আট নম্বর রুম - অর্পিতা সরকার

 



আট নম্বর রুম
অর্পিতা সরকার
 


রুমেলার সব ভালো লাগে নীলিমার শুধু ওই লুকোচাপা স্বভাবটা ছাড়া। নীলিমা তো টিপিক্যাল দজ্জাল শাশুড়ি নয় যে ছেলে-বৌমার প্রেমের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াবে! তাছাড়া অ্যারেঞ্জড ম্যারেজও নয় ওদের। রীতিমত বছর পাঁচেক প্রেমের পরে বিয়ে। বিয়েও তো হয়ে গেলো প্রায় বছর চারেক। এখনও রুমেলা আর অনির্বাণ কেন যে ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায় কিছু সেটা ও বোঝে না। 
দুজনেই একই অফিসে চাকরি করে। এক সঙ্গেই বেরোয় অফিস। তখনও তো নীলিমা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দুজনকে জোর করে খাইয়ে পাঠায়। রুমেলা কোনোদিন মুখ ফুটে নিন্দে করতে পারবে না যে নীলিমা ছেলেকে বড় মাছের পিস দিয়ে বৌমার পাতে ছোট দিয়েছে। অবশ্য রুমেলা সর্বদা নীলিমার প্রশংসাই করে। ওদের সম্পর্কটা শাশুড়ি বউয়ের মত নয়। বরং অসমবয়েসী বন্ধুর মতো। তারপরেও ওদের এই শনিবার সন্ধে হলেই অফিস থেকে ফিরে কেন যে সেজেগুজে বেরোতে হয় জানে না নীলিমা। 
ইদানিং রুমেলার এই লুকিয়ে রাখার স্বভাবটা বড্ড কষ্ট দিচ্ছে নীলিমাদেবীকে। 
কিন্তু এখন আবার এক নতুন কথার আমদানি হয়েছে সংসারে 'প্রাইভেসি'। তাই আগ বাড়িয়ে ছেলে বা বৌমাকে জিজ্ঞেসও করা যায় না, যে তোমরা গত এক বছর ধরে নিয়ম করে শনিবার সন্ধেতে কোথায় যাও? 
তবুও জানার চেষ্টা করেছে নীলিমা। ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ছেলে হাসির ছলে বলেছিল নিজেদেরও তো কিছু ব্যক্তিগত বিষয় থাকে মা। সবকিছু জিজ্ঞেস করো না। থমকে গিয়েছিল, নিজের সন্তানের ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে যে তার ঢোকা নিষেধ এটা জানা ছিলো না। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছে নীলিমা, শনিবার বেরোনোর সময় রুমেলা ওকে প্রণাম করে বলে, আসছি মা। অন্য দিন অফিস বেরোনোর সময় এমনিই আসছি বলে বেরিয়ে যায়। একমাত্র শনিবার সন্ধেতে প্রণাম করে বেরোয়। দিনদিন কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে নীলিমার। নিজের বাতের ব্যথার সঙ্গে এটাও একটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী লুকিয়ে রেখেছে তার ছেলে আর ছেলের বউ তার কাছ থেকে! 
শনিবার সন্ধেতে নীলিমা আঁচ করছিলো ওরা অফিস থেকে ফিরেই চা খেয়ে ফ্রেস হতে শুরু করলো। নীলিমা একবার উঁকি দিয়ে দেখেছে। রুমেলার পরনে জিন্স আর টি শার্ট। অফিসে চুড়িদার বা কুর্তি পরে রুমি। একমাত্র শনিবারে বেরোনোর সময়েই একটু বেশি কমবয়সীদের মত সাজে। অদ্ভুত লাগে নীলিমার। অনির্বাণও কমবয়সীদের মত ডিপ কালারের টিশার্ট পরে রেডি। 
আরেকটা জিনিস খেয়াল করলো নীলিমা, অন্যদিন রুমেলার সিঁথিতে হালকা সিঁদুরের রেখা থাকলেও আজ চুল দিয়ে ঢাকা সিঁথির বিশেষ অংশটা। মোট মিলিয়ে ঠিক যেন অবিবাহিত কাপল। 
নীলিমাও কাপড় পরছে দেখে রুমেলা একটু চমকে উঠেই বললো, তুমি কোথাও যাবে নাকি মা? আমরা তো বেরোচ্ছি। তাহলে কি চাবিটা নিয়ে যাবো?
নীলিমাদেবী স্বাভাবিক গলায় বললেন, ওই সবিতাদের গীতা পাঠের আসরে যেতে বলেছিলো তাই ভাবলাম একবার ঘুরে আসি। 
রুমেলা প্রণাম করতে করতেই বললো, হ্যাঁ যাও না ঘুরে এসো। সবিতা আন্টির বাড়ি তুমি অনেকদিন যাওনি তো। একটা ট্যাক্সি ডেকে নিও। 
রুমেলারা আজকে গাড়ি নিলো না। অনির্বাণ বাইক স্টার্ট করলো। 
ওরা বেরোতেই একমুহূর্ত দেরি না করে নীলিমা বেরিয়ে এলো। ট্যাক্সিতে চেপে প্রথমে ওদের দেখতে পেলো না। একটু গিয়ে ফার্স্ট সিগন্যালে দেখলো অনির বাইক দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীলিমাদেবী সাবধানে বললেন, ওই বাইকটাকে ফলো করুন তো। চ্যাংড়া ড্রাইভার বললো, কোনো লাফরা কেস নেই তো?
নীলিমা সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন, আরে ওরা আমার ছেলে আর ছেলের বৌমা। 
বাপের বাড়ি যাবার নাম করে সিনেমা যাচ্ছে কিনা সেটাই দেখবো। 
ছেলেটা ফ্যাক করে হেসে বললো, জেঠিমার কি গোয়েন্দা গিন্নি বেশি দেখা হয়! এসব হচ্ছে ঘর ঘর কি কাহানি। আমার বৌকেও আমার মা দু চোখে দেখতে পারে না। 
নীলিমার মনে হচ্ছিলো ফিরে যেতে। ড্রাইভারের ভাষায় ও সেই টিপিক্যাল শাশুড়ি হয়ে গেলো যে কিনা ছেলে-বৌয়ের ভালো সম্পর্ক সহ্য করতে পারে না। কেমন যেন লজ্জা করে উঠলো ওর। ইস একটা অপরিচিত ছেলে কী ভাবলো ওর সম্পর্কে! 
সিগন্যাল গ্রিন হতেই অনির বাইক ফলো করতে শুরু করলো নীলিমার ট্যাক্সি। নীলিমা ঘামছে। বিজবিজে অস্বস্তিই ঘামের জন্ম দিচ্ছে। ওদের গোপন বিষয়টা জানতে আসা উচিত হয়নি ওর। কেন যে এমন ভীমরতি ধরলো কে জানে! যদি রুমেলা বা অনি দেখে ফেলে তাহলে আর কোনোদিন ওকে সম্মান করতে পারবে ওরা! ছি ছি একি ভুল করলো নীলিমা!
ড্রাইভার ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে বললো, আরে জেঠিমা আপনার ছেলে আর ছেলের বউ তো হোটেলে ঢুকছে। বিশ্রীভাবে হেসে ছোকরা বললো, জেঠিমা কি এক ঘরে ছেলে-বউকে শুতে অবধি দেন না নাকি? বেচারারা পালিয়ে ভিকট্রি হোটেলে আসছে। 
নীলিমা একটু অবাক হয়েই বললেন, সে ওরা প্রায়ই হোটেলে খেতে আসে। আমার জন্য ভেজ খাবার প্যাক করেও নিয়ে যায়। 
ড্রাইভার খ্যাকখ্যাক করে হেসে বললো, এ হোটেল খাবার জন্য বিখ্যাত নয় জেঠিমা। এ হলো সস্তায় পুষ্টিকর হোটেল। পার ঘন্টা পাঁচশো টাকার হোটেল। সব প্রেমিক-প্রেমিকারা আসে। দুঘন্টা জাপটাজাপটি করে বাড়ি পালায়। বিবাহিতরা কেউই আসে না এখানে। 
মাঝে মাঝেই পুলিশ রেড অবধি করে। 
নীলিমাদেবীর কান লাল হয়ে গেলো। শেষপর্যন্ত অনি আর রুমি এভাবে মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে এমন একটা জায়গায় আসে! এ যে ভাবনার অতীত ছিল। 
ড্রাইভার আরও কিসব বলতে শুরু করেছিল...আসলে পার্কে তো আর সব হয় না। 
নীলিমা কোনো মতে টাকা মিটিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলো। 

প্রতিবার নিজের হাতে রুমির জন্মদিনে পায়েস রান্না করে নীলিমা, কেক বানায়। কোনোদিন ওকে বৌমা ভাবেনি। এমনকি অনিকেও বলে, রুমিকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসবি। রাতে অতক্ষণ সময় ল্যাপটপে কাটাবি না। দুজনে গল্প করবি। তারপরে এই দিন দেখতে হলো ওকে! অসার শরীর আর ক্লান্ত মন নিয়ে হোটেলের রিসেপশনে পা দিলেন নীলিমাদেবী। এখনও ড্রাইভারের বলা ব্যঙ্গাত্মক কথাগুলোর অনুরণন চলছে কানের মধ্যে। 
ও এত খারাপ মা, যে রুমি আর অনিকে এইসব সস্তার হোটেলে এসে ঘর ভাড়া করতে হচ্ছে!
রিসেপশনের মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বললো, আন্টি এটা শুধু কাপেল হোটেল। কাউকে খুঁজছেন? কিছু বলবেন? নীলিমা এদিক ওদিক তাকিয়ে রুমেলা বা অনির্বাণকে দেখতে পেলো না। 
নীলিমার কথা শেষ হবার আগেই একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে বললো, ম্যাডাম পুলিশ ভ্যান এসেছে। রেড করবে নাকি?
নীলিমা দেখলো, একটা অদ্ভুত চঞ্চলতা সকলের মধ্যে। দুজন ছেলে দুরদুর করে উঠে গেলো দোতলায়। 
বেশ কিছু ছেলেমেয়ে অবিন্যস্ত ভাবেই নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে। পিছনের দরজাটা খোলা... ওদিকেই যেতে ইঙ্গিত দেখাচ্ছে হোটেলের স্টাফরা। ছেলেমেয়েগুলো সেদিকেই ছুটছে। নীলিমাদেবী এমন পরিবেশে এর আগে কখনও আসেননি। কেমন একটা ভয় ভয় করছে। প্রায় গোটা পাঁচেক পুলিশ ঢুকলো হোটেলের রিসেপশনে। 
নীলিমার চোখ পড়ল সিঁড়িতে। রুমেলা আর অনি উদ্ভ্রান্তের মত নামছে। সামনে পুলিশ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। একজন পুলিশ রিসেপশনের মেয়েটিকে বললো, তোরা যে বলেছিলি ধান্দা তুলে দিয়েছিস, তাহলে এরা কারা?
কেউ কিছু বলার আগেই নীলিমাদেবী বললেন, ওরা আমার ছেলে-ছেলের বউ। আমরা গ্রাম থেকে এসেছি। আমার চিকিৎসার জন্য এখানেই উঠেছি। 
নীলিমাদেবীর দিকে তাকিয়ে একজন পুলিশ বললো, আর জায়গা পেলেন না মাসিমা। আসলে আপনারা গ্রামের লোক বলেই হয়তো জানেন না, এই হোটেলটি ফ্যামিলি নিয়ে থাকার ভদ্র হোটেল নয়। 
হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অনিকে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন নীলিমাদেবী। বেশ জোরে বললেন, ছি এই তোদের রুচি?
রুমেলা অঝোরে কেঁদে বললো, কিন্তু মা ও যে আর আসতে চাইছে না আমাদের কাছে। এই হোটেলেই ও এসেছিল। আমরা ওকে নষ্ট করে দিয়েছি বললেই ও অভিমান করে আর আসতে চাইছে না আমাদের কাছে।  
 নীলিমাদেবী কিছুই না বুঝে বললেন, কে? কার কথা বলছিস তোরা? অনির বাবা মারা গেছেন তখন অনি কলেজে পড়ে। তখন থেকে পেনশনের টাকায় সব কিছু ম্যানেজ করে অনিকে বড় করেছি। একতলা বাড়িটাকে দোতলা করেছি। বাড়িতে অতগুলো ঘর থাকতে....কখনও তো তোদের কোনো ইচ্ছেতে আমি বাধা দিইনি। তাহলে তোরা এখানে কেন আসিস?
অনির্বাণ মাথা নীচু করে বললো, মা আমরা একটা ভুল করেছিলাম বিয়ের আগেই। 
বিয়ে ঠিক হবার পরে একদিন এই হোটেলে এসেছিলাম। তারপর রুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। 
রুমেলা বললো, মা আমরা বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনিনি জানো তো। অ্যাবরশন করিয়ে নিয়েছিলাম। 
বছর দুয়েক আগে থেকে তুমি প্রায় বলছো, এবারে একটা নাতি-নাতনি চাই। তখন আমরা ট্রাই করি। কিন্তু রুমি মা হতে পারছিলো না। ডক্টর দেখলাম। ডক্টর বললেন, ওই অ্যাবরশনের সময়েই রুমির জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। 
রুমি তারপর রোজ রাতে কাঁদে আর বলে, যে আসতে চেয়েছিলো পৃথিবীতে তাকে হত্যা করেছি বলেই নাকি এমন শাস্তি দিচ্ছে ভগবান। কে জানে কেন ওর ধারণা হয়েছে এই হোটেলের আট নম্বর রুমে সেই ভ্রূণ এখনও গুমরে কাঁদে। আমাদের ভালোবাসার সন্তানকে আমরা হত্যা করেছিলাম মা। সেটাও একটা শনিবার ছিল। তাই রুমির অবদারেই প্রতি শনিবার এই হোটেলের আট নম্বর ঘরটা বুক করি আমি। 
রুমি কেঁদেই চলেছে। আর আসবো না মা। সে অভিমান করে চলে গেছে আমার কাছ থেকে, আমায় আর মা ডাক শুনতে দেবে না কিছুতেই। 
নীলিমাদেবী রুমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, পাগলী মেয়ে। তোরা না এখনকার ছেলে-মেয়ে? তোরা এসব কুসংস্কারে বিশ্বাসী হলি কবে থেকে!
অনি আমরা কালকেই মাদার টেরেজার হোমে অ্যাপ্লাই করে দেবো। মোটকথা আমার নাতি-নাতনি চাই। 
রুমি বললো, অ্যাডাপ্ট করলে তোমার সমস্যা হবে না মা? 
নীলিমাদেবী বললেন, তুমি কি আমার গর্ভে জন্মেছো নাকি? তাহলে আমি তোমার মা হলাম কীকরে?
মা হবার জন্য একটা মন দরকার ব্যস। 
রুমেলা চোখের জলটা মুছে বললো, আমাদের ক্ষমা করো মা। আমরা যেটা করেছিলাম ভুল করেছিলাম। নীলিমাদেবী বললেন, চলো বাড়ি চলো। মনে মনে বললেন, কিছু আবেগকে সময়ে সামলাতে হয়। নাহলে এভাবে ভুল হয়ে যায়।
 
সমাপ্ত
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার
 

 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by