উপন্যাস (থ্রিলার) - তপশ্রী পাল - নিশিনিলয়




নিশিনিলয়

তপশ্রী পাল

 

 

সময় আন্দাজ রাত্রি একটা। বাইপাস থেকে চৌভাগা হয়ে বাণতলার দিকে প্রচন্ড বেগে ধেয়ে চলেছে একটি লাল রঙের হোন্ডা সিটি! পিছনে জোর হেডলাইট জ্বেলে গাড়িটাকে ফলো করছে পুলিশের জিপ। ডিসেম্বরের রাত। সামনে হালকা কুয়াশার আস্তরণ। একটা কালভার্ট পার হয়েই রাস্তা ঘুরে গেছে বাঁ দিকে। কিন্তু কালভার্ট পেরিয়েই হঠাত বাঁ দিক না নিয়ে শেষ মূহূর্তে লাল গাড়িটা ডান দিকে নেমে গেলো! ডানদিকে রাস্তা নেই। দুপাশে ঝুপড়ি গাছের মধ্য দিয়ে ভাঙ্গা পায়ে চলা পথ গিয়ে মিশেছে চাষের জমি আর আলপথে। চাষের জমি ছাড়িয়ে গ্রামের কয়েকটা বাড়ি আর ফিশারিসের বিশাল ঝিল! চারিদিক ঘন অন্ধকার! পুলিশের গাড়ি অপ্রস্তুত অবস্থায় বাঁ দিক ঘুরেও প্রচন্ড জোরে ব্যাক করে এসে ডানদিকে নামলো। ততক্ষণে ঘন অন্ধকারে কোথায় উধাও হয়েছে গাড়িটা!

পুলিশের জিপে রয়েছেন কলকাতা পুলিশের দুই অফিসার নবারুণ পাত্র ও সমীর আইচ। এদিকটা বেশ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়েছে আজকাল। তাই রেগুলার নাইট রাউন্ডে বেরোতে হয়। থানার সামনে থেকে রাউন্ডে বেরোবার মুখেই কালিকাপুর থেকে গাড়িটাকে প্রচন্ড জোরে চৌভাগার দিকে যেতে দেখে কেমন সন্দেহ হয় নবারুণের। তখনি ফলো করতে শুরু করেন তাঁরা। ফলো করা হচ্ছে বুঝে হঠাত গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয় অনেকবার গাড়ির নম্বরটা পড়ার চেষ্টা করেছিলেন নবারুণ, কিন্তু কুয়াশা ও গাড়ির গতির জন্য পড়তে পারেননি পুরোটা। তবে প্রথম কয়েকটা অক্ষর নোট করেছেন। ব্যাটারা গেলো কোথায় মূহূর্তের মধ্যে? দুপাশের ঘন গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে নেই তো?  নবারুণ সমীরকে বললো

চলো তো, নেমে দেখি! মনে হচ্ছে আসেপাশেই গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমরা চলে গেলেই –“

না হে, নিজেরা লুকিয়ে থাকতে পারে, অতো বড়ো গাড়িটাকে কোথায় লুকোবে?”

তবু ওয়াইল্ড গুজ চেজ করি একটু”

বন্দুক আছে অবশ্য, কিন্তু ওদের সঙ্গেও অস্ত্র থাকতে পারে, সাবধান!”

পায়ে চলা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই গাছের গায়ে দাঁড় করানো আছে গাড়িটা! কুয়াশার জন্য দূর থেকে দেখা যায়নি! গাড়ির সব কাঁচ তোলা! ভিতরে কেউ নেই। নম্বর প্লেট নকল। নবারুণ বলে -

তার মানে গাড়ি এখানে ফেলে রেখে ওরা আলপথ দিয়ে গ্রামের দিকে গেছে! অথবা এখানেই আসেপাশে –“

চলো তো, চারিদিকে টর্চ ফেলে দেখি!”

বেশ খানিকক্ষণ এদিক ওদিক টর্চ মেরে কিছু দেখা গেলো না। গাছগুলো এখানে বেশ ঘন আর ঝুপসি! চারিদিকে লম্বা লম্বা ঘাসও আছে! সমীর বললো –

গাড়িটাকে টো করে নিয়ে যাই। তারপর কাল সকালে এসে নাহয় –“

তাই করা যাক তবে, কিন্তু এ ভাবে স্টেশনারী গাড়ি সরাবে কী করে? দাঁড়াও আমি টো-ট্রাকের সঙ্গে কথা বলি। থানাতেই আছে মনে হচ্ছে। ওরা এলে তবে আমরা যাব! নইলে গাড়ি গায়েব হয়ে যেতে পারে!”

ওকে, তুমি কথা বলো, আমি জিপে আছি”

জিপের দিকে এগোয় সমীর।

 

                                                   

আনন্দপুরে নতুন অফিস খোলার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি জিভাগোর হেড অনিকেত মল্লিকের সঙ্গে ভালোই আলাপ হয়ে গেছে থানার ও সি বারীণ ব্যানার্জীর। আনন্দপুরের দিকটা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠছে। নতুন নতুন অফিস-টাওয়ার, হাউসিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট, বড়ো হোটেল, গেস্টহাউস, হাসপাতাল, স্কুল কী নেই? আর রয়েছে প্রচুর নতুন গজিয়ে ওঠা আইনী বেআইনী দোকানপাট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতে। কলকাতার ফুসফুস পুবদিকের বিশাল ওয়েটল্যান্ড ভরে যাচ্ছে বেআইনী ভাবে! উঠছে বহুতল। বাংলাদেশ বর্ডার কাছে হওয়ায় প্রচুর বাংলাদেশী বেআইনী অনুপ্রবেশকারী ঢুকছে প্রতিদিন! লোকজনে গমগম করছে চারিদিক! মূল শহর থেকে একটু বাইরে এবং বাইপাস সংলগ্ন হওয়ায় এখান দিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুবিধেও আছে, আছে লুকিয়ে থাকার সুবিধেও। নানা অপরাধ হচ্ছে রাতবিরেতে। মহিলাদের ওপর আক্রমণও আছে তার মধ্যে। তাই বারীণ ব্যানার্জীর ব্যস্ততার শেষ নেই। খানিকটা সেই কারণেই বলা যায় অনিকেত মল্লিকও এদিকে নতুন ব্রাঞ্চ অফিস খুলেছেন। নইলে এদিককার কেস এলে দমদমে জিভাগোর অফিস থেকে পৌঁছোতেই সময় লেগে যায়। আনন্দপুরের অফিস দেখতে দিয়েছেন তাঁর দুই সিনিয়ার সহকর্মী আকাশ আর টিনাকে। নিজে মাঝে মাঝে এখানে, মাঝে মাঝে দমদম করে কাটান। বারীণবাবুর ফোন এসেছে সকালে নটা নাগাদ। অনিকেত তখন দমদমে।

বারীণবাবু খুব উত্তেজিত। ফোন ধরতেই বললেন “অনিকেত! কালকে মারাত্মক কান্ড হয়েছে চৌভাগায়! আমার দুজন সিনিয়ার অফিসারকে হারিয়েছি কাল, জানেন? আমি খুব হেল্পলেস বোধ করছি!  আপনার সাহায্য খুব প্রয়োজন আমাদের। অন্য জায়গা থেকে রেনফোর্সমেন্ট না এলে আমি প্রায় একা! অথচ ব্যাপারটা একেবারেই ফেলে রাখা যাচ্ছে না! কাগজের লোকেরা অলরেডি থানার সামনে ভীড় করেছে!

অনিকেত মল্লিক একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন “শান্ত হোন। দু কথায় বলুন আমাকে, কী হয়েছে।“

কাল রাতে থানা থেকে আমার দুজন অফিসার নবারুণ আর সমীর একটি গাড়িকে চেজ করে চৌভাগার দিকে যায়। ওখান থেকে রাত্রে নবারুণ থানায় ফোন করে টো-ট্রাক পাঠানোর জন্য, কারণ গাড়িটা এক জায়গায় পড়েছিলো । ভিতরে লোকজন কেউ ছিলো না। থানা থেকে টো-ট্রাক গিয়ে দেখে দুজনেই জিপের সামনে পড়ে আছে, মৃত! কোথাও কোন গাড়ির চিহ্ণ নেই!”

বলেন কী! দুজনেই মৃত!”

হ্যাঁ, এখানেই শেষ নয়! রাতে তো ওখানে পুলিশ পোস্ট করে রেখেছিলাম। আজ সকালে ঐ অঞ্চলের লোক্যাল লোকের থেকে একটি ফোন পেয়ে আমি নিজেও যেতে বাধ্য হই! ভেড়িতে নাকি একটি মেয়ের বডি ভেসে উঠেছে! তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি বেশ ভালো পোশাক পরা একটি মেয়ের দেহ, যেখানে নবারুণরা মারা গেছে, তারই কাছাকাছি ভেড়ির জলে ভাসছে!”

বাবা! এ তো জোড়া কান্ড! আমার যেতে একটু সময় লাগবে। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট আকাশ আনন্দপুর অফিসে আছে। ওকে পাঠাচ্ছি, ইনিশিয়াল হেল্প করতে।“

বডিগুলো এখনো থানায় আনা হয়নি। আমি চাইছিলাম আপনি একবার ওখানে গিয়ে কন্ডিশনটা দেখুন। তারপর বডি পরীক্ষা করে পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দেবো।“

আমি দেখছি কী করা যায়” বলে ফোন রেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনিকেত। প্রথমেই আকাশকে ফোন করে চৌভাগা যেতে বললেন বারীনবাবুর কাছ থেকে জায়গাটা জেনে নিয়ে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আকাশের ফোন! 

স্যার! সাংঘাতিক কান্ড! দু দুজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করে মেরে দিয়েছে স্যার! দেখে মনে হচ্ছে এঁরা নেমে গাড়িটা যখন ইনভেস্টিগেট করছিলেন, গাড়িতে যারা ছিলো তারা নেমে কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে ছিলো! যেই টো-ট্রাকের কথা বলে পুলিশ ওখানেই অপেক্ষা করতে লাগলো, তারা ডেসপ্যারেট হয়ে যায়, কারণ নিশ্চই গাড়িতে এমন কিছু ছিলো যেটা শুদ্ধ গাড়িটা থানায় চলে গেলে তাদের প্রবল অসুবিধা ছিলো! তাই তারা বাধ্য হয় এদের সরিয়ে দিতে! এই দুটো খুন ওদের প্ল্যানে একেবারেই ছিলো বলে মনে হয় না। আর স্যার, মেয়েটার বডিটাও খুব অদ্ভুত! মেয়েটাকে আগেই খুন করা হয়েছিলো। বডিটা পরে ঝিলে ফেলা হয়। গোটা শরীর কোন ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফালাফালা করা! মনে হয় সেই আঘাত মৃত্যুর পরে করা হয়েছে! কোন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই খুন মনে হচ্ছে স্যার! মেয়েটির কামিজের ভিতরের পকেটে একটা দামী মোবাইল পেয়েছি! পুলিশ মনে হয় ভিতরের পকেট চেক করেনি! মোবাইল পাসওয়ার্ড লকড!”

বাঃ ভালো প্রগ্রেস করেছো! মোবাইলটা পুলিশের হাতে দাও। পরে আমি গিয়ে দেখছি! আচ্ছা আকাশ তোমার কি মনে হয় এই জোড়া ঘটনার মধ্যে কোন যোগাযোগ আছে?”

থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে স্যার!“

আমি রওনা হচ্ছি! তুমি মৃতদেহগুলোর ছবি তুলে নাও। তারপর পুলিশকে বডিগুলো পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিতে বলো।“

 

বেলা দুটো নাগাদ হাঁপাতে হাঁপাতে অনিকেত থানায় এসে পৌঁছলেন। মৃতদেহগুলো পোস্টমর্টেমে চলে গেছে। বারীণবাবু অনিকেতকে দেখে হাতে চাঁদ পেলেন “যাক, আপনি এসে গেছেন! আমি একেবারে ভাবতে পারছি না নবারুণ আর সমীর নেই! আমি কাকে নিয়ে কাজ করবো ভেবে পাচ্ছি না। ওদের স্ত্রীদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। একটা খুব ডেসপারেট গ্রুপের মোকাবিলা করছি আমরা! ডেসপারেট না হলে দু দুটো পুলিশ অফিসারকে মেরে ফেলার সাহস করে? ধরা পড়লে ফাঁসি ছাড়া কোন শাস্তি হবে না। “

সত্যিই রেয়ার কেস! খুব আনফরচুনেট! এগোনোর আগে কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে – এক, নবারুণ আর সমীরের মোবাইল পাওয়া গেছে? আর দুই, মেয়েটির মোবাইল আকাশ পেয়েছিলো, সেটা কি আপনার কাছে আছে?”

হ্যাঁ তিনটে মোবাইলই আছে আমার কাছে। তবে তিনটেই পাসওয়ার্ড লকড! তার মধ্যে নবারুণের মোবাইলটা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আমি সকালে চার্জে লাগিয়ে অন করেছিলাম। আর মেয়েটার মোবাইলে প্রচুর জল ঢুকেছে, উল্টোপাল্টা বিহেভ করছে!”

ঠিক আছে এক্ষুণি এগুলো লালবাজার স্পেশাল সেলে পাঠিয়ে দিন আনলক করার জন্য। আর মেয়েটার মোবাইলটা ভালো করে শুকিয়ে গেলেই আবার ঠিক কাজ করবে আশা করি। ওদের স্পেশালিস্ট আছে এই কাজের জন্য। বেশ এবার বলুন লাস্ট নবারুণের সঙ্গে কার কথা হয়েছিলো?”

তো বরুণ! ও নাইট ডিউটিতে ছিলো। ওকেই ফোন করেছিলো নবারুণ, টো-ট্রাক পাঠানোর জন্য। দাঁড়ান ডেকে দিচ্ছি।“

অনিকেত বলল “বরুণ, মনে করে বলুন তো নবারুণ ঠিক কী কী বলেছিলেন আপনাকে”

নবারুণদা বলে যে গাড়িটাতে কেউ ছিলো না। গাড়ি বন্ধ। তাই টো-ট্রাক ছাড়া নিয়ে আসা যাবে না। গাড়িটা থানায় নিয়ে যাওয়া খুব জরুরী।“

অনিকেত চিন্তিত ভাবে বললেন “আর কিছু? গাড়িটা সম্বন্ধে বা আর কিছু সম্বন্ধে –“

বরুণ একটু থতমত খেয়ে বললো “দাঁড়ান ভাবি। ও হ্যাঁ, নবারুণদা বলেছিলো গাড়ির নম্বর প্লেটটা সম্ভবতঃ ফেক ছিলো, তবে প্রথম কয়েকটা ক্যারেক্টার JH01-23! নবারুণদা আর সমীর দুজনেরই নাকি ধারণা হয়েছিলো আসেপাশেই কেউ লুকিয়ে ছিলো, কিন্তু অনেক টর্চের আলো ফেলেও কাউকে দেখা যায়নি ঝুপড়ি গাছ আর ঘাসের জন্য।“

গাড়িতে উঁকি দিয়ে ওরা কিছু দেখতে পেয়েছিলো?

না, গাড়িতে কেউ ছিলো না”

অনিকেত আবার গভীর চিন্তায়। নিজের মনেই বললেন “হুম, ঝাড়খন্ডের নাম্বার প্লেট! নম্বরটা ফেক হলেও ঝাড়খন্ডটা ফেক নাও হতে পারে...অন্ততঃ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে এটা ঝাড়খন্ডের গাড়ি! সেক্ষেত্রে এখানে এতো কুকীর্তি করে আর এখানে না থেকে এরা নির্ঘাত নিজেদের রাজ্যে পালাবার চেষ্টা করবে! ইশ! অনেকটা সময় চলে গেছে! মিস্টার ব্যানার্জী আপনি এক্ষুণি ব্যবস্থা করুন যাতে রাজ্য থেকে ঝাড়খন্ডে যাওয়ার সব কটা রাস্তা বন্ধ করে এরকম নম্বরের লাল কোন গাড়ি দেখলে আটকানোর ব্যবস্থা হয়! খুব তাড়াতাড়ি করুন! হাতে কোন সময় নেই। ওরা যদি কাল রাত থেকে ট্রাভেল করে থাকে টানা, হয়তো এতোক্ষণে –“

মিস্টার ব্যানার্জী বললেন “অনিকেত আমি এদিকে যা করার করছি। আপনি মহিলার কেসটা টেক আপ করুন।“ অনিকেত জানেন পোস্টমর্টেম আর মোবাইল ছাড়া মহিলার কেসটা এগোনো মুশকিল। তাই জিজ্ঞাসা করলেন “মিস্টার ব্যানার্জী, আশা করি কাল মোবাইলগুলো খোলা হয়ে যাবে। আমি আকাশকে পাঠাবো। ওর হাতে মোবাইলগুলো অবশ্যই আমার কাছে পাঠাবেন। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষায় রইলাম।“

                                                  

 

 

 

 

সেদিন রাতে আর কোন খবর এলো না। মনে হয় না গাড়িটাকে কোন পোস্টে ইন্টারসেপ্ট করতে পেরেছে – হয়তো রাজ্য থেকে বেরিয়ে গেছে তার আগেই অথবা হয়তো রাজ্যেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে এখনো! নিজের মনেই ভেবে চলেছেন অনিকেত আনন্দপুরের অফিসের চেম্বারে বসে। কেসটা সত্যিই বেশ ভাবিয়ে তুলেছে! এমন ভয়ানক কেস এর আগে অনিকেতের হাতে আসে নি। হঠাত আকাশ চেম্বারে ঢুকলো।

স্যার, গাড়িটা কোন দিকে গেছিলো কাল সেটা কিন্তু সিসি টিভি ক্যামেরাগুলো থেকে বোঝা যেতে পারে খানিকটা।“

হঠাত বিদ্যুৎ চমকের মতো অনিকেতের মনে হয়, তাই তো! সিসি টিভি ফুটেজগুলো চেক করা খুব দরকার! ওখান থেকে বেরোতে হলে সায়েন্স সিটি দিয়েই বেরোতে হবে। সেখানকার সিসি টিভি দেখলে বোঝা যাবে ওরা বাইপাস দিয়ে উত্তর দিকে গেছে না পার্ক সার্কাসের দিকে। সেই বুঝে পরবর্তী সিসি টিভি চেক করতে হবে! অবিলম্বে আবার মিস্টার ব্যানার্জীকে ধরলেন অনিকেত এবং সিসি টিভির ফুটেজ চেক করতে বললেন। তারপর ফিরে এসে দেখলেন আকাশ টেবলের ওপর অনেকগুলো ছবি রেখে গেছে!

দুই মৃত পুলিশ অফিসার আর সেই মেয়েটির ছবি। সমীর উপুড় হয়ে আর নবারুণ চিত হয়ে পড়ে আছে। সমীরের গায়ের কাছেই জিপটা দাঁড়িয়ে! মানে সমীর জিপে ওঠার ঠিক আগে মারা যায়!  কিন্তু নবারুণ অনেকটা দূরে! বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত, হাতে ধরা মোবাইল! সম্ভবতঃ নবারুণ আগে খুন হয়, তারপর সমীর! হয়তো নবারুণের কোন আর্ত চিতকার শুনে সমীর গাড়িতে না উঠে ঘুরে তাকাতে গেছিলো আর সেই সময়েই তাকে গুলি করা হয়।

 

মেয়েটির বেশ কটা ছবি তুলেছে আকাশ। গোটা শরীর বীভৎস ভাবে ক্ষতবিক্ষত! কামিজ নানা জায়গায় ছেঁড়া! মহিলার বয়স আন্দাজ বছর বিশেক তো হবেই। বেশ সুন্দরী সেটা এতো অত্যাচারের পরেও বোঝা যাচ্ছে! একটা ছবিকে বেশ বড়ো করে দেখতে লাগলেন অনিকেত। গোটা হাতে, প্রায় কনুই পর্যন্ত পুরোনো মেহেন্দির দাগ রয়েছে মেয়েটির! তবে কি – এ নিয়ে আরো চিন্তা করার আগেই আরেকটা কল এলো অনিকেতের। অন্য এক ক্লায়েন্টের। কল শেষ হলে ছবিগুলো আরো ভালো করে দেখার জন্য সঙ্গে নিয়ে নিলেন অনিকেত।

রাস্তায় বেরোনোর খানিক পরেই মিস্টার ব্যানার্জীর ফোন! একটি লাল গাড়িকে গতকাল প্রায় শেষ রাতের দিকে সায়েন্স সিটি থেকে পার্কসার্কাসের দিকে প্রচন্ড স্পিডে যেতে দেখা যায়। “তাহলে মা ফ্লাইওভার, এ জে সি বোস রোড ফ্লাইওভার, হয়ে সেকেন্ড হুগলী ব্রিজ পর্যন্ত যতো সিসি টিভি ক্যামেরা আছে সব কটার ফুটেজ চেক করুন এক্ষুণি!” উত্তেজিত ভাবে বললেন অনিকেত!কিন্তু পার্ক সার্কাসের দিকেও তো যেতে পারে!” বললেন মিস্টার ব্যানার্জী। “না, সম্ভবতঃ যাবে না। কারণ শহরে ওরা আর থাকতে চাইবে না আর পুলিশ খুঁজলে প্রথমেই পার্ক সার্কাসে খুঁজবে।“

  

পরদিন সকালে জানা গেলো, যে আর কোন সিসি টিভিতেই গাড়িটার ফুটেজ ধরা পড়েনি। আশ্চর্য! তবে কি পার্ক সার্কাসেই? কিন্তু কেন? তবে কি যা অনিকেত ভেবেছিলো, যে গাড়িটা ঝাড়খন্ডের, তা সত্যি নয়? বেশ ধাঁধায় পড়ে গেলো অনিকেত। নাঃ মোবাইলগুলো না আসা অবধি আর এগোনো যাবে না মনে হচ্ছে। শুধু মিস্টার ব্যানার্জীকে ফোন করে পার্কসার্কাসের দিকের মোটর গ্যারেজগুলোতে লাল কোন হন্ডা সিটি গাড়ি দেওয়া হয়েছে কি না খোঁজ করতে বললেন অনিকেত মল্লিক। যদি নম্বর প্লেট বদলাতে হয়, হয়তো এইসব রোডসাইড ছোট কোন গ্যারেজে দেওয়া হতে পারে। গাড়িটাকে লোকচক্ষুর আড়াল করতেও সেটা করা হতে পারে।

 

ইতিমধ্যে বিকেলের দিকে নবারুণ আর সমীরের ফোন এসে গেলো থানায়। লক খোলা হয়েছে। মেয়েটির ফোন এখনো শুকোতে হবে। তার আগে কাজ করবে না। যা পাওয়া গেলো তাই সই। আপাততঃ কয়েকদিনের জন্য অনিকেত আনন্দপুরে আড্ডা গেড়েছেন। এদিকে দিদির বাড়িতেই রাতে থাকছেন, যাতে যে কোন সময় ছুটে যেতে পারেন অফিসে।

সমীরের ফোনে তেমন কিছু পাওয়া গেলো না। নবারুণের ফোনে দেখা গেলো লাস্ট কল কিন্তু থানায় করা হয়নি। তার পরেও নবারুণ আউটগোইং কল করেছিলো। নম্বরটা থানায় পাঠালেন অনিকেত। জানা গেলো ওটা ওর বাড়ির নম্বর। নবারুণের বৌ জানালো নবারুণ ফোনে বলেছিলো হয়তো রাতে বাইরেই থাকতে হবে, কখন বাড়ি ফিরবে ঠিক নেই। কথাবার্তা বলতে বলতেই ওর বৌ ফোনে গুলির আওয়াজ ও নবারুণের আর্ত চিৎকার শোনে। তারপরে সম্ভবতঃ ফোনটা অন রয়ে যায় যার জন্য পাওয়ার ডাউন হয়ে গেছিলো! অনিকেত একবার ফোন করলেন নবারুণের স্ত্রীকে। বললেন “আপনার মনের অবস্থা কী, বুঝতেই পারছি, কিন্তু তাও বিরক্ত করলাম। সম্ভবতঃ নবারুণের কলটা অন রয়ে গেছিলো যখন ঘটনা ঘটে! আপনি কি অন্য কোন আওয়াজ পেয়েছিলেন এরপর পিছনে?” নবারুণের স্ত্রী বললেন যে উদবেগে ভালো করে শুনতে পারেনি, কিন্তু একটা চীৎকার “দোনো খতম!” শুধু শুনেছিলো। এটাই যথেষ্ট অনিকেতের জন্য। তার মানে যে বা যারা খুন করেছিলো তারা হিন্দীভাষী ছিলো! অর্থাৎ ঝাড়খন্ডের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না এখনো।

 

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী নবারুণ আর সমীরের মৃত্যু গুলিতে । মেয়েটিকে গলা টিপে মারা হয় এবং তারপর তার দেহে ছুরি জাতীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়। মেয়েটির মৃত্যু হয় ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে।

কয়েকটি প্রশ্ন জড়ো হয় অনিকেতের মনে। তার উত্তর লুকোনো আছে হয়তো মেয়েটির মোবাইলে। কিন্তু অনিকেত যা ভাবছে তা যদি হয় তবে হিসেবে মিলছে না।   

 

                                                  

 

আরো একদিন পর মেয়েটির মোবাইল ফেরত পেলো থানা। কিন্তু আশ্চর্যভাবে মোবাইলের মেসেজ, ছবি, কল রেকর্ড ইত্যাদি সব ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে! অর্থাৎ মোবাইলটা পেয়ে কোন লাভই হলো না। একেবারে কোন লাভ হলো না বলা যায় না। আই এম এ আই নম্বর থেকে, মোবাইল সেট কার নামে কেনা জানা যেতে পারে, তবে সেটা সময়সাপেক্ষ। সিমটা রয়ে গেছে। সেটা অনিকেত সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে কল রেকর্ড চেকের জন্য থানায় পাঠিয়ে দিলেন। আনন্দপুরের চেম্বারে চিন্তিত মুখে বসেছিলেন অনিকেত। মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে! বড় দেরী হয়ে যাচ্ছে সময়মতো ইনফরমেশনগুলো না পাওয়ার জন্য।

আকাশ ঢুকলো চেম্বারে। আকাশকে দেখে নড়ে চড়ে বসলেন অনিকেত মল্লিক। নিজের চিন্তাগুলো আকাশের সঙ্গে একটু শেয়ার করে নিলে ভালো হয়। যদি ওর কোন চিন্তা থাকে সেটাও জানা যাবে। অনিকেত বললেন “আকাশ, আমার ধারণা মেয়েটি অবাঙ্গালী এবং বিবাহিতা। খুব সম্ভবতঃ কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছিলো। হাতে এখনো পুরোনো মেহেন্দির দাগ রয়েছে! তুমি যে ফটো তুলেছো তাতে দেখলাম।“ কিন্তু স্যার, অবাঙ্গালী মেয়েরা এমনিও মেহেন্দি পরে। অনেক সময় আত্মীয় স্বজনের বিয়েতেও পরে।“ বললো আকাশ। “তা পরে, কিন্তু এতো ঘন মেহেন্দি একেবারে কনুই অবধি – উঁহু, বিয়ের সময় ছাড়া এমন পরে না।“ ঘাড় নাড়লেন অনিকেত “সেক্ষেত্রে যদি ধরে নিই মেয়েটির অল্প কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছিলো, তবে সম্ভতঃ বিয়ের পরেই সে এই অঞ্চলে এসেছিলো। এমন একটি মেয়েকে কে মারতে পারে বলে তোমার মনে হয়?”

আকাশ খানিক ভেবে বললো “স্যার, একটি নববিবাহিতা গৃহবধূকে অনেক সময় দহেজের মানে পণের জন্য শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার করা হয় বা মেরে ফেলা হয়!”

গুড পয়েন্ট আকাশ! সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই খুনের সঙ্গে গাড়ি উধাও হওয়ার ঘটনাকে মেলানো যাচ্ছে না। যদি ধরেও নিই যে মেরে ফেলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে মারা যাওয়ার পরও ঐ ভাবে ছুরি দিয়ে দেহ ফালাফালা করার কোন কারণ নেই। এরকম ক্ষেত্রে সাধারণতঃ শ্বশুরবাড়ির লোক ভয়ে থাকে এবং সাধারণ মৃত্যু প্রমাণ করে তাড়াতাড়ি বডি পুড়িয়ে ফেলে বা কবর দেয়। এরকম ইঞ্জুরি থাকলে কোনভাবেই সাধারণ মৃত্যু দেখানো যাবে না। উঁহু, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার কেসটা ধোপে টিকছে না হে। বরং – যদি এমন ভাবা যায় যে মেয়েটি পরিবারের অমতে পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিলো এবং এই অঞ্চলে বাস করছিলো তাহলে –“ বলতে বলতেই অনিকেতের ফোন বেজে উঠলো। মিস্টার ব্যানার্জী। মেয়েটির মোবাইলের কল রেকর্ড পাওয়া গেছে। মিস্টার ব্যানার্জী কল রেকর্ড চেক করে দেখেছেন মেয়েটির মোবাইল থেকে সেদিন বিকেলে কোন কল যায়নি এবং আসেনি। তবে তার আগে কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি কল করা হয়েছে দুটি নম্বরে। দুটিই ঝাড়খন্ডের নম্বর।

আকাশ, আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে! গাড়ির নম্বর ফেক হলেও রেজিস্ট্রেশন নম্বরের প্রথম অক্ষরগুলো পরিবর্তনের কথা ভাবা হয়নি। নম্বরটাই শুধু চেঞ্জ করা হয়েছিলো। অর্থাৎ গাড়িটি ঝাড়খন্ডের এবং এ রাজ্যে ঢোকার আগেই নম্বর সম্ভবতঃ চেঞ্জ করা হয়। কারণ গাড়ির আরোহীরা জানতো যে তারা কোন বেআইনি কাজে যাচ্ছে এবং ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে।“ উত্তেজিত ভাবে বললো অনিকেত।

তাহলে সেই ঝাড়খন্ড থেকে এই নিরীহ মেয়েটিকে খুন করতে এতো দূর আগমন হলো খুনীর! কী কারণে স্যার? আর খুন করতে গিয়ে সে দু দুজন পুলিশ অফিসারকে খুন করে ফেললো! ” মাথা চুলকে বললো আকাশ।

 “পুলিশ খুনটা একই লোক নাও করে থাকতে পারে আকাশ! এ ক্ষেত্রে আরেকটা হিসেব মিলছে না।“ চিন্তিত মুখে বলে অনিকেত।

কী স্যার?”

মেয়েটির স্বামী! আমি যা ভাবছিলাম তা হলে তারও মরার কথা, কিন্তু সে মরলো না কেন? আর যদি সে বেঁচে থাকে তবে তার থানায় ডায়রী করা উচিত ছিলো যে তার স্ত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না! তাও সে করেনি!”

সেটা বলা যায় না স্যার। আমরা তো সব থানায় মিসিং ডায়রী চেক করিনি এখনো!” বলে আকাশ।

কথাটা মন্দ বলোনি, তবে সে সব কাজ পুলিশ ইতিমধ্যে অবশ্যই করছে। মেয়েটির ছবি দিয়ে নানা থানায় জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে এই মহিলার ব্যাপারে কেউ মিসিং ডায়রি করেছে কিনা। মেয়েটিকে আইডেন্টিফাই তো করতে হবে।“ বলেন অনিকেত।

মিস্টার ব্যানার্জী বললেন যে সমস্ত থানায় মিসিং পারসন লিস্ট চেক করা হয়েছে। এই মেয়েটির ব্যাপারে কেউ ডায়রি করেনি।

দেখলে তো আকাশ? আমি আগেই বলেছিলাম! এই স্বামী লোকটি খুবই রহস্যময়! আর চিন্তা গাড়িটাকে নিয়ে। পার্কসার্কাসের দিকে গিয়ে সে কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো? সার্ভিস সেন্টারগুলোতে খোঁজ নেওয়া হয়েছিলো। সেখানে কোথাও ওরকম কোন গাড়ির দেখা পাওয়া যায়নি। তার মানে ওদিকেই কোন আস্তানায় সেটা লুকোনো আছে! কিন্তু কে বা কারা আশ্রয় দিলো এই ঝাড়খন্ডবাসীদের? নাঃ আর অপেক্ষা করা যাবে না। মিস্টার ব্যানার্জীকে বলি কাগজে একটা বিজ্ঞাপণ দিতে, মেয়েটির ছবি দিয়ে। কেউ মেয়েটিকে ঐদিন বা তার আগে দেখেছে কিনা। দেখা যাক, খুনীর কী রিঅ্যাকশন হয় ছবি বেরোনোর পর!” দৃঢ়স্বরে বলেন অনিকেত।

 

ঘটনার খবর আগেই বেরিয়েছিলো সব কাগজে। সাংবাদিকরা মিস্টার ব্যানার্জীকে ছিঁড়ে খাচ্ছে প্রতিদিনের আপডেটের জন্য। কিন্তু মেয়েটির ছবি এই কদিন দেওয়া হয়নি। অনিকেতই বারণ করেছিলেন মিস্টার ব্যানার্জীকে। এখন কাগজে মেয়েটির ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপণ দেওয়ার পর থানায় সংবাদ মিডিয়ার ভীড় আরো বাড়লো। বিকেলের দিকে মিস্টার ব্যানার্জী যখন ফোন করলেন ততক্ষণে তাঁর গলা ভেঙ্গে গেছে! প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা! বললেন “মশাই কী করলেন বলুন তো! আমি তো পাগল হয়ে যাব!”

অনিকেত হেসে বলেন “কেন? কী হলো?”

কী হলো? সাংবাদিকদের জ্বালায় আমার অবস্থা কাহিল!”

 “এ ছাড়া আর কেউ এসেছিলো?”

হ্যাঁ হ্যাঁ! বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম! এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি বললেন তিনি অফিসের কাজে এসে কালিকাপুরে একটি গেস্টহাউসে আছেন। ঘটনার দিন তিনি নাকি ঐ মেয়েটিকে একটি লোকের সঙ্গে ঐ গেস্টহাউসে ঢুকতে দেখেছিলেন। মেয়েটি নাকি বোরখা পরে এসেছিলো। কিন্তু হাঁটার সময় লবিতে হোঁচট খাওয়ায় তার পায়ে আঘাত লাগে এবং সে উঃ বলে ভদ্রলোকের চেয়ারের কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ে, মুখের নকাব তুলে নিজের পায়ের দিকে তাকায়। তখন তিনি তার মুখ ভালোভাবে দেখতে পান। তিনি তখন নীচে লবিতে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন বিকেল পাঁচটা নাগাদ!”

মাই গড! দারুণ খবর! ভদ্রলোকের ফোন নম্বর নিয়েছেন তো? আর গেস্টহাউসের নাম?”

হ্যাঁ হ্যাঁ, সে কি আর ভুল হয়? নিউ শাইন গেস্টহাউস!”

বোরখা? আশ্চর্য! বোরখা পরার তো কোন – যদি না – আচ্ছা গিয়ে চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন করা যাক! চলুন শীগগিরি! নিউ শাইনকে আগে খবর দেওয়ার কোন দরকার নেই!” ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন অনিকেত।

 

 

নিউ শাইন গেস্টহাউস নতুন তৈরী একটি চারতলা বাড়ি। এখানকার অনেক বসতবাড়িই গেস্টহাউসে রূপান্তরিত হয়েছে ইদানিং। এটিও তেমনি। নীচের রিসেপশনে মিস্টার ব্যানার্জী নিজের আই ডি দেখাতেই রিসেপশনের মেয়েটি তাড়াতাড়ি একটি কনফারেন্স রুমে নিয়ে বসালো ওদের। মেয়েটির অস্বস্তি বেশ চোখে লাগলো অনিকেতের। একটু পরে ম্যানেজার মিস্টার আহমেদ দেখা দিলেন এবং আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। মিস্টার ব্যানার্জী মেয়েটির ছবি দেখানোতে ম্যানেজারবাবু আঁতকে উঠলেন! বললেন যে এমন কোন মহিলাকে কস্মিনকালেও এখানে দেখেননি। অনিকেতের সঙ্গে মিস্টার ব্যানার্জীর চোখাচোখি হলো। মিস্টার ব্যানার্জী বললেন “বুঝেছি এমনিতে আপনি কিছু বলবেন না। বেশ, আমার সঙ্গে থানায় চলুন! সেখানে গিয়েই ব্যবস্থা হবে! এটা খুনের ঘটনা এবং আপনার এখানকার এক গেস্ট এঁকে এখানে ঢুকতে দেখেছেন মৃত্যুর দিন!” ম্যানেজারবাবু বিপাকে পড়ে বললেন “আমাকে নিয়ে কেন টানাটানি করছেন স্যার? আমি বলতে চাইছিলাম যে ইনি এখানে ওঠেন নি। কোন গেস্টের সাথে দেখা করতে এসে থাকতে পারেন, সেটা মিলি, মানে আমাদের রিসেপশনিস্ট বলতে পারবে।“বেশ, এই তো মুখ খুলেছে! আমরা মিলির সঙ্গে কথা বলছি। আপনি কোথাও যাবেন না। আমাদের আরো অনেক কিছু জানার আছে।“ বলে অনিকেত।

মিস্টার ব্যানার্জী আর অনিকেত রিসেপশনে ফিরে আসায় মিলি মেয়েটি যেন আরো অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। মিস্টার ব্যানার্জী বললেন “এই ছবিটা দেখুন। খবরের কাগজে পড়েছেন তো চৌভাগার ঘটনা! এই মেয়েটি খুন হয়েছে। একে মৃত্যুর দিন এই গেস্টহাউসে ঢুকতে দেখেন আপনাদেরই এক গেস্ট! উনি কার কাছে এসেছিলেন?”

মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে নখ খুঁটতে থাকে। মিস্টার ব্যানার্জী ধমক দিয়ে বলেন “বলুন! বলুন! চুপ করে থাকলে থানায় যেতে হবে!” মিলির মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ “স্যার! আমার বাড়িতে বিধবা মা! এই চাকরী আমার ভরসা! আমার কিছু হলে মা মারা যাবেন আর বেফাঁস কিছু বলে ফেললে আমার চাকরী যাবে স্যার!” অনিকেত এবার খুব আস্তে বুঝিয়ে বললেন “মিলি, এই মেয়েটি তোমারই বয়সী একটি মেয়ে, যাকে এরকম নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। তুমি কি চাও না এর কিনারা হোক? তোমার কোন ভয় নেই। তোমার কিছু হবে না। তুমি নির্ভয়ে বলো।“

মিলি বললো “আমি ঠিক ভালো বলতে পারবো না স্যার। ম্যানেজারবাবু জানেন, ইনি কে। গত দুমাস ধরে মাঝে মাঝেই আমাদের গেস্টহাউসে হাসব্যান্ডের সঙ্গে আসতেন। নানা গেস্টের ঘরে চলে যেতেন ওঁর হাসব্যান্ড নীচে অপেক্ষা করতেন। ঘন্টাখানেক পরে দুজনে চলে যেতেন।“

তুমি জিজ্ঞাসা করতে না, কেন বা কার কাছে আসেন?”

না ম্যানেজারবাবু বলেছিলেন ওঁর বর মালিকের বন্ধু। কোন কথা না জিজ্ঞাসা করতে।“

দিন কি উনি চলে গেছিলেন?”

মেয়েটি বললো “আমার ডিউটি ছটায় শেষ হয়ে যায় স্যার। তারপর ম্যানেজারবাবু থাকেন। আমি বলতে পারবো না উনি কখন গেছেন। আমি যেতে দেখিনি।“

উনি বা ওনার হাসব্যান্ড হোটেলের খাতায় কখনো সাইন করেছেন?”

নাঃ”

বেশ, এবার ম্যানেজারবাবুকে ডেকে দিন!”

ম্যানেজার মিস্টার আহমেদের কাছ থেকে সহজে কিছু বার করা গেলো না বলে তাঁকে থানায় নিয়ে আসতে হলো মিস্টার ব্যানার্জী আর অনিকেতকে।

বেশ কয়েক দফা মারধোর পড়ার পর জানা গেলো যে মহিলার বর সুলতান হোসেন, হোটেলের মালিক মহম্মদ সাদিকের চেনা জানা! মাসেক দুয়েক ধরে সুলতান হোসেন তাঁর বিবিকে নিয়ে আসতেন গেস্টহাউসে। গেস্টহাউসটিকে নিশিনিলয় হিসাবে ব্যবহার করেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সেলসের লোকজন। ক্লায়েন্টদের এন্টারটেন করা হয় এখানে এনে। এন্টারটেনমেন্ট মানে ঢালাও মদ, নারীসঙ্গ ইত্যাদি। সুলতান হোসেনের স্ত্রীকে সেই কাজেই ব্যবহার করা হতো। ঘটনার দিনও মহিলা ও তার স্বামী এসেছিলেন। সেদিন রাঁচি থেকে একটি লাল গাড়ি নিয়ে দুজন ভদ্রলোক এসেছিলেন একটি ঘরে। মেয়েটি সেখানে চলে যায়। এতে ম্যানেজার অবাক হলেও তাঁর কিছু বলার এক্তিয়ার ছিলো না। কিন্তু এদিন সে ঘর থেকে বেরোয়নি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে মালিক মহম্মদ সাদিক তাড়াহুড়ো করে আসেন এবং মহিলার স্বামীকে নিয়ে ওপরে চলে যান। বেশ খানিক পরে একটি মস্ত বড়ো ট্রলি ব্যাগ ও অন্য জিনিসপত্র নিয়ে রাঁচির দুজন ভদ্রলোক ও মালিক বেরিয়ে আসেন ও সেই লাল গাড়িতে করে চলে যান।

অনিকেত জিজ্ঞাসা করেন “আর মহিলা?”

ম্যানেজার বলে “জানি না স্যার, তাঁকে দেখিনি!”

সে কী? আস্তনিস্ত এক মহিলা উড়ে গেলেন? আপনারা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না?”

আমাদের পারমিশন নেই স্যার!”

বেশ, যে ঘরে তারা ছিলেন আমরা দেখবো সেই ঘর! নিয়ে চলুন!” কড়া গলায় বলেন মিস্টার ব্যানার্জী।

সে ঘর তো বন্ধ স্যার! সেদিনই মালিক চাবি নিয়ে চলে গেছেন!”

মাই গড! আই সি!”

বেশ, এবার মালিকের ঠিকানা দিন” বলেন অনিকেত।

উনি পার্ক সার্কাসের দিকে থাকেন স্যার। আমি ওনার ঠিকানা জানি না!”

ন্যাকামি হচ্ছে? হোটেল রেকর্ডে নিশ্চই আছে! গিয়ে খুঁজে বার করুন! চলুন!” ম্যানেজারকে নিয়ে হোটেলে ফিরলেন অনিকেত ও মিস্টার ব্যানার্জী। কিন্তু রেকর্ডে কোথাও ম্যানেজারের ঠিকানা পাওয়া গেলো না। তাঁর ফোন যথারীতি বন্ধ।

যে গেস্টরা ঝাড়খন্ড থেকে এসেছিলেন তাঁদের ফোন নম্বর হোটেল রেজিস্টার থেকে নিয়ে দেখা গেলো ভুল নম্বর দেওয়া হয়েছে হোটেলে।

অনিকেত বললেন “অপরাধী আজকাল ভালোভাবে জেনে গেছে যে পুলিশ মূলত এখন মোবাইল ফোনের সুত্র ধরে কেস সমাধান করে। তাই সব মোবাইল অফ হয়ে যায় বা তারা অন্য সিম ব্যবহার করে। এখন লাস্ট চান্স হিসাবে মেয়েটি ঝাড়খন্ডে যে নম্বরে কয়েকবার ফোন করেছিলো সেই নম্বর অন হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে। আর এটা মোটামুটি অনুমান করা যায় যে পার্কসার্কাস অঞ্চলেই লাল গাড়িটা লুকোনো আছে। তাই পার্কসার্কাস অঞ্চলের প্রতিটি রাস্তার সিসি টিভি ফুটেজগুলো ভালো ভাবে দেখতে পাঠান। এতে অন্ততঃ একটি অঞ্চলকে আমরা চিহ্ণিত করতে পারবো এবং সেই অঞ্চলে পুলিশ পোস্টিং বাড়াতে পারা যাবে।“                          

 

 

পরদিন সব সিসি টিভি ফুটেজ অ্যানালিসিস হয় সারাদিন। সেদিন রাতে লাল গাড়িটাকে পার্কসার্কাস থেকে বেকবাগানের দিকে যেতে দেখা যায় একটি ক্যামেরায় এবং বেকবাগানের একটি গলিতে গাড়িটা ঢুকে যায়। তারপর আর কভারেজ পাওয়া যায় না। অনিকেত মিস্টার ব্যানার্জীকে বলেন “আপনি এই অঞ্চল থেকে বেরোনোর সব কটি রাস্তায় পুলিশ পিকেট বসিয়ে দিন। প্রতিটা গাড়ি চেক করে তবে বেরোতে দেবেন। খুনীরা হয়তো ডেসপ্যারেট হয়ে অন্য কোনভাবে  বেরোনোর চেষ্টা করতে পারে। ঐ গাড়ি ব্যবহার নাও করতে পারে। কারণ এই রাজ্যে আর বেশীদিন থাকা তাদের পক্ষে বিপদজনক। তাই সব গাড়ির, মানে সবরকম গাড়ির আরোহির আই ডি চেক করার ব্যবস্থা করুন। তবে যিনি তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তিনি বড়ো খেলোয়াড়। তার কথা অবশ্য আলাদা।“

পিকেটিং শুরু হওয়ার পর দিন সাতেক কোন খবর পাওয়া গেলো না। অনিকেত ক্রমশঃ অধৈর্য হয়ে উঠছেন। নিজের চেম্বারে অতিষ্ঠ হয়ে ঘোরাঘুরি করে বেড়াচ্ছেন। তাঁর ক্যারিয়ারে কোন কেস সল্ভ করতে এতোদিন সাধারণতঃ লাগেনি।

মিস্টার ব্যানার্জীকে বলে নিউ শাইন গেস্টহাউস সিল করিয়ে দিলেন। তাঁর বদ্ধ ধারণা হলো ব্যবসায় হাত পড়লে আজ হোক কাল হোক আড়ালে থাকা মেঘনাদ বেরোবেই।

অবশেষে দিন সাতেক পর মিস্টার ব্যানার্জীর ফোন দুপুরের দিকে “অনিকেত! শীগগিরি এসো! খবর আছে। ফোনে বলা যাবে না।“ থানায় যেতে মিস্টার ব্যানার্জী গোল গোল চোখে বললেন “একটা মালবাহী ৪০৭ গাড়ি বুঝলে ঐ বেকবাগান থেকে বেরোচ্ছিলো, বেশ কিছু লোহা লক্কড় নিয়ে। ওরকম অনেক গাড়ি ওখান থেকে রোজ বেরোয়। কিন্তু এই গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়াও দুজন বসেছিলেন যাদের দেখলে ঠিক খালাসী শ্রেণীর মনে হয়না। বেশ ভালো পোশাক পরিচ্ছদ পরা। পুলিশ তাদের আই ডি দিতে বলায় তারা গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেয়! বেশ ভালোরকম চেজ করে, একজনের পায়ে গুলি করে তবে তাদের ধরা যায়! দুটোকেই লক আপে পুরেছি! বডি সার্চ করে দুজনের কাছেই বন্দুক পেয়েছি! কান্ট্রি মেড বন্দুক! কেন তারা অমন পালাবার চেষ্টা করেছিলো তার কোন সদুত্তর তারা দিতে পারেনি!”

তাদের কাছে মোবাইল পেয়েছেন? বন্দুকের চেয়েও সেগুলো দামী!”

পেয়েছি, তবে সুইচড অফ! একজনেরটা অন করে দেখেছি! সিম নেই! অন্যটা এখনো দেখার সময় পাইনি!”

আচ্ছা! তার মানে পুরোনো সিম ফেলে দিয়েছে! কিন্তু নতুন সিম ভরার সময় পায়নি! ঠিক আছে, সিম না থাকলেও ক্ষতি নেই। ফোনে কী সেভড আছে তো দেখা যাবে! ওদের সঙ্গে পরে কথা বলছি। ফোনটা আনুন!”

অন্য একটি সিম ঢোকানো হলো ফোনে। ফোন থেকে নিকাহের ছবি পাওয়া গেলো বেশ কিছু! বিয়ের কণের সঙ্গে খুন হওয়া মেয়েটির প্রচুর সাদৃশ্য! অতএব অনিকেতের সন্দেহ হলো এই লোকটিই ওর স্বামী সুলতান হোসেন! কিন্তু অন্য লোকটিই কি তবে ঝাড়খন্ড থেকে আগত? সে কে এবং কেন এসেছিলো? অনিকেত এবার মিস্টার ব্যানার্জীকে অন্য ফোনটি আনতে বললেন। এই ফোনটিতে সিম রয়েছে। অন করে দেখা গেলো ফোন লকড। আবার লক খুলতে সময় লাগবে। একটা ওয়াইল্ড ট্রাই করে অনিকেত যে নম্বরটিতে মেয়েটি ফোন করেছিলো সেই নম্বরটায় ফোন করলো! আশ্চর্যভাবে এই ফোনটি বেজে উঠলো! যাক সব সূত্রই একজায়গায় এসে পৌঁছচ্ছে!

 

দুটি লোককে প্রচুর জেরা করে ও থার্ড ডিগ্রি টর্চার করার পর কাহিনীসূত্র জানা গেলো ও একটি ভয়ঙ্কর খুনের পরিকল্পনা স্পষ্ট হলো! মেয়েটির নাম ছিলো জানকী কুমারী। রাঁচির বাসিন্দা। দুজন আসামীর মধ্যে একজন তার নিজের দাদা আশিস কুমার। তাদের পরিবার অত্যন্ত গোঁড়া এবং নিজেদের জাত গোত্রের বাইরে বিয়ে করা তাদের সমাজে অচল! কিন্তু জানকী যা করেছিলো তা তাদের চিন্তা ভাবনার বাইরে! সুলতানের সঙ্গে জানকীর পরিচয় হয় ফেসবুকে! সুলতানের রূপে আর মিষ্টি কথায় মুগ্ধ হয় জানকী। সেখান থেকে প্রেম! এরপর সুলতান রাঁচিতে যায় এবং জানকী তার সঙ্গে পালিয়ে আসে বাড়িতে কোন খবর না দিয়ে! কলকাতায় এসে নিকাহ করে সুলতানকে! এরপর অনেকদিন বাড়িতে তার কোন খবর ছিলো না। বাড়ির লোক জানকীকে মৃত ধরে নিয়েছিলো কারণ তাদের পরিবারে মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে এভাবে পালালে তাদের আর বাড়ি ফেরার কোন রাস্তা থাকে না। কিন্তু জানকী ভাবতে পারেনি সে কোন ফাঁদে পড়েছে!          

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই সুলতানের আসল রূপ খোলে। সে বিবিকে বন্ধু মহম্মদ সাদিকের হোটেলে ক্লায়েন্ট এন্টারটেনমেন্টের জন্য পাঠাতে শুরু করে! রাজী না হলেই বীভৎস মারধোর পড়তে থাকে। ক্রমে একেবারে অসহ্য হয়ে ওঠায় সে শেষ উপায় হিসাবে বাড়িতে দাদাকে ফোন করে যে সে ফিরে যেতে যায়! বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায় যে জানকী কলকাতায় কী কাজ করতে বাধ্য হয়েছে! একে বিধর্মীর সাথে বিবাহ, তারপর বেশ্যাবৃত্তি! যদি পাড়া প্রতিবেশী জানতে পারে তাহলে তো কোনদিন আর মুখ দেখাতে পারবে না তারা সমাজে! তাই জানকীর বাবা, আশিসকে বলে যে জানকীকে মেরে ফেলা ছাড়া তাঁদের আর উপায় নেই। জানকীর অনার কিলিং প্ল্যান করা হয়।

আশিস জানকীকে ফোনে ভরসা দেয় যে সে কলকাতা যাচ্ছে এবং তার আগে সুলতানের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। না শুনলে কলকাতা এসে জানকীকে নিয়ে চলে যাবে। জানকী সুলতানের নম্বর দেয়। আশিস ক্লায়েন্ট সেজে সুলতানকে ফোন করে এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে। সে ও তার এক বন্ধু কলকাতায় আসে। বন্ধুটি জানকীর ব্যর্থ প্রেমিক এবং জানকী এভাবে পালিয়ে আসায় তার মনে প্রতিহিংসা নেবার প্রবল ইচ্ছা ছিলো। জানকী ঘরে এলে দুই বন্ধু মিলে প্রথমে গলা টিপে জানকীকে মারে। তারপর আশিসের বন্ধুটি ছুরি দিয়ে দেহ ফালাফালা করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে! এদিকে সুলতান নীচে অপেক্ষা করে করে বহুক্ষণ পরেও যখন জানকী নামলো না আর তার ফোন পাওয়া গেলো না, তখন বিপদ বুঝে সাদিককে ফোন করে এবং সাদিক এসে সেই ঘরে গিয়ে এই কান্ড দেখে! হোটেলের কর্মচারীদের মধ্যে এ সব জানাজানি হলে খুব বিপদ! আর আশিসকে ছেড়ে দিলে সে যদি ধরা পড়ে তাহলেও সাদিকের মুশকিল। তাই সে কাউকে কিছু না বলে আশিসের সুটকেস থেকে সব বার করে সেখানে মৃতদেহ ডাম্প করে নিয়ে বেরিয়ে যায়। চৌভাগার দিকে কোথাও জলে ফেলে দেবে এমনি ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দুজন পুলিশ অফিসার পিছনে পড়ে যায়। সাদিক এ সব দিক খুব ভালো চিনতো । সে গাড়ি একজায়গায় দাঁড় করিয়ে ঘন ঘাস জঙ্গলের মধ্যে সঙ্গীদের নিয়ে লুকিয়ে পড়ে! ভেবেছিলো পুলিশ কাউকে না দেখতে পেয়ে রাতের মতো চলে যাবে। হয়তো পরদিন এসে গাড়িটার ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করবে! কিন্তু যখন শোনে যে টো-ট্রাকে গোটা গাড়িটাই নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে নবারুণ এবং ফোনে টো-ট্রাক আনার কথা বলছে, তখন সাদিকের আর কোন উপায় ছিলো না তাঁদের সরিয়ে দেওয়া ছাড়া। কারণ তখনো সে বডি ডিসপোস করতে পারেনি! নবারুণ ও সমীর মারা যাওয়ার পর সে জানকীর বডি জলে ফেলে এবং গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। সাদিক জানতো এই তিনটি ঘটনায় পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করবে এবং মিডিয়াও খুব সচেতন হয়ে পড়বে। তাই আশিস ও তার বন্ধুকে এবং গাড়িটিকে বাড়িতেই লুকিয়ে রাখে। সব ফোনও তারা বন্ধ রেখেছিলো।

কিন্তু অনিকেতের দেখার চোখের ও বুদ্ধির জন্যই তারা ধরা পড়লো। পুলিশের সাধ্য ছিলো না এই কেস সল্ভ করে। আশিসের বন্ধু একা দু-একদিন আগে ট্রেনে রাঁচি ফিরে গেছে। পুলিশের একটি দল তাকে ধরার জন্য রাঁচি রওনা হলো।

 

**** সমাপ্ত ****

অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার