শুভ্রা রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শুভ্রা রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

অপরাহ্নের মিঠে আলো - শুভ্রা রায়

  অপরাহ্নের মিঠে আলো 

শুভ্রা রায় 



    ধীরাজ পার্টিতে কাউকে না জানিয়ে চারতলায় চলে এলেন । ধীরাজের মামাতুতো বোন সুমি তার মেয়ের বিয়েতে যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিল তারই চারতলায় আমন্ত্রিতদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন  । সাজসজ্জা করে আত্মীয়রা অনেক আগেই নিচে নেমে গেছে ,  এখন সবাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে আর গার্ডেনে বিয়েবাড়ি অনুষ্টানে ব্যস্ত । অনুষ্টান সম্পূর্ণ রূপে শেষ না হলে কেউ আর উপরে উঠে আসবে না । ধীরাজ চারতলার বারান্দায় এসে যেন হাঁপাছেন । চেহারার ভাব উদভ্রান্ত । মনে হচ্ছে ভিতরে ভিতরে যেন চুরমার হয়ে গেছেন । সমুদ্রতট থেকে উড়ে আসা বালুকারাশি বহুদূরে নিজ স্বীয় অবস্থান গড়ে তুলেছিল এতদিন , জানত যেন সামুদ্রিক কম্পনে সৃষ্ট প্রকাণ্ড জলরাশি ছাড়া এখানে ঢেউ আছড়ে পড়া অসম্ভব । আজ এই মুহুর্তে শুকনো বালুকা রাশিতে এক অজানা সুনামি আছড়ে পড়েছে । আর তারি সাথে ধীরাজের অতীত তোলপাড় করে তুলেছে  । ধীরাজ উদভ্রান্তের মতো দুবার পাক দিয়ে বারান্দায় রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন । অন্যমনস্ক ভাবে পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়ে সিগারেট আর লাইটার বের করে ধরাতে যাবেন ঠোঁট থেকে সিগারেট মাটিতে পড়ে যায় । ঠোঁট কাঁপছে কপালের শিরা ফুলে উঠেছে , তড়িৎ গতিতে ধমণীর জালিকা সমূহে রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক স্রোতকে অগ্রাহ্য করে দূর্বার গতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে । এমতবস্থায়   কোন নারী থাকলে এতক্ষণে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন । কিন্তু পুরুষের চোখের জল আসতে নেই । রাগ ক্ষোভ অপমানের দংশন যতই তীব্র হোক না কেন চোখে জল আসতে নেই । প্রিয় হারানোর ব্যাথায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে নেই । কিন্তু এই সীলমোহর মিথ্যা বৈ সত্য নয় । কারণ পুরুষেরও কান্না আসে । গলার কাছে আটকে থাকা জমাট বাঁধা কান্না অচিরে বেরিয়ে আসতে চায় । তাদেরও চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় । পুরুষের হৃদয়ের শত টুকরোতে অশ্রুজলের প্লাবন আসতেই পারে । ধীরাজ চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে বাঁহাতে কপালটা ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকেন .....। কখন যে গুটি গুটি পায়ে সুজাতা চারতলায় উঠে এসেছে ধীরাজ বুঝতেই পারেননি । সুজাতা ধীরাজের পিঠে হাত দিতেই ধীরাজ মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখেন পিছনে সুজাতা দাঁড়িয়ে । অবোধ শিশুর মতো একপলক দেখে সুজাতার হাত ধরে টেনে নিজের সম্মুখে দাঁড় করান । মুহুর্তের মধ্যে দুহাত দিয়ে সুজাতার কোমর জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন । এ পুরুষ কণ্ঠের কান্না না অবোধ শিশুর মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কান্না ! সুজাতা বিস্মিত ! বাকরুদ্ধ । সুজাতা নিশ্চুপ । ধীরাজের মানষিক অবস্থানের তোলপাড় কতটা অসহনীয় তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না । সুজাতা আসতে আসতে ধীরাজের মাথায় হাত বোলায় । একসময় ধীরাজের কান্না থামে তবুও সুজাতা হাত দিয়ে ধীরাজের মাথাটা নিজের বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে থাকে । এই বেষ্টনীর রেশ কাটাতে চায় না যেন সুজাতা । তার চোদ্দবছরের বিবাহিত জীবনে এই দ্বিতীয়বার ধীরাজ সুজাতাকে এমন আন্তরিক ভাবে জড়িয়ে ধরেছে । এই স্পর্শ পাবার আকাঙ্খায় সুজাতা কত বিনিদ্র রাত জেগেছে । কিন্তু ধীরাজ তার অতীতকে ভুলে সুজাতার রাত জাগা রাত্রের খোঁজ নেয়নি কখনই । কিন্তু সুজাতা সবই খোঁজ রাখে । তাই সে জিজ্ঞাসা করে --- ' কষ্ট তো তুমি আগেও পেয়েছো ধীরাজ । আজ কি এমন হলো যে তুমি নিজের কাছে নিজেই দূর্বল হয়ে গেলে ? চোখের জল আজ বাঁধা মানলো না ? ' 

--- ' সুজাতা '......আবার নিশ্চুপ ধীরাজ ...

---' আমাকে বলতে মন না চাইলে , তবে থাক ধীরাজ তোমাকে বলতে হবে না । '

--- ' না না তা নয় , জানো সুজাতা , আমাকে সুমি ওর মেয়ের নতুন শ্বশুর শাশুড়ির  সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে । তুমি জানো রীতিকার  শাশুড়ি  কে ?  সাতাশটা বছর আমি যার প্রতীক্ষায় এক একটা দিন গুনেছি । প্রতিনিয়ত ভেবেছি একদিন না একদিন আমি অর্পিতাকে খুঁজে পাবোই । এই আশা নিয়ে সাতাশটা বছর কাটিয়ে দিলাম । অর্পিতাই হচ্ছে রীতিকার  নতুন শাশুড়ি  । আর আমার প্রাণের বন্ধু নির্মলেন্দু কিনা অর্পিতার স্বামী  ! এত বড় ষড়যন্ত্র ছিল আমি টের পাইনি । আমার জমানো সমস্ত অর্থ তুলে দিয়ে ছিলাম নির্মলেন্দুর হাতে --- আমাকে বলেছিল খুব টাকার দরকার , পরে দিয়ে দেবে , বিয়ে করে বাইরে সেটেল হবে । তক্ষুনি বিয়ে না করলে নির্মলেন্দুর প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করবে প্রেমিকার বাবা । যা জমিয়ে ছিলাম নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবই মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম   নির্মলেন্দুর ঠিকানায় । তখনও একবারের জন্য আন্দাজ করতে পারিনি ও আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে । ইনফ্যাক্ট এই সাতাশটা বছরেও জানতে পারিনি । সুজাতা , অর্পিতা কেন এমন করেছিলো বলোতো ? ' 
#####

    সুজাতা সব শোনার পরও নিস্তব্ধ । গলার কাছে কিছু যেন আটকে আছে গিলতে খুব কষ্ট হচ্ছে । ধীরাজকে হারানোর ভয় সব সময় তার মধ্যে ছিল । কিন্তু সুজাতা এও জানতো ধীরাজের অস্তিত্বটুকু সে পেয়েছে । সার্বিক সত্বা   বহুকাল আগেই অর্পিতাকে  সমর্পণ করেছিল ধীরাজ  । না ... না , অর্পিতাকে সে মিছিমিছি দোষ দিচ্ছে । অর্পিতাতো কোনও  দিনও খেয়াল রাখেনি ধীরাজের মনের চাওয়া পাওয়াকে  । তাহলে অর্পিতাকে ভয় কিসের ? বরং ধীরাজ এত বছর ধরে কষ্ট পেয়ে এসেছে তাকে সাহায্য করা সুজাতা মনে করে এটা তার পরম কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে , কারণ এই ধীরাজের জন্য সে আজ সমাজের বুকে মাথা তুলে বেঁচে আছে । চৌদ্দবছর  আগে আজও  সেই ভয়ংকর অতীতের   অসহনীয় দিনটার কথা ভাবলে সুজাতা ভয়ে কুঁকড়ে যায় ।....... সেদিন সুজাতা অর্ডারের ব্লাউজ গুলো দোকানে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিল , শীতের সন্ধ্যা অনেকটা ঘন হয়ে এসেছিলো । অন্ধকার গলি পথে দ্রুত হাঁটা শুরু করে । বাজারের শেষে সাইকেল সারানোর দোকানটায় বেশ জটলা , হাসি ঠাট্টার ফোয়ারা চলছিল । সকালে এই দোকানে সাইকেল রিক্সা সারাই হয় । তারপর সন্ধ্যা নামলে ওই দোকানে দেশীয় মদের  বিলি বন্টনের ব্যবস্থা চলে । দোকানের কাছে আসতেই সুজাতা আরো দ্রুত হাঁটা শুরু করে , প্রায় দৌড়ানো । কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না । পিছন থেকে ধাওয়া করে সুজাতাকে ওরা ধরে ফ্যালে , টেনে নিয়ে যায় কূলতলির রেললাইনের ধারে । সারারাত ধরে চলে নরপশুদের অকথ্য অত্যাচার । ফূর্তির রেশ কাটতেই প্রায় মৃত রক্তাক্ত দেহটা ট্রেন লাইনে ফেলে যায় । যাতে ট্রেনের তলায় বাকি প্রাণটার ভবলীলা সাঙ্গ হয় । কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস সুজাতা বেঁচে যায় । অদৃষ্টের করুণা কোন ভাবেই বলা যায় না , যদি বাঁচানোর থাকতো তাহলে আগেই কেন বাঁচালেন না ঈশ্বর ? হয়তো ঈশ্বরের অনুসন্ধিৎসা ছিল অন্য রকম । হয়তো সুজাতার ভাগ্য অন্য ভাবে লিখে ছিলেন ।

    গতকাল ধীরাজ কূলতলিতে এসেছিলেন বন্ধুর বিয়েতে । কলকাতা ফেরার শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হন মফস্বলে রাত কাটাতে । ধীরাজ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে স্টেশানে দিকে পা বাড়ান । বাড়িতে বৃদ্ধা মা একা , তাই ভোরের প্রথম ট্রেন ধরতে সর্টকাট পথে স্টেশানে পৌঁছানোর জন্য ধীরাজ ট্রেন লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করেন ।ধীরাজ হন্তদন্ত হাঁটছেন হঠাৎ ই দূর থেকে দেখতে পান ট্রেন লাইনে কেউ পড়ে আছে । কাছে আসতেই দ্যাখে রক্তাক্ত উলঙ্গ এক নারীর দেহ । দেখেই গা শিউরে উঠে ছিল ধীরাজের । সারা গায়ে অজস্র আঁচড়ানো কামড়ানোর চিহ্ন । যোনি পথ রক্তে ভেসে যাচ্ছে । তাতে মাছি উড়ছে । ধীরাজ পালস ধরে দ্যাখেন খুব ক্ষীণ সাড়া আছে । ধীরাজ দ্রুত নিজের পরনের পাঞ্জাবীটা খুলে মেয়েটির লজ্জাকে আড়াল করেন । তারপর প্রায়মৃত দেহটাকে কাঁধে ফেলে রেললাইন দিয়ে হেঁটে স্টেশনে আসেন । স্টেশানে এসে লোকজনদের সহায়তায় সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন । প্রায় এক সপ্তাহ যমে মানুষে টানাটানি তারপর সুজাতা চোখ খোলে । চোখ খুললেও নিদারুণ যন্ত্রণার কথা মুখে আনতে ভয় কুঁকড়ে ওঠে সে । পাপিষ্ঠগুলো সংখ্যায় এতো ছিল যে সঠিক কতজন বলতে পর্যন্ত পারেনি সুজাতা । তবুও যেটুকু পুলিস জানতে পেরেছে পূর্ণ তদন্ত শুরু হয়েছে । চার পাঁচটা মাথা অবিলম্বে খুঁজে পেয়েছে , বাকি গুলো ফেরার হলেও খোঁজা অব্যাহত আছে । এতো গুলো দিন ধীরাজ রোজই কলকাতা থেকে এসে দেখে গেছেন । মেয়েটির জ্ঞান ফিরতে ধীরাজ জানতে পারে মেয়েটির নাম সুজাতা দেবনাথ । কূলতলিতে শ্বশুরবাড়ি থাকে । স্বামী বি এস এফ কাজ করতেন , বিয়ের আড়াই মাসের মধ্যে সুজাতা বিধবা হয়ে যায় । পেনশনের টাকাটা যাতে হাত ছাড়া না হয় চার বছর হয়ে গেলো শ্বশুর বাড়িতেই ছিল সুজাতা । কিন্তু এই ঘটনার পর পেনশনের টাকার কথা তোয়াক্কা না করেই শ্বশুরবাড়ির লোক আর ফিরিয়ে নেবে না স্পষ্ট জানিয়ে গেছে । বাপের বাড়িতে দাদা বৌদির সংসারে ফেরা অসম্ভব । সেদিন তাই ধীরাজ দেখা করতে আসতেই সুজাতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল --- ' কেন আমাকে আপনি বাঁচাতে গেলেন বলুনতো ? এখন আমি কোথায় যাবো ? শুধু পেনশনের টাকা নয় । আমি টিউশান করে ব্লাউজ সেলাই করে যা পেতাম সবই শাশুড়িমার  হাতে তুলে দিতাম । আমি এখন নিঃসম্বল । '

    সেদিন ধীরাজ পারেননি মুখ ফিরিয়ে নিতে । হাসপাতাল থেকে সুজাতাকে বাড়ি নিয়ে আসেন । সমাজে সুজাতা যাতে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে সেইজন্য ধীরাজ সর্ব সম্মুখে সুজাতাকে বিয়েও করেন । সুজাতাকে সব রকম সুবিধায় রেখেছেন আজ অবধি । কিন্তু স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অধিকার সেটা কোন ভাবেই সুজাতাকে দেননি । ধর্ষিতা সুজাতা অন্তঃস্বত্তা হয়েছিল , কিন্তু সন্তান ভূমিষ্ঠর পরই মারা যায় । সেই সময় সুজাতা হাতজোড় করে ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে , কারন এই মাতৃত্বকে স্বীকৃতি  দেওয়াটা তার কাছে অসম্ভব ছিল ।
#####

    তারপর ও কেটে গিয়েছিল দুবছর । একবার  গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে  ধীরাজ তাঁর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর বন্ধুদের সাথে শিমলা বেড়াতে যান । সুজাতাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন । সব প্রফেসর নিজেদের বৌ বাচ্চা নিয়ে হই হই করে মেতে ছিল শিমলায় । শুধুমাত্র ধীরাজ আর সুজাতাকে ঘিরে ধরে ছিল অসীম শূন্যতা । সুজাতা আর থাকতে না পেরে বলেই বসে --- ' ধীরাজ বেঁচে থাকার জন্য দয়া নেওয়াটা কি খুব প্রয়োজন বলোতো ? ' 

ধীরাজ প্রতিউত্তরে জানিয়ে ছিলেন --- ' কেন এ ভাবে বলছো ? 

--- ' না বলে পারলাম না , দুবছর বিয়ে হয়ে গেলো এখনও আমরা দুজনের থেকে কত দূরে । আমি আইনত তোমার স্ত্রী হলেও স্ত্রীর মৌলিক অধিকার গুলো তো কোন দিনই পাবো না । মা হতে পারবো না কোন দিনই । শুধুমাত্র খাওয়া পরার জন্য যেন আমার সংসারে থাকা । ' 

    হতাশার সূর সেদিন বড়ই বিদ্ধ করেছিল ধীরাজের অন্তর । সেদিন আর শিমলার হোটেল ছেড়ে বেরোতে চাননি ধীরাজ । অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরাজ সেদিন আবেগ ঘন হয়ে ছিলেন সুজাতায় । সেটাই ছিল প্রথম ছোঁয়া ধীরাজের । তারপর আর সেই রকম পরিস্থিতির সম্মূখীন হয়নি সুজাতা । শিমলা থেকে ফিরে এসে সুজাতা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে । তারপর রৌণকের জন্মের পর সুজাতা এই পৃথিবীতে  নিজের অস্তিত্ব   খুঁজে পায় । ধীরাজ সুজাতার সাহচর্যে রৌণক বড় হয়ে ওঠে । সুজাতাও ভুলতে শুরু করে দিয়েছিলে ধীরাজের অপারগতা । 

#####

    আজ তাই ধীরাজের স্পর্শকাতর মনের দোলা চালে ধীরাজ যখন সুজাতাকে জড়িয়ে ধরেন সুজাতা আবার যেন দূর্বল হয়ে ওঠে । ধীরাজের স্পর্শ পাবার আনন্দে মনটা অদ্ভুত ভাবে বিষন্ন হয়ে ওঠে এই ভেবে ধীরাজ তাহলে নিজের অতীতের প্রেমকে কোন ভাবেই ভুলতে পারেনি । এখানেই যেন সুজাতা নিজের ব্যার্থতা ও অপূর্ণতাকে টের পায় । কিন্তু ধীরাজ মানুষটাকে সুজাতা এতো বছর বড়ই ভালবেসে ফেলেছে । ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে নিজের ভিতরটাও কষ্টে ভরে ওঠে । সুজাতা মনে মনে ঠিক করে নেয় ধীরাজের সব প্রশ্নের উত্তর আজ অর্পিতার কাছ থেকে আদায় করেই ছাড়বে । ধীরাজকে যেমন করেই হোক মানষিক শান্তি এনে দেবেই । 

#### 

    সেই রাতে ধীরাজ আর বিয়ের অনুষ্ঠানে নিচে নামেননি । নিজেদের থাকার রুমে নিজেকে আলাদা করে রাখতে চাইলেন । সুজাতা নেমে গেছে নিচে । যাবার আগে ধীরাজের খাবারটা উপরে নিয়ে আসবে বলেছিল , ধীরাজ রাজী হননি । ধীরাজ পাঞ্জাবিটা চেয়ারে ছেড়ে রাখেন । বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে বিছানায় এসে শুয়ে পড়েন । এই মুহুর্তে তাঁর খুব মনে পড়ছে অর্পিতার সাথে সেই শেষ দেখা হওয়া দিনটার কথা ।....... সেদিন ছিল খুব ঝড় জলের সন্ধ্যা ধীরাজ আর অর্পিতা হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ভিজতে ভিজতে বাসে ওঠে । ধীরাজের বাবা সুমন্ত ব্যানার্জী সিরোসিস লিভার - এ আক্রান্ত । তিনমাস যাবৎ পিজিতে ভর্তি আছেন । ডাক্তাররা বলেই দিয়েছেন লাস্ট স্টেজ । সেদিন তাই অর্পিতা ধীরাজের সাথে গিয়েছিল ওনাকে দেখতে । ফেরার পথে অন্ধকার নেমে এসেছিলো তার উপর ক্রমাগত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া । বেকবাগান বাসস্টপে নেমে সেখানে থেকে অনেকটা ভিতরে অর্পিতার বাড়ি । ধীরাজের মন চাইলো না অর্পিতা একা এতটা অন্ধকার গলিপথে পা বাড়াক । যদিও অর্পিতা বলেছি সে নিজেই চলে যেতে পারবে । কিন্তু ধীরাজ শোনেননি । বাড়ির কাছকাছি আসতেই ধীরাজ ফিরে যেতে চাইলে অর্পিতা বাঁধা দেয় ---- ' চলো বাড়ি , বাড়ির কাছে এসে ফিরে যাবে নাকি ? তোমার ভিজে পাঞ্জাবীটা অন্তত বদলে নাও । যাদবপুর যেতে এখনও অনেক্ষন । এতক্ষন ভিজে পাঞ্জাবীটা পরে থাকলে শরীর খারাপ করতে পারে । চলো ভিতরে এসো । ' ..... বাড়িতে সেদিন কেউ ছিল না । সেদিন সকালেই অর্পিতার বাবা কিশোরলাল চক্রবর্তী ও মা সবিতাদেবী বড় মেয়ে সমর্পিতাকে নিয়ে ধানবাদে অর্পিতার মাসির বাড়ি যান । অর্পিতার মাসির ঠিক করা পাত্রপক্ষকে দেখোনোর জন্য । পাত্রপক্ষ কোলকাতায় এসে পাত্রী দেখতে নারাজ । তাই ওনারাই ধানবাদ চলে গেছেন । অর্পিতার কেমিস্ট্রি অনার্স ফাইনাল ইয়ার আর হাতে মাত্র দেড়মাস বাকী তাই সে বাবা মা দিদির সাথে যায়নি । তিন বছর আগে পর্যন্ত ধীরাজ অর্পিতাকে ওর বাড়িতেই কেমিস্ট্রি পড়িয়ে যেতেন । সেই কারণে অর্পিতার বাড়ির পরিবেশ ও অর্পিতার পরিবার তাঁর অপরিচিত নয় । তাছাড়া বছর তিনেক আগেই গৃহশিক্ষক আর ছাত্রীর মধ্যে মন দেয়ানেয়া হয়ে গিয়েছিল । ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হবার পর অর্পিতা সপ্তাহের দুদিন যাদবপরে কলেজে করে অর্পিতার বান্ধবী অরুনিমার বাড়িতে কেমিস্ট্রির ক্লাস সেরে বাড়ি ফিরতো । অরুনিমার বাড়িতে অর্পিতা ওর ক্লাসের ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসাথে ধীরাজ কাছে পড়ে । আজ অর্পিতা টিউশনির পর ধীরাজের সাথে বেড়িয়ে পড়েছিল পিজির উদ্দ্যেশে । 

    অর্পিতা দরজার লক খুলে ধীরাজকে নিয়ে ভিতরে আসে । ঘরে ঢুকে ধীরাজ ভিজে গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে ড্রয়িংরুমে । অর্পিতা ভিতরের ঘর থেকে শুকনো তোয়ালে নিয়ে এসে ধীরাজের হাতে দেয় । --- ' তাড়াতাড়ি মাথাটা মোছো , এই নাও ধীরাজদা বাবার এই পায়জামা পাঞ্জাবীটা পরে ফ্যালো । বাবা আর তুমি একই হাইটের কোন অসুবিধা হবে না । '

--- ' প্লীজ আমি জিন্স চেঞ্জ করতে পারবো না , পাঞ্জাবী পরছি কিন্তু আমি তোমার বাবার সমিতভঞ্জ মার্কা ঢোলকা পায়জামা পরতে পারবো না । '

    অর্পিতা তখনও ভিজে চুড়িদার ছাড়েনি , তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছিলো , ধীরাজের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে ---- ' কি বললে ? আমার বাবা সমিতভঞ্জ মার্কা ঢোলকা পায়জামা পরে ...? '

    ধীরাজ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিলেন , অর্পিতাকে অমন করে হাসতে দেখে অর্পিতার কাছে সরে আসেন । --- ' অর্পিতা তোমাকে হাসলে খুব সুন্দর দেখায় , শরতের ঝরা শিউলী ফুলের মতো দেখায় । ' 

--- ' তাও ভালো ! ভ্যাগিস আমাকে সন্ধ্যা রায়ের মতো দেখায় বলোনি ।তাহলে আমি নিজেকে নায়িকা ভেবে ফুলে উঠতাম । বলেই অর্পিতা আবার হেসে ওঠে । ধীরাজ সহসা অর্পিতার সিক্ত গাল দুহাতে টেনে নিয়ে অর্পিতার ঠোঁটে উষ্ণ চুম্বন দেন । অর্পিতার মনে ভীষণ ভালোলাগার তরঙ্গ বয়ে যায় । বুকের ভীতর শিরশির করে ওঠে । ধীরাজ চুম্বন দিয়েই সরে আসতে যায় । অর্পিতা দুহাত বাড়িয়ে ধীরাজকে আরো কাছে টেনে নিয়ে ধীরাজের বুকে মাথা রাখে । তাৎক্ষণিক পরিবেশের একাকিত্বে প্রেমিক যুগল যৌবনের করাঘাতে সংযম হারিয়ে ফেলে নিজেকে একে অপরের কাছে উজাড় করে দেয় । বেহিসেবী ভূলের হিসেব নিকেশ করার অবকাশ পায় না । যখন স্তম্ভিত ফেরে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে । কৃতকর্মে অনুতপ্ত ধীরাজ অনেকবার অর্পিতার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন । অর্পিতা জানিয়েছিল --- ' আমাদের ভালোবাসাকে ভূল প্রমানিত করার জন্য এত ব্যাকুল হলে কেন ধীরাজদা ? তুমি আমাকে ভালোবাসো , আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশী ভালবাসি এবং বিশ্বাস করি । ভালবাসার মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছি এতে ভূলের কি আছে ? '

    সেদিনের পর দিন চারেক যেতেই ধীরাজ অর্পিতাকে বন্ধু মারফত দুঃসংবাদটা জানান । এরপর ধীরাজ বাবার শ্রাদ্ধের কাজ কর্মের ব্যস্ত হয়ে ওঠেন । অর্পিতা ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করে । শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরিসমাপ্তির পর পি এইচ ডি করতে কানপুর আই আই টি চলে যান । যাবার আগে অর্পিতার সাথে দেখা করে যেতে পারেননি কারণ অর্পিতার তখন পরীক্ষা শুরু হয়ে যায় ।ধীরাজ  অরুনিমার হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন । কানপুর চলে যাবার পর এক দুবার চিঠি আদান প্রদান হয়েছিল । অর্পিতা দুবারই চিঠিতে অনুরোধে করেছিলো ধীরাজ যেন একবার কোলকাতায় এসে দেখা করেন । ধীরাজ মাস ছয়েকের মধ্যে কোলকাতা আসা সম্ভব নয় সেটা বুঝিয়ে অর্পিতাকে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন । তারপর অর্পিতার চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় । মাস ছয়েক পর ধীরাজ কোলকাতায় এসে জানতে পারেন অর্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে । চমকের পর চমক । অর্পিতার বাড়ি গিয়ে খবর নিতে গিয়ে দ্যাখেন অর্পিতার বাবা মা বাড়ি বিক্রি করে কোথায় চলে গেছেন , আশে পাশে কেউই তাদের খবর দিতে পারেনি । ধীরাজ বহু খোঁজার চেষ্টা করে ছিলেন । ব্যার্থতাকে অগ্রাহ্য করে এই সাতাশটা বছর তিনি প্রতিনিয়ত অপেক্ষাই করে গেছেন এবং মনে আশার প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছিল এই বিশ্বাসে একদিন না একদিন অর্পিতার সাথে দেখা ঠিক হবেই । সাতাশ বছর আগে সেই ঝড়জলের রাতের স্মৃতিই ছিল ধীরাজের বেঁচে থাকার রসদ । তাই আজ ধীরাজ স্বপ্নেও ভাবতেই পারেননি সেই অপেক্ষার অবশান হবে ব্যাঙ্গালোরে মামাতুতো বোন সুমির  মেয়ের বিয়েতে এসে । 

####

    সুজাতা নিচে নেমে এসে আবার বিবাহবাসরে যোগদান করে । কিন্তু মন পড়ে থাকে ধীরাজের কাছে । আসলে ধীরাজের মতো মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে বুকের ভিতরটা মুষড়ে ওঠে । সুজাতা মনে ঠিক করে নেয় যেমন করেই হোক ধীরাজের সাথে অর্পিতার একবার একান্তে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবে । সুজাতা সেই উদ্দ্যেশ্য চরিতার্থে সুমিকে গিয়ে বলে --- ' কি গো দিদিভাই তোমার ফরেনার বেআই এর সাথে আলাপ করিয়ে দিলে না ? অর্পিতার সাথে আলাপ পর্বে সুজাতা ব্যস্ত থাকলেও কখন সুমির আড়ালে অর্পিতাকে পাবে সেই চিন্তায় সুজাতা বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়ে । বয়সের বিচক্ষণতায় মানুষ অন্য জনের মুখমন্ডলের ভাষা পরতে পারে , আর সেটাই করে অর্পিতা । অর্পিতা জিজ্ঞাসা করে বসে --- ' আপনি মনে হয় শুধুমাত্র আলাপ করার জন্য আমার কাছে আসেননি , তাই না ? ' 

---' ঠিকই ধরেছেন , ধীরাজ ব্যানার্জী আপনার সাথে একবার দেখা করতে চাইছেন । আপনি প্লীজ একবার ওনার সাথে দেখা করে নিন । হয়তো আপনার একবার দেখা করে নিলে আমি আমার প্রাপ্য সম্মানের অধিকার পেতে পারি । তাই আপনার কাছে আসা । '

--' আপনি ? 

--- 'আমি ওনার আইনত স্ত্রী , কিন্তু এই মর্যাদা আমার কাছে শুধুই প্রহসন । আমি ধীরাজের মননে ছায়া সঙ্গী হতে চাই । যা আজ পর্যন্ত আমি ধীরাজের পাশে থেকেও পাইনি শুধুমাত্র আপনার কারণে ।... আপনি আসবেন ? '

---' কোথায় দেখা করবো বলুন ? 

---' আপনি পাত্রের মা , বিয়ে বাড়িতে আপনার অনুপস্থিতি লোকজনের কৌতুহলের কারণ হতে পারে । তাই এদিকটা একটু ম্যানেজ করে নিয়ে যদি কাল বিকালে ক্যাফেটেরিয়ায় দেখা করেন তাহলে সুবিধা হয় । 

####

    পাঁচটায় টাইম ঠিক করা ছিল । ধীরাজ এক মিনিট এদিকে ওদিক না করেই ক্যাফেটেরিয়ার দরজা খুলে ভিতরে ঢোকেন । ভিতরটা নিবু আলোকে অন্ধকারের চাদর মোড়ানো । হটাৎ ঢুকলে চোখ অন্ধকার হাতড়াতে থাকে  । ধীরাজ অনভ্যাস বশতঃ এদিকে ওদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করা শুরু করে দেন । একজন ওয়েটার ধীরাজকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে আসে --- ' স্যার লেফট সাইডের কর্ণার টেবিলে একজন ম্যাম আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন । ওই যে , আপনি প্লীজ আসুন । ' 

    ধীরাজ দ্রুত হেঁটে কর্ণারে এগিয়ে গেলেন । অর্পিতা আগে থাকতেই উপস্থিত থাকবে ভাবতেই পারেননি । চেয়ার টেনে ধীরাজ অর্পিতার মুখোমুখি বসেন । মিনিট এক দুই দুজনেই নিস্তব্ধ । তারপর ধীরাজ কোন রকম ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন ছুঁড়লেন --- ' আমার কি অক্ষমতা তোমার চোখে পড়েছিল অর্পিতা আমাকে তুমি ভুলে গেলে ? '

    ভাবলেশহীন নির্বিকার অর্পিতা ধীরাজের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে । ধীরাজ আবার বলে ওঠেন --- ' তোমার চোখের তারায় আমি হারাতে আসিনি অর্পিতা । আমার প্রশ্নের উত্তর দাও , আমি একটু স্বস্তি পেতে চাই । অনেক গুলো বছর তোমাকে খুঁজে কাটিয়েছি । '

--' আমিও তোমায় ভুলতে পারিনি ধীরাজদা । আজ যা বলবো বিশ্বাস করবে তুমি ? '

---' করবো '

---' সেদিন আমার ইউনিভার্সিটিতে আমার লাস্ট পরীক্ষা ছিল । পরীক্ষা দিয়ে আমি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি । তোমার ফটোগ্রাফার বন্ধু নির্মলেন্দু বাস স্ট্যান্ডে আগে থাকতেই ছিল । আমাকে দেখে নির্মলেন্দু কথা বলতে এগিয়ে আসে এবং অনেক প্রশ্ন করেছিলেন --- আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ? আমার মা বাবা কেমন আছেন ? দিদি বিয়ে ঠিক হয়েছে কিনা ? ..... ইত্যাদি । এই রকম অনেক প্রশ্ন করে তার উত্তর জেনে সর্বশেষে আমার হাতে একটা বড় খাম ধরিয়ে দিয়ে বাসে উঠে চলে যায় । আমি অবাক হয়ে গেছিলাম । নির্মলেন্দু যাবার সময় আমাকে আরো বলে গেছিলো আমি যেন বুদ্ধি নিয়ে কাজ করি । আমার বাস এসে গেলো আমিও বাসে উঠে বাড়ি চলে এলাম । বাড়িতে গিয়ে আমার ঘরের দরজা আটকে খাম খুলি । তুমি আন্দাজ করতে পারো ওই খামে কি ছিল ? কথা বলতে বলতে থেমে যায় অর্পিতা , যেন গলা বুজে এসেছে , বলতে গিয়েও বলতে না পারার আড়ষ্টতা চোখের কোনদুটোকে ভিজিয়ে তোলে । অর্পিতা পার্স থেকে রুমাল বেরকরে চোখে মুখের যন্ত্রণা গুলিকে স্বভাবিক করে নিয়ে আবার বলা শুরু করে ---' খামে ছিল সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় তোমার আমার অন্তরঙ্গ কিছু ছবি আর একটা চিঠি '

--- ' সেকি ! 

--- ' হ্যাঁ ধীরাজদা , চিঠিতে লেখা ছিল --- ' অর্পিতা আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই ভালবাসি । তাই আগ বাড়িয়ে সব সময় তোমাকে ও তোমার বাবামা দিদিকে হেল্প করতে চাইতাম । তোমাকে যে আমি ভালবাসি সেই কথাটা অনেকদিন বলবো বলবো ভেবেছি । ভেবেছিলাম তুমি কলেজে উঠলে বলবো তোমার বোঝার বয়স হয়ে যাবে তখন । কিন্ত আমার ভাবনা ভূল , তুমি অনেক বেশী বোঝদার মেয়ে । তোমার পড়াশোনার সুবিধার জন্য আমার বন্ধু ধীরাজকে তোমার গৃহশিক্ষক হিসাবে আমিই ঠিক করে দিই । একবারও বুঝিনি আমার বন্ধুই আমার ভালোবাসাকে কেড়ে নেবে । এতদিন তুমি ধীরাজের সাথে যা করে এসেছো আমি সব মাপ করে দেব । তুমি আমাকে বিয়ে কর । আমি তোমাকে সুখে রাখবো । আমি ধীরাজের আগে তোমাকে ভালবেসেছি । তুমি আমার হবে । আমার প্রস্তাবে সম্মতি না দিলে এই ছবি গুলো আমি তোমার দিদির হবু শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেবো । ওই কালো মেয়ের একবার বিয়ে ভেঙ্গে গেলে আর বিয়ে হবে না । সেটা ভেবে দেখো । আমি তোমাকে অন্য কারোর হতে দেবো না । খুব তাড়াতাড়ি উত্তর দিও আমাকে । ধীরাজকে এই ব্যাপারে কিছু জানিও না । এতে তোমার দিদি কষ্ট পাবে । ' 

--- ' কি সাংঘাতিক ! তুমি একবারও যদি আমাকে জানাতে আমি নির্মলেন্দুকে উচিৎ জবাব দিতে পারতাম । অথচ আমিই কিনা ওর একটা চিঠিতে আমার কাছে যতটুকু ছিল প্রায় সবটাই ওর ঠিকানায় মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম । আমাকে নির্মলেন্দু বলেছিল ওর প্রেমিকাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল করবে । টাকার খুব দরকার । একবারও ভাবিনি নির্মলেন্দু আমার পিঠ পিছে ছুরি হানবে । অর্পিতা কেন আমাকে সব কথা বলোনি ? 

--- ' তুমি কি ভেবেছিলে সব কিছু করা  এতোই সহজ ? খালি তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে , গায়ের জোর আছে । আমার কি কিছুই নেই ? আমি দুবার তোমায় চিঠি পাঠাই তুমি আসতে পারবে না বলে দিয়েছিলে । আমি নির্মলেন্দুর কাছে সময় চেয়েনিই । তুমি জানতে তো কত কাঠ খড় পুড়িয়ে দিদির ওই সমন্ধ জোগাড় করা হয়েছিল । কালো মেয়ের পনের টাকা জোগাড় করতে বাবা বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখেছিলেন । অপেক্ষা করছিলাম দিদির একবার বিয়ে হয়ে যাক । তারপর যেমন করেই হোক একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবো মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিলাম । কিন্তু বাধ সাধলো আমার অদৃষ্ট । দিদির বিয়ের পর পরই জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট । আমার পায়ের তলা থেকে সেদিন মাটি সরে গেছিলো । আমি কি করবো দিশেহারা হয়ে যাই ।এর আগে  দুবার চিঠি পাঠিয়েছিলাম তুমি আসতে চাওনি তাই আমি তোমার মায়ের শরণাপন্ন হয়েছিলাম । যদি উনি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন । সব জানানোর পর উনি আমাকে চরিত্রহীনা বদনাম দিয়ে তোমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন । আমার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় । বাধ্য হয়েই আমি নির্মলেন্দুর কাছে ফিরে যাই । আমি প্রেগন্যান্ট জেনেও নির্মলেন্দু আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যায় । আসলে নির্মলেন্দু আমাকে পাগলের মতো ভালবাসে । সাতাশটা বছর আমরা দেশের বাইরে । খুব স্ট্রাগল করেছে ফটোগ্রাফি বিসনেস দাঁড় করাতে । কিন্তু আমাকে কখনই কষ্টে রাখেনি । আকাশ তোমার সন্তান জেনেও আকাশকে নিজের সন্তানই মনে করে । হ্যাঁ , ধীরাজদা আকাশ তোমারই ছেলে । আকাশের জন্মের পর থেকে আজ অবধি কোন ব্যাপারে কোন অপূর্ণতা রাখেনি নির্মলেন্দু  । নির্মলেন্দুর অদ্ভুত সাইকোলজি ও শুধু আমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছিল । ওর চাওয়াটা অন্যায় ছিল । আমাকে খুবই ঘৃণ্য ভাবে ব্ল্যাকমেইল করেছিল ঠিকই । কিন্তু আমার সব রাস্তা যেখানে বন্ধ হয়েছিল সেখানে আমি নির্মলেন্দুর দুয়ার খোলা পেয়ে ছিলাম । ওর সাথে এতবছর কাটিয়ে আমি কখন যে ওকে ভালবেসে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি । আমি খুব ভাল আছি ধীরাজদা । নির্মলেন্দু আর আমার দুই ছেলে আকাশ অর্পণ এই তিনে নিয়ে আমার সবুজ সজীব পৃথিবী । এখন আবার রীতিকা এসে মিশবে আমাদের সবুজালী পৃথিবীতে । ধীরাজদা জীবনে অনেক কিছুই মনের মতো হয় না । কিন্তু যা হয় তাকে যদি আমরা অসহিষ্ণুতা বর্জন করে মেনে নিই । দেখবে অপরাহ্নে আলোর দিশা খুঁজে পেয়েছো । আর অপারগতা পাখনা মেলেছে সেই আলোর বিস্তীর্ণ পথে । আমাকে তুমি তোমার ভাবনাতে রেখো কিন্তু অনুভবে রেখোনা । ওইখানে থাকার অধিকার একমাএ সুজাতারই আছে । সুজাতার হৃদয় অনেক বড় , না হলে তুমি আর আমি এইখানে বসতে পারতাম না । 

---' এবার বুঝতে পেরেছি মা মৃত্যুর আগে আমাকে কেন বলেছিলেন --- ' আমাকে ক্ষমা করে দিস নীলু । আমার জন্যই তুই এত কষ্ট পেলি । ' আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি মা কেন ক্ষমা চেয়েছিলেন ? স্পষ্ট হয়ে গেল সব । কিন্তু তোমার প্রেগনেন্সির কথা একবারও তুমি চিঠিতে জানাওনি কেন ? 

--- ' জানিনা , তখন আমার মন অন্য দোলা চালে ছিল । ভেবে ছিলাম আমার চিঠি পেলেই তুমি ছুটে আসবে তখন সামনাসামনি বলবো । চিঠিতে সব কথা লেখা যায় না । কে জানে চিঠি অন্য কেউ পড়তে পারে । কিন্তু তা স্বত্বেও আমি তোমাকে আমার তৃতীয় চিঠিতে প্রেগনেন্সির খবর পাঠাই তার কোন উত্তর পাইনি । 

--- ' আমি তোমার কোন তৃতীয় চিঠি পাইনি । সত্যি বলছি অর্পিতা । আমাকে বিশ্বাস করো প্লীজ । 

--- ' বিশ্বাস তুমি যখন আমাকে করতে পারলে তখন আমিও তোমাকে আজ বিশ্বাস করলাম । 
জানো ধীরাজদা আমাকে নির্মলেন্দু বহুবার তোমার থেকে নেওয়া টাকাটা ফিরত দেবার জন্য আমায় জানিয়ে ছিল । আমি ততবার ওকে বাঁধা দিয়েছি । আমি চাইনি তুমি আমাদের ঠিকানা খুঁজে পাও । আসলে তোমাকে না পাওয়ার ক্ষোভে আমি তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম । কিন্তু আমাদের ভাবনার কাছে পৃথিবীটা যেন অনেক ছোট পড়ে গেছে । সেই তোমার সামনাসামনি আসতেই হলো আমাকে । ভ্যাগিস সুমি তোমার পিসতুতো বোন , নিজের বোন হলে আমরা হীনন্মন্যতায় অপরাধ বোধে ভুগতাম । চলো এবার ওঠা যাক । '

    ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে পড়ে ধীরাজ ও অর্পিতা । এখন তারা অনেক সাবলীল । অপরাহ্নের আলোয় মনের ভিতর ম্লান হয়ে এসেছে অতীতের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ । প্রেম যেন একটা অসমাপ্ত মননের পরিধি । যে জন প্রেমকে নিজের করে পায় সেকি আদৌ প্রেমের যোগ্য সম্মান দিতে পারে ? হয়তো  তার অন্তরেও প্রেমকে কেন্দ্র করে হতাশা বাসা বাঁধতে পারে ? তার মনে সেই সম্পর্ক  তখন বোঝা হতে পারে । সেও হয়তো প্রেম হীন গণ্ডির থেকে বেরিয়ে আসতে চায় । আবার যারা ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরেও প্রেম কে নিজের করে পায় না । তাদের হতাশা তাদের ভাবনাকে  তাদের অনুভবকে সম্পূর্ণ রূপে গ্রাস করে । যেটা ধীরাজ ও অর্পিতার ক্ষেত্রে ঘটেছিল । আজ সাতাশ বছর বাদে ধীরাজ অর্পিতা নিজেদের মনের ভিতরে জমে থাকা ক্ষোভকে অপ্রেম গণ্ডির থেকে ছুড়ে ফেলে যত্নশীল সাজানো প্রেমের আঙ্গিনায় প্রবেশ করে । তারা তাদের স্বীয় গণ্ডির মধ্যে নতুন করে প্রেম খুঁজে নেবে আবার । এটাই যে গতিময় জীবনের সারাংশ । 



সমাপ্ত ॥
 
 
Subhra Roy