মায়াটান
বাপ্পাদিত্য দাস
নিঃসঙ্গতার
দোসর যখন নির্জনতা, অবসাদ তখন দখল নেয় পরিসরের, খিদে উবে যায়.. ঘুম পায়..
মনে উঁকি দেয় অমোঘ জিজ্ঞাসা.. বেঁচে থেকে কি হবে ?
এখানে এসে থেকে এরকমটা হচ্ছে |
তবে
এখানে আমার কিছু বন্ধুও হয়েছে.. আকাশ, গাছ, পাখী, কাঠবিড়ালী, প্রজাপতি,
গুবরে পোকা .. আমার শহরে শুধু ইট কাঠ কংক্রিট আর দৌড়ে বেড়ানো মানুষের
ভীড় ছিল.. বন্ধু ছিলনা |
আমি
সাধারণ, মধ্যমেধার মানুষ | ছাপ ফেলার মত কিছু করতে পারিনি জীবনে | আমি
ভিড়ে মিশে থাকা সেই লাখো মনিষ্যি দের একজন,যাদের একটা নামই আছে শুধু |
চারপাশে সবাই কমবেশী ব্যাস্ত, শুধু আমার অখন্ড অবসর | পৈত্রিক বাড়ীর ভাড়া
আর বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা, আমার চলে যেত | কোন কাজ খুব বেশীদিন ভালো
লাগতো না, তাই কখনো কাজ আমায় ছাড়ত কখনো আমি কাজকে |
বন্ধুবান্ধব
সবাই নিজের নিজের জীবনে শিকড় গেড়ে বসেছে | কত ব্যাস্ততা তাদের.. কত
গল্প.. বউয়ের টকঝাল খুনসুটি, সন্তানের স্কুল, পরীক্ষা, ভবিষ্যত | পরকীয়া,
অবদমিত যৌনেচ্ছা.. সুগার, প্রেসার, আমাশা..ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ীর মাইলেজ
.. বসের শয়তানি, বকেয়া ডিএ .. কত্ত বিষয়, যা আমার নেই | তাই একসময় আরও
একা হয়ে পড়লাম |
একা
থাকতে মাঝেমাঝে ক্লান্ত লাগত | মনে হত, যদি একটা সংসার থাকত.. একটা মিষ্টি
মত বৌ, 'পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর', ছেলেপিলে, দায়িত্ত্ব,
ঝগড়াঝাটি, অভিমান .. ভালবাসা আর কিছু ভীতু স্বপ্ন ! পরক্ষণে হাসি পেত |
আমার মত লোকের আবার স্বপ্ন !
হঠাৎই এই চাকরীর সুযোগটা এসেছিল |
আমার ভাড়াটে ছেলেটি একদিন বললো ..
- দাদা আজকাল কি করছেন ?
কঠিন
প্রশ্ন | যদি বলি কাজ করছি, তো কি কাজ ? কোথায় অফিস ? কত দেয় ? যদি বলি
কিছু করছিনা, তবে কেন করছেন না ? না করলে চলছে কি করে ? একঝুড়ি কথা ..
আমার বেশী কথা বলতে ভালো লাগেনা .. তাই হুঁ হা করে এড়িয়ে যাব ভেবেছিলাম,
কিন্তু সে ছেলে ছাড়লে তো ?
- একটা কাজ আছে , করবেন ?
এইরে ..আমার মত লোকের জন্যও কাজ ?
- আমাকেই বলছ কেন ? কাজের লোকের তো অভাব নেই ..
- না মানে .. ওরা একজন পিছুটান হীন লোক চাইছেন ..
ঠিক
| আমার জীবনটা নিয়ে আমি যা খুশী করতে পারি, আমার কারো প্রতি কোনো দায়
দায়িত্ব নেই.. কেউ বসে থাকেনা পথ চেয়ে | আমার না আছে শিকড়, আমার শুধু
বন্ধ্যা পরিসর |
আমি পিছুটান হীন |
আত্মোপলব্ধি.. একটা চিনচিনে ব্যাথা মেশানো মজা পেলাম |
এখন
আমি শহর থেকে দূরে, শাল মহুলের জঙ্গলে ঘেরা জনপদে একটা আবাসিক স্কুলের
কেরানী | ছাত্ররা বেশির ভাগই ছাত্রাবাসে থাকে | হিসেবনিকেশ দেখা, খাতাপত্র
লেখা, ছেলেপুলে গুলোর ওপর নজর রাখা, এইসব আমার কাজ | থাকা খাওয়ার
ব্যবস্থা ছাত্রাবাসেই | আমার জন্য বরাদ্দ ঘরটি চমৎকার | জানলা খুললেই
অনেকটা সবুজ জমি, ঢালু হয়ে মিশেছে গভীর জঙ্গলে যেখানে একটা বিশাল জলা আছে
শুনেছি | রাতে ছাত্ররা খেয়ে শুয়ে পড়লে আমি ছাদে গিয়ে বসি | জঙ্গলের শব্দ
শুনি.. গাছেদের ফিসফিসানি, রাতচরা পাখী আর অচেনা জন্তু জানোয়ারের ডাক, আর
সব ছাপিয়ে কানে আসে জলের আওয়াজ, ছলাৎ ছলাৎ করে পাড়ে আছড়ে পড়া ছোট ছোট
ক্ষণভঙ্গুর ঢেউয়ের ডাক | রাত যত গভীর হয়, তত ওখানে জেগে ওঠে অলৌকিক
শব্দেরা.. ডাকে..
আমি একদিন যাব.. যেতেই হবে.. ওইখানে |
আজ
ঢালু জমিটায় শেষপ্রান্তে এসে বসেছি | এখান থেকে বড় গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে
আবছা দেখা যায় জলাটা | আমার ভিতর এখন সেই ইচ্ছেটা পাক খাচ্ছে .. চলে যাই
এসব ছেড়েছুড়ে জঙ্গলের গহীনে ওই জলাশয়ের কাছে | স্কুলের মাষ্টাররা বারণ
করেছেন যেতে .. সাপ খোপ, বুনো জন্তু সব আছে ওদিকে.. আরও কিছু আছে ও জলায়..
ভয়ানক.. যারা আগে সাহস করে গেছে, কেউ কেউ ফেরেনি.. রান্নার মাসী বলে জলাটা
ভূতুড়ে.. মায়াটান আছে .. নিশির ডাকের মত মানুষকে ভুলিয়ে টেনে নিয়ে যায় |
এখন
শেষ বিকেল .. লোকজন গরু ছাগলের খুঁট ধরে বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে .. মাথায়
ঝরা শালপাতার বোঝা, অন্য হাতে কাঠকুটো .. কলকল করতে করতে ঘরে ফিরছে..
টুকরো কথা, হাসি, ছাগল গুলোর গলায় বাঁধা ঘন্টার টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে |
ওদের পায়ে পায়ে মেঠো পথে ধুলো উড়ছে .. প্রাচীন গাছগুলোর মাথায় আগুনরাঙা
সূর্য ধীরে নেমে আসছে .. আমার বিবশ মনে আছড়ে পড়ছে পাড়ে ধাক্কা খাওয়া
জলের শব্দ .. ছলাৎ .. ছলাৎ ..
ঘোর
ভেঙে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে .. বছর দশেক বয়েস.. আদুল গা, একহাতে ঢলঢলে
হাফপ্যান্টটা ধরা, অন্য হাতে একটা মাছ ধরার ছিপ, হনহন করে জঙ্গলের দিকে
যাচ্ছে একা | এই শেষ বিকেলে একা একটা বাচ্চা ছেলে ওদিকে..
- এই ছেলে .. কোথায় যাচ্ছিস?
চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা, আমাকে দেখছে ..
একমাথা রুখুশুখু চুল, শ্যামলা মুখটায় টানা দুটো চোখ .. কি ভীষন মায়া তাতে ..
- তুমি কে ?
- আমি ওই স্কুলে থাকি |
- ও .. তুমি জলা দেখতে যাবে ?
আমি অবাক .. আমার জলা দেখার ইচ্ছের কথা ও জানল কি করে ?
- তোর নাম কি ?
- ছোটু..
- বেশ.. তা তোর প্যান্টুটা কি ঢলঢল করছে ? হাত দিয়ে ধরে আছিস যে ?
- হুঁ ..
- দাঁড়া ..
হাঁটু
মুড়ে বসলাম, প্যান্টুটা ধরে ওর কোমরের ঘুনশীর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে ওপর দিকে
তুলে দিলাম.. এবার টাইট হয়ে আটকে রইল কোমরে .. একগাল হাসি দিল ছোটু ..
- চলো তোমায় জলা দেখিয়ে নিয়ে আসি .. আমি মাছ ধরব ওখানে .. মা আর আমি খাব ..
- তা বেশ .. চল ..
ছেলেটা সরল আর মিশুকে..
- ঘরে তোরা কে কে থাকিস রে ?
- আমি আর মা ..
- বাবা ?
- নেই .. চলে গেছে .. আর আসে না ..
বুকটা হু হু করে উঠলো .. এতটুকু ছেলে .. বাবা নেই ..
ছোটু মহা উৎসাহে আপনমনে হাত পা নেড়ে বকবকম করতে করতে হাঁটছে .. তাল রাখতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছি ..
- তা মাছ ধরবি যে, চার কোথায় ?
- এইতো ..
পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজে মোড়া একদলা মোটা লালচে ভাত বার করে দেখাল |
- আচ্ছা ..
আমরা
জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি .. খুব চুপচাপ চারদিক | পাখীর ডাক আর বড় গাছগুলোর
নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে আমাদের চলার শব্দ, আর কোনও আওয়াজ নেই
..
শুধু একটা গন্ধ..
ভেজা, গহন, গভীর প্রাচীন গন্ধটা ধীরে আমার ইন্দ্রিয়কে বশ করে আনছে .. কি
মাদকতা এই গন্ধে .. আমি অস্থির হয়ে উঠছি.. যেতে হবে.. আরও কাছে যেতে হবে..
- উই দেখো জলা .. আমরা এসে গেছি গো ..
হঠাৎ
যেন উঁচু গাছ গুলোর মাথা থেকে ঝুপ করে দলাদলা নরম অন্ধকার নেমে এলো নীচে
.. সেগুলো কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের ঘিরে .. আমরা এখন জলের একদম
কাছে এসে দাঁড়িয়েছি ..
ছোটু পাড়ের কাদা মাড়িয়ে জলে নেমে ভাত বেঁধানো বড়শীটা ছুড়ে দিল.. পাশে আমি.. ওর সাথেই নেমেছি..
জলে
একটা আলোড়ন উঠলো .. দেখলাম তোলপাড় হচ্ছে জল .. ছোটুর ছিপে টান পড়েছে ..
ও ছিপটা টেনে পাড়ের দিকে আনতে চাইছে, পারছেনা.. উলটে গভীরে নেমে
যাচ্ছে..
আমি উৎসাহ পেয়ে গেলাম .. কোন রাঘব বোয়াল গেঁথেছে নির্ঘাত .. ওর হাতের পাশ দিয়ে চেপে ধরলাম ছিপটা .. টানতে লাগলাম পাড়ের দিকে ..
পারছি
না .. পারছি না দুজনে .. উল্টে নেমে যাচ্ছি গভীরে .. ভিতর পানে .. থকথকে
কাদায় গেঁথে যাচ্ছে পা.. আঁধার গভীর হচ্ছে চারপাশে .. পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে
জলজ গাছ, শ্যাওলা .. ছোটুর হাতটা ছেড়ে গেল বোধহয় .. শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে
ছিপটায় টান দিলাম আর তখুনি..
আমার চারপাশে এক অপার্থিব দৃশ্যের জন্ম হল..
চরাচর
জোড়া মিশকালো আকাশ.. মাথার ওপরে, সামনে, চারপাশে.. সলমা জরির ফুলকারি
কাজের মত ঝিকিমিকি তারা .. আমার কোমর অবদি ডুবে আছে সেই তরল কালো আকাশে ..
চারপাশে একটা স্রোতের টান.. অনেকটা দুরে জলের মধ্যে বিশাল এক ঘুর্ণী..
দুরন্ত টানে টেনে নেবে সব.. আমি বুঝতে পারছি কিন্তু এই আকাশ জল জঙ্গল
ঘুর্ণী সবটা জুড়ে কি এক অমোঘ মায়া আমায় ডাকছে .. হাতছানি দিচ্ছে.. ফিশফিশ
করে বলছে .. আয়.. গভীরে আয় .. পাড়ে কেউ নেই তোর জন্য অপেক্ষায়.. শুধু
শুকনো তেষ্টা আর নিস্করুণ শূন্যতা.. এখানে আয় ..গভীর শীতলতা আর নির্জন
নির্বান.. তোর জন্য |
আমি বুঝলাম, এই অমোঘ ডাক, এই
টান, অস্বীকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি, .. বিবশ হয়ে পড়ছি.. সেই গন্ধটায় চারপাশে ম ম করছে .. আমি ডুবে যাচ্ছি সেই আদিম গন্ধে |
- মাছ পেয়েছি গো.. কই গেলে..
- ছোটু .. কোথায় তুই ?
- এইতো আমি,
অনেক
কষ্টে পিছু ফিরলাম, ছোটু পাড়ে দাড়িয়ে, ওর হাতে ধরা একটা ছটফটে রূপোলি
মাছ | ওর মুখে হাসি, ও ডাকছে আমায়.. আমার বুকটা হু হু করে উঠল.. আমি যেন
দেখতে পেলাম তকতকে নিকানো মাটির উনুনে, কাঠকুটরো আর শুকনো ডালপালার আগুনে
লোহার কড়াইয়ে মাছ ভাজা হচ্ছে, সেই গন্ধে ম ম করছে চারপাশ..
ছোটু বসে আছে ভাতের থালার সামনে..
ঘোমটা পরে কেউ খাইয়ে দিচ্ছে ওকে আদর করে |
তারপর সে আমার দিকে ফিরল ..
- আসুন, এবার আপনিও বসুন..
মুখে
সলজ্জ হাসি, কপালে সিঁদুর, সিঁদুরের গুঁড়ো তার নাকের ওপর পড়েছে, ঘামে
ভেজা মুখ, ফুলছাপ ব্লাউজের নীচে একজোড়া ভরন্ত বুক.. নিরাভরন হাতে ধরা
গরম ধোঁয়া ওঠা একথালা ভাত..
আমার জন্য |
আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, গলার কাছে দলা পাকানো কি একটা ঠেকছে ..
শরীরের সব শক্তি দিয়ে পাড়ের দিকে এগোলাম |
এখন আমার হাতে ধরা ছোটুর হাত .. ওর গা মুছিয়ে দিয়েছি আমার জামা দিয়ে ..
ছোটু বকবক করছে, ওর গাঁয়ের কথা, বন্ধুদের কথা, মায়ের কথা..
এখন
আমার শান্ত মনে শুকনো ডাঙার নিশ্চিন্তি .. ছোটুর হাতের উত্তাপ আমার গা
শুকিয়ে যাচ্ছে.. আমি যেন দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন অপেক্ষা করছে ধোঁয়া ওঠা গরম
ভাতের থালা নিয়ে.. আমার জন্য | তাঁর 'পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর'..
নিকষ কালো অন্ধকার কেটে যাচ্ছে.. ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ফুটফুটে একফালি চাঁদ |
আমার শরীর মন জুড়ে এখন শুধু এক অচেনা খিদে |
..........................................................
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি