কাক
রুমি বন্দ্যোপাধ্যায়
কাক
দুটো কোথা থেকে এসে জুটেছে কে জানে? গাগুলোতে ঐ তিতকুটে কালোটা আরেক পরত
বেশি চড়ানো। ওদের যেন অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেও নেই, কোন কাজকর্মও নেই।
শ্যাওলা পড়া কুয়োর পাশে হিলহিলে দুটো উচ্ছে গাছের মাচা করা আছে, সেখানেই
বসে থাকে। অঞ্জু এঁটো বাসন মাজার সময় রোজ ওদের দেখতে পায়।
অঞ্জুদের
বাড়িতে মাছ-মাংস কালেভদ্রে আসে। এলেও ছেলে-মেয়ে দুটো হাড়মাস পর্যন্ত
চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। ল্যাজার দিকের মাছ সস্তায় পায়। মাছওয়ালা বঙ্কু
অঞ্জুর বর বিনয়ের চেনা। আগে বটতলা বাজারে পাশাপাশি দুজনে বসত।মাটিতে নীল
প্লাস্টিক পেতে সবজি বিক্রি করত। এখন বছর তিনেক হল বিনয় জয়পুরে। সাত/সাত
এর একটা ছোট্ট খুপরিতে থাকে। জরি, চুমকি, পাথর শাড়িতে সেলাই করে বসায়।
জারদৌসি শাড়ির কারিগর, ওদের ওখানে মেয়েরা সবসময় এইরকম ঝলমলে শাড়ি পরে
।বিনয় নীল রঙের একটা জারদৌসি শাড়ি এনে দিয়েছিল একবার বউএর জন্য। দেখে
মনে হয় শাড়িটা মাঝরাতের আকাশ, তারায় ভরা। গায়ে দিলে এত চকমক করে যে
লজ্জায় কোনদিন পরতেই পারেনি ও। সেটা সেকেন্ডহ্যান্ডে কেনা আলমারিটাতেই
তোলা থাকে উপরের তাকে, কোণ ঘেঁষে। দুটো ন্যাপথলিনের বল ঢোকানো আছে ভেতরে।
ল্যাজার
লম্বা কাঁটাটার দিকে তাকিয়ে অঞ্জু হতাশ হয়। এতোটুকু মাছের নরম শরীর লেগে
নেই ওখানে যে কাকদুটো ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তাও কিসের জন্য যে ওগুলো অন্য
কোথাও যায় না! অঞ্জু খ্যাসখেসে গলা নিয়ে ওদের 'হুস হুস' করে তাড়ায়,
আবার কখনও শুকিয়ে যাওয়া ডাল মাখা ভাত ছিটিয়ে দেয়।
অঞ্জু
যে সময় বাসন মাজে সেই সময় পাশের ঘরের চন্দনের বউ মুনিয়া দাঁতে গুড়াকু
ঘষে চৌকাঠে বসে। বিলাসপুরে ওদের জমি-জিরেত আছে। মাথাভর্তি কমলা সিঁদুর ওর
মুখে খানিকটা কমলা রঙের আভা নিয়ে আসে। শাড়িটা ইচ্ছে করেই হাঁটু অবধি
তুলে ডালিম রঙা পায়ের গোছ দেখায়। ঠিক কাকে দেখায় কে জানে? তবে ও এলেই
আসে পাশের ঘরের ছেলে ছোকরাদের কলতলায় যাওয়ার তাড়া বেড়ে যায়। মুনিয়াও
বলছিল
------ওই কাউয়া দুটো তুমি পুষেছো নাকি ভাবী? আমি কত ডাকি, ঘি মাখানো রুটি, ছাতু মাখা দিই তাও এদিকে আসে না।
মনে
মনে হাসে অঞ্জু। ভাবে যত অভাগা তার কপালেই জুটেছে। হাসপাতাল থেকে যাকে
নিয়ে এসেছে সেও কী কম অভাগী? মেয়েটার চোখে জন্ম কাজল পরানো, জ্যৈষ্ঠের
নির্দয়, খটখটে, চৌচির উঠোনে আঁজলা ভরে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দেয় ঐ মুখ।
এত্তটুকুন হাঁ, হাই তোলার সময় দেখা যায়। পাখির বাচ্চার মত ভেতরটা
টুকটুকে লাল। হাসপাতালে যখন প্রথম দেখল অঞ্জু আশার মেয়েকে তখন গায়ে
গর্ভের আঠা লেগে আছে। আশা তার নিজের মায়ের পেটের বোন। মা-বাপ অবশ্য মরে
গেছে কবে, বাপের বাড়ির সম্পর্ক বলতে ছিল ওই ছোট বোনটা।
কাছেই
একটা ফ্যাক্টরিতে মাছ কাটার কাজ করত আশা। মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলায় চায়ের
জল ফুটতে দিয়ে যখন সিরিয়াল দেখতে বসত অঞ্জু তখন পিছন থেকে এসে কানামাছির
রুমালের মতো হাত দুটো চোখের ওপর খপাৎ করে চেপে ধরত। গা থেকে সব সময় বিটকেল
মাছের গন্ধ বেরোতো ওর। ওই গন্ধেই ওকে চেনা যেত। তাও যে কেন ছেলেমানুষি
খেলা খেলত! বিরক্ত হয়ে অঞ্জু বলত
-----ইস ম্যাগো, যা
সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে আয়। কি করে থাকিস এই গন্ধে সারাক্ষণ। তুই
তো ছোটবেলায় ঘেন্নায় মাছ-মাংস ছুঁতিস না।
আশা হেসে বলতো
------অভ্যেস রে দিদি , অভ্যেস। আগে আমারও গা গোলাতো, এখন আর কিছু মনে হয় না।
গায়ে
আঁশটে গন্ধ নিয়েও বুকের ভিতরে যে তার একটা ওডিকোলন মাখানো স্বপ্ন ভুরভুর
করত সেটা অঞ্জু জানত। যবে থেকে বুঝেছিল জরায়ুর নরম বিছানায় প্রাণের
ধুকপুকানি শোনা যাচ্ছে তবে থেকেই সেই স্বপ্নের শুরু।
-----দেখিস দিদি আমার মেয়েই হবে। আর মেয়ে হলে আমি রাজকন্যার মত বড় করব।
অঞ্জু বলত
-----তোরা
দুজনেই যা খরচে। যা রোজগার করিস তার থেকে বেশি উড়িয়ে দিস। তা না হলে কেউ
'ওলা' করে চিড়িয়াখানা বেড়াতে যায়, না দুদিন ছুটি পেতে না পেতেই ধেই
ধেই করে মন্দারমনি ঘুরতে যায়?
------নারে এবার সব ছেড়ে দেবো।রাজাও বলেছে এখন থেকে টাকা জমাতে হবে। পোস্ট অফিসে কত সুদ দেয় রে দিদি?
দিদির
কাছে এসেই গত তিন মাস ধরে দুহাজার টাকা জমা করে যেত। ওর কাছে রাখলে নাকি
খরচ হয়ে যাবে। টাকাপয়সা চুলকাতো ওর গায়ে। অঞ্জু সেই টাকাটা একটা পুরনো
রেক্সিনের পার্সে জমিয়ে রাখত।
পাঁচ মাসেই পেটটা বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল আশার। তাই নিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে আসত। অঞ্জু বলত
------সাবধানে চলাফেরা কর, প্রথম বাচ্চা সারাক্ষণ এত খলবল করিস কেন? পা ছড়িয়ে বসত মেঝেতে আশা
-------হারানদার
দোকানের পাশে যে নতুন বেডিং স্টোর হয়েছে সেখানে একটা দোলনা দেখে এসেছি
দিদি! ভেতরের বিছানাটা কি তুলতুলে রে। হাত দিলে দুই আঙুল ডুবে যায়। আমাদের
এই শক্ত তক্তপোশে শোয়াব না আমার মেয়েকে। আমাকে দু হাজার টাকা দে না
দিদি। কিনে আনি ওটা।
--------একদম না। বাচ্চা হওয়ার আগে ওর নাম করে কিছু কিনতে নেই জানিস না। আগে জন্মাক তারপর দেখা যাবে।
সেই
রাজকন্যা জন্মাবার ঠিক এক সপ্তাহ আগে অলপ্পেয়ে অতিমারিতে অঞ্জুর বর
মারা গেল। ডেলিভারি ডেটের দিন পাঁচেক বাকি থাকতেই গায়ে জ্বর নিয়ে
হাসপাতালে ভর্তি হল আশা। বাচ্চাটা হওয়ার পর একবারও বুকে ছোঁয়াতে পারল না
নরম শরীরটাকে মেয়েটা। দূর থেকেই দেখেছিল কেবল। কি একটা বলতে চায়ছিল ক্ষীণ
গলায়... অঞ্জুও হাঁকপাঁক করছিল শোনার জন্য কিন্তু এলাচের খোসার মতো
বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঠোঁটগুলোর কষ বেয়ে আকুতি ছাড়া আর কিছু গড়িয়ে পড়েনি
সেদিন। হাসপাতালে দশ দিন ছিল আশার মেয়ে তারপর সব নথিপত্র জমা দিয়ে ওকে
নিয়ে এসেছে অঞ্জু, একমাত্র কাছের আত্মীয়া।
-----আমাদের
ঘরে আর কি পাবে? তার থেকে হাসপাতালে রেখে দিলে ওরাই কোন অনাথ আশ্রমের
ব্যবস্থা করতো। হয়তো কোন ভালো পরিবার থেকে ওকে দত্তক নিত কেউ। তাছাড়া
সরকারও তো শুনছি এসব বাপ মা হারা বাচ্চাদের টাকা পয়সাও দেবে বলেছে। তুমি
এই ঝামেলা সামলাতে পারবে?
ফোনে বলেছিল বিনয়,সপ্তাহে দুদিন ফোন করে নিয়মমাফিক।
কথাটা
যে অঞ্জুর মনে আসেনি তা নয় কিন্তু যতবার ভেবেছে একটা বিসর্জনের বাজনা
বেজে উঠেছে আর বুকটা চন্দনপুকুর হয়ে গেছে। চন্দনপুকুরে ডোবানো হত ওদের
পাড়ার প্রতিমা। অঞ্জু, আশা দুই বোন হাত ধরাধরি করে দেখতে যেত। পুকুরের
চারদিকে বড় বড় হ্যালোজেন লাইট লাগানো হত। খুব ভিড় হত। তাই দুজন দুজনকে
শক্ত করে ধরে রাখত। বিসর্জনের পরের দিন ওই পুকুরে ভেসে উঠত শোলার মুকুট,
খড়ের কাঠামো, গাঁদার মালা। শ্মশান মনে হত।লোকালয়ের মাঝেই দুপুরবেলায় লি
লি করত বিসর্জনের পরের দিনের চন্দনপুকুর।
আশার
মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসায় সব থেকে বেশী চটেছে অঞ্জুর নিজের মেয়ে
বাবলি। স্কুলে পড়লে এবছর মাধ্যমিক দিত। কিন্তু লেখাপড়া তার মাথায় ঢুকল
না। বস্তির উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েগুলোর সাথে চোখে মুখের রঙ মেখে টিক্-টক্
ভিডিও বানাতে শুরু করেছিল তাই একরকম জোর করেই একটা সেলাইয়ের স্কুলে ভর্তি
করে দিয়েছে অঞ্জু। মজুমদারের বাড়ি থেকে ওদের মেজ বউ দেখতে এসেছিল আশার
মেয়েকে। দীক্ষা নেওয়া আছে বলে ওই বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজোর ভোগ রাঁধতে
ডাকত ওকে, অনেক সময় আশাকেও নিয়ে গেছে। চারখানা সুতির পুরনো শাড়ি দিয়ে
গেছে। নামেই পুরনো, বড়লোকদের আর কোন শাড়িই বা পুরোনো হয়। তারমধ্যে
বেগুনি রঙের একখানা শাড়ি খুব পছন্দ হয়েছিল বাবলির।
-------আমাকে
ওটা দাও না , কুর্তি বানাবো। হাত কাটা, ডিপ নেক। ওটাই বেশি চলছে এখন।
নেকটা সাড়ে সাত নেব । ভি গলা, বুকের ঠিক খাঁজের কাছে এসে আবার উঠে যাবে
লাইনটা । এমনভাবে কাটব না, সেলাই এর দিদিমণি হাঁ হয়ে যাবে। নিখুঁত করতে
হবে ফিটিংসটা। সবার ফিগারে মানায় না , আমাকে হেব্বি লাগবে। দাওনা... দাওনা
দেখাব তোমায় কেমন শিখলাম।
তাও
দেয়নি অঞ্জু। তিন খানা শাড়ি কেটে কুটে কাঁথা বানিয়েছে মাঝখান দিয়ে ছোট
ছোট রান সেলাই দিয়ে। আর বেগুনিটার একটা দিক বেঁধেছে মরচে পড়া গ্রিলে আর
একটা দিক ঘুণ পোকা লাগা আলনায়। তৈরি হয়েছে দোলনা। বাচ্চাটার কোন জ্বালা
নেই। পেটভরা থাকলেই হাত-পা নেড়ে খেলা করে। যেন বুঝে গেছে এ সংসারে থাকতে
গেলে জ্বালাতন করা চলবে না, সবার মেজাজ বুঝে চলতে হবে।
কিন্তু
সে রাতে কি হয়েছিল কে জানে কান্না কিছুতেই থামছিল না। মাঝরাতে ওমন
কান্নার চোটে বাবলি আর বিল্টু তো রেগেই অস্থির। অঞ্জুও নাজেহাল। হাত মুঠো
করে সেকি চিল চিৎকার! বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এত ঘন সেই বৃষ্টি যে
মজুমদারদের সবুজ রঙের চারতলা বাড়ি, তিনখানা বড় সুপারি গাছ কিছুই আর ঠাহর
করা যাচ্ছিল না। বুকের ওমে জড়িয়ে নিয়েছিল শিশুটাকে অঞ্জু ,বড় অসহায়
লাগছিল ওর নিজেকে। হঠাৎ চোখ যায় বাইরে। শিরশির করে গায়ে পদ্মকাঁটা ওঠে,
শীতল স্রোত সাঁতার কেটে নেমে যায় শরীর জুড়ে, দেখে ডানা মেলে উড়ে এসে ঐ
দুটো কাক চুপচাপ গ্রিলের পাশে এসে বসল।
ওদের
গা থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। এলোপাথাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে ঝুপ দুটোই।
কিন্তু একবারও চেষ্টা করছে না ডানা ঝাপটে সে জল ঝেরে ফেলতে বরং দুজনেই বড়
উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে আছে বাচ্চাটার দিকে। ঠিক অবলা প্রাণীর দৃষ্টি নয়
সেটা, সে দৃষ্টি কথা বলে। কালো কষ্টি পাথরের মতো চোখ দুটোতে যেন জলের ফোঁটা
ধরানো। কারা ওরা! শুধুই কি দুটো কাক? তবে ওরা এসে বসতেই আশার মেয়ে এমন
চুপ করে গেল কেন? কাপাস ফাঁটা নরম সুতলির মত এক চিলতে হাসি যেন ফুটে উঠল
শিশুটার মুখে। যেন এতক্ষন ধরে যার জন্য বায়না করছিল সে জিনিসটা হাতের
কাছে পেয়ে গেছে! মেয়েটা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত উড়ে গেল না কাকদুটো।
অঞ্জু আর ঘুমোতে পারল না। শেষ রাতে ওদের উড়ে যাওয়া পথটুকুর দিকে তাকিয়ে আচমকা ডুকরে উঠল।
....................................
অলঙ্করণ :- পায়েল খান