গোলক - ধাঁধা
কেয়া চ্যাটার্জী
মিশরে
এই গোলকটা আমায় আমার এক সহকর্মী, গাজী, দিয়েছিল আমার তেত্রিশতম জন্মদিনে।
বলেছিল, “যেদিন অন্তরাত্মার সাথে তোমার যোগাযোগ হবে, সেদিন এর রং পরিবর্তন
হবে।” কী? অন্তরাত্মার সাথে যোগাযোগ? সেটা আবার কী? যতসব আজগুবি কথা। আমি
পাত্তা দিইনি সেদিন। অফিসের কাজে মাঝে মধ্যেই আমায় যেতে হয় হিল্লি দিল্লি।
তাই অনেকেই আমায় চেনে। আমায় খাতির করে। আমিও সেটা বেশ উপভোগ করি। কেনই বা
করবো না বলুন তো? একটা ডুবন্ত কারখানার হাল ধরে তাকে তুলে এনেছি পারে। এখন
সেই কারখানার শেয়ার কিনতে মানুষ মরিয়া হয়ে পড়েছে। সেই কোম্পানির সাথে ডিল
করতে ছুটে আসে দেশি বিদেশি কোম্পানি। নেল কাটার থেকে হেয়ার স্টাইলার,
রান্না ঘরের বাসন থেকে কারখানার বড় বড় যন্ত্রপাতি সব কিছুতেই আমার
কোম্পানির কর্মীদের ছোঁয়া। সারাদিন ওদের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। মেশিন অনবরত
ঘটর ঘটর চলেই যাচ্ছে। সেই কোম্পানির ম্যানেজার আমি অজিতেশ বসু।
হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে আমি গাজীর দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে
হাসলাম, " অন্তরাত্মার সাথে কানেকশন হবে কিভাবে? সন্ন্যাস নিয়ে? অজিতেশ বসু
সন্ন্যাস নিলে তোমাদের চলবে তো?" গাজী কেমন অদ্ভুত হাসল, "তোমার বড্ড
অহংকার বেড়েছে বোস। অহংকার কিন্তু পতনের কারণ।" আমি মিশরীয় ভাষা খুব একটা
জানি না। জানলে হয়তো গাজীকে দুটো খিস্তি মেরে দিতাম অনায়াসে। কিন্তু বিদেশ
বিভুঁয়ে অকারণ রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। ডিলটা মিটিয়েই ফিরতে হবে কলকাতা। আমাদের
তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর জন্য ঘটা করে আয়োজন করেছে তমশা। এই একটা দিন ওর
পুতুল খেলার জন্য আমি সব ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকি। ওর পরিবার, বন্ধু বান্ধব,
কলিগের কাছে আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়। দেখো কেমন বর পেয়েছি! সুপুরুষ,
সুচাকুরে। আমিও যে সেটা উপভোগ করি না তা নয়। সারা বছর কাজ পাগল আমি কয়েক
ঘন্টার জন্য পারিবারিক, সোশ্যাল হয়ে উঠি।
কাজী হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আমি গোলোকটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি।
কাঁচের তৈরী শ্বেত শুভ্র একটা গোলক। বসার ঘরের শো কেসে বেশ মানবে। ইউনিক
গিফট হিসেবে তমশাকেও চমকানো যাবে। কিন্তু গাজী হঠাৎ এরকম অদ্ভুত একখানা
বস্তু আমায় উপহার দিতে গেল কেন? ব্যাটার অন্য কোন মতলব নেই তো? এমনিতেই
মাঝে মধ্যে ছিচকে চুরির দায়ে জেল খাটে। আবার স্মাগলিং করছে না তো? আমি খুব
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখি। না এটা না ভেঙে এর ভিতর কিছু ঢোকানো যাবে না। অন্য
কোন পথ নেই। তবে পুরোটাই সাদা। আমি স্থির করলাম মনে দোলাচলতা নিয়ে লাভ নেই।
এটা এই হোটেলেই রেখে যাবো।
রুম ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে এসে বসেছি। কথামতো গোলোকটা রুমেই বিছানার পাশের
টেবিলে রেখে এসেছি। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগের মুহূর্তে হঠাৎ হোটেলের একটি
ছেলে দৌড়ে দৌড়ে এসে দিয়ে গেল জিনিসটা। ছেলেটির চোখে বিস্ময় ও ভয় মাখা,
"স্যার এটা আপনি ফেলে যাচ্ছিলেন।" আমি বললাম, "না না এটা আমার নয়।" কিন্তু
ছেলেটি নাছোড়। কিছুতেই এই জিনিস সে হোটেলে রাখতে দেবে না। অগত্যা গোলোকটা
নিয়েই যাত্রা করতে হল। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে লাগেজের মধ্যে খুব সাবধানে
প্যাক করলাম। কাঁচের জিনিস। ভেঙে গেলে আরেক ঝামেলা। ভীষণ বিরক্তি লাগছিল।
যত ঝামেলা! যদিও কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি আমায়। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে
গেছিলাম কলকাতা।
তমশা
ব্যাগ আনপ্যাক করতে করতে বস্তুটা বের করে আনলো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আমার
দিকে তাকালো। আমি আমার অপ্রতিভভাব কাটিয়ে উঠে হাসি মুখে বললাম, "অ্যান্টিক।
সামলে রেখো কিন্তু।" ও সন্দেহ কাটাতে পারে না তবু হেসে ড্রইংরুমের একটা
তাকে গোলকটা রেখে দেয়। দরজা খুলেই যাতে গেস্টদের চোখে পড়ে। পরেরদিনই বাড়িতে
অনুষ্ঠান। তমশা এই নিয়ে আর বেশি ঘাটালো না। আমি অনায়াসেই বলতে পারতাম
জিনিসটা গাজী দিয়েছে। কেন যে বলতে পারলাম না?
"
বাবা! অজিতেশের কি জ্যোতিষ চর্চার ভূত চাপল নাকি?" পার্টির মাঝেই সফ্ট
ড্রিংকে চুমুক লাগাতে লাগাতে বলে উঠল তমশার বন্ধু শ্রীতমা। এতক্ষন কেউ
গোলোকটাকে নজর করেনি। ওর কথাতেই প্রায় সকলে এসে জড়ো হলো শেলফের সামনে। একে
একে সকলে সপ্রশ্ন চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য
অন্য কথা পারলাম। যেন এমন কিছুই না। তবে মনে হল যেন কেউ আমার কথা বিশ্বাস
করল না।
একটা ব্যাপার ভীষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে
আমায় আজকাল। কলকাতায় নামার পর থেকেই আমি কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমার
সেই সেলফ কনফিডেন্স, সেই অহংকার, ধারালো বুদ্ধি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।
আমি কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারছি না। কেউ যেন আমায় বিশ্বাস করছে না। সেদিন
তমশা যেভাবে তাকিয়েছিল, বিবাহ বার্ষিকীর দিন অতিথিরা যেভাবে চেয়েছিল আমার
দিকে আমি যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম নিজের ভেতর। এরকম তো কখনো হয়নি। যখন পড়াশোনা
শেষ করার লড়াই লড়ছিলাম, যখন চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, যখন নিজের
সর্বস্ব দিয়ে উন্নতির চেষ্টায় লেগেছিলাম — কখনো এতো দুর্বল হয়ে পড়িনি। কখনো
মনে হয়নি আমায় সবাই অবিশ্বাস করছে। আমার মাথার ভেতর তৈরী করা ফাঁদ সবাই
দেখতে পাচ্ছে। যে অজিতেশ বসু সমীহ চায়, সম্মান চায়, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, যশ
চায় তাকে সবাই ঘেন্না করছে। আমার ভেতরটা ক্রমে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আমি যেন
নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।
ঘুমটা ভেঙে গেল। মোবাইলের
ঘড়িতে রাত তিনটে। ঘরে এসির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন। তবু আমার জামা ঘামে ভিজে
গেছে। ওয়াশরুমে এসে মুখে চোখে জল ছিটিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। ভীষণ
ক্লান্ত লাগছে। কেন যে এমন হয়ে পড়ছি জানি না। কদিনের মধ্যেই ডাক্তার দেখানো
দরকার। প্রয়োজন হলে মানসিক ডাক্তারও। হলের ঘড়িতে একটানা আওয়াজ হচ্ছে
টিকটিক। হঠাৎ চোখ গেল সেই গোলোকটার দিকে। অন্ধকারে যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে
উঠেছে। এতটা আলোকিত তো দেখিনি আগে! অবশ্য রাত্রে জিনিসটাকে তো ভালো করে
দেখিইনি কখনো। গোলোকটা হাতে নিয়ে বসে পড়লাম সোফায়। আহ! কি শান্তি। ভেতরটা
কেমন শান্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে গোলোকটার
দিকে। কি সুন্দর রং! অন্তরের সব গ্লানি, সব দুর্বলতা, মলিনতা, ক্লেদ যেন
ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একি, এটা কি হচ্ছে? রংটা হঠাৎ পাল্টে
যাচ্ছে কেন? সাদা রং পাল্টে গিয়ে হয়ে উঠছে সবুজ। সবুজ, সবুজ— ঈর্ষার রং
সবুজ। হ্যাঁ হিংসেই তো করতাম আমি পরাগকে। তমশার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল
পরাগের সেই কলেজ জীবন থেকে। সেই সুবাদেই ওর বাবার কোম্পানীতে চাকরিটা পেয়ে
যায়। তখন আমি সামান্য ক্লার্ক। চোখে স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। ম্যানেজারের
চেয়ারটা না পেতে পারলে যেন শান্তি নেই। তমশাকে কি আমি ভালোবেসেছিলাম কখনো?
না বোধহয়। ও-ই তো ছিল আমার স্বর্গে ওঠার একমাত্র সিঁড়ি। বাধা ছিল পরাগ।
সেইজন্যই তো সব প্ল্যান। এক পার্টির রাতে ঘুমের ওষুধ মেশালাম ওর ড্রিঙ্কসে।
রিটাকে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। টাকা কথা বলে কিনা! পরাগ বেসামাল
হতেই ওকে হোটেলের রুম খুলে দেওয়া হল। ও শুয়ে পড়ল। শুধু আমি জানলাম ও
বেহুঁশ। তারপর সুযোগ বুঝে টুক করে রিটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েকটা অন্তরঙ্গ ছবি
আর একটা এম এম এস। ব্যাস, ওদের সম্পর্ক ভাঙতে বেশিদিন লাগেনি। পরাগ মুখ
লুকাতে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। অনেকে বলে নাকি সুইসাইড করেছে। আমি খোঁজ
নিইনি। নিয়েই বা কি লাভ? যেখানে আমার ধান্দা নেই, সেখানে আমার শ্রম নেই।
তারপর তমশাকে জালে ধরতে কম কশরৎ করতে হয়নি। ইন্টেলেকচুয়াল মেয়ে। যতসব
ন্যাকামি!
এই তো, এই তো আবার রং পাল্টাচ্ছে।
রং পাল্টে হয়ে যাচ্ছে লাল। লাল, লাল — লোভের রং লাল। তমশাকে বিয়ে করার পর
আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। একমাত্র কন্যা
সন্তানের পিতা সমস্ত সম্পত্তিই মেয়ের নামে করে গেছিলেন। ধীরে ধীরে আমার জাল
গোটাতে গোটাতে সবটাই কুক্ষিগত করে ফেললাম। কিন্তু ও হরি! এতো কিছুর পর
পুরোটাই ব্যর্থ। কোম্পানি শুধু নামেই বড়। ভেতরটা ফাঁপা। একটু হাত সাফাই
করতে গেলেই ধসে পড়বে। অভিজ্ঞ বুড়োর ঠিক নজরে পড়েছে সেটা। অগত্যা হাল ধরতে
হল। একবার যদি বুড়ো মরে তার সব সম্পত্তি তমশার আর তমশা
মরলে....হা..হা..হা...
ওই তো ওখানে দাঁড়িয়ে তমশা।
ওর চোখে ঘৃণা। ওর চোখে রাগ। পাশে কে? পরাগ? এখনো, এখনো তমশার মন প্রাণ
জুড়ে পরাগ? আমি নেই? বেইমান মেয়ে! রাগে আমার সারা শরীর ফুঁসতে শুরু করেছে।
লাল আরো গাঢ় লাল হয়ে যাচ্ছে গোলোকের রং। শ্বশুরের সাথে কোম্পানির একাউন্ট
নিয়ে বচসা হচ্ছিল সেদিন। তপব্রত লাহিড়ী অজিতেশ বসুকে সন্দেহ করছে। হ্যাঁ
আমি সরিয়েছিলাম পঞ্চাশ হাজার। তাতে কি? প্রমাণই বা কই? তলে তলে যে আমি
কোম্পানি বেচে ফেলার মতলব এঁটেছি তা কি আর জানতে বুড়ো? লোকটা আমায় চোর
বলল। অপমানে মাথা গরম হয়ে গেল। হাঁপানির রোগ ছিল লোকটার। সুযোগ বুঝে
ইনহেলারটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শ্বশুর বাড়িতেই তো থাকতাম। তপব্রত
লাহিড়ীর ঘরে ঢুকে ইনহেলারের শিশিটা নামিয়ে রেখে দিলাম। কেউ বুঝল না এটা
খুন। সবাই জানল অসুস্থতার ফলে মৃত্যু। ঐ তো ঐ ব্যালকনির সামনে দাঁড়িয়ে
মিস্টার লাহিড়ী। আমায় দেখে হাসছে। বিদ্রুপের হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলছে
অজিতেশ বসু লুসার।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি লুসার?
এতদিন এত পরিশ্রমের পরেও আমি লুসার? আমি দুহাতে ওদের কলার চেপে ধরলাম।
তোমরা আবার ফিরে এসেছ? পরাগ, তুমি তমশাকে আর পাবে না। আর এই যে মিস্টার
লাহিড়ী তোমায় আবার, আবার খুন করবো আমি। কিন্তু, কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?
এরা তো মৃত। এরা কিভাবে এলো? হঠাৎ মনে হল আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি। আবার মিশে
যাচ্ছি মাটির বুকে। লাল, লাল— প্রেমের রং লাল। আমার চারিদিকে লাল রক্তের
ছড়াছড়ি। তমশা ব্যালকনি থেকে বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে আমার দিকে। ওর হাতে
সেই গোলক। শ্বেতশুভ্র রং। স্নিগ্ধ। তুমি কাঁদছ তমশা। আমার মতো কীটের জন্য?
তুমি আমায় ঘৃণা করো তমশা। আচ্ছা, ঘৃণার রং কী? তুমি স্বছতোয়া নদীর মতো
নির্মল। তাই তো গোলোকটা রং পাল্টাচ্ছে না। আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তমশা।
চোখ বন্ধ হওয়ার আগে গাজীর কথা মনে পড়ল, "যেদিন অন্তরাত্মার সাথে তোমার
যোগাযোগ হবে সেদিন রং পাল্টে যাবে।" রঙ পাল্টেছে গাজী। তোমার জ্বালা
জুড়িয়েছে তো?
.......................................
অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার