প্রবন্ধ - জয়নগরের মোয়া, জয়নগরের জয়চণ্ডী - সমুদ্র বসু

জয়নগরের মোয়া, জয়নগরের জয়চণ্ডী
সমুদ্র বসু

 



 


জয়নগর। নামটা শুনলেই মনে পড়ে নাকি এক সুস্বাদু মিষ্টির? হ্যাঁ, জয়নগর মানেই মোয়া।
জয়নগরের মোয়া। মোয়ার জন্মস্থান এই গ্রামের ইতিহাসও মোটে হেলাফেলার নয়। রায়মঙ্গল কাব্যে উল্লেখ মেলে ‘বড়ুক্ষেত্রে’র। এই বড়ুক্ষেত্রই বহরু। উনিশ শতকের শুরুতে এই গ্রামের জমিদারি পান নন্দকুমার বসু। তিনি ঠিক করেন এই বহরুতেই মথুরা-বৃন্দাবন স্থাপন করবেন। সেই ইচ্ছে অনুযায়ী, বহরুতেই তৈরি হয় শ্যামসুন্দরের মন্দির। সেই মন্দিরের গায়ে দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী গঙ্গারাম ভাস্কর। এই বহরুতেই ছোটোবেলা কেটেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। আর, এসবের পাশাপাশি রত্নগর্ভা এই গ্রামই জন্ম
দিয়েছিল বাঙালির অতিপ্রিয় মোয়ার।

উনিশ শতক তখনও ফুরোয়নি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহরু গ্রামের যামিনীবুড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন। তাঁর নিজের খেতেই চাষ হত কনকচূড় ধান। সেই কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে নলেন গুড় মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে তিনি পরিবেশন করলেন একটা অনুষ্ঠানে। এমন জিনিস আগে কেউ খায়নি। ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। এভাবেই জন্ম নিল মোয়া। আজ্ঞে, জয়নগরে নয়। তবে, জয়নগর টাউনের মধ্যেই একটি গ্রাম পঞ্চায়েত, বহরুতে। শিয়ালদা থেকে রেললাইন বরাবর গেলে জয়নগরের ঠিক আগের স্টেশন এই বহরু।

যামিনীবুড়োর তৈরি সেই মোয়ায় অবশ্য খই আর নলেন গুড় ছাড়া উপকরণ বলতে আর কিছুই ছিল না। সেই মোয়াকে আজকের আদল দিলেন দুই বন্ধু জয়নগরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু আর নিত্যগোপাল সরকার। দুজনে মিলে ঠিক করলেন এই মোয়া তৈরি করে বিক্রি শুরু করবেন। এতদিন হাটুরে, চাষী, গেরস্তরা ইচ্ছে হলেই খই, গুড়ে মেখে মুখে পুরে দিতেন। এবারে শুরু হল সেই মোয়ারই বাণিজ্যিক উৎপাদন। মোয়াতে মিশল গাওয়া ঘি, খোয়া ক্ষীর। খই আর গুড়ের জুটিও আরো অন্তরঙ্গ হল। ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’ সেই শুরু হল মোয়ার ‘জয়নগর’ তকমার আড়ালে পথচলার শুরুয়াৎ। সালটা ১৯২৯।

এবার কালক্রমে জয়নগরের মোয়া এমনই বিখ্যাত হয়ে উঠল যে তার নামের ভারে ধামাচাপা পড়ে গেল জন্মদাত্রী বহরুর নাম। এই নব্বই বছরে জয়নগর-মজিলপুরেই গজিয়ে উঠেছে প্রায় আড়াইশোটি

2

মোয়ার দোকান। তবে, জয়নগর স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে বাসরাস্তার পাশে ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আজো দাঁড়িয়ে। আজো এই দোকানের খ্যাতি বুঁচকিবাবুর দোকান হিসেবেই। কিন্তু, শোনা যায়, স্বাদের খ্যাতিতে এই দোকানকেও এখন টেক্কা দিচ্ছে কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পঞ্চানন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বা রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মোয়া।

কোয়ালিটির ফারাকে মোয়ার দামেরও হেরফের হয়। দেড়শো টাকা কেজি থেকে দাম পৌঁছতে পারে  পাঁচশো-সাড়ে পাঁচশো টাকা কেজিতেও। এক-এক কেজিতে কুড়িটি করে মোয়া। খাঁটি জয়নগরের মোয়ার ক্ষেত্রে খই আর গুড়ের রসায়নটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়। খই মানে কনকচূড়। বাংলায় মরিশাল নামে আরেক রকমের খইয়ের ধানও চাষ হয়। স্বাদে, গন্ধে কনকচূড়ের থেকে ঢের পিছিয়ে এই ধান। অথচ, কলকাতা ও শহরতলির বাজারে ‘জয়নগরের মোয়া’ তকমার আড়ালে গিজগিজ করছে এই মরিশাল খইয়েরই মোয়া। একইসঙ্গে, আসল নলেন গুড় পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে এখন। উৎকৃষ্ট মোয়ার জন্য প্রয়োজন খাঁটি নলেন গুড়। জিরেন খেজুর কাঠ থেকে রস সংগ্রহ করে শিউলিরা (যাঁরা খেজুর রস
সংগ্রহ করেন) রেখে দেন তিন দিন। তারপর, সেই রস সামান্য আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়। এই নলেন গুড় আর কনকচূড়ের গুণমানে খামতি হলে প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম রং, ফ্লেভারের। যাঁরা রসিক, তাঁদের জিভ দিব্যি ধরতে পারে সেই ‘নকল’ স্বাদ। অতএব, আসল মোয়া চাখতে গাঁটের কড়ি ফেলতেই হবে। সেই জন্যেই কেজি প্রতি মোয়ার দাম পাঁচশোও ছাপিয়ে যায় হরবখত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলপি-কাকদ্বীপ-নামখানায় ৪০০ বিঘার বেশি জমিতে আজো চাষ হয় কনকচূড় ধান। জিরেন কাঠের খেজুর রস অবশ্য দুর্লভতর হচ্ছে দিন-দিন।

হেমন্ত শেষ হতে না হতেই মোয়া তৈরির মরসুম শুরু হয়ে যায় জয়নগর-মজিলপুর-বহরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। অসংখ্য পরিবারের সারা বছরের রোজগার এই কয়েক মাসের মোয়া তৈরি ও বিক্রি থেকেই উঠে আসে। মোয়াতে নলেন গুড়, খইয়ের সঙ্গে মেশে গাওয়া ঘি, এলাচ, পেস্তা, খোয়া ক্ষীর। ওপরে কিসমিস, কাজু। ঘি, পেস্তা, ক্ষীরের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে দামের হেরফের ঘটে। চাহিদা বাড়লেও দাম ঊর্দ্ধমুখী হয় মাঝেমাঝেই।

জয়নগরের মোয়ার আধিপত্যে কীভাবে যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে মোয়ার আবিষ্কর্তা যামিনীবুড়োর গ্রাম বহরু। যদিও, বহরুর মোয়া স্বাদে কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই জয়নগরের মোয়ার থেকে। বহরু বাজারের ওপরেই ‘শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ মোয়া তো বিখ্যাত। প্রায় একই উপাদান, কিন্তু জয়নগরের মোয়ার থেকে বহরুর মোয়া যেন কিঞ্চিৎ নরম। জয়নগরের মোয়ায়
ক্ষীরের আধিক্য সামান্য বেশি, আর বহরুর মোয়ায় গুড়ের। স্বাদের বিচারে কে সেরা— তা নিয়ে অবশ্য রসিকদের মধ্যে বিবাদের শেষ নেই।

3


স্বাদে পিছিয়ে না থাকলেও খ্যাতিতে বহরুর মোয়া ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি জয়নগরের। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, বহরুও বৃহত্তর জয়নগরেরই অংশ। সেই যুক্তিতে বহরুর মোয়াও জয়নগরের মোয়া। বহরুর মোয়া-বিক্রেতা-নির্মাতারা এই কথা মোটেও মানতে চান না। খ্যাতিতে পিছিয়ে থাকলেও আলাদা অস্তিত্বের এই গৌরব তাঁরা ছাড়তে রাজি নন।

১৮৫৫ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকে ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও স্বদেশপ্রেমের ডাকে যখন সবে একটু একটু করে স্বায়ত্বশাসনের দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সেই তখন থেকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত সমৃদ্ধশালী নগরী জয়নগর-মজিলপুর ও সেখানকার কৃতি সন্তানরা এঁকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিতে ধ্রুবতারার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে অবস্থান করে। স্বায়ত্বশাসনের অধিকার ছিনিয়ে আনার প্রস্তুতিপর্বে ১৮৬৫ সালে প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ বিদ্যাসাগরের সভাপতিত্বে প্রথম তৈরি হল জয়নগর টাউন কমিটি। সেই কমিটি গঠনের মাত্র চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে ১লা
এপ্রিল তা জয়নগর পৌরসভা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যা দক্ষিণ ২৪ পরগণাসহ সারা বাংলার প্রাচীন পুরসভাগুলির মধ্যে অন্যতম।

একসময় এই জয়নগর ও মজিলপুরের বুক চিরে প্রবল ধারায় প্রবাহিত হয়ে যেত আদিগঙ্গার ধারা যা আজ মৃতপ্রায় এবং মানুষ তাঁকে অধিগ্রহণ করে নিয়ে মিত্রগঙ্গা, ঘোষগঙ্গা, বোসগঙ্গা নাম দিয়ে পুকুরের ন্যায় প্রতিপালন করছেন। কিন্তু, কোন সভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা কতখানি তা ইতিহাসে হরপ্পা, মহেঞ্জাদারো, সিন্ধু-গাঙ্গেয় সভ্যতা দেখলে বোঝা যায়। অপরদিকে আমরা
পুরাণে খুঁজলে দেখি সত্যযুগে নারায়ণ ক্ষীরোদসাগরের তীরে, ত্রেতায় রামচন্দ্র সরযু নদীর তীরে, দ্বাপরে কৃষ্ণ যমুনার কুলে, কলিতে জগন্নাথ সাগরপারে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ভাগীরথী গঙ্গার ঘাটে অবস্থান করে তাঁদের লীলা সম্পন্ন করেন। তাছাড়া কাশী, বারানসি, হরিদ্বার, পুরীধামের অবস্থান এই নদীমাতৃক সভ্যতার পক্ষে সওয়াল করেছে। ঠিক তেমনি আজ থেকে ২৪৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৭৫ সালের আগে পর্যন্ত এই স্থানে গঙ্গার মাহাত্ম্য বিদ্যমান ছিল এবং অবিভক্ত বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার সমৃদ্ধস্থান ছিল এই জয়নগর। মজিলপুর তার অনেক পরে সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে গঙ্গার মজে যাওয়া বক্ষে বাসস্থান গড়ে তোলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যশোরের চন্দ্রকেতু দত্ত ও তাঁদের কুলগুরু শ্রীকৃষ্ণ উদ্‌গাতা ছিলেন।

মজার বিষয় ১৭৭৫ সালে যখন মুর্শিদকুলি খাঁ বেতরের কাছে খাল কেটে গঙ্গার মূল ধারা ঘুরিয়ে সরস্বতী নদীর মরা খাত দিয়ে বজবজ, রায়চক, ফলতা, ডায়মণ্ডহারবারের পাশ দিয়ে সাগরের মুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে মেশায় তখন থেকে আদিগঙ্গার মৃত্যু ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।

4

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য আদিগঙ্গার তীর ধরে চক্রতীর্থ ভ্রমণ করে জয়নগর হয়ে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে গমন করেন। এই স্থানের পণ্ডিত মানুষদের তর্কশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের কারণে একে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হত। ঘটনাচক্রে, এই জলপথে আগত বিদেশী মগ, পর্তুগীজ, ফরাসী জলদস্যুরা প্রায়শই জয়নগরে লুট সন্ত্রাস চালাত এবং নিকটবর্তী জঙ্গলে ঢেকে থাকা মগরাহাট এলাকায় লুকিয়ে থাকত। কথিত আছে এই মগ দস্যুদের নামানুসারে মগরাহাটের নামকরণ হয়েছে।

এই জয়নগরের রাজা নীলকণ্ঠ মতিলাল করদ রাজা হিসাবে রাজা সুবুদ্ধিরায়ের রায়নগর রাজ্য তথা রায়মঙ্গল ঠেকে সূর্যপুর ও পশ্চিমে সরস্বতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এলাকার কিছু অংশ শাসন করতেন। এক হাজার এক সালে যখন সমগ্র জয়নগর ভেসে যায়, রায়নগর রাজ্যের অধিকাংশ জনশুন্য হয়ে পড়ে। নীলকণ্ঠ মতিলাল মগধের যুদ্ধে প্রাণ হারালে তার ভাই সপরিবারে যশোরে চলে যান,
কিন্তু কয়েক পুরুষ পরেই ঐ বংশের সুপুত্র গুনানন্দ মতিলাল পৈতৃক সম্পত্তি ও কুলদেবী জয়চন্ডী দেবীকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের সাথে সাথে সেই মূর্তির পাশে দারুকাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত নতুন মূর্তি রচনা করা হয়। সেই থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১০১৮ বছর পূর্ব থেকে এই দেবী পূজিত হয়ে আসছেন। এই দেবীর নামে জয়নগরের নামকরণ বলে মনে করা হয়। এই দেবীর প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে একপক্ষকালব্যাপী রূপপরিবর্তনের মেলা ও পূজা হয়ে আসছে। এই
জয়চন্ডী দেবীই যে জয়নগরের নামের সুত্রপাত সেটার ইতিহাস ব্যক্ত করতে হবে। অনেকে জয়নগরে বসবাস করছেন কিন্তু এই ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
এই জয়নগরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বৈষ্ণব ও শাক্তদের নানা দর্শনীয় স্থান যার মধ্যে রয়েছে ময়দা গ্রামে অবস্থিত ত্রেতা যুগে ময়দানব পূজিত পাতালভেদী ময়দানবেশ্বরী কালীবাড়ি, জয়নগরের চিকিৎসা প্রসিদ্ধ ধন্বন্তরী কালী, রাধাবল্লভজীউ মন্দির, শ্যামসুন্দর জীউ মন্দির, মহাপ্রভু জীউ মন্দির, জগন্নাথবাটী ধাম ইত্যাদি। তবে সে সব গল্প করতে আরো খানিক সময়
লাগবে। আপাতত পুজো শেষে শীতকাল এলে জয়নগরের মোয়া খাওয়ার সময় তার ইতিহাসটুকু যদি কবার মনে করা হয় তাতেই সার্থক হবে এই জায়গার মাহাত্ম্য।

কৃতজ্ঞতা- সনৎকুমার পুরকায়েত, অনিতেশ চক্রবর্তী

........................