণ হারাবে না।
তবে
এমনও নয় যে আমিই তোমার হয়ে চিকিৎসা করি বা অপারেশনগুলো করি। ওসব তুমিই
করো, শত হোক আমার নাতি তো বটে, চিকিৎসাবিদ্যা তোমার রক্তে। তুমি তো নিজের
গুণেই রোগীদের সুস্থ করো, আমি শুধু আজকের ওই রোগীর মত ক্রিটিকাল কোন
অপারেশনের কেস হলে, তোমার সঙ্গে যাই। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে, নিছক শিক্ষা,
অভিজ্ঞতা ও ধারণা অনুসারে বাধ্য হয়ে যে কাজগুলো একজন চিকিৎসককে করতে হয়
অপারেশন থিয়েটারে, সেগুলোকেই সার্থক করে তুলি আমি।
না
হলে আজকের এই রোগীকে তুমি বাঁচাতেই পারতে না কিছুতেই। আমি সর্বদা এটাই চাই
যে তোমার চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই বাড়ি ফিরে যাক সব রোগী। তোমার
সাফল্যেই যে আমি আমার নিজের সাফল্য দেখতে পাই। লোকে তো গর্ব করে বলবে যে,
আমার নাতি কত বড় ডাক্তার হয়ে উঠেছে, আমার থেকেও বড়!
..................................